গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎঃ আমার শংকা by ড. মুহাম্মদ ইউনূস
খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমার মত দেশের অনেকের, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গরীব মহিলাদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ১৫মে, ২০১২ তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ক নানা বিষয়ে সুপারিশ দেবার জন্য চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন (কমিশন অব ইনকোয়ারি) করে দিয়েছে। কমিশনকে তিনমাস সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করার জন্য।
এই তদন্ত কমিশন গঠন করে আমরা একটা রেকর্ড স্থাপন করলাম। নোবেল পুরস্কারের একশ’ দশ বছরের ইতিহাসে মোট বিশটি নোবেল জয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের উপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে। আমাদের ইতিহাসে এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের উপর তদন্ত কমিশন কেন?
সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরীবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি পেলো সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা, গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার উপর তদন্ত চালাতে হবে। এ পর্যন্ত যত তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে সেগুলি বড় রকমের অঘটন ঘটার পর মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগার কারণে সরকার তদন্তকমিশন গঠন করে তার তদন্ত করেছে। তদন্ত কমিশন গঠণের আইনটাও এ ধরনের পরিস্থিতিকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল।
এই কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদকাল পর্যালোচনা করে তারা সুপারিশ/মতামত দেবে। এই মেয়াদের আগাগোড়া আমি প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করে এসেছি। ২০১০ সাল পরবর্তী সময়টাকে কমিশনের বিবেচনার বাইরে রাখার কারণ বুঝতে পারলাম না। ২০১০ সালের পর কি গ্রামীণ ব্যাংকের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে?
তদন্ত কমিশনের কাছে সাধারণত চাওয়া হয় ঘটনা-উত্তর বিষয়ের কারণ ও সমাধান। এই তদন্ত কমিশনের কাছে চাওয়া হয়েছে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে তার সুবিস্তৃত কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানের মৌলিক বিষয়গুলির ভালমন্দ যাচাই করে ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের দায়িত্ব। মাত্র তিনমাস সময়ের মধ্যে স্বল্প লোকবল নিয়ে এই বিশাল দায়িত্ব পালন করা তদন্ত কমিশনের জন্য একটা কঠিন কাজ হবে। সময় স্বল্পতার কারণে কমিশন যদি ভুল পরামর্শ দিয়ে ফেলে তার পরিণতি বাংলাদেশের গরীব মানুষের জন্য মর্মান্তিকও হতে পারে।
এই ধরনের কাজ সাধারণত সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সেরা গবেষকদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে দেয়া হয়। যাঁরা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, পরিচালনা করেছেন, যাঁরা প্রতিষ্ঠানের উপকারভোগী, যাঁরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত তাঁদের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে বহু যুক্তিতর্ক দিয়ে পরিচালনা পর্ষদের বিবেচনার জন্য এই প্রতিবেদন পেশ করা হয়। ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য অংশগুলি প্রতিষ্ঠানের চলমান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত না-করে যত্নের ধাপে ধাপে প্রয়োগ করা হয়।
এই তদন্ত কমিশনের সময়সীমা দেখে মনে হতে পারে ছুরি-কাঁচি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে কাজে নামা ছাড়া তাদের গতি নেই।
গ্রামীণ কোম্পানি
কমিশনের কার্যপরিধিতে গ্রামীণ নামের কোম্পানিগুলি নিয়ে সরকারের অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নগুলি পড়লে মনে হয় হয়তো সরকারের ধারণা যে কোম্পানিগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় সৃষ্টি হয়েছে, অথচ কোম্পানিগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনে নেই। আমি বহুবার বলেছি, এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা খুবই সহজ। একটা আন্তর্জাতিক মানের অডিট ফার্মকে গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেনের ইতিহাস বের করতে দিলে তারা সব কথা বের করে নিয়ে আসবে। এর জন্য পুরাদস্তুর তদন্ত কমিশন বসানোর দরকার কি? গ্রামীণ ব্যাংক এসব কোনো কোম্পানির মালিক কিনা, গ্রামীণ ব্যাংক এগুলি প্রতিষ্ঠা করেছে কিনা এটা দেখার জন্য এত বড় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দরকার কি?
আমি নিজের উদ্যোগে বহু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছি। আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলির নামের সঙ্গে আমি ‘গ্রামীণ’ নাম ব্যবহার করে এসেছি। এই প্রতিষ্ঠানগুলির বেশীর ভাগই হলো ‘মুনাফার জন্য নয়’ এমন প্রতিষ্ঠান। আইন অনুসারে এদের কোনো ‘মালিক’ নেই। কোম্পানি আইনের সেকশন ২৮ দিয়ে বেশীর ভাগ কোম্পানিগুলি সৃষ্ট। এগুলিতে শেয়ার বিক্রি করার ব্যবস্থা থাকে না (নন-স্টক), এগুলি থেকে কেউ মুনাফা পায় না, যেহেতু কারো এতে মালিকানা নেই, এবং এগুলি স্পন্সরদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দ্বারা সীমিত, অর্থাৎ কোম্পানি দায় দেনা শোধ করতে না পারলে স্পন্সররা ব্যক্তিগতভাবে তাদের দেয়া গ্যারান্টি পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। কাজেই এমন প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা থাকারও প্রশ্ন আসে না। আর কিছু আছে মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান। মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মালিক হচ্ছে এক বা একাধিক ‘মুনাফার জন্য নয়’ এমন প্রতিষ্ঠান। এখানেও গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা থাকার কোন অবকাশ নেই।
গ্রামীণ ব্যাংক নিজে কোন প্রতিষ্ঠান করেনি কারণ গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের কোন ক্ষমতা ব্যাংককে দেয়া হয়নি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি সৃষ্টিরও কারণ আছে। গরীবদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ঋণ ছাড়াও আরো অনেক সমস্যার সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। শিক্ষার সমস্যা (গ্রামীণ শিক্ষা), স্বাস্থ্যের সমস্যা (গ্রামীণ কল্যাণ), মার্কেটিং এর সমস্যা (গ্রামীণ চেক), কৃষির সমস্যা (গ্রামীণ কৃষি), মৎস্য ও পশুপালন সমস্যা (গ্রামীণ মৎস্য), প্রযুক্তির সমস্যা (গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কমুনিকেশান্স), বীমার সমস্যা (গ্রামীণ ব্যবসা বিকাশ) বিদ্যুতের সমস্যা, চুলার সমস্যা (গ্রামীণ শক্তি), ইত্যাদি। প্রতিটি সমস্যার মোকাবেলার জন্য একটি করে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছি। যখনি সমস্যার মুখোমুখি হতে চেয়েছি তার সমাধানের জন্য একটা পৃথক কোম্পানি সৃষ্টি করেছি। এমনভাবে করেছি যাতে কোম্পানি নিজের আয়ে নিজে চলতে পারে। পরমুখাপেক্ষি হয়ে যেন কোম্পানিকে থাকতে না হয়। একটি কোম্পানির পতন হলে সে-যেন আর পাঁচটি কোম্পানিকে টেনে নিচে নামিয়ে ফেলতে না-পারে। প্রতিটি কোম্পানিই উদ্ভাবনমূলক কোম্পানি। আগে কোনদিন কাজ করা হয়নি এমনভাবে, নতুন ভঙ্গীতে, নতুন কনসেপ্ট দিয়ে সমস্যার সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এদের মধ্যে অনেকগুলি কোম্পানি পৃথিবীতে দৃষ্টান্তমূলক কোম্পানি হিসেবে ইতিমধ্যেই দাঁড়াতে পেরেছে। গ্রামীণ টেলিকমের মাধ্যমে গ্রামীণ ফোনের মোবাইল ফোন গরীব মহিলাদের হাতে পৌঁছানোর কনসেপ্ট সারা পৃথিবীর টেলিকম জগতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর সৃষ্টি করেছে। গ্রামীণ শক্তি সৌর শক্তির মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ শক্তির মাধ্যমে এবছরই ১০ লক্ষ গ্রামীণ পরিবারে সৌরবিদ্যুৎ পৌছানো সম্পন্ন হবে। দৈনিক গড়ে এক হাজার নতুন পরিবারে সৌরশক্তি স্থাপন করছে এই কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলিতে কারো ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। এগুলি হলো ‘‘ট্রাস্টের’’ মত প্রতিষ্ঠান। মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। কারো জন্য মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে এইসব কোম্পানি সৃষ্টি করা হয়নি। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি।
গ্রামীণ বা অন্য কোন নামের কোন প্রতিষ্ঠানে আমার কোন শেয়ার বা মালিকানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংকেও আমার কোন শেয়ার নেই। কাজেই কোন কোম্পানির কোন মুনাফার অংশ আমার কাছে আসার কোন সুযোগ কখনো ছিল না, আজও নেই। কোন গ্রামীণ কোম্পানির বোর্ড মিটিং-এ উপস্থিতি বা পরিচালনার জন্য আমি কোন সম্মানী ব ভাতা কোন সময় নেইনি।
কমিশনের কার্যপরিধির আরেকটি বিষয় হলোঃ ‘গ্রামীণ’ প্রতিষ্ঠানগুলির মালিকানার উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইন কানুনগুলি খতিয়ে দেখা। (What are the succession rules for ownership and management of these institution). মজার কথা হলো এর প্রত্যেকটি কোম্পানিই কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। নিবন্ধনকৃত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকেই তার পরিচালনা পরিষদের গঠন ও পুনর্গঠনের নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট করা থাকে। শেয়ারের উত্তরাধিকার কিভাবে নির্ধারণ করবে সেটার জন্য দেশের প্রচলিত আইনই ত যথেষ্ট হবার কথা। বাবার শেয়ার ছেলেমেয়েরা পাবে- এরকমই ত হয়। তাছাড়া গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলিতে যখন শেয়ারের বালাই নেই সেখানে মালিকানার উত্তরাধিকার কিভাবে প্রাসঙ্গিক হবে, কিংবা অর্থবহ হবে, সেটাও বুঝতে পারছি না। একেবারে তদন্ত কমিশন বসিয়ে এখন মালিকানার উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করার প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াতে এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের মনে ভুল চিন্তা জেগে উঠা কি অন্যায় হবে?
তদন্ত কমিশনের কার্যপরিধি দেখলে মনে হবে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে সরকারের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ। একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানার উত্তরাধিকার (এমন কি সে প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমালিক যদি থেকেও থাকে) তা নিয়ে সরকারকে কেন এত চিন্তিত হতে হলো যে তার জন্য একটা তদন্ত কমিশনকে দায়িত্ব দিতে হলো সেটা সহজে বোধগম্য হচ্ছে না। মালিকানার যেসম্পর্ক এগুলির প্রতিষ্ঠালগ্নে ছিল না, যেসম্পর্ক এখনও নেই, বাংলাদেশ ব্যাংকের বহু বছর ধরে করে যাওয়া অডিট রিপোর্টেও কোনো দিন যার উল্লেখ করা হয়নি, আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের মেয়াদেও যার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন জাগেনি, সেই সম্পর্ক উদঘাটনের জন্য পুরো দস্তুর একটি তদন্ত কমিশন বসানোতে অবাক লাগারই কথা। বিশেষ করে যে কমিশনের কর্মপদ্ধতি এবং সুপারিশসমূহ দেশে এবং বিদেশে বহুলভাবে এবং বহুদিন ধরে আলোচিত হতে থাকবে।
পটভূমি
গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। চট্রগ্রামের জোবরা গ্রামে। ৮৫৬ টাকা নিজের পকেট থেকে ঋণ দিয়ে। এরপর আমি জামানতকারী হয়ে জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ঋণ দেয়া শুরু করলাম। ১৯৭৮ সালে কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আনিসুজ্জামানের সহযোগিতায় এটাকে রূপান্তরিত করা হলো কৃষি ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে। আমার প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি আমার তত্ত্বাবধায়নে পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠা করে দিলেন জোবরা গ্রামে। নাম দেয়া হলো ‘কৃষি ব্যাংক, পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’। এর পরের বছর ১৯৭৯ সালে এটা আরো বৃহত্তর আকার ধারণ করলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর জনাব গঙ্গোপাধ্যায়ের আগ্রহে, ও আমার প্রস্তাবে। কৃষি ব্যাংকের প্রকল্প থেকে এবার হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকল্প। পুরো টাংগাইল জেলা জুড়ে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হলো। সকল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক এই প্রকল্পের অংশীদার হলো। প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় করলাম টাংগাইল জেলায়। এজন্যে আমি আকুর টাকুর পাড়ায় বসবাস শুরু করি। এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত টাংগাইলের আকুর টাকুর পাড়াতেই কাটালাম। এই প্রকল্প পাঁচ জেলায় সম্প্রসারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে আমার অমত সত্ত্বেও প্রধান কার্যালয় ঢাকায় শ্যামলীতে স্থানান্তরিত করলাম। ১৯৮৩ সালে আমার প্রস্তাবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতের উৎসাহে এবং রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের সমর্থনে ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩’ প্রণয়ন ও জারী করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প এবার ‘গ্রামীণ ব্যাংকে’ রূপান্তরিত হলো। নতুন আইন কাঠামোতে ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস নিয়ে আমি ঘোরতর আপত্তি তুললাম। এতে সরকারের মালিকানা রাখা হয়েছে ৬০%। অর্থাৎ এটাকে সরকারী ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমি এই কাঠামো নিয়ে অগ্রসর হতে নারাজ হলাম। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করলেন যে তিনি শিগগিরই মালিকানা পাল্টে দিয়ে একে বেসরকারী ব্যাংক বানিয়ে দেবেন। কিন্তু সে কাজটি করার সুযোগ তিনি পেলেন না। তিনি এর আগে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে গেলেন। তাঁর উত্তরসূরি জনাব সায়ীদুজ্জামান সে কাজটি করে দিলেন ৮ জুলাই ১৯৮৬ সালে। মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন করে অধ্যাদেশ সংশোধন করে দিলেন। এবার মালিকানা হলো ৭৫% গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতাদের, ২৫% সরকারের। এই অনুসারে বোর্ডের গঠন ও পরিবর্তন হলো। বোর্ডে ৯ জন ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধি, ৩ জন সরকারের, পদাধিকার বলে থাকবেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ৩১শে জুলাই ১৯৯০ সালে আরেকটি সংশোধন হলো। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে পরিচালনা পর্ষদ- সরকার নয়। ১৯৯০ সাল থেকে এপর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক এভাবেই চলে আসছে। বর্তমানে ঋণগ্রহীতাদের শেয়ারের অংশ ৯৭ শতাংশ। সরকার ৩ শতাংশ।
সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে চলে আসার কারণে হচ্ছে সরকার শুরুতে যে মূলধন দিয়েছিল তার পরিমাণ আর কখনো বাড়ায়নি। এদিকে ঋণগ্রহীতাদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। তাঁরা প্রত্যেকে শেয়ার কিনেছেন। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। একজন ঋণগ্রহীতার সঞ্চয়ী হিসাবে টাকার পরিমাণ ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে তিনি ১০০ টাকা দিয়ে একটা শেয়ার কিনতে পারেন এবং তিনি কিনেনও। ফলে ঋণগ্রহীতাদের শেয়ারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এই কারণেই তাদের শেয়ারের পরিমাণ ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদি মূলধনের পরিমাণ না বাড়ায়, আর ঋণগ্রহীতাদের শেয়ারের পরিমাণ যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তবে সরকারের শেয়ারের আনুপাতিক অংশ ক্রমান্বয়ে আরো কমে যেতে থাকবে।
৮৫৬ টাকা দিয়ে যে উদ্যোগের শুরু হয়েছিল এখন সে ব্যাংক ৮৪ লাখ ঋণগ্রহীতাকে বছরে বারো হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। ঋণগ্রহীতাদের নিজস্ব সঞ্চয়ী তহবিলে এই মুহূর্তে জমা আছে সাত হাজার কোটি টাকা। গরীব মহিলারা নিজস্ব সঞ্চয়ী আমানতে সাত হাজার কোটি টাকা জমা রেখেছে শুধু তাই নয়, এটাকার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। তাদের নিজস্ব পেনশন ফান্ড আছে। তাদের ছেলেমেয়েদেরকে পৌনে তিনশ’ কোটি টাকা শিক্ষা ঋণ দিয়েছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। প্রতি বছর আরো শিক্ষাঋণ দিয়ে চলেছে।
১৯৯০ সালের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধনগুলি করে ব্যাংকের মালিকানা ঋণগ্রহীতাদের হাতে তুলে দেওয়ার কারণে এবং সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পরিচালনা পর্ষদের হাতে ন্যস্ত করার কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক একটি মজবুত ও সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছে।
গ্রামীণ ব্যাংককে অনেকে অন্যান্য ব্যাংকের মত মনে করেন বলে এর সম্বন্ধে ভুল সিদ্ধান্তে চলে আসেন। তারা মনে করেন এই ব্যাংকের একমাত্র বৈশিষ্ট হচ্ছে যে তারা ছোট অংকের টাকা ঋণ দেয়। তা মোটেই নয়। এটা পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যা বিন্দুমাত্র জামানত না নিয়ে চলে। এতে কোন জমাজমির দলিল লাগে না। এই ব্যাংক তার সেবা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়। প্রতি সপ্তায় তার দোর গোড়ায় গিয়ে তার কাছ থেকে ঋণের কিস্তি নিয়ে আসে। কাউকে ব্যাংকের অফিসে এসে টাকা জমা দিতে হয় না। একটা ঋণ শোধ হলে আবার ঋণ নিতে কোন সময় লাগে না। ঋণগ্রহীতা মারা গেলে কিংবা তার স্বামী মারা গেলে অবশিষ্ট ঋণ আর পরিশোধ করতে হয় না। অথচ আবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ঋণ নিতে পারেন। ঋণগ্রহীতা ইন্তেকাল করলে জানাজার জন্য অনুদান পায়। শাখার ম্যানেজারকে জানাজায় উপস্থিত থাকতে হয়। সকল ঋণগ্রহীতার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ঋণ দেয়া হয়। প্রত্যেক ঋণগ্রহীতা নিজেই ব্যাংকের মালিক। এটা জগতের মূল ব্যাংকিং কর্মপদ্ধতির একেবারে উল্টা কর্মপদ্ধতি। এজন্যই গ্রামীণ ব্যাংক গরীব মহিলাদের কাছে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যেতে পেরেছে। এজন্যই এই ব্যাংকের এত গুরুত্ব।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে তদন্ত কমিশনের করণীয়
তদন্ত কমিশনের যে কার্যপরিধি দেয়া হয়েছে তাতে শংকা জাগে যে সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে চায়। কমিশনের কার্যপরিধিতে আছে:
ক. ব্যাংকের শুরু থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদে এর কর্মক্ষমতা, দুর্বলতা এবং এর সামনে প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করা।
খ. ব্যাংকের সুশাসন, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ প্রদান করা।
গ. গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস, বোর্ড প্রতিনিধিত্ব, বোর্ড সদস্যদের যোগ্যতা নির্ধারণ সম্পর্কে তাদের মতামত দেয়া।
কর্মদক্ষতা, দুর্বলতা যাচাই করার মাপকাঠি কী হবে?
কার্যপরিধির যে অংশে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মদক্ষতা, দুর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা যাচাই করার কথা বলা হয়েছে সে সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন সবার মনে জাগবে। কমিশন কোন মাপকাঠিতে এই বিচার করবে? তারা কি ঋণ আদায়ের হার, সুদের হার, ব্যাংকের লাভ-লোকসান, কর্মী প্রতি কতজন ঋণগ্রহীতা দেখাশোনার দায়িত্ব, এম.আই.এস, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রশাসনিক দক্ষতা, কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা, অর্থ সংস্থান, বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি, কতজন দরিদ্র মহিলার কাছে ঋণ সুবিধা নিয়ে যেতে পেরেছে, তাদের মধ্যে কত পরিমাণ সঞ্চয় সৃষ্টি করতে পেরেছে এগুলি বিচার করবে, নাকি অন্য কোনো মাপকাঠি নিয়ে আসবে? তারা কার সঙ্গে তুলনা করে তাদের মতামত স্থির করবে? তারা কি কাল্পনিক একটি যোগ্যতা স্থির করে তার সঙ্গে বিচার করে দেখবে, নাকি বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করে গ্রামীণ ব্যাংকের অবস্থান নির্ণয় করবে। নাকি তারা গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু একটি ব্যাংক সেকারণে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করে দেখবে- যেমন, কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, বা কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংক।
বাস্তবতার নিরিখে যাচাই না করে মনগড়া একটা মতামত দিতে গেলে কমিশনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এটা তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংক অডিট ও পরিদর্শন করে। এ জন্য কেনুদ্রীয় ব্যাংকে এর একটি সুনির্দিষ্ট বিভাগ আছে। বহু বছর ধরে ক্রমাগতভাবে তারা এ কাজ করে আসছে। তাদের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের ভাল মন্দ সব খবর জমা আছে। তাদের নিষ্ঠাবান দক্ষ কর্মকর্তারা বহু বছর ধরে প্রতিবছর শাখায় শাখায় গিয়ে, প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অনুসন্ধান চালিয়ে এমন কোনো চাঞ্চল্যকর খবর তুলে ধরেনি যে যার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক বেকায়দায় পড়ে গেছে। তারা প্রতিবছর যেসব বিষয়ে আপত্তি তোলেন গ্রামীণ ব্যাংক তার ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। তারা বছরের পর বছর জানিয়ে এসেছে যে তাদের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে অনিষ্পত্তিকৃত কোন বিষয় অবশিষ্ট নেই।
একবার বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি তুলেছিল।
২০০০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম আমার অবসর গ্রহণ করার বয়সসীমা নিয়ে প্রশ্ন উথ্থাপন করে। আমরা বুঝালাম যে গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ম নীতিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য কোন বয়সসীমা নির্ধারণ করা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক জানালো যে আপনারা আপনাদের সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে আসুন আমরা পরীক্ষা করে দেখব। কাগজপত্র দেয়ার পর তারা একটা যৌথ সভার ব্যবস্থা করল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এ বিষয়ে বৈঠক করলেন জানুয়ারী ১৫, ২০০১ সালে। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল যে গ্রামীণ ব্যাংক কয়েকটি দলিলের কপি সরবরাহ করলে তাদের আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। গ্রামীণ ব্যাংক তা সরবরাহ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন এই আপত্তিটি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গ্রহণ করে তখন আমার বয়স ৬১ বছর ৬ মাস। আমার বয়স ৬০ পার হলেও সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ঘটনা-উত্তর অনুমোদন নেবার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। পরবর্তী বছরসমূহের অডিট প্রতিবেদনে অনিষ্পত্তিকৃত বিষয়সমূহের মধ্যেও আর কোন দিন এই বয়সসীমার প্রশ্নটি আর তোলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে প্রশ্নটি তুলেছিল। আমরা আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি। তারা তাতে সন্তুষ্ট হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংক জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রতি বছর দেশের সব চাইতে খ্যাতনামা দুইটি অডিট ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষিত হয়ে এসেছে। তাঁরা আমাদের হিসাবপত্র এবং ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানের বলে বরাবর আমাদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে এসেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের সুশাসন, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ চাওয়া হয়েছে তদন্ত কমিশনের কাছে।
এত বছর পর, এত অডিট রিপোর্টের পর, এত গবেষণার পর, এত পুরস্কারের পর, এত সম্মান লাভের পর, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে হঠাৎ সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠাতে আমার মত অনেক মানুষ নিশ্চয়ই বিচলিত বোধ করবে- বিশেষত আমাদের মত দেশে, যেখানে এই গুণাবলীগুলির অনুপস্থিতি নিয়ে বিচারে বসলে যারা অনায়াসে তালিকার শীর্ষস্থানগুলি দখল করে রাখবে তাদের ব্যাপারে, কোন তদন্ত কমিশন গঠন না করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি সরকারের এই আগ্রহ অনেককে বিস্মিত করেছে। কমিশনের কার্যপরিধি যেভাবে লেখা হয়েছে সাদা চোখে সেভাবে পড়লেই চলবে, নাকি অন্য কোনো বিশেষ চশমা দিয়ে পড়তে হবে, সেটা নিয়েও অনেক পাঠক দোটানায় পড়তে পারেন।
যে চারজন সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে আমার মত অনেকে মনে করতে পারেন। তাঁরা যদি ক্ষুদ্র-ঋণ জগতের সঙ্গে পরিচিত না-হন তাহলে সমস্যাটা তাঁদের জন্য আরো জটিল হয়ে পড়বে।
ক্ষুদ্রঋণের জন্ম বাংলাদেশে হলেও এই কর্মকাণ্ড এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে ধনী দরিদ্র এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চলছে না। এর ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে এ ক্ষেত্রে বহু বিশেষজ্ঞের জন্ম হয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিষয়ে ডিপার্টমেন্ট সৃষ্টি হয়েছে, বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। বহু ভাষায় বহু প্রকাশনা একে কেনুদ্র করে প্রকাশিত হয়। বহু অধ্যাপক অধ্যাপনা করেন। এই কর্মসূচি পরিচালনা করে পৃথিবীজুড়ে বহুজন খ্যাতি অর্জন করেছেন। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশ অন্যান্য অনেক দেশ থেকে এগিয়ে। এদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করে পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন এমন অনেক ব্যক্তিত্ব এখানে আছেন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে, গবেষণা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, অনেক জার্নালে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের উপর নজরদারি করার দায়িত্ব পালন করে। তাছাড়া ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিসমূহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পৃথক রাষ্ট্রীয় সংস্থা মাইক্রোফাইনান্স রেগুলেটরি অথরিটি রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলিতে অর্থ সরবরাহ করার জন্য বহু বছরের মূল্যবান অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান পি,কে,এস,এফ রয়েছে। এত গবেষক, এত প্রশাসক, এত বিশেষজ্ঞ থাকতে এই চারজনের উপর এতবড় দায়িত্ব কেন চাপানো হলো এটা বুঝা বড় কষ্টকর।
সরকার কমিশনের সামনে যেসব বিষয় উপস্থাপন করেছেন তাতে একটা দুশ্চিন্তা মনে জাগে যে, সরকার হয়তো চাইছেন গ্রামীণ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্বল’ এটা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ তাকে বলুক। কারণ সরকার চাইছে গ্রামীণ ব্যাংক যেভাবে চলছে সেভাবে না-চলুক। সরকারের নিজস্ব চিন্তা অনুসারে চলুক। সরকারের চিন্তাটা এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনার একটা ব্যবস্থা করার সুযোগ হোক।
বর্তমান আইনে সে সুযোগ নেই। কারণ বর্তমান আইন অনুসারে এটা মালিকদের সিদ্ধান্তে চলে। সরকারের সিদ্ধান্তে চলতে হলে তার মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন করা দরকার। সরকার হয়তো আশা করছেন যে, কমিশন এরকম একটা সুপারিশ তাঁদেরকে দেবে। মালিকানা পরিবর্তন হলে বোর্ড পরিবর্তন হবে। তার ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হবে।
মালিকানা পরিবর্তন না করেও সরকার এমনভাবে আইন সংশোধন করতে পারে যে বোর্ডের সর্বময় ক্ষমতা আর থাকবে না। বোর্ড যেমনি আছে তেমনি থাকবে, কিন্তু সকল ব্যাপারে তাকে সরকারের নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
কার্যপরিধি পড়ে এধরনের শংকা মনে জাগে। আমি আশা করবো যে আমার এই সকল শংকা সম্পূর্ণ অমূলক প্রমাণিত হবে। তবু সময় থাকতে শংকাগুলি সবার সামনে নিয়ে আসা উচিত মনে করে বিষয়গুলি তুলে ধরছি।
২৩শে এপ্রিল, ২০১২ তারিখে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের লিখিত বক্তব্যে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি এবং হবেও না’। এই পরিস্কার বক্তব্যে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিন পর জারীকৃত তদন্ত কমিশনের কার্যপরিধি দেখে আবার শংকাটি বিপুলভাবে চাড়া দিয়ে উঠেছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা
গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে অল্প অল্প সঞ্চয় জমিয়ে গরীব মহিলারা গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কিনেছে। এ ব্যাংক তাদের নিজস্ব ব্যাংক জেনে তারা এটাকে মজবুত রাখার জন্য প্রতিদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আজ তাদের মালিকানা নিয়ে তদন্ত কমিশনের কাছে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় গরীব মহিলারা শংকিত বোধ করবেন। একটা বড় নির্দয় প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে কমিশনের সামনে। কমিশন কী জবাব দেয় তা যেমন ৮৪ লক্ষ গরীব মহিলা শেয়ার মালিকরা লক্ষ্য করবেন, তেমনি দেশবাসীও লক্ষ্য করবেন। নারীর ক্ষমতায়নে আগ্রহী পৃথিবীর সকল মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে এই উত্তরের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
পরিচালনা পর্ষদে সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারনের ব্যাপারেও কমিশনের সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। এটাও একটা দুর্ভাগ্যজনক প্রশ্ন। তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক-এটাই তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা। গরীব মালিকদের মধ্যে সরকার একটা উচ্চবণের্র শ্রেণী তৈরীর কথা চিন্তা করছেন না তো? গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নিরক্ষর মহিলা । গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যাঁরা এপর্যন্ত নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাঁদের নেতৃত্ব দানের গুণাবলী নিয়ে কারো মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বরাবরই দেশের গুণী ব্যক্তিরা চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। যেমন: প্রফেসর ইকবাল মাহমুদ, প্রফেসর রেহমান সোবহান, ড. আকবর আলী খান, প্রফেসর কায়সার হোসেন, জনাব তবারক হোসেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এঁদের কেউ বলবেন না যে মহিলাদের প্রতিনিধিরা যোগ্যতার মাপকাঠিতে কোনো অংশে খাটো ছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সকল মহিলাদের এবং সকল সদস্যের পক্ষ থেকে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং গৌরব নিয়ে এঁদেরই একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের পিরগাছা গ্রামের তসলিমা বেগম সমস্ত পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অসলোতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সকল মহিলার মনে প্রচন্ড অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে সুন্দর বাংলায় পুরস্কার গ্রহণোত্তর ভাষণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের টেলিভিশনে তা সরাসরি প্রচার করা হয়েছিল। আমার মনে হয় তাঁর ভাষণ শুনে বাংলাদেশের মহিলাদের রক্তে যে শিহরণ জেগেছিল সেই শিহরণ আজো জেগে আছে। এখন কি এই তসলিমাদের হারিয়ে যাবার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিশনকে? সরকারের মনে কী আছে- সবাই এটা জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা একটা মস্ত বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে
১৯৮৩ সালের ২রা অক্টোবর টাংগাইলের জামুর্কী হাই স্কুলের মাঠে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের মহিলা সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম মুহূর্তে এই সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মহোদয় এবং টাংগাইলের ঋণগ্রহীতা মহিলারা, সরকারী কর্মকর্তারা নয়।
এই ব্যাংক গরীব মহিলার ব্যাংক এব্যাপারে কোনো আপস কখনো হয়নি। এই ব্যাংক জোবরা গ্রাম থেকে শুরু করে আকুর টাকুর পাড়া, শ্যামলী হয়ে মিরপুরে পৌঁছার পথে তার এই মূল আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি।
গরীব মহিলাদেরকে মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এরকম একটা পদক্ষেপ নেবার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা। যে আইন, যে ব্যবস্থাপনা কাঠামো, যে কর্মপদ্ধতিকে কেনুদ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফরমুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।
এই প্রতিষ্ঠান নিজের টাকায় চলে। গ্রামীণ ব্যাংক না সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়, না কোনো দাতা সংস্থা থেকে টাকা নেয়। এই প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং জগতে একটা বিশাল মাত্রার সংযোজন করেছে। পৃথিবীর অসংখ্য ব্যাংকার এই ব্যাংক সম্বন্ধে জানতে সব সময় আগ্রহী থাকে। সারা দুনিয়ার মানুষ এর দিকে বিস্ময় এবং সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখে। এই ব্যাংক এদেশের জন্য পৃথিবীতে একটা স্থায়ী সম্মানের আসন তৈরী করে দিয়েছে। এর প্রতি আমাদের সরকার একটু সদয় হবে, ভাবনা চিন্তা করে কাজ করবে এটাই আমরা সবাই আশা করবো। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐকমত্য থাকা দরকার। কারণ এটা আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতিষ্ঠান।
গ্রামীণ ব্যাংকের হাজার হাজার কর্মী এবং লক্ষ লক্ষ ঋণগ্রহীতার ৩৫ বছরের সাধনার ফসলকে অতি দ্রুততার সঙ্গে উপলদ্ধি করে এই তদন্ত কমিশন এমন সব সুপারিশ তৈরী করবে যা এই প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তিশালী করবে, দুর্বল করবে না, বিপদগ্রস্থ করবে না- মনে এরকম আস্থা জাগানো কঠিন হয়ে পড়ে।
আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামোর পরিবর্তন করে সরকারের ভূমিকা এতে বাড়ানো হলে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। গ্রামীণ ব্যাংকে হাত না-দিয়ে সরকার এরকম আরেকটি বা একাধিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করুক তাতে কারো আপত্তি হবে বলে মনে হয় না। এটা কোনো রাজনৈতিক আদশের্র ব্যাপার নয়। গ্রামীণ ব্যাংককে বর্তমান মালিকানায় বর্তমান আইন কাঠামোতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর বিকল্প হতে পারে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি বিশাল সম্মানের কারণে পৃথিবীর অজানা অচেনা দেশে বহু প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় ‘‘গ্রামীণ’’ নাম ধারণ করেছে। তারা বাংলাদেশকে চেনে এই বাংলা শব্দের মাধ্যমে। তারা জানেও না ‘গ্রামীণ’ শব্দের অর্থ কি। বাংলাদেশ থেকে পাওয়া এই শব্দটি তাদের কাছে একটা স্বপ্নের নাম। বিশাল একটা সম্ভাবনার নাম।
সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে গ্রামীণ ব্যাংক কোন পথে অগ্রসর হবে সেটা আঁচ করতেই মনে ভয় ধরে। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ম শৃংখলার ব্যাংক। সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হলে নানারকম সংঘাত এর ভেতর দ্রুত প্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দেবে। গ্রামীণ ব্যাংকের ২৪ হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের প্রায় প্রত্যেককে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার নগদ টাকা নিয়ে রোজ একা একা গ্রামের রাস্তায় চলাফেরা করতে হয়। সে টাকার কতটুকু ব্যাংকের কাছে জমা হবে, আর কত টাকা মাঝখানে হাওয়া হয়ে যাবে সেটা নিয়েও মাথায় চিন্তা আসবে। ঘুষ দিয়ে ঋণ পাওয়া, ঘুষ দিয়ে পোস্টিং পাওয়া, পদোন্নতি পাওয়া, জোর যার মুলুক তার ধরনের পরিস্থিতি ক্রমাগত দৈনন্দিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এইগুলি সবই দুঃস্বপ্ন। স্বপ্ন যেমন বাস্তব হবার সম্ভাবনা থাকে, দুঃস্বপ্নও সেরকম বাস্তবে রূপান্তরিত হতে পারে। এটা যাতে না-হতে পারে তার জন্য আমাদের এখন বিশেষ উদ্যোগ দরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের অব্যবস্থা, দুর্নীতি নিয়ে এত লেখালেখি, এত গবেষণা হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত সেগুলি বেসরকারী মালিকানায় দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল অতীতে। এখন গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারী নিয়ন্ত্রনে নেবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে প্রচন্ড ভয় ধরেছে।
মিরপুরের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের (বৈঠক) ‘কেনুদ্র’ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের সকলেই সর্বত্র একই শৃংখলার সূত্রে গাঁথা, একই নিয়মানুবর্তিতায় এরা আবর্তিত হয়। সরকারী মেজাজের হাওয়া যদি একবার লাগে গ্রামীণ ব্যাংকের এতদিনের অর্জন ফুৎকারে মিলিয়ে যেতে বেশী সময় লাগবে না। ঐক্য-কর্ম-শৃংখলার মন্ত্রে দীক্ষিত গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লক্ষ ঋণগ্রহীতা তাদের কঠোর পরিশ্রম দিয়ে বিশ্বের হূদয়কে জয় করেছে। তাদের কাছ থেকে মালিকানা ও পরিচালনা পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছেঁটে দিলেই কি সব সমস্যার অবসান ঘটবে? সরকার কি ৮৪ লক্ষ পরিবারকে বুঝাতে পারবে কেন ঋণগ্রহীতারা তাদের নিজের অর্থে, নিজের শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা থেকে বঞ্চিত হলো?
দেশের মানুষ বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের গরীব মহিলা মালিকরা, নিশ্চয়ই চাইবেন না যে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের এই পরিণতি হোক। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যের ছেলে মেয়েরা, বিশেষ করে যারা শিক্ষাঋণ নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ও অন্যান্য পেশাজীবী হয়ে উঠেছে তারা, নিশ্চয়ই চাইবে না যে তাদের মায়ের ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রনে কিংবা মালিকানায় চলে যাক। কারণ তারা নিজেরাই এখন দলে দলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘‘নতুন উদ্যোক্তা’’ ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে নেমে পড়ছে। দেশের সবাই মিলে যদি আমরা সরকারকে বুঝাতে পারি যে গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামো পরিবর্তন দেশের জন্য, গরীবদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না তাহলে একে ঠেকানো যাবে। কিন্তু আমাদেরকে আমাদের শংকাগুলি প্রকাশ করে সরকারকে বুঝাতে হবে। বুঝাতে হবে যে এটা কারো জন্য মঙ্গলজনক ত হবেই না, বরং ভয়ংকর পরিনতি বয়ে আনবে। গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীব্যপী বাংলাদেশের একটা ব্রান্ড-নেইম। এটার কোনো ক্ষতি হোক এমন কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
দেশবাসী হিসেবে আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোন অবস্থাতেই থাকুন আমরা একযোগে সরকারকে বুঝাবার চেষ্টা করতে পারি যে গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না। একাজ থেকে সরকারকে বিরত করার জন্য যে যেভাবে পারি সেভাবে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি। নারীর ক্ষমতায়নে, বিশেষ করে গরীব মানুষের ক্ষমতায়নে, যারা বিশ্বাসী তাদেরকে এব্যাপারে সোচ্চার হতে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আমার এই লেখাটি ছাপিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সকল শাখায় পাঠাচ্ছি যাতে ঋণগ্রহীতা মালিকরা তাঁদের মালিকানা রক্ষা করার জন্য তাঁরাও স্থানীয় গণ্যমান্যদের মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে পারেন।
আমাদের সবাইকে মিলে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষা করতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক গরীব মহিলাদের মালিকানায় যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেভাবে পরিচালিত হতে থাকুক, গরীব মহিলাদের সেবায় অব্যাহত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাক, এটা আমদেরকে সুদৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আমার মনে যে শংকা জেগেছে সে-শংকা যদি আপনার মনেও জেগে থাকে আপনিও সরকারকে এপথ থেকে সরে আসার পরামর্শ দিন।
লেখক: নোবেলজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা
No comments