সময়চিত্র- মিথ্যা, মিথ্যাচার, অপপ্রচার by আসিফ নজরুল
‘হেসেই খুন’ এই শব্দযুগলের সঙ্গে আমার
পরিচয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নারকীয় ঘটনার পর। আওয়ামী লীগের জনসভায় এদিন
ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ বহু মানুষ নিহত হন, আহত হন আরও বেশি
মানুষ।
স্রেফ সৌভাগ্যবশত প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের
সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার তো দূরের কথা, তদন্তই করেনি
তৎকালীন বিএনপি সরকার। তদন্তের নামে চলে বরং তামাশা। জজ মিয়া নামের
পলকাদেহী এক নগণ্য তরুণকে খুঁজে বের করা হয়। এই জজ মিয়াই নাকি আর্জেস
গ্রেনেড মেরেছিলেন আওয়ামী লীগের জনসভায়! জজ মিয়া কি গ্রেনেড মারতে
পারেন? প্রথম আলোর এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হেসেই খুন’ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর এক
আত্মীয়!
প্রথম আলোর এই অসাধারণ শব্দচয়ন পুরোপুরি হূদয়ঙ্গম করতে পারিনি আমি বহুদিন। কিছুদিন আগে এক মামুলি ঘটনায় হঠাৎ নিজেই হেসে খুন হয়ে এর মানে বুঝতে পারি। ফেসবুকে কারা নাকি ছড়াচ্ছে, ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্র্যাকের একজন কর্মকর্তার কাছে কয়েক বছর আগে লাখ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল একজন শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস! রোবায়েত নাকি ব্র্যাককে জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে এই লবিংয়ের কাজে জড়িত ছিলাম আমিও!
রোবায়েত যতবার ভয়ার্ত কণ্ঠে এই মিথ্যাচার শোনায়, আমি ‘বিমুগ্ধ’ হয়ে যাই। সারা বিশ্বের এক নম্বর এনজিও ব্র্যাকের প্রধান স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিশ্ববরেণ্য একজন ব্যক্তি। তাঁর মতো একজন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো মানুষকে নোবেল পাইয়ে দেওয়ার ছেলেভোলানো কথা ব্র্যাকে গিয়ে বলেছিলেন তখনকার তরুণ প্রভাষক রোবায়েত! এমন প্রচারণাও চালাতে পারে কোনো নির্বোধ? আমার হাসি থামতেই চায় না এসব শুনে। কিন্তু রোবায়েত সিরিয়াস! তিনি জানান, ফেসবুকে সমানে এই কল্পকাহিনি প্রচার করছে বহু মানুষ, যা-তা মন্তব্য লিখে শেয়ার করছে বহুজনের সঙ্গে!
রোবায়েত জীবনে কখনো অপপ্রচারের শিকার হননি। তাই এই জঘন্য অথচ হাস্যকর মিথ্যাচারে ঘাবড়ে যান তিনি। কিন্তু আমি এতে অবাক হই না। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বহু বরেণ্য মানুষ সম্পর্কে অকথ্য এবং গাঁজাখুরি প্রচারণা চলছে ফেসবুক আর বিভিন্ন ব্লগে। অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, এবিএম মূসা, ড. আকবর আলি খানের মতো বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও। সবচেয়ে বেশি এবং নিরন্তর অপপ্রচার চলেছে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে। তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আনন্দে ধন্য ও বিগলিত হয়ে আমার ফ্যানপেজে তাঁর সঙ্গের একটি ছবি সম্প্রতি আপলোড করেছি আমি। হতবাক হয়ে একদিন দেখি তার নিচে দু-একজন মন্তব্য লিখেছেন: এমন একজন (মুদ্রণ অনুপযোগী) মানুষের সঙ্গে কীভাবে ছবি তুললাম আমি! তাঁর মতো একজন নমস্য মানুষ সম্পর্কে কতটা ঘৃণ্য অপপ্রচার চললে কেউ ভাবতে পারে এমন!
ফেসবুকে কখনো কখনো অসাধারণ কোনো লেখা বা মন্তব্যও চোখে পড়ে। যেমন—আলী রীয়াজ, আজফার হোসেন বা বিবিসির মিজানুর রহমান খানের কারও কারও মন্তব্য খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতোও। কিন্তু ফেসবুক বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অপপ্রচারণাকারীদের অধিকাংশের ভাষায় কোনো যুক্তি, প্রামাণ্য তথ্য, এমনকি শালীনতা পর্যন্ত নেই। তাঁদের মধ্যে কিছু মেধাবী তরুণ আছেন। আছেন এমন ব্যক্তিরাও, যাঁদের কেউ ত্রাণের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কেউ অতীতে মাদক সেবনের জন্য দৈনিক পত্রিকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, কেউ অতীতে নারী নির্যাতনের মামলার আসামি ছিলেন, আবার কেউ কেউ নগণ্য পত্রিকায় অনুল্লেখ্য সাংবাদিকতা করছেন। জীবনের সব ব্যর্থতা আর হতাশার ক্রোধ মেটান তাঁরা সমাজের পরিচিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে যা-তা লিখে। পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থাকলে লেখা বেশি পঠিত হবে, এই চিন্তাও হয়তো কাজ করে তাঁদের অনেকের মধ্যে। এই সমাজের কিছু তরুণ, বই তাঁর গবেষণার সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই বলেই হয়তো ভিত্তিহীন নানা প্রচারণায় অংশ নিয়ে গালাগালের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন ফেসবুক বা ব্লগে।
গভীর অর্থে দেখলে অবশ্য ফেসবুক বা অন্যান্য ব্লগে এসব প্রচারণা দেখে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে সমাজের তরুণতর অংশ। আরও বাস্তব জীবনে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যেভাবে মিথ্যাচার করেন, তার প্রভাব তো পড়বেই তাঁদের ওপর। এই মিথ্যাচার সবচেয়ে বেশি চলে রাজনীতিতে। কখনো তা নিষ্ঠুরতা আর শালীনতার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। খালেদা জিয়ার জন্ম চা-বাগানে, শেখ হাসিনা নাস্তিক, ৫ মে হেফাজতের কর্মীরা গায়ে রং মেখে শুয়ে ছিলেন বা সেদিন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল কিংবা শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন তাঁরা জামায়াতের লোক, কাবা শরিফে দোয়া হয়েছে একজন যুদ্ধাপরাধীর জন্য—এসব মিথ্যাচার করেছেন বা একে উৎসাহিত করেছেন রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। মাঠের রাজনীতির কুশীলবেরা আরও বহুধাপ এগিয়ে চাঁদের বুকে সাঈদীর ছবি(!) আবিষ্কার করার গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে চালিয়েছেন নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ।
নিরন্তর রাজনৈতিক অপপ্রচারণাকে কখনো কখনো আবার মিথের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় এ দেশে। কারও যেন কোনো প্রমাণের দরকার নেই, দরকার নেই কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যেরও। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাসদের ৪০ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, খালেদা জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগের ২২ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে—কেউ কি আমরা কোনো প্রমাণ চেয়েছি এসবের? আমরা সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা দুই রাজনীতির শিবিরে বিভক্ত হয়ে বরং মিথ্যাচারের এই সংস্কৃতির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছি। আমরা একদল আওয়ামী লীগ বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার হলে তাতে অংশ নিই বা তার প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকি। আরেক দল বিএনপির ক্ষেত্রে একই আচরণ করি।
এমন একটি মিথ্যার সংস্কৃতিতে বাস করা সমাজে নতুন উপদ্রব হিসেবে এসেছে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন নামের একটি আইন। এই আইনে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, অধিকার তার ওয়েবপেজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ৫ মে হেফাজতের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে সরকারের অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছেন। এ অভিযানে আসলে কতজন নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে প্রচণ্ড বিভ্রান্তি আছে দেশে-বিদেশে। মাত্র কয়েক দিন আগে সারা বিশ্বে স্বনামধন্য পত্রিকা ইকোনমিস্ট বলেছে, ওই দিনের অভিযানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও মানবাধিকার সংস্থা বিভিন্ন সময়ে এ সংখ্যা ১১ থেকে শ-খানেক বলে উল্লেখ করেছে। সরকারের পুলিশ ৭ মে বলেছে, অভিযানে মারা গেছেন আটজন, তাঁদের একজন পুলিশ (দেখুন: প্রথম আলো, ৮ মে, ২০১৩), পরে বলেছে, একজনও মারা যায়নি অভিযানকালে! তার মানে হচ্ছে, প্রকৃত সত্য না জেনেই বলছে অধিকাংশ পক্ষ। তাহলে একমাত্র আদিলুরই কেন হবেন গ্রেপ্তার আর নির্যাতনের শিকার? আর তাঁর সংগঠন মিথ্যা বলেছে, এর প্রমাণ কী?
আদিলুর রহমান খান বা অধিকারের তথ্য মিথ্যা—এই প্রচারণা চালিয়ে তাঁর প্রতি সরকারের নির্যাতনকে সমর্থন করছেন সমাজের কিছু বরেণ্য ব্যক্তি পর্যন্ত। শেয়ারবাজার, রেল কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, গুম আর ক্রসফায়ার—কোনো কিছুর মধ্যে সরকারের কোনো মিথ্যাচার দেখেন না তাঁরা, দেখেন একটি মানবাধিকার সংগঠনের দায়িত্বপ্রসূত প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে।
এসব মানুষের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গিতে উৎসাহিত হয়েই হয়তো সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি আইনকে আরও কঠোরতর করার উদ্যোগ নিচ্ছে। আইনটির খসড়া সংশোধনী অনুসারে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশিত হলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে, বিনা জামিনে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখা যাবে, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। আইনটি অনুসারে গ্রেপ্তারের আগে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা—এটি নির্ধারণ করবে সরকার। অর্থাৎ খসড়া আইনটি পাস হলে সরকার ও তার পক্ষের লোকজনের বক্তব্য ‘সত্য’ আর ভিন্নমতাবলম্বী বা সমালোচকদের বক্তব্য ‘মিথ্যা’—এই অবস্থান নিয়ে চরম নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকবে সরকারের। আর তাই যদি হয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমেও, ভবিষ্যতে আমরা আর বহুপক্ষীয় মিথ্যা নয়, দেখব কেবল সরকারের অনুকূলে একপক্ষীয় মিথ্যাচার। কেমন হবে সেই সরকার—একদিন যদি হয় বিএনপি-জামায়াতের সরকার?
মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের তাই রুখে দাঁড়াতে হবে দলকানা মনোভাব বাদ দিয়ে। মিথ্যা সবচেয়ে ভয়ংকর হয় তা যখন অমিত শক্তিশালী সরকারের পক্ষে হয়, সরকারের সমালোচনাকারীদের বিপক্ষে হয়। মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব সরকারের সময় আমরা যদি এ বিষয়ে সচেতন না হই, তাহলে নতুন নতুন আইনের কবলে পড়ে এ দেশে মানবাধিকার আর সুশাসনের লড়াই চরমভাবে বিপন্ন হবে।
প্রথম আলোর এই অসাধারণ শব্দচয়ন পুরোপুরি হূদয়ঙ্গম করতে পারিনি আমি বহুদিন। কিছুদিন আগে এক মামুলি ঘটনায় হঠাৎ নিজেই হেসে খুন হয়ে এর মানে বুঝতে পারি। ফেসবুকে কারা নাকি ছড়াচ্ছে, ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্র্যাকের একজন কর্মকর্তার কাছে কয়েক বছর আগে লাখ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল একজন শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস! রোবায়েত নাকি ব্র্যাককে জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে এই লবিংয়ের কাজে জড়িত ছিলাম আমিও!
রোবায়েত যতবার ভয়ার্ত কণ্ঠে এই মিথ্যাচার শোনায়, আমি ‘বিমুগ্ধ’ হয়ে যাই। সারা বিশ্বের এক নম্বর এনজিও ব্র্যাকের প্রধান স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিশ্ববরেণ্য একজন ব্যক্তি। তাঁর মতো একজন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো মানুষকে নোবেল পাইয়ে দেওয়ার ছেলেভোলানো কথা ব্র্যাকে গিয়ে বলেছিলেন তখনকার তরুণ প্রভাষক রোবায়েত! এমন প্রচারণাও চালাতে পারে কোনো নির্বোধ? আমার হাসি থামতেই চায় না এসব শুনে। কিন্তু রোবায়েত সিরিয়াস! তিনি জানান, ফেসবুকে সমানে এই কল্পকাহিনি প্রচার করছে বহু মানুষ, যা-তা মন্তব্য লিখে শেয়ার করছে বহুজনের সঙ্গে!
রোবায়েত জীবনে কখনো অপপ্রচারের শিকার হননি। তাই এই জঘন্য অথচ হাস্যকর মিথ্যাচারে ঘাবড়ে যান তিনি। কিন্তু আমি এতে অবাক হই না। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বহু বরেণ্য মানুষ সম্পর্কে অকথ্য এবং গাঁজাখুরি প্রচারণা চলছে ফেসবুক আর বিভিন্ন ব্লগে। অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, এবিএম মূসা, ড. আকবর আলি খানের মতো বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও। সবচেয়ে বেশি এবং নিরন্তর অপপ্রচার চলেছে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে। তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আনন্দে ধন্য ও বিগলিত হয়ে আমার ফ্যানপেজে তাঁর সঙ্গের একটি ছবি সম্প্রতি আপলোড করেছি আমি। হতবাক হয়ে একদিন দেখি তার নিচে দু-একজন মন্তব্য লিখেছেন: এমন একজন (মুদ্রণ অনুপযোগী) মানুষের সঙ্গে কীভাবে ছবি তুললাম আমি! তাঁর মতো একজন নমস্য মানুষ সম্পর্কে কতটা ঘৃণ্য অপপ্রচার চললে কেউ ভাবতে পারে এমন!
ফেসবুকে কখনো কখনো অসাধারণ কোনো লেখা বা মন্তব্যও চোখে পড়ে। যেমন—আলী রীয়াজ, আজফার হোসেন বা বিবিসির মিজানুর রহমান খানের কারও কারও মন্তব্য খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতোও। কিন্তু ফেসবুক বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অপপ্রচারণাকারীদের অধিকাংশের ভাষায় কোনো যুক্তি, প্রামাণ্য তথ্য, এমনকি শালীনতা পর্যন্ত নেই। তাঁদের মধ্যে কিছু মেধাবী তরুণ আছেন। আছেন এমন ব্যক্তিরাও, যাঁদের কেউ ত্রাণের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কেউ অতীতে মাদক সেবনের জন্য দৈনিক পত্রিকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, কেউ অতীতে নারী নির্যাতনের মামলার আসামি ছিলেন, আবার কেউ কেউ নগণ্য পত্রিকায় অনুল্লেখ্য সাংবাদিকতা করছেন। জীবনের সব ব্যর্থতা আর হতাশার ক্রোধ মেটান তাঁরা সমাজের পরিচিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে যা-তা লিখে। পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থাকলে লেখা বেশি পঠিত হবে, এই চিন্তাও হয়তো কাজ করে তাঁদের অনেকের মধ্যে। এই সমাজের কিছু তরুণ, বই তাঁর গবেষণার সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই বলেই হয়তো ভিত্তিহীন নানা প্রচারণায় অংশ নিয়ে গালাগালের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন ফেসবুক বা ব্লগে।
গভীর অর্থে দেখলে অবশ্য ফেসবুক বা অন্যান্য ব্লগে এসব প্রচারণা দেখে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে সমাজের তরুণতর অংশ। আরও বাস্তব জীবনে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যেভাবে মিথ্যাচার করেন, তার প্রভাব তো পড়বেই তাঁদের ওপর। এই মিথ্যাচার সবচেয়ে বেশি চলে রাজনীতিতে। কখনো তা নিষ্ঠুরতা আর শালীনতার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। খালেদা জিয়ার জন্ম চা-বাগানে, শেখ হাসিনা নাস্তিক, ৫ মে হেফাজতের কর্মীরা গায়ে রং মেখে শুয়ে ছিলেন বা সেদিন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল কিংবা শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন তাঁরা জামায়াতের লোক, কাবা শরিফে দোয়া হয়েছে একজন যুদ্ধাপরাধীর জন্য—এসব মিথ্যাচার করেছেন বা একে উৎসাহিত করেছেন রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। মাঠের রাজনীতির কুশীলবেরা আরও বহুধাপ এগিয়ে চাঁদের বুকে সাঈদীর ছবি(!) আবিষ্কার করার গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে চালিয়েছেন নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ।
নিরন্তর রাজনৈতিক অপপ্রচারণাকে কখনো কখনো আবার মিথের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় এ দেশে। কারও যেন কোনো প্রমাণের দরকার নেই, দরকার নেই কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যেরও। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাসদের ৪০ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, খালেদা জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগের ২২ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে—কেউ কি আমরা কোনো প্রমাণ চেয়েছি এসবের? আমরা সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা দুই রাজনীতির শিবিরে বিভক্ত হয়ে বরং মিথ্যাচারের এই সংস্কৃতির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছি। আমরা একদল আওয়ামী লীগ বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার হলে তাতে অংশ নিই বা তার প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকি। আরেক দল বিএনপির ক্ষেত্রে একই আচরণ করি।
এমন একটি মিথ্যার সংস্কৃতিতে বাস করা সমাজে নতুন উপদ্রব হিসেবে এসেছে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন নামের একটি আইন। এই আইনে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, অধিকার তার ওয়েবপেজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ৫ মে হেফাজতের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে সরকারের অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছেন। এ অভিযানে আসলে কতজন নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে প্রচণ্ড বিভ্রান্তি আছে দেশে-বিদেশে। মাত্র কয়েক দিন আগে সারা বিশ্বে স্বনামধন্য পত্রিকা ইকোনমিস্ট বলেছে, ওই দিনের অভিযানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও মানবাধিকার সংস্থা বিভিন্ন সময়ে এ সংখ্যা ১১ থেকে শ-খানেক বলে উল্লেখ করেছে। সরকারের পুলিশ ৭ মে বলেছে, অভিযানে মারা গেছেন আটজন, তাঁদের একজন পুলিশ (দেখুন: প্রথম আলো, ৮ মে, ২০১৩), পরে বলেছে, একজনও মারা যায়নি অভিযানকালে! তার মানে হচ্ছে, প্রকৃত সত্য না জেনেই বলছে অধিকাংশ পক্ষ। তাহলে একমাত্র আদিলুরই কেন হবেন গ্রেপ্তার আর নির্যাতনের শিকার? আর তাঁর সংগঠন মিথ্যা বলেছে, এর প্রমাণ কী?
আদিলুর রহমান খান বা অধিকারের তথ্য মিথ্যা—এই প্রচারণা চালিয়ে তাঁর প্রতি সরকারের নির্যাতনকে সমর্থন করছেন সমাজের কিছু বরেণ্য ব্যক্তি পর্যন্ত। শেয়ারবাজার, রেল কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, গুম আর ক্রসফায়ার—কোনো কিছুর মধ্যে সরকারের কোনো মিথ্যাচার দেখেন না তাঁরা, দেখেন একটি মানবাধিকার সংগঠনের দায়িত্বপ্রসূত প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে।
এসব মানুষের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গিতে উৎসাহিত হয়েই হয়তো সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি আইনকে আরও কঠোরতর করার উদ্যোগ নিচ্ছে। আইনটির খসড়া সংশোধনী অনুসারে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশিত হলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে, বিনা জামিনে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখা যাবে, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। আইনটি অনুসারে গ্রেপ্তারের আগে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা—এটি নির্ধারণ করবে সরকার। অর্থাৎ খসড়া আইনটি পাস হলে সরকার ও তার পক্ষের লোকজনের বক্তব্য ‘সত্য’ আর ভিন্নমতাবলম্বী বা সমালোচকদের বক্তব্য ‘মিথ্যা’—এই অবস্থান নিয়ে চরম নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকবে সরকারের। আর তাই যদি হয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমেও, ভবিষ্যতে আমরা আর বহুপক্ষীয় মিথ্যা নয়, দেখব কেবল সরকারের অনুকূলে একপক্ষীয় মিথ্যাচার। কেমন হবে সেই সরকার—একদিন যদি হয় বিএনপি-জামায়াতের সরকার?
মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের তাই রুখে দাঁড়াতে হবে দলকানা মনোভাব বাদ দিয়ে। মিথ্যা সবচেয়ে ভয়ংকর হয় তা যখন অমিত শক্তিশালী সরকারের পক্ষে হয়, সরকারের সমালোচনাকারীদের বিপক্ষে হয়। মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব সরকারের সময় আমরা যদি এ বিষয়ে সচেতন না হই, তাহলে নতুন নতুন আইনের কবলে পড়ে এ দেশে মানবাধিকার আর সুশাসনের লড়াই চরমভাবে বিপন্ন হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments