ইতিহাস- মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর বছর পর by আহমদ মমতাজ

৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কারাগারে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন ও বিপস্নবী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এর পূর্বে কয়েকজন ইংরেজ অফিসার সেলে ঢুকে মাস্টারদাকে নির্মমভাবে মারধর করে। সূর্যসেন শেস্নাগান দিতে শুরু করলে তার মুখে উপযর্ুপরি ঘুষি মেরে বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলে বলে বিপস্নবী দলের সদস্যদের স্মৃতিকথায় জানা যায়।
দেশ মাতৃকার জন্যে জীবন উৎসর্গকারী এই দুই বীর সন্তানের মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনদের কাছেও ফেরত দেয়া হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভীত ছিল মাস্টারদা ও তারকেশ্বরের মৃতদেহ ফেরত দেয়া হলে চট্টগ্রামে জন-অসন্তোষ দেখা দেবে ও তাঁদের সমাধিস্থল ভারতের স্বাধীনতাকামীদের তীর্থস্থানে পরিণত হবে।
মাস্টারদার ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা যায়নি। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সাফল্য সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মত। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ভারতবর্ষ ত্যাগের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়। শহীদদের রক্তস্নাত চট্টগ্রাম পরিণত হল বিপস্নবের পুণ্যতীর্থে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের বীর সৈনিকেরা পেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং জীবন উৎসর্গকারীরা শহীদের মর্যাদা। তৎকালীন ভারতবাসী নতুনভাবে জেগে ওঠার দুর্দমনীয় মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে স্বাধীনতার দাবি। চট্টগ্রামের শহীদদের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামীদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে। ১৯৩০ সালের পর মাত্র সতের বছরের মাথায় ব্রিটিশদের এদেশ থেকে চলে যেতে হয়, আর তারও ২৫ বছরের মাথায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটে।
মাস্টারদার নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের বিশেষ তাৎপর্য এখানেই নিহীত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৮৫৭ সালের পর ১৯৩০ এবং ১৯৭১ এই তিনটি খ্রীস্টিয় সাল বিশেষ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত, মাস্টারদা'র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে চট্টগ্রামের মুসলমানদের কিরূপ ভূমিকা ছিল_ তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একথা অনস্বীকার্য যে, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন অঞ্চলের মত চট্টগ্রামের মুসলমান সমাজের অবদান অবিস্মরণীয়। সৈয়দ আহমদ বেরেলবি'র নেতৃত্বে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে যে অগি্নশিখা অগি্ন প্রজ্বলন করেছিল তা ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নেয়। পরবতর্ীকালে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এসে দাউ দাউ করে জ্বলেছিল_ হাবিলদার রজব আলী খান ছিলেন সেই সিপাহী বিদ্রোহ তথা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সিপাহসালার। চট্টগ্রামের মওলানা সৈয়দ ওয়ারেস আলী ও মওলানা আহমদ উলস্নাহ সেই জেহাদী আন্দোলনের শহীদ এবং শাহ সুফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী বালাকোট যুদ্ধের বীর সেনাপতি। সিপাহী বিদ্রোহে শেষোক্তজনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সেই থেকে পরবতর্ী নব্বই বছরে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এর সবক'টিতে বাংলার অন্যান্য অনেক অঞ্চলের চাইতেও চট্টগ্রামের মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকাই ছিল।
বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী ও রদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর খেলাফত আন্দোলন ও মহাত্মাগান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে এখানকার মুসলিম সমাজের ভূমিকা গৌরবময়। কিন্তু মাস্টারদা'র নেতৃত্বে চট্টগাম যুব বিদ্রোহে এখানকার মুসলমানদের অংশগ্রহণ কিরূপ ছিল_ এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় এই যুব বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা হিন্দু তরুণ-যুবকরা হলেও মুসলমানদের সংখ্যা ও ভূমিকা মোটেও নগণ্য ছিল না। মুসলমানদের এমন গৌরবময় ভূমিকার কথা অম্বিকা চক্রবতর্ী ও পুর্ণেন্দু দস্তিদার ব্যতীত অন্য কোন বিপস্নবী তাদের স্মৃতিকথায় তেমন উলেস্নখ করেননি_ এটা চট্টগ্রামের বিপস্নবী নায়কদের অনুদার মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে জীবিত মাস্টারদা'র অন্যতম সহযোদ্ধা বিপস্নবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীও মুসলিমদের অবদানের প্রশংসা করে থাকেন।
চট্টগাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ অভিযান সফল হবার পেছনে এক মুসলমান বাবুর্চির সক্রিয় সহযোগিতা ছিল, যিনি অভিযানের পূর্বে ক্লাবের ভেতর ও বাইরের নানাবিধ তথ্য বিপস্নবীদের কাছে সরবরাহ করেছিলেন। কিন্তু সে মুসলমান বাবুর্চির অবদানের কথা একমাত্র পূর্ণেন্দু দস্তিদারের লেখা 'স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম' ব্যতীত অন্য কোথাও উলেস্নখ পাওয়া যায় না।
নামহীন, অজানা এ সকল দেশভক্তদের এ অমূল্য দানের কথা, গোপন আত্মদানের কাহিনী ঘটনার পৌনে একশ' বছরেও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা যায়নি। ব্রিটিশের শাসন-শোষনের শৃঙ্খল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার কাজে বুক পেতে যাঁরা বুলেট-বেয়নেট, জেল, ফাঁসি ও দ্বীপান্তর বরণ করে নিয়েছিলেন সেসব বিপস্নবী যোদ্ধাদের মতোই চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলমান সাধারণ জনগণের অবদান অসামান্য।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাসে আরেকটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হল সে কালের স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধি শেখ ই চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, পৌরসভার চেয়ারম্যান নুর আহমদ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান বাহাদুর জালালুদ্দীন আহমদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আব্দুল হক দোভাষ, আহমদ সাগীর চৌধুরীর মত ব্যক্তিত্বরা বিপস্নবীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ও পরোক্ষ সহযোগী ছিলেন। যা ইতিহারে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাস প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে প্রকৃত সত্য ইতিহাসের স্বার্থে প্রণয়নের সময় এসেছে সে ইতিহাস হবে মাস্টারদাসহ চট্টগ্রামের সকল অকুতোভয় সৈনিক যাঁরা দেশকে ভালবেসে হাসিমুখে জীবন দান করে গেছেন, যাঁরা সকল বিপদ ও অর্থের প্রলোভনকে তুচ্ছজ্ঞান করে বিপস্নবীদের আশ্রয় দিয়েছেন, যত্ন ও শুশ্রূষা দান করেছেন, তথ্য-বিবরণ সরবরাহ করে সহযোগিতা দিয়েছেন সকলের কথা যথাযোগ্য স্থান পাবে_ এমন ইতিহাস রচনা করতে হব। যে ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে অনুপ্রেরণা যোগাবে। বিলম্ব হলেও সময় এসেছে মাস্টারদাসহ সকল বিপস্নবী ও সহযোগীদের অবদানের যথাযথ মূল্যায়নের। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে বিপস্নবী-স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মদনের কাহিনী আজো স্থান পায়নি, রচিত হয়নি কোনো প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ, কোনো ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস, নির্মিত হয়নি চলচ্চিত্র কিংবা নাটক। অথচ এই একটি অধ্যায় নিয়ে রচিত হতে পারতো হাজারো গল্প-উপন্যাস, কবিতা, নাটক কিংবা চলচ্চিত্র।
হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। সম্প্রতি মাস্টারদা সূর্যসেন ও তার সহযোগী নির্ভীক যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা আশুতোষ গোয়াড়িকর নির্মাণ করেছেন 'খেলে হাম জি জান সে' ছায়াছবি। এটি মূলত বিপস্নবী নারী কল্পনা দত্তের পুত্রবধূ সাংবাদিক মানিনী চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'ডু অর ডাই' কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। সূর্যসেনের চরিত্রে অভিষেক বচ্চন আর কল্পনা দত্তের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপিকা পাড়-কোন। অস্কার মনোনয়ন পাওয়া লগান-এর পরিচালক স্বদেশ, যোদ্ধা আকবর-এর প্রশংসিত, পুরস্কৃত, নির্মাতা আশুতোষ গোয়াড়িকর অবাঙালি হয়েও বাঙালি দেশপ্রেমিকদের প্রতি যে দায়িত্ববোধ প্রদর্শন করেছেন আমরা বাঙালি এমনকি চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র হয়েও কি সে পরিমাণ বা কাছাকাছি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছি বা দিচ্ছ?
চট্টগ্রামের বিপস্নবীদের প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আদর্শস্বরূপ উপস্থাপন করতে চট্টগ্রামে একটি মিউজিয়াম, জালালাবাদ পাহাড়ে একটি স্মৃতিসৌধ এবং ব্রিটিশদের সাথে বিপস্নবীদের সম্মুখযুদ্ধের স্থানসমূহে স্মৃতিস্মারক নির্মাণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। বিপস্নবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর ১৪০ মোমিন রোডস্থ 'বিপস্নবী কুটির' হোক_ সেই মিউজিয়াম, যেখানে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের সকল স্মৃতিস্মারক সংরক্ষিত থাকবে। প্রকৃত অর্থে বিপস্নবী কুটির পরিণত হোক চট্টগ্রাম বিপস্নবের পবিত্র মহাতীর্থে। মাস্টারদার ৭৭তম ফাঁসি দিবসে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করি সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম বিদ্রোহ অমর হোক।
=============================
পৌরসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আহমদ মমতাজ
ইতিহাস বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রাহক, গবেষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.