পানির যুদ্ধে বাংলাদেশ by আলফাজ আনাম
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালের পর দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। এখন যেমন তেল ও গ্যাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে, তেমনি পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েও যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পানি সঙ্কট মার্কিন নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সমীক্ষা চালায়। গত ২২ মার্চ অফিস অব দ্য ডাইরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স (ওডিএনআই) এই তথ্য প্রকাশ করে।
আগামীতে বিশ্বে পানি নিয়ে সঙ্ঘাতের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সিআইএ ও এফবিআইসহ বিদেশে গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে জড়িত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, উজানের দেশগুলো ভাটির দেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় ক্ষোভের কারণে সঙ্ঘাত বাড়বে। এমনকি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। পানি নিয়ন্ত্রণের স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করতে পারে। যা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এর আগে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর জন কেরির নেতৃত্বাধীন ফরেন রিলেশন্স কমিটিও ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পানি নিয়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করে রিপোর্ট দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় পানির অভাবে এ অঞ্চলে বিপজ্জনক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও মার্কিন বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে কোন কোন দেশের মধ্যে পানি নিয়ে যুদ্ধের এই ঝুঁকি রয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে এই সমীক্ষায় কোন কোন নদী ও অববাহিকা সঙ্ঘাতের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। নীল নদ নিয়ে মিসর, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করা হয়েছে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী নিয়ে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, মেকং নদী নিয়ে চীন ও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ; জর্ডান নদী নিয়ে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে ভারতের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং আমুদরিয়া নদী নিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেয়া এই রিপোর্টের আগে বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরগেলদ্দিন ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে মন্তব্য করেছিলেন “আগামী বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের অন্য অঞ্চল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত না হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া যে পানি নিয়ে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্ত্তত তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।”
পানি নিয়ে যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। সাড়ে চার হাজার বছর আগে নগররাষ্ট্র লাগাস ও উমার মধ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানি নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল। আর আধুনিককালে মধ্যপ্রাচ্যে পানি নিয়ে যুদ্ধ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। গোলান উপত্যকা দখলের উদ্দেশ্যও ছিল পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, যাতে ইসরাইলের হাতে থাকে।
এ ছাড়া সেনাগেল নদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ হয়েছিল। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক নীল নদের ওপর ইথওপিয়ার একটি ড্যাম উড়িয়ে দেয়ার জন্য বিশেষ বাহিনী পাঠানোর হুমকি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এখনো সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
২.
পানি নিয়ে যুদ্ধের আশঙ্কা কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি নিয়ে এই সঙ্ঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পানি নিয়ে এক সঙ্ঘাতের মধ্যে অবস্থান করছে। আরো স্পষ্ট করে বলতে হয়, উজানের দেশ ভারত অনেক আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এই যুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের মে মাসে, পরীক্ষামূলকভাবে একটি ব্যারাজ চালু করার মাধ্যমে। যা আর কখনো বন্ধ হয়নি। ফারাক্কা ব্যারাজ নামে পরিচিত এই ব্যারাজটি চালু করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর।
এই ব্যারাজ চালুর পর বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টির বেশি নদী। বেড়েছে লবণাক্ততা। ফসলের উৎপাদন কমেছে। গঙ্গা বা পদ্মার তীরবর্তী অসংখ্য মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে অন্য জায়গায় বসতি গড়েছে। পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন লবণাক্ততার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। গঙ্গা বা পদ্মার উপকূলের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যয়ের পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য যেভাবে ধ্বংস হয়েছে তা যেকোনো যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে যেমন আক্রান্ত দেশ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, প্রতিবাদ জানায়, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে; তেমনি বাংলাদেশের মানুষও ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘেও উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশে এই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিক্ষোভ হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ মে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে লংমার্চ হয়েছিল; যাতে দেশের হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। আমন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী এই সঙ্কটের দিকটি উঠে এসেছিল। এরপর ফারাক্কা ইস্যুটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করা হয়েছিল। এর ফল হিসেবে ভারত মোটামুটি একটি নায্য পানিবণ্টন চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর গ্যারান্টি ক্লজসহ একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি, বরং নতুন করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে।
১৯৯৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিষয়টি আবারো জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ডিসেম্বর মাসে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ চুক্তির চেয়ে কম পানি পায়। ৩০ বছর বা ৩৬০ মাসের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। চুক্তি অনুসারে ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশ-ভারত সমান ভাগে পাবে। এটি হচ্ছে চুক্তির মূল বিষয়। চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলেই চুক্তির পানিবণ্টন ফর্মুলা অকার্যকর হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দুই দেশ জরুরি ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে পানির নতুন পরিমাণ ঠিক করবে। গঙ্গার উজানে ব্যাপক হারে টেনে নেয়ার পর ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে সে পানির ভাগই বাংলাদেশ পাবে। কার্যত এই চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পুরো পানির ওপর ভাটির দেশ বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই তা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। পানিবণ্টন চুক্তির এটি বড় ধরনের দুর্বল দিক।
ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি মেট্রো এলাকা, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পানি যথেষ্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের হরিদ্বারে, উত্তর কাশির কাছে মালেরিতে ও নারোরার কাছে গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরের তেহারিতে গঙ্গার ওপর আর একটি বড় আকারের বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে ৫০ হাজার কিউসেকের নিচ দিয়েই প্রবাহিত হবে তা দুই দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে জানা সত্ত্বেও হয়তো তখন একটি চুক্তি জরুরি ছিল। সে চুক্তি আদৌ কার্যকর হবে কি না, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কি না, এসব বিষয় কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার এই পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এ পর্যন্ত ভারতের সাথে চুক্তি পর্যালোচনা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
৩.
শুধু গঙ্গা বা পদ্মা নয়, বাংলাদেশ-ভারতের সবগুলো অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আশা করা হয়েছিল তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। কিন্তু অনেক দেনদরবারের পর ভারতের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম শরিক কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিতে সম্মত নন। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভয়াবহ রকম কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতকে আগেই সব ধরনের সুবিধা দেয়ার ফলে বাংলাদেশ ভারতের সাথে দরকষাকষির শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ এতটাই নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে, তিস্তার পানিবণ্টনের সামান্যতম অগ্রগতি না হলেও ফেনী নদীর পানি ব্যবহারে ভারতকে সম্মতি দেয়া হয়েছে।
তিস্তা নদীর উজানে ভারত একটি ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ শুধু অকার্যকর হয়ে পড়েনি। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান এই নদীটি শুকিয়ে গেছে। তিস্তা পারের মানুষ এখন পানির জন্য হাহাকার করছে। এ অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পদ্মা ও তিস্তার পানিশূন্যতার কারণে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন বাড়ছে তেমনি আর্সেনিক সমস্যাসহ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৪৬ ভাগ আসে কৃষি খাত থেকে। নদীগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ফেলায় দেশের কৃষিব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
৪.
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদী ভারত থেকে নেমে এসেছে। এই নদীগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলো বড় নদীর ওপর ভারত কোনো না কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে। বাংলাদেশের নদীগুলো হয়ে পড়ছে পানিশূন্য। পদ্মা ও তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এখন মরুকরণ শুরু হয়েছে। এখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল আরেকটি বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ভারতের মনিপুরে বরাক ও টুইভাই নদীর সংযোগস্থলে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় একটি ড্যাম নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এ ড্যামের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ শুধু বাধাগ্রস্ত হবে না, ভূমিকম্পজনিত যেকোনো বিপর্যয়ে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু ভারত এই ড্যাম নির্মাণের নীতি থেকে সরে আসেনি। ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না। এমন আশ্বাস ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সময়ও দেয়া হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর তা আর কখনোই বন্ধ হয়নি।
৫.
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত পুরোপুরিভাবে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের মানুষ এই যুদ্ধে শুধু হেরে যাচ্ছে না, কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিপর্যয় অপেক্ষা করছে; ইতোমধ্যে চীন ঘোষণা করেছে তারা ব্রহ্মপুত্রের উজানেও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। অপর দিকে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করছে। ব্রহ্মপুত্রের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে বাংলাদেশের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের পানি পাওয়ার প্রধান উৎস নদীগুলো পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়বে। পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো কী করতে পারে? তাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পানি সমস্যার দিকগুলো এখনই না তুলে ধরলে এসব সঙ্কট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার পানির যুদ্ধে বাংলাদেশ হয়তো এখন প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র।
আলফাজ আনাম: সাংবাদিক
alfazanambd@yahoo.com
আগামীতে বিশ্বে পানি নিয়ে সঙ্ঘাতের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সিআইএ ও এফবিআইসহ বিদেশে গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে জড়িত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, উজানের দেশগুলো ভাটির দেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় ক্ষোভের কারণে সঙ্ঘাত বাড়বে। এমনকি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। পানি নিয়ন্ত্রণের স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করতে পারে। যা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এর আগে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর জন কেরির নেতৃত্বাধীন ফরেন রিলেশন্স কমিটিও ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পানি নিয়ে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করে রিপোর্ট দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় পানির অভাবে এ অঞ্চলে বিপজ্জনক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও মার্কিন বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে কোন কোন দেশের মধ্যে পানি নিয়ে যুদ্ধের এই ঝুঁকি রয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে এই সমীক্ষায় কোন কোন নদী ও অববাহিকা সঙ্ঘাতের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। নীল নদ নিয়ে মিসর, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করা হয়েছে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী নিয়ে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, মেকং নদী নিয়ে চীন ও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ; জর্ডান নদী নিয়ে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে ভারতের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং আমুদরিয়া নদী নিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেয়া এই রিপোর্টের আগে বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরগেলদ্দিন ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে মন্তব্য করেছিলেন “আগামী বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের অন্য অঞ্চল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত না হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া যে পানি নিয়ে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্ত্তত তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।”
পানি নিয়ে যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। সাড়ে চার হাজার বছর আগে নগররাষ্ট্র লাগাস ও উমার মধ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানি নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল। আর আধুনিককালে মধ্যপ্রাচ্যে পানি নিয়ে যুদ্ধ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। গোলান উপত্যকা দখলের উদ্দেশ্যও ছিল পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, যাতে ইসরাইলের হাতে থাকে।
এ ছাড়া সেনাগেল নদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ হয়েছিল। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক নীল নদের ওপর ইথওপিয়ার একটি ড্যাম উড়িয়ে দেয়ার জন্য বিশেষ বাহিনী পাঠানোর হুমকি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এখনো সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
২.
পানি নিয়ে যুদ্ধের আশঙ্কা কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি নিয়ে এই সঙ্ঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পানি নিয়ে এক সঙ্ঘাতের মধ্যে অবস্থান করছে। আরো স্পষ্ট করে বলতে হয়, উজানের দেশ ভারত অনেক আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এই যুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের মে মাসে, পরীক্ষামূলকভাবে একটি ব্যারাজ চালু করার মাধ্যমে। যা আর কখনো বন্ধ হয়নি। ফারাক্কা ব্যারাজ নামে পরিচিত এই ব্যারাজটি চালু করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর।
এই ব্যারাজ চালুর পর বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টির বেশি নদী। বেড়েছে লবণাক্ততা। ফসলের উৎপাদন কমেছে। গঙ্গা বা পদ্মার তীরবর্তী অসংখ্য মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে অন্য জায়গায় বসতি গড়েছে। পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন লবণাক্ততার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। গঙ্গা বা পদ্মার উপকূলের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যয়ের পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য যেভাবে ধ্বংস হয়েছে তা যেকোনো যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে যেমন আক্রান্ত দেশ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, প্রতিবাদ জানায়, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে; তেমনি বাংলাদেশের মানুষও ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘেও উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশে এই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিক্ষোভ হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ মে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে লংমার্চ হয়েছিল; যাতে দেশের হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। আমন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী এই সঙ্কটের দিকটি উঠে এসেছিল। এরপর ফারাক্কা ইস্যুটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করা হয়েছিল। এর ফল হিসেবে ভারত মোটামুটি একটি নায্য পানিবণ্টন চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর গ্যারান্টি ক্লজসহ একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি, বরং নতুন করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে।
১৯৯৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিষয়টি আবারো জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ডিসেম্বর মাসে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ চুক্তির চেয়ে কম পানি পায়। ৩০ বছর বা ৩৬০ মাসের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। চুক্তি অনুসারে ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশ-ভারত সমান ভাগে পাবে। এটি হচ্ছে চুক্তির মূল বিষয়। চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলেই চুক্তির পানিবণ্টন ফর্মুলা অকার্যকর হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দুই দেশ জরুরি ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে পানির নতুন পরিমাণ ঠিক করবে। গঙ্গার উজানে ব্যাপক হারে টেনে নেয়ার পর ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে সে পানির ভাগই বাংলাদেশ পাবে। কার্যত এই চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পুরো পানির ওপর ভাটির দেশ বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই তা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। পানিবণ্টন চুক্তির এটি বড় ধরনের দুর্বল দিক।
ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি মেট্রো এলাকা, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পানি যথেষ্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের হরিদ্বারে, উত্তর কাশির কাছে মালেরিতে ও নারোরার কাছে গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরের তেহারিতে গঙ্গার ওপর আর একটি বড় আকারের বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে ৫০ হাজার কিউসেকের নিচ দিয়েই প্রবাহিত হবে তা দুই দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে জানা সত্ত্বেও হয়তো তখন একটি চুক্তি জরুরি ছিল। সে চুক্তি আদৌ কার্যকর হবে কি না, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কি না, এসব বিষয় কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার এই পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এ পর্যন্ত ভারতের সাথে চুক্তি পর্যালোচনা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
৩.
শুধু গঙ্গা বা পদ্মা নয়, বাংলাদেশ-ভারতের সবগুলো অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আশা করা হয়েছিল তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। কিন্তু অনেক দেনদরবারের পর ভারতের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম শরিক কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিতে সম্মত নন। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভয়াবহ রকম কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতকে আগেই সব ধরনের সুবিধা দেয়ার ফলে বাংলাদেশ ভারতের সাথে দরকষাকষির শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ এতটাই নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে, তিস্তার পানিবণ্টনের সামান্যতম অগ্রগতি না হলেও ফেনী নদীর পানি ব্যবহারে ভারতকে সম্মতি দেয়া হয়েছে।
তিস্তা নদীর উজানে ভারত একটি ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ শুধু অকার্যকর হয়ে পড়েনি। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান এই নদীটি শুকিয়ে গেছে। তিস্তা পারের মানুষ এখন পানির জন্য হাহাকার করছে। এ অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পদ্মা ও তিস্তার পানিশূন্যতার কারণে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন বাড়ছে তেমনি আর্সেনিক সমস্যাসহ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৪৬ ভাগ আসে কৃষি খাত থেকে। নদীগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ফেলায় দেশের কৃষিব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
৪.
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদী ভারত থেকে নেমে এসেছে। এই নদীগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলো বড় নদীর ওপর ভারত কোনো না কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে। বাংলাদেশের নদীগুলো হয়ে পড়ছে পানিশূন্য। পদ্মা ও তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এখন মরুকরণ শুরু হয়েছে। এখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল আরেকটি বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ভারতের মনিপুরে বরাক ও টুইভাই নদীর সংযোগস্থলে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় একটি ড্যাম নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এ ড্যামের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ শুধু বাধাগ্রস্ত হবে না, ভূমিকম্পজনিত যেকোনো বিপর্যয়ে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু ভারত এই ড্যাম নির্মাণের নীতি থেকে সরে আসেনি। ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না। এমন আশ্বাস ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সময়ও দেয়া হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর তা আর কখনোই বন্ধ হয়নি।
৫.
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত পুরোপুরিভাবে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের মানুষ এই যুদ্ধে শুধু হেরে যাচ্ছে না, কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিপর্যয় অপেক্ষা করছে; ইতোমধ্যে চীন ঘোষণা করেছে তারা ব্রহ্মপুত্রের উজানেও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। অপর দিকে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করছে। ব্রহ্মপুত্রের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে বাংলাদেশের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের পানি পাওয়ার প্রধান উৎস নদীগুলো পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়বে। পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো কী করতে পারে? তাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পানি সমস্যার দিকগুলো এখনই না তুলে ধরলে এসব সঙ্কট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার পানির যুদ্ধে বাংলাদেশ হয়তো এখন প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র।
আলফাজ আনাম: সাংবাদিক
alfazanambd@yahoo.com
No comments