বিশ্বায়নের কাল- অধিকার এবং মানবাধিকাররক্ষীদের দায় by কামাল আহমেদ
লন্ডনের কাছেই সাসেক্সে একটি তেল
অনুসন্ধানের খননকাজের বিরোধিতাকারী পরিবেশবাদীদের এক বিক্ষোভ থেকে ১৯ আগস্ট
গ্রেপ্তার হলেন ব্রিটেনের বিরোধী রাজনৈতিক দল গ্রিন পার্টির এমপি
ক্যারোলাইন লুকাস এবং আরও জনা তিরিশেক আন্দোলনকারী।
ব্রিটেনে
আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কোনো এমপির গ্রেপ্তার হওয়ার এই ঘটনা বহু বছরের
মধ্যে এই প্রথম। রাজপথ অবরোধ করার কারণে এই নারী রাজনীতিক এবং তাঁর
সঙ্গীদের পুলিশ যখন তাঁর অবস্থান থেকে জোর করে উঠিয়ে নেয়, তখন
আইনবহির্ভূত কিছু হচ্ছে কি না অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা
হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি করতে দেখতে গেল কিছু মানবাধিকারকর্মী। দূর
থেকে দৃশ্যমান উজ্জ্বল রঙের জ্যাকেটধারী এসব পর্যবেক্ষক প্রতিটি মুহূর্তের
ঘটনাক্রম লিখে রাখছিলেন এবং কেউ কেউ তার ছবি তুলছিলেন। এর আগে লন্ডনে মে
দিবসের বিক্ষোভ এবং পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভেও অ্যামনেস্টি এবং লিবার্টির
পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতির বহু নজির রয়েছে।
নিজস্ব সূত্রে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের গুরুত্ব বৈশ্বিক সংগঠনগুলো ভালোই বুঝেছে। যে কারণে অ্যামনেস্টির মতো সংগঠন সম্ভাব্য হাঙ্গামার স্থান, বিশেষ করে বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার পাশাপাশি তাদের সদর দপ্তরে নিজস্ব সংবাদকক্ষ গড়ে তুলেছে, যেখানে সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ পেশাদারেরা পালাক্রমে বিশ্বের নানা প্রান্তের খবরাখবর সম্পাদনার পরই তা প্রকাশ করে থাকেন। বাংলাদেশেও মানবাধিকাররক্ষীরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। তাহলে, মিথ্যাচারের প্রবণতা কিছুটা কমলেও কমতে পারে।
অধিকার সম্পাদক আদিলুরকে গ্রেপ্তার এবং বিচারের আগেই গণমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁকে দোষী হিসেবে চিত্রিত করার পটভূমিতে প্রথম আলোয় ১৬ আগস্ট প্রকাশিত আমার মতামতের পক্ষে এবং বিপক্ষে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয় বিষয়টিতে আরও আলোচনা প্রয়োজন। আমার নিবন্ধটিতে হেফাজতের ৫ মের সমাবেশকে ঘিরে অধিকার-এর রিপোর্টের সত্যাসত্য নিয়ে কোনো মন্তব্য ছিল না। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে অধিকার-এর রিপোর্টে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার পরও কেন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন অধিকার কি দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে? সরকারের কাছে নিহত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা দেওয়ায় তাদের আপত্তি কী, এটা প্রমাণ করে না যে তাদের কাছে কোনো তালিকা নেই? এ ধরনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেগুলোর জবাব পেতে আমিও আগ্রহী। আমিও মনে করি যে ওই রিপোর্ট সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় অধিকারের ওপর বর্তায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এসব প্রশ্নের জবাব আদায়ে আইনের ভাষায় ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ (ডিউ প্রসেস) অনুসরণ করেছে? আদিলুরকে গ্রেপ্তারের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহারের আলামত রয়েছে। আদালতে পেশ করা অভিযোগের নথি অনুযায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা হয়েছে ১০ আগস্ট দুপুরে। কিন্তু সেদিন রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ৫৪ ধারায় সন্দেহের ভিত্তিতে (সাধারণত এই ধারায় গ্রেপ্তার করা হয় ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে সুবিধামতো মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে)। এরপর আদালতে হাজির করার আগ পর্যন্ত তাঁর আইনজীবীকে অভিযোগের বিষয়ে কিছু না জানানো ক্ষমতাধরদের অসৎ উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত বহন করে। মূল উদ্দেশ্য, অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবী অভিযোগ সম্পর্কে না জানলে রিমান্ডের বিরোধিতা করে হালে পানি পাবেন না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এভাবে ক্ষমতা অপব্যবহারের চেষ্টা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। যদিও মাঝেমধ্যে রাজনীতিকেরাই এর নিষ্ঠুরতার নির্মম শিকার হয়ে থাকেন (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তা বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়)।
অধিকার-এর রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য মিথ্যা কি না, সেটি এখন আদালতের বিচার্য বিষয়। অথচ আদালতের জন্য সেই বিচারের সুযোগটুকু না রেখেই গণমাধ্যমের একাংশ একজন ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তিকে ‘দোষী’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। এটি সাংবাদিকতার নীতিমালার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ? আদালতের বিচারকে প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য অভিযোগটির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি অথবা অস্বীকৃতির কথা তুলে ধরাই তো বস্তুনিষ্ঠতা। এটি আদিলুরের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আরও হাজার হাজার মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা—গুম, হত্যা, নির্যাতন, বেআইনি গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, রাজনৈতিক হয়রানি, সীমান্তে হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে অধিকারের বিভিন্ন মাসওয়ারি প্রকাশনার তথ্যসূত্র হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের কথা বলে। তার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো। হেফাজতের সমাবেশবিষয়ক তাদের রিপোর্টেও সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কে প্রচারিত বিভিন্ন ছবির কথা বলা হয়েছে। তাদের ওই রিপোর্টের একটি বড় সূত্র হচ্ছে ‘বাংলার চোখ’ নামের একটি ফটো এজেন্সি। কারণ, যত ছবি রিপোর্টের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তার সবই ওই সংস্থার। অধিকারের রিপোর্টের আরেকটি সূত্র হচ্ছে, তাদের কর্মীরা বিভিন্নজনের যেসব সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাঁরা। তাঁদের মধ্যে নিহত কয়েকজনের পরিবারের সদস্য, আহত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিক, বিভিন্ন ক্লিনিকের চিকিৎসক ও নার্স, ঢাকা মেডিকেলের মর্গের একজন কর্মী, অভিযানে অংশ নেওয়া র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তা, বিজিবির তথ্য কর্মকর্তা প্রমুখ। রিপোর্টটির তথ্যের আরেকটি উৎস হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের ৬ ও ৭ তারিখের ১৬টি লাশের বিবরণী এবং বিভিন্ন থানায় করা পুলিশি মামলার তালিকা।
বাংলাদেশে আরও যেসব মানবাধিকার সংস্থা এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও আছে, তাদের অধিকাংশেরই তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনের প্রক্রিয়াও প্রায় একই রকম। অধিকারের তথ্যগুলোর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগে এভাবে আর কোনো মানবাধিকার সংস্থার প্রকাশনা এভাবে নিবিড় ময়নাতদন্তের সম্মুখীন হয়নি। এনজিওগুলোর মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে অবশ্য এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিবছর, যখনই তারা বাংলাদেশের দুর্নীতির করুণ চেহারাটা সর্বসমক্ষে তুলে ধরে। অধিকারসহ অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো উপজাতীয় কিংবা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে অতীতে যেসব প্রতিবেদন বা পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সেগুলোর তথ্যসূত্র যাচাইয়ে কাউকে এতটা কঠোর হতে দেখা যায়নি। সুতরাং, এখন যে দৃষ্টান্ত তৈরি হলো, তাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে সন্দেহ নেই।
ফটোশপের অপব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কত ধরনের অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমকর্মীদের ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিন্তু তারপরও সোশ্যাল মিডিয়ার গুজবের পেছনে ছোটা বন্ধ হয়নি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যুর সময় ঢাকায় এ ধরনের করুণ ঘটনা আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। ফেসবুকে গুজবতাড়িত হয়ে শীর্ষস্থানীয় একাধিক টিভি চ্যানেলে কর্মরত তাঁর ছাত্ররাই তাঁর মৃত্যুর আগেই মারা যাওয়ার খবর প্রচার করে দিয়েছিলেন। পরে তাঁদের পরিবার থেকে ফোন করে সেই সংবাদটির প্রচার বন্ধ করাতে হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য নিজস্ব সূত্র থেকে যাচাই করার বিষয়টিতে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো কতটা সতর্ক, তা বলা মুশকিল। তবে জবাবদিহির দাবির কারণে তাদের এখন সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
দলকানা এবং ফরমায়েশি সাংবাদিকতায় নতুন নাম লিখিয়েছেন অথবা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন যাঁরা, তাঁরা অবশ্য শিগগিরই তাঁদের স্বভাব বদলাবেন, এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। ১৯ আগস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় সোহেল নামের একজন মাদ্রাসাছাত্রের ছবি ছাপিয়ে দাবি করা হয়েছে যে অধিকারের নিহতের তালিকায় থাকা ব্যক্তিটি বেঁচে আছেন। অথচ, অধিকারের রিপোর্টে মাত্র যে তিনজন নিহত এবং একজন আহতের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে ওই নামটি নেই। অধিকারের দাবি করা ৬১ জনের বাকিদের অপ্রকাশিত নাম পত্রিকাটির হাতে এসেছে, সেটাও পত্রিকাটি দাবি করেনি।
অধিকারের রিপোর্টে নিহত যে তিনজনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তাদের একজনের পরিবার অভিযোগ করেছে, পুলিশ একটি ঈদগাহে ওই নিহত ব্যক্তির জানাজা করতে দেয়নি এবং তাদের পরিবারের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করলে তাদের পরিবারের ওপর হুমকি আসার আশঙ্কা কি সত্যিই অমূলক? ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের হুমকিতে বাড়িছাড়া হওয়া লোকের সংখ্যা তো বাংলাদেশে কম নয়। আর যদি তা সরকার অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে একটি অসহায় পরিবারের ততোধিক অসহায় কিশোর লিমনকে কত দিন বাড়িছাড়া থাকতে হয়েছে, সেই একটি দৃষ্টান্তই কি যথেষ্ট নয়?
সরকারের কাছে তালিকা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি এবং সবকিছুর আগে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং তাদের তথ্যসূত্রগুলোর যে নিরাপত্তা তারা চেয়েছিল, তার কোনো জবাব না দিয়েই গ্রেপ্তার এবং মামলা দায়ের ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। আর যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিপক্ষ সরকার, সেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থে নিরপেক্ষ বিচারক প্রয়োজন, যেটা কেবল বিচার বিভাগীয় তদন্তেই সম্ভব। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্তই উদ্ঘাটন করবে ‘সত্য, পূর্ণ সত্য এবং সত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ সেই পথে না গিয়ে কূটনীতিকদের আইন শেখানোর চেষ্টায় ইমেজ উদ্ধারের সফল হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
নিজস্ব সূত্রে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের গুরুত্ব বৈশ্বিক সংগঠনগুলো ভালোই বুঝেছে। যে কারণে অ্যামনেস্টির মতো সংগঠন সম্ভাব্য হাঙ্গামার স্থান, বিশেষ করে বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার পাশাপাশি তাদের সদর দপ্তরে নিজস্ব সংবাদকক্ষ গড়ে তুলেছে, যেখানে সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ পেশাদারেরা পালাক্রমে বিশ্বের নানা প্রান্তের খবরাখবর সম্পাদনার পরই তা প্রকাশ করে থাকেন। বাংলাদেশেও মানবাধিকাররক্ষীরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। তাহলে, মিথ্যাচারের প্রবণতা কিছুটা কমলেও কমতে পারে।
অধিকার সম্পাদক আদিলুরকে গ্রেপ্তার এবং বিচারের আগেই গণমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁকে দোষী হিসেবে চিত্রিত করার পটভূমিতে প্রথম আলোয় ১৬ আগস্ট প্রকাশিত আমার মতামতের পক্ষে এবং বিপক্ষে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয় বিষয়টিতে আরও আলোচনা প্রয়োজন। আমার নিবন্ধটিতে হেফাজতের ৫ মের সমাবেশকে ঘিরে অধিকার-এর রিপোর্টের সত্যাসত্য নিয়ে কোনো মন্তব্য ছিল না। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে অধিকার-এর রিপোর্টে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার পরও কেন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন অধিকার কি দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে? সরকারের কাছে নিহত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা দেওয়ায় তাদের আপত্তি কী, এটা প্রমাণ করে না যে তাদের কাছে কোনো তালিকা নেই? এ ধরনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেগুলোর জবাব পেতে আমিও আগ্রহী। আমিও মনে করি যে ওই রিপোর্ট সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় অধিকারের ওপর বর্তায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এসব প্রশ্নের জবাব আদায়ে আইনের ভাষায় ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ (ডিউ প্রসেস) অনুসরণ করেছে? আদিলুরকে গ্রেপ্তারের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহারের আলামত রয়েছে। আদালতে পেশ করা অভিযোগের নথি অনুযায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা হয়েছে ১০ আগস্ট দুপুরে। কিন্তু সেদিন রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ৫৪ ধারায় সন্দেহের ভিত্তিতে (সাধারণত এই ধারায় গ্রেপ্তার করা হয় ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে সুবিধামতো মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে)। এরপর আদালতে হাজির করার আগ পর্যন্ত তাঁর আইনজীবীকে অভিযোগের বিষয়ে কিছু না জানানো ক্ষমতাধরদের অসৎ উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত বহন করে। মূল উদ্দেশ্য, অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবী অভিযোগ সম্পর্কে না জানলে রিমান্ডের বিরোধিতা করে হালে পানি পাবেন না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এভাবে ক্ষমতা অপব্যবহারের চেষ্টা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। যদিও মাঝেমধ্যে রাজনীতিকেরাই এর নিষ্ঠুরতার নির্মম শিকার হয়ে থাকেন (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তা বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়)।
অধিকার-এর রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য মিথ্যা কি না, সেটি এখন আদালতের বিচার্য বিষয়। অথচ আদালতের জন্য সেই বিচারের সুযোগটুকু না রেখেই গণমাধ্যমের একাংশ একজন ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তিকে ‘দোষী’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। এটি সাংবাদিকতার নীতিমালার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ? আদালতের বিচারকে প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য অভিযোগটির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি অথবা অস্বীকৃতির কথা তুলে ধরাই তো বস্তুনিষ্ঠতা। এটি আদিলুরের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আরও হাজার হাজার মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা—গুম, হত্যা, নির্যাতন, বেআইনি গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, রাজনৈতিক হয়রানি, সীমান্তে হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে অধিকারের বিভিন্ন মাসওয়ারি প্রকাশনার তথ্যসূত্র হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের কথা বলে। তার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো। হেফাজতের সমাবেশবিষয়ক তাদের রিপোর্টেও সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কে প্রচারিত বিভিন্ন ছবির কথা বলা হয়েছে। তাদের ওই রিপোর্টের একটি বড় সূত্র হচ্ছে ‘বাংলার চোখ’ নামের একটি ফটো এজেন্সি। কারণ, যত ছবি রিপোর্টের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তার সবই ওই সংস্থার। অধিকারের রিপোর্টের আরেকটি সূত্র হচ্ছে, তাদের কর্মীরা বিভিন্নজনের যেসব সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাঁরা। তাঁদের মধ্যে নিহত কয়েকজনের পরিবারের সদস্য, আহত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিক, বিভিন্ন ক্লিনিকের চিকিৎসক ও নার্স, ঢাকা মেডিকেলের মর্গের একজন কর্মী, অভিযানে অংশ নেওয়া র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তা, বিজিবির তথ্য কর্মকর্তা প্রমুখ। রিপোর্টটির তথ্যের আরেকটি উৎস হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের ৬ ও ৭ তারিখের ১৬টি লাশের বিবরণী এবং বিভিন্ন থানায় করা পুলিশি মামলার তালিকা।
বাংলাদেশে আরও যেসব মানবাধিকার সংস্থা এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও আছে, তাদের অধিকাংশেরই তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনের প্রক্রিয়াও প্রায় একই রকম। অধিকারের তথ্যগুলোর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগে এভাবে আর কোনো মানবাধিকার সংস্থার প্রকাশনা এভাবে নিবিড় ময়নাতদন্তের সম্মুখীন হয়নি। এনজিওগুলোর মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে অবশ্য এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিবছর, যখনই তারা বাংলাদেশের দুর্নীতির করুণ চেহারাটা সর্বসমক্ষে তুলে ধরে। অধিকারসহ অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো উপজাতীয় কিংবা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে অতীতে যেসব প্রতিবেদন বা পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সেগুলোর তথ্যসূত্র যাচাইয়ে কাউকে এতটা কঠোর হতে দেখা যায়নি। সুতরাং, এখন যে দৃষ্টান্ত তৈরি হলো, তাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে সন্দেহ নেই।
ফটোশপের অপব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কত ধরনের অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমকর্মীদের ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিন্তু তারপরও সোশ্যাল মিডিয়ার গুজবের পেছনে ছোটা বন্ধ হয়নি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যুর সময় ঢাকায় এ ধরনের করুণ ঘটনা আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। ফেসবুকে গুজবতাড়িত হয়ে শীর্ষস্থানীয় একাধিক টিভি চ্যানেলে কর্মরত তাঁর ছাত্ররাই তাঁর মৃত্যুর আগেই মারা যাওয়ার খবর প্রচার করে দিয়েছিলেন। পরে তাঁদের পরিবার থেকে ফোন করে সেই সংবাদটির প্রচার বন্ধ করাতে হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য নিজস্ব সূত্র থেকে যাচাই করার বিষয়টিতে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো কতটা সতর্ক, তা বলা মুশকিল। তবে জবাবদিহির দাবির কারণে তাদের এখন সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
দলকানা এবং ফরমায়েশি সাংবাদিকতায় নতুন নাম লিখিয়েছেন অথবা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন যাঁরা, তাঁরা অবশ্য শিগগিরই তাঁদের স্বভাব বদলাবেন, এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। ১৯ আগস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় সোহেল নামের একজন মাদ্রাসাছাত্রের ছবি ছাপিয়ে দাবি করা হয়েছে যে অধিকারের নিহতের তালিকায় থাকা ব্যক্তিটি বেঁচে আছেন। অথচ, অধিকারের রিপোর্টে মাত্র যে তিনজন নিহত এবং একজন আহতের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে ওই নামটি নেই। অধিকারের দাবি করা ৬১ জনের বাকিদের অপ্রকাশিত নাম পত্রিকাটির হাতে এসেছে, সেটাও পত্রিকাটি দাবি করেনি।
অধিকারের রিপোর্টে নিহত যে তিনজনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তাদের একজনের পরিবার অভিযোগ করেছে, পুলিশ একটি ঈদগাহে ওই নিহত ব্যক্তির জানাজা করতে দেয়নি এবং তাদের পরিবারের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করলে তাদের পরিবারের ওপর হুমকি আসার আশঙ্কা কি সত্যিই অমূলক? ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের হুমকিতে বাড়িছাড়া হওয়া লোকের সংখ্যা তো বাংলাদেশে কম নয়। আর যদি তা সরকার অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে একটি অসহায় পরিবারের ততোধিক অসহায় কিশোর লিমনকে কত দিন বাড়িছাড়া থাকতে হয়েছে, সেই একটি দৃষ্টান্তই কি যথেষ্ট নয়?
সরকারের কাছে তালিকা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি এবং সবকিছুর আগে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং তাদের তথ্যসূত্রগুলোর যে নিরাপত্তা তারা চেয়েছিল, তার কোনো জবাব না দিয়েই গ্রেপ্তার এবং মামলা দায়ের ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। আর যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিপক্ষ সরকার, সেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থে নিরপেক্ষ বিচারক প্রয়োজন, যেটা কেবল বিচার বিভাগীয় তদন্তেই সম্ভব। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্তই উদ্ঘাটন করবে ‘সত্য, পূর্ণ সত্য এবং সত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ সেই পথে না গিয়ে কূটনীতিকদের আইন শেখানোর চেষ্টায় ইমেজ উদ্ধারের সফল হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments