টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বিস্মিত, সে জন্যই আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়েছেন শিরোনামে: টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা! কিন্তু বিস্ময়ের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নন, সে কারণেই বলছেন: ...বহুদলীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে [প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, পৃষ্ঠা: ১০]। এই ‘জানা গেছে’র সূত্র ধরেই তাঁর রচনা। উদ্বিগ্ন হয়েই খোঁজ নিয়েছি, সরকারের কোনো নির্দেশনার হদিস যেমন পাইনি, তেমনি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদেরও মন্তব্য পাইনি। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি টেলিভিশনে টক শোর একজন উপস্থাপক বদল থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সে কারণে খোঁজ নিয়ে জানলাম: ওই উপস্থাপক সেই চ্যানেলটির মালিকের উপদেষ্টাও বটে। অর্থাৎ চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও তিনি জড়িত। চ্যানেলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে: উপদেষ্টা ও মালিকের সম্মতিতেই টক শোর উপস্থাপক বদলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলছেন, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না যে মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু না মালিক, না উপদেষ্টা, না চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এই ‘সরকারি চাপের’ প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবাদটি করলে পেশাদার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীরা নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়াবেন। এই প্রেক্ষাপটেই পরের দুটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেষ্টা করি। প্রথম প্রশ্ন, সরকার কেন টক শো নিয়ন্ত্রণ করবে? টিভি টক শোতে সরকারের বিরুদ্ধে আর কি কথা বলার বাকি আছে?
শেখ হাসিনার পরিণতি তাঁর বাবার মতো হবে’, ‘এই ফ্যাসিস্ট সরকার পালাবার পথ খুঁজে পাবে না’, ‘আওয়ামী লীগকে দেখলে সবাই বলবে চোর’, ‘শেখ হাসিনা এখন গণপ্রজাতন্ত্রী ঢাকার প্রধানমন্ত্রী’, ‘এই সরকারের আমলেই সাতক্ষীরা স্বাধীন হয়ে গেছে,’ ‘শেখ হাসিনার তো কিছু হবে না, কিন্তু তাঁর দলের লোকজনের পিঠের চামড়া থাকবে না, ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনিরা সব অপকর্ম করছে’, ‘বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সরকারি দলের গুন্ডারা বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারছে, এই জালিম সরকারের পতন আসন্ন...’ এসবই হালফিল টক শোর ভাষা। এসব যদি সরকার সহ্যই করে থাকে, তাহলে আর টক শো নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন: টক শোগুলোতে আর কী বলার স্বাধীনতা প্রয়োজন? এই প্রতিক্রিয়া যখন লিখছি, তখন বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায় হলো: আটজনের মৃত্যুদণ্ড আর ১৩ জনের যাবজ্জীবন। কিছুকাল আগে এক টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আলোচক বললেন: ‘লিখে রাখতে পারেন, এই সরকারের আমলে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হবে না।’ লিখে রেখেছিলাম। সেই আলোচক আর সেই টেলিভিশন চ্যানেল এখন কী বলে, তা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী মন্তব্য করব। নিবন্ধে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করেছেন: ‘কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশেষ বিশেষ আলোচককে আমন্ত্রণ না করার জন্য চাপ আছে। এই চাপ প্রয়োগের কারণ বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে লাইসেন্স পেয়েছে।’
এ বিষয়ে বিতর্কে না গিয়ে একটি আদর্শ পরিবেশের কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে প্রশ্ন করা যায়, কোন টেলিভিশন কাকে কখন টক শোতে ডাকবে বা ডাকবে না, সেটি কে ঠিক করে দেবে? কোন পত্রিকা কার লেখা ছাপাবে অথবা ছাপাবে না, তা নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায়? এই প্রশ্ন ওঠে না এই কারণে যে প্রতিটি সংবাদপত্র পরিচালিত হয় তার নির্ধারিত সম্পাদকীয় নীতিমালার অধীনে। যদি সংবাদপত্রের বেলায় প্রশ্ন না তোলা যায়, তাহলে টেলিভিশনের বেলায় কেন যাবে? টক শোতে কবে, কাকে অতিথি করা হবে, তা একান্তই টেলিভিশনের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতির বিষয়। যদি টক শোর অতিথি নির্বাচনে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তো নাটক, নৃত্য বা গানের অনুষ্ঠান নির্মাণে শিল্পী নির্বাচনের বেলায়ও একই প্রশ্ন তোলা যাবে। চাপ, অনুরোধ, আগ্রহ বা পরামর্শ হয়তো থাকবে কিন্তু অতিথি নির্বাচনের চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে লাইসেন্স পাওয়াদের ওপর সরকারের চাপ বেশি। কিন্তু অ-আওয়ামী আমলে লাইসেন্স পাওয়া টেলিভিশনগুলোও তো তাদের টক শোতে তাদের পছন্দসই তালিকার বাইরে কাউকে ডাকে না! সেখানে কারা চাপ দেয়—এ প্রশ্ন কি করা যায়? না, করা যায় না। কারণ, সেটিও তাদের স্বাধীন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত। তবে চাপ সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক-এগারোর আগে বিএনপির তখনকার মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলের প্রতিনিধিদলসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যান একটি তালিকা নিয়ে। বলেন, এই তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের টক শোতে নিলে তাঁর দলের স্বার্থ রক্ষা হয়। এর কিছুদিন পর এক-এগারো ঘটে যায়। নতুন পরিস্থিতিতে মহাপরাক্রমশালী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা।
এ পর্যায়ে তাঁরা এলেন আরেক তালিকা নিয়ে। নির্দেশ: টেলিভিশন টক শোতে যাতে তাঁদের তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সুযোগ দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তার সঙ্গে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার তালিকার ভিন্নতা খুব বেশি ছিল না। এ বিষয়টি সবাইকে বুঝতে বলি: টক শোতে আমন্ত্রণ পাওয়া কিন্তু কোনো অতিথির সরাসরি ‘অধিকার (রাইট)’ নয়, এটি হচ্ছে তাঁদের ‘বিশেষ সম্মান (প্রিভিলেজ)’। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পরিকল্পনাকারীরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কখন সেই বিশেষ সম্মান জানাবেন। কয়েকটি টক শোতে কথা বললেই কারও ইচ্ছামাফিক যেমন আমন্ত্রিত হওয়ার অধিকার জন্মায় না, তেমনি কোনো চ্যানেল ডাকলেই সেখানে যেতে তাঁরা বাধ্য নন। এ তো গেল অতিথি প্রসঙ্গ; এবার উপস্থাপক নির্বাচন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় কিছু প্রচলিত ও স্বীকৃত বিধান আছে। এই রীতি অনুযায়ী টেলিভিশনে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরই উপস্থাপক নির্বাচন করা হয়। তবে সম্পাদকীয় নীতি সরাসরি দৃশ্যমান হয় সে ধরনের স্পর্শকাতর অনুষ্ঠান উপস্থাপনা বা পরিচালনার জন্য সাধারণভাবে সেই টেলিভিশনের পূর্ণকালীন কর্মীকে দায়িত্ব দেওয়াটাই রীতি। কারণ, নিজের প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকীয় নীতিটি সেই কর্মীর মাথায় থাকবে,
এই নীতির লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে। উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত চ্যানেলগুলোর সম্পাদকীয় নীতিসংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর অনুষ্ঠানগুলোর উপস্থাপকদের দেখুন, তাঁরা কারা। তবে যোগ্য নিজস্ব কর্মী পাওয়া না গেলে অতিথি উপস্থাপক নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচিত উপস্থাপককে এ শর্ত মেনে নিজস্ব মত ও পথ সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক থেকেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজটি কঠিন বটে। একটি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উপস্থাপক দিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারে, তেমনি যেকোনো সময় তাঁকে বদলও করতে পারে। এতে কেউ অসম্মানিত হলেন এমনটি মনে করার কারণ নেই। একজন উপস্থাপক বদল করার সঙ্গে সব সময়ই গণমাধ্যমে চাপ বা স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গটি যুক্ত না-ও থাকতে পারে। অনেক টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিকেরা প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁদের নিউজ পলিসির সঙ্গে টক শোর পলিসি মেলে না। কারণ, নিউজ তো চালান টেলিভিশনের পূর্ণকালীন কর্মীরা এবং তাঁরা জানেন তাঁদের স্টেশনের বা চ্যানেলের সম্পাদকীয় নীতি কী? কিন্তু টক শো চালান আমন্ত্রিত বিশেষজনেরা, চ্যানেলের সম্পাদকীয় নীতির প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সরাসরি রাজনীতি করেন এমন বাগ্মী ও মেধাবী ব্যক্তিরাও টক শোর উপস্থাপক হয়ে আসেন, কিন্তু উপস্থাপকের নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখা তাঁদের জন্য খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে।
নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক বিরাগ বা অনুরাগধর্মী মন্তব্য থেকে অনেক সময়ই নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পারেন না অনেকেই। ফলে তিনি নিজে হয়তো লাভবান হন কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয় চ্যানেলের নিরপেক্ষতা; বিভ্রান্ত হন দর্শক-শ্রোতারা। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি, শুধু টক শো বা টিভি অনুষ্ঠান নয়; কোনো গণমাধ্যমের উপস্থাপনায় কেউ ক্ষুব্ধ হলে পর্যাপ্ত তথ্য দিয়েই তার মোকাবিলা করতে হবে। তথ্যের লড়াই তথ্য দিয়েই করতে হবে, অন্য কোনো পন্থায় তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করতে চাইলে তা হবে আত্মঘাতী। অন্যদিকে চ্যানেলগুলোকেও স্পষ্ট করতে হবে তাদের সম্পাদকীয় নীতি; এই নীতির আলোকে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, উপস্থাপনা আর সম্প্রচারে হতে হবে আরও সতর্ক, দায়িত্বশীল, পেশাদারি। মনে রাখতে বলি, শুধু বহিরঙ্গের চাপ বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নয়, অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনাহীনতা এবং সংকীর্ণ স্বার্থে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গণমাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহারই গণমাধ্যমের বড় শত্রু।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।
No comments