সুশীলদের তামাশা by ফরহাদ মজহার
শেখ
হাসিনা বলেছেন, ‘সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে তিনি একাদশ সংসদের নির্বাচন
দেবেন।’ এ প্রস্তাবের পেছনে পরাজয়ের সুর আছে; এটা কি পিছু হটা? মোটেও নয়।
তার এই প্রস্তাব কি তথাকথিত সমঝোতার ইঙ্গিত? তাও নয়। তিনি যা বলছেন, তিনি
কি আসলেই তা করবেন? না, করবেন না। এটা অসম্ভব। এর কারণ, সিদ্ধান্ত তিনি
নিজে নেবেন না, সিদ্ধান্ত নেবে দিল্লি। যদি তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার
জায়গাগুলো অবশিষ্ট থাকত, তাহলে তার এই ঘোষণাকে ভিন্নভাবে বিচার করার সুযোগ
থাকত। তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার যে জায়গাগুলো ছিল, তিনি তা অপচয় করেছেন।
নির্বাচনের নামে যে কাণ্ড করলেন তাতে শুধু তার নিজের নয়, বিশ্বে বাংলাদেশের
মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এখন তিনি সমঝোতার কথা বলছেন না, তার লজ্জা ঢাকার জন্য
বলছেন, বিরোধী দল যেন দশম সংসদ মেনে নেয়, তিনি তাহলে নতুন করে একাদশ
সংসদের নির্বাচন করবেন। এটা সমঝোতার প্রস্তাব নয়, নিজের লজ্জা সামাল দেয়ার
আরেকটি নির্লজ্জ চেষ্টা। সুশীলদের লেখালেখিতে দেখছি, তারা এতকিছুর পরও শেখ
হাসিনার পিছু ছাড়ছে না। তারা এখনও ভাবছে সমস্যাটা সাংবিধানিক; ফলে তাদের
দাবি, এখনও নাকি নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানে একটা ‘উপযুক্ত
সংশোধনী’র সুযোগ আছে। কিন্তু এখন যে সংসদ বহাল হতে যাচ্ছে সেটা তথাকথিত দশম
সংসদ। সংশোধনী আনতে হলে আনতে হবে দশম সংসদে। যদি দশম সংসদ এই সংশোধনী আনে
তাহলে বিরোধী জোটকে তামাশার দশম সংসদকেই ‘বৈধ’ বলে মেনে নিতে হবে। বিএনপি
এই মহা ভুল করবে কি-না জানি না। শেখ হাসিনা নাগরিকদের ভোটের অধিকার হরণ করে
যেভাবে নির্বাচন (??) করছেন, সেই নির্বাচন মেনে নেয়া কিভাবে সম্ভব?
প্রশ্নই আসে না। ক্ষমতাসীনরা মূলত সব অর্থেই অবৈধ। কোনো ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান
সম্পন্ন লোক এখন আর দাবি করতে পারে না যে তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’
ধরে রাখতে চাইলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানের একটি ‘উপযুক্ত
সংশোধনী’ লাগবে। প্রস্তাব হচ্ছে, শেখ হাসিনা যদি মুখে যা বলেছেন তা মন
থেকেই বলেন তাহলে দশম জাতীয় সংসদে তার উচিত হবে একটি ‘উপযুক্ত সংশোধনী’
আনা। এর ফলে দশম সংসদকে ‘বৈধ’ সংসদ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা
যাবে এবং এই ‘বৈধতা’ অর্জনের পর ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ এনে একাদশ সংসদের
নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া যাবে। খুবই প্রতিভাবান প্রস্তাব। দৈনিক প্রথম
আলো এই প্রস্তাব দিয়েছে (দেখুন, মিজানুর রহমান খান, ‘দশম সংসদের বৈধতা ও
একাদশের ভাবনা’, প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩)।
প্রথম আলোর যুক্তি হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী একদিকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষাকে জরুরি মনে করছে, অন্যদিকে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। বৃথা। আরও ইন্টারেস্টিং যুক্তি হচ্ছে, ‘সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়’। বিএনপিকে সংবিধানই মানতে হবে। শেখ হাসিনা তো বারবার এ কথাই বলছেন। সংবিধানই সব। প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ গঠনের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্ত দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা দশম সংসদ নিয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছেন। প্রথম আলো একই লেখায় বলছে, জানুয়ারি মাসের পর ‘দশম সংসদ নির্বাচন’ কথাটি জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে। অর্থাৎ দশম সংসদ নিয়ে কোনো কথা বলার আর সুযোগ নেই। এসব কথা বলে বিএনপি ‘অপরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে’।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কী করা উচিত তার নসিহতও দেয়া হয়েছে। বিএনপির উচিত হবে কেবল নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সমঝোতা করা নয়, বরং তাদের উচিত ‘গুচ্ছ প্রস্তাব’ নিয়ে আসা। যেমন- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর ফর্মুলা ইত্যাদি। সুশীলদের এই আকুতিকে আমরা সাধুবাদই জানাব। ঠিকই বিএনপি সংবিধানের কী ধরনের সংস্কার করতে চায় সেটা তাদের পরিষ্কার করেই বলা উচিত। অর্থাৎ বিদ্যমান সংবিধান বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রব্যবস্থার যে চরিত্র দাঁড়িয়েছে তার রূপান্তর বা সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো ভবিষ্যৎ নাই, এটা আমাদের সবার কাছে, যারা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার।
অতএব সুশীল রাজনীতির ধারক প্রথম আলো বিএনপি সংবিধান প্রশ্নে যে সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিচ্ছে, তার যে সমালোচনা করছে, তাতে কিছুটা সায় দেয়া হয়তো যায়। যদিও তাদের সমালোচনার মধ্যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আওয়ামী প্রীতি যতটা প্রবল, ঠিক ততটাই বিএনপির সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের বিচারবুদ্ধির নমুনা কম দেখি। প্রায়ই দেখি এক ধরনের ঘৃণা বিষের মতো গলগল করে বেরিয়ে পড়ে। সুশীল রাজনীতির সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারও মতো বা রাজনীতি বিএনপি-বিরোধী হতেই পারে। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষের অসুখের কারণে তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহকারী। এই মানসিক বিকার কাটিয়ে তোলা কঠিন, এটাও স্বীকার করি। কিন্তু যদি আমরা ইতিবাচক কোনো সুশীল চিন্তা ও রাজনীতির দ্বারা সমাজে অবদান রাখতে চাই, তাহলে নসিহত দেয়ার ভাষা কিংবা প্রকাশের ধরনের একটা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থা থাকা দরকার। যে কারণে প্রথম আলো শেষাবধি একটি আওয়ামীপন্থী পত্রিকায় পরিণত হয়। হয়তো পত্রিকার নীতি না হলেও এর মধ্যে আওয়ামী ক্যাডার ও ভারতপন্থীদের প্রাবল্যের কারণে যে ইতিবাচক নিরপেক্ষ ভূমিকা পত্রিকাটি পালন করতে পারত সেখানে ঘাটতি সীমাহীন।
কথাগুলো বলার কারণ রয়েছে। এর আগে আমি কয়েকবারই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সুশীল রাজনীতি বা যাকে সাধারণত ইংরেজিতে লিবারেলিজম বলা হয় তার একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে। বিশেষত যেখানে আমাদের সমাজ নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বোঝে প্রথম আলোর স্বাধীনতা। কিন্তু দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, কিংবা ইসলামিক টিভির স্বাধীনতা নয়। যেখানে ভিন্ন চিন্তাকে আমরা সহ্যই করতে পারি না ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে উদার চিন্তা ও মানসিকতার চর্চা প্রশস্ত করার দরকার রয়েছে কোনো সন্দেহ নেই।
তারপরও বলব, ‘দুই-তৃতীয়াংশের চেরাগ পেলে বিএনপি কোন কোন অনুচ্ছেদ বদলাবে? কোনটার পরিবর্তে কোনটা আনবে? দেখবেন আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে’- প্রথম আলোর এই অভিযোগ সঠিক। অর্থাৎ যদি বিএনপি বা বিরোধীদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তাদের কী? ঠিক, বিএনপি এটা জানে না। কিন্তু জানেটা কে? প্রথম আলো? সুশীল সমাজ? সমাজের বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা? টকশোর পারফর্মাররা? সংবিধান বিশেষজ্ঞরা? না, কেউ জানে না। আজ অবধি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী ধরনের ‘গঠনতন্ত্র’ আমাদের দরকার এবং কী ধরনের গঠনতন্ত্র ও রাষ্ট্রকাঠামো বাংলাদেশের উপযোগী সেই তর্কের কিনারেই আমরা পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু এটা তো বিএনপির একা করার কথা নয়। সংবিধানের সংস্কার কী করে হতে পারে, তার উত্তর শুধু কি বিএনপির কাছ থেকে আমরা চাইব? এটা তো কাজের কথা হতে পারে না। আজ অবধি সুশীলদের মধ্যে কি আমরা কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তা দেখেছি? দেখিনি। বাহাত্তরের পূত পবিত্র সংবিধানকে মাথায় তুলে তো ৪২ বছর কেটেছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল করেছেন, তার কন্যা শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী করে আজ দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেই ক্ষান্ত থাকেননি, খোদ সার্বভৌমত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছেন, বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন দিল্লির হাতে, এই গ্যাঁড়াকল থেকেই তো দেশ মুক্ত করা যাচ্ছে না। ইসলামাবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করা গেছে, দিল্লির কবল থেকে মুক্ত হব কিভাবে? গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র বা সংবিধান নিয়ে চিন্তাভাবনা তো অনেক দূরের কথা। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের দল হতো তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটত অনেক আগেই। এটা আমাদের রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য। ফলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকা যেমন অসম্ভব, একইভাবে বিএনপি বা বিরোধী দলের পক্ষাবলম্বনও অসম্ভব।
প্রথম আলো বিএনপি ও আঠারো দলের বিরোধী, এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু তারা আওয়ামীপন্থী এখানেই তাদের রাজনৈতিক চরিত্র আমরা বুঝতে পারি। তারা আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে তাকে রক্ষার জন্য, গণমানুষের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা বা রাজনীতির বিকাশ ঘটানোর জন্য নয়। এখন নির্লজ্জ ওকালতি হচ্ছে দশম সংসদ মেনে নেয়ার পক্ষে জনমত তৈরি করা।
প্রথম আলোর দাবিটি কৌতুককর। যে তামাশার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘সংসদ’ নামে এক প্রকার বিচিত্র জিনিস জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেই সংসদকে ‘বৈধ’ বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ সেই সংসদই ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ আনবে। আর তাতেই ‘সমঝোতা’ হবে, আর বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর চেয়ে হাস্যকর, গণতন্ত্রবিরোধী, আইন ও সাংবিধানিক ধ্যানধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা আর কী হতে পারে?
প্রথম আলো এখনই বিএনপির কাছ থেকে কথা বের করতে চায়। তারা ক্ষমতায় গেলে দেশ শাসনের কার্যপ্রণালীটা কী করবে? ‘আসলে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কী হবে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। মৌখিক নয়, একটি লিখিত অবস্থান আদায়ে বিএনপিকে চাপ দিতে হবে। শুধু অবরোধ বা তার নামে নাশকতা দিয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করা যাবে না।’
যে দলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না, যাদের নেতাদের জেলে পুরে রাখা হয়েছে, যাদের কর্মীদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, আন্দোলনের এই তুঙ্গ মুহূর্তে বিএনপির কাছ থেকে ‘লিখিত অবস্থান’ আদায় করা তামাশা ছাড়া কিছু না। একটি গণমাধ্যম বা টেলিভিশন চ্যানেল নেই, যারা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করে। ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে বিকৃত তথ্য। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কাছ থেকে আমি কিছুই প্রত্যাশা করি না। কিন্তু যেটা প্রত্যাশা করি, সেটা হচ্ছে আন্দোলনের পদক্ষেপ ও ধরন সম্পর্কে হুঁশে আসা। প্রথম আলো বলতে চাইছে ‘আন্দোলন ও নাশকতা’ দিয়ে বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারবে না। কেন তারা বলছে সেটা বুঝতে পারি, কারণ দশম সংসদের নির্বাচনকে তারা ‘বৈধ’ করার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে। এটা ভুল রাজনীতি। এতে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো মীমাংসা হবে না। বরং কিভাবে আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটবে সেই পরামর্শই বিএনপিকে দেয়া দরকার। এরপরই আসবে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্ন।
বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সামনে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ নেই। এজন্য একথা বলছি না যে, রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। না, তা নয়। আছে। কিন্তু সে সুযোগের ব্যবহার শেখ হাসিনা করতে পারবেন না। কারণ লড়াইটা স্পষ্টতই দিল্লির বিরুদ্ধে। এই গোড়ার সত্যকে অস্বীকার করলে সুশীলরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে তা শেষতক দিল্লির পক্ষেই নগ্ন দালালি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
বিএনপিকে অবশ্যই পরামর্শ দেয়া উচিত। কিন্তু সেটা দশম সংসদ ‘বৈধ’ প্রমাণ করার জন্য ‘উপযুক্ত সংশোধনী’র প্রস্তাব নয়। বরং আন্দোলনের ধরন ও কৌশল নিয়ে পরামর্শ। যাতে আন্দোলন গণতান্ত্রিক চরিত্র পরিগ্রহণ করতে পারে এবং বর্তমান সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের উপাদান ও শর্ত তৈরি করা সম্ভব হয়।
শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে যা করেছেন, তারপরও তাকে রক্ষার চেষ্টা দেখে লজ্জাবোধ হয়।
প্রথম আলোর যুক্তি হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী একদিকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষাকে জরুরি মনে করছে, অন্যদিকে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। বৃথা। আরও ইন্টারেস্টিং যুক্তি হচ্ছে, ‘সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়’। বিএনপিকে সংবিধানই মানতে হবে। শেখ হাসিনা তো বারবার এ কথাই বলছেন। সংবিধানই সব। প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ গঠনের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্ত দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা দশম সংসদ নিয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছেন। প্রথম আলো একই লেখায় বলছে, জানুয়ারি মাসের পর ‘দশম সংসদ নির্বাচন’ কথাটি জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে। অর্থাৎ দশম সংসদ নিয়ে কোনো কথা বলার আর সুযোগ নেই। এসব কথা বলে বিএনপি ‘অপরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে’।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কী করা উচিত তার নসিহতও দেয়া হয়েছে। বিএনপির উচিত হবে কেবল নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সমঝোতা করা নয়, বরং তাদের উচিত ‘গুচ্ছ প্রস্তাব’ নিয়ে আসা। যেমন- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর ফর্মুলা ইত্যাদি। সুশীলদের এই আকুতিকে আমরা সাধুবাদই জানাব। ঠিকই বিএনপি সংবিধানের কী ধরনের সংস্কার করতে চায় সেটা তাদের পরিষ্কার করেই বলা উচিত। অর্থাৎ বিদ্যমান সংবিধান বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রব্যবস্থার যে চরিত্র দাঁড়িয়েছে তার রূপান্তর বা সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো ভবিষ্যৎ নাই, এটা আমাদের সবার কাছে, যারা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার।
অতএব সুশীল রাজনীতির ধারক প্রথম আলো বিএনপি সংবিধান প্রশ্নে যে সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিচ্ছে, তার যে সমালোচনা করছে, তাতে কিছুটা সায় দেয়া হয়তো যায়। যদিও তাদের সমালোচনার মধ্যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আওয়ামী প্রীতি যতটা প্রবল, ঠিক ততটাই বিএনপির সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের বিচারবুদ্ধির নমুনা কম দেখি। প্রায়ই দেখি এক ধরনের ঘৃণা বিষের মতো গলগল করে বেরিয়ে পড়ে। সুশীল রাজনীতির সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারও মতো বা রাজনীতি বিএনপি-বিরোধী হতেই পারে। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষের অসুখের কারণে তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহকারী। এই মানসিক বিকার কাটিয়ে তোলা কঠিন, এটাও স্বীকার করি। কিন্তু যদি আমরা ইতিবাচক কোনো সুশীল চিন্তা ও রাজনীতির দ্বারা সমাজে অবদান রাখতে চাই, তাহলে নসিহত দেয়ার ভাষা কিংবা প্রকাশের ধরনের একটা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থা থাকা দরকার। যে কারণে প্রথম আলো শেষাবধি একটি আওয়ামীপন্থী পত্রিকায় পরিণত হয়। হয়তো পত্রিকার নীতি না হলেও এর মধ্যে আওয়ামী ক্যাডার ও ভারতপন্থীদের প্রাবল্যের কারণে যে ইতিবাচক নিরপেক্ষ ভূমিকা পত্রিকাটি পালন করতে পারত সেখানে ঘাটতি সীমাহীন।
কথাগুলো বলার কারণ রয়েছে। এর আগে আমি কয়েকবারই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সুশীল রাজনীতি বা যাকে সাধারণত ইংরেজিতে লিবারেলিজম বলা হয় তার একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে। বিশেষত যেখানে আমাদের সমাজ নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বোঝে প্রথম আলোর স্বাধীনতা। কিন্তু দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, কিংবা ইসলামিক টিভির স্বাধীনতা নয়। যেখানে ভিন্ন চিন্তাকে আমরা সহ্যই করতে পারি না ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে উদার চিন্তা ও মানসিকতার চর্চা প্রশস্ত করার দরকার রয়েছে কোনো সন্দেহ নেই।
তারপরও বলব, ‘দুই-তৃতীয়াংশের চেরাগ পেলে বিএনপি কোন কোন অনুচ্ছেদ বদলাবে? কোনটার পরিবর্তে কোনটা আনবে? দেখবেন আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে’- প্রথম আলোর এই অভিযোগ সঠিক। অর্থাৎ যদি বিএনপি বা বিরোধীদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তাদের কী? ঠিক, বিএনপি এটা জানে না। কিন্তু জানেটা কে? প্রথম আলো? সুশীল সমাজ? সমাজের বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা? টকশোর পারফর্মাররা? সংবিধান বিশেষজ্ঞরা? না, কেউ জানে না। আজ অবধি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী ধরনের ‘গঠনতন্ত্র’ আমাদের দরকার এবং কী ধরনের গঠনতন্ত্র ও রাষ্ট্রকাঠামো বাংলাদেশের উপযোগী সেই তর্কের কিনারেই আমরা পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু এটা তো বিএনপির একা করার কথা নয়। সংবিধানের সংস্কার কী করে হতে পারে, তার উত্তর শুধু কি বিএনপির কাছ থেকে আমরা চাইব? এটা তো কাজের কথা হতে পারে না। আজ অবধি সুশীলদের মধ্যে কি আমরা কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তা দেখেছি? দেখিনি। বাহাত্তরের পূত পবিত্র সংবিধানকে মাথায় তুলে তো ৪২ বছর কেটেছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল করেছেন, তার কন্যা শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী করে আজ দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেই ক্ষান্ত থাকেননি, খোদ সার্বভৌমত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছেন, বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন দিল্লির হাতে, এই গ্যাঁড়াকল থেকেই তো দেশ মুক্ত করা যাচ্ছে না। ইসলামাবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করা গেছে, দিল্লির কবল থেকে মুক্ত হব কিভাবে? গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র বা সংবিধান নিয়ে চিন্তাভাবনা তো অনেক দূরের কথা। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের দল হতো তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটত অনেক আগেই। এটা আমাদের রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য। ফলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকা যেমন অসম্ভব, একইভাবে বিএনপি বা বিরোধী দলের পক্ষাবলম্বনও অসম্ভব।
প্রথম আলো বিএনপি ও আঠারো দলের বিরোধী, এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু তারা আওয়ামীপন্থী এখানেই তাদের রাজনৈতিক চরিত্র আমরা বুঝতে পারি। তারা আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে তাকে রক্ষার জন্য, গণমানুষের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা বা রাজনীতির বিকাশ ঘটানোর জন্য নয়। এখন নির্লজ্জ ওকালতি হচ্ছে দশম সংসদ মেনে নেয়ার পক্ষে জনমত তৈরি করা।
প্রথম আলোর দাবিটি কৌতুককর। যে তামাশার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘সংসদ’ নামে এক প্রকার বিচিত্র জিনিস জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেই সংসদকে ‘বৈধ’ বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ সেই সংসদই ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ আনবে। আর তাতেই ‘সমঝোতা’ হবে, আর বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর চেয়ে হাস্যকর, গণতন্ত্রবিরোধী, আইন ও সাংবিধানিক ধ্যানধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা আর কী হতে পারে?
প্রথম আলো এখনই বিএনপির কাছ থেকে কথা বের করতে চায়। তারা ক্ষমতায় গেলে দেশ শাসনের কার্যপ্রণালীটা কী করবে? ‘আসলে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কী হবে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। মৌখিক নয়, একটি লিখিত অবস্থান আদায়ে বিএনপিকে চাপ দিতে হবে। শুধু অবরোধ বা তার নামে নাশকতা দিয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করা যাবে না।’
যে দলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না, যাদের নেতাদের জেলে পুরে রাখা হয়েছে, যাদের কর্মীদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, আন্দোলনের এই তুঙ্গ মুহূর্তে বিএনপির কাছ থেকে ‘লিখিত অবস্থান’ আদায় করা তামাশা ছাড়া কিছু না। একটি গণমাধ্যম বা টেলিভিশন চ্যানেল নেই, যারা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করে। ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে বিকৃত তথ্য। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কাছ থেকে আমি কিছুই প্রত্যাশা করি না। কিন্তু যেটা প্রত্যাশা করি, সেটা হচ্ছে আন্দোলনের পদক্ষেপ ও ধরন সম্পর্কে হুঁশে আসা। প্রথম আলো বলতে চাইছে ‘আন্দোলন ও নাশকতা’ দিয়ে বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারবে না। কেন তারা বলছে সেটা বুঝতে পারি, কারণ দশম সংসদের নির্বাচনকে তারা ‘বৈধ’ করার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে। এটা ভুল রাজনীতি। এতে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো মীমাংসা হবে না। বরং কিভাবে আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটবে সেই পরামর্শই বিএনপিকে দেয়া দরকার। এরপরই আসবে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্ন।
বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সামনে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ নেই। এজন্য একথা বলছি না যে, রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। না, তা নয়। আছে। কিন্তু সে সুযোগের ব্যবহার শেখ হাসিনা করতে পারবেন না। কারণ লড়াইটা স্পষ্টতই দিল্লির বিরুদ্ধে। এই গোড়ার সত্যকে অস্বীকার করলে সুশীলরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে তা শেষতক দিল্লির পক্ষেই নগ্ন দালালি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
বিএনপিকে অবশ্যই পরামর্শ দেয়া উচিত। কিন্তু সেটা দশম সংসদ ‘বৈধ’ প্রমাণ করার জন্য ‘উপযুক্ত সংশোধনী’র প্রস্তাব নয়। বরং আন্দোলনের ধরন ও কৌশল নিয়ে পরামর্শ। যাতে আন্দোলন গণতান্ত্রিক চরিত্র পরিগ্রহণ করতে পারে এবং বর্তমান সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের উপাদান ও শর্ত তৈরি করা সম্ভব হয়।
শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে যা করেছেন, তারপরও তাকে রক্ষার চেষ্টা দেখে লজ্জাবোধ হয়।
No comments