জন্ম শতবর্ষে বিচারপতি মোর্শেদ by জিয়া হাবীব আহসান
আজ বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুস সালেক ছাত্রজীবনে মেধার পরিচয় দিয়ে পরে বঙ্গীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন বিচারপতি মোর্শেদের মামা। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি রাজশাহী বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে তিনি অনার্সসহ বিএ ও এমএ পাস করেন যথাক্রমে ১৯৩০ ও ১৯৩২ সালে। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে আইন পাস করেন। ১৯৩৯ সালে বিলেতের লিনকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। তারপর দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন। ১৯৬২-৬৩ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং ১৯৬৪ সালে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৬৭ সালে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি স্যার টম উইলিয়ামস ঢাকায় এলেন, বিচারপতি মোর্শেদ টম উইলিয়ামসকে বলেছিলেন, ‘এই মামলায় আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব।’ টম উইলিয়ামস উত্তরে বলেছিলেন, ‘একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি থাকেন। সুতরাং সে হিসেবে আপনি আমার উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করবেন।’ টম উইলিয়ামস ঢাকায় থাকাকালে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি মোর্শেদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে অনেক বৈঠক হয়। বিচারপতি মোর্শেদের জ্ঞান ও আইনের শাসনের প্রতি অনুরাগ দেখে টম উইলিয়ামস বহুবার প্রশংসা করেছেন।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই কঠিন পর্যায়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন একজন নির্ভীক সৈনিকের মতো। আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ জন নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বিচারপতি মোর্শেদ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারাসনে বসে স্বৈরাচারী সরকার এবং সামরিক আমলে যে সিদ্ধান্ত ও রায় দিয়েছেন, তা নজিরবিহীন। শুধু যুক্তিতর্কই নয়, বলিষ্ঠ ভাষা ও তাঁর পণ্ডিত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের আইনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিচারপতি মোর্শেদ বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রই সর্বোচ্চ অধিকার, তিনি আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতায় মর্মাহত হয়েছিলেন, উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য যাঁরা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। চুয়ান্নর যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে ও ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ণে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা এ জাতি কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে নিম্ন আদালতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি রাজনীতিবিদদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে কিছুটা ভগ্ন স্বাস্থ্যজনিত কারণে, কিছুটা সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন এই তেজস্বী পুরুষ নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবুও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে কখনো তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। ১৯৬৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিস্মৃতিপরায়ণ এই সমাজের জন্য, মূল্যবোধের প্রবল সংকটের সময় বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের মতো ব্যক্তিত্বের আজ বড়ই প্রয়োজন। তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবান বক্তৃতা, প্রবন্ধ, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রায় মেধায়, প্রজ্ঞায়, বিচক্ষণতায়, আইনের ব্যাখ্যায় আমাদের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত। এসব গ্রন্থভুক্ত করে সমাজকে সমৃদ্ধিশালী করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রিন্সিপাল শাহ মুহাম্মদ খোরশেদ প্রণীত Justice Syed Mahbub Mursed-A Profile নামের একটি মূল্যবান পুস্তক প্রকাশ করেছে। পুস্তকটিতে তাঁর সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য রয়েছে।
বিচারপতি মোর্শেদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি যে প্রত্যয়, মূল্যবোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামী অবদান রেখে গেছেন, তা আমাদের সামনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশের মানুষকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করবে। শুধু বিচারক হিসেবেই নন, দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তিনি যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সংশোধনী: গতকাল প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু মানিক মিয়া’ ফিচারটিতে দুটো ভুল আছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু মানিক মিয়ার সঙ্গে বঙ্গভবনে নয়, গণভবনে দেখা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি নন।
১৯৬৭ সালে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি স্যার টম উইলিয়ামস ঢাকায় এলেন, বিচারপতি মোর্শেদ টম উইলিয়ামসকে বলেছিলেন, ‘এই মামলায় আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব।’ টম উইলিয়ামস উত্তরে বলেছিলেন, ‘একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি থাকেন। সুতরাং সে হিসেবে আপনি আমার উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করবেন।’ টম উইলিয়ামস ঢাকায় থাকাকালে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি মোর্শেদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে অনেক বৈঠক হয়। বিচারপতি মোর্শেদের জ্ঞান ও আইনের শাসনের প্রতি অনুরাগ দেখে টম উইলিয়ামস বহুবার প্রশংসা করেছেন।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই কঠিন পর্যায়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন একজন নির্ভীক সৈনিকের মতো। আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ জন নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বিচারপতি মোর্শেদ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারাসনে বসে স্বৈরাচারী সরকার এবং সামরিক আমলে যে সিদ্ধান্ত ও রায় দিয়েছেন, তা নজিরবিহীন। শুধু যুক্তিতর্কই নয়, বলিষ্ঠ ভাষা ও তাঁর পণ্ডিত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের আইনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিচারপতি মোর্শেদ বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রই সর্বোচ্চ অধিকার, তিনি আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতায় মর্মাহত হয়েছিলেন, উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য যাঁরা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। চুয়ান্নর যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে ও ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ণে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা এ জাতি কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে নিম্ন আদালতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি রাজনীতিবিদদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে কিছুটা ভগ্ন স্বাস্থ্যজনিত কারণে, কিছুটা সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন এই তেজস্বী পুরুষ নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবুও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে কখনো তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। ১৯৬৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিস্মৃতিপরায়ণ এই সমাজের জন্য, মূল্যবোধের প্রবল সংকটের সময় বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের মতো ব্যক্তিত্বের আজ বড়ই প্রয়োজন। তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবান বক্তৃতা, প্রবন্ধ, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রায় মেধায়, প্রজ্ঞায়, বিচক্ষণতায়, আইনের ব্যাখ্যায় আমাদের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত। এসব গ্রন্থভুক্ত করে সমাজকে সমৃদ্ধিশালী করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রিন্সিপাল শাহ মুহাম্মদ খোরশেদ প্রণীত Justice Syed Mahbub Mursed-A Profile নামের একটি মূল্যবান পুস্তক প্রকাশ করেছে। পুস্তকটিতে তাঁর সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য রয়েছে।
বিচারপতি মোর্শেদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি যে প্রত্যয়, মূল্যবোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামী অবদান রেখে গেছেন, তা আমাদের সামনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশের মানুষকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করবে। শুধু বিচারক হিসেবেই নন, দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তিনি যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সংশোধনী: গতকাল প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু মানিক মিয়া’ ফিচারটিতে দুটো ভুল আছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু মানিক মিয়ার সঙ্গে বঙ্গভবনে নয়, গণভবনে দেখা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি নন।
No comments