সামনের বছরগুলোতেও তিস্তা চুক্তি করবে না ভারত by কামরুজ্জামান
ভারত তিস্তায় পানিবণ্টন চুক্তিতে রাজি হলে দেশটিকে বাংলাদেশের খরচে দেশের ওপর দিয়ে করিডোর দেয়া চলে; এমন একটা আবহ তৈরির চেষ্টা করছে সরকার, এবং আশা করছে দেশটি তিস্তা চুক্তিতে রাজি হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের সেইটুকু সাহায্যে এগিয়ে আসতে নারাজ ভারত।
একের পর এক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে চুক্তি থেকে সরে থাকছে দেশটি। ভারতের জাতীয় রাজনীতির যেসব ‘অবস্থা’কে ‘কারণ’ হিসেবে দেখিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি থেকে বিরত থাকছে, সেসব অবস্থা আগামী তিন-চার কি পাঁচ-ছয় বছরের মতো স্বল্পমেয়াদে পাল্টে যাবার কোনো লক্ষণ নেই। তিস্তাও বহুদূর!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালে ভারত সফরকালে আশায় ছিলেন যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। ভারত চুক্তি করেনি। সরকারের আশা ছিল যে অন্তত একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি হবে। ভারত করেনি। ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সামনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসলেন। সেবারও শেখ হাসিনার সরকার খুব করে আশা করেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হবে। চুক্তি হলো না। এ যাত্রায় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হলো, সামনে তাদের উপনির্বাচন। তাই এ চুক্তি এখন করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত ৯ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির ভারত সফরে গেলেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময় নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু এবারেও তিনি আশ্বাসটুকু পর্যন্ত পেলেন না। তিস্তায় পানি পাবার আশা এখন একদমই টিমটিমে।
শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদে আগামী দুই বছরের মধ্যে চুক্তিটি করছে না ভারত। ভারত রাষ্ট্র হিসেবে মূলত কতগুলো রাজ্যের ‘ইউনিয়ন’। ইউনিয়ন অফ ইনডিয়া। প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষেত্র ছাড়া প্রত্যেকটি রাজ্য সাংবিধানিকভাবেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বাধীন। পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজে যদিও এখতিয়ার ইউনিয়ন সরকারের, কিন্তু যদি এতে কোনো রাজ্যের স্বার্থ বিশেষভাবে যুক্ত থাকে তবে সাধারণত রাজ্য সরকারের সমর্থন না থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার একক সিদ্ধান্তে আর্ন্তজাতিক চুক্তি করে না। এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রেওয়াজ।
সেক্ষেত্রে তিস্তায় চুক্তি করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রে কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন জোটসঙ্গী তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির সমর্থন দরকার। এ চুক্তিতে মমতার সমর্থন নেই নানা কারণে।
ওদিকে দেশটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এগিয়ে আসছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী মমতার সমর্থন প্রয়োজন কংগ্রেসের। কংগ্রেসের সামনে যদি তিস্তা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একটিকে বেছে নিতে হবে, নিশ্চিতভাবেই তিস্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না কংগ্রেস। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি আর হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর? মমতার আগামী মেয়াদে জিতে আসার লড়াই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক যুগের বাম শাসনকে হারিয়ে সাবেক কংগ্রেস নেত্রী মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে, প্রধানত কেন্দ্রের কাছে ‘নতজানু’ বামদের বিরুদ্ধে ‘পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙালি’র স্বার্থ ক্ষুন্ন করার লাগাতার অভিযোগ এনে। মমতা আগামী নির্বাচনেও জিততে চাইছেন এবং কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারে মমতার মতকে প্রাধান্য দেবে। কংগ্রেসের রাজ্য শাখা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ‘সঙ্গী’ হয়ে থাকার ব্যাপারে বিনীত ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কেন?
কারণ, নানা ভাষা ও সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত নানা জাতি-গোষ্ঠির মাতৃভূমি ভারত। এই আলাদা আলাদা মাতৃভূমিগুলোতে নানা রাজ্যের স্থানীয় দলগুলোর জনসমর্থন ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষত, যেসব জাতির লোকেরা মনে করছে যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বেলায় কেন্দ্রের তরফে তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে, সেসব রাজ্যে এ হার বেশি। প্রাচীন জাতীয় দলটি, বৃটিশরা যার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছে সেই ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে ক্রমশই স্থানীয় দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বৃটিশরা চলে যাবার ছয় দশক পরেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটিতে আঞ্চলিক বৈষম্যের তীব্রতা এত বেশি বলে নাগরিকদের চোখে ধরা পড়েছে যে, তামাম হিন্দুস্তানকে নিজেদের এক সুতায় গেথে রাখার মতো আবেদন দলটির কাছে নেই। অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়বাদী ভারতীয় জনতা পার্টি ওরফে বিজেপি’র সর্বভারতীয় হিন্দুত্বের আবেদনও সাড়া জাগাতে পারছে না স্থানীয় লোকস্বার্থের বিপরীতে। তাদেরও জোট করেই কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে।
কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকতে ভারতীয় রাজনীতির এ জোট নির্ভরতা’র অনিবার্যতা সামনের বছরগুলোতে হাওয়া মিলিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা বা সম্ভাবনা এখনও টের করা যাচ্ছে না। এ রাজনীতিতে কংগ্রেসের কোনো ‘চিরায়ত মিত্র’ নন মমতা আর তার তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলাদেশে যেমন কিছু বাম দল যে কোনো শর্তেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকতে ‘আদর্শগতভাবে বাধ্য’ অবস্থানে থাকে, মমতার তৃণমূলের তা নেই। বিজেপি’র সঙ্গে হাত মেলাতে তার সামনে কোনো ধরনের বাধা নেই, এটা প্রমাণিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের মত জোটে নেহাতই দলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ভারতে জোট হয় না, আগেই বলেছি। রাজ্যভিত্তিক দলগুলোর সমর্থনে জোট করা ছাড়া কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসাই দেশটিতে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে তিস্তা চুক্তিতে রাজি হয়ে মমতার মতো জোটসঙ্গী হারাতে চাইবে কংগ্রেস, এমনটি ধরে নেবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখছি না।
কিন্তু এটুকুই অবস্থার সামগ্রিক চিত্র নয়। এর চেয়েও বড় ঝুঁকি নিয়ে কি কংগ্রেস অতীতে কোনো আর্ন্তজাতিক চুক্তি করেনি? করেছে। কেন্দ্রে জোটসঙ্গী বামদলগুলো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির চরম বিরোধী ছিল। জোট থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবার হুমকি দিচ্ছিল, বিপরীতে চুক্তি না হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি দিচ্ছিলেন ড. মনমোহন সিং। সেই সময়ে এত বিরোধীতার মুখেও চুক্তি করেছিল ভারত। আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে, সন্ধি-চুক্তি-সমঝোতা করতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই তা নানা অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় অবস্থা ও শর্তের সঙ্গে সাংর্ঘষিক হয়। সে সাংর্ঘষিক অবস্থার ঝুঁকি যতটা সম্ভব কমিয়েই আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হয়। এমন কোনো দেশ নেই দুনিয়ায়, যারা এ অভিজ্ঞতার মুখে পড়েনি। সর্বশেষ ফ্রান্সের উদাহরণ দেয়া যায়, ইউরো মুদ্রা অঞ্চল টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জনমতের একাংশের মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে হারলেন রাষ্ট্রপতি সারকোজি। যতই ইউরো মুদ্রা বিরোধী ভাবসাব নিয়ে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ জিতে আসুন না কেন, ইউরো মুদ্রা অঞ্চল ও অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে ছাড় দিতে হবে তাকেও।
কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশকে তিস্তায় পানিটুকু পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে না আভ্যন্তরীণ বিষয়কে বাধা হিসেবে দেখিয়ে। যতদিন ভারত থাকবে, ততদিন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকবে। নির্বাচন থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা অগ্রাধিকারের ইস্যু থাকবে। এটা স্বাভাবিক। দেশের জনমত, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান- এসবই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মৌলিক উপকরণ হিসেবে কাজ করে। এসবের অবস্থা রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য হয় সুবিধা কিংবা অসুবিধা তৈরি করে। ক্ষমতাসীনরা চাইলে রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সুবিধাকে অসুবিধায় আবার অসুবিধাকে সুবিধায় পরিণত করতে পারে। তিস্তা চুক্তির বেলায় অভ্যন্তরীণ উপকরণগুলো থেকে ভারত ঠিক সুবিধাজনক অবস্থাটি বেছে নিয়েছে। তাই দেশটি তাদের নির্বাচনের কথা বলছে, জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলছে।
কিন্তু এ সুবিধাজনক অবস্থান নেয়ার মানে কি? ভারত তো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতবোন অঞ্চলে যেতে বাংলাদেশের কাছে করিডোর চাইছে। আর এ চাওয়ার পক্ষে যারা বাংলাদেশে জনসংযোগের কাছ করছেন, তারা ‘ভারত তিস্তায় পানিবণ্টন চুক্তিতে রাজি হলে দেশটিকে বাংলাদেশের খরচে দেশের ওপর দিয়ে করিডোর দেয়া চলে’ ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে তিস্তায় পানি না এলে করিডোর মিলবে কি করে? প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, তিস্তায় চুক্তি না করে কিংবা শেখ হাসিনার সরকারকে কোনো ছাড় না দিয়েই করিডোর মিলছে। বাংলাদেশ খোদ ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে করিডোরের অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে। অবকাঠামো তৈরি করার কাজ এগিয়ে চলছে, এটা জানার জন্য গোপন নথিপত্র আবিষ্কারের দরকার নেই, সবকিছু তো প্রকাশ্যেই হচ্ছে, বাংলাদেশেই হচ্ছে।
তিস্তা তো একটা নদী মাত্র, বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন সব আর্ন্তজাতিক নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। তাতে তো করিডোর বন্ধ করে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার। এমন অবস্থায়, সুবিধাজনক অবস্থান বেছে না নেয়ার মতো কোনো জরুরত তো কংগ্রেসের সামনে নেই। কেন নেই? আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে ঠিক এমন কোন অবস্থা তৈরি হলো যে, করিডোরের মতো বিশাল সুবিধা দিয়েও একটি মাত্র আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন চুক্তিতে ভারতের নারাজিকে মেনে নিতে হচ্ছে তাকে? এ প্রশ্নের জবাব তালাশের প্রসঙ্গ ভিন্ন।
সে জবাব যাই হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের রাজ্যের পানি ‘চাহিদা’ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে একটি অভিন্ন নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না ভারত। একটি আর্ন্তজাতিক নদীর ক্ষত্রে কোনো দেশ বা দেশের কোনো রাজ্যের এ ধরনের অবস্থান নেয়ার সুযোগ মোটেই নেই। তিস্তার পানিতে এর অববাহিকার সব জনগোষ্ঠির অধিকার রয়েছে। উজানের দেশ হিসেবে ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে পানি দেবে না, এ ধরনের দাবি করা যায় না, করলেও তার কোনো ভিত্তি দাঁড় করানো যায় না।
বাংলাদেশের ৫৭টি আর্ন্তজাতিক নদী রয়েছে। বাংলাদেশকে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে যাওয়া প্রয়োজন। আর্ন্তজাতিক মতামত সৃষ্টির জন্যে, দরকার হলে মামলা করবার জন্যে যেতে হবে। অভিন্ন নদী-পাহাড়-পর্বত এগুলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে। কোনো রাষ্ট্র চাইলেই অভিন্ন নদীতে একক শাসন করতে পারে না। অববাহিকার সকল দেশের সর্বসম্মতিক্রমেই নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অববাহিকার সকল দেশের স্বার্থেই কেবল নদী শাসন করা যেতে পারে। নদীতে বাঁধ দিয়ে অববাহিকার দেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। পানির প্রবাহের ওপরে একক সার্বভৌমত্বের দাবি করা যাবে না। দেশে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বা যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, জনগণকে এ কথা তুলতে হবে।
বর্তমান সরকারকে প্রশ্ন করতে হবে, তাদের সামনে ঠিক এমন কোন অবস্থা তৈরি হলো যে, নিজেদের খরচে ভারতকে করিডোরের মত বিশাল সুবিধা দিয়েও একটি মাত্র আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন চুক্তিতে দেশটির নারাজিকে মেনে নিতে হচ্ছে তাকে? এ প্রশ্নের জবাব চাইতে হবে সরকারের কাছে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক
ইমেইল: kamruzzaman46@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালে ভারত সফরকালে আশায় ছিলেন যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। ভারত চুক্তি করেনি। সরকারের আশা ছিল যে অন্তত একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি হবে। ভারত করেনি। ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সামনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসলেন। সেবারও শেখ হাসিনার সরকার খুব করে আশা করেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হবে। চুক্তি হলো না। এ যাত্রায় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হলো, সামনে তাদের উপনির্বাচন। তাই এ চুক্তি এখন করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত ৯ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির ভারত সফরে গেলেন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময় নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু এবারেও তিনি আশ্বাসটুকু পর্যন্ত পেলেন না। তিস্তায় পানি পাবার আশা এখন একদমই টিমটিমে।
শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদে আগামী দুই বছরের মধ্যে চুক্তিটি করছে না ভারত। ভারত রাষ্ট্র হিসেবে মূলত কতগুলো রাজ্যের ‘ইউনিয়ন’। ইউনিয়ন অফ ইনডিয়া। প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষেত্র ছাড়া প্রত্যেকটি রাজ্য সাংবিধানিকভাবেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বাধীন। পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজে যদিও এখতিয়ার ইউনিয়ন সরকারের, কিন্তু যদি এতে কোনো রাজ্যের স্বার্থ বিশেষভাবে যুক্ত থাকে তবে সাধারণত রাজ্য সরকারের সমর্থন না থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার একক সিদ্ধান্তে আর্ন্তজাতিক চুক্তি করে না। এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রেওয়াজ।
সেক্ষেত্রে তিস্তায় চুক্তি করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রে কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন জোটসঙ্গী তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির সমর্থন দরকার। এ চুক্তিতে মমতার সমর্থন নেই নানা কারণে।
ওদিকে দেশটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এগিয়ে আসছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী মমতার সমর্থন প্রয়োজন কংগ্রেসের। কংগ্রেসের সামনে যদি তিস্তা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একটিকে বেছে নিতে হবে, নিশ্চিতভাবেই তিস্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না কংগ্রেস। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি আর হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর? মমতার আগামী মেয়াদে জিতে আসার লড়াই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক যুগের বাম শাসনকে হারিয়ে সাবেক কংগ্রেস নেত্রী মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে, প্রধানত কেন্দ্রের কাছে ‘নতজানু’ বামদের বিরুদ্ধে ‘পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙালি’র স্বার্থ ক্ষুন্ন করার লাগাতার অভিযোগ এনে। মমতা আগামী নির্বাচনেও জিততে চাইছেন এবং কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারে মমতার মতকে প্রাধান্য দেবে। কংগ্রেসের রাজ্য শাখা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ‘সঙ্গী’ হয়ে থাকার ব্যাপারে বিনীত ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কেন?
কারণ, নানা ভাষা ও সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত নানা জাতি-গোষ্ঠির মাতৃভূমি ভারত। এই আলাদা আলাদা মাতৃভূমিগুলোতে নানা রাজ্যের স্থানীয় দলগুলোর জনসমর্থন ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষত, যেসব জাতির লোকেরা মনে করছে যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বেলায় কেন্দ্রের তরফে তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে, সেসব রাজ্যে এ হার বেশি। প্রাচীন জাতীয় দলটি, বৃটিশরা যার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছে সেই ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে ক্রমশই স্থানীয় দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বৃটিশরা চলে যাবার ছয় দশক পরেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটিতে আঞ্চলিক বৈষম্যের তীব্রতা এত বেশি বলে নাগরিকদের চোখে ধরা পড়েছে যে, তামাম হিন্দুস্তানকে নিজেদের এক সুতায় গেথে রাখার মতো আবেদন দলটির কাছে নেই। অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়বাদী ভারতীয় জনতা পার্টি ওরফে বিজেপি’র সর্বভারতীয় হিন্দুত্বের আবেদনও সাড়া জাগাতে পারছে না স্থানীয় লোকস্বার্থের বিপরীতে। তাদেরও জোট করেই কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে।
কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকতে ভারতীয় রাজনীতির এ জোট নির্ভরতা’র অনিবার্যতা সামনের বছরগুলোতে হাওয়া মিলিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা বা সম্ভাবনা এখনও টের করা যাচ্ছে না। এ রাজনীতিতে কংগ্রেসের কোনো ‘চিরায়ত মিত্র’ নন মমতা আর তার তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলাদেশে যেমন কিছু বাম দল যে কোনো শর্তেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকতে ‘আদর্শগতভাবে বাধ্য’ অবস্থানে থাকে, মমতার তৃণমূলের তা নেই। বিজেপি’র সঙ্গে হাত মেলাতে তার সামনে কোনো ধরনের বাধা নেই, এটা প্রমাণিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের মত জোটে নেহাতই দলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ভারতে জোট হয় না, আগেই বলেছি। রাজ্যভিত্তিক দলগুলোর সমর্থনে জোট করা ছাড়া কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসাই দেশটিতে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে তিস্তা চুক্তিতে রাজি হয়ে মমতার মতো জোটসঙ্গী হারাতে চাইবে কংগ্রেস, এমনটি ধরে নেবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখছি না।
কিন্তু এটুকুই অবস্থার সামগ্রিক চিত্র নয়। এর চেয়েও বড় ঝুঁকি নিয়ে কি কংগ্রেস অতীতে কোনো আর্ন্তজাতিক চুক্তি করেনি? করেছে। কেন্দ্রে জোটসঙ্গী বামদলগুলো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির চরম বিরোধী ছিল। জোট থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবার হুমকি দিচ্ছিল, বিপরীতে চুক্তি না হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি দিচ্ছিলেন ড. মনমোহন সিং। সেই সময়ে এত বিরোধীতার মুখেও চুক্তি করেছিল ভারত। আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে, সন্ধি-চুক্তি-সমঝোতা করতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই তা নানা অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় অবস্থা ও শর্তের সঙ্গে সাংর্ঘষিক হয়। সে সাংর্ঘষিক অবস্থার ঝুঁকি যতটা সম্ভব কমিয়েই আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হয়। এমন কোনো দেশ নেই দুনিয়ায়, যারা এ অভিজ্ঞতার মুখে পড়েনি। সর্বশেষ ফ্রান্সের উদাহরণ দেয়া যায়, ইউরো মুদ্রা অঞ্চল টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জনমতের একাংশের মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে হারলেন রাষ্ট্রপতি সারকোজি। যতই ইউরো মুদ্রা বিরোধী ভাবসাব নিয়ে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ জিতে আসুন না কেন, ইউরো মুদ্রা অঞ্চল ও অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে ছাড় দিতে হবে তাকেও।
কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশকে তিস্তায় পানিটুকু পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে না আভ্যন্তরীণ বিষয়কে বাধা হিসেবে দেখিয়ে। যতদিন ভারত থাকবে, ততদিন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকবে। নির্বাচন থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা অগ্রাধিকারের ইস্যু থাকবে। এটা স্বাভাবিক। দেশের জনমত, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান- এসবই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মৌলিক উপকরণ হিসেবে কাজ করে। এসবের অবস্থা রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য হয় সুবিধা কিংবা অসুবিধা তৈরি করে। ক্ষমতাসীনরা চাইলে রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সুবিধাকে অসুবিধায় আবার অসুবিধাকে সুবিধায় পরিণত করতে পারে। তিস্তা চুক্তির বেলায় অভ্যন্তরীণ উপকরণগুলো থেকে ভারত ঠিক সুবিধাজনক অবস্থাটি বেছে নিয়েছে। তাই দেশটি তাদের নির্বাচনের কথা বলছে, জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলছে।
কিন্তু এ সুবিধাজনক অবস্থান নেয়ার মানে কি? ভারত তো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতবোন অঞ্চলে যেতে বাংলাদেশের কাছে করিডোর চাইছে। আর এ চাওয়ার পক্ষে যারা বাংলাদেশে জনসংযোগের কাছ করছেন, তারা ‘ভারত তিস্তায় পানিবণ্টন চুক্তিতে রাজি হলে দেশটিকে বাংলাদেশের খরচে দেশের ওপর দিয়ে করিডোর দেয়া চলে’ ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে তিস্তায় পানি না এলে করিডোর মিলবে কি করে? প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, তিস্তায় চুক্তি না করে কিংবা শেখ হাসিনার সরকারকে কোনো ছাড় না দিয়েই করিডোর মিলছে। বাংলাদেশ খোদ ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে করিডোরের অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে। অবকাঠামো তৈরি করার কাজ এগিয়ে চলছে, এটা জানার জন্য গোপন নথিপত্র আবিষ্কারের দরকার নেই, সবকিছু তো প্রকাশ্যেই হচ্ছে, বাংলাদেশেই হচ্ছে।
তিস্তা তো একটা নদী মাত্র, বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন সব আর্ন্তজাতিক নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। তাতে তো করিডোর বন্ধ করে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার। এমন অবস্থায়, সুবিধাজনক অবস্থান বেছে না নেয়ার মতো কোনো জরুরত তো কংগ্রেসের সামনে নেই। কেন নেই? আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে ঠিক এমন কোন অবস্থা তৈরি হলো যে, করিডোরের মতো বিশাল সুবিধা দিয়েও একটি মাত্র আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন চুক্তিতে ভারতের নারাজিকে মেনে নিতে হচ্ছে তাকে? এ প্রশ্নের জবাব তালাশের প্রসঙ্গ ভিন্ন।
সে জবাব যাই হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের রাজ্যের পানি ‘চাহিদা’ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে একটি অভিন্ন নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না ভারত। একটি আর্ন্তজাতিক নদীর ক্ষত্রে কোনো দেশ বা দেশের কোনো রাজ্যের এ ধরনের অবস্থান নেয়ার সুযোগ মোটেই নেই। তিস্তার পানিতে এর অববাহিকার সব জনগোষ্ঠির অধিকার রয়েছে। উজানের দেশ হিসেবে ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে পানি দেবে না, এ ধরনের দাবি করা যায় না, করলেও তার কোনো ভিত্তি দাঁড় করানো যায় না।
বাংলাদেশের ৫৭টি আর্ন্তজাতিক নদী রয়েছে। বাংলাদেশকে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে যাওয়া প্রয়োজন। আর্ন্তজাতিক মতামত সৃষ্টির জন্যে, দরকার হলে মামলা করবার জন্যে যেতে হবে। অভিন্ন নদী-পাহাড়-পর্বত এগুলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে। কোনো রাষ্ট্র চাইলেই অভিন্ন নদীতে একক শাসন করতে পারে না। অববাহিকার সকল দেশের সর্বসম্মতিক্রমেই নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অববাহিকার সকল দেশের স্বার্থেই কেবল নদী শাসন করা যেতে পারে। নদীতে বাঁধ দিয়ে অববাহিকার দেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। পানির প্রবাহের ওপরে একক সার্বভৌমত্বের দাবি করা যাবে না। দেশে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বা যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, জনগণকে এ কথা তুলতে হবে।
বর্তমান সরকারকে প্রশ্ন করতে হবে, তাদের সামনে ঠিক এমন কোন অবস্থা তৈরি হলো যে, নিজেদের খরচে ভারতকে করিডোরের মত বিশাল সুবিধা দিয়েও একটি মাত্র আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন চুক্তিতে দেশটির নারাজিকে মেনে নিতে হচ্ছে তাকে? এ প্রশ্নের জবাব চাইতে হবে সরকারের কাছে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক
ইমেইল: kamruzzaman46@gmail.com
No comments