নজিরবিহীন নির্বাচনে জয়-পরাজয় কার? by মোঃ মাহমুদুর রহমান
তফসিল অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ জানুয়ারি ২০১৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন
নির্বাচন। দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকরা এই নির্বাচনকে কীভাবে
অভিহিত করবেন, তা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। একদলীয় নির্বাচন, তামাশার
নির্বাচন, প্রহসনের নির্বাচন, ভোটার ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন ইত্যাদি
বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মহল থেকে অভিহিত করা হচ্ছে। টিভি টকশোতে নামকরণ নিয়ে
বিভ্রান্তিতে থাকা এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন
মালিক একে নজিরবিহীন নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক উল
হকের মতে, এই নির্বাচনকে প্রহসন বললেও কম বলা হবে। ইতিমধ্যে ১৫৪ জন
প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি ১৪৬টি
আসনে নির্বাচন হবে। সংবিধান অনুযায়ী ১৫১ আসনে জয়ী হলে সরকার গঠন করা যায়।
সেই হিসাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট জনগণের ভোট ছাড়াই সংবিধান অনুযায়ী আগামী
পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভোট ছাড়াই সরকার গঠনের
মতো আসন লাভ বাংলাদেশ তথা বিশ্বের স্বীকৃত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভবত এই
প্রথম। তাই বিশ্লেষকরা এ নির্বাচনকে কীভাবে আখ্যায়িত করবেন তা নিয়ে অনেকেই
অনেক কথা বলছেন। ভবিষ্যতে হয়তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণার কাজে এই
নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
বিরোধী দলের অনেক বক্তব্য থাকতে পারে নির্বাচন ও ক্ষমতাসীনদের আচরণ নিয়ে। অনেক অভিযোগ আছেও। কোনোটি যৌক্তিক, আবার কোনোটি হয়তো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার জন্য। তবে তাদের একটি অভিযোগ রাজনীতির বাইরের সাধারণ মানুষের কাছে আজ দিবালোকের মতো সত্য- তা হচ্ছে, এই সরকার দেশের মানুষকে ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া যেখানে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়, সেখানে সরকারি দল এর কী ব্যাখ্যা দেবে বোঝা যাচ্ছে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছেন, সরকার ভোটার ও প্রার্থীবিহীন এই নির্বাচনকে কীভাবে নিচ্ছে? আমাদের যিনি আগেই বলেছেন এই ভোটারবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, সেই ভদ্রলোককে কেন রাষ্ট্রদূত বিব্রতকর প্রশ্নটি করলেন বোঝা যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী সঠিকভাবে বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। অর্থমন্ত্রী, যিনি মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র সদস্য, একই সঙ্গে সরকারি দলেরও, তার অতীতের কোনো কোনো বক্তব্য বিতর্কিত হলেও ব্যক্তিগত সততার বিষয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে জেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানানোর কথা বলে অর্থমন্ত্রী দুটি বার্তা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। প্রথমত, দেশে বিতর্কিত এই নির্বাচনের মাধ্যমে কী অর্জিত হচ্ছে, তা সরকার ও দল জানে না। দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনের দায়দায়িত্বও তারা নিচ্ছেন না। এর ফলে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যদি দেশের কোনো কল্যাণ হয় তাহলে তা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব। আবার যদি কোনো ক্ষতি হয় তার দায়ও প্রধানমন্ত্রীর।
সাধারণ মানুষ এই নির্বাচনের কোনো হিতকর দিক আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রায় শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছে। অনেক গাড়ি, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিরাপত্তাহীন শুধু বিরোধী দলের কর্মীরা নন, সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আমাদের মতো রাজনীতির বাইরের খেটে খাওয়া মানুষও নিরাপত্তাহীন। এ মুহূর্তে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে আছেন। এর বাইরের সরকারি দলের কর্মী, বিরোধী দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ কেউই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না। কারণ প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কাউকে না কাউকে প্রতিপক্ষের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে। রাস্তা চলাচলে কিংবা যানবাহনে অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হতে হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমাদের কি এই মরণ খেলা থেকে মুক্তি দিতে পারবে? পাবলিক পারসেপশন হচ্ছে- না, পারবে না। তাহলে কেন এই নির্বাচন? আমরা কী অর্জন করছি এ নির্বাচনী খেলার মাধ্যমে? সবাইকে নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন হলে কি জাতির কল্যাণ হতো না?
এ প্রশ্নগুলো করার জন্য কোনো দায়িত্বশীল মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সদুত্তর দিতে পারবেন এবং জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীকরণে সাহায্য করতে পারেন। অথচ দেশের কোটি কোটি মানুষের একই প্রশ্ন। উত্তর নেই। দেশ যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে বলে সবার ধারণা থাকলেও এর মাত্রা যে এত ভয়াবহ হবে তা কেউ সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলেও নির্বাচনের মাধ্যমেও যে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়তে পারে, তা দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে কারও জানা ছিল বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের ছোট একটি অংশ ছাড়া দেশ-বিদেশের সবাই একমত, বর্তমানে নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে তা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া। তাই দেশীয় পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘও চাচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তা এ মুহূর্তে হচ্ছে না। তাই এ নির্বাচন দেশ-বিদেশের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে তা সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কথায়ও এ বৈধতা সংকটের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। নির্বাচনের পর বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে প্রয়োজনে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্য জনগণকে আরও দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। পরে সমঝোতা করে নির্বাচন করলে এখন করা হচ্ছে না কেন? সাংবিধানিক সময়সীমার যুক্তি সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মানতে পারছেন না। সমঝোতা হলে বর্তমান তফসিল স্থগিত করে কীভাবে নির্বাচন করা যায়, তা প্রতিনিয়ত টকশোতে বাতলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কার কথা কে শোনে!
সরকারি দলের অনেক নেতাও জনগণের সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। অর্থমন্ত্রী আগেই বলেছেন, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। পরে কক্সবাজারের রামু উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলের নেত্রীদের মতের বিপরীতে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সীমিত হলেও এখন সাহস করে প্রকাশ্যে অনেকেই বলবেন বলে মনে হচ্ছে। তাদের বক্তব্যকে যত তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দেবেন ততই দেশ, জাতি ও ক্ষমতাসীনদের জন্য কল্যাণকর হবে। বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার প্রথম মেয়াদের সরকারের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার অনুরোধ করে একজন মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। পরে তার কথাই বাস্তবায়িত হয়েছিল। এবারও এমন হতে পারে। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলে সম্ভবত প্রশংসা ও তোষামোদকারীদের বেশি ভালো লাগে সবার। যৌক্তিক ভিন্নমতও তখন শত্র“তা মনে হয়। অথচ সময়মতো ক্ষমতাসীনরা শত্র“-মিত্র শনাক্তকরণে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারলে দেশ ও জনগণ অনেক অপ্রয়োজনীয় সহিংসতা থেকে রেহাই পেত। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করে সব পক্ষ সমঝোতার পথে এগিয়ে আসবে- এটাই এই মুহূর্তে জনগণের প্রত্যাশা। সহিংসতা নয়, সমঝোতাই নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে পারে। এই সত্য উপলব্ধি করে উভয় পক্ষ একটি কার্যকর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাক- এটাই দেশবাসী দেখতে চায়।
অন্যথায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কারণ এ নির্বাচনে গণতন্ত্রের পরাজয় হবে। নজিরবিহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা জিতলেও দেশ হারবে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা। নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক কেউ চাইবে না দেশ হেরে যাক।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার
বিরোধী দলের অনেক বক্তব্য থাকতে পারে নির্বাচন ও ক্ষমতাসীনদের আচরণ নিয়ে। অনেক অভিযোগ আছেও। কোনোটি যৌক্তিক, আবার কোনোটি হয়তো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার জন্য। তবে তাদের একটি অভিযোগ রাজনীতির বাইরের সাধারণ মানুষের কাছে আজ দিবালোকের মতো সত্য- তা হচ্ছে, এই সরকার দেশের মানুষকে ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া যেখানে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়, সেখানে সরকারি দল এর কী ব্যাখ্যা দেবে বোঝা যাচ্ছে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছেন, সরকার ভোটার ও প্রার্থীবিহীন এই নির্বাচনকে কীভাবে নিচ্ছে? আমাদের যিনি আগেই বলেছেন এই ভোটারবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, সেই ভদ্রলোককে কেন রাষ্ট্রদূত বিব্রতকর প্রশ্নটি করলেন বোঝা যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী সঠিকভাবে বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। অর্থমন্ত্রী, যিনি মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র সদস্য, একই সঙ্গে সরকারি দলেরও, তার অতীতের কোনো কোনো বক্তব্য বিতর্কিত হলেও ব্যক্তিগত সততার বিষয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে জেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানানোর কথা বলে অর্থমন্ত্রী দুটি বার্তা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। প্রথমত, দেশে বিতর্কিত এই নির্বাচনের মাধ্যমে কী অর্জিত হচ্ছে, তা সরকার ও দল জানে না। দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনের দায়দায়িত্বও তারা নিচ্ছেন না। এর ফলে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যদি দেশের কোনো কল্যাণ হয় তাহলে তা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব। আবার যদি কোনো ক্ষতি হয় তার দায়ও প্রধানমন্ত্রীর।
সাধারণ মানুষ এই নির্বাচনের কোনো হিতকর দিক আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রায় শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছে। অনেক গাড়ি, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিরাপত্তাহীন শুধু বিরোধী দলের কর্মীরা নন, সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আমাদের মতো রাজনীতির বাইরের খেটে খাওয়া মানুষও নিরাপত্তাহীন। এ মুহূর্তে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে আছেন। এর বাইরের সরকারি দলের কর্মী, বিরোধী দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ কেউই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না। কারণ প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কাউকে না কাউকে প্রতিপক্ষের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে। রাস্তা চলাচলে কিংবা যানবাহনে অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হতে হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমাদের কি এই মরণ খেলা থেকে মুক্তি দিতে পারবে? পাবলিক পারসেপশন হচ্ছে- না, পারবে না। তাহলে কেন এই নির্বাচন? আমরা কী অর্জন করছি এ নির্বাচনী খেলার মাধ্যমে? সবাইকে নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন হলে কি জাতির কল্যাণ হতো না?
এ প্রশ্নগুলো করার জন্য কোনো দায়িত্বশীল মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সদুত্তর দিতে পারবেন এবং জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীকরণে সাহায্য করতে পারেন। অথচ দেশের কোটি কোটি মানুষের একই প্রশ্ন। উত্তর নেই। দেশ যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে বলে সবার ধারণা থাকলেও এর মাত্রা যে এত ভয়াবহ হবে তা কেউ সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলেও নির্বাচনের মাধ্যমেও যে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়তে পারে, তা দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে কারও জানা ছিল বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের ছোট একটি অংশ ছাড়া দেশ-বিদেশের সবাই একমত, বর্তমানে নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে তা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া। তাই দেশীয় পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘও চাচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তা এ মুহূর্তে হচ্ছে না। তাই এ নির্বাচন দেশ-বিদেশের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে তা সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কথায়ও এ বৈধতা সংকটের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। নির্বাচনের পর বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে প্রয়োজনে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্য জনগণকে আরও দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। পরে সমঝোতা করে নির্বাচন করলে এখন করা হচ্ছে না কেন? সাংবিধানিক সময়সীমার যুক্তি সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মানতে পারছেন না। সমঝোতা হলে বর্তমান তফসিল স্থগিত করে কীভাবে নির্বাচন করা যায়, তা প্রতিনিয়ত টকশোতে বাতলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কার কথা কে শোনে!
সরকারি দলের অনেক নেতাও জনগণের সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। অর্থমন্ত্রী আগেই বলেছেন, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। পরে কক্সবাজারের রামু উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলের নেত্রীদের মতের বিপরীতে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সীমিত হলেও এখন সাহস করে প্রকাশ্যে অনেকেই বলবেন বলে মনে হচ্ছে। তাদের বক্তব্যকে যত তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দেবেন ততই দেশ, জাতি ও ক্ষমতাসীনদের জন্য কল্যাণকর হবে। বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার প্রথম মেয়াদের সরকারের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার অনুরোধ করে একজন মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। পরে তার কথাই বাস্তবায়িত হয়েছিল। এবারও এমন হতে পারে। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলে সম্ভবত প্রশংসা ও তোষামোদকারীদের বেশি ভালো লাগে সবার। যৌক্তিক ভিন্নমতও তখন শত্র“তা মনে হয়। অথচ সময়মতো ক্ষমতাসীনরা শত্র“-মিত্র শনাক্তকরণে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারলে দেশ ও জনগণ অনেক অপ্রয়োজনীয় সহিংসতা থেকে রেহাই পেত। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করে সব পক্ষ সমঝোতার পথে এগিয়ে আসবে- এটাই এই মুহূর্তে জনগণের প্রত্যাশা। সহিংসতা নয়, সমঝোতাই নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে পারে। এই সত্য উপলব্ধি করে উভয় পক্ষ একটি কার্যকর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাক- এটাই দেশবাসী দেখতে চায়।
অন্যথায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কারণ এ নির্বাচনে গণতন্ত্রের পরাজয় হবে। নজিরবিহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা জিতলেও দেশ হারবে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা। নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক কেউ চাইবে না দেশ হেরে যাক।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার
No comments