যুক্তরাষ্ট্র কখন সশস্ত্র সংগ্রাম পছন্দ করে
লিবীয়
বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তা
‘সশস্ত্র সংগ্রামে’ পরিণত হলো। বিন্দুমাত্র দেরি না করেই যুক্তরাষ্ট্রও
বিদ্রোহীদের পূর্ণোদ্যমে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করল এবং বিদ্রোহটা পরিণত হলো
পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে। অথচ এই একই আমেরিকা ৩৪ বছরের ইসরায়েলি দখলদারির
বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ সশস্ত্র আত্মরক্ষাকে সরকারিভাবে
‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে কলঙ্ক-দাগ দিয়ে রেখেছে।
যে ওবামা লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছেন, সেই ওবামাই কিন্তু মাস খানেক আগে মিসরীয় বিদ্রোহীদের শান্তিবাদী স্লোগান ‘সিমিলিয়া সিমিলিয়া’র প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ মিসরে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের বিপক্ষে, কিন্তু লিবিয়ায় তাঁরা অস্ত্রের ব্যবহারই দেখতে চান। ওবামা বলেছিলেন, ‘মিসরীয়রা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং তারা সেটা করেছে সহিংসতার মাধ্যমেই সুবিচার পাওয়া সম্ভব এমন ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে...। অহিংস আন্দোলনের নৈতিক শক্তিই ইতিহাসের মোড় সুবিচারের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।’
২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ওবামাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলে তিনি একে তাঁর অর্জনের তুলনায় বেশি পাওয়া এবং ‘কর্মের ডাক’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। এরই দুই বছরের মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধকে আরও তীব্রতর করেন, যুদ্ধটাকে পাকিস্তানেও প্রসারিত করেন। কার্যত ইরাকেও তিনি জর্জ বুশের যুদ্ধ কর্মসূচি অনুসরণ করে যান। আর এখন লিবিয়ায় তৃতীয় একটি রণাঙ্গনের জন্ম দিয়েছেন তিনি। সেখানে তাঁর প্রশাসন যেকোনো শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়, সংঘাতটাকে আন্তর্জাতিক করে তোলে এবং মীমাংসার সব প্রচেষ্টা, বিশেষত আফ্রিকান ইউনিয়নের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবসতিপূর্ণ দেশ চীন কিংবা সবচেয়ে বড় মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার শান্তি প্রস্তাবেও তিনি কান দেননি।
ওবামা বলেছেন, লিবিয়ায় এক ‘বিরল পরিস্থিতি’ বিরাজ করছে। সেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের সমর্থন জোগানো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির স্বাভাবিক প্রকাশ নয়, এটাও এক ব্যতিক্রম। এই ‘অস্বাভাবিক ও বিরল’ অবস্থার দোহাই দিয়েই তিনি ‘অস্বাভাবিক ও বিরল’ দ্রুততার সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে, মার্কিন জনমতের সামনে তাঁর সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা না দিয়ে একতরফাভাবে নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। অথচ অনেক দূরের এই সংঘাতকে কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি বলে দেখানো সম্ভব নয়।
২০০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর আশার ঔদ্ধত্য বইয়ে ওবামা লিখেছেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও যেনতেনভাবে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার ফল অনিশ্চিত। কেন উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমারে হামলা না করে ইরাকে হামলা করা হলো? কেন বসনিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হলো অথচ দারফুরে কিছুই করা হলো না?’ এখন মনে হচ্ছে, লিবিয়া বিষয়ে তড়িঘড়ি করে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর কোনো অসুবিধা নেই।
আরব এবং বিশেষত ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর আগের আহ্বানগুলো মনে রাখলে কোনো আরব বা ফিলিস্তিনি আর আশা করে না যে তিনি প্রশ্ন তুলবেন: কেন লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আমেরিকা আগ বাড়িয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ করল, যেখানে সাধারণ মানুষ আত্মরক্ষার স্বার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাহলে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখলদারির মধ্যে বন্দী ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই চালালে কারও কোনো সাহায্য পাবে না?
ওবামার যুক্তি মানলে লিবিয়ার ‘বিরল’ পরিস্থিতি ইসরায়েলের মতো নয়। ইসরায়েলের ফ্যাসিস্ট আচরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনিদের অপরাধটা কী? পশ্চিমা জোট এখন বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। কার্যত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা দল ইতিমধ্যে লিবিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহীদের কাকে অস্ত্র দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, তা ঠিক করে দিচ্ছে। অথচ ঠিক সেই একই সময়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিশ্বের চোখের সামনে গাজা উপত্যকায় আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের শেকড় উপড়ে ফেলার। ইসরায়েলের একটানা আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরাও কি মানবিক হস্তক্ষেপ আশা করতে পারে না?
কিছু আরব রাষ্ট্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৭৩ সালের একটি সিদ্ধান্তের নামে তারা এমন একটি আগ্রাসী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে লিবিয়ার ওপর, যেখানে বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তি যথা: রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ভারত ও ব্রাজিল রাজি ছিলনা। এই যুদ্ধ তাই বৈধ নয়। এখন ন্যাটোর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার যে কথা ওবামা বলছেন, তার জবাব জাতিসংঘে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন বল্টনের কথাতেই আছে, ‘ওবামাই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি জানেন না যে আমরাই, যুক্তরাষ্ট্রই ন্যাটো চালায়।’
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
>>>নিকোলা নাসের: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক।
যে ওবামা লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছেন, সেই ওবামাই কিন্তু মাস খানেক আগে মিসরীয় বিদ্রোহীদের শান্তিবাদী স্লোগান ‘সিমিলিয়া সিমিলিয়া’র প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ মিসরে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের বিপক্ষে, কিন্তু লিবিয়ায় তাঁরা অস্ত্রের ব্যবহারই দেখতে চান। ওবামা বলেছিলেন, ‘মিসরীয়রা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং তারা সেটা করেছে সহিংসতার মাধ্যমেই সুবিচার পাওয়া সম্ভব এমন ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে...। অহিংস আন্দোলনের নৈতিক শক্তিই ইতিহাসের মোড় সুবিচারের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।’
২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ওবামাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলে তিনি একে তাঁর অর্জনের তুলনায় বেশি পাওয়া এবং ‘কর্মের ডাক’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। এরই দুই বছরের মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধকে আরও তীব্রতর করেন, যুদ্ধটাকে পাকিস্তানেও প্রসারিত করেন। কার্যত ইরাকেও তিনি জর্জ বুশের যুদ্ধ কর্মসূচি অনুসরণ করে যান। আর এখন লিবিয়ায় তৃতীয় একটি রণাঙ্গনের জন্ম দিয়েছেন তিনি। সেখানে তাঁর প্রশাসন যেকোনো শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়, সংঘাতটাকে আন্তর্জাতিক করে তোলে এবং মীমাংসার সব প্রচেষ্টা, বিশেষত আফ্রিকান ইউনিয়নের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবসতিপূর্ণ দেশ চীন কিংবা সবচেয়ে বড় মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার শান্তি প্রস্তাবেও তিনি কান দেননি।
ওবামা বলেছেন, লিবিয়ায় এক ‘বিরল পরিস্থিতি’ বিরাজ করছে। সেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের সমর্থন জোগানো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির স্বাভাবিক প্রকাশ নয়, এটাও এক ব্যতিক্রম। এই ‘অস্বাভাবিক ও বিরল’ অবস্থার দোহাই দিয়েই তিনি ‘অস্বাভাবিক ও বিরল’ দ্রুততার সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে, মার্কিন জনমতের সামনে তাঁর সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা না দিয়ে একতরফাভাবে নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। অথচ অনেক দূরের এই সংঘাতকে কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি বলে দেখানো সম্ভব নয়।
২০০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর আশার ঔদ্ধত্য বইয়ে ওবামা লিখেছেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও যেনতেনভাবে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার ফল অনিশ্চিত। কেন উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমারে হামলা না করে ইরাকে হামলা করা হলো? কেন বসনিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হলো অথচ দারফুরে কিছুই করা হলো না?’ এখন মনে হচ্ছে, লিবিয়া বিষয়ে তড়িঘড়ি করে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর কোনো অসুবিধা নেই।
আরব এবং বিশেষত ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর আগের আহ্বানগুলো মনে রাখলে কোনো আরব বা ফিলিস্তিনি আর আশা করে না যে তিনি প্রশ্ন তুলবেন: কেন লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আমেরিকা আগ বাড়িয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ করল, যেখানে সাধারণ মানুষ আত্মরক্ষার স্বার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাহলে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখলদারির মধ্যে বন্দী ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই চালালে কারও কোনো সাহায্য পাবে না?
ওবামার যুক্তি মানলে লিবিয়ার ‘বিরল’ পরিস্থিতি ইসরায়েলের মতো নয়। ইসরায়েলের ফ্যাসিস্ট আচরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনিদের অপরাধটা কী? পশ্চিমা জোট এখন বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। কার্যত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা দল ইতিমধ্যে লিবিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহীদের কাকে অস্ত্র দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, তা ঠিক করে দিচ্ছে। অথচ ঠিক সেই একই সময়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিশ্বের চোখের সামনে গাজা উপত্যকায় আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের শেকড় উপড়ে ফেলার। ইসরায়েলের একটানা আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরাও কি মানবিক হস্তক্ষেপ আশা করতে পারে না?
কিছু আরব রাষ্ট্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৭৩ সালের একটি সিদ্ধান্তের নামে তারা এমন একটি আগ্রাসী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে লিবিয়ার ওপর, যেখানে বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তি যথা: রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ভারত ও ব্রাজিল রাজি ছিলনা। এই যুদ্ধ তাই বৈধ নয়। এখন ন্যাটোর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার যে কথা ওবামা বলছেন, তার জবাব জাতিসংঘে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন বল্টনের কথাতেই আছে, ‘ওবামাই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি জানেন না যে আমরাই, যুক্তরাষ্ট্রই ন্যাটো চালায়।’
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
>>>নিকোলা নাসের: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক।
No comments