তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্কঃ কৌশলগত অমিত সম্ভাবনা by কামরুজ্জামান
প্রায় ১৩ বছর পর গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কের কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্দুল্লাহ গুল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে বছর নভেম্বরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেসেপ তাইপ এরদোগানও বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ এপ্রিল ২০১২ তারিখে তুরস্ক সফরে যান।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আরব বিপ্লবের পর যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ও পশ্চিমা বিশ্বে মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছে সেই দেশটি হচ্ছে তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কিংবা নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকায় ইরান এই কাজটি করতে পারেনি। কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হওয়ায় সৌদি আরবও পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে এবং বাইরে তুরস্ক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ যদি তুরস্কের সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজার ও পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে লাভবান হবে।
ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে তুরস্কের অবস্থান খুব গুরুত্বের দাবি রাখে। দেশটির অবস্থান এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ এই তিন মহাদেশের ঠিক মধ্যে। ইস্তাম্বুল শহরটি ইউরোপ ও এশিয়া এই দুটি মহাদেশে অবস্থান করছে আর তাই তুরস্ককে বলা হয় ইউরেশিয়ান কান্ট্রি। দেশটির আয়তন ফ্রান্সের চেয়ে বড়। তেলসমৃদ্ধ ইরানের পাশের দেশ। দার্দানেস এবং বসফরাস প্রণালী তার অধীনে। সব মিলিয়ে তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সব শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃত।
তুরস্কের ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বর্তমান ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পুরোপুরি ইসলামি এবং আধুনিক ভাবধারার। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর ২৭টি সদস্যের মধ্যে তুরস্কই একমাত্র মুসলিম দেশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য ন্যাটো দেশের সঙ্গে তুরস্কও আফগানিস্তানের পুনঃগঠন কাজে অংশ নিয়েছে। দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিতে (ওআইসি) বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ এবং তুরস্ক উভয়ই ডি-৮ এর সদস্য। ডি-৮ হলো সারা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যায় ও শক্তিতে বড় আট দেশের সংগঠন। এর সদস্য হলো- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইরান, মিসর, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। বাংলাদেশ তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে ডি-৮ এর সুযোগ-সুবিধাগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হবে। তুরস্কের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে এসব ক্ষেত্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক অন্যান্য অঙ্গনেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।
বাংলাদেশের রফতানি মূলত ইউরোপ ও আমেরিকাকেন্দ্রিক।এর বাইরেও বাজার খোঁজা উচিত। তুরস্কে বাংলাদেশী পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, সিরামিক, ওষুধ, চামরাজাত পণ্য ও জুতার চাহিদা রয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক সফরকালে ডিসকাউন্ট মূল্যে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানির কথা বলেন। গার্মেন্টস, সিরামিক, ওষুধ, চামরাজাত পণ্যের রফতানি ব্যাপারেও তিনি কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, “আমরা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ওষুধ রফতানি করছি। আমরা সুলভমূল্যে তুরস্কে ওষুধ রফতানি করতে পারবো।”
এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার বেড়ে গিয়েছে। ২০০২ সালে দুই দেশের মধ্যে ট্রেড ভোলিউম ছিল মাত্র ৪৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৮ মিলিয়ন ইউএস ডলারে। ২০১১ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় এক বিলিয়ন ইউএস ডলারে। হাসিনা ও এদোগান এই দুই প্রধানমন্ত্রী এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে ২০১৫ নাগাদ দুই দেশের মধ্যে ট্রেড ভলিউম তিন বিলিয়ন ইউএস ডলারে পৌঁছুবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী দেশ। অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে সমগ্র ইউরোপে তুরস্কের অবস্থান ৬ষ্ঠ। সারা বিশ্বের তুলনায় ১৬তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশ তুরস্ক। গত বছর প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছিলেন- ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন।
তুরস্ক ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শেকড়। ১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বাংলা তুর্কি শাসকরা শাসন করেছিলেন। ঊনিশ শতকের ত্রিশের দশকে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের যে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল তা আজো তুরস্কের সাধারণ মানুষ স্মরণ করেন। তুরস্কের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি বাড়ি থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে তুরস্কের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন যুগিয়েছিলেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে প্যান-ইসলামিক মুভমেন্ট গড়ে ওঠেছিল সে আন্দোলনটি আসলে খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। এই বাঙলা থেকে বিশেষ করে মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী একেবারে সামনে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই খেলাফত আন্দোলনে অন্যান্যদের মধ্যে যোগ দেন মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরাম খান ও এ কে ফজলুল হক। কিন্তু যুদ্ধ শেষে মুস্তফা কামাল পাশা ১৯২২ সালে সালতানাতের বিলোপ ঘোষণা করলেন। খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল করে ১৯২৩ সালে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করায় খেলাফত আন্দোলনের নেতাদের মাঝে হতাশা নেমে আসে। এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে তুরস্কের সেনাবাহিনী টিকিয়ে রেখেছিল প্রায় ৯০ বছর। এখন আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা নুইয়ে আসছে তুরস্কে। সংবিধান পরিবর্তন হচ্ছে। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির মতো দলগুলো ক্ষমতায় আসছে।পরিবর্তনের এই ধারা আরো সামনের দিকে গড়াবে বলেই মনে হচ্ছে।
আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের স্মরণে বাংলাদেশ সরকার ১৯৩৯ সালে ফেনীর দাগনভূঁইয়াতে আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পয়ায়ক্রমে ১৯৮২ ও ১৯৯৮ সালে ‘মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক’ নামে দুটি সড়কের নামকরণ করে বাংলাদেশ সরকার। তুরস্কের সরকার রাজধানী আঙ্কারায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ ও ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’ এর নামে দুটি সড়কে নামকরণ করে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ত্রিশের দশকে ও চল্লিশের দশকে কামাল আতাতুর্কের প্রশংসায় অনেক কবিতা লিখেছেন। নজরুলের লেখা ‘আমার কামাল পাশা’ শিরোনামে কবিতাটি জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। নজরুল কবিতার ভাষায় বলেন- ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই”। বাংলা ভাষায় কিছু তুর্কি সাহিত্য ও অনুবাদ করা হয়েছিল। ঢাকার ‘পিলখানা’ ও ‘তোপখানা’ নামে যে দুটি জায়গা আছে। এখানে ‘পিলখানা’ ও ‘তোপখানা’ শব্দ দুটোই তুর্কি ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
kamruzzaman46@gmail.com
ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে তুরস্কের অবস্থান খুব গুরুত্বের দাবি রাখে। দেশটির অবস্থান এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ এই তিন মহাদেশের ঠিক মধ্যে। ইস্তাম্বুল শহরটি ইউরোপ ও এশিয়া এই দুটি মহাদেশে অবস্থান করছে আর তাই তুরস্ককে বলা হয় ইউরেশিয়ান কান্ট্রি। দেশটির আয়তন ফ্রান্সের চেয়ে বড়। তেলসমৃদ্ধ ইরানের পাশের দেশ। দার্দানেস এবং বসফরাস প্রণালী তার অধীনে। সব মিলিয়ে তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সব শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃত।
তুরস্কের ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বর্তমান ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পুরোপুরি ইসলামি এবং আধুনিক ভাবধারার। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর ২৭টি সদস্যের মধ্যে তুরস্কই একমাত্র মুসলিম দেশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য ন্যাটো দেশের সঙ্গে তুরস্কও আফগানিস্তানের পুনঃগঠন কাজে অংশ নিয়েছে। দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিতে (ওআইসি) বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ এবং তুরস্ক উভয়ই ডি-৮ এর সদস্য। ডি-৮ হলো সারা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যায় ও শক্তিতে বড় আট দেশের সংগঠন। এর সদস্য হলো- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইরান, মিসর, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। বাংলাদেশ তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে ডি-৮ এর সুযোগ-সুবিধাগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হবে। তুরস্কের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে এসব ক্ষেত্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক অন্যান্য অঙ্গনেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।
বাংলাদেশের রফতানি মূলত ইউরোপ ও আমেরিকাকেন্দ্রিক।এর বাইরেও বাজার খোঁজা উচিত। তুরস্কে বাংলাদেশী পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, সিরামিক, ওষুধ, চামরাজাত পণ্য ও জুতার চাহিদা রয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক সফরকালে ডিসকাউন্ট মূল্যে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানির কথা বলেন। গার্মেন্টস, সিরামিক, ওষুধ, চামরাজাত পণ্যের রফতানি ব্যাপারেও তিনি কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, “আমরা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ওষুধ রফতানি করছি। আমরা সুলভমূল্যে তুরস্কে ওষুধ রফতানি করতে পারবো।”
এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার বেড়ে গিয়েছে। ২০০২ সালে দুই দেশের মধ্যে ট্রেড ভোলিউম ছিল মাত্র ৪৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৮ মিলিয়ন ইউএস ডলারে। ২০১১ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় এক বিলিয়ন ইউএস ডলারে। হাসিনা ও এদোগান এই দুই প্রধানমন্ত্রী এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে ২০১৫ নাগাদ দুই দেশের মধ্যে ট্রেড ভলিউম তিন বিলিয়ন ইউএস ডলারে পৌঁছুবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী দেশ। অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে সমগ্র ইউরোপে তুরস্কের অবস্থান ৬ষ্ঠ। সারা বিশ্বের তুলনায় ১৬তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশ তুরস্ক। গত বছর প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছিলেন- ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন।
তুরস্ক ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শেকড়। ১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বাংলা তুর্কি শাসকরা শাসন করেছিলেন। ঊনিশ শতকের ত্রিশের দশকে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের যে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল তা আজো তুরস্কের সাধারণ মানুষ স্মরণ করেন। তুরস্কের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি বাড়ি থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে তুরস্কের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন যুগিয়েছিলেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে প্যান-ইসলামিক মুভমেন্ট গড়ে ওঠেছিল সে আন্দোলনটি আসলে খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। এই বাঙলা থেকে বিশেষ করে মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী একেবারে সামনে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই খেলাফত আন্দোলনে অন্যান্যদের মধ্যে যোগ দেন মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরাম খান ও এ কে ফজলুল হক। কিন্তু যুদ্ধ শেষে মুস্তফা কামাল পাশা ১৯২২ সালে সালতানাতের বিলোপ ঘোষণা করলেন। খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল করে ১৯২৩ সালে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করায় খেলাফত আন্দোলনের নেতাদের মাঝে হতাশা নেমে আসে। এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে তুরস্কের সেনাবাহিনী টিকিয়ে রেখেছিল প্রায় ৯০ বছর। এখন আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা নুইয়ে আসছে তুরস্কে। সংবিধান পরিবর্তন হচ্ছে। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির মতো দলগুলো ক্ষমতায় আসছে।পরিবর্তনের এই ধারা আরো সামনের দিকে গড়াবে বলেই মনে হচ্ছে।
আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের স্মরণে বাংলাদেশ সরকার ১৯৩৯ সালে ফেনীর দাগনভূঁইয়াতে আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পয়ায়ক্রমে ১৯৮২ ও ১৯৯৮ সালে ‘মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক’ নামে দুটি সড়কের নামকরণ করে বাংলাদেশ সরকার। তুরস্কের সরকার রাজধানী আঙ্কারায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ ও ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’ এর নামে দুটি সড়কে নামকরণ করে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ত্রিশের দশকে ও চল্লিশের দশকে কামাল আতাতুর্কের প্রশংসায় অনেক কবিতা লিখেছেন। নজরুলের লেখা ‘আমার কামাল পাশা’ শিরোনামে কবিতাটি জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। নজরুল কবিতার ভাষায় বলেন- ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই”। বাংলা ভাষায় কিছু তুর্কি সাহিত্য ও অনুবাদ করা হয়েছিল। ঢাকার ‘পিলখানা’ ও ‘তোপখানা’ নামে যে দুটি জায়গা আছে। এখানে ‘পিলখানা’ ও ‘তোপখানা’ শব্দ দুটোই তুর্কি ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
kamruzzaman46@gmail.com
No comments