সন্ত্রাসী আর পুলিশের সাধারণ টার্গেট কি সাংবাদিকরা? by সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
মাত্র ক’দিন আগে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস গেলো। ঘটা করে না হলেও প্রতিবছর দিবসটি পালন করে সাংবাদিকদের নানা সংগঠন। সব সময়ই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা উঠে।
তবে এবার ব্যতিক্রম। মনে হচ্ছে বেশ অনুশীলন করেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আর লাইসেন্সধারী মাস্তান বাহিনী হামলে পড়েছে সাংবাদিকদের ওপর। কারণটা কি? বাংলাদেশের অনেক ঘটনা বা বিষয়ের মতো এটিও অজানা।
আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায় সময়ই দাবি করেন বর্তমান সরকার সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে সরকার সচেষ্ট। আরেকটি কথা বলেন, সেটি হলো, এই সরকার তথ্য অধিকার আইন সংসদে পাশ করেছে। যদিও এই আইন করে গেছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা শুধু এই সংসদে অনুমোদন দিয়েছেন।
একথা সত্য যে ১৯৯০ এ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারায় (নাকি নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ধারায়) দেশ ফেরার পর সেই অর্থে দেশে লিখিতভাবে গণমাধ্যমের আর কণ্ঠরোধ করা হয় না। এই কাজটিও করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আইনের যে ধারা বলে সংবাদপত্র বন্ধ করা যেতো তা রহিত করেছেন তিনি।
কিন্তু অলিখিতভাবে সেন্সর আছে, হুমকি আছে। না ছাপানো, না বলার, না দেখানোর পরামর্শ আছে।
সংবাদমাধ্যমরে প্রতি, সাংবাদিকদের প্রতি অসহিষ্ণুতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিঘাংসায় রূপ নিচ্ছে। একদল ক্ষমতায় থেকে কোনো বিশেষ ভবনের তুর্কি তরুণদের দিয়ে টিভি আর পত্রিকায় হুমকি স্বরুপ দিতো পরামর্শ, আরেকদল সংসদে দাড়িয়ে সম্পাদকদের, পত্রিকার নাম ধরে বিষোদগার করে।
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে যে সুশাসনের সমস্যা তার কারণেই আসলে গণমাধ্যমের প্রতি এই আচরণ। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে ঠিকই, তবে তাদের ভালোলাগে মোড়লগিড়ি। মনের গহীনে বাস করে সামন্তভাবনা।
অন্তরে প্রগতিশীলতা নেই বলেই আমাদের শাসকগোষ্ঠি সবসময় চায় কায়দা-কানুন করে গণমাধ্যমের কণ্ঠ চেপে রাখতে। তা না পারলে নির্যাতন করতে।
তবে সরকার যেমনই হোক যে বিষয়টি বেশি পীড়াদায়ক তা হলো আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের তথাকথিত কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ। ঐতিহাসিকভাবে গণবিরোধী ও অদৃষ্ট এই গোষ্ঠীটা এখন রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সুবধাদি আদায়ের পাশাপাশি এই চক্রটি এখন নৈতিকতার চরম অবনতিতে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক আনুগত্য দেখে নিয়োগ, বদলি আর দায়িত্ব নিয়ে এক একটি সার্ভিস ক্যাডার হয়ে উঠছে ভয়ানক সব সংগঠন।
পুলিশ কি এখন কোন শৃঙ্খলা বাহিনী? নাকি পেটোয়া বাহিনী? কখনো কখনো ফারাক বোঝা কষ্টসাধ্য হযে যায়।
যাক সে আলোচনা আর দীর্ঘ করে লাভ নেই। শুধু ভাবছি আমরা সাংবাদিকরা আসলে আছি কেমন। কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। বেডরুমে খুন। এখন নতুন করে জানান দিল যে অফিসে ঢুকেও খুন করা যায়। বিডিনিউজের সাংবাদিকরা মারা যানননি। কিন্তু যারা এসেছিল তারা খুনের নেশায় উন্মত্ত ছিল। পলিশ রাজপথে সাংবাদিকদের রক্তাক্ত করে। শোরগোল হলে একদিন বিরতি দিয়ে আদালত পাড়ায় ধর্ষণ ঠেকাতে সাংবাদিক-আইনজীবী এগিয়ে গেলে তাদেরও রক্তাক্ত করে।
এমনিতে সাংবাদিকতা পেশাটি ঝুঁকিপূর্ণ। নানা স্বার্থান্বেষী মহল সাংবাদিকদের ওপর নাখোশ থাকে। তাদের রোশানল থেকে বাঁচতে সাংবাদিকের শেষ ভরসাস্থল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হয়ে সে কাজটি করে পুলিশ। কিন্তু সেই পুশিই যখন নির্যাতকের ভূমিকায় অগ্রণী, তখন কার কাছে যাবো আমরা?
কতদিন চলে গেল, সাগর-রুনি খুন হয়েছেন। এই পুলিশ তার কোনো রহস্য বের করতে পারেনি। ব্যর্থ পুলিশের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়েছে র্যাব। তারাও কতটা করতে পারবে সংশয় আছে। যে পুলিশ বিভাগ উচ্চ আদালতে গিয়ে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে, সে বিভাগের শীর্ষ কর্তারা নিলর্জ্জের মতো এখনো পদ আগলে আছেন। তারা নিজেরা সরে দাঁড়াননি। সরকারও তাদের অপসারণ করেনি। ফলে তাদের অধীনস্তরা এখন যা পারছে তা করছে। তারই মহড়া ছিল আগারগাঁয়ে সাংবাদিকদের ওপর হায়েনার মতো আক্রমণ। দু’দিন যেতে না যেতেই এই বাহিনীর লোকজন আদালত পাড়ায় বিচার চাইতে যাওয়া তরুণীকে মা-বাবার কাছ থেতে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করতে ঝাঁপিযে পড়ে। সাংবাদিক-আইনজীবীরা বাধা দিলে তাদের রক্তাক্ত করা হয়। দেশের মানুষের মানবাধিকার নিয়ে যে সাংবাদিক সমাজ কলম ধরে তাদের অধিকারই আজ ভূলুণ্ঠিত, তারা আজ আহত।
সন্ত্রাসীরা বিডিনিউজ অফিসে ঢুকে সাংবাদিকদের খুন করতে চেয়েছে। দেশে কোনো সংবাদ মাধ্যম কার্যালয়ে ঢুকে এমন সন্ত্রাসী হামলা এটাই প্রথম। পুলিশের সাম্প্রতিক যে দক্ষতা আর ইচ্ছাশক্তির যে প্রমাণ পাচ্ছি তাতে নিশ্চিত হতে পারছি না যে প্রকৃত সন্ত্রাসীদেরও ধরতে পারবে তারা বা ধরবে।
প্রণিধানযোগ্য আইজিপি নানা প্রণিধানযোগ্য বাক্য ছুঁড়ছেন। বলছেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য পুরো পুলিম বাহিনীকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। কথাটি সত্য। আমরা বলতে চাই না যে গুটি কয়েক অসফল কর্মকর্তার জন্য গোটা বাহিনীকেই দোষ দিতে হবে। যে কাজ সাংবাদিকদের নয়, তাই করছেন তারা। পথে নামছেন, বিক্ষোভ করছেন। দোষীদের শাস্তি দাবি করছেন। আশ্বাসও মিলছে। কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি খুনের পর সেই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এখন এতটাই হাস্যকর যে কোনো আশ্বাসই আর আমাদের আশ্বস্ত করে না।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায় সময়ই দাবি করেন বর্তমান সরকার সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে সরকার সচেষ্ট। আরেকটি কথা বলেন, সেটি হলো, এই সরকার তথ্য অধিকার আইন সংসদে পাশ করেছে। যদিও এই আইন করে গেছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা শুধু এই সংসদে অনুমোদন দিয়েছেন।
একথা সত্য যে ১৯৯০ এ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারায় (নাকি নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ধারায়) দেশ ফেরার পর সেই অর্থে দেশে লিখিতভাবে গণমাধ্যমের আর কণ্ঠরোধ করা হয় না। এই কাজটিও করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আইনের যে ধারা বলে সংবাদপত্র বন্ধ করা যেতো তা রহিত করেছেন তিনি।
কিন্তু অলিখিতভাবে সেন্সর আছে, হুমকি আছে। না ছাপানো, না বলার, না দেখানোর পরামর্শ আছে।
সংবাদমাধ্যমরে প্রতি, সাংবাদিকদের প্রতি অসহিষ্ণুতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিঘাংসায় রূপ নিচ্ছে। একদল ক্ষমতায় থেকে কোনো বিশেষ ভবনের তুর্কি তরুণদের দিয়ে টিভি আর পত্রিকায় হুমকি স্বরুপ দিতো পরামর্শ, আরেকদল সংসদে দাড়িয়ে সম্পাদকদের, পত্রিকার নাম ধরে বিষোদগার করে।
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে যে সুশাসনের সমস্যা তার কারণেই আসলে গণমাধ্যমের প্রতি এই আচরণ। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে ঠিকই, তবে তাদের ভালোলাগে মোড়লগিড়ি। মনের গহীনে বাস করে সামন্তভাবনা।
অন্তরে প্রগতিশীলতা নেই বলেই আমাদের শাসকগোষ্ঠি সবসময় চায় কায়দা-কানুন করে গণমাধ্যমের কণ্ঠ চেপে রাখতে। তা না পারলে নির্যাতন করতে।
তবে সরকার যেমনই হোক যে বিষয়টি বেশি পীড়াদায়ক তা হলো আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের তথাকথিত কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ। ঐতিহাসিকভাবে গণবিরোধী ও অদৃষ্ট এই গোষ্ঠীটা এখন রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সুবধাদি আদায়ের পাশাপাশি এই চক্রটি এখন নৈতিকতার চরম অবনতিতে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক আনুগত্য দেখে নিয়োগ, বদলি আর দায়িত্ব নিয়ে এক একটি সার্ভিস ক্যাডার হয়ে উঠছে ভয়ানক সব সংগঠন।
পুলিশ কি এখন কোন শৃঙ্খলা বাহিনী? নাকি পেটোয়া বাহিনী? কখনো কখনো ফারাক বোঝা কষ্টসাধ্য হযে যায়।
যাক সে আলোচনা আর দীর্ঘ করে লাভ নেই। শুধু ভাবছি আমরা সাংবাদিকরা আসলে আছি কেমন। কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। বেডরুমে খুন। এখন নতুন করে জানান দিল যে অফিসে ঢুকেও খুন করা যায়। বিডিনিউজের সাংবাদিকরা মারা যানননি। কিন্তু যারা এসেছিল তারা খুনের নেশায় উন্মত্ত ছিল। পলিশ রাজপথে সাংবাদিকদের রক্তাক্ত করে। শোরগোল হলে একদিন বিরতি দিয়ে আদালত পাড়ায় ধর্ষণ ঠেকাতে সাংবাদিক-আইনজীবী এগিয়ে গেলে তাদেরও রক্তাক্ত করে।
এমনিতে সাংবাদিকতা পেশাটি ঝুঁকিপূর্ণ। নানা স্বার্থান্বেষী মহল সাংবাদিকদের ওপর নাখোশ থাকে। তাদের রোশানল থেকে বাঁচতে সাংবাদিকের শেষ ভরসাস্থল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হয়ে সে কাজটি করে পুলিশ। কিন্তু সেই পুশিই যখন নির্যাতকের ভূমিকায় অগ্রণী, তখন কার কাছে যাবো আমরা?
কতদিন চলে গেল, সাগর-রুনি খুন হয়েছেন। এই পুলিশ তার কোনো রহস্য বের করতে পারেনি। ব্যর্থ পুলিশের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়েছে র্যাব। তারাও কতটা করতে পারবে সংশয় আছে। যে পুলিশ বিভাগ উচ্চ আদালতে গিয়ে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে, সে বিভাগের শীর্ষ কর্তারা নিলর্জ্জের মতো এখনো পদ আগলে আছেন। তারা নিজেরা সরে দাঁড়াননি। সরকারও তাদের অপসারণ করেনি। ফলে তাদের অধীনস্তরা এখন যা পারছে তা করছে। তারই মহড়া ছিল আগারগাঁয়ে সাংবাদিকদের ওপর হায়েনার মতো আক্রমণ। দু’দিন যেতে না যেতেই এই বাহিনীর লোকজন আদালত পাড়ায় বিচার চাইতে যাওয়া তরুণীকে মা-বাবার কাছ থেতে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করতে ঝাঁপিযে পড়ে। সাংবাদিক-আইনজীবীরা বাধা দিলে তাদের রক্তাক্ত করা হয়। দেশের মানুষের মানবাধিকার নিয়ে যে সাংবাদিক সমাজ কলম ধরে তাদের অধিকারই আজ ভূলুণ্ঠিত, তারা আজ আহত।
সন্ত্রাসীরা বিডিনিউজ অফিসে ঢুকে সাংবাদিকদের খুন করতে চেয়েছে। দেশে কোনো সংবাদ মাধ্যম কার্যালয়ে ঢুকে এমন সন্ত্রাসী হামলা এটাই প্রথম। পুলিশের সাম্প্রতিক যে দক্ষতা আর ইচ্ছাশক্তির যে প্রমাণ পাচ্ছি তাতে নিশ্চিত হতে পারছি না যে প্রকৃত সন্ত্রাসীদেরও ধরতে পারবে তারা বা ধরবে।
প্রণিধানযোগ্য আইজিপি নানা প্রণিধানযোগ্য বাক্য ছুঁড়ছেন। বলছেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য পুরো পুলিম বাহিনীকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। কথাটি সত্য। আমরা বলতে চাই না যে গুটি কয়েক অসফল কর্মকর্তার জন্য গোটা বাহিনীকেই দোষ দিতে হবে। যে কাজ সাংবাদিকদের নয়, তাই করছেন তারা। পথে নামছেন, বিক্ষোভ করছেন। দোষীদের শাস্তি দাবি করছেন। আশ্বাসও মিলছে। কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি খুনের পর সেই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এখন এতটাই হাস্যকর যে কোনো আশ্বাসই আর আমাদের আশ্বস্ত করে না।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
No comments