আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব
লক্ষ্মী। নামের মধ্যেই সৌভাগ্যের বারতা মেশানো। কেন রাখা হয়েছিল এমন নাম? নূরজাহানের কপালে লক্ষ্মীর ছোঁয়া লাগেনি কেন? ফতোয়াবাজরা একজন নারীকে নিয়ে কেন করল এমন আচরণ
এসব ভাবনা মাথায় থাকতেই ট্রেন এসে থামল কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে আবার পথচলা শুরু। গন্তব্য ছাতকছড়া, যে গ্রামে নূরজাহানের ওপর ফতোয়া জারি হয়েছিল।
ছাতকছড়া পেঁৗছে জানা গেল এ গ্রামের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের কথা। এ বৈশিষ্ট্যের যাঁতাকলে পড়ে ফতোয়ার শিকার হয়ে ১৯৯৩ সালে জীবন দিতে হয়েছিল নূরজাহান ওরফে লক্ষ্মীকে। জানা গেল, প্রশাসন নয়, জনপ্রতিনিধি নয়, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতাও নয়_ছাতকছড়া চলে একজন গ্রাম্য নেতার কথামতো।
বিয়ে থেকে শুরু করে আচার-বিচারসহ গ্রামের সবকিছু চলে সেই নেতার সিদ্ধান্তে। একনায়কতন্ত্রের মতো এই নেতা আমৃত্যু ক্ষমতাধর।
বিয়ে থেকে শুরু করে আচার-বিচারসহ গ্রামের সবকিছু চলে সেই নেতার সিদ্ধান্তে। একনায়কতন্ত্রের মতো এই নেতা আমৃত্যু ক্ষমতাধর।
নব্বইয়ের দশক। ছাতকছড়া গ্রামের নেতা মনির উদ্দিন সর্দার। জঙ্গলের বাঘের মতো গ্রামে চলত মনির সর্দারের দাপট। আশ্রব উল্লাহ সেই গ্রামের হতদরিদ্র এক ব্যক্তি। ছয় মেয়ে দুই ছেলের জনক তিনি। তারই চতুর্থ মেয়ে নূরজাহান ওরফে লক্ষ্মী। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নূরজাহানের বিয়ে হয় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর গ্রামের রব্বান মিয়া ওরফে বইছার সঙ্গে। সে সময় নূরজাহানের বয়স ছিল ১৮ বছর। বছর না ঘুরতেই একদিন রব্বান মিয়া নূরজাহানকে মৌখিকভাবে তালাক দেয়। নূরজাহান চলে যান তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। নূরজাহানের বাবা যুবতী তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে। মেয়েকে তিনি আবার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালান। সেই সময় নানাজনে নানা কথা বলায় আশ্রব উল্লাহ শেরপুরে রব্বান মিয়ার কাছে গিয়ে চূড়ান্ত তালাকনামা নিয়ে আসেন। এ ছাড়া গ্রামের মসজিদের ইমাম আবদুল মান্নানের কাছ থেকেও মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে শরিয়তসম্মত হবে কি না জানতে চান। ইমাম মান্নান পক্ষে ফতোয়া দেয়ার নাম করে আশ্রব উল্লাহর কাছ থেকে সেই সময় দু শ টাকা পারিশ্রমিকও নেন। দরিদ্র বাবা ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে একই গ্রামের আবদুল মতলিবের সঙ্গে নূরজাহানকে বিয়ে দেন। মতলিবও বিবাহিত ছিলেন। তবে তার স্ত্রী ছিলেন অসুস্থ। অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিয়েই মতলিব নূরজাহানকে বিয়ে করেন। বিয়েতে গ্রামের অনেক লোক উপস্থিত ছিলেন।
নূরজাহানের এই দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই বিষয়টিকে ইস্যু করতে গ্রামের সমাজপতি মনির সর্দার তৎপর হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে ইমাম মান্নানও যোগ দেন। দুজনেরই কুনজর পড়ে নূরজাহানের ওপর।
নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। ২১ অক্টোবর মনির সর্দারের ডাকে পঞ্চায়েতের বৈঠক বসে ছাতকছড়া মসজিদ মাঠে। পঞ্চায়েতে নূরজাহানের বিয়েকে শরিয়তবিরোধী এবং আশ্রব উল্লাহর পরিবারকে একঘরে করা হোক বলে সিদ্ধান্ত দেন গ্রাম্য নেতা মনির সর্দার।
দীর্ঘদিন একঘরে থেকে স্বাভাবিক জীবন কামনা করেন আশ্রব উল্লাহ। বিষয়টি তখন আমলে নেয় পঞ্চায়েত। মনির উদ্দিনের ডাকে ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি আয়োজন করা হয় আরেক বৈঠকের। বৈঠক বসে প্রথমে ছাতকছড়া মসজিদ মাঠে। শীতের কারণে বৈঠক স্থানান্তর করা হয় পাশের আবদুর রাজ্জাক ওরফে নিয়ামত উল্লাহর বাড়িতে। সেখানে অন্যদের সঙ্গে উপস্থিত হন ছাতকছড়া মসজিদের ইমাম আবদুল মান্নান।
পঞ্চায়েতের এ বৈঠকে মনির উদ্দিনের মতামত নিয়ে ফতোয়া জারি করেন ইমাম মান্নান। ফতোয়ায় বলা হয়, যেহেতু নূরজাহান ও মতলিবের বিয়ে শরিয়তমতো হয়নি, তাই তারা জেনা করেছে। এর শাস্তিস্বরূপ নূরজাহান ও মতলিবকে কোমর পর্যন্ত মাটির গর্তে পুঁতে ১০০ করে পাথর ছুড়ে মারা হবে। আর অবৈধ কাজে সহযোগিতা করার অপরাধে ৫০টি করে দোররা (বেত্রাঘাত) মারা হবে নূরজাহানের মা-বাবাকেও।
সালিসে মনির সর্দার ও মান্নান মোল্লার সাঙ্গোপাঙ্গসহ ১০-১২ জন ছিল। আর সালিস দেখার জন্য সারা গ্রামের মানুষ ভিড় করেছিল। নূরজাহানের বাবা আশ্রব উল্লাহকে ডেকে আনা হয়। আশ্রব উল্লাহ নূরজাহানের আগের স্বামীর (রব্বান মিয়া) তালাকনামা দেখালেও মনির সর্দার ও মান্নান সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেন। মনির সর্দার গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান। তার সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমন সাহস কারো নেই। তার পরও একজন বলেন, শাস্তির পরিমাণ কিছুটা কমানো যায় কি না একটু ভেবে দেখেন। মান্নান মোল্লা পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে কোমরের বদলে হাঁটু সমান গর্তে দাঁড় করিয়ে নূরজাহান ও মতলিবকে পাথর ছুড়ে মারা এবং নূরজাহানের বাবা আশ্রব উল্লাহ ও মা সায়রা বিবিকে ১০০ দোররার বদলে ৫০টি বেত মারার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।
শুরু হয় শাস্তি কার্যকরের জন্য ওই বাড়ির উঠোনে গর্ত খোঁড়া। এবার শাস্তি দেয়ার জন্য প্রথমেই নূরজাহানকে নিয়ে আসা হয় গর্তের কাছে। নূরজাহান পেছন ফিরে বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু মান্নান মোল্লা কথা বলতে না দিয়ে ধমক দিয়ে তাকে গর্তে নামিয়ে দেন। উপস্থিতদের মধ্যে একজন তির্যকভাবে বলেন, 'বিয়ে বইতে এত শখ কেনে, বিষ খাইয়া মরতে পারছ না?'
এর পরই নূরজাহানের ওপর ছোড়া হয় ১০১ পাথর। একইভাবে মতলিবের শাস্তিও কার্যকর করা হয়। নূরজাহান-মতলিবের বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকে দশবার কান ধরে উঠবস করানো হয়। সবার শাস্তি কার্যকর হওয়ার পর মান্নান মোল্লা উপস্থিতদের তওবা পড়ান ও মোনাজাত করেন।
এদিকে নূরজাহানের শাস্তি শেষ হওয়ার পরই সে অাঁচলে মুখ ঢেকে দৌড়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বাবার বাড়ি চলে যায়। সালিসস্থলে লোকজনের ভিড় থাকাবস্থায়ই নূরজাহানের বাড়ি থেকে খবর আসে সে কীটনাশক পান করেছে। নূরজাহানের বাবা ও আত্দীয়রা দ্রুত বাড়িতে যান। ততক্ষণে এ পৃথিবীর প্রতি চরম ঘৃণা আর সমাজপতিদের বিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে চিরবিদায় নিয়েছে নূরজাহান।
এবার নূরজাহানের লাশ দাফনের পালা। বাবা আশ্রব উল্লাহ মনির সর্দারের কাছে লাশ দাফনের অনুমতির জন্য গেলে তারা নূরজাহানের মৃত্যু নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। 'এই মেয়ে জেনা করেছে, তার লাশ দাফন হবে না' বলে মান্নান মোল্লা আবার নতুন ফতোয়া জারি করেন। এ সময় একজন বলে ওঠেন, 'বিষ খেয়ে মরা লাশ। এ লাশের খবর থানাকে না জানিয়ে দাফন করলে পরে সমস্যা হতে পারে। খবর পাঠানো হয় থানায়। বিকেলে ঘটনাস্থলে পেঁৗছে পুলিশ। তারা লাশ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ থানায়। ময়নাতদন্তের জন্য পরদিন ১১ জানুয়ারি লাশ পাঠানো হয় মৌলভীবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত শেষে ১২ জানুয়ারি নূরজাহানের লাশ ছাতকছড়ায় ফেরত আসায় গ্রামের মানুষ ফতোয়া উপেক্ষা করে একটি টিলায় নূরজাহানকে দাফন সম্পন্ন করে।
থানা পুলিশের কথামতো নূরজাহানের বাবা আশ্রব উল্লাহ ১১ জানুয়ারি কমলগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় বিষয়টি ফলাওভাবে প্রচারিত হওয়ায় ঘটনার ১৭ দিন পর ২৭ জানুয়ারি কমলগঞ্জ থানার সহকারী দারোগা ওয়াজিউল্লাহ মান্নান মোল্লাসহ সাতজনকে বিবাদী করে একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করেন। থানা কর্তৃপক্ষ চার মাস তদন্ত শেষে ১৬ এপ্রিল নয়জনকে আসামি করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসংবলিত চার্জশিট আদালতে দাখিল করে।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলাটি চলে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মামলার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনসহ সরকারের সঙ্গে থেকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।
========================
ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি' গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী' ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী' ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর' সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুল হামিদ মাহবুব
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি' গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী' ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী' ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর' সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুল হামিদ মাহবুব
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments