হিলারি কি ত্রাণকর্তা? by কামরুজ্জামান
বাংলাদেশে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরটি এমন এক সময়ের ঘটনা যখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে, যখন একের পর এক গুমের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত, যখন দমনপীড়ন আর হামলা-মামলায় মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে ঠেকেছে, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটছে
এবং যখন ড. ইউনূসের সাথে সরকারের বৈরী আচরণে মার্কিন প্রশাসনও ক’দিন আগেও বেশ সরব ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ভাবছেন- হয়তো বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিলারির এ সফর। হয়তো ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য হাসিনাকে চাপ দেবেন হিলারি। হয়তো হামলা-মামলা ও দমন-পীড়ন বন্ধের কথা বলবেন। হয়তো সব দলের অংশগ্রহণে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্যই তার এ সফর । হয়তো ড. ইউনূসের একটা সম্মানজনক সমাধান চান তিনি। না, তিনি এসব কিছু চান না। এসবের জন্যেও তার এ সফর নয়। এ সফর শুধু তার নিজ দেশের স্বার্থের জন্যে। তবে তিনি মিডিয়ার সামনে এসবের বুলি আওড়াবেন ঠিকই। আর সাধারণ মানুষ মনে করবে- এই তো হিলারি বাংলাদেশের একজন ত্রাণকর্তা।
হিলারির এ সফরের গুরুত্ব অনেক গভীর। স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত, ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে আমরা খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি। হিলারি চীন সফর করেছেন। এর পর পরই তার বাংলাদেশ সফর। চীন সফরে তিনি স্ট্রাটেজিক দিকের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের’ কথা বলেছে। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’র’ ওপর জোর দিচ্ছে। হিলারির এ সফরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ। এখানে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ বলতে বোঝায়- এ অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশিদারিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করতে। চীনকে মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহুল আলোচিত এই কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটা হবে অনেকটা ভারতের সঙ্গে করা বাংলাদেশের সহযোগিতার নেটওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের মতো। চীনের পশ্চিম সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যে যৌথ নজরদারি বাড়াচ্ছে সেখানে বাংলাদেশকেও ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চীন নির্ভরশীলতা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামরিক বিষয়াদিতে বাংলাদেশ চীনের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা কমিয়ে এনে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে তার মুখাপেক্ষী করে তুলতে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে হিলারির সফরের মূল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদের প্রতি মার্কিনী লোলুপ দৃষ্টি। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে ভারত-মার্কিন বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে। মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাকেও ভারত-মার্কিন সমন্বিত কৌশলের মধ্যে নিয়ে আসার টার্গেট করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার গতিশীল সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে এই দুটি দেশ সর্বতোভাবে উপকৃত হচ্ছিল। কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে, হিলারির ঢাকা সফরের পর বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে ভূ-রাজনৈতিক এক খেলার সূচনা হবে, যেটা বর্তমানে চলছে মালাক্কা প্রণালী নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ যেসব কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেগুলো হলো- বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, মায়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া মূলত এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র একসাথে কাজ করছে। এবং ভবিষ্যতেও এই নিরাপত্তা রক্ষার সহযোগিতা আরও বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতির অর্থই হচ্ছেই ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনোকোফিলিপস বঙ্গোপসাগরের দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কোম্পানিটি আরও ছয়টি ব্লকে অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছে। এসব ব্লক নিয়ে চীনারা প্রস্তাব দেয়ার আগেই দ্রুত চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য হিলারি চাপ দেবেন।
আকস্মিকভাবে হিলারির এসফর অনুষ্ঠিত হয়নি। নিরাপত্তা সংলাপের বিষয়টিও হঠাৎ করে অনুষ্ঠিত হয়নি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনিয়র কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন- রাজনীতি বিষয়ক উপমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান এবং রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ড্রু শাপিরো। শাপিরো বলেছেন, “বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এবং এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় গত দশকে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে। বাংলাদেশ তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে। সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুঁজছে। এই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সমরাস্ত্র আমাদের অংশীদারদের কাছে বিক্রি করতে চাই।”
অন্যদিকে, শেখ হাসিনা চাইছেন যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সমূলে বাতিল করতে হয় তবুও তিনি করতে চাইবেন। যদি নিজের অধীনে নিবার্চন করতে হয় তবুও তিনি তা করতে চাইবেন। যদি ভারতের কাছে বিনা টাকায় ট্রান্জিট দিতে হয় তবুও তিনি তা দিতে চাইবেন। টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ গুম হলেও তিনি খুঁজে বের করতে চাইবেন না। দেশের স্বার্থে নয়, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথেও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে চাইবেন। হিলারির কাছে অন্য কোন এজেণ্ডাই মুখ্য নয়, তার নিজ দেশের স্বার্থই মুখ্য, ঠিক বিপরীতভাবে হাসিনার কাছে নিজ দেশের স্বার্থ মুখ্য নয়, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আসল কথা। এখানে উভয় পক্ষের মাঝে স্বার্থ কেন্দ্রিক একরকম মিল রয়েছে। আর এ কারনেই ড. ইউনূসের ইস্যুটি ছাপিয়ে, মানবাধিকারের নাজুক অবস্থাকে ছাপিয়ে, বাংলাদেশের স্বার্থকে ছাপিয়ে হাসিনা ও হিলারি ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে পারছেন।
‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ এজেণ্ডাটির সাথে আরও যেসব এজেণ্ডা থাকবে সেগুলো হলো- ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা), সন্ত্রাসবাদ দমন, নিরাপত্তা, বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা। তবে এ এজেণ্ডাগুলো মুখ্য বিষয় নয় হিলারির এ সফরে। মুখ্য বিষয় হচ্ছে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’। এমনকি চলমান ইস্যুগুলোও মুখ্য নয়। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করা, গুম বন্ধ করা, হামলা-মামলা বন্ধ করা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, ড. ইউনূসের সম্মান ফিরিয়ে আনার মত বিষয়গুলোও মুখ্য নয় এই সফরে। তার কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে মার্কিন স্বার্থ। তাদের নিজস্ব এজেণ্ডা অর্থাৎ ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ তবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ শব্দটির বদলে ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ শব্দটি ব্যবহার করা হতে পারে।
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি গ্রহণের সময় ‘রেশনাল চয়েস থিওরিটি’ বিবেচনায় রাখা হয়। এ থিওরির মূল কথা হলো- অনেকগুলো বিকল্প পলিসির মধ্য থেকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক পলিসি গ্রহণ করা। ঠিক একইভাবে হিলারির সামনে এখন অনেকগুলো বিকল্প এজেণ্ডা রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের সাথে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তোলা। তাই হিলারি এটিই গ্রহণ করবে। এটাই তার জন্যে রেশনাল চয়েস। আর এভাবেই নির্ধারিত হয় একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি।
এখানে অন্য দেশের জন্য ভালোবাসা কাজ করে না। পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগ-অনুভূতির স্থান নেই। এখানে নিজ দেশের স্বার্থই মুখ্য। জাতীয় স্বার্থই মুখ্য। তাই বাংলাদেশে গুম বন্ধ হলো না বাড়ল তাদের যায় আসে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো নাকি সামরিক সরকার কিংবা একনায়কতন্ত্র চালু হলো এ নিয়ে তাদের যায় আসে না। হামলা-মামলা আর মানবাধিকার পরিস্থিতির বারোটা বাজলেও তাদের যায় আসে না। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীরা যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকরের ছবক দিয়ে বেড়ায় তা একটা মুখোশ ছাড়া আর কিছুই না। তা সংশ্লিষ্ট দেশের সমস্যার ভেতরে ঢোকার মাধ্যম বা উপায় ছাড়া আর কিছুই না। যদি তা না হবে তবে কেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক সরকারসহ পৃথিবীর অন্যান্য সামরিক জান্তাদের সমর্থন ও সাহায়তা দিয়ে গেল? কেন নিকারাগুয়া ও গুয়েতেমালায় গেরিলা গ্রুপগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল? কেন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে?
এ কথা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ স্বার্থের জন্য অন্য দেশের সাথে যে আচরণ করা দরকার সেই আচরণই করবে। আর একথাও নির্মম সত্য যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যেকোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে সব চেষ্টাই করছে এবং করবে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক
ইমেইল: kamruzzaman46@gmail.com
হিলারির এ সফরের গুরুত্ব অনেক গভীর। স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত, ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে আমরা খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি। হিলারি চীন সফর করেছেন। এর পর পরই তার বাংলাদেশ সফর। চীন সফরে তিনি স্ট্রাটেজিক দিকের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের’ কথা বলেছে। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’র’ ওপর জোর দিচ্ছে। হিলারির এ সফরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ। এখানে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ বলতে বোঝায়- এ অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশিদারিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করতে। চীনকে মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহুল আলোচিত এই কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটা হবে অনেকটা ভারতের সঙ্গে করা বাংলাদেশের সহযোগিতার নেটওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের মতো। চীনের পশ্চিম সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যে যৌথ নজরদারি বাড়াচ্ছে সেখানে বাংলাদেশকেও ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চীন নির্ভরশীলতা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামরিক বিষয়াদিতে বাংলাদেশ চীনের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা কমিয়ে এনে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে তার মুখাপেক্ষী করে তুলতে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে হিলারির সফরের মূল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদের প্রতি মার্কিনী লোলুপ দৃষ্টি। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে ভারত-মার্কিন বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে। মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাকেও ভারত-মার্কিন সমন্বিত কৌশলের মধ্যে নিয়ে আসার টার্গেট করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার গতিশীল সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে এই দুটি দেশ সর্বতোভাবে উপকৃত হচ্ছিল। কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে, হিলারির ঢাকা সফরের পর বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে ভূ-রাজনৈতিক এক খেলার সূচনা হবে, যেটা বর্তমানে চলছে মালাক্কা প্রণালী নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ যেসব কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেগুলো হলো- বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, মায়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া মূলত এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র একসাথে কাজ করছে। এবং ভবিষ্যতেও এই নিরাপত্তা রক্ষার সহযোগিতা আরও বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতির অর্থই হচ্ছেই ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনোকোফিলিপস বঙ্গোপসাগরের দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কোম্পানিটি আরও ছয়টি ব্লকে অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছে। এসব ব্লক নিয়ে চীনারা প্রস্তাব দেয়ার আগেই দ্রুত চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য হিলারি চাপ দেবেন।
আকস্মিকভাবে হিলারির এসফর অনুষ্ঠিত হয়নি। নিরাপত্তা সংলাপের বিষয়টিও হঠাৎ করে অনুষ্ঠিত হয়নি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনিয়র কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন- রাজনীতি বিষয়ক উপমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান এবং রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ড্রু শাপিরো। শাপিরো বলেছেন, “বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এবং এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় গত দশকে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে। বাংলাদেশ তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে। সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুঁজছে। এই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সমরাস্ত্র আমাদের অংশীদারদের কাছে বিক্রি করতে চাই।”
অন্যদিকে, শেখ হাসিনা চাইছেন যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সমূলে বাতিল করতে হয় তবুও তিনি করতে চাইবেন। যদি নিজের অধীনে নিবার্চন করতে হয় তবুও তিনি তা করতে চাইবেন। যদি ভারতের কাছে বিনা টাকায় ট্রান্জিট দিতে হয় তবুও তিনি তা দিতে চাইবেন। টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ গুম হলেও তিনি খুঁজে বের করতে চাইবেন না। দেশের স্বার্থে নয়, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথেও ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে চাইবেন। হিলারির কাছে অন্য কোন এজেণ্ডাই মুখ্য নয়, তার নিজ দেশের স্বার্থই মুখ্য, ঠিক বিপরীতভাবে হাসিনার কাছে নিজ দেশের স্বার্থ মুখ্য নয়, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আসল কথা। এখানে উভয় পক্ষের মাঝে স্বার্থ কেন্দ্রিক একরকম মিল রয়েছে। আর এ কারনেই ড. ইউনূসের ইস্যুটি ছাপিয়ে, মানবাধিকারের নাজুক অবস্থাকে ছাপিয়ে, বাংলাদেশের স্বার্থকে ছাপিয়ে হাসিনা ও হিলারি ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে পারছেন।
‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ এজেণ্ডাটির সাথে আরও যেসব এজেণ্ডা থাকবে সেগুলো হলো- ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা), সন্ত্রাসবাদ দমন, নিরাপত্তা, বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা। তবে এ এজেণ্ডাগুলো মুখ্য বিষয় নয় হিলারির এ সফরে। মুখ্য বিষয় হচ্ছে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’। এমনকি চলমান ইস্যুগুলোও মুখ্য নয়। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করা, গুম বন্ধ করা, হামলা-মামলা বন্ধ করা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, ড. ইউনূসের সম্মান ফিরিয়ে আনার মত বিষয়গুলোও মুখ্য নয় এই সফরে। তার কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে মার্কিন স্বার্থ। তাদের নিজস্ব এজেণ্ডা অর্থাৎ ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ তবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ শব্দটির বদলে ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ শব্দটি ব্যবহার করা হতে পারে।
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি গ্রহণের সময় ‘রেশনাল চয়েস থিওরিটি’ বিবেচনায় রাখা হয়। এ থিওরির মূল কথা হলো- অনেকগুলো বিকল্প পলিসির মধ্য থেকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক পলিসি গ্রহণ করা। ঠিক একইভাবে হিলারির সামনে এখন অনেকগুলো বিকল্প এজেণ্ডা রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের সাথে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তোলা। তাই হিলারি এটিই গ্রহণ করবে। এটাই তার জন্যে রেশনাল চয়েস। আর এভাবেই নির্ধারিত হয় একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি।
এখানে অন্য দেশের জন্য ভালোবাসা কাজ করে না। পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগ-অনুভূতির স্থান নেই। এখানে নিজ দেশের স্বার্থই মুখ্য। জাতীয় স্বার্থই মুখ্য। তাই বাংলাদেশে গুম বন্ধ হলো না বাড়ল তাদের যায় আসে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো নাকি সামরিক সরকার কিংবা একনায়কতন্ত্র চালু হলো এ নিয়ে তাদের যায় আসে না। হামলা-মামলা আর মানবাধিকার পরিস্থিতির বারোটা বাজলেও তাদের যায় আসে না। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীরা যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকরের ছবক দিয়ে বেড়ায় তা একটা মুখোশ ছাড়া আর কিছুই না। তা সংশ্লিষ্ট দেশের সমস্যার ভেতরে ঢোকার মাধ্যম বা উপায় ছাড়া আর কিছুই না। যদি তা না হবে তবে কেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক সরকারসহ পৃথিবীর অন্যান্য সামরিক জান্তাদের সমর্থন ও সাহায়তা দিয়ে গেল? কেন নিকারাগুয়া ও গুয়েতেমালায় গেরিলা গ্রুপগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল? কেন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে?
এ কথা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ স্বার্থের জন্য অন্য দেশের সাথে যে আচরণ করা দরকার সেই আচরণই করবে। আর একথাও নির্মম সত্য যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যেকোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে সব চেষ্টাই করছে এবং করবে।
কামরুজ্জামান: মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক
ইমেইল: kamruzzaman46@gmail.com
No comments