আসবে কি নতুন দিনের সাংবাদিকতা? by সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
আমরা কি কোনো পাঠকের কথা জানি যিনি পত্রিকার পাতা উল্টে বিরক্ত বোধ করেন, বলেন “না, আমি যা পড়তে চাই তা খবরের কাগজ দিচ্ছে না।’’ কিংবা এমন কোনো দর্শকের কথা, যিনি টেলিভিশনে একই রকম সংবাদ আর অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে বিরক্ত?
গণমাধ্যম এমন কোনো পাঠক বা দর্শককে হয়তো সরাসরি চেনে না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারে যে পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন সংবাদ পরিবেশনায়, অনুষ্ঠান নির্মাণে। বাংলাদেশে এখন মিডিয়ার প্লাবন চলছে। নতুন সব কাগজ, নতুন চ্যানেল আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল-এ বাজার সয়লাব।
এমন এক সময়ে সাংবাদিকতাটা হচ্ছে কেমন?
সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেন, সাংবাদিকতা এক সময় ছিল পবিত্র পেশা। এই পেশায় সে অর্থে কোনো অর্থবিত্ত ছিলনা, কিন্তু প্রাণ ছিল, মানুষ বিশ্বাস করতো। তথ্যের জন্য সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরতা ছিল অনেক বেশি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি সেরকম নেই। মানুষ এখন শুধু পত্রিকা নির্ভর নয়। আছে তথ্য জানা আর তথ্য জানানোর নানা মাধ্যম। আছে ইন্টারনেট, মোবাইল, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম, বেতার আর টেলিভিশন। মুহূর্তেই সংবাদ হাতের মুঠোয় সব খবর।
গণমাধ্যম বেড়েছে, ফলে বেড়েছে প্রতিযোগিতা। সবাই চায় আগে ছুটতে। কে কার আগে সংবাদ দেবে। সবাই চায় বিশেষ কিছু করতে। ফলে নিরেট, মেদহীন সংবাদ প্রকাশের বা প্রচারের যে নীতি তা ভুলে যায় অনেকেই। অনেক গণমাধ্যমের সংবাদেই এখন তথ্যের চেয়ে থাকে অনেক বেশি গল্প, থাকে মতামত। থাকে না তথ্যের প্রমাণ, থাকেনা সব পক্ষের কথা।
মানুষ তথ্য চায়, নিজেও তথ্য প্রবাহের এই ঢেউয়ে যোগ দিতে চায়। সেই চিন্তা থেকেই সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার শুরু। আজ অনেক সাধারণ মানুষও তথ্য দিচ্ছেন সংবাদ মাধ্যমকে। রিপোর্ট লিখে পাঠকরাও হয়ে উঠছেন সাংবাদিক। এই সাংবাদিকতা মূলত হচ্ছে অনলাইন মাধ্যমে। এই নাগরিক সাংবাদিকরা কেউ বেতন পান, কেউ পান না। কিন্তু তাদের উৎসাহের কমতি নেই।
আর এক নতুন ধরনের সাংবাদিকতা হলো ব্লগিং। ব্লগাররা তথ্য দিচ্ছেন, মতামত দিচ্ছেন। এক ধরনের সক্রিয় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন ব্লগাররা।
এই যে এত আয়োজন এর মোদ্দা কথাটা কি? তথ্য আর একমুখী কোনো বিষয় নয়। শুধু গণমাধ্যম তথ্য দিয়ে যাবে, মানুষ পড়বে, শুনবে বা দেখবে- সেই অবস্থাটি আর নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কোনো না কোনোভাবে মানুষ তথ্য পাচ্ছে। সেন্সর করে, আইন করে, নিষিদ্ধ করে মানুষকে তথ্য থেকে দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বিকল্প সব মাধ্যম গড়ে উঠছে। কারণ এখন আর মানুষ শুধু তথ্য চায় না, নিজেও তার মতো করে কিছু বলতে চায়। যে পন্থায় গণমাধ্যম তথ্য দিচ্ছে, তা তাদের মতো না হলে নিজেই বিকল্প পথ করে নিচ্ছে। তা ছাড়া নাগরিক ব্যস্ততায় এত সময় নেই যে অনেক বড় বড় রিপোর্ট বা ফিচার পড়বে। মানুষ চায় ছোট, স্মার্ট অথচ তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্ট।
চ্যানেল, পত্রিকা এ দিকটায় নজর দিতে চায়। তাই টেলিভিশনে একটি ঘটনায় একটি রিপোর্ট নয়, হচ্ছে একাধিক রিপোর্ট। সাথে থাকছে সংশ্লিষ্ট নানা মানুষের মতামত। টেলিভিশনের বার্তা কক্ষ তো পারলে ৩০ মিনিটের সংবাদ চাংকের পুরোটাই চায় একটি ঘটনার তথ্য আর বিশ্লেষণ দিতে। আর এমনটা বেশি ঘটে কোনো দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক বিষয়ে।
এর একটা ভয় হলো এ ধরনের প্রবণতা অনেক সময় খুব ছোট ঘটনাকে বড় করে তুলে। অনেক সত্যিকারের সংবাদ স্থান পায় না টিভি পর্দায় বা পত্রিকা পাতায়। তাতে সব সংবাদের প্রতি নজর দেয়া হয় না। সাধারY মানুষ বঞ্চিত হয় নাগরিক সব রাজনৈতিক বেড়াজালের খবরে। কোনো ঘটনাকে বড় করে দেখাতে গিয়ে সত্য থেকে সরে গিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিরও সম্ভাবনা থাকে।
যেকোনো এক ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মানুষ আসলেই এতো বিস্তারিত জানতে চায় কি? সত্য জানতে মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। সে যাওয়াটা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সমালোচকরা অবশ্য বলেন গণমাধ্যম এখন অনেক বেশি পারদর্শী চাঞ্চল্য সৃষ্টিতে। ব্রেকিং নিউজের নামে অনেক অতি সাধারণ তথ্যও চালিয়ে দেয়া হয়।
রাজনীতি, অপরাধ বিষয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টির এই প্রবণতায় হারিয়ে যেতে বসেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এক শ্রেণীর সম্পাদক বা সিনিয়র সাংবাদিক যত সময় দিচ্ছেন টিভি পর্দায়, ততটুকু দিচ্ছেন না নিজের কাগজে। দু’একটি কাগজ বাদ দিলে প্রায় সব পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের খবরে। একই পরিস্থিতি টেলিভিশন চ্যানেলেও।
দেশে প্রায় ২০টির ও বেশি চ্যানেল। আছে সংবাদভিত্তিক চ্যানেল। আরো আসছে। প্রত্যেকেই চায় ভিন্ন কিছু করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায় সবার রানডাউন প্রায় এক।
আর সব খাতের মতো মিডিয়ায় ঢুকছে বড় পুঁজি। কিন্তু আমরা তো একথা অস্বীকার করতে পারি না যে গণমাধ্যম শুধুই লাভ-ক্ষতির ব্যবসা নয়। তাই এখানে কে কি উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করছে, কে কিভাবে তার মিডিয়াকে ব্যবহার করছে তা পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হলো কে করবে? সরকার করতে গেলে অযথা সেন্সরশিপের শংকা আছে। সেক্ষেত্রে দায়িত্বটা কি সাংবাদিকদেরই?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
এমন এক সময়ে সাংবাদিকতাটা হচ্ছে কেমন?
সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেন, সাংবাদিকতা এক সময় ছিল পবিত্র পেশা। এই পেশায় সে অর্থে কোনো অর্থবিত্ত ছিলনা, কিন্তু প্রাণ ছিল, মানুষ বিশ্বাস করতো। তথ্যের জন্য সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরতা ছিল অনেক বেশি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি সেরকম নেই। মানুষ এখন শুধু পত্রিকা নির্ভর নয়। আছে তথ্য জানা আর তথ্য জানানোর নানা মাধ্যম। আছে ইন্টারনেট, মোবাইল, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম, বেতার আর টেলিভিশন। মুহূর্তেই সংবাদ হাতের মুঠোয় সব খবর।
গণমাধ্যম বেড়েছে, ফলে বেড়েছে প্রতিযোগিতা। সবাই চায় আগে ছুটতে। কে কার আগে সংবাদ দেবে। সবাই চায় বিশেষ কিছু করতে। ফলে নিরেট, মেদহীন সংবাদ প্রকাশের বা প্রচারের যে নীতি তা ভুলে যায় অনেকেই। অনেক গণমাধ্যমের সংবাদেই এখন তথ্যের চেয়ে থাকে অনেক বেশি গল্প, থাকে মতামত। থাকে না তথ্যের প্রমাণ, থাকেনা সব পক্ষের কথা।
মানুষ তথ্য চায়, নিজেও তথ্য প্রবাহের এই ঢেউয়ে যোগ দিতে চায়। সেই চিন্তা থেকেই সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার শুরু। আজ অনেক সাধারণ মানুষও তথ্য দিচ্ছেন সংবাদ মাধ্যমকে। রিপোর্ট লিখে পাঠকরাও হয়ে উঠছেন সাংবাদিক। এই সাংবাদিকতা মূলত হচ্ছে অনলাইন মাধ্যমে। এই নাগরিক সাংবাদিকরা কেউ বেতন পান, কেউ পান না। কিন্তু তাদের উৎসাহের কমতি নেই।
আর এক নতুন ধরনের সাংবাদিকতা হলো ব্লগিং। ব্লগাররা তথ্য দিচ্ছেন, মতামত দিচ্ছেন। এক ধরনের সক্রিয় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন ব্লগাররা।
এই যে এত আয়োজন এর মোদ্দা কথাটা কি? তথ্য আর একমুখী কোনো বিষয় নয়। শুধু গণমাধ্যম তথ্য দিয়ে যাবে, মানুষ পড়বে, শুনবে বা দেখবে- সেই অবস্থাটি আর নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কোনো না কোনোভাবে মানুষ তথ্য পাচ্ছে। সেন্সর করে, আইন করে, নিষিদ্ধ করে মানুষকে তথ্য থেকে দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বিকল্প সব মাধ্যম গড়ে উঠছে। কারণ এখন আর মানুষ শুধু তথ্য চায় না, নিজেও তার মতো করে কিছু বলতে চায়। যে পন্থায় গণমাধ্যম তথ্য দিচ্ছে, তা তাদের মতো না হলে নিজেই বিকল্প পথ করে নিচ্ছে। তা ছাড়া নাগরিক ব্যস্ততায় এত সময় নেই যে অনেক বড় বড় রিপোর্ট বা ফিচার পড়বে। মানুষ চায় ছোট, স্মার্ট অথচ তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্ট।
চ্যানেল, পত্রিকা এ দিকটায় নজর দিতে চায়। তাই টেলিভিশনে একটি ঘটনায় একটি রিপোর্ট নয়, হচ্ছে একাধিক রিপোর্ট। সাথে থাকছে সংশ্লিষ্ট নানা মানুষের মতামত। টেলিভিশনের বার্তা কক্ষ তো পারলে ৩০ মিনিটের সংবাদ চাংকের পুরোটাই চায় একটি ঘটনার তথ্য আর বিশ্লেষণ দিতে। আর এমনটা বেশি ঘটে কোনো দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক বিষয়ে।
এর একটা ভয় হলো এ ধরনের প্রবণতা অনেক সময় খুব ছোট ঘটনাকে বড় করে তুলে। অনেক সত্যিকারের সংবাদ স্থান পায় না টিভি পর্দায় বা পত্রিকা পাতায়। তাতে সব সংবাদের প্রতি নজর দেয়া হয় না। সাধারY মানুষ বঞ্চিত হয় নাগরিক সব রাজনৈতিক বেড়াজালের খবরে। কোনো ঘটনাকে বড় করে দেখাতে গিয়ে সত্য থেকে সরে গিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিরও সম্ভাবনা থাকে।
যেকোনো এক ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মানুষ আসলেই এতো বিস্তারিত জানতে চায় কি? সত্য জানতে মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। সে যাওয়াটা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সমালোচকরা অবশ্য বলেন গণমাধ্যম এখন অনেক বেশি পারদর্শী চাঞ্চল্য সৃষ্টিতে। ব্রেকিং নিউজের নামে অনেক অতি সাধারণ তথ্যও চালিয়ে দেয়া হয়।
রাজনীতি, অপরাধ বিষয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টির এই প্রবণতায় হারিয়ে যেতে বসেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এক শ্রেণীর সম্পাদক বা সিনিয়র সাংবাদিক যত সময় দিচ্ছেন টিভি পর্দায়, ততটুকু দিচ্ছেন না নিজের কাগজে। দু’একটি কাগজ বাদ দিলে প্রায় সব পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের খবরে। একই পরিস্থিতি টেলিভিশন চ্যানেলেও।
দেশে প্রায় ২০টির ও বেশি চ্যানেল। আছে সংবাদভিত্তিক চ্যানেল। আরো আসছে। প্রত্যেকেই চায় ভিন্ন কিছু করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায় সবার রানডাউন প্রায় এক।
আর সব খাতের মতো মিডিয়ায় ঢুকছে বড় পুঁজি। কিন্তু আমরা তো একথা অস্বীকার করতে পারি না যে গণমাধ্যম শুধুই লাভ-ক্ষতির ব্যবসা নয়। তাই এখানে কে কি উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করছে, কে কিভাবে তার মিডিয়াকে ব্যবহার করছে তা পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হলো কে করবে? সরকার করতে গেলে অযথা সেন্সরশিপের শংকা আছে। সেক্ষেত্রে দায়িত্বটা কি সাংবাদিকদেরই?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
No comments