নানা বিন্দু দিয়ে তৈরি গল্প by সৈয়দ গোলাম দস্তগীর
টু স্টোরিলাইন ফর অ্যান ইনস্টলেশন, ব্লোয়িং কালারস, লোনলিনেস, সোয়িং ফ্লাওয়ারসশিল্পী: হোশিনা টয়েমি |
ছবি তো ছবিই, তার কি কোনো গল্প থাকতে পারে? এর বিপরীত কথাও বলা যায়, এমন কোনো ছবি বা দৃশ্য আছে, যার কোনো গল্প নেই? আমাদের অক্ষরমালা কতগুলো চিহ্নের সমষ্টি। এই চিহ্নই তৈরি করে একেকটি গল্প।জাপানের শিল্প বহুকাল ধরে চিন্তা ও দার্শনিকতার বিশাল আধার। জাপানি শিল্পী হোশিনা টয়েমির ‘এখানেই সেখানে—যেখানেই এখানে’ শীর্ষক প্রদর্শনী সেই ঐতিহ্যকেই উপস্থাপন করছে। এই শিল্পীর অঙ্কনরীতি ‘ইয়োয়ে নোগু’ ও ‘সুমিয়ে’ ধারার অঙ্কনপদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুমিয়ে ধারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, এ পদ্ধতিতে শিল্পীকে পটে বর্ণ প্রয়োগের আগে ধ্যানস্থ হতে হয়। এ সময় তিনি কল্পনাকে দৃশ্যমান করেন মানসপটে। ফলে শিল্পীর পক্ষে বাহুল্য বর্জন করে সবল ভাষায় নিজের বক্তব্য পটে ধারণ করা সহজ হয়ে ওঠে।এই বিশেষ পদ্ধতিটির উদ্ভব চীনে, তাং সাম্রাজের সময়ে (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। আরও পরিশীলিত হয়ে সোং সাম্রাজ্যের (৯৬০-১২৭৯) সময়ে তা উৎকর্ষ লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এটি কোরিয়া ও জাপানের শিল্পধারার অন্যতম প্রধান অঙ্কনরীতি হয়ে ওঠে। এই রীতির অন্যতম প্রধান দর্শন হলো বস্তু নয়, বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তাকে অনুসন্ধান করা। এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম হয় বিচিত্র গল্পের।প্রদর্শনীতে হোশিনা টয়েমি এ রকম নানা গল্প এঁকেছেন পটে। কখনো কখনো ছবিতে বিশদ বর্ণনায় ব্যাপৃত হয়েছেন, যা সুমিয়ে রীতির চেয়ে ভারতীয় মোগল চিত্রকলায় বেশি দেখা যায়। আবার কখনো মাত্র একটি অবজেক্টেই ধারণ করেছেন সমগ্র ঘটনা।‘থ্রি স্টোরিলাইন ফর অ্যান ইনস্টলেশন’ শীর্ষক কাজে একটি পটে বিশদ বর্ণনা করেছেন শিল্পী। তাঁর ভাষায়, ‘উজ্জ্বল নক্ষত্রে বিস্মিত চোখ যেন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথিবী থেকে—সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের ওপরে ছিল একটি কালো কাক—এরপর আগুনে সমস্ত স্মৃতিই ধ্বংস হলো।’আবার গর্ভস্থ শিশুর ছবি এঁকে বলছেন, ‘আমি কিছুই শুনতে পাই না বলেই ডাক্তার বলছেন,
একধরনের ছত্রাক আলট্রাসাউন্ডকে কাজ করতে দিচ্ছে না।’ টু স্টোরিলাইন ফর অ্যান ইনস্টলেশন’ শীর্ষক ছবিতে তাঁর বক্তব্য, ‘অন্তর্বাস আকাশ থেকে নাচতে নাচতে এল। বর্ষাদিনে আমার প্রতিবিম্ব ছোট্ট ডোবার পানিতে।’ ছবিতে বলা শিল্পীর কথাগুলো অনেকটা কবিতার মতো। অন্যদিকে ‘মেমোরি অব এ বোটানিক্যাল গার্ডেন’ শিরোনামের কাজে আমরা দেখব ফুল ফোটা, ঝরে পড়াসহ নানা ঘটনা। প্রদর্শনীর একটি ছবি ‘ব্লোয়িং কালারস’ বিষয়ে আলোচনা না করলেই নয়। এখানে সাতজন একা একা কথা বলতে বলতে নানা গল্প সৃষ্টি করে। কখনো মনে হবে এঁরা বুদ্ধ, কখনো বা সাতজন ধ্যানী মানুষ। এর শিরোনাম হয়তো আমাদের এমন একটি চিন্তার জন্ম দিতে পারে, এঁরা সাত স্বর বা রঙের প্রতিনিধি। ‘রেইনিং’ শীর্ষক কাজটিতে হোশিনা টয়েমির কথা, ‘আমরা বৃষ্টি ও বৃষ্টির ঝরে পড়া নানা বিন্দু নিয়ে তৈরি একটি গল্প।’ ‘সোয়িং ফ্লাওয়ারস’ ছবিতে দেখা যায়, উড়ুক্কু দুটি মানুষ পাপড়িঝরা ফুলের বাগানে মৌমাছির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার ‘দ্য ট্যাটুড ক্যাট’ কাজটির মধ্যে দেখতে পাই, বিড়ালের গায়েও রয়েছে ট্যাটু। ‘ফলিং গ্লাস’ চিত্রে আবারও শিল্পী রচনা করেছেন কথা—গল্প, যা পাঠকের কাছে কবিতার মতো লাগতে পারে, ‘হঠাৎ আকাশ গাঢ় হলো আর লাল কাচের টুকরোগুলো পড়তে থাকল।’ এভাবে একই সঙ্গে শিল্পী যখন ছবি আঁকেন এবং গল্প বলেন, তখন এই বাক্যই অনুরণিত হয়, ‘a sord is not just a iron, it is spirit’। আর অবস্থানগত কারণে সে নিজের সত্তাতেই থাকে স্থিত, যা শুধু ঘটাতে পারে একটি রূপান্তর। হোশিনা টয়োমি জাপানের সমকালীন প্রধান শিল্পীদের অন্যতম। তিনি স্থাপনাশিল্প, নানা আর্ট প্রজেক্ট, ভাস্কর্য ও পাবলিক আর্টের মাধ্যমে জাপানে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের ধানমন্ডির গ্যালারিতে ৬৬টি কাজ নিয়ে শুরু হয়েছে তাঁর এই প্রদর্শনী। ১৭ আগস্ট শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত।
No comments