শিলাইদহ কুঠিবাড়ির যে ঘটনা আজো শিহরণ জাগায় by জাহিদুজ্জামান
বাঙালির সকল অস্তিত্বে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। পরিবর্তিত সময়েও জীবনের সকল আয়োজনে তার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী, অনিবার্য। আমাদের আধুনিকতা, সভ্যতা সবক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। আর বাংলা সাহিত্যে তিনি রবি, কিরণ ছড়িয়েছেন আজন্ম, এখনো। তার শতবর্ষ আগের চিন্তা চেতনা আজও ছন্দময়, বিশ্বয়কর। এই বিশ্বকবির আজ জন্মদিন।
কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয় এই মহামানবেরে। তাইতো রবির উদয়ক্ষণে জাগরণ উঠিছে দুই বাংলায়। আজ যেন সব বাঙালির জন্মদিন, শ্রদ্ধা জানাই তোমায়।
সব বাঙালি আজ উৎসবে মাতোয়ারা। এই দিনটি এলেই আমি ফিরে যাই শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে। মনে পড়ে কুৎসিত সেই ঘটনার কথা। শিহরিত হই এখনও।
ঘটনা ২০০৬ সালের। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিনে। কুষ্টিয়াস্থ স্টাফ রিপোর্টার। মানবজমিনের সাপ্তাহিক প্রকাশনা জনতার চোখ-এ ৭ মে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সামনের (২০০৭ সালের) নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। এই তিনজনের একজন তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম। তিনিই কাণ্ডটি ঘটান। কেন এমন সংবাদ লেখা হলো কৈফিয়ত চেয়ে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেন। দেখে নেবার হুমকি দেন। রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে তখন চলছিল বিশ্বকবির জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী ও উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্র ভক্ত হতভম্ব। হতভম্ব আমিও। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি অধ্যাপক! সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। কবির স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে জন্ম জয়ন্তী উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান দেখালো। সঙ্গে সঙ্গেই ছি ছি পড়ে গেল। সহকর্মী সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালেন।
স্কুলজীবন থেকে সাইকেলে করে এই শিলাইদহে আসতাম। তারপর বেড়াতে,অন্যদের দেখাতে এবং পেশাগত কাজে কতবার এখানে এসেছি সে হিসাব করা কঠিন। বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই কুঠিবাড়ি আমার কাছে সেদিন একেবারে অচেনা মনে হলো। এ ঘটনার পরও অনেকবার শিলাইদহ গেছি, ওই দুঃস্মৃতি ভেসে উঠেছে ছবির মতো।
সেদিনের ওই ঘটনার রেশ ছিল আরো দীর্ঘ। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মীরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯ মে সমকাল,যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেন আমার বিরুদ্ধে। আমার পাশে দাড়িয়ে শহীদুলের অসভ্যতার প্রতিবাদ ও পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করায় আমার সাথে আরো দু সহকর্মী মুন্সী তরিকুল ইসলাম(প্রতিনিধি, সমকাল) ও আল-মামুন সাগরকেও (প্রতিনিধি, যুগান্তর) মামলায় আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয় আমরা তিন সাংবাদিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তার বাসায় গিয়ে তার কাছে চাঁদাদাবি করেছি। মজার ব্যাপার হলো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে আরেকটি মামলা করা হয় আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়। এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মীদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয় বিভিন্ন পয়েন্টে। মনজুর এহসান চৌধুরীর (প্রতিনিধি, চ্যানেল আই)প্রাইভেট গাড়িতে করে গ্রাম্য পথে ঢাকায় পৌছাই আমরা। হামলা ও মামলার হুমকিতে ক’দিনের মাথায়ই মনজুর এহসান চৌধুরীও আমাদের সঙ্গী হন। বন্ধ করে দেয়া হয় তার সম্পাদিত পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। বন্ধ ছিল ৪৪ দিন।
এদিকে বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার ওপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরমধ্যে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলসহ অন্যরা উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়ায় গিয়ে একটি সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙে দেয়া হবে। সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে। তিনি আমাদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের। হামলা হলে আমার ওপর হবে। আমরা সাহস পেলাম। সমাবেশের জন্য নির্ধারিত দিন ২৯ মে আমরা কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারা এসেছেন সমাবেশে। আয়োজন করা হয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে। ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামানের বক্তব্যের পরই শুরু হলো হামলা। অদূরে জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডাররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট ভাঙচুর শুরু করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরলো ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হলেন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙে ফেলা হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো পুলিশ। পরে ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আমাদের উদ্ধার করলো।
কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদের নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসলেন সাংবাদিক নেতারা। কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে এই হামলার ঘটনায় দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রাজ্জাক (প্রয়াত) এই হামলার বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদের বক্তব্য রাখেন হামলাকারি শহীদুল এমপি। সেদিন তার দম্ভের পক্ষে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। এই দৃশ্য দেখে আমাদের মনে হলো চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর বোধহয় কুষ্টিয়া ফেরা হবে না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কুষ্টিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ২ মাস ৪দিন পর আমরা কুষ্টিয়া ফিরতে পেরেছিলাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য সেদিনের ওই হামলার পর ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দিলেও পুলিশ সে মামলা নিতে পারেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটি করা হয়। বর্তমানে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও কোনো এক কারণে মামলাটির বিচার কাজে কোনো গতি নেই।
কৃতজ্ঞতা জানাই
অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সেই সময়ের বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার আরেক এমপি। তিনি আমেরিকান দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমকে আমাদের পক্ষে নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। মাইনুল হক খান, উদ্যোগ নিয়ে বিসিডিজেসি থেকে অর্থ বরাদ্দ করে আমাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির ও সাংবাদিক আব্দুল হান্নান মামলা থেকে আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, মতিউর রহমান, সাংবাদিক কামরুল হাসান, হারুন অর রশিদ, সাইফুল ইসলাম তালুকদারসহ অন্যদের, যারা সংবাদপত্রে লেখনির ঝড় তোলেন। সংবাদিক রাহুল রাহা, যিনি এ ঘটনা নিয়ে এটিএন বাংলায় বিশেষ প্রতিবেদন সংবাদ তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেসক্লাব,শহীদুলের ছবি টানিয়ে তাকে নিষিদ্ধ করে। ইউরোপীয় তিন দেশ বিমানবন্দরে শহীদুলকে কালো তালিকাভুক্ত করে। আমেরিকান এ্যামবেসি,আমেরিকান জার্নালিস্ট,অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশানালসহ কয়েকশ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা এ ঘটনা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারকে। আমার স্ত্রী শারমিন আক্তারকে,যিনি সেসমযে ছিলেন সন্তানসম্ভবা। এই পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকেও। আর ধিক্কার জানাই সেসময়ে সমকালে কর্মরত এক সাংবাদিককে,যিনি কুষ্টিয়া গিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকায় ম্যানেজ হয়ে হামলাকারি শহীদুলের পক্ষে সংবাদ লিখেছিলেন।
জাহিদুজ্জামান: ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।
সব বাঙালি আজ উৎসবে মাতোয়ারা। এই দিনটি এলেই আমি ফিরে যাই শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে। মনে পড়ে কুৎসিত সেই ঘটনার কথা। শিহরিত হই এখনও।
ঘটনা ২০০৬ সালের। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিনে। কুষ্টিয়াস্থ স্টাফ রিপোর্টার। মানবজমিনের সাপ্তাহিক প্রকাশনা জনতার চোখ-এ ৭ মে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সামনের (২০০৭ সালের) নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। এই তিনজনের একজন তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম। তিনিই কাণ্ডটি ঘটান। কেন এমন সংবাদ লেখা হলো কৈফিয়ত চেয়ে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেন। দেখে নেবার হুমকি দেন। রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে তখন চলছিল বিশ্বকবির জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী ও উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্র ভক্ত হতভম্ব। হতভম্ব আমিও। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি অধ্যাপক! সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। কবির স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে জন্ম জয়ন্তী উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান দেখালো। সঙ্গে সঙ্গেই ছি ছি পড়ে গেল। সহকর্মী সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালেন।
স্কুলজীবন থেকে সাইকেলে করে এই শিলাইদহে আসতাম। তারপর বেড়াতে,অন্যদের দেখাতে এবং পেশাগত কাজে কতবার এখানে এসেছি সে হিসাব করা কঠিন। বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই কুঠিবাড়ি আমার কাছে সেদিন একেবারে অচেনা মনে হলো। এ ঘটনার পরও অনেকবার শিলাইদহ গেছি, ওই দুঃস্মৃতি ভেসে উঠেছে ছবির মতো।
সেদিনের ওই ঘটনার রেশ ছিল আরো দীর্ঘ। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মীরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯ মে সমকাল,যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেন আমার বিরুদ্ধে। আমার পাশে দাড়িয়ে শহীদুলের অসভ্যতার প্রতিবাদ ও পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করায় আমার সাথে আরো দু সহকর্মী মুন্সী তরিকুল ইসলাম(প্রতিনিধি, সমকাল) ও আল-মামুন সাগরকেও (প্রতিনিধি, যুগান্তর) মামলায় আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয় আমরা তিন সাংবাদিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তার বাসায় গিয়ে তার কাছে চাঁদাদাবি করেছি। মজার ব্যাপার হলো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে আরেকটি মামলা করা হয় আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়। এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মীদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয় বিভিন্ন পয়েন্টে। মনজুর এহসান চৌধুরীর (প্রতিনিধি, চ্যানেল আই)প্রাইভেট গাড়িতে করে গ্রাম্য পথে ঢাকায় পৌছাই আমরা। হামলা ও মামলার হুমকিতে ক’দিনের মাথায়ই মনজুর এহসান চৌধুরীও আমাদের সঙ্গী হন। বন্ধ করে দেয়া হয় তার সম্পাদিত পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। বন্ধ ছিল ৪৪ দিন।
এদিকে বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার ওপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরমধ্যে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলসহ অন্যরা উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়ায় গিয়ে একটি সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙে দেয়া হবে। সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে। তিনি আমাদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের। হামলা হলে আমার ওপর হবে। আমরা সাহস পেলাম। সমাবেশের জন্য নির্ধারিত দিন ২৯ মে আমরা কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারা এসেছেন সমাবেশে। আয়োজন করা হয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে। ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামানের বক্তব্যের পরই শুরু হলো হামলা। অদূরে জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডাররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট ভাঙচুর শুরু করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরলো ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হলেন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙে ফেলা হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো পুলিশ। পরে ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আমাদের উদ্ধার করলো।
কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদের নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসলেন সাংবাদিক নেতারা। কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে এই হামলার ঘটনায় দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রাজ্জাক (প্রয়াত) এই হামলার বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদের বক্তব্য রাখেন হামলাকারি শহীদুল এমপি। সেদিন তার দম্ভের পক্ষে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। এই দৃশ্য দেখে আমাদের মনে হলো চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর বোধহয় কুষ্টিয়া ফেরা হবে না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কুষ্টিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ২ মাস ৪দিন পর আমরা কুষ্টিয়া ফিরতে পেরেছিলাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য সেদিনের ওই হামলার পর ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দিলেও পুলিশ সে মামলা নিতে পারেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটি করা হয়। বর্তমানে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও কোনো এক কারণে মামলাটির বিচার কাজে কোনো গতি নেই।
কৃতজ্ঞতা জানাই
অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সেই সময়ের বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার আরেক এমপি। তিনি আমেরিকান দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমকে আমাদের পক্ষে নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। মাইনুল হক খান, উদ্যোগ নিয়ে বিসিডিজেসি থেকে অর্থ বরাদ্দ করে আমাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির ও সাংবাদিক আব্দুল হান্নান মামলা থেকে আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, মতিউর রহমান, সাংবাদিক কামরুল হাসান, হারুন অর রশিদ, সাইফুল ইসলাম তালুকদারসহ অন্যদের, যারা সংবাদপত্রে লেখনির ঝড় তোলেন। সংবাদিক রাহুল রাহা, যিনি এ ঘটনা নিয়ে এটিএন বাংলায় বিশেষ প্রতিবেদন সংবাদ তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেসক্লাব,শহীদুলের ছবি টানিয়ে তাকে নিষিদ্ধ করে। ইউরোপীয় তিন দেশ বিমানবন্দরে শহীদুলকে কালো তালিকাভুক্ত করে। আমেরিকান এ্যামবেসি,আমেরিকান জার্নালিস্ট,অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশানালসহ কয়েকশ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা এ ঘটনা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারকে। আমার স্ত্রী শারমিন আক্তারকে,যিনি সেসমযে ছিলেন সন্তানসম্ভবা। এই পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকেও। আর ধিক্কার জানাই সেসময়ে সমকালে কর্মরত এক সাংবাদিককে,যিনি কুষ্টিয়া গিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকায় ম্যানেজ হয়ে হামলাকারি শহীদুলের পক্ষে সংবাদ লিখেছিলেন।
জাহিদুজ্জামান: ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।
No comments