আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ‘দি ইসরাইল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি’ by জন জে ম্যায়ারসিমা এবং স্টিফেন এম ওয়াল্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নানা ধরনের লবি আছে। এদের কাজ হচ্ছে সরকারি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নীতিগতভাবে তাদের স্বার্থ হাসিল করা।
যেসব লবি রয়েছে তার মধ্যে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তাদের নেটওয়ার্কের পরিসরও অনেক বিস্তৃত। এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, নিরাপত্তা, বিদেশনীতি ইত্যাদি বিষয়ে মার্কিনি নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক। এই লবিতে কারা আছেন, কোন ক্ষেত্রে কীভাবে তারা কাজ করেন। এ বিষয়েই জন জে ম্যায়ারসিমা এবং স্টিফেন এম ওয়াল্ট-এর বই ‘দি ইসরাইল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি’। বইটির অংশবিশেষ সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে প্রকাশিত হল। অনুবাদ করেছেনঃ ওসমান করীম।
‘ইসরাইল লবি’ কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো নিয়মিতভাবে জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন ধারণার রূপ দেয় এবং তাদের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নীতি গ্রহণে তারা আইন প্রণেতা ও প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করে।প্রতিযোগী দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক কাজের অত্যন্ত প্রশংসা করেন ১০নং ফেডারেলিস্টে জেমস মেডিসন, আর বিভিন্ন সুবিধাবাদী গ্রুপের চাপে যুদ্ধের সিদ্ধান্তসহ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি রূপ লাভ করে। যখন কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থবাদী গ্রুপ বিশেষভাবে শক্তিশালী বা রাজনৈতিকভাবে দক্ষ হয়ে ওঠে তখন তারা এমন নীতির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে যা সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষার জন্য শুল্ক আরোপ করা হলে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পের সুবিধা হয়। কিন্তু ওই শিল্পের পণ্য ব্যবহারকারী অনেক ভোক্তাকে এজন্য বাড়তি অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নকে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন ব্যর্থ করে দেয়। এর ফলে বন্দুক প্রস্তুতকারী ও ডিলাররা নিঃসন্দেহে লাভবান হয়, তবে সমাজের অবশিষ্ট লোকগুলো বন্দুক সংক্রান্ত অনিষ্টের বিষয়ে আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইন্সটিটিউটের সাবেক লবিস্ট হোয়াইট হাউসের পরিবেশের মান সংক্রান্ত পরিষদের প্রধান হন এবং তিনি যখন এই পদমর্যাদাকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতার মধ্যকার সম্পর্কবিষয়ক রিপোর্টকে নাকচ করে দেন (অক্সন মবিল-এ চাকরি নেওয়ার জন্য পদত্যাগের পূর্বে) তখন অনেকেই যৌক্তিকভাবে উদ্বিগ্ন হন যে, তেল শিল্প এমনভাবে এর স্বার্থ রক্ষা করছে যেন তা আমাদের সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের ওপর জ্বালানি স্বার্থের প্রভাব অথবা ওষুধের ব্যবস্থাপত্রের ওপর ওষুধ কোম্পানিগুলোর ভূমিকার মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ওপর ইসরাইল লবির প্রভাব একই মাপকাঠিতে বিচার করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে নীতি অনুসরণ করে তার কৌশলগত বা নৈতিক ভিত্তি যা আছে তা খুবই সামান্য। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব গ্রুপ ও ব্যক্তি লবি তৈরি করে তাদের স্বার্থই হলো এর মূল কারণ। এটা যদি লবির প্রয়াস না হতো তাহলে কৌশলগত ও নৈতিক যে যুক্তিকে নিঃশর্তভাবে মার্কিন সমর্থনের জন্য সাধারণত চাওয়া হয় তা বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন হতো। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে নীতি কার্যকর আছে তার আমূল পরিবর্তন হতো। ইসরাইল সমর্থক শক্তিগুলো নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে, তারা এমন নীতিকে উৎসাহিত করছে যা আমেরিকা ও ইসরাইলের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষার জন্যই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা ভিন্ন মত পোষণ করি। তারা যেসব নীতি সমর্থন করে তার অধিকাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভিন্ন একটা পথ অনুসরণ করতো তাহলে উভয় দেশই লাভবান হতে পারতো। ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকারের প্রতি সমর্থনের জন্য আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো প্রশ্ন করছি না। কারণ ওই অধিকার এখন স্পষ্টভাবে যৌক্তিক এবং সারাবিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশ তা সমর্থন করে। আমাদের যে প্রশ্ন ও যার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন তা হলো – ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ব্যাপকতা ও এর নিঃশর্ত প্রকৃতি এবং ইসরাইলের কল্যাণকে বিবেচনায় রেখে এর মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিচালনার মাত্রা। এ লক্ষ্যে এখানে ইসরাইল লবির মূল উপাদানগুলো চিহ্নিত এবং কিভাবে তা সময়ের বিবর্তনে গড়ে উঠেছে তা বর্ণনা করা হলো। ‘আরব লবি’ ও ‘তেল লবি’র মতো সম্ভাব্য প্রতিযোগীর তুলনায় ইসরাইল লবি কেন এতোটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, তাও আমরা আলোচনা করবো। লবির ব্যাখ্যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের শিথিল জোটকে আমরা সুবিধাজনক সংক্ষিপ্ত নাম ‘ইসরাইল লবি’ ব্যবহার করেছি যা ইসরাইল-সমর্থক লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির রূপ গঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এ লবির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসহ কোনো একক ও সংঘবদ্ধ আন্দোলন নেই। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এ ব্যাপক জোট কখনো কখনো কোনো নির্দিষ্ট নীতির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। এটা কোনো ধরনের গোপন অভিসন্ধির জন্য মিলিত ক্ষুদ্র দল বা ষড়যন্ত্র নয়। বরং লবি গঠনকারী এসব সংগঠন ও ব্যক্তি খোলামেলাভাবে কাজ করে, যেমনভাবে অন্যান্য স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো কাজ করে। ‘ইসরাইল লবি’ কথাটা ব্যবহার করা হয়ত কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কারণ এ শিথিল জোটের অনেক ব্যক্তি ও কোনো কোনো গ্রুপ আনুষ্ঠানিক লবিং কাজে (নির্বাচিত কর্মকর্তাদের অনুরোধ করার জন্য সরাসরি প্রয়াস) যুক্ত নয়। বরং ওই লবির বিভিন্ন অংশ মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে, যেমন করে অন্যান্য স্বার্থবাদী গ্রুপ। কেউ এ প্রয়াসকে যথার্থভাবে বর্ণনা করতে পারেন ‘ইসরাইল সমর্থক সম্প্রদায়’ অথবা ‘ইসরাইলকে সহায়তা করার আন্দোলন’ হিসেবে। কারণ বিভিন্ন গ্রুপের কাজের ব্যাপকতা সাধারণ লবিং কাজের চেয়ে অনেক বেশি। যাহোক, যেহেতু অনেক গ্রুপ লবিংয়ের কাজ করে সেহেতু ‘ইসরাইল লবি’ কথাটা সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে (যেমন ‘ফার্ম লবি’, ‘ইনসিওরেন্স লবি’, ‘গান লবি’ বা ‘অন্যান্য লবি’)। অন্যান্য স্বার্থবাদী বিশেষ গ্রুপের মতো ইসরাইল লবির কাজের সীমারেখা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তাছাড়া অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের কাজের সীমারেখা নির্ধারণ করা গেলেও তাদের অবস্থানের শ্রেণীবিভাগ করা খুবই কষ্টকর। ওই লবির অংশ হিসেবে কিছু কিছু গ্রুপকে চিহ্নিত করা যায়, যেমন মার্কিন ইহুদি সংগঠন। আবার ওই লবির সদস্য হিসেবে কিছু কিছু লোককেও চিহ্নিত করা যায়, যেমন কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস অব মেজর আমেরিকান জুইশ অর্গানাইজেশনস-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান ম্যালকম হোয়েনলিন। অনেক সংগঠন আছে যা সুস্পষ্টভাবে ওই লবির অংশ নয়, যেমন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনস অব আরব-আমেরিকানস। অনেক ব্যক্তি আছে যারা ওই লবির সদস্যের বাইরের লোক, যেমন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পন্ডিত ব্যক্তি রশিদ খালিদী। তবু এমন অনেক গ্রুপ ও ব্যক্তি আছে যাদের অবস্থান খুবই অনিশ্চিত। অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো ইসরাইল লবির কাজের সীমা স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এ লবি কোনো কেন্দ্রিভূত, পুরোহিততান্ত্রিক সংগঠন নয়, ব্যাখ্যা করা যায় এমনভাবে এর কোনো সদস্য পদও নেই। এর কোনো সদস্যপদ কার্ড বা দীক্ষা নেওয়ার কোনো রীতি নেই। বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে এর একটা ঘোষিত মূল লক্ষ্য আছে। আর তা হলো, ইসরাইলকে বস্তুগত সহায়তা ও এর সরকারের নীতিকে সমর্থন দেওয়ার জন্য মার্কিন সরকার ও এর জনগণকে উৎসাহিত করা। এছাড়াও আছে প্রভাবশালী মার্কিন লোকদের ওই একই উদ্দেশ্যে উৎসাহিত করা। বলা যায়, এসব লক্ষ্যই হলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এ লবি বিভিন্ন উপ-গ্রুপ ও ব্যক্তির সমর্থনও পায় যারা ইসরাইলের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা চায় যে, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থন অব্যাহত রাখুক। তবে এসব উপ-গ্রুপ ও ব্যক্তি মূল গ্রুপ ও ব্যক্তির মতো ততোটা উৎসাহী বা অবিচলিতভাবে সক্রিয় নয়। এভাবে, আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির একজন লবিস্ট, ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির একজন গবেষক অথবা অ্যান্টি-ডেফামেশন লীগ ও ক্রিস্টিয়ানাস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের মতো নেতৃস্থানীয় সংগঠনগুলো ওই লবির মূল অংশ, আর যেসব লোক তাদের স্থানীয় পত্রিকায় ইসরাইলকে সমর্থন করে পত্র লেখে অথবা ইসরাইল সমর্থক রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটিকে চেক পাঠায় তাদের দেখা হয় সমর্থকদের কাজের নেটওয়ার্কের একটা অংশ হিসেবে। এ ব্যাখার অর্থ এটা নয় যে, ইসরাইলের প্রতি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রত্যেক মার্কিনি ওই লবির সদস্য। এ ক্ষেত্রে একটা ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। এ বইয়ের লেখকদ্বয় এ অর্থে ‘ইসরাইল সমর্থক’ কারণ আমরা এর টিকে থাকার অধিকারকে সমর্থন করি, এর অনেক অর্জনকে প্রশংসা করি, এর নাগরিকদের নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবন চাই এবং বিশ্বাস করি যে, ইসরাইলের অস্তিত্ব যদি বিপদাপন্ন হয় তাহলে এর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু আমরা সুস্পষ্টভাবে ইসরাইল লবির অংশ নই। এটাও এ ইঙ্গিত দেয় না যে, যেসব আমেরিকান ইসরাইলকে সমর্থন করে তারাও ইসরাইল লবির অংশ। যে সিনেটর ইসরাইলকে সহায়তা দেওয়ার পক্ষে অবিচলিতভাবে ভোট দেন, তিনিও আবশ্যিকভাবে ইসরাইল লবির অংশ এমন নয়। কারণ তিনি হয়তো ইসরাইল-সমর্থক স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর রাজনৈতিক চাপে সাড়া দিতে পারেন। অন্য কথায়, লবির অংশ হতে হলে কাউকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ইসরাইল-সমর্থক লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হয়। কোনো সংগঠনের পক্ষে এই প্রচেষ্টা তার মিশনের অংশ হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য তার সম্পদ ও কর্মসূচির একটা বিরাট অংশ কাজে লাগাতে হয়। কোনো ব্যক্তির পক্ষে এর অর্থ হলো, কারো পেশাগত বা ব্যক্তিগত জীবনের কিছুটা অংশ এ কাজের জন্য ব্যয় করতে হয় (অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটা অংকের অর্থ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য। কোনো সাংবাদিক অথবা কোনো শিক্ষাবিদ, যিনি মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্য বিষয় নিয়ে লেখেন এবং বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করেন তা ইসরাইলের অনুকূলে গেলেও তাকে ইসরাইল লবির অংশ হিসেবে দেখা ঠিক নয়, যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার ডেভিড স্যানগার অথবা ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস জেন্টলসন। কিন্তু কোনো সাংবাদিক বা পন্ডিত ব্যক্তি যিনি ইসরাইলের পক্ষ নেবেন বলে পূর্বেই ধারণা করা যায় এবং যিনি ইসরাইলের জন্য স্থির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পক্ষে তার লেখার অধিকাংশই ব্যয় করেন তিনি স্পষ্টভাবে ইসরাইল লবির অংশবিশেষ, যেমন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট চার্লস ক্রাউথামার বা প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ঐতিহাসিক বার্নার্ড লিউস। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়াস ও নির্দিষ্ট কাজের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় এবং ইসরাইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি একমত নাও হতে পারে। অনেক ব্যক্তি ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিরোধিতা করেন এবং এর পরিবর্তে তারা বিশ্বাস করেন যে, সব এলাকা বা অধিকৃত এলাকার অধিকাংশই ইসরাইলের রেখে দেওয়া উচিত। এসব লোকের মধ্যে আছেন আমেরিকার ইহুদি সংগঠনের মর্টন ক্লেইন, ক্রিস্টিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের জন হ্যাপি এবং আমেরিকানস ফর অ্যা সেফ ইসরাইলের রায়েল জ্যাঁ আইজাক। অন্যরা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা বলেন এবং মাঝে মাঝে ইসরাইলের নির্দিষ্ট কোনো কার্যব্যবস্থার সমালোচনা করেন। এদের মধ্যে আছেন ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ডেনিস রস এবং ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের মার্টিন ইনডায়েক। এসব পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের সবাই বিশ্বাস করেন যে, ইসরাইলের কোনো কাজের বিরোধিতা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাকে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করা। এ ধরনের সহায়তাকে উৎসাহিত করার জন্য তারা তাদের পেশাগত জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেন। এভাবে এমন চিন্তা করা স্পষ্টত ভুল যে, ওই লবি হলো একটা একক চিন্তার স্তম্ভ; এটা কোনো গুপ্ত অভিসন্ধির দল বা ষড়যন্ত্র নয়। তেমনি যারা ইহুদি রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার বিশেষ সম্পর্ক রক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে তাদের ওই লবির বাইরের লোক বলে মনে করাও একইভাবে ভুল হবে। আমেরিকান ইহুদি সম্প্রদায়ের ভূমিকা লবির বেশিরভাগ লোকই আমেরিকান ইহুদি। তারা সব সময় এটা নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ইসরাইলের স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক মেলভিন আই ইউরোফসকির মতে, ‘আমেরিকার ইতিহাসে মানবজাতির আর কোনো গ্রুপ বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে এতটা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট নেই।’ স্টিভেন টি রোসেনথেল একথা সমর্থন করে লেখেন, ‘১৯৬৭ সাল থেকে … আর কোনো দেশ পাওয়া যায় না যার নাগরিকরা অন্য দেশের সাফল্যের জন্য এতটা অঙ্গীকারাবদ্ধ, যেমনটা আমেরিকান ইহুদিরা করে ইসরাইলের জন্য।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ট্রাইস ১৯৮১ সালে লেখেন, ইসরাইল সমর্থক লবির সংখ্যা কমপক্ষে পঁচাত্তরটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ, এদের অধিকাংশই ইহুদি। এরা ‘ইসরাইল সরকারের প্রায় সব কাজ ও নীতির সমর্থন করে।’ এসব গ্রুপের কাজ শুধু ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা সংবাদ সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি লেখে, ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেয় এবং এমন এক বা একাধিক ইসরাইল সমর্থক সংগঠনকে সক্রিয় সমর্থন দেয় যারা তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে ওই গ্রুপের লোকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। তবু সব আমেরিকান ইহুদি ইসরাইল লবির সমার্থক নয়। যেসব ব্যক্তি বা গ্রুপ ইসরাইলের জন্য মার্কিন সমর্থনকে উৎসাহিত করে তাদের সবাইকে ‘ইহুদি লবি’ বলে বর্ণনা করা যথার্থ নয়। একটা বিষয় হলো, ইসরাইলের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধের গভীরতার ক্ষেত্রে মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা আছে। সাধারণভাবে তাদের মধ্যে তৃতীয়জন বস্তুত ইসরাইলকে নির্দিষ্টভাবে মূল বিষয় বলে গণ্য করে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালে পরিচালিত একটা জরিপ থেকে দেখা যায়, আমেরিকার ইহুদিদের মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ ইসরাইলের প্রতি আবেগপ্রবণভাবে সংশ্লিষ্ট অবস্থায় ‘বেশি নয়’ বা ‘মোটেই নয়’ অবস্থায়। এছাড়াও অনেক আমেরিকান ইহুদি আছে যারা ইসরাইলের প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও লবির প্রধান প্রধান সংগঠনের বিভিন্ন নীতি সমর্থন করে না। যেমন, অনেক বন্দুক-মালিক ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন সমর্থিত সব নীতি সমর্থন করে না, তেমনি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর সব পদক্ষেপকেই অবসরপ্রাপ্তরা অনুকূল বলে মনে করেন না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সামগ্রিকভাবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় ইরাক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমেরিকান ইহুদিরা খুবই কম আগ্রহী ছিল। অথচ লবির প্রধান প্রধান সংগঠনগুলো ওই যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। মার্কিন ইহুদিরা ওই যুদ্ধের ব্যাপারে আগের চেয়ে এখন বেশি বিরোধিতা করে। সবশেষে, ইসরাইলের পক্ষে অধিক সোচ্চার কিছু কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপ ইহুদি নয়, যেমন ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টস। আমেরিকান ইহুদিরা যেহেতু লবির প্রধান উপাদান, সেহেতু এই শিথিল জোটকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে ইসরাইল লবি হিসেবে। এটাই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা যা ওই লবির ব্যাখ্যা করে – ওই লবিকে যারা এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের ধর্মীয় বা এয্নিক পরিচিতি থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। অনেক আমেরিকান ইহুদি ইসরাইলের জন্য যে আসক্তি অনুভব করেন তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। বিভিন্ন দেশ বা জাতির জন্য একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও একাত্মতা অন্যান্য এয্নিক গ্রুপের মধ্যেও দেখা যায় যাদের উৎস এক অথচ তারা বিদেশে বসবাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইহুদিরা ইহুদিবাদ আন্দোলনের প্রথমদিকে এ সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কিন্তু ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর এর প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের ওপর ভীতিকর নির্যাতন সংঘটিত হওয়ার পর এ সম্পর্কে সবাই সচেতন হয়ে ওঠে। তুলনামূলকভাবে খুব কম সংখ্যক ইহুদি ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সেখানে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-পুরিয়ন এবং অন্যান্য ইসরাইলি নেতা প্রথমদিকে এ প্রয়াসের সমালোচনা করেন। তবু ইসরাইলের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার খুব শিগগিরই অনেক মার্কিন ইহুদির জন্য পরিচিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনে একটা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বিষ্ময়কর বলে মনে হয়, বিশেষ করে নাজি কর্তৃক হত্যাকান্ডের পর। ‘মরুভূমিতে ফুল ফোটানোর’ জন্য ইসরাইলের অর্জন নিশ্চিতভাবে গর্বের উৎস ছিল। ইসরাইলের সঙ্গে গভীর পরিচিতি ওই সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য একটা নতুন ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা অতি দ্রুত মার্কিন সমাজে মিশে যায়। তারা একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে রোসেনথাল লেখেন : ‘বাসস্থান থেকে ৮ হাজার মাইল দূরে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কারো ইহুদিত্বের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ধর্মের বাধা এড়ানোর সুবিধাজনক উপায় হলো ইসরাইলকে ইহুদি ধর্মমতের সঙ্গে সমীকরণ করা… যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে মার্কিন ইহুদিদের জীবনধারার মূলকেন্দ্র সিনাগগ হয়ে ওঠে ইসরাইলকেন্দ্রিক। নতুন এক শ্রেণীর পেশাজীবী ইহুদি বিভিন্ন নগরের উপকণ্ঠে গড়ে ওঠে। তারা শিগগিরই দেখতে পায়, তাদের নিজ নিজ এলাকার ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উদাসীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অত্যন্ত কার্যকর উপায় হলো ইসরাইল। ইসরাইলের জন্য ব্যাপক আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনের সমর্থনে প্রধানত অনেক সংগঠন গড়ে ওঠে। অর্থ যোগাড় ও লবিং কাজের জন্য কাউকে ক্রমাগতভাবে ইসরাইলের সঙ্গে মার্কিন ইহুদিদের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।’ মার্কিন ইহুদিরা অনেক আকর্ষণীয় নাগরিক সংগঠন গড়ে তুলেছে যার কর্মসূচি হলো ইসরাইলের কল্যাণের জন্য কাজ করা, অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করা। এসব সংগঠনের মধ্যে আছে আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, আমেরিকান জুইস কংগ্রেস, জাইওনিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা, ইসরাইল পলিসি ফোরাম, আমেরিকান জুইশ কমিটি, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ, রিলিজিয়াস অ্যাকশন সেন্টার অব রিফর্ম জুডাইজম, আমেরিকানস ফর সেফ ইসরাইল, আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব লিকুড, মারকাজ-ইউএসএ, হাডাসাহ এবং আরো অনেক সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানী চেইম আই. ওয়াক্সম্যান ১৯৯২ সালে বলেন, আমেরিকান জুইশ ইয়ারবুকে ৮০টারও বেশি জাতীয় ইহুদি সংগঠনের নাম তালিকাভুক্ত আছে যা ‘বিশেষভাবে ইহুদি ও ইসরাইল সমর্থক কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত… এবং অন্যসব সংগঠনের লক্ষ্য ও কার্যাবলির মধ্যে আছে ‘ইসরাইলের কল্যাণকে উৎসাহিত করা’, ‘ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থন করা’ এবং ‘ইসরাইল সম্পর্কিত জ্ঞানকে উৎসাহিত করা’। সবচেয়ে বড় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলোর মধ্যে ৫১টা সংগঠন কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস অব মেজর আমেরিকান জুইশ অর্গানাইজেশনসে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যার বর্ণিত মিশনের মধ্যে আছে ‘ইসরাইলের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন গ্রুপের একক শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া’ এবং ‘বিশেষ মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ক জোরদার ও লালনে’র জন্য কাজ করা। লবির মধ্যে আছে বিভিন্ন থিঙ্ক-ট্যাংক, যেমন জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, মিডল ইস্ট ফোরাম ও ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার-ইস্ট পলিসি। এছাড়া আছে অনেক ব্যক্তি যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আরো আছে কয়েক ডজন ইসরাইল সমর্থক পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি যারা ইসরাইল সমর্থক প্রার্থী অথবা এমন সব প্রার্থীকে অর্থ দেওয়ার জন্য প্রস্ত্তত থাকে যাদের বিপক্ষ প্রার্থী ইসরাইলের যথেষ্ট সমর্থক নয় বা এর বিপক্ষ বলে মনে হয়। প্রচারমূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দলীয় গবেষণা গ্রুপ সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স এমন কমবেশি তিন ডজন ‘ইসরাইল-সমর্থক’ পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি চিহ্নিত করে। ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক রিপোর্টে বলে, ২০০৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থীদের তারা প্রায় ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। ইহুদিদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে, যাদের এজেন্ডার মধ্যে প্রধান অংশ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক, আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হলো স্পষ্টভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত পরিচিত। ১৯৯৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন কংগ্রেস সদস্য ও তাদের কর্মচারীদের কাছে ওয়াশিংটনে সবচেয়ে শক্তিশালী লবি কোনটি তা জিজ্ঞাসা করে। এতে দেখা যায়, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর পর পরই আসে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নাম যা আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব লিকুড-সিআইও এবং ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের মতো শক্তিশালী লবিরও ওপরে ছিল। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ন্যাশনাল জার্নাল একই রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর সঙ্গে যুক্ত করে) অবস্থান ওয়াশিংটনের ‘পেশীশক্তির দিক থেকে’ দ্বিতীয় স্থানে নির্ধারণ করে। সাবেক কংগ্রেস সদস্য মেরভিন ডাইম্যালি একবার বলেন, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হলো ‘কংগ্রেসের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কার্যকর লবি’। হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান লি হ্যামিলটন ১৯৯১ সালে বলেন, ‘এর সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো লবি গ্রুপ নেই… তারা নিজেরাই একটি শ্রেণীবিশেষ।’ মি. হ্যামিলটন কংগ্রেসে কাজ করেন ৩৪ বছর। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো অন্য গ্রুপগুলো বর্তমানে যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রথমদিকে, এমনকি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও ইসরাইলের পক্ষে নীরবে লবিং চলে দৃশ্যের অন্তরালে। ওই লবিং চলে সাধারণত প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট, অল্পসংখ্যক ইহুদি নেতা, ইহুদি সমর্থক, উপদেষ্টা বা ইহুদি বন্ধুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার পক্ষে উড্রো উইলসন সমর্থন দেন অংশত তার ইহুদি বন্ধু সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি লুইস ডি. ব্রান্ডিস এবং রাবিব স্টিফেন ওয়াইজের প্রভাবে। একইভাবে, ইসরাইলের সৃষ্টি ও নতুন রাষ্ট্রকে সমর্থন করার হ্যারি এস. ট্রূম্যানের সিদ্ধান্ত তার ইহুদি বন্ধু ও উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপে প্রভাবিত হয়। ইসরাইলের সমর্থকদের অনাড়ম্বরভাবে চলার আগ্রহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সেমিটিক বিরোধিতাকে দীর্ঘায়িত করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়। আবার এমন ভীতিও দেখা যায় যে, ইসরাইলের পক্ষে অতি বেশি লবিং মার্কিন ইহুদিদের বিরুদ্ধে দ্বৈত-স্বদেশপ্রীতির অভিযোগ প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সৃষ্টির উৎস হলো ইহুদি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন স্পষ্টভাবে সমর্থনকারী হিসেবে। এর প্রতিষ্ঠাতা আই. এল ‘সি’ কেনেন ১৯৫১ সালে আমেরিকান জাইওনিস্ট কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। ওই কাউন্সিল ছিল তালিকাভুক্ত বিদেশি লবিং গ্রুপ। কেনেন এই কাউন্সিলকে মার্কিন লবিং সংগঠনে পুনর্গঠিত করেন যা ১৯৫৩-৫৪ সালে আমেরিকান জাইওনিস্ট কমিটি ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৫৯ সালে এ সংগঠনের নতুন নামকরণ করা হয় আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হিসেবে। কেনেন জনসমক্ষে প্রচার বা জনগণকে সংগঠিত করার পরিবর্তে প্রধান আইন প্রণয়নকারীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর নির্ভর করতেন। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সাধারণত ইসরাইলের স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ‘কেনেনের নীতি’ অনুসরণ করতো। এক নম্বর অনুসৃত নীতি ছিল : আইন প্রণয়নের পেছনে থাকুন, এর সামনে আসবেন না (অর্থাৎ অনাড়ম্বর অবস্থান বজায় রাখুন)। ইহুদি সংবাদপত্র ফরোয়ার্ডের সম্পাদক জে. জে. গোল্ডবার্গের মতে, ইহুদি সমর্থনের প্রভাব ‘কেনেডি ও জনসনের শাসনামলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ ওই সময়ে মার্কিন সমাজে ইহুদিদের সমৃদ্ধি ও প্রভাব বেড়ে যায়।’ অন্য একটা কারণ হলো, কেনেডি ও জনসন ‘তাদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, দাতা ও ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন।’ তবু ওই সময় আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির কার্যকলাপ ছিল ক্ষুদ্রাকারে এবং এর লোকসংখ্যা ও বাজেট ছিল খুবই কম। স্টুয়ার্ট আইজেনস্ট্যাট উল্লেখ করেন, ‘ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে এ সংগঠন ইহুদি রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রকাশ্যে শুরু করেনি।’ লবির আকার, সম্পদ ও প্রভাব ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ৬ দিনের যুদ্ধের পর ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আইজেনস্ট্যাটের মতে, ওই সংঘর্ষ ‘মার্কিন ইহুদি জনগণকে এমনভাবে সংঘবদ্ধ করে যা ইসরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আর কোনো ঘটনা করতে পারেনি।’ ‘নতুন ইহুদি জাতি’র অহমিকা, গর্ব ও বলিষ্ঠতা এবং নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতার অনুভূতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের ওপর সীমাহীনভাবে প্রভাব ফেলে। সেমিটিক-বিরোধিতার বিরুদ্ধে সফল প্রচার এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক হত্যাকান্ডের ভীতি সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা। ফলে দীর্ঘদিনের বিভেদমূলক বাধা অপসারিত হয়, আর মার্কিন ইহুদিরা ‘তাদের ভীতির অনুভূতি থেকে মুক্ত হয়’ যা প্রথমদিকে ‘তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রসারকে ব্যাহত করেছিল।’ ইসরাইল ক্রমাগতভাবে ইহুদি পরিচিতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল, যেখানে মিলে যাওয়া ক্রমেই সহজ ও ব্যাপক হয়ে যায়। তবু রাজনীতির সঙ্গে ওই সংশ্লিষ্টতার এমন কিছু কারণ ছিল যা প্রকাশ করা যায় না। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য শত্রুর শক্তি ক্ষয় (১৯৬৯-১৯৭০) এবং যুদ্ধের সময় (১৯৭৩) ইহুদি সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসরাইলের কল্যাণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ অব্যাহত থাকে। এসব সংঘর্ষে ইসরাইলের সামরিক সাহসিকতার গর্ব পুনরায় বলীয়ান হয়। তবে তারা ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়। এজন্য তারা অনেক ইহুদি সম্প্রদায়-সম্পর্ক গ্রুপের ইসরাইলকেন্দ্রিক দৃষ্টিকে আরো শক্তিশালী করে। জাতীয় ইহুদি কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজার কাউন্সিলের (পরে ইহুদি কাউন্সিল ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামকরণ করা হয়) নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট চেরনিন ১৯৭৮ সালে এ আশা প্রকাশ করেন যখন তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার ইসরাইল, তবে এর সঙ্গে সবশ্রেণীর লোকের উদ্বেগসহ মার্কিন ইহুদি নেতৃত্বের মতামতের পূর্ণ ঐক্যের প্রতিফলন থাকতে হবে।’ ঐতিহাসিক জ্যাক ওয়েরদিমার এ মন্তব্যকে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি সম্প্রদায়-সম্পর্ক সংগঠনগুলোর সব উদ্বেগ উপেক্ষা করে ইসরাইলকে সহায়তা করার রাজনৈতিক প্রয়াসের হতবুদ্ধিকর স্বীকৃতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ব্যক্তিগত অর্থ প্রদানের তুলনায় ইসরাইলে মার্কিন বিদেশী সহায়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইসরাইল সমর্থক সংগঠনগুলো ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক কার্যাবলীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যার লক্ষ্য ছিল মার্কিন সরকারের সমর্থন রক্ষা করা অথবা বৃদ্ধি করা। ওয়েরদিমারের মতে, ‘ইসরাইলের জন্য লবিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস… এবং আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ওপর ন্যস্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। ওই দুটি সংগঠন সত্তর এবং আশির দশকে প্রসিদ্ধি লাভ করে।’ অতিরিক্ত প্রয়াসের ফলে সচেতনতা এমনভাবে প্রতিফলিত হয় যে, ইসরাইলকে সমর্থন করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে এবং তা রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক ও সমর্থনযোগ্য করে তুলতে হয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে মরিস অমিতায় ১৯৭৫ সালে কেনেনের স্থলাভিষিক্ত হন। মরিস বলেন, ‘আপনি যদি ইসরাইলকে সহায়তা করতে চান তাহলে খেলার নাম হলো রাজনৈতিক কাজ।’ মরিস ও তার উত্তরসূরি টম ডাইনের সময় আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ঘনিষ্ঠ ও কম বাজেটের কার্যকলাপ থেকে বড় ও গণভিত্তিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। এর কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ এবং বার্ষিক বাজেট (পুরোপুরি ব্যক্তিগত দান থেকে আসা) ১৯৭৩ সালে ৩ লাখ মার্কিন ডলার থেকে বর্তমানে (২০০৭) প্রাক্কলিত ৪০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। কেনেনের সময় সংগঠনটা প্রচার-খ্যাতি এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এ সময় তা ক্রমাগতভাবে এর ক্ষমতা প্রচার করতে চায়। সাবেক একজন কর্মকর্তার মতে, ‘তাত্ত্বিক দিক হলো, কেউ যদি আপনার সম্পর্কে না জানে, তাহলে সে আপনাকে ভয় পাবে না।’ আগে ইহুদীদের পক্ষে ইহুদি উপদেষ্টা ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে লবিং করতো। আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং লবির অন্যান্য গ্রুপ ইসরাইলের ইহুদিদের জন্য মানবিক সাহায্য হিসেবে তাদের কর্মসূচিকে ব্যাখ্যা করেনি। বরং লবির বিবর্তনে তা ক্রমাগতভাবে আমেরিকা ও ইসরাইলের কৌশলগত স্বার্থ এবং নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্তি সম্পর্কে বাস্তব যুক্তি গ্রহণ ও তার বিকাশে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। নগদ অর্থ এবং ঠান্ডা যুদ্ধের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ভালো অবস্থানে থেকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি প্রচারাভিযানের জন্য ব্যয়িত অর্থ সম্পর্কে নতুন ফেডারেল বিধির ফলে তার রাজনৈতিক পেশীশক্তি আরো বর্ধিত আকারে দেখতে পায়। এর ফলে স্বাধীন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয় এবং এর পক্ষে ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীর কাছে অর্থ প্রেরণ করা সহজতর হয়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সবদিক থেকে খুব শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু আশির দশকে, ওয়ারেন বাসের মতে, তা ছিল ‘ওয়াশিংটন পাওয়ার হাউস’। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং মতবিরোধের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকতা লবি কোনো কেন্দ্রভিত্তিক বা যাজকীয় আন্দোলন ছিল না, এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি লবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইহুদিদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট নীতির বিষয়েও ব্যাপক মতবিরোধ দেখা গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস ইসরাইলের লিকুড ও অন্য গোঁড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে এবং তারা অসলো শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ, যেমন অ্যামেইনু, আমেরিকানস ফর পিস নাউ, জুইশ অ্যালায়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস, ইসরাইল পলিসি ফোরাম, জুইশ ভয়েস ফর পিস, মেরেতজ-ইউএসএ এবং টিকুকন কমিউনিটি সমস্যার জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধানের জোর সমর্থক। এসব গ্রুপ বিশ্বাস করে, এটা করার জন্য ইসরাইলকে গুরুত্বপূর্ণভাবে ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের মতপার্থক্যের জন্য বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেও মাঝে মাঝে বিভেদ দেখা দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৬ সালে ইসরাইল পলিসি ফোরাম, আমেরিকানস ফর পিস নাউ, জুইশ ভয়েস ফর পিস এবং জুইশ অ্যালায়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস প্রকাশ্যে কংগ্রেসের একটা প্রস্তাবের (এইচআর ৪৬৮১) বিরোধিতা করে যার স্পন্সর করে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি – ওই প্রস্তাবটা ছিল প্যালেস্টাইনকে সাহায্য দেয়ার ওপর ইসরাইল যা চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সংক্রান্ত। সংশোধিত আকারের ওই প্রস্তাবটা অবশ্য সুবিধাজনক ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। কিন্তু ওই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইসরাইল সমর্থক গ্রুপগুলো একক দলের ধারায় কেন্দ্রীভূত একক স্তম্ভ হিসেবে গঠিত নয়। এতদসত্ত্বেও মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের সংগঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষ করে তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ গ্রুপগুলো ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের অনুসৃত নীতিকে উপেক্ষা করে ওই রাষ্ট্রের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূল সমর্থনের ব্যাপারে অটল থাকে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির একজন মুখপাত্র ২০০০ সালের জুন মাসে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, চীনের কাছে ইসরাইলের অস্ত্র বিক্রি সম্পর্কে সৃষ্ট উদ্বেগের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হ্রাসের আহবান জানানো হয়। ওই সময় ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই ইসরাইলের সহায়তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছু সংশ্লিষ্ট করার বিরোধিতা করি। কারণ একবার এরকম শুরু হলে তা কখনো থামবে না।’ এমনকি আমেরিকানস ফর পিস নাউ গ্রুপও ‘ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা’কে সমর্থন করে এবং মার্কিন সহায়তা ‘হ্রাস বা শর্তযুক্ত’ করারও বিরোধিতা করে। তাদের শুধু একটাই দাবি ছিল, আর তা হলো, মার্কিন সহায়তার অর্থ দিয়ে অধিকৃত অঞ্চলে পুনর্বাসন কাজের জন্য যেন তা ব্যবহার করা না হয়। একইভাবে মধ্যপন্থী ইসরাইল পলিসি ফোরাম ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাকে অধিক শর্তযুক্ত করা সমর্থন করে না। বরং দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি বাস্তবায়নে অধিক সক্রিয় ও কার্যকরভাবে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্ররোচিত করার প্রচেষ্টাকে তারা বেশি গুরুত্ব দেয়। শান্তি প্রয়াস ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সংক্ষেপে বলা যায়, ইসরাইল সমর্থক প্রায় প্রত্যেকটা গ্রুপ ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বজায় রাখতে চায়। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো জুইশ ভয়েস ফর পিস গ্রুপ। পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুসালেমে দখল না থামানো পর্যন্ত ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার জন্য ওই গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহবান জানায়। এ অবস্থায় বস্তুত কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, জুইশ ভয়েস ফর পিস আদৌ লবির অংশ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে সর্বাধিক করার প্রয়াসে ইসরাইলি কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে মার্কিন ইহুদি নেতৃবৃন্দকে নিয়োজিত করে এবং নির্দিষ্ট কোনো ইসরাইলি নীতির পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে সহায়তা করার জন্য তাদের প্রতি আহবান জানায়। কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের সাবেক চেয়ারম্যান রাবিব আলেকজান্ডার সিন্ডলার ১৯৭৬ সালে ইসরাইলের একটা ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস এবং এর সদস্যরা ইসরাইলি নীতির সরকারি যন্ত্র হয়ে আছে। দেখা যায় যে, আমাদের কাজ হলো সরকারের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করা এবং ইহুদি সম্প্রদায়কে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা উপেক্ষা করেই আমরা আমাদের সাধ্যমতো কাজ করি। (এ অবস্থা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে সিন্ডলার মনে করেন। সাক্ষাৎকারীকে তিনি বলেন যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের অন্য কেউ ব্যবহার করুক এটা তারা দেখতে চায় না’)। একই ধরনের কথা বলেন ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কমিটির আলবার্ট চেরলিন। তিনি ১৯৭০ সালে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমরা নীতি তৈরি করি, কিন্তু ইসরাইলের বিষয়ে আমাদেরকে নীতি দেয়া হয়… বাস্তবে, কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস হলো সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে ইসরাইল তার নীতি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করে।’ ফরোয়ার্ড পত্রিকার ওরি নির একটা প্রধান ইহুদি সংগঠনের একজন কর্মীর (নাম উল্লেখ না করে) উদ্ধৃতি দেন। ২০০৫ সালে ওই কর্মী দাবি করেন যে, ‘নিয়মমাফিকভাবে আমরা বলি, নির্দিষ্ট বিষয়ে এটাই আমাদের নীতি। কিন্তু ইসরাইলিরা কি চিন্তা করছে তা আমাদের খোঁজ করতে হয়। সম্প্রদায় হিসেবে আমরা এ কাজ সব সময় করি।’ আমেরিকান জুইশ কমিটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হাইমান বুকবাইন্ডার একবার স্বীকার করেন, ‘মারাত্মক চাপ, সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ বা মৌলিক কিছু না হলে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য ইসরাইল যা বলে তোতা পাখির মতো আপনিও তাই বলুন। মার্কিন ইহুদি হিসেবে আমরা বলে বেড়াই না যে, ইসরাইল তার বিভিন্ন নীতিতে ভুল করছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সমর্থন সঞ্চারিত করার দক্ষতা ইসরাইল বারবার দেখিয়েছে। জাইয়নিস্ট (এবং পরে ইসরাইল) কর্মকর্তারা ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ দেশভাগ পরিকল্পনা এবং ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য প্রচার করতে মার্কিন ইহুদি নেতৃবৃন্দকে উৎসাহিত করে। একই সঙ্গে তারা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী ফোল্ক বার্নাডোটের উদ্ভাবিত ব্যর্থ শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লবিং করতে বলে। এ ধরনের সংঘবদ্ধ প্রয়াসের ফলে ট্রূমান প্রশাসন ১৯৫২ সালে ইসরাইলের জন্য আর্থিক সহায়তা ব্যাপক বৃদ্ধি এবং মিসরকে এক কোটি মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়ার পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দফতরের প্রস্তাব বাতিল করে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিন যুদ্ধের আগে সংকটের সময় ইসরাইল সরকার ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তার দূতকে নির্দেশ পাঠায় ‘জনমত সৃষ্টি করতে, যা (জনসন) প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে… তবে এটা যেন স্পষ্ট না হয় যে, জনমত সৃষ্টির পেছনে আমরা আছি।’ ওই প্রচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহানুভূতিশীল মার্কিনিরা চিঠিপত্র, সম্পাদকীয় লেখে, টেলিগ্রাম পাঠায় ও জনসমক্ষে বিবৃতি দেয় বিভিন্নভাবে। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী এর উদ্দেশ্য ছিল ‘জনসমর্থনের পরিবেশ সৃষ্টি করা… যা প্রশাসনে আমাদের বন্ধুদেরকে শক্তিশালী করবে।’ হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা অবশেষে তাদের ইসরাইলি প্রতিপক্ষদের চিঠি লেখা প্রচারণা বন্ধ করতে অনুরোধ করে। কিন্তু ইসরাইলি দূত জেরুসালেমে রিপোর্ট করে যে, ‘নিশ্চিতভাবে আমরা এটা অব্যাহত রেখেছি।’ ঐতিহাসিক টম সেগেভের মতে, ‘ইসরাইলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ সম্বলিত নাগরিকদের চিঠিপত্রে’ হোয়াইট হাউস ‘প্লাবিত’ হয়ে যায়। ইসরাইলকে সমর্থন করার এমন প্রবণতা আজকাল অনেক কমে এলেও লবির বড় বড় সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় ইসরাইলি নেতাদের সমর্থন করাকে অগ্রাধিকার দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বুশ প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ‘রোড ম্যাপ’ প্রকাশ করার পর কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের ম্যালকম হোয়েনলিন ‘হারেতজ্’-কে বলেন বলে বলা হয় যে, ‘রোড ম্যাপ’ সম্পর্কে ইসরাইল সরকার আপত্তি করলেও তা আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবে। হোয়েনলিন জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের কথা শোনানোর জন্য আমরা ইতস্তত করব না।’ ইসরাইল সরকার ও আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের কিছু গ্রুপের মধ্যে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এ সম্প্রদায় ‘সাধারণভাবে এমন নীতি গ্রহণ করে যে, মৌলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে জনসমক্ষে ইসরাইলের কোনো সমালোচনা করা যাবে না।’ স্টিভেন রোসেনথেলের মতে, ‘আমেরিকার লাখ লাখ ইহুদির কাছে ইসরাইলের সমালোচনা করা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করার চেয়েও অত্যন্ত খারাপ পাপ।’ বুকবাইন্ডার একবার স্বীকার করেন যে, ‘ইসরাইল সরকারকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করবে কিনা ইহুদিদের এমন অপরাধবোধ আছে… এ কারণেই তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একই পথ অবলম্বন করে।’ মার্কিন ইহুদিদের মতামত নিয়ে সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, সাধারণভাবে দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা একমত যে, ‘আরবদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত মতামত থাকলেও মার্কিন ইহুদিদের উচিত যথাযথভাবে নির্বাচিত ইসরাইল সরকারের নীতি সমর্থন করা।’ ইসরাইলের নীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি-আমেরিকান সংগঠনগুলোর নেতা ও সব শ্রেণীর লোকের এমন আন্তরিক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা ইসরাইল সরকারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টির জন্য সাধারণত মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করে না। গত কয়েক দশকে একাধিক ঘটনায় জনসমক্ষে সমালোচনার বিরুদ্ধে একটা সাধারণ নিয়ম স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রগতিশীল একদল মার্কিন ইহুদি ‘ব্রেইরা’ (যার অর্থ বিকল্প) নামে একটা নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ওই সংগঠন ইসরাইল ও বিদেশে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহবান জানায়। তারা অধিকৃত এলাকা থেকে প্রত্যাহার ও প্যালেস্টাইনের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত সংগঠন করতে চায়। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি জনসমক্ষে পরিচিত করার লক্ষ্যে আমেরিকার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়াও অনেক ‘ব্রেইরা’ নেতা মার্কিন ইহুদি প্রতিনিধি দলে যোগ দেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে একদল প্যালেস্টাইন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করে আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি। কিছু সংখ্যক ইহুদি নেতা ‘ব্রেইরা’কে সমর্থন করলেও প্রধান প্রধান ইহুদি সংগঠনের শক্তিশালী সদস্যরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ‘নিয়ার ইস্ট রিপোর্ট’ ইসরাইলের প্রতি সমর্থনকে অবমূল্যায়ন করার জন্য ‘ব্রেইরা’কে অভিযুক্ত করে। রিফর্ম রাবিবনেটের প্রেসিডেন্ট আর্থার লিলাইভেল্ড বলেন যে, ‘ব্রেইরা’র মতো সংগঠনগুলো ‘তাদেরকে সহায়তা ও স্বস্তি দেয় যারা ইসরাইলকে সহায়তা কমিয়ে দেয় এবং হত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের সামনে ইসরাইলকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে দেয়।’ হাডাসার এক নিউজলেটার-এ ‘ব্রেইরা’ সদস্যদের ‘পরাজিত মনোভাবের উৎফুল্ল নেতা’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং নিজেদের সদস্যদের এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, তারা যেন ‘ওই ধরনের সংগঠন ও তাদের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে যা ইসরাইলের নিরাপত্তা ও ইহুদিদের অস্তিত্বের বিপরীত।’ কনজারভেটিভ রাবিবনিক্যাল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, ‘ব্রেইরা’ হলো ‘পিএলও-এর সম্মুখভাগ।’ অপরদিকে ৪৭ জন রাবিব এক বিবৃতিতে ব্রেইরার অবস্থাকে ‘বাস্তবে আরব দৃষ্টিভঙ্গির মতো’ বলে মন্তব্য করেন। ‘প্রো-সেটেলমেন্ট গ্রুপ আমেরিকানস ফর এ সেফ ইসরাইল’ ৩০ পাতার একটা পুস্তিকা বিতরণ করে। ওই পুস্তিকায় অন্যান্য বামপন্থী শাখার লক্ষ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য ‘ব্রেইরা’ নেতৃবৃন্দকে অপবাদ দেওয়া হয়। তাদের তারা ‘ফাতাহ্র ইহুদি’ বলে আখ্যায়িত করে। জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার ম্যাগাজিন ‘আমেরিকান জাইয়নিস্ট’ স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘ব্রেইরা’কে অভিযুক্ত করে। তারা সতর্ক করে দেয় যে, যেসব ইহুদি জনসমক্ষে ‘অন্যায়’ বলে চিৎকার করে তাদের নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কাজের ফল সম্পর্কে অনুধাবন করা উচিত… তারাই শুধু আলাদা অনুভব করে না, বরং হাজার হাজার মাইল দূরের সহযোগী ইহুদিরাও আলাদা অনুভব করে।’ এসব আক্রমণের মুখে ‘ব্রেইরা’ আলোচনার জন্য খোলামেলা পরিবেশ অনুসরণ বা প্রতিষ্ঠিত করার প্রায় কোনো সুযোগই পায় না। স্থানীয় সম্প্রদায় গ্রুপগুলো ‘ব্রেইরা’ প্রতিনিধিদের বাদ দেয়। আর জুইশ কমিউনিটি কাউন্সিল অব নিউ হ্যাভেন শুধুমাত্র স্থানীয় ‘ব্রেইরা’ চ্যাপ্টারকে প্রবেশাধিকারে সম্মত হয় এই শর্তে যে, তাদের সমালোচনা তারা শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। আমেরিকান জুইশ কমিউনিটি অভ্যন্তরীণভাবে একটা স্মারকপত্র তৈরি করে – এতে ওই গ্রুপকে কো-অপ্ট করার সুপারিশ করা হয়। তবে ওই গ্রুপকে সম্মত হতে হবে যে তারা ‘ইসরাইল ও বিদেশে বসবাসরত ইহুদিদের মধ্যকার স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের ভিন্নমত তারা শুধু ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছেই প্রকাশ করবে এবং সাধারণ জনগণের কাছে আবেদন জানানো থেকে বিরত থাকবে।’ নিয়মিতভাবে তহবিল পেতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং নেতাদের দলত্যাগের কারণে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। পাঁচ বছর পর ‘ব্রেইরা’ ভেঙে যায়। ‘ব্রেইরা’ বিতর্কের পর কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস, সিনাগগ কাউন্সিল অব আমেরিকা, আমেরিকান জুইশ কমিটি ও ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের মতো সংগঠনগুলো দলত্যাগের যথার্থ স্থান নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে গবেষণা বা গণতদন্ত করে। জে. জে. গোল্ডবার্গের মতে, ‘এসব সংগঠন একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় : আমেরিকার ইহুদিদের স্বাধীনভাবে যে কোনো বিষয় আলোচনা করার অধিকার আছে, তবে তা হতে হবে জনসমক্ষের বাইরে বিচক্ষণ ফোরামের মধ্যে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত সিমচা দিনিৎজ ১৯৭৬ সালে ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের সঙ্গে কাজ করে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আচার-আচরণ পরিচালনার কতিপয় মূলনীতির নির্দেশিকা তৈরি করেন। গোল্ডবার্গ উল্লেখ করেন, প্রথম নীতি হলো এই যে, ‘ইসরাইলের নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র ইসরাইল জনগণের।’ দ্বিতীয় নীতি হলো : ‘আমেরিকার ইহুদিরা ইসরাইলের পাশে প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণ করবে, তবে কথার বিতর্ক হবে গোপনে।’ এডওয়ার্ড টিভন্যান লেখেন যে, গত শতকের সত্তর দশকে ‘সারা আমেরিকায় স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের জন্য ইসরাইলের পুরো সমর্থন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।’ ইসরাইলি নীতি সম্পর্কে প্রকাশ্য সমালোচনার বিরুদ্ধে যে নিয়ম ছিল তার অধিকাংশই অটুট থাকে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মর্টন ক্লেইন অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের প্রধান আব্রাহাম ফক্সম্যানের কাছে একটা চিঠি দেন। অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের এক নৈশভোজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস এল. ফ্রেইডম্যানকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ওই চিঠিতে প্রতিবাদ জানানো হয়। তিনি অভিযোগ করেন যে, ফ্রেইডম্যান ‘নিয়মিতভাবে ইসরাইল ও এর প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর নিন্দা করে।’ ক্লেইন অতঃপর ওই চিঠি কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের কর্মকর্তাদের কাছে বিলি করেন। যার ফলে ফক্সম্যান তাকে ‘থট পুলিশম্যান’ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এ বিরোধ আরো গভীর হয় যখন নেতানিয়াহুর কমিউনিকেশন পরিচালক এর গভীরতা অনুধাবন করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, ‘জাইয়নিস্টের মতো মনে হয় এমন কোনো সংস্থায়’ ফ্রেইডম্যানকে মঞ্চে কথা বলতে দেওয়া উচিত নয়। ইসরাইলের কোনো কোনো নীতির সমালোচনা করলেও ফ্রেইডম্যান প্রায় মোটেও ইসরাইলবিরোধী ছিলেন না। আর ফক্সম্যান নিজে ছিলেন ইসরাইলের অতি অত্যুৎসাহী একজন সমর্থনকারী। কিন্তু ক্লেইনের জবাব থেকে দেখা যায়, খোলামেলা আলোচনার বিরোধিতা কতটা গভীর হতে পারে। এর কয়েক বছর পর ওয়ার্লড জুইশ কংগ্রেসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এডগার ব্রন্ফম্যান সিনিয়রকে ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। কারণ তিনি প্রেসিডেন্ট বুশকে অনুরোধ জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন যে, বিতর্কিত ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী’ নির্মাণ কাজে বাধা দিতে তিনি যেন ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। কংগ্রেসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আইসি লাইয়েবলার ঘোষণা করেন যে, ‘ইসরাইল সরকারের অনুসৃত নীতি প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে লবিং করা ওয়ার্লড জুইশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের জন্য যে কোনো সময় একটা নোংরা কাজ।’ দু’বছর পর লাইয়েবলার এবং অন্যরা একইভাবে বুঝতে পারেন যে, মধ্যপন্থী ইসরাইল পলিসি ফোরামের প্রেসিডেন্ট সিমোর রিচ ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিজা রাইসকে গাজা স্ট্রিপ পার হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য ইসরাইলকে চাপ দেওয়ার পরামর্শ দেন। রাইসের কাছে রিচের পরামর্শ ছিল যৌক্তিক এবং সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু লাইয়েবলার তার ওই কাজকে ‘দায়িত্বহীন আচরণ’ বলে দোষারোপ করেন। অপরদিকে অর্থোডক্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন স্যাভিৎজকি বলেন যে, এটা ‘ইসরাইল সরকারের প্রতি শুধু অসম্মানজনক নয়, বরং এমন উদ্যোগকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানকারী লাখ লাখ মার্কিন ইহুদির প্রতি আক্রমণাত্মক।’ লাইয়েবলার আরো সতর্ক করে দেন যে, ‘বিশ্বজুড়ে বসবাসকারী ইহুদিদের প্রধান ধারার নেতৃবৃন্দ যখন মনে করেন যে তারা ইসরাইলের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নিরাপত্তা নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে লবি করতে পারেন তখন তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে কিছুটা খারাপ পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে। এ ধরনের আচরণ যদি সহ্য করা হয় তাহলে আমরা অবশিষ্ট একটা মিত্রকেও বাদ দিতে পারি – আর ওই মিত্র হলো বিদেশে বসবাসরত ইহুদি।’ এসব আক্রমণের কাছে নীতি স্বীকার করে রিচ বলেন যে, ‘চাপ শব্দটা আমার শব্দতালিকায় নেই যখন তা ইসরাইলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।’ ইসরাইলের নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার অনীহা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। ইসরাইলের শত্রুদের সহায়তা করতে পারে এমন কোনো কথা বলা থেকে বিরত থাকার স্পষ্ট আগ্রহ ছাড়াও যে সব গ্রুপ বা ব্যক্তি ইসরাইলের নীতি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করে তাদের পক্ষে সমর্থন বজায় রাখা ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তহবিল জোগাড় করা খুবই কষ্টকর। বড় বড় প্রধান ধারার সংগঠন দ্বারা তাদের সমাজচ্যুত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। আমেরিকানস ফর পিস নাও, টিককুন কমিউনিটি, ইসরাইল পলিসি ফোরাম এবং নিউ ইসরাইল ফান্ডের মতো গ্রুপ টিকে আছে এবং তা প্রসারিত হলেও ‘ব্রেইরা’ টিকে থাকতে পারেনি। অন্যান্য প্রগতিশীল ইহুদি গ্রুপ, যেমন নিউ জুইশ এজেন্ডা ‘ব্রেইরা’র মতো বিরোধিতার সম্মুখীন হয় এবং মাত্র এক দশকের সামান্য বেশি সময় টিকে থাকে। একইভাবে, আমেরিকানস ফর পিস নাউ বিবাদপূর্ণ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৯৩ সালে কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসে অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রগ্রেসিভ মেরেত্জ ইউএসএ এবং রিকনস্ট্রাকসনিস্ট রাবিবনিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ওই কনফারেন্সের অভ্যন্তরের মধ্যপন্থী গ্রুপের সমর্থন পাওয়ার পরও ২০০২ সালে এর সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করা হয়। একইভাবে সানফ্রানসিসকো এলাকায় ইহুদি সম্প্রদায়ের একটা প্রধান অনুষ্ঠানে জুইশ ভয়েস ফর পিসকে স্থান দিতে অস্বীকার করা হয়। এ গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা পর্যাপ্তভাবে ইসরাইল সমর্থক নয়। টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে হিল্লেল চ্যাপ্টারও জুইশ স্টুডেন্টস ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটসকে একটা স্টাডি গ্রুপ পরিচালনার জন্য স্থান দিতে অস্বীকার করে। ভিন্নমত পোষণকারী ইহুদি কণ্ঠকে কোণঠাসা করার প্রয়াস এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্ট নীরবতা ভঙ্গ করে ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরব হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলে অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাজের সমালোচনাকারী সাবেক ইসরাইল সৈনিকদের সংগঠন, জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করে এবং দাবি করে যে, তাদেরকে ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন থেকে বহিষ্কার করা হোক। ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন হলো ইসরাইল সমর্থকগোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক, যার মধ্যে আছে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ও অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ। জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার ক্লেইনের মতে, ‘ইসরাইলের সমালোচনাকারী গ্রুপগুলোকে স্পন্সর করা ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের মিশন নয়।’ ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্টের পরিচালক জোর দিয়ে বলেন যে, এ গ্রুপের ‘ইসরাইলের প্রতি ভালোবাসা’ আছে। অন্যান্য গ্রুপও তাদের সমর্থন করে। তবু ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের স্টিয়ারিং কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার দাবি বাতিল করে দেয়। হতাশ না হয়ে ক্লেইন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদেরকে দোষারোপ করে বলেন, ‘তাদের মিশনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে যুদ্ধের উদ্দীপনা। তবু আমরা বিস্মিত যে, ইসরাইলি কর্তৃক ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই উদ্দীপনাকে তারা উপেক্ষা করছে।’ জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা একটা প্রেস রিলিজ ইস্যু করে – এতে ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের সদস্য সংগঠনগুলোকে তাদের ভোট পরিবর্তনের আহবান জানানো হয়। ওই প্রেস রিলিজে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা রিপোর্টের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, যাতে বলা হয়, ‘এসব সংগঠনকে সহায়তা, এমনকি স্পন্সর করার জন্য ইহুদি সম্প্রদায়ের আগ্রহ দুঃখজনক… ইসরাইলের ভাবমূর্তির ওপর তাদের নেতিবাচক ফলাফলকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন স্টিয়ারিং কমিটির অন্তত একটা অর্থোডক্স গ্রুপ এরপর ঘোষণা করে যে, এটা এখন ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্টসকে অপসারণের পক্ষে। লবি ডানদিকে ঝুঁকে পড়েছে অধিকাংশ আমেরিকান ইহুদি অনেকদিন থেকেই উদার দৃষ্টিভঙ্গী ও গণতান্ত্রিক দলকে সমর্থন করেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সংকট নিরসনে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’কে সমর্থন করে। তবু লবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপগুলো সময়ের ব্যবধানে ক্রমাগতভাবে রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আছে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ও কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস। এসব গ্রুপ এখন পরিচালিত হচ্ছে কট্টরপন্থীদের দ্বারা – তারা ইসরাইলে বৈদেশিক নীতিতে বল প্রয়োগে বিশ্বাসী তাদের প্রতিপক্ষদের অবস্থানকে সমর্থন করে। জে. জে. গোল্ডবার্গ তার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘জুইশ পাওয়ার, দি সিক্স ডে ওয়ার অ্যান্ড ইটস আফটারম্যাথ’-এ বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় ‘নতুন ইহুদি’দের একটা গ্রুপকে লক্ষ্যণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। ওইসব ‘নতুন ইহুদি’ অসামঞ্জস্যভাবে এসেছে কট্টরপন্থী জাইয়নিস্ট, অর্থোডক্স ও নয়া-রক্ষণশীল গোষ্ঠী থেকে। ‘তাদের বিরোধিতা এমন জোরালো ও তাদের ক্রোধ এমন গভীর যে’ তিনি লেখেন, ‘ইহুদি সম্প্রদায়ের অবশিষ্টরা সম্ভ্রমের সঙ্গে পেছনে থাকে এবং নতুন ইহুদিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে দেয়। সংখ্যালঘিষ্টদের সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা ইহুদি রাজনীতির প্রভাবশালী কণ্ঠ হয়ে ওঠে।’ এ ধারা আরো শক্তিশালী হয় ১৯৭৪ সালের জ্যাকসন-বণিক সংশোধনের পক্ষে প্রচারের মাধ্যমে – ওই সংশোধনের ফলে সোভিয়েট ইউনিয়নের জন্য অত্যন্ত অনুকূল রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মর্যাদার সঙ্গে ব্যাপকহারে ইহুদি দেশান্তর অনুমোদনে মস্কোর আগ্রহ সংশ্লিষ্ট হয়। ওই ধারা জোরদার হওয়ার সঙ্গে আরো যুক্ত হয় তথাকথিত নতুন রক্ষণশীল আন্দোলনের শুরু ও অগ্রগতি এবং ইসরাইলের লেবার পার্টির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সময়কালে ইসরাইল সমর্থক সংগঠনগুলোর কট্টরপন্থীদের সমর্থন আদায় ও জোরদার করতে লিকুড পার্টির সফল প্রয়াস। গোল্ডবার্গের মতে, ‘শামিরের কৌশল দক্ষতা ছিল ইহুদি প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সুবিধাজনকভাবে কাজে লাগানো, যেন কোনো পক্ষ অবলম্বন ছাড়াই তারা সরকারের অর্ধেক অংশীদার লিকুড পার্টির কণ্ঠ হয়ে ওঠে।’ লিকুড পার্টির কর্মকর্তারা (প্রধানমন্ত্রী শামিরের চিফ অব স্টাফ ইয়োসি বেন-আহরণসহ) এটা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যে, কনফারেন্স অব প্রেসিডন্টসের চেয়ারম্যান হবেন রক্ষণশীল কর্মকর্তারা। তারা ১৯৮৬ সালে কনফারেন্সের নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে ম্যালকম হোসেন লিনকে মনোনীত করার কাজে সহায়তা করে। ইসরাইলী নেতারা অনেক কট্টরপন্থী গ্রুপকে অধিক মাত্রায় গ্রহণ ও তাদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। এর ফলে এ ধারণা জোরদার হয়, তারাই হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বমূলক কণ্ঠ। লেবার পার্টি নেতার উপদেষ্টা হিসেবে শিমন পেরেজ পরে স্বীকার করেন, ‘আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের উপেক্ষা করে আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম… শামিরের লোকেরা যা করতে চেয়েছিল আমরা তাদের তা করতে দিয়েছিলাম।’ লবির কিছু কিছু প্রধান সংস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা থেকে ডানপন্থী ধারার প্রতিফলন ঘটে। এছাড়া কিছুসংখ্যক সম্পদশালী রক্ষণশীল লোকদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকেও তা দৃশ্যমান হয়, যারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো সংগঠনে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসে পঞ্চাশটার বেশি সংগঠনের প্রতিনিধি আছে এবং ছোট-বড় নির্বিশেষে প্রত্যেক সংগঠনের একটা করে ভোট আছে। মাইকেল ম্যাসিং উল্লেখ করেন, ‘কনফারেন্সে ছোট ছোট রক্ষণশীল গ্রুপ নিশ্চিতভাবে বড় উদার গ্রুপের চেয়ে সংখ্যায় বেশি এবং এ কারণে তারা তাদের (উদার গ্রুপ) প্রভাবকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। এর ফলে ম্যালকম হোয়েনলিনের (নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান) হাতে ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। হোয়েনলিন দীর্ঘকাল ধরে ইসরাইলের সেটলার আন্দোলনের সমর্থক এবং তিনি অসলো শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। একইভাবে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের সদস্য পদের ভিত্তি হলো প্রত্যেক ডাইরেক্টরের আর্থিক অনুদান, ম্যাসিং বলেন যে, ‘আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য হিসেবে কতোটা ভালোভাবে কাজ করেন তার ওপর ভিত্তিশীল নয়।’ যেসব ব্যক্তি আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে (এবং সহানুভূতিশীল রাজনীতিকদের) বেশি অংকের অর্থ অনুদান দিতে আগ্রহী হয় তাদের ইসরাইলের উৎসাহী রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য করার ধারা বিদ্যমান আছে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব (সাধারণত এ সংগঠনের সাবেক প্রেসিডেন্ট) অধিকাংশ ইহুদি আমেরিকানদের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে অধিকতর বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি যদিও ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অসলো শান্তি প্রক্রিয়াকে অনুমোদন করে তবু একে কার্যকর করতে কাজ করে খুব কম এবং ১৯৯৯ সালে এহুদ বারাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ধারনাকে অনুমোদন না করেই এর বিরোধিতাকে বাদ দেয়। বস্তত, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং অন্যান্য কট্টরপন্থী গ্রুপ ইসরাইল সরকার সমর্থন না করলেও অধিক চরম অবস্থাকে মাঝে মাঝে সমর্থন করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৪ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে অধিক বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা ফরেন এইড বিল সংশোধনে সফলভাবে লবিং করে – সংশোধিত আইনে প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর অতিরিক্ত বাধানিষেধ আরোপ করা হয়। ক্লিনটন প্রশাসন এবং ইসরাইলে রবিন সরকার অবশ্য ওই ব্যবস্থার বিরোধিতা করে। কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস কখনো অসলো শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি, আর আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ১৯৯৫ সালের জেরুজালেম এমব্যাসি অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগে সহায়তা করে – এর স্পষ্ট প্রয়াস ছিল তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। বস্তুত, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির অভ্যন্তরীণ সার্কেলের প্রধান দাতারা নির্বাহী পরিচালক টুম ডাইনকে বহিষ্কার করে। কারণ, তার দৃষ্টিভঙ্গীতে পররাষ্ট্র বিষয়ে বলপ্রয়োগের বিষয়টা যথেষ্ট ছিল না এবং তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় স্বাধীন। লবির মধ্যকার প্রধান সংগঠনগুলো পরিচালনা ও প্রভাবিত করার চরম দৃষ্টিভঙ্গির লোকদের এ ধরনের প্রবণতা ছাড়াও আর একটা উপাদান এই যে, ইসরাইল সমর্থক অনেক গোষ্ঠী ডান চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর লক্ষ্য হলো, চাঁদার প্রবাহ অব্যাহত রাখা। ওয়াক্সম্যান বলেন, ‘অনেক আমেরিকান জুইশ সংগঠনের পক্ষে এখন তাদের নিজের অস্তিত্বের বৈধতার জন্য ইসরাইলকে প্রয়োজন। ইসরাইলের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ওইসব সংগঠন গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখন তাদের অব্যাহতভাবে টিকে থাকার জন্য ইসরাইল হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যক।’ ইসরাইলকে অবরুদ্ধ ও সমালোচনার যোগ্য গণ্য করে অব্যাহত বা ক্রমাগতভাবে সেমিটিক বিরোধী বলে বেশি করে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তারা সম্ভাব্য সমর্থকদের গভীরভাবে উদ্বিগ্নের মধ্যে রাখে এবং এভাবে ওইসব সংগঠন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিশ্চিত করে। উত্তর আমেরিকার জুইশ এডুকেশন সার্ভিসের জোনাথন উচার ১৯৯২ সালে লেখেন : ‘আমরা আমেরিকায় একেবারে নতুন এক শিল্পের উত্থান লক্ষ্য করেছি, আর তা হলো বিভিন্ন সংগঠন, যার কাজ হলো মনিটরিং এবং সারাবিশ্বে সেমিটিক বিরোধী যুদ্ধের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা… এ ব্যাপারে সাইমন ওয়াইসেনদাল সেন্টারের সাফল্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ইহুদি নিরাপত্তার জন্য তা হুমকিস্বরূপ সেমিটিক বিরোধীর খোঁজে তা অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের চেয়ে বেশি সরাসরি ফান্ড সংগ্রহের প্রধান সংগঠন হয়ে ওঠে। সেমিটিক বিরোধী যুদ্ধে কে বেশি ‘কঠোর’ তা সংগঠনগুলোর মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর সেমিটিক বিরোধী ওই যুদ্ধ চালানো হয় ইহুদি সংবাদপত্রে এবং সরাসরি মেইল করে আবেদনের মাধ্যমে।’ এর তিন বছর পর নিউইয়র্ক টাইমসের টমাস এল ফ্রেডম্যান মন্তব্য করেন, ‘মি. রবিন ও মি. আরাফাত করমর্দন করার দিন থেকে আমেরিকান জুইশ গ্রুপের প্রধান ধারার গ্রুপগুলো তাদের সাদামাটাভাবে গ্রহণ করে। এরমধ্যে আছে কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস। অন্যসব গোঁড়া ও শাখা ইহুদি গ্রুপগুলো সরাসরি এর বিরোধিতা করে। মনে হয় এসব সংগঠন তখনই কেবল সক্রিয় হয়ে ওঠে যখন তারা কোনো শত্রু বা লড়াই করার জন্য কাউকে পায়।’ এসব ঘটনা থেকে বার বার স্পষ্ট হয় যে, আমেরিকান জুইশ কমিউনিটির বেশ কয়েকটা গ্রুপ ইসরাইলের কিছু কিছু নীতি, বিশেষ করে অধিকৃত এলাকায় এর অব্যাহত অবস্থানের সমালোচনা করে। এর মধ্যে কিছু কিছু সংগঠন, যেমন ইসরাইল পলিসি ফোরাম শান্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। সাম্প্রতিককালে তারা আইন পরিষদে কিছু ছোট-খাটো বিষয়ে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। তবু এসব গ্রুপের আর্থিক সম্পদ নেই এবং আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ, জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা বা কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের মতো প্রভাব নেই। ওইসব গ্রুপের ডান-ঘেঁষা মধ্যপন্থী মতামতকে দুঃখজনকভাবে রাজনীতিক ও নীতি-নির্ধারকরা এবং আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের প্রতিনিধিত্বমূলক কণ্ঠ বলে মিডিয়া গ্রহণ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে লবির প্রধান সংগঠনগুলো অনেক লোকের সঙ্গে অসম নীতিগত অবস্থানকে সমর্থন করে, তারা দাবি করে, ওইসব লোকের জন্যই তারা কথা বলে। নিউ কন বা রক্ষণশীলদের ভূমিকা লবির ডানপন্থার দিকে যাওয়ার প্রবণতা আরো শক্তিশালী হয় নিও কনজারভেটিভ বা নয়া রক্ষণশীলদের উত্থানের পর। সত্তর দশক থেকে আমেরিকার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক জীবনে নয়া রক্ষণশীল আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ওই বিষয়টার দিকে বিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বুশ প্রশাসনের এককভাবে পররাষ্ট্র নীতি এবং বিশেষভাবে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নয়া রক্ষণশীলবাদ একটা রাজনৈতিক আদর্শ- এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে স্পষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখানে শুধু পররাষ্ট্রনীতিই প্রাসঙ্গিক। অধিকাংশ নয়া রক্ষণশীল আমেরিকার কর্তৃত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করে। কখনো কখনো তারা আমেরিকান সাম্রাজ্যের ধারণারও প্রশংসা করে। তারা বিশ্বাস করে যে, গণতন্ত্রের বিস্তারে এবং এমনকি আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতার চেষ্টাকারী সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে অনুৎসাহিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে ব্যবহার করা উচিত। তাদের মতে, গণতন্ত্রের বিস্তার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার পথই হলো দীর্ঘস্থায়ী শান্তির উত্তম পথ। নয়া রক্ষণশীলরা আরো বিশ্বাস করে, আমেরিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এটা নিশ্চিত করে যে অধিকাংশ দেশ ওই পদ্ধতিকে সদয় প্রাধান্য বলে দেখবে এবং মার্কিন নেতৃত্বকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে; তবে শর্ত হলো, তা যদি দৃঢ়সংকল্পের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিষয়ে তারা সন্দেহপ্রবণ বিশেষভাবে জাতিসংঘের ব্যাপারে। এ সংস্থাকে তারা ইসরাইলবিরোধী এবং আমেরিকার স্বাধীনভাবে কাজ করার পক্ষে বাধাস্বরূপ বলে মনে করে। তারা অনেক মিত্রের ব্যাপারেও সতর্ক (বিশেষ করে ইউরোপীয়দের ব্যাপারে- তাদেরকে তারা গণ্য করে আদর্শবাদী-শান্তিবাদী যারা মার্কিনিদের যুদ্ধ বন্ধের কথা বলে স্বাধীনভাবে চলতে চায়)। নয়া রক্ষণশীলদের ‘প্রজেক্ট ফর নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির’ ওয়েবসাইটের উদ্ধৃতি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ‘আমেরিকা ও বিশ্ব উভয়ের জন্য ভালো’। নয়া রক্ষণশীলরা সাধারণভাবে মার্কিন শক্তিকে এককভাবে কার্যকর করার পক্ষপাতী। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নয়া রক্ষণশীলরা বিশ্বাস করে যে বিশ্বকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করার জন্য সামরিক শক্তি একটা অতি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার এবং এতে আমেরিকা লাভবান হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সামরিক শৌর্য প্রদর্শন করে এবং দেখায় যে, সে তার অধীন ক্ষমতা ব্যবহার করতে ইচ্ছুক, তাহলে মিত্ররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব অনুসরণ করবে এবং সম্ভাব্য বিরোধীরা অনুধাবন করবে যে প্রতিরোধ করা অর্থহীন। তখন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সংক্ষেপে, নয়া রক্ষণশীলবাদ হলো বিশেষভাবে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বল প্রয়োগে বিশ্বাসী রাজনৈতিক আদর্শ। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে নয়া রক্ষণশীলরা প্রভাবশালী পদে আসীন হয়। খ্যাতনামা নয়া রক্ষণশীলদের মধ্যে আছে সাবেক ও বর্তমান নীতিনির্ধারক, যেমন ইলিয়ট আব্রামস, কেনেথ এডেলম্যান, উইলিয়াম বেনেট, জন বোল্টন, ডগলাস ফেইথ, পরলোকগত জিনে কির্কপ্যাট্রিক, আই.লিউস ‘স্কুটার’ লিবিব, রিচার্ড বার্লি, পল উলফোইৎজ, জেমস উলসে এবং ডেভিড উর্মসার। সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন পরলোকগত রবার্ট বার্টলে, ডেভিড ব্রুকস, চার্লস ক্রাউথ্যামার, উইলিয়াম ক্রিস্টল, ব্রেট স্টিফেন্স এবং নর্মান পুধোরেৎজ। শিক্ষাবিদদের মধ্যে আছেন ফওয়াদ আজামি, ইলিয়ট কোহেন, আরন ফ্রেইডবার্গ, বার্নার্ড লুইস এবং রুথ ওয়েজউড, থিংক-ট্যাংক পন্ডিতদের মধ্যে আছেন ম্যাক্স বুট, ডেভিড ফ্রাম, রিউয়েল মার্ক জেরেস্ট, রবার্ট কাগান, মাইকেল লেডিন, জশুয়া মুরাভচিক, ডেনিয়েল পাইপস, ডেনিয়েলে প্লেথকা, মাইকেল রুবিন এবং মেয়ারভ উর্মসার। নয়া রক্ষণশীলদের প্রধান সাময়িকী ও সংবাদপত্রের মধ্যে আছে কমেন্টারি, নিউইয়র্ক সান, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ড। এই নয়া রক্ষণশীলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে অনেক থিংক ট্যাঙ্ক ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপ জড়িত আছে। এরা হলো আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইনস্টিটিউট, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, মিডল ইস্ট ফোরাম, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেনচুরি এবং ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি। আসলে নতুন সব রক্ষণশীলই ইসরাইলের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ – এ বিষয়টা তারা খোলাখুলি এবং অপরাধবোধ না করেই প্রকাশ করে এবং গুরুত্ব দেয়। একজন প্রভাবশালী নয়া রক্ষণশীল পন্ডিত ম্যাক্স বুটের মতে, ইসরাইলকে সমর্থন করা হলো ‘নয়া রক্ষণশীলবাদের একটা প্রধান নীতি’। এ অবস্থাকে তিনি মূল্যায়ন করেন ‘অংশীদারিত্বের উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ হিসেবে। বেঞ্জামিন জিনসবার্গ নামে একজন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আমেরিকান রাজনীতি ও সেমিটিক-বিরোধী বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন। তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, নয়া রক্ষণশীলদের ডানপন্থী হওয়ার একটা প্রধান কারণ হলো ‘ইসরাইলের প্রতি তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং ষাটের দশকে একটা গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে থাকার সময় তাদের ক্রমবর্ধমান হতাশা- ওই দল আমেরিকার সামরিক প্রস্তুতির বিরোধিতা এবং তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থের প্রতি ক্রমাগতভাবে অনুরক্ত হয়ে ওঠে।’ জিনসবার্গ নির্দিষ্টভাবে লেখেন যে, তারা রোনাল্ড রিগানের ‘কঠোর কমিউনিজম বিরোধী’ নীতিকে সমর্থন করে। কারণ তারা ওই নীতিকে দেখতে পায় একটা ‘রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে যা ইসরাইলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে।’ নয়া রক্ষণশীলরা ছিল বৈদেশিক নীতিতে বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী এবং এ কারণে এটা বিস্ময়ের কিছু নয় যে, তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরের ডানপন্থীদের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা গড়ে তুলবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আটজন নয়া রক্ষণশীলের একটা গ্রুপ (এর নেতৃত্বে ছিলেন রিচার্ড পার্লে, এ গ্রুপে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন ডগলাস ফেইথ এবং ডেভিড উর্মসার) লিকুড দলের নতুন প্রধানমন্ত্রী রেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য ১৯৯৬ সালে ‘ক্লিন ব্রেক’ অর্থাৎ ‘স্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন’ সম্পর্কিত গবেষণার খসড়া তৈরি করে। ওই গবেষণায় সুপারিশ করা হয় যে, ইসরাইল অসলো শান্তি প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করুক এবং অবন্ধুসুলভ মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক শক্তিসহ সাহসী ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এবং অতঃপর আরব ইসরাইল যুদ্ধে ‘উচ্চতর’ অবস্থান গ্রহণ করুক। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রসারমান অনেক থিংক ট্যাংক, কমিটি ও প্রকাশনার সঙ্গে অনেক নয়া রক্ষণশীল জড়িত। তাদের এজেন্ডার মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের উন্নয়ন করা। রিচার্ড পার্লের কথাই ধরুন। প্রসিদ্ধ নয়া রক্ষণশীলদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো। ডানপন্থী সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইনস্টিটিউট, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, মিডল ইস্ট ফোরাম এবং ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির উপদেষ্টা বোর্ডেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার সহকর্মী নয়া রক্ষণশীলরাও একইভাবে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত : উইলিয়াম ক্রিস্টল হলেন সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ডের সম্পাদক, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির সহপ্রতিষ্ঠাতা। পূর্বে তিনি জড়িত ছিলেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, মিডল ইস্ট ফোরাম এবং আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট চার্লস ক্রাউথামার আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের আরভিং ক্রিস্টল পুরস্কার পান (নয়া রক্ষণশীলবাদের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন উইলিয়ামের পিতার নামে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়)। এছাড়া তিনি ছিলেন প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির পক্ষে অনেক খোলা চিঠির স্বাক্ষরকারী, সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ডের কন্ট্রিবিউটিং সম্পাদক। তিনি ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এর সঙ্গে অতীতে যারা জড়িত ছিলেন এবং বর্তমানে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের নামের তালিকা থেকে এর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এরা হলেন- এলিয়ট আব্রামস (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); উইলিয়াম বেনেট (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); জন বোল্টন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); ডগলাস ফেইথ (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স); ডেভিড ফ্রাম (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, উইকলি স্ট্যান্ডার্ড); রিউইয়েল মার্ক গেরেস্ট (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, উইকলি স্টান্ডার্ড); মাইকেল লেডিন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স); জিন কার্ক প্যাটরিক (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); জসুয়া মুরাভচিক (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); ডেনিয়েল পাইপস (প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, মিডলইস্ট ফোরাম, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); নরম্যান পোধোরেজ (হডসন ইন্সটিটিউট, কমেন্টারি, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); মাইকেল রুবিন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, মিডলইস্ট ফোরাম); পল উলফোইৎজ, (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ারইস্ট পলিসি); ডেভিড উর্মসার (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, মিডলইস্ট ফোরাম, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস) এবং জেমস উলসে (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস)। নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনের মধ্যকার এই পারস্পরিক সংশ্লিষ্টতার সারসংক্ষেপ কোনোভাবেই শেষ হওয়ার নয়। তবে অনেকের কাছে এটা কিছুটা ছায়ামূলক ষড়যন্ত্র বলে মনে হয় (বা অনেকের কাছে মনে হয় এমনকি এটা একটি ডানপন্থী গুপ্ত সমিতি)। এর বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের থিঙ্কট্যাংক, কমিটি, ফাউন্ডেশন ও প্রকাশনা নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখে, যেমনভাবে তা টিকিয়ে রাখে নীতির নেটওয়ার্ক। প্রচারণা থেকে বিরত না থেকে অথবা গুপ্ত কার্যক্রমে জড়িত না থেকে এসব গ্রুপ সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায় জনমত এবং এলিট অংশের মত গঠন করার জন্য। এভাবেই তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি গঠনে অগ্রসর হয়। নয়া রক্ষণশীল নেটওয়ার্ক নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কর সংস্কার, পরিবেশ বা দেশান্তর নীতির মতো এর নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। এটা ঠিক যে, নয়া রক্ষণশীলরা আমেরিকার নিরাপত্তার মতো ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতিও যত্নশীল। তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের নীতির ব্যবস্থাপত্র উভয় দেশকেই লাভবান করবে। যাহোক, আশির দশকে বেশকিছু প্রথাগত রক্ষণশীল দাবি করে যে, নয়া রক্ষণশীলরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরাইলের বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। দৃষ্টান্ত হিসেবে খ্যাতনামা রক্ষণশীল রাজনৈতিক তাত্ত্বিক রাসেল কির্কের কথা বলা যায়। তিনি বলেন, নয়া রক্ষণশীলদেরকে যা উদ্দীপ্ত করে তা হলো ইসরাইলকে রক্ষা করা। সবকিছুর পেছনে এটা বর্তমান থাকে। নয়া রক্ষণশীলরা এ অভিযোগ জোরের সঙ্গে অস্বীকার করে এবং এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল গ্রুপগুলোর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। ওই দ্বন্দ্ব এখন আর নেই, তবে রক্ষণশীল আন্দোলনের মধ্যকার দুই শাখার মধ্যে এখনো উত্তেজনা বিদ্যমান রয়েছে। অনেক ভাষ্যকার নয়া রক্ষণশীলদের ইহুদি উৎসের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যদিও এ আন্দোলনের প্রধান নীতিগুলোর অনেকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায় এখনো উদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত। ‘দি নিওকনজারভেটিভ রেভ্যুলিউশন : জুইশ ইনটেলেকচুয়ালস অ্যান্ড দি শেপিং অব পাবলিক পলিসি’ বইয়ে মুরে ফ্রাইডম্যান নয়া রক্ষণশীলবাদকে ‘আমেরিকান জুইস রক্ষণশীলবাদ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু নয়া রক্ষণশীলদের সবাই ইহুদি নয়। এ থেকে আমাদের মনে হয় যে, ধর্ম বা জাতিগতভাবে লবির ব্যাখ্যা করা হয়নি বরং এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে রাজনৈতিক এজেন্ডা দিয়ে। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব আছেন যারা নয়া রক্ষণশীলবাদের মূল সব নীতি গ্রহণ না করলেও এর অনেকটাই গ্রহণ করেছেন ইসরাইলের জন্য ব্যাপক সমর্থন অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তাদের মধ্যে এর কঠোর নীতি গ্রহণের প্রতি প্রবণতা দেখা যায়। এদের মধ্যে আছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদক রবার্ট বার্টলে, সাবেক শিক্ষাসচিব উইলিয়াম বেনেট, জাতিসংঘে নিয়োজিত সাবেক রাষ্ট্রদূত জন বোল্টন এবং জিনে কার্কপ্যাট্রিক এবং সিআইএ-এর সাবেক পরিচালক জেমস উলসে। নয়া রক্ষণশীল এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার জন্য এসব অ-ইহুদি ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর কেন্দ্রবিন্দুতে যেসব ইহুদি আছে তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এই অর্থে নয়া রক্ষণশীলবাদ হলো ব্যাপক ইসরাইল সমর্থক আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। আমেরিকান ইহুদিরা হলো নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনের মূল, যেমন তারা অধিকাংশ লবির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই অ-ইহুদিরা সক্রিয়। নয়া সংরক্ষণশীলরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব প্রতীকস্বরূপ। কারণ তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অধিকাংশ মার্কিন ইহুদির প্রথাগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইহুদি সমর্থক খ্রিস্টান এ লবির মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অইহুদি গ্রুপ আছে – এরা ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টস অর্থাৎ ইহুদীবাদী খৃষ্টান। এটা হলো ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক চিন্তাধারার খ্রিস্টান ডানপন্থী উপদল। এ গ্রুপের নামকরা সদস্যদের মধ্যে আছেন ধর্মীয় সব ব্যক্তিত্বরা। যেমন পরলোকগত জেরি ফালওয়েল, গেরি বাউয়ের, প্যাট রবার্টসন এবং জন হ্যাগি। এর সদস্যদের মধ্যে আছেন রাজনীতিবিদ, যেমন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা টম ডি’লে ও রিচার্ড আর্মে এবং সিনেটর জেমস ইনহোপে। ইসরাইলের প্রতি সমর্থন তাদের একমাত্র উদ্বেগের বিষয় না হলেও অনেক খ্রিস্টান ধর্মযাজককে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যপটে দেখা যায় এবং তারা ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে সোচ্চার। সম্প্রতি তারা অনেক সংগঠন গড়ে তুলেছেন তাদের অঙ্গীকারকে রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এক অর্থে বলা যায়, আমেরিকান ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভিন্ন ইসরাইল সমর্থক গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ক্রিশ্চিয়ান জাইয়নবাদের উৎস হলো বিধির বিধান ধর্মতত্ত্বে, যার বাইবেলীয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয় উনিশ শতকে, ইংল্যান্ডে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ধর্মযাজক মন্ত্রী লুইস ওয়ে এবং জন লেনসন ডার্বি। বিধির বিধান মতবাদ হলো পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের পুনরাগমন সম্পর্কিত, যেখানে বলা হয়েছে, যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে না আসা পর্যন্ত বিশ্ব দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষ করবে। অনেক খ্রিস্টানের মতো বিধির বিধানে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করত যে, যিশুখ্রিস্টের পুনরায় এ বিশ্বে আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টে। ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে ফিরে যাবে – এটা একটা প্রধান ঘটনা যা একটা পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া, যা যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমনের আগে সংঘটিত হবে। ডার্বি, ওয়ে এবং তাদের অনুসারীদের ধর্মীয় মতবাদ বহু ইংরেজ রাজনীতিককে প্রভাবিত করে। এটাও হতে পারে যে, এভাবেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসস্থল সৃষ্টির ধারণায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ‘বিধির বিধান’ ধর্মতত্ত্ব উনিশ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এজন্য বেশ কয়েকজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সক্রিয় ছিলেন। এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন ধর্মযাজক ডুইট মুডি (শিকাগোর মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা), সিআই স্কোফিল্ড এবং উইলিয়াম ই-ব্লাকস্টোন। সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় বক্তব্য প্রচরিত হয়েছে সত্য ও অসত্যের কাল্পনিক যুগের বিবরণ সংবলিত হাল লিন্ডসের ‘লেট গ্রেট প্ল্যানেট আর্থ’ এবং টিমোথি লা’হায়েসের ‘লেফট বিহাইন্ড’ সিরিজে। এ দুই সিরিজের বিক্রীত সংখ্যা ৫০ মিলিয়নের বেশি বলে জানা যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিধির বিধান আন্দোলন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধকে নেতারা মূল্যায়ন করেন ‘খোদার অলৌকিক ঘটনা’ হিসেবে। আর ওই যুদ্ধের পর বিধির বিধান আন্দোলন রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ইসরাইল কর্তৃক জেরুসালেম ও পশ্চিম তীর দখলকে (লিকুড পার্টির মতো তারা পশ্চিম তীরকে জুডিয়া ও সামারিয়া বলে গণ্য করে) বিধির বিধানের সমর্থনকারীরা ব্যাখ্যা করেন ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন হিসেবে। এসব ‘নিদর্শন’ তাদের এবং অন্যান্য ধর্মযাজককে নতুন করে কাজ শুরু করতে উৎসাহিত করে যে, বাইবেলে বর্ণিত পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সঠিক পথে’ আছে। মেমফিস থিয়োলজিক্যাল সেমিনারির সাবেক প্রেসিডেন্ট টিমোথি ওয়েবারের মতে, ‘ছয় দিনের যুদ্ধের আগে বিধির বিধানের সমর্থনকারীরা ইতিহাসের সাধারণ দর্শকদের আসনে বসে মাটিতে ‘শেষ সময়ের খেলার ব্যাখ্যা করে তৃপ্ত হতো… কিন্তু পশ্চিমতীর ও গাজায় ইসরাইলের অগ্রাভিযানের পর তারা মাঠে নেমে পড়তে শুরু করে এবং নিশ্চিত হয় যে, সব দল লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় কাজে জড়িত হয়ে পড়ে; এর আগে তারা ওইসব কাজে জড়িত ছিল না।’ তাদের ওই প্রয়াস ছিল তথাকথিত খ্রিস্টান অধিকারের ব্যাপক উত্থান (তাদের অনেকে ইসরাইলের জোর সমর্থক ছিল না) এবং তাদের একাজে স্পষ্টভাবে সহায়ক হয় ধর্মযাজকদের আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রাধান্য। এসব বিশ্বাস থাকার পর ডেনিয়েল পাইপসের বিশ্বাস বিস্ময়কর কিছু ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ‘ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ছাড়া আমেরিকার খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা ইহুদি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কৌশলগত সম্পদ হতে পারে।’ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাবেক যোগাযোগ পরিচালক মাইকেল ফ্রেয়ান্ড ২০০৬ সালে লেখেন, ‘খ্রিস্টান জাইওনিস্টদের খোদাকে ধন্যবাদ। এটা পছন্দ করুন বা না করুন, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আমেরিকার খ্রিস্টানদের চেয়ে ইহুদিদের ওপর অনেক কম নির্ভরশীল হবে।’ খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা অনেক সংগঠন গঠন করে, যার ঘোষিত নীতি হলো ইসরাইলের প্রতি সমর্থনকে উৎসাহিত করা। এসব সংগঠনের মধ্যে আছে ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইল (এর প্রতিষ্ঠাতা জন হ্যাপি এটাকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির খ্রিস্টান রূপ বলে মন্তব্য করেন), ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কনফারেন্স ফর ইসরাইল, ইউনিটি কোয়ালিশন ফর ইসরাইল, ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেন্ডস অব ইসরাইল কমিউনিটিজ, খ্রিস্টানস ইসরাইল পাবলিক অ্যাকশন কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান অ্যাম্বাসি জেরুসালেম এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ। খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ অব ক্রিশ্চিয়ানস আন্তর্জাতিক অ্যান্ড জুইসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকাগো ভিত্তিক এ সংগঠনটা পরিচালনা করেন রাবিব ইয়েমিয়েল ইকসটেইল। তার লক্ষ্য হলো ‘ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ইসরাইলের জন্য ব্যাপক সমর্থন গড়ে তোলা।’ ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অব ক্রিশ্চিয়ানস অ্যান্ড জুইস সাবেক ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশনের পরিচালক এবং জিওপি কৌশলবিদ রালফ রিডের সঙ্গে মিলে একটা নতুন গ্রুপ গঠন করে। ওই গ্রুপের নাম ‘স্ট্যান্ড ফর ইসরাইল, এর লক্ষ্য হলো আত্মিক ও রাজনৈতিকভাবে জনগণকে ইসরাইলের পক্ষে উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করা।’ তারা ইসরাইলের পক্ষে বছরে একবার ‘প্রার্থনা ও সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস’ পালন করে। সক্রিয় আন্দোলনের ওই আধুনিক যুগে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের স্বাভাবিক বিশ্বাস এই যে, তাদের আমেরিকা ও ইসরাইলের ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করতে হবে যারা বসতি আন্দোলনকে সমর্থন এবং দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতির বিরোধিতা করে। ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা হ্যাপির মতে, ‘আমরা ইসরাইলকে সমর্থন করি কারণ সব রাষ্ট্রই মানুষের বিধান দ্বারা সৃষ্ট, কিন্তু ইসরাইল সৃষ্টি হয়েছে খোদার বিধান দ্বারা।’ হ্যাপি তার অনুসারীদের আরো বলেন, ‘খোদা এ ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেন।’ তিনি দাবি করেন যে, অধিকৃত এলাকায় বসতিদের এবং ইসরাইলে নতুন দেশান্তরীদের সহায়তার জন্য তিনি ১২ মিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছেন। হ্যাপির দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিশ্চিয়ান জাইওনবাদের প্রতিনিধিত্বমূলক। এভানজেনিক্যাল রিলিজিয়াস রাউন্ডটেবলের প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘ক্রিশ্চিয়ান রাইট’-এর মধ্যে একজন প্রধান সাংগঠনিক শক্তি পরলোকগত অ্যাডওয়ার্ড ম্যাকাটির একবার ঘোষণা করেন যে, ‘মৃত সাগর, জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার প্রতিটি বালুকণা ইহুদিদের। এর মধ্যে আছে পশ্চিমতীর ও গাজা।’ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান অ্যাম্বাসি জেরুজালেমের পরিচালক ম্যালকম হেডিংয়ের মতে, ‘চার হাজার বছর আগে আব্রাহামের চুক্তির অধীন যে ভূমি খোদা দিয়েছিলেন তা ইসরাইলের এবং আমরা ইসরাইলের অধিকারকে সমর্থন করি … ফিলিস্তিনি বলতে কিছু নেই।’ একইভাবে ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেন্ডস অব ইসরাইলি কমিউনিটিজের প্রতিষ্ঠাতা ট্রেড বেকেট এই সংগঠকের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন যে, এর লক্ষ্য হলো ‘জুডিয়া, সামারিয়া গাজায় বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ, সান্ত্বনা দেওয়া ও সহায়তা করা।’ এ সংগঠনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গির্জার সঙ্গে ইসরাইলে বসতি স্থাপনকারীদের ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গির্জা তাদের সহযোগিতা করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কলোরাডোর আর্ভডায় ফেইথ বাইবেল চ্যাপেল অ্যারিয়েলে পশ্চিমতীর বসতি এলাকা ‘গ্রহণ’ করে এবং সেখানে লাইব্রেরি, হেলথ ক্লিনিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে তারা সাহায্য করে বলে জানা যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টরা সমস্যার দুই-রাষ্ট্র সমাধান নীতির অথবা ফিলিস্তিনিদের কোনোভাবে কোনো এলাকায় সুবিধা দেওয়ার বিরোধিতা করে। ১৯৭৭ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাতের জেরুসালেমে ঐতিহাসিক সফরের প্রাক্কালে ইভানজেলিকাল গ্রুপগুলো প্রধান প্রধান মার্কিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ওইসব বিজ্ঞাপনে তারা ‘ইহুদি আবাসভূমিতে অন্য রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠার যে কোনো প্রচেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।’ ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তিনি (খোদা) তার জনগণকে যে ভূমি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তা বিভক্ত করা যাবে না … ইরেতজ ইসরাইলের যে কোনো অংশে একটা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া সব রাষ্ট্রের জন্য আরো একটা ভুল বলে গণ্য হবে। এ ধরনের গভীর বিশ্বাসের জন্য ক্রিশ্চিয়ান রাইট নেতা প্যাট রবার্টসন বলেন, ২০০৬ সালে জানুয়ারি মাসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন হূদরোগে আক্রান্ত হন স্বর্গীয় প্রতিশোধের জন্য। কারণ তিনি গাজা ভূখন্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রবার্টসনের ভাষায়, তিনি খোদার ভূমি ভাগ করছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য ইসরাইলের যেসব প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের পথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি আমি ধিক্কার জানাই।… খোদা বলেন, ‘এ ভূমি আমার। তুমি বরং তা ত্যাগ কর এককভাবে।’ রবার্টসন পরে অবশ্য তার ওই ‘অনুপযুক্ত ও অনুভূতিহীন’ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এ ঘটনা থেকে অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় যে, কিছু কিছু ক্রিশ্চিয়ান ইভানজেলিক কিভাবে বিশাল ইসরাইলের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করে। একই ধরনের বিশ্বাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিকের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। হাউসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হুইপ (এবং পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা) টম ডেলে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির বার্ষিক নীতি নির্ধারণী সম্মেলনে বলেন, তিনি ফিলিস্তিনিদের ভূমি দেওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জুডিয়া সামারিয়া সফর করেছি এবং গোলান মালভূমির চূড়ায় উঠেছি। আমি অধিকৃত কোনো অঞ্চল দেখিনি, আমি দেখেছিলাম ইসরাইল।’ ডেলের পূর্বসূরি সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা রিচার্ড আর্মে ২০০২ সালের মে মাসে ‘হার্ডবলে’র ক্রিস ম্যাথিউসকে বলেন, ‘পশ্চিমতীরের পুরো এলাকা ইসরাইল দখলে আনায়’ তিনি খুশি এবং ‘ফিলিস্তিনিদের চলে যাওয়া উচিত’ বলে তিনি বিশ্বাস করেন। একইভাবে জেমস ইনহোপ তার সঙ্গীদের এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে সমগ্র প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের অধিকার সম্পর্কে যুক্তি দেখান। তিনি বলেন, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি – কারণ খোদা এমনই বলেছিলেন … এই স্থানে (হেবরন) খোদা আব্রাহামের কাছে আবির্ভূত হন এবং বলেন ‘আমি তোমাকে এই ভূমি দিচ্ছি’ অর্থাৎ পশ্চিমতীর। সম্প্রসারণশীল ইসরাইলের প্রতি ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের সমর্থনের প্রেক্ষাপটে এটা বিস্ময়ের কিছু নয় যে, ‘ইসরাইলের কট্টরপন্থীরা সাধারণ স্বার্থে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী। এটা আরো বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রধান ধারার খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে ইসরাইল কর্তৃক বিভিন্ন এলাকা অধিকার করার ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে। কলিন শিনডলার বলেন, ১৯৭৭ সালের পর বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক অস্তিত্বে আসে যা ইসরাইলি ডানপন্থী ও ক্রিশ্চিয়ান ডানপন্থী আদর্শের উভয়ের পক্ষে অনুকূল হয়।’ মেনাহেম বেগিনের লিকুড সরকারের সময় ইভানজেলিকদের সক্রিয়ভাবে ডেকে আনা হয়, ১৯৭৯ সালে ফলওয়েলকে একটা ব্যক্তিগত জেট দেওয়া হয় এবং ১৯৮০ সালে তাকে ‘অসামান্য অবদানের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ জ্যাবটিনস্কি মেডেল প্রদান করা হয়। তিনিই একমাত্র অইহুদি যিনি এ মেডেল লাভ করেন। এ মেডেল প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যান্য ব্যক্তিত্ব হলেন লেখক লিয়ন উরিস এবং এলি ওয়াইজেল। ১৯৮১ সালে ইসরাইল ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা নিক্ষেপের পর বেগিন প্রেসিডেন্ট রিগানের সঙ্গে দেখা করার আগে ফলওয়েলের সঙ্গে দেখা করেন বলে জানা যায়। তিনি তাকে ‘আমার জন্যে কাজ করার’ অনুরোধ করেন এবং ইসরাইলের কাজকে আমেরিকার জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৬ সালে এক দল ইভানজেলিক নেতাকে ইসরাইলে নিয়ে আসেন ইসরাইল ক্রিস্টিয়ান অ্যাডভোকেসি কাউন্সিলের উদ্যোগে। প্যাট রবার্টসন এবং এহুদ ওলমার্ট (ওই সময় জেরুসালেমের মেয়র) যৌথভাবে ২০০২ সালে জেরুসালেম প্রচার অভিযান প্রার্থনার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ইসরাইল সরকার খ্রিস্টান সফরকারী দলকে ইসরাইল সফর করার জন্যে উৎসাহিত করে। এর ফলে একদিকে পর্যটন খাতে আয় হয়, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মযাজকদের সমর্থন আরো জোরদার হয়। এভাবে ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিস্টিয়ান এমব্যাসি জেরুসালেমের বার্ষিক ভোজসভায় (ইসরাইলে আয়োজিত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশ বলে কথিত) বলেন যে, ‘আমাদের প্রয়োজন আপনাদের এবং আপনাদের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন… আমি আপনাদের একটা কথা বলছি যা আপনারা মনে করে দেশে নিয়ে যাবেন : আপনাদের মতো আরো লোককে ইসরাইল সফরে পাঠান। শ্যারনের উত্তরসূরি এহুদ ওলমার্ট যখন জেরুসালেমের মেয়র ছিলেন তখন তিনি এক সমাবেশে একই ধরনের বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাদের সৈন্যবাহিনী, আমাদের শক্তি ও আমাদের প্রতিরক্ষার অংশ।’ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ইস্যুতেও ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের সময় ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইল ওয়াশিংটনে ইসরাইল সমর্থকদের এক সভার আয়োজন করে। ওই সময়টাকে সতর্ক করে দেওয়ার উপযুক্ত মনে করেন জেরি ফলওয়েল। তিনি বলেন, ‘আমরা সীমান্ত ছাড়াই একটা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আছি’ যা ‘ভবিষ্যতের সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার যুদ্ধ এবং যীশুখ্রিস্টের মহান প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাবনা বা অগ্রদূত হিসেবে গণ্য হবে।’ বিখ্যাত লেখক জন হ্যাসি ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে লেখেন যে, ‘ইসরাইলের জন্যে একমাত্র যৌক্তিক বিকল্প হলো’ ইরানের ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারমাণবিক আঘাত হানা। জন হ্যাসি ২০০৬ সালে তার ‘জেরুসালেম কাউন্টডাউন’ বইয়ে সতর্ক করে দেন যে, ‘ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সংঘাত একটা নিশ্চিত বিষয়। ইজেকিয়েল ৩৮-৩৯ যুদ্ধ বই প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে যেতে পারে।’ হ্যাগি পক্ষপাতমূলক ইরাক গবেষণা গ্রুপের রিপোর্টকে (২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত) সমালোচনা করেন। ওই রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি বলেন যে, জেমস বেকার ‘আরো একবার ইসরাইলের পিঠে ছুরি মারছে’। তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘আমার পিতার প্রজন্ম … এ সময়ের মধ্যে ইরানের ওপর বোমা নিক্ষেপ করত।’ অনেক ইহুদি আমেরিকান সংগঠন ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের সঙ্গে ঐক্যকে স্বাগত জানায় একটা দীর্ঘায়িত উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও যে, এসব গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চিয়ান এজেন্ডা কার্যকর করতে এবং ইহুদিদের খ্রিস্টান বানাতে চায়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ইভানজিলিক্যাল আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করার জন্যে নিজস্ব একটা লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠিত করেছে। জাইওনিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার মতো লিকুদ সমর্থক সংগঠনগুলো ফলওয়েলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং ক্রিশ্চিয়ান ইভানজিলিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। তারা ‘কমেনটারির’ পাতায় আরভিং ক্রিস্টলের সমর্থন লাভ করে। ক্রিস্টল হলো নতুন রক্ষণশীলবাদের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের মধ্যে একজন। অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের সাবেক পরিচালক নাথান পালমোটারের মতে, ‘ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের অভ্যন্তরীণ সব অগ্রাধিকারের সঙ্গে ইহুদিরা বসবাস করতে পারে। এ বিষয়ে উদার ইহুদিরা মৌলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করে, কারণ এসব বিষয় তাদের কাছে ইসরাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ পালমোটারের উত্তরসূরি আব্রাহাম ফক্সম্যান নিয়মিতভাবে ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডার সমালোচনা করেন। তিনিও ওই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন ২০০৭ সালে। তিনি বলেন যে, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ ইভানজিলিকদের সমর্থনকে স্বাগত জানান ‘এমন এক সময় যখন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি মারাত্মক হুমকি ছিল।’ আমেরিকান জুইশ কমিটির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড হ্যারিসের মতে, ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের সঙ্গে সমঝোতা করার ইচ্ছা অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক : ‘সময়ের শেষ আগামীকালও হতে পারে, কিন্তু ইসরাইল এখন ভারসাম্যের দোলায় দুলছে।’ লবির মধ্যে দুটো প্রধান শাখার গভীর বন্ধন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নীতি বিষয়ক সম্মেলনে। উদ্বোধনী নৈশভোজে জন হ্যাসি যে ভাষণ দেন তা উপস্থিত সবাই সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। হ্যাসির প্রতি প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়কর। কারণ সম্প্রতি তিনি লেখেন যে ইহুদিদের ‘আত্মিক জীবন ছাড়া সবকিছুই আছে’ এবং ইহুদিদের (খোদার বিরুদ্ধে) বিদ্রোহের ফল হলো সেমিটিকবাদ-বিরোধিতা এবং খোদা ‘সেমিটিকবিরোধী জাতিগুলোকে ইসরাইল জাতির মধ্যে নিয়ে আসবেন তাদের ধ্বংস করার জন্যে যেন ইসরাইলের ইহুদিরা সামগ্রিকভাবে স্বীকার করে যে, একমাত্র তিনিই প্রভু।’ হ্যাসির বিরক্তিকর বক্তব্য সত্ত্বেও অ্যান্টি ডিফামেশন লীগের ফক্সম্যান ঘোষণা করেন যে, তার জন্যে একটা ভূমিকা আছে … কারণ, ইসরাইলের জন্য তার সমর্থন। ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের এজেন্ডা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর মধ্যপন্থী ইসরাইলি ও ইহুদি মার্কিনিরা তাদের ঐক্যের বিষয়ে গভীরভাবে সতর্ক, ঐতিহাসিক নায়োমি কোহেন বলেন যে, ‘ইসরাইলের প্রয়োজন ছাড়া অধিকাংশ মার্কিন ইহুদি নিউ ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের সঙ্গে যেকোনো লেনদেন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতো। তাদের আশংকা যে, অনেক ইভানজিলিক গ্রুপের এখনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ইহুদিদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা। তাদের চিন্তার বিষয় এই যে, ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের একগুঁয়ে দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সত্যি কষ্টকর। আমেরিকানস ফর পিচ নাউয়ের জো-অ্যান মোর্ট মার্কিন ইহুদি ও ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের মধ্যকার সহযোগিতাকে ‘অসৎ ঐক্য’ বলে মন্তব্য করেন। ইসরাইলের মধ্যপন্থী ইয়োসি আলফার সতর্ক করে দেন যে, অব্যাহতভাবে বসতি স্থাপনের জন্যে খ্রিস্টানদের সমর্থন ‘আমাদেরকে এক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা পুরোপুরি সর্বনাশা।’ সিবিএস নিউজকে তিনি বলেন, ‘এসব লোক থেকে খোদা আমাদের রক্ষা করুন।’ একইভাবে ইসরাইলি-আমেরিকান পন্ডিত ব্যক্তি জারশম গোরেনবার্গ মন্তব্য করেন যে, বিধির বিধান ধর্মীয় মত অনুযায়ী ইহুদিদের জন্যে সুখী নিয়তি দেখা যায় না : শেষ সময়ে ‘ইহুদিরা মরে যায় বা ধর্মান্তরিত হয়।’ বিশেষভাবে তিনি সতর্ক করেন ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের, ‘আসল ইহুদি লোকদের ভালোবেস না। তারা আমাদের ভালোবাসে তাদের নাটক ও কাহিনীর চরিত্র হিসেবে … (এবং) এটা পাঁচ অঙ্কের নাটক- চতুর্থ অঙ্কেই ইহুদিরা অদৃশ্য হয়ে যায়।’ ইসরাইল লবির ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট শাখা ইসরাইলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ইসরাইলে বসতি স্থাপন আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এবং আঞ্চলিক এলাকা ছাড় দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টরা ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করেছে। একইসঙ্গে তারা ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টির বিষয়টি মার্কিন নেতৃবৃন্দের জন্যে কষ্টকর করে তুলেছে। তাদের সমর্থন ছাড়া ইসরাইলে বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা অনেক কম হতো। অধিকৃত অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সরকারও কম বাধার সম্মুখীন হতো। এছাড়া খ্রিস্টানদের সফর বা ভ্রমণ (এর বেশিরভাগই হয় ধর্মযাজকদের উদ্যোগে) হয়ে উঠেছে ইসরাইলের জন্যে এক আকর্ষণীয় আয়ের পথ। এ খাত থেকে ইসরাইল ও তার আশপাশের এলাকা প্রতি বছরে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে বলে জানা যায়। ইসরাইলের পক্ষে এই অ-ইহুদি জোরালো সমর্থন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদানে এমন উৎসাহিত করে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদানে বসবাসকারী ইহুদিদের সুপারিশের চেয়ে বেশি। সম্ভবত ওই সমর্থনের প্রভাব ইহুদি নির্বাচনী এলাকা নয় এমন রাজনীতিকদের এলাকার হিসাব-নিকাশের ওপরও পড়ে। আরভিন অ্যান্ডারসন মনে করেন যে, ‘বিধির বিধান’ অনুসারীদের চিন্তা পুনরায় শক্তিশালী হয় ‘ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থনে মার্কিন সাংস্কৃতিক পূর্ব ধারণা, যার ভিত্তি আংশিকভাবে খ্রিস্টান বাইবেলের প্রভাব।’ ‘বাইবেলের কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হওয়া… অথবা তা পড়ে… ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে জড়ো হওয়া ‘দ্বিতীয় আগমনের সূচনার অংশবিশেষ, এটা বিস্ময়কর নয়, অনেক (যদিও সবাই নয়) আমেরিকান সাধারণভাবে ধারণা করে যে, ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে প্রত্যাবর্তন এবং সেখানে তাদের নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সঠিক ও যথার্থ। তবু খ্রিস্টান জাইয়নিস্টদের প্রভাব বাড়িয়ে বলা ঠিক হবে না। ‘বৃহৎ ইসরাইলে’র জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার এবং এর উপজাত ফলস্বরূপ সমস্যার দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতির বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিডে ক্লিনটন প্রশাসন শেষোক্ত বিষয় (অর্থাৎ দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি) থেকে বিরত ছিল না। এছাড়া ক্লিনটন প্রশাসন পশ্চিম তীরের কিছু কিছু এলাকায় ইসরাইলি সৈন্য পুনরায় মোতায়েন না করার বিধানসহ ১৯৯৮ সালের উইয়ি চুক্তি অকার্যকর করেনি। সম্ভবত আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ক্রিস্টিয়ান রাইটদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ২০০১ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি তার নিজের সমর্থনের ঘোষণা থেকে বিরত করেনি। ইসরাইল লবির অন্যান্য অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে যতোটা প্রভাব বিস্তার করে, ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টরা ততোটা না পারার একাধিক কারণ আছে। প্রেসিডেন্ট বুশের রাজনৈতিক ভিত্তির একটা প্রধান অংশ ক্রিস্টিয়ান রাইট হলেও ওই ঐক্য ইসরাইল সম্পর্কিত বিষয়ের বাইরেও বিস্তৃত। এর মধ্যে যুক্ত আছে অনেক সামাজিক বিষয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে ইসরাইলকে সমর্থন করা একটা এবং এই একটা বিষয়ের সঙ্গেই রবার্টসন, বাউয়ের ও ফলওয়েলের মতো ইভানজিলিকরা সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তাদের সম্পৃক্ততা থাকে। ক্রিস্টিয়ান রাইটের নেতারা প্রায়ই ৪ কোটি অথবা আরো বেশি স্বীকৃত ইভানজিলিক খ্রিস্টানদের পক্ষে কথা বলেন বলে দাবি করেন। কিন্তু এদের মধ্যে ইসরাইল সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেন এমন অনুসারীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে খুবই কম। এছাড়া আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো গ্রুপের বিপরীতে ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টদের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় পর্যালোচনা করার অথবা পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার সাংগঠনিক সামর্থ্য নেই। আশির দশকে রুখ মৌলি এবং ১৯৯৯ সালে আরভিন অ্যান্ডারসন কংগ্রেসীয় জরিপে যে সহায়তা দেন তাতে দেখা যায়, ‘ইসরাইল বিষয়ে ফলওয়েল এবং রিলিজিয়াস রাইটের অন্যান্য বিখ্যাত সদস্যদের কংগ্রেসে ব্যাপক ও সরাসরি লবিং ছিল খুবই কম।’ একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অব ক্রিস্টিয়ানস অ্যান্ড জু উসের প্রতিষ্ঠাতা রাবিব ইয়েসিয়েল ইকসটেইন ইসরাইলি লেখক জেড সাফেটসকে বলেন, ইভানজিলিকদের এক প্রতিনিধি দলকে তিনি ২০০৩ সালে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কন্ডোলিৎসা রাইসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নিয়ে যান। এটাই ছিল ‘একমাত্র ক্রিস্টিয়ান গ্রুপ যা প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের পক্ষে লবিং করে।’ ইকসটেইন কিছুটা বাড়িয়ে বললেও এটা স্পষ্ট যে, ইভানজিলিকদের অনেক উদ্বেগের তালিকার মধ্যে ইসরাইল মাত্র একটা বিষয়। এর বিপরীতে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, অ্যান্টি ডিফামেশন লীগ, জাইয়নিস্ট অর্গনাইজেশন অব আমেরিকা এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের মতো জায়ালিস্ট গ্রুপগুলো ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে তাদের কর্মতালিকার শীর্ষে রেখেছে। পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য তাদের প্রয়াসকে জোরদার করে জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স ও ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির মতো থিংক ট্যাংকগুলো। এছাড়াও খ্রিস্টধর্মে বেশ কিছু জটিল নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা আছে এবং এর গুরুত্বপূর্ণ কার্যধারাগুলোর মধ্যে আছে ইসরাইলকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন বা সমর্থনের জন্য উৎসাহিত না করা। ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টরা বিশ্বাস করতে পারে, সমগ্র প্যালেস্টাইনের ওপর ইহুদি নিয়ন্ত্রণ বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু অন্য খ্রিস্টান নীতি যেমন যিশু খ্রিস্টের নির্দেশ হলো ‘নিজের মতো তোমার প্রতিবেশীকেও ভালোবাসো’, প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি ইসরাইলের আচরণ একেবারে বিপরীতমুখী। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনীর সঙ্গে পরিচিতি এবং অন্যান্য ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও প্রধান ধারার খ্রিস্টান গীর্জাগুলোকে সমস্যা সমাধানের জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি সমর্থন এবং খ্রিস্টান নীতির ওপর ভিত্তিশীল শান্তি ও ন্যায় বিচারের অঙ্গীকার সত্ত্বেও ইসরাইলের বিভিন্ন নীতিকে সমালোচনা করা থেকে তাদের বিরত রাখা যায়নি। ইসরাইল যা করছে তার সব কিছু সব আমেরিকান ইহুদি যেমন সমর্থন করে না - তেমনি অনেক খ্রিস্টান ও ইভানজিলিকও তা সমর্থন করে না। ইসরাইল সমর্থক জুইশ গ্রুপদের মতো ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টদের আর্থিক ক্ষমতা নেই। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তাদের সমর্থনের জন্য মিডিয়ার ভূমিকাও কম। নৈতিক বা ধর্মীয় বিষয়ে কথা বললে রবার্টসন বা বাউয়ের মতো নেতাদের প্রতি মিডিয়া বেশ দৃষ্টি দেয়। কিন্তু ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বা ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি যখন ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে তখন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকেই বেশি দৃষ্টি দেয়। এসব কারণে ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টকে লবির ইহুদি অংশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে করা হয় না। লবির ক্ষমতার উৎস : ইসরাইল লবি এতোটা ফলপ্রসূ কেন? এর একটা কারণ হলো আমেরিকার রাজনৈতিক পদ্ধতির ব্যাপক মুক্ত বৈশিষ্ট্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে বিভাজিত সরকার পদ্ধতি, স্বাধীন মত প্রকাশের সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য, এমন এক পদ্ধতি যেখানে নির্বাচন পরিচালনা খুবই ব্যয়বহুল এবং নির্বাচন প্রচারণার জন্য দেয় চাঁদা নিয়ন্ত্রিত হয় খুবই দুর্বলভাবে। এমন পরিবেশে কোনো নীতিকে প্রভাবিত করার অথবা নিজের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের পথ আছে। স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো তাদের প্রিয় প্রার্থীর প্রচারণার জন্য চাঁদা প্রদান এবং সন্দেহজনক মতাদর্শের প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য চেষ্টা করতে পারে। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি ও নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের কাছে লবিং করতে পারে এবং শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পদে তাদের সমর্থক লোকদের নিয়োগ করাতে পারে। এছাড়াও, জনমত গঠনে স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর সামনে অনেক পথ খোলা থাকে। এরমধ্যে আছে সহানুভূতিশীল সাংবাদিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা; বই, প্রবন্ধ লেখা এবং ভিন্ন মতাবলম্বী কাউকে অসম্মান বা ছোট করার জন্য কাজ করা। যেসব গ্রুপ অত্যন্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং যাদের যথেষ্ট অর্থ আছে তাদের জন্য সরকারি নীতি প্রভাবিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উপায়ের কোনো কমতি নেই। লবির ফলপ্রসূতার মধ্যে প্রতিফলিত হয় বহুদলীয় সমাজে স্বার্থবাদী গ্রুপ রাজনীতির মূল কর্মপদ্ধতি। গণতন্ত্রে আনুপাতিক হারে ক্ষুদ্র গ্রুপও বিশেষ কোনো ইস্যুতে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ওই ইস্যুতে অন্যসব লোক ব্যাপকভাবে উদাসীন থাকলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। এমনকি ওইসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা একেবারে কম হলেও নীতিনির্ধারকরা এবং বিশেষভাবে কংগ্রেস সদস্যরা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়। কারণ তারা নিশ্চিতভাবে জানে, এজন্য অবশিষ্ট জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যাবে না। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটরকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি এবং তার সহকর্মীরা লবির সমর্থিত বিতর্কিত আইন স্বাক্ষর করেছিলেন কেন। তার জবাব ছিল এ রকম : ‘এটা স্বাক্ষর না করলে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা হতো না। আপনি স্বাক্ষর করলে কারো মনে কষ্ট দিতেন না। কিন্তু স্বাক্ষর না করলে আপনি আপনার রাজ্যে কিছু ইহুদিকে হয়তো কষ্ট দিতেন।’ যখন বিরোধী গ্রুপের অস্তিত্ব থাকে না বা থাকলেও দুর্বল থাকে তখন ক্ষুদ্র অথচ দৃশ্যমান স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর অসামঞ্জস্য প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায়। কারণ রাজনীতিকদের একটা গ্রুপের স্বার্থকে মানতে হয় এবং জনগণ শুধু কাহিনীর একটা দিকই হয়তো শুনতে পায়। ইস্যুটা কৃষিতে ভর্তুকি বা পররাষ্ট্রনীতি হোক না কেন, বিশেষ স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই এমনভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে যা জনসংখ্যার চেয়ে তাদের মোট সংখ্যা অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নীতি নির্ধারণে প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতায় ইসরাইল লবি অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করে। আমেরিকার ইহুদিরা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ ও সুশিক্ষিত এবং তাদের আছে এক প্রশংসনীয় লোকহিতকর ঐতিহ্য। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে উদারভাবে সহায়তা করে এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণের হারও খুব বেশি। আমেরিকার ইহুদিদের সংখ্যালঘিষ্ট একটা দল ইসরাইলের বিষয়ে জোরালোভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়। তবে তাদের মধ্যে স্পষ্টভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দল যে কোনোভাবে ইসরাইলের ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট এবং সংখ্যালঘিষ্ট একটা দল ওই ইস্যুতে জোরালোভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, লবির মধ্যে প্রধান ইহুদি সংগঠনগুলোর আকর্ষণীয় সম্পদ ও বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞানের স্তর। রাজনৈতিক বিজ্ঞানী রবার্ট ট্রাইসের মতে, ‘অধিকাংশ প্রধান ইহুদি গ্রুপগুলোর বৈশিষ্ট হলো তাদের অধিক সংখ্যক সদস্য, সুশিক্ষিত পেশাগত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সামাজিক, কল্যাণ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ এবং অভ্যন্তরীণভাবে সুবিস্তৃত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।’ এছাড়া, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহুসংখ্যক সংগঠনের উপস্থিতি থেকে অনুধাবন করা যায়, ‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির বিষয় উত্থাপিত হলে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুত ও সমন্বিতভাবে ইসরাইল সমর্থক আন্দোলন সংগঠনের সামর্থ্য তাদের আছে।’ এসব প্রয়াস আরো সহজতর হয় সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের অনুকূল ভাবমূর্তি থাকার জন্য। সাবেক সিনেটর ওয়ারেন রুডম্যান একবার মন্তব্য করেন, ‘বিক্রি করার মতো তাদের খুবই ভালো পণ্য আছে।’ আমরা দেখতে পাই, লবির নিজস্ব প্রচেষ্টায় ওই ভাবমূর্তির একটা বড় অংশ গড়ে উঠেছে এবং তারা নিশ্চিতভাবে চেষ্টা করে ইসরাইল সম্পর্কে অনুকূল ভাবমূর্তি গড়ে তোলার। ব্যাপক অর্থে অনুকূল ভাবমূর্তির জন্য আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল একই ইহুদি-খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ এবং তারা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত। সবশেষে, এ লবি উপকৃত হয় কার্যকর বিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতির জন্য। একজন সিনেটর বলেন, ‘কোনো ভারসাম্যমূলক অনুভূতি নেই… আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মারাত্মক চাপের বিপরীতে আপনি যদি ভোট দেন, তাহলে কেউ আপনাকে বলবে না যে এটা ভালো কাজ।’ আরব-আমেরিকানরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘিষ্ট জনগোষ্ঠী হলেও তারা ইহুদি আমেরিকানদের মতো তেমন সমৃদ্ধ, সুসংগঠিত, বহুসংখ্যক বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নয়। গ্রুপ হিসেবে আরব-আমেরিকানরা শিক্ষা, ব্যবসা ও মিডিয়ায় উল্লেখযোগ্য পদে পৌঁছাতে সফল হয়নি। রাজনীতিতে তাদের প্রায় দেখাই যায় না। এর আংশিক কারণ হলো এই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরবদের অভিবাসিত হওয়া আনুপাতিকহারে সাম্প্রতিক এবং প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা সম্পদের দিক দিয়ে কম সমৃদ্ধ, গুরুত্বপূর্ণ পেশায় কম প্রতিনিধিত্ব্মূলক এবং মার্কিন রীতি-নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কম পরিচিত। তারা রাজনীতিতে কম সক্রিয় এবং সে কারণে কম প্রভাবশালী। তবে পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। আরব-সমর্থক সংগঠনগুলো ইসরাইল লবির প্রধান প্রধান গ্রুপগুলোর অনুরূপ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরব সমর্থক ও প্যালেস্টাইন সমর্থক কিছু গ্রুপ আছে, তবে তারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং অন্য ইসরাইল সমর্থক গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও দুর্বল। আর্থিকভাবে তারা সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এবং কোথাও তারা কার্যকর নয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ‘নিয়ার ইস্ট রিপোর্টে’র সাবেক সম্পাদক মিটসেল বোর্ডের মতে, ‘শুরু থেকে আরব লবি শুধু নির্বাচনী রাজনীতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি, তারা সাংগঠনিক দিক থেকেও অসুবিধার সম্মুখীন হয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক গ্রুপ আছে, কিন্তু তাদের অনেকগুলোই পরিচালিত হয় একক ব্যক্তির মাধ্যমে। তাদের যেমন আর্থিক সামর্থ নেই, তেমনি জনসমর্থনও নেই।’ মার্কিন রাজনীতিকরা কখনো ‘আরব-আমেরিকান লবি’ থেকে কোনো চাপ প্রয়োগের অভিযোগ করেনি এবং তারা এমন কোনো আচরণ করেনি যা গ্রহণের জন্য সামান্য কারণ থাকে। এ বিষয়ে হ্যারি ট্রুম্যান একটা বিখ্যাত উক্তি করেন তা হলো ‘আমার পুরো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আমি কখনো স্মরণ করতে পারি না যে, সমান সমান নির্বাচনে আরব ভোটে কেউ বিজয়ী হয়েছে।’ তদুপরি, আরব-আমেরিকানরা বিভিন্ন দেশ এবং পরিবেশ থেকে আসে এবং এদের মধ্যে মুসলমান ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তারা একক চিন্তা-চেতনায় কাজ করবে এটা প্রায় অসম্ভব। বস্ত্তত, তারা মাঝে মাঝে একেবারে বিপরীত মত পোষণ করে। অনেক আমেরিকান মনে করে, ইসরাইল ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক নৈকট্য আছে এবং বিশ্বাস করে, ইসরাইলিরা ‘আমাদের মতো’। আরবদের প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা হয় বিদেশি (অথবা এমনকি শত্রু) সভ্যতার অংশ হিসেবে। আমেরিকান ইহুদি বা তাদের খ্রিস্টান মিত্রদের জন্য আমেরিকায় কারো মন জয় করা যতটা সহজ, আরবদের জন্য তা ততটাই কঠিন এবং কষ্টকর যুদ্ধের মতো। রবার্ট ট্রাইস ১৯৮১ সালে আরব-আমেরিকান গ্রুপগুলো সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেন তা এখনো প্রণিধানযোগ্য। তার মূল্যায়ন ছিল : ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব উপেক্ষণীয়।’ তেলের (পরিমিত) প্রভাব : আরব সরকারগুলো অথবা দাম্ভিক ‘তেল লবি’ ইসরাইল লবির মতো এতটা গুরুত্ব বহন করে না। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, তেল কোম্পানিগুলো এবং/অথবা তেলসমৃদ্ধ শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর ব্যাপক ও শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে। এই বিশ্বাসের ব্যাপক প্রতিফলন ঘটে বারবার এ দাবির ক্ষেত্রে যে, ২০০৩ সালে ইরাকে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা ছিল ‘তেলের জন্য যুদ্ধ’ এবং সংশ্লিষ্ট কর্পোরেট স্বার্থ, যেমন হ্যালিবার্টনের জন্য। বিস্ময়ের বিষয়, এই দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত করেন ইসরাইলের কঠোর সমালোচকরা, যেমন নোয়াম চমসকি ও স্টিফেন জোনস এবং অতি সমর্থক, যেমন মার্টিন পেরেৎজ। এই দৃষ্টিভঙ্গির আরো ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য এমন যে, বুশ পরিবার ও সউদের পরিবারের মধ্যকার ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতির বাস্তব রূপ লাভ করে। এ ধরনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ইসরাইল লবি মাত্র একটা নিয়ামক শক্তি এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লবি নয়। এটা কোনো প্রশ্ন নয় যে, পারস্য উপসাগর এলাকার জ্বালানি সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের কৌশলগত স্বার্থ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে তার জ্বালানির অধিকাংশই আমদানি করে কানাডা, মেক্সিকো ও ভেনিজুয়েলা থেকে। তেল ও গ্যাস অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত বিশ্ববাজারে কেনা ও বিক্রি করা হয়। কোনোভাবে এর সার্বিক সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায় এবং মার্কিন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা পারস্য উপসাগরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের স্থান বলে বিবেচনা করে এবং সেখানে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ওই এলাকা থেকে তেলের সরবরাহ কোনো শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিঘ্নিত হওয়াও তারা প্রতিরোধ করে। মূল তথ্য থেকে এ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় যে, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক বিভিন্ন নীতির সঙ্গে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও উপসাগরীয় একাধিক দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের গুরুত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাহকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করে। এর কারণ ছিল একই। ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের পর একই ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে রিগান প্রশাসন ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় (১৯৮০-৮৮) সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের প্রতি সমর্থন দেয়। আবার ১৯৯০ সালে শেখ শাসিত রাজ্য দখল করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েত থেকে ইরাককে উৎখাত করে। ওই এলাকায় কোনো একক শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করার এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এসব নীতিকে উৎসাহিত করার জন্য কোনো শক্তিশালী লবির প্রয়োজন ছিল না। কারণ বন্ধু নয় এমন কারো কর্তৃত্বের বাইরে পারস্য উপসাগরের তেল থাকুক, এ বিষয়ে খুব কম লোকই প্রশ্ন তোলে। যা হোক, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের অধিকার রক্ষার স্পষ্ট স্বার্থের বাইরে খুব সামান্য সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, ব্যাপকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর সমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলোর বা শক্তিশালী ‘তেল লবি’র যথেষ্ট প্রভাব আছে। আরব পেট্রো ডলার বা জ্বালানি কোম্পানিগুলো যদি মার্কিন নীতিকে পরিচালিত করত তাহলে যে কেউই দেখতে পেত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য সে রাতদিন কাজ করছে। সৌদি আরবের মতো দেশ বারবার ওয়াশিংটনের ওপর চাপ দিয়েছে যে, ইসরাইল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে ওয়াশিংটন যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের যুদ্ধে ‘তেল অস্ত্র’কে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা সত্ত্বেও ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন অথবা ওই এলাকায় সামগ্রিকভাবে মার্কিন নীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। একইভাবে তেল কোম্পানিগুলো যদি ইসরাইলের ব্যাপারে মার্কিন নীতিকে পরিচালিত করত তাহলে কেউ হয়তো দেখতে পেত যে, ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর, যেমন সাদ্দাম হোসেনের ইরাক (সাদ্দাম হোসেন যখন জীবিত ও ক্ষমতায় ছিলেন তখন একথা বলা হয়) মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিবিয়া অথবা ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের অনুগ্রহ পাওয়ার চেষ্টা করছে, যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো অর্থ আয় করে নিজেদের জ্বালানি সম্পদের উন্নতি করতে পারে এবং তা বাজারে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই তিন দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটা ছিল জ্বালানি কোম্পানিগুলো যা চেয়েছিল তার ঠিক বিপরীত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ। এমনকি এটাও দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো লাভবান হবে এমন ব্যবসায়িক চুক্তি ব্যর্থ করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এক্ষেত্রে অনেক সমালোচকেরই বিশ্বাস তেল লবি ততটা শক্তিশালী হলে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো না। সমৃদ্ধ তেল উৎপাদনকারী দেশ, যেমন সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং নির্দিষ্ট অস্ত্র চুক্তির লবিং করার জন্য জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এবং পেশাগত লবিস্টদের নিয়োগ করে। তাদের প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে সফল হয়। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৮২ সালে সৌদি আরবে এডব্লিউএসিএস (অ্যাওয়াক) বিমান বিক্রি করতে কংগ্রেসকে রাজি করানো। এ ঘটনায় মাঝে মাঝে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইসরাইল লবির প্রভাব সীমিত এবং আরব লবির ক্ষমতা বেশি। তবে এ ঘটনায় আরব লবির সাফল্যের কারণ ছিল বেশ কিছু অসাধারণ অনুকূল অবস্থা। সৌদি তেলের কৌশলগত গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। ওই সময় পারস্য উপসাগরে সোভিয়েট ইউনিয়ন সামরিক হুমকি হিসেবে আবিভূূর্ত হয়। রোনাল্ড রিগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য তার প্রশাসন সব ধরনের বাধা তুলে নেয়। তবু ওই যুদ্ধবিমান বিক্রি সিনেটে সামান্য ভোটের ব্যবধানে (৫২-৪৮) অনুমোদিত হয় এবং রিগানকে লবি ও কংগ্রেসের পুনরায় বিরোধিতার মুখে পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব ও জর্দানের সঙ্গে সম্পাদিত একাধিক অস্ত্র বিক্রি প্যাকেজ বাতিল করতে বাধ্য হতে হয়। তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলোর সীমিত প্রভাবের একটা কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে তাদের সমর্থনের ভিত্তি নেই। কারণ তারা পেশাগত লবিস্টস্ এবং জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। তাদের প্রতিনিধিদের বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে কলঙ্কিত করা সমালোচকদের জন্য খুবই সহজ। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির টম ডাইন একবার সৌদি লবিং প্রয়াসকে বাতিল করে দিয়ে বলেন, তারা তদের পক্ষে দরপত্র দেওয়ার জন্য ফ্রেড ডাটলের মতো বিদেশি এজেন্ট নিয়োগ করে। অথচ তাদের সমর্থন আমেরিকার মাটিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়।’ এর বিপরীতে ইসরাইল লবি হলো আমেরিকান নাগরিকদের একটা অংশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ এবং এ কারণে এর রাজনৈতিক কাজকে ব্যাপক ও যথার্থভাবে বৈধ বলে গণ্য করা হয়।
‘ইসরাইল লবি’ কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো নিয়মিতভাবে জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন ধারণার রূপ দেয় এবং তাদের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নীতি গ্রহণে তারা আইন প্রণেতা ও প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করে।প্রতিযোগী দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক কাজের অত্যন্ত প্রশংসা করেন ১০নং ফেডারেলিস্টে জেমস মেডিসন, আর বিভিন্ন সুবিধাবাদী গ্রুপের চাপে যুদ্ধের সিদ্ধান্তসহ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি রূপ লাভ করে। যখন কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থবাদী গ্রুপ বিশেষভাবে শক্তিশালী বা রাজনৈতিকভাবে দক্ষ হয়ে ওঠে তখন তারা এমন নীতির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে যা সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষার জন্য শুল্ক আরোপ করা হলে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পের সুবিধা হয়। কিন্তু ওই শিল্পের পণ্য ব্যবহারকারী অনেক ভোক্তাকে এজন্য বাড়তি অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নকে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন ব্যর্থ করে দেয়। এর ফলে বন্দুক প্রস্তুতকারী ও ডিলাররা নিঃসন্দেহে লাভবান হয়, তবে সমাজের অবশিষ্ট লোকগুলো বন্দুক সংক্রান্ত অনিষ্টের বিষয়ে আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইন্সটিটিউটের সাবেক লবিস্ট হোয়াইট হাউসের পরিবেশের মান সংক্রান্ত পরিষদের প্রধান হন এবং তিনি যখন এই পদমর্যাদাকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতার মধ্যকার সম্পর্কবিষয়ক রিপোর্টকে নাকচ করে দেন (অক্সন মবিল-এ চাকরি নেওয়ার জন্য পদত্যাগের পূর্বে) তখন অনেকেই যৌক্তিকভাবে উদ্বিগ্ন হন যে, তেল শিল্প এমনভাবে এর স্বার্থ রক্ষা করছে যেন তা আমাদের সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের ওপর জ্বালানি স্বার্থের প্রভাব অথবা ওষুধের ব্যবস্থাপত্রের ওপর ওষুধ কোম্পানিগুলোর ভূমিকার মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ওপর ইসরাইল লবির প্রভাব একই মাপকাঠিতে বিচার করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে নীতি অনুসরণ করে তার কৌশলগত বা নৈতিক ভিত্তি যা আছে তা খুবই সামান্য। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব গ্রুপ ও ব্যক্তি লবি তৈরি করে তাদের স্বার্থই হলো এর মূল কারণ। এটা যদি লবির প্রয়াস না হতো তাহলে কৌশলগত ও নৈতিক যে যুক্তিকে নিঃশর্তভাবে মার্কিন সমর্থনের জন্য সাধারণত চাওয়া হয় তা বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন হতো। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে নীতি কার্যকর আছে তার আমূল পরিবর্তন হতো। ইসরাইল সমর্থক শক্তিগুলো নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে, তারা এমন নীতিকে উৎসাহিত করছে যা আমেরিকা ও ইসরাইলের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষার জন্যই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা ভিন্ন মত পোষণ করি। তারা যেসব নীতি সমর্থন করে তার অধিকাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভিন্ন একটা পথ অনুসরণ করতো তাহলে উভয় দেশই লাভবান হতে পারতো। ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকারের প্রতি সমর্থনের জন্য আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো প্রশ্ন করছি না। কারণ ওই অধিকার এখন স্পষ্টভাবে যৌক্তিক এবং সারাবিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশ তা সমর্থন করে। আমাদের যে প্রশ্ন ও যার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন তা হলো – ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ব্যাপকতা ও এর নিঃশর্ত প্রকৃতি এবং ইসরাইলের কল্যাণকে বিবেচনায় রেখে এর মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিচালনার মাত্রা। এ লক্ষ্যে এখানে ইসরাইল লবির মূল উপাদানগুলো চিহ্নিত এবং কিভাবে তা সময়ের বিবর্তনে গড়ে উঠেছে তা বর্ণনা করা হলো। ‘আরব লবি’ ও ‘তেল লবি’র মতো সম্ভাব্য প্রতিযোগীর তুলনায় ইসরাইল লবি কেন এতোটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, তাও আমরা আলোচনা করবো। লবির ব্যাখ্যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের শিথিল জোটকে আমরা সুবিধাজনক সংক্ষিপ্ত নাম ‘ইসরাইল লবি’ ব্যবহার করেছি যা ইসরাইল-সমর্থক লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির রূপ গঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এ লবির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসহ কোনো একক ও সংঘবদ্ধ আন্দোলন নেই। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এ ব্যাপক জোট কখনো কখনো কোনো নির্দিষ্ট নীতির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। এটা কোনো ধরনের গোপন অভিসন্ধির জন্য মিলিত ক্ষুদ্র দল বা ষড়যন্ত্র নয়। বরং লবি গঠনকারী এসব সংগঠন ও ব্যক্তি খোলামেলাভাবে কাজ করে, যেমনভাবে অন্যান্য স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো কাজ করে। ‘ইসরাইল লবি’ কথাটা ব্যবহার করা হয়ত কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কারণ এ শিথিল জোটের অনেক ব্যক্তি ও কোনো কোনো গ্রুপ আনুষ্ঠানিক লবিং কাজে (নির্বাচিত কর্মকর্তাদের অনুরোধ করার জন্য সরাসরি প্রয়াস) যুক্ত নয়। বরং ওই লবির বিভিন্ন অংশ মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে, যেমন করে অন্যান্য স্বার্থবাদী গ্রুপ। কেউ এ প্রয়াসকে যথার্থভাবে বর্ণনা করতে পারেন ‘ইসরাইল সমর্থক সম্প্রদায়’ অথবা ‘ইসরাইলকে সহায়তা করার আন্দোলন’ হিসেবে। কারণ বিভিন্ন গ্রুপের কাজের ব্যাপকতা সাধারণ লবিং কাজের চেয়ে অনেক বেশি। যাহোক, যেহেতু অনেক গ্রুপ লবিংয়ের কাজ করে সেহেতু ‘ইসরাইল লবি’ কথাটা সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে (যেমন ‘ফার্ম লবি’, ‘ইনসিওরেন্স লবি’, ‘গান লবি’ বা ‘অন্যান্য লবি’)। অন্যান্য স্বার্থবাদী বিশেষ গ্রুপের মতো ইসরাইল লবির কাজের সীমারেখা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তাছাড়া অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের কাজের সীমারেখা নির্ধারণ করা গেলেও তাদের অবস্থানের শ্রেণীবিভাগ করা খুবই কষ্টকর। ওই লবির অংশ হিসেবে কিছু কিছু গ্রুপকে চিহ্নিত করা যায়, যেমন মার্কিন ইহুদি সংগঠন। আবার ওই লবির সদস্য হিসেবে কিছু কিছু লোককেও চিহ্নিত করা যায়, যেমন কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস অব মেজর আমেরিকান জুইশ অর্গানাইজেশনস-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান ম্যালকম হোয়েনলিন। অনেক সংগঠন আছে যা সুস্পষ্টভাবে ওই লবির অংশ নয়, যেমন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনস অব আরব-আমেরিকানস। অনেক ব্যক্তি আছে যারা ওই লবির সদস্যের বাইরের লোক, যেমন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পন্ডিত ব্যক্তি রশিদ খালিদী। তবু এমন অনেক গ্রুপ ও ব্যক্তি আছে যাদের অবস্থান খুবই অনিশ্চিত। অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো ইসরাইল লবির কাজের সীমা স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এ লবি কোনো কেন্দ্রিভূত, পুরোহিততান্ত্রিক সংগঠন নয়, ব্যাখ্যা করা যায় এমনভাবে এর কোনো সদস্য পদও নেই। এর কোনো সদস্যপদ কার্ড বা দীক্ষা নেওয়ার কোনো রীতি নেই। বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে এর একটা ঘোষিত মূল লক্ষ্য আছে। আর তা হলো, ইসরাইলকে বস্তুগত সহায়তা ও এর সরকারের নীতিকে সমর্থন দেওয়ার জন্য মার্কিন সরকার ও এর জনগণকে উৎসাহিত করা। এছাড়াও আছে প্রভাবশালী মার্কিন লোকদের ওই একই উদ্দেশ্যে উৎসাহিত করা। বলা যায়, এসব লক্ষ্যই হলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এ লবি বিভিন্ন উপ-গ্রুপ ও ব্যক্তির সমর্থনও পায় যারা ইসরাইলের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা চায় যে, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থন অব্যাহত রাখুক। তবে এসব উপ-গ্রুপ ও ব্যক্তি মূল গ্রুপ ও ব্যক্তির মতো ততোটা উৎসাহী বা অবিচলিতভাবে সক্রিয় নয়। এভাবে, আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির একজন লবিস্ট, ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির একজন গবেষক অথবা অ্যান্টি-ডেফামেশন লীগ ও ক্রিস্টিয়ানাস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের মতো নেতৃস্থানীয় সংগঠনগুলো ওই লবির মূল অংশ, আর যেসব লোক তাদের স্থানীয় পত্রিকায় ইসরাইলকে সমর্থন করে পত্র লেখে অথবা ইসরাইল সমর্থক রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটিকে চেক পাঠায় তাদের দেখা হয় সমর্থকদের কাজের নেটওয়ার্কের একটা অংশ হিসেবে। এ ব্যাখার অর্থ এটা নয় যে, ইসরাইলের প্রতি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রত্যেক মার্কিনি ওই লবির সদস্য। এ ক্ষেত্রে একটা ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। এ বইয়ের লেখকদ্বয় এ অর্থে ‘ইসরাইল সমর্থক’ কারণ আমরা এর টিকে থাকার অধিকারকে সমর্থন করি, এর অনেক অর্জনকে প্রশংসা করি, এর নাগরিকদের নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবন চাই এবং বিশ্বাস করি যে, ইসরাইলের অস্তিত্ব যদি বিপদাপন্ন হয় তাহলে এর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু আমরা সুস্পষ্টভাবে ইসরাইল লবির অংশ নই। এটাও এ ইঙ্গিত দেয় না যে, যেসব আমেরিকান ইসরাইলকে সমর্থন করে তারাও ইসরাইল লবির অংশ। যে সিনেটর ইসরাইলকে সহায়তা দেওয়ার পক্ষে অবিচলিতভাবে ভোট দেন, তিনিও আবশ্যিকভাবে ইসরাইল লবির অংশ এমন নয়। কারণ তিনি হয়তো ইসরাইল-সমর্থক স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর রাজনৈতিক চাপে সাড়া দিতে পারেন। অন্য কথায়, লবির অংশ হতে হলে কাউকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ইসরাইল-সমর্থক লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হয়। কোনো সংগঠনের পক্ষে এই প্রচেষ্টা তার মিশনের অংশ হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য তার সম্পদ ও কর্মসূচির একটা বিরাট অংশ কাজে লাগাতে হয়। কোনো ব্যক্তির পক্ষে এর অর্থ হলো, কারো পেশাগত বা ব্যক্তিগত জীবনের কিছুটা অংশ এ কাজের জন্য ব্যয় করতে হয় (অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটা অংকের অর্থ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য। কোনো সাংবাদিক অথবা কোনো শিক্ষাবিদ, যিনি মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্য বিষয় নিয়ে লেখেন এবং বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করেন তা ইসরাইলের অনুকূলে গেলেও তাকে ইসরাইল লবির অংশ হিসেবে দেখা ঠিক নয়, যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার ডেভিড স্যানগার অথবা ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস জেন্টলসন। কিন্তু কোনো সাংবাদিক বা পন্ডিত ব্যক্তি যিনি ইসরাইলের পক্ষ নেবেন বলে পূর্বেই ধারণা করা যায় এবং যিনি ইসরাইলের জন্য স্থির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পক্ষে তার লেখার অধিকাংশই ব্যয় করেন তিনি স্পষ্টভাবে ইসরাইল লবির অংশবিশেষ, যেমন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট চার্লস ক্রাউথামার বা প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ঐতিহাসিক বার্নার্ড লিউস। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়াস ও নির্দিষ্ট কাজের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় এবং ইসরাইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি একমত নাও হতে পারে। অনেক ব্যক্তি ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিরোধিতা করেন এবং এর পরিবর্তে তারা বিশ্বাস করেন যে, সব এলাকা বা অধিকৃত এলাকার অধিকাংশই ইসরাইলের রেখে দেওয়া উচিত। এসব লোকের মধ্যে আছেন আমেরিকার ইহুদি সংগঠনের মর্টন ক্লেইন, ক্রিস্টিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের জন হ্যাপি এবং আমেরিকানস ফর অ্যা সেফ ইসরাইলের রায়েল জ্যাঁ আইজাক। অন্যরা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা বলেন এবং মাঝে মাঝে ইসরাইলের নির্দিষ্ট কোনো কার্যব্যবস্থার সমালোচনা করেন। এদের মধ্যে আছেন ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ডেনিস রস এবং ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের মার্টিন ইনডায়েক। এসব পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের সবাই বিশ্বাস করেন যে, ইসরাইলের কোনো কাজের বিরোধিতা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাকে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করা। এ ধরনের সহায়তাকে উৎসাহিত করার জন্য তারা তাদের পেশাগত জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেন। এভাবে এমন চিন্তা করা স্পষ্টত ভুল যে, ওই লবি হলো একটা একক চিন্তার স্তম্ভ; এটা কোনো গুপ্ত অভিসন্ধির দল বা ষড়যন্ত্র নয়। তেমনি যারা ইহুদি রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার বিশেষ সম্পর্ক রক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে তাদের ওই লবির বাইরের লোক বলে মনে করাও একইভাবে ভুল হবে। আমেরিকান ইহুদি সম্প্রদায়ের ভূমিকা লবির বেশিরভাগ লোকই আমেরিকান ইহুদি। তারা সব সময় এটা নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ইসরাইলের স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক মেলভিন আই ইউরোফসকির মতে, ‘আমেরিকার ইতিহাসে মানবজাতির আর কোনো গ্রুপ বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে এতটা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট নেই।’ স্টিভেন টি রোসেনথেল একথা সমর্থন করে লেখেন, ‘১৯৬৭ সাল থেকে … আর কোনো দেশ পাওয়া যায় না যার নাগরিকরা অন্য দেশের সাফল্যের জন্য এতটা অঙ্গীকারাবদ্ধ, যেমনটা আমেরিকান ইহুদিরা করে ইসরাইলের জন্য।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ট্রাইস ১৯৮১ সালে লেখেন, ইসরাইল সমর্থক লবির সংখ্যা কমপক্ষে পঁচাত্তরটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ, এদের অধিকাংশই ইহুদি। এরা ‘ইসরাইল সরকারের প্রায় সব কাজ ও নীতির সমর্থন করে।’ এসব গ্রুপের কাজ শুধু ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা সংবাদ সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি লেখে, ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেয় এবং এমন এক বা একাধিক ইসরাইল সমর্থক সংগঠনকে সক্রিয় সমর্থন দেয় যারা তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে ওই গ্রুপের লোকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। তবু সব আমেরিকান ইহুদি ইসরাইল লবির সমার্থক নয়। যেসব ব্যক্তি বা গ্রুপ ইসরাইলের জন্য মার্কিন সমর্থনকে উৎসাহিত করে তাদের সবাইকে ‘ইহুদি লবি’ বলে বর্ণনা করা যথার্থ নয়। একটা বিষয় হলো, ইসরাইলের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধের গভীরতার ক্ষেত্রে মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা আছে। সাধারণভাবে তাদের মধ্যে তৃতীয়জন বস্তুত ইসরাইলকে নির্দিষ্টভাবে মূল বিষয় বলে গণ্য করে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালে পরিচালিত একটা জরিপ থেকে দেখা যায়, আমেরিকার ইহুদিদের মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ ইসরাইলের প্রতি আবেগপ্রবণভাবে সংশ্লিষ্ট অবস্থায় ‘বেশি নয়’ বা ‘মোটেই নয়’ অবস্থায়। এছাড়াও অনেক আমেরিকান ইহুদি আছে যারা ইসরাইলের প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও লবির প্রধান প্রধান সংগঠনের বিভিন্ন নীতি সমর্থন করে না। যেমন, অনেক বন্দুক-মালিক ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন সমর্থিত সব নীতি সমর্থন করে না, তেমনি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর সব পদক্ষেপকেই অবসরপ্রাপ্তরা অনুকূল বলে মনে করেন না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সামগ্রিকভাবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় ইরাক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমেরিকান ইহুদিরা খুবই কম আগ্রহী ছিল। অথচ লবির প্রধান প্রধান সংগঠনগুলো ওই যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। মার্কিন ইহুদিরা ওই যুদ্ধের ব্যাপারে আগের চেয়ে এখন বেশি বিরোধিতা করে। সবশেষে, ইসরাইলের পক্ষে অধিক সোচ্চার কিছু কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপ ইহুদি নয়, যেমন ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টস। আমেরিকান ইহুদিরা যেহেতু লবির প্রধান উপাদান, সেহেতু এই শিথিল জোটকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে ইসরাইল লবি হিসেবে। এটাই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা যা ওই লবির ব্যাখ্যা করে – ওই লবিকে যারা এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের ধর্মীয় বা এয্নিক পরিচিতি থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। অনেক আমেরিকান ইহুদি ইসরাইলের জন্য যে আসক্তি অনুভব করেন তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। বিভিন্ন দেশ বা জাতির জন্য একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও একাত্মতা অন্যান্য এয্নিক গ্রুপের মধ্যেও দেখা যায় যাদের উৎস এক অথচ তারা বিদেশে বসবাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইহুদিরা ইহুদিবাদ আন্দোলনের প্রথমদিকে এ সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কিন্তু ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর এর প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের ওপর ভীতিকর নির্যাতন সংঘটিত হওয়ার পর এ সম্পর্কে সবাই সচেতন হয়ে ওঠে। তুলনামূলকভাবে খুব কম সংখ্যক ইহুদি ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সেখানে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-পুরিয়ন এবং অন্যান্য ইসরাইলি নেতা প্রথমদিকে এ প্রয়াসের সমালোচনা করেন। তবু ইসরাইলের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার খুব শিগগিরই অনেক মার্কিন ইহুদির জন্য পরিচিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনে একটা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বিষ্ময়কর বলে মনে হয়, বিশেষ করে নাজি কর্তৃক হত্যাকান্ডের পর। ‘মরুভূমিতে ফুল ফোটানোর’ জন্য ইসরাইলের অর্জন নিশ্চিতভাবে গর্বের উৎস ছিল। ইসরাইলের সঙ্গে গভীর পরিচিতি ওই সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য একটা নতুন ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা অতি দ্রুত মার্কিন সমাজে মিশে যায়। তারা একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে রোসেনথাল লেখেন : ‘বাসস্থান থেকে ৮ হাজার মাইল দূরে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কারো ইহুদিত্বের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ধর্মের বাধা এড়ানোর সুবিধাজনক উপায় হলো ইসরাইলকে ইহুদি ধর্মমতের সঙ্গে সমীকরণ করা… যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে মার্কিন ইহুদিদের জীবনধারার মূলকেন্দ্র সিনাগগ হয়ে ওঠে ইসরাইলকেন্দ্রিক। নতুন এক শ্রেণীর পেশাজীবী ইহুদি বিভিন্ন নগরের উপকণ্ঠে গড়ে ওঠে। তারা শিগগিরই দেখতে পায়, তাদের নিজ নিজ এলাকার ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উদাসীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অত্যন্ত কার্যকর উপায় হলো ইসরাইল। ইসরাইলের জন্য ব্যাপক আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনের সমর্থনে প্রধানত অনেক সংগঠন গড়ে ওঠে। অর্থ যোগাড় ও লবিং কাজের জন্য কাউকে ক্রমাগতভাবে ইসরাইলের সঙ্গে মার্কিন ইহুদিদের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।’ মার্কিন ইহুদিরা অনেক আকর্ষণীয় নাগরিক সংগঠন গড়ে তুলেছে যার কর্মসূচি হলো ইসরাইলের কল্যাণের জন্য কাজ করা, অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করা। এসব সংগঠনের মধ্যে আছে আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, আমেরিকান জুইস কংগ্রেস, জাইওনিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা, ইসরাইল পলিসি ফোরাম, আমেরিকান জুইশ কমিটি, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ, রিলিজিয়াস অ্যাকশন সেন্টার অব রিফর্ম জুডাইজম, আমেরিকানস ফর সেফ ইসরাইল, আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব লিকুড, মারকাজ-ইউএসএ, হাডাসাহ এবং আরো অনেক সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানী চেইম আই. ওয়াক্সম্যান ১৯৯২ সালে বলেন, আমেরিকান জুইশ ইয়ারবুকে ৮০টারও বেশি জাতীয় ইহুদি সংগঠনের নাম তালিকাভুক্ত আছে যা ‘বিশেষভাবে ইহুদি ও ইসরাইল সমর্থক কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত… এবং অন্যসব সংগঠনের লক্ষ্য ও কার্যাবলির মধ্যে আছে ‘ইসরাইলের কল্যাণকে উৎসাহিত করা’, ‘ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থন করা’ এবং ‘ইসরাইল সম্পর্কিত জ্ঞানকে উৎসাহিত করা’। সবচেয়ে বড় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলোর মধ্যে ৫১টা সংগঠন কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস অব মেজর আমেরিকান জুইশ অর্গানাইজেশনসে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যার বর্ণিত মিশনের মধ্যে আছে ‘ইসরাইলের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন গ্রুপের একক শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া’ এবং ‘বিশেষ মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ক জোরদার ও লালনে’র জন্য কাজ করা। লবির মধ্যে আছে বিভিন্ন থিঙ্ক-ট্যাংক, যেমন জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, মিডল ইস্ট ফোরাম ও ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার-ইস্ট পলিসি। এছাড়া আছে অনেক ব্যক্তি যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আরো আছে কয়েক ডজন ইসরাইল সমর্থক পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি যারা ইসরাইল সমর্থক প্রার্থী অথবা এমন সব প্রার্থীকে অর্থ দেওয়ার জন্য প্রস্ত্তত থাকে যাদের বিপক্ষ প্রার্থী ইসরাইলের যথেষ্ট সমর্থক নয় বা এর বিপক্ষ বলে মনে হয়। প্রচারমূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দলীয় গবেষণা গ্রুপ সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স এমন কমবেশি তিন ডজন ‘ইসরাইল-সমর্থক’ পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি চিহ্নিত করে। ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক রিপোর্টে বলে, ২০০৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থীদের তারা প্রায় ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। ইহুদিদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে, যাদের এজেন্ডার মধ্যে প্রধান অংশ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক, আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হলো স্পষ্টভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত পরিচিত। ১৯৯৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন কংগ্রেস সদস্য ও তাদের কর্মচারীদের কাছে ওয়াশিংটনে সবচেয়ে শক্তিশালী লবি কোনটি তা জিজ্ঞাসা করে। এতে দেখা যায়, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর পর পরই আসে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নাম যা আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব লিকুড-সিআইও এবং ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের মতো শক্তিশালী লবিরও ওপরে ছিল। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ন্যাশনাল জার্নাল একই রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড পার্সনস-এর সঙ্গে যুক্ত করে) অবস্থান ওয়াশিংটনের ‘পেশীশক্তির দিক থেকে’ দ্বিতীয় স্থানে নির্ধারণ করে। সাবেক কংগ্রেস সদস্য মেরভিন ডাইম্যালি একবার বলেন, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হলো ‘কংগ্রেসের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কার্যকর লবি’। হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান লি হ্যামিলটন ১৯৯১ সালে বলেন, ‘এর সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো লবি গ্রুপ নেই… তারা নিজেরাই একটি শ্রেণীবিশেষ।’ মি. হ্যামিলটন কংগ্রেসে কাজ করেন ৩৪ বছর। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো অন্য গ্রুপগুলো বর্তমানে যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রথমদিকে, এমনকি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও ইসরাইলের পক্ষে নীরবে লবিং চলে দৃশ্যের অন্তরালে। ওই লবিং চলে সাধারণত প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট, অল্পসংখ্যক ইহুদি নেতা, ইহুদি সমর্থক, উপদেষ্টা বা ইহুদি বন্ধুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার পক্ষে উড্রো উইলসন সমর্থন দেন অংশত তার ইহুদি বন্ধু সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি লুইস ডি. ব্রান্ডিস এবং রাবিব স্টিফেন ওয়াইজের প্রভাবে। একইভাবে, ইসরাইলের সৃষ্টি ও নতুন রাষ্ট্রকে সমর্থন করার হ্যারি এস. ট্রূম্যানের সিদ্ধান্ত তার ইহুদি বন্ধু ও উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপে প্রভাবিত হয়। ইসরাইলের সমর্থকদের অনাড়ম্বরভাবে চলার আগ্রহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সেমিটিক বিরোধিতাকে দীর্ঘায়িত করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়। আবার এমন ভীতিও দেখা যায় যে, ইসরাইলের পক্ষে অতি বেশি লবিং মার্কিন ইহুদিদের বিরুদ্ধে দ্বৈত-স্বদেশপ্রীতির অভিযোগ প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সৃষ্টির উৎস হলো ইহুদি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন স্পষ্টভাবে সমর্থনকারী হিসেবে। এর প্রতিষ্ঠাতা আই. এল ‘সি’ কেনেন ১৯৫১ সালে আমেরিকান জাইওনিস্ট কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। ওই কাউন্সিল ছিল তালিকাভুক্ত বিদেশি লবিং গ্রুপ। কেনেন এই কাউন্সিলকে মার্কিন লবিং সংগঠনে পুনর্গঠিত করেন যা ১৯৫৩-৫৪ সালে আমেরিকান জাইওনিস্ট কমিটি ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৫৯ সালে এ সংগঠনের নতুন নামকরণ করা হয় আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি হিসেবে। কেনেন জনসমক্ষে প্রচার বা জনগণকে সংগঠিত করার পরিবর্তে প্রধান আইন প্রণয়নকারীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর নির্ভর করতেন। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সাধারণত ইসরাইলের স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ‘কেনেনের নীতি’ অনুসরণ করতো। এক নম্বর অনুসৃত নীতি ছিল : আইন প্রণয়নের পেছনে থাকুন, এর সামনে আসবেন না (অর্থাৎ অনাড়ম্বর অবস্থান বজায় রাখুন)। ইহুদি সংবাদপত্র ফরোয়ার্ডের সম্পাদক জে. জে. গোল্ডবার্গের মতে, ইহুদি সমর্থনের প্রভাব ‘কেনেডি ও জনসনের শাসনামলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ ওই সময়ে মার্কিন সমাজে ইহুদিদের সমৃদ্ধি ও প্রভাব বেড়ে যায়।’ অন্য একটা কারণ হলো, কেনেডি ও জনসন ‘তাদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, দাতা ও ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন।’ তবু ওই সময় আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির কার্যকলাপ ছিল ক্ষুদ্রাকারে এবং এর লোকসংখ্যা ও বাজেট ছিল খুবই কম। স্টুয়ার্ট আইজেনস্ট্যাট উল্লেখ করেন, ‘ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে এ সংগঠন ইহুদি রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রকাশ্যে শুরু করেনি।’ লবির আকার, সম্পদ ও প্রভাব ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ৬ দিনের যুদ্ধের পর ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আইজেনস্ট্যাটের মতে, ওই সংঘর্ষ ‘মার্কিন ইহুদি জনগণকে এমনভাবে সংঘবদ্ধ করে যা ইসরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আর কোনো ঘটনা করতে পারেনি।’ ‘নতুন ইহুদি জাতি’র অহমিকা, গর্ব ও বলিষ্ঠতা এবং নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতার অনুভূতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের ওপর সীমাহীনভাবে প্রভাব ফেলে। সেমিটিক-বিরোধিতার বিরুদ্ধে সফল প্রচার এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক হত্যাকান্ডের ভীতি সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা। ফলে দীর্ঘদিনের বিভেদমূলক বাধা অপসারিত হয়, আর মার্কিন ইহুদিরা ‘তাদের ভীতির অনুভূতি থেকে মুক্ত হয়’ যা প্রথমদিকে ‘তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রসারকে ব্যাহত করেছিল।’ ইসরাইল ক্রমাগতভাবে ইহুদি পরিচিতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল, যেখানে মিলে যাওয়া ক্রমেই সহজ ও ব্যাপক হয়ে যায়। তবু রাজনীতির সঙ্গে ওই সংশ্লিষ্টতার এমন কিছু কারণ ছিল যা প্রকাশ করা যায় না। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য শত্রুর শক্তি ক্ষয় (১৯৬৯-১৯৭০) এবং যুদ্ধের সময় (১৯৭৩) ইহুদি সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসরাইলের কল্যাণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ অব্যাহত থাকে। এসব সংঘর্ষে ইসরাইলের সামরিক সাহসিকতার গর্ব পুনরায় বলীয়ান হয়। তবে তারা ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়। এজন্য তারা অনেক ইহুদি সম্প্রদায়-সম্পর্ক গ্রুপের ইসরাইলকেন্দ্রিক দৃষ্টিকে আরো শক্তিশালী করে। জাতীয় ইহুদি কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজার কাউন্সিলের (পরে ইহুদি কাউন্সিল ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামকরণ করা হয়) নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট চেরনিন ১৯৭৮ সালে এ আশা প্রকাশ করেন যখন তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার ইসরাইল, তবে এর সঙ্গে সবশ্রেণীর লোকের উদ্বেগসহ মার্কিন ইহুদি নেতৃত্বের মতামতের পূর্ণ ঐক্যের প্রতিফলন থাকতে হবে।’ ঐতিহাসিক জ্যাক ওয়েরদিমার এ মন্তব্যকে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি সম্প্রদায়-সম্পর্ক সংগঠনগুলোর সব উদ্বেগ উপেক্ষা করে ইসরাইলকে সহায়তা করার রাজনৈতিক প্রয়াসের হতবুদ্ধিকর স্বীকৃতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ব্যক্তিগত অর্থ প্রদানের তুলনায় ইসরাইলে মার্কিন বিদেশী সহায়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইসরাইল সমর্থক সংগঠনগুলো ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক কার্যাবলীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যার লক্ষ্য ছিল মার্কিন সরকারের সমর্থন রক্ষা করা অথবা বৃদ্ধি করা। ওয়েরদিমারের মতে, ‘ইসরাইলের জন্য লবিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস… এবং আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ওপর ন্যস্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। ওই দুটি সংগঠন সত্তর এবং আশির দশকে প্রসিদ্ধি লাভ করে।’ অতিরিক্ত প্রয়াসের ফলে সচেতনতা এমনভাবে প্রতিফলিত হয় যে, ইসরাইলকে সমর্থন করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে এবং তা রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক ও সমর্থনযোগ্য করে তুলতে হয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে মরিস অমিতায় ১৯৭৫ সালে কেনেনের স্থলাভিষিক্ত হন। মরিস বলেন, ‘আপনি যদি ইসরাইলকে সহায়তা করতে চান তাহলে খেলার নাম হলো রাজনৈতিক কাজ।’ মরিস ও তার উত্তরসূরি টম ডাইনের সময় আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ঘনিষ্ঠ ও কম বাজেটের কার্যকলাপ থেকে বড় ও গণভিত্তিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। এর কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ এবং বার্ষিক বাজেট (পুরোপুরি ব্যক্তিগত দান থেকে আসা) ১৯৭৩ সালে ৩ লাখ মার্কিন ডলার থেকে বর্তমানে (২০০৭) প্রাক্কলিত ৪০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। কেনেনের সময় সংগঠনটা প্রচার-খ্যাতি এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এ সময় তা ক্রমাগতভাবে এর ক্ষমতা প্রচার করতে চায়। সাবেক একজন কর্মকর্তার মতে, ‘তাত্ত্বিক দিক হলো, কেউ যদি আপনার সম্পর্কে না জানে, তাহলে সে আপনাকে ভয় পাবে না।’ আগে ইহুদীদের পক্ষে ইহুদি উপদেষ্টা ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে লবিং করতো। আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং লবির অন্যান্য গ্রুপ ইসরাইলের ইহুদিদের জন্য মানবিক সাহায্য হিসেবে তাদের কর্মসূচিকে ব্যাখ্যা করেনি। বরং লবির বিবর্তনে তা ক্রমাগতভাবে আমেরিকা ও ইসরাইলের কৌশলগত স্বার্থ এবং নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্তি সম্পর্কে বাস্তব যুক্তি গ্রহণ ও তার বিকাশে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। নগদ অর্থ এবং ঠান্ডা যুদ্ধের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ভালো অবস্থানে থেকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি প্রচারাভিযানের জন্য ব্যয়িত অর্থ সম্পর্কে নতুন ফেডারেল বিধির ফলে তার রাজনৈতিক পেশীশক্তি আরো বর্ধিত আকারে দেখতে পায়। এর ফলে স্বাধীন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয় এবং এর পক্ষে ইসরাইল সমর্থক প্রার্থীর কাছে অর্থ প্রেরণ করা সহজতর হয়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি সবদিক থেকে খুব শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু আশির দশকে, ওয়ারেন বাসের মতে, তা ছিল ‘ওয়াশিংটন পাওয়ার হাউস’। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং মতবিরোধের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকতা লবি কোনো কেন্দ্রভিত্তিক বা যাজকীয় আন্দোলন ছিল না, এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি লবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইহুদিদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট নীতির বিষয়েও ব্যাপক মতবিরোধ দেখা গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস ইসরাইলের লিকুড ও অন্য গোঁড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে এবং তারা অসলো শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ, যেমন অ্যামেইনু, আমেরিকানস ফর পিস নাউ, জুইশ অ্যালায়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস, ইসরাইল পলিসি ফোরাম, জুইশ ভয়েস ফর পিস, মেরেতজ-ইউএসএ এবং টিকুকন কমিউনিটি সমস্যার জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধানের জোর সমর্থক। এসব গ্রুপ বিশ্বাস করে, এটা করার জন্য ইসরাইলকে গুরুত্বপূর্ণভাবে ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের মতপার্থক্যের জন্য বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেও মাঝে মাঝে বিভেদ দেখা দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৬ সালে ইসরাইল পলিসি ফোরাম, আমেরিকানস ফর পিস নাউ, জুইশ ভয়েস ফর পিস এবং জুইশ অ্যালায়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস প্রকাশ্যে কংগ্রেসের একটা প্রস্তাবের (এইচআর ৪৬৮১) বিরোধিতা করে যার স্পন্সর করে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি – ওই প্রস্তাবটা ছিল প্যালেস্টাইনকে সাহায্য দেয়ার ওপর ইসরাইল যা চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সংক্রান্ত। সংশোধিত আকারের ওই প্রস্তাবটা অবশ্য সুবিধাজনক ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। কিন্তু ওই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইসরাইল সমর্থক গ্রুপগুলো একক দলের ধারায় কেন্দ্রীভূত একক স্তম্ভ হিসেবে গঠিত নয়। এতদসত্ত্বেও মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের সংগঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষ করে তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ গ্রুপগুলো ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের অনুসৃত নীতিকে উপেক্ষা করে ওই রাষ্ট্রের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূল সমর্থনের ব্যাপারে অটল থাকে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির একজন মুখপাত্র ২০০০ সালের জুন মাসে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, চীনের কাছে ইসরাইলের অস্ত্র বিক্রি সম্পর্কে সৃষ্ট উদ্বেগের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হ্রাসের আহবান জানানো হয়। ওই সময় ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই ইসরাইলের সহায়তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছু সংশ্লিষ্ট করার বিরোধিতা করি। কারণ একবার এরকম শুরু হলে তা কখনো থামবে না।’ এমনকি আমেরিকানস ফর পিস নাউ গ্রুপও ‘ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা’কে সমর্থন করে এবং মার্কিন সহায়তা ‘হ্রাস বা শর্তযুক্ত’ করারও বিরোধিতা করে। তাদের শুধু একটাই দাবি ছিল, আর তা হলো, মার্কিন সহায়তার অর্থ দিয়ে অধিকৃত অঞ্চলে পুনর্বাসন কাজের জন্য যেন তা ব্যবহার করা না হয়। একইভাবে মধ্যপন্থী ইসরাইল পলিসি ফোরাম ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাকে অধিক শর্তযুক্ত করা সমর্থন করে না। বরং দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি বাস্তবায়নে অধিক সক্রিয় ও কার্যকরভাবে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্ররোচিত করার প্রচেষ্টাকে তারা বেশি গুরুত্ব দেয়। শান্তি প্রয়াস ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সংক্ষেপে বলা যায়, ইসরাইল সমর্থক প্রায় প্রত্যেকটা গ্রুপ ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বজায় রাখতে চায়। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো জুইশ ভয়েস ফর পিস গ্রুপ। পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুসালেমে দখল না থামানো পর্যন্ত ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার জন্য ওই গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহবান জানায়। এ অবস্থায় বস্তুত কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, জুইশ ভয়েস ফর পিস আদৌ লবির অংশ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে সর্বাধিক করার প্রয়াসে ইসরাইলি কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে মার্কিন ইহুদি নেতৃবৃন্দকে নিয়োজিত করে এবং নির্দিষ্ট কোনো ইসরাইলি নীতির পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে সহায়তা করার জন্য তাদের প্রতি আহবান জানায়। কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের সাবেক চেয়ারম্যান রাবিব আলেকজান্ডার সিন্ডলার ১৯৭৬ সালে ইসরাইলের একটা ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস এবং এর সদস্যরা ইসরাইলি নীতির সরকারি যন্ত্র হয়ে আছে। দেখা যায় যে, আমাদের কাজ হলো সরকারের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করা এবং ইহুদি সম্প্রদায়কে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা উপেক্ষা করেই আমরা আমাদের সাধ্যমতো কাজ করি। (এ অবস্থা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে সিন্ডলার মনে করেন। সাক্ষাৎকারীকে তিনি বলেন যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের অন্য কেউ ব্যবহার করুক এটা তারা দেখতে চায় না’)। একই ধরনের কথা বলেন ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কমিটির আলবার্ট চেরলিন। তিনি ১৯৭০ সালে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমরা নীতি তৈরি করি, কিন্তু ইসরাইলের বিষয়ে আমাদেরকে নীতি দেয়া হয়… বাস্তবে, কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস হলো সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে ইসরাইল তার নীতি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করে।’ ফরোয়ার্ড পত্রিকার ওরি নির একটা প্রধান ইহুদি সংগঠনের একজন কর্মীর (নাম উল্লেখ না করে) উদ্ধৃতি দেন। ২০০৫ সালে ওই কর্মী দাবি করেন যে, ‘নিয়মমাফিকভাবে আমরা বলি, নির্দিষ্ট বিষয়ে এটাই আমাদের নীতি। কিন্তু ইসরাইলিরা কি চিন্তা করছে তা আমাদের খোঁজ করতে হয়। সম্প্রদায় হিসেবে আমরা এ কাজ সব সময় করি।’ আমেরিকান জুইশ কমিটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হাইমান বুকবাইন্ডার একবার স্বীকার করেন, ‘মারাত্মক চাপ, সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ বা মৌলিক কিছু না হলে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য ইসরাইল যা বলে তোতা পাখির মতো আপনিও তাই বলুন। মার্কিন ইহুদি হিসেবে আমরা বলে বেড়াই না যে, ইসরাইল তার বিভিন্ন নীতিতে ভুল করছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সমর্থন সঞ্চারিত করার দক্ষতা ইসরাইল বারবার দেখিয়েছে। জাইয়নিস্ট (এবং পরে ইসরাইল) কর্মকর্তারা ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ দেশভাগ পরিকল্পনা এবং ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য প্রচার করতে মার্কিন ইহুদি নেতৃবৃন্দকে উৎসাহিত করে। একই সঙ্গে তারা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী ফোল্ক বার্নাডোটের উদ্ভাবিত ব্যর্থ শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লবিং করতে বলে। এ ধরনের সংঘবদ্ধ প্রয়াসের ফলে ট্রূমান প্রশাসন ১৯৫২ সালে ইসরাইলের জন্য আর্থিক সহায়তা ব্যাপক বৃদ্ধি এবং মিসরকে এক কোটি মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়ার পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দফতরের প্রস্তাব বাতিল করে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিন যুদ্ধের আগে সংকটের সময় ইসরাইল সরকার ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তার দূতকে নির্দেশ পাঠায় ‘জনমত সৃষ্টি করতে, যা (জনসন) প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে… তবে এটা যেন স্পষ্ট না হয় যে, জনমত সৃষ্টির পেছনে আমরা আছি।’ ওই প্রচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহানুভূতিশীল মার্কিনিরা চিঠিপত্র, সম্পাদকীয় লেখে, টেলিগ্রাম পাঠায় ও জনসমক্ষে বিবৃতি দেয় বিভিন্নভাবে। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী এর উদ্দেশ্য ছিল ‘জনসমর্থনের পরিবেশ সৃষ্টি করা… যা প্রশাসনে আমাদের বন্ধুদেরকে শক্তিশালী করবে।’ হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা অবশেষে তাদের ইসরাইলি প্রতিপক্ষদের চিঠি লেখা প্রচারণা বন্ধ করতে অনুরোধ করে। কিন্তু ইসরাইলি দূত জেরুসালেমে রিপোর্ট করে যে, ‘নিশ্চিতভাবে আমরা এটা অব্যাহত রেখেছি।’ ঐতিহাসিক টম সেগেভের মতে, ‘ইসরাইলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ সম্বলিত নাগরিকদের চিঠিপত্রে’ হোয়াইট হাউস ‘প্লাবিত’ হয়ে যায়। ইসরাইলকে সমর্থন করার এমন প্রবণতা আজকাল অনেক কমে এলেও লবির বড় বড় সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় ইসরাইলি নেতাদের সমর্থন করাকে অগ্রাধিকার দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বুশ প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ‘রোড ম্যাপ’ প্রকাশ করার পর কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের ম্যালকম হোয়েনলিন ‘হারেতজ্’-কে বলেন বলে বলা হয় যে, ‘রোড ম্যাপ’ সম্পর্কে ইসরাইল সরকার আপত্তি করলেও তা আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবে। হোয়েনলিন জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের কথা শোনানোর জন্য আমরা ইতস্তত করব না।’ ইসরাইল সরকার ও আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের কিছু গ্রুপের মধ্যে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এ সম্প্রদায় ‘সাধারণভাবে এমন নীতি গ্রহণ করে যে, মৌলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে জনসমক্ষে ইসরাইলের কোনো সমালোচনা করা যাবে না।’ স্টিভেন রোসেনথেলের মতে, ‘আমেরিকার লাখ লাখ ইহুদির কাছে ইসরাইলের সমালোচনা করা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করার চেয়েও অত্যন্ত খারাপ পাপ।’ বুকবাইন্ডার একবার স্বীকার করেন যে, ‘ইসরাইল সরকারকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করবে কিনা ইহুদিদের এমন অপরাধবোধ আছে… এ কারণেই তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একই পথ অবলম্বন করে।’ মার্কিন ইহুদিদের মতামত নিয়ে সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, সাধারণভাবে দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা একমত যে, ‘আরবদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত মতামত থাকলেও মার্কিন ইহুদিদের উচিত যথাযথভাবে নির্বাচিত ইসরাইল সরকারের নীতি সমর্থন করা।’ ইসরাইলের নীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি-আমেরিকান সংগঠনগুলোর নেতা ও সব শ্রেণীর লোকের এমন আন্তরিক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা ইসরাইল সরকারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টির জন্য সাধারণত মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করে না। গত কয়েক দশকে একাধিক ঘটনায় জনসমক্ষে সমালোচনার বিরুদ্ধে একটা সাধারণ নিয়ম স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রগতিশীল একদল মার্কিন ইহুদি ‘ব্রেইরা’ (যার অর্থ বিকল্প) নামে একটা নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ওই সংগঠন ইসরাইল ও বিদেশে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহবান জানায়। তারা অধিকৃত এলাকা থেকে প্রত্যাহার ও প্যালেস্টাইনের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত সংগঠন করতে চায়। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি জনসমক্ষে পরিচিত করার লক্ষ্যে আমেরিকার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়াও অনেক ‘ব্রেইরা’ নেতা মার্কিন ইহুদি প্রতিনিধি দলে যোগ দেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে একদল প্যালেস্টাইন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করে আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি। কিছু সংখ্যক ইহুদি নেতা ‘ব্রেইরা’কে সমর্থন করলেও প্রধান প্রধান ইহুদি সংগঠনের শক্তিশালী সদস্যরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ‘নিয়ার ইস্ট রিপোর্ট’ ইসরাইলের প্রতি সমর্থনকে অবমূল্যায়ন করার জন্য ‘ব্রেইরা’কে অভিযুক্ত করে। রিফর্ম রাবিবনেটের প্রেসিডেন্ট আর্থার লিলাইভেল্ড বলেন যে, ‘ব্রেইরা’র মতো সংগঠনগুলো ‘তাদেরকে সহায়তা ও স্বস্তি দেয় যারা ইসরাইলকে সহায়তা কমিয়ে দেয় এবং হত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের সামনে ইসরাইলকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে দেয়।’ হাডাসার এক নিউজলেটার-এ ‘ব্রেইরা’ সদস্যদের ‘পরাজিত মনোভাবের উৎফুল্ল নেতা’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং নিজেদের সদস্যদের এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, তারা যেন ‘ওই ধরনের সংগঠন ও তাদের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে যা ইসরাইলের নিরাপত্তা ও ইহুদিদের অস্তিত্বের বিপরীত।’ কনজারভেটিভ রাবিবনিক্যাল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, ‘ব্রেইরা’ হলো ‘পিএলও-এর সম্মুখভাগ।’ অপরদিকে ৪৭ জন রাবিব এক বিবৃতিতে ব্রেইরার অবস্থাকে ‘বাস্তবে আরব দৃষ্টিভঙ্গির মতো’ বলে মন্তব্য করেন। ‘প্রো-সেটেলমেন্ট গ্রুপ আমেরিকানস ফর এ সেফ ইসরাইল’ ৩০ পাতার একটা পুস্তিকা বিতরণ করে। ওই পুস্তিকায় অন্যান্য বামপন্থী শাখার লক্ষ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য ‘ব্রেইরা’ নেতৃবৃন্দকে অপবাদ দেওয়া হয়। তাদের তারা ‘ফাতাহ্র ইহুদি’ বলে আখ্যায়িত করে। জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার ম্যাগাজিন ‘আমেরিকান জাইয়নিস্ট’ স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘ব্রেইরা’কে অভিযুক্ত করে। তারা সতর্ক করে দেয় যে, যেসব ইহুদি জনসমক্ষে ‘অন্যায়’ বলে চিৎকার করে তাদের নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কাজের ফল সম্পর্কে অনুধাবন করা উচিত… তারাই শুধু আলাদা অনুভব করে না, বরং হাজার হাজার মাইল দূরের সহযোগী ইহুদিরাও আলাদা অনুভব করে।’ এসব আক্রমণের মুখে ‘ব্রেইরা’ আলোচনার জন্য খোলামেলা পরিবেশ অনুসরণ বা প্রতিষ্ঠিত করার প্রায় কোনো সুযোগই পায় না। স্থানীয় সম্প্রদায় গ্রুপগুলো ‘ব্রেইরা’ প্রতিনিধিদের বাদ দেয়। আর জুইশ কমিউনিটি কাউন্সিল অব নিউ হ্যাভেন শুধুমাত্র স্থানীয় ‘ব্রেইরা’ চ্যাপ্টারকে প্রবেশাধিকারে সম্মত হয় এই শর্তে যে, তাদের সমালোচনা তারা শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। আমেরিকান জুইশ কমিউনিটি অভ্যন্তরীণভাবে একটা স্মারকপত্র তৈরি করে – এতে ওই গ্রুপকে কো-অপ্ট করার সুপারিশ করা হয়। তবে ওই গ্রুপকে সম্মত হতে হবে যে তারা ‘ইসরাইল ও বিদেশে বসবাসরত ইহুদিদের মধ্যকার স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের ভিন্নমত তারা শুধু ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছেই প্রকাশ করবে এবং সাধারণ জনগণের কাছে আবেদন জানানো থেকে বিরত থাকবে।’ নিয়মিতভাবে তহবিল পেতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং নেতাদের দলত্যাগের কারণে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। পাঁচ বছর পর ‘ব্রেইরা’ ভেঙে যায়। ‘ব্রেইরা’ বিতর্কের পর কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস, সিনাগগ কাউন্সিল অব আমেরিকা, আমেরিকান জুইশ কমিটি ও ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের মতো সংগঠনগুলো দলত্যাগের যথার্থ স্থান নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে গবেষণা বা গণতদন্ত করে। জে. জে. গোল্ডবার্গের মতে, ‘এসব সংগঠন একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় : আমেরিকার ইহুদিদের স্বাধীনভাবে যে কোনো বিষয় আলোচনা করার অধিকার আছে, তবে তা হতে হবে জনসমক্ষের বাইরে বিচক্ষণ ফোরামের মধ্যে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত সিমচা দিনিৎজ ১৯৭৬ সালে ন্যাশনাল জুইশ কমিউনিটি রিলেশনস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের সঙ্গে কাজ করে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আচার-আচরণ পরিচালনার কতিপয় মূলনীতির নির্দেশিকা তৈরি করেন। গোল্ডবার্গ উল্লেখ করেন, প্রথম নীতি হলো এই যে, ‘ইসরাইলের নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র ইসরাইল জনগণের।’ দ্বিতীয় নীতি হলো : ‘আমেরিকার ইহুদিরা ইসরাইলের পাশে প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণ করবে, তবে কথার বিতর্ক হবে গোপনে।’ এডওয়ার্ড টিভন্যান লেখেন যে, গত শতকের সত্তর দশকে ‘সারা আমেরিকায় স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের জন্য ইসরাইলের পুরো সমর্থন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।’ ইসরাইলি নীতি সম্পর্কে প্রকাশ্য সমালোচনার বিরুদ্ধে যে নিয়ম ছিল তার অধিকাংশই অটুট থাকে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মর্টন ক্লেইন অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের প্রধান আব্রাহাম ফক্সম্যানের কাছে একটা চিঠি দেন। অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের এক নৈশভোজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস এল. ফ্রেইডম্যানকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ওই চিঠিতে প্রতিবাদ জানানো হয়। তিনি অভিযোগ করেন যে, ফ্রেইডম্যান ‘নিয়মিতভাবে ইসরাইল ও এর প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর নিন্দা করে।’ ক্লেইন অতঃপর ওই চিঠি কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের কর্মকর্তাদের কাছে বিলি করেন। যার ফলে ফক্সম্যান তাকে ‘থট পুলিশম্যান’ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এ বিরোধ আরো গভীর হয় যখন নেতানিয়াহুর কমিউনিকেশন পরিচালক এর গভীরতা অনুধাবন করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, ‘জাইয়নিস্টের মতো মনে হয় এমন কোনো সংস্থায়’ ফ্রেইডম্যানকে মঞ্চে কথা বলতে দেওয়া উচিত নয়। ইসরাইলের কোনো কোনো নীতির সমালোচনা করলেও ফ্রেইডম্যান প্রায় মোটেও ইসরাইলবিরোধী ছিলেন না। আর ফক্সম্যান নিজে ছিলেন ইসরাইলের অতি অত্যুৎসাহী একজন সমর্থনকারী। কিন্তু ক্লেইনের জবাব থেকে দেখা যায়, খোলামেলা আলোচনার বিরোধিতা কতটা গভীর হতে পারে। এর কয়েক বছর পর ওয়ার্লড জুইশ কংগ্রেসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এডগার ব্রন্ফম্যান সিনিয়রকে ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। কারণ তিনি প্রেসিডেন্ট বুশকে অনুরোধ জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন যে, বিতর্কিত ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী’ নির্মাণ কাজে বাধা দিতে তিনি যেন ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। কংগ্রেসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আইসি লাইয়েবলার ঘোষণা করেন যে, ‘ইসরাইল সরকারের অনুসৃত নীতি প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে লবিং করা ওয়ার্লড জুইশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের জন্য যে কোনো সময় একটা নোংরা কাজ।’ দু’বছর পর লাইয়েবলার এবং অন্যরা একইভাবে বুঝতে পারেন যে, মধ্যপন্থী ইসরাইল পলিসি ফোরামের প্রেসিডেন্ট সিমোর রিচ ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিজা রাইসকে গাজা স্ট্রিপ পার হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য ইসরাইলকে চাপ দেওয়ার পরামর্শ দেন। রাইসের কাছে রিচের পরামর্শ ছিল যৌক্তিক এবং সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু লাইয়েবলার তার ওই কাজকে ‘দায়িত্বহীন আচরণ’ বলে দোষারোপ করেন। অপরদিকে অর্থোডক্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন স্যাভিৎজকি বলেন যে, এটা ‘ইসরাইল সরকারের প্রতি শুধু অসম্মানজনক নয়, বরং এমন উদ্যোগকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানকারী লাখ লাখ মার্কিন ইহুদির প্রতি আক্রমণাত্মক।’ লাইয়েবলার আরো সতর্ক করে দেন যে, ‘বিশ্বজুড়ে বসবাসকারী ইহুদিদের প্রধান ধারার নেতৃবৃন্দ যখন মনে করেন যে তারা ইসরাইলের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নিরাপত্তা নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে লবি করতে পারেন তখন তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে কিছুটা খারাপ পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে। এ ধরনের আচরণ যদি সহ্য করা হয় তাহলে আমরা অবশিষ্ট একটা মিত্রকেও বাদ দিতে পারি – আর ওই মিত্র হলো বিদেশে বসবাসরত ইহুদি।’ এসব আক্রমণের কাছে নীতি স্বীকার করে রিচ বলেন যে, ‘চাপ শব্দটা আমার শব্দতালিকায় নেই যখন তা ইসরাইলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।’ ইসরাইলের নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার অনীহা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। ইসরাইলের শত্রুদের সহায়তা করতে পারে এমন কোনো কথা বলা থেকে বিরত থাকার স্পষ্ট আগ্রহ ছাড়াও যে সব গ্রুপ বা ব্যক্তি ইসরাইলের নীতি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করে তাদের পক্ষে সমর্থন বজায় রাখা ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তহবিল জোগাড় করা খুবই কষ্টকর। বড় বড় প্রধান ধারার সংগঠন দ্বারা তাদের সমাজচ্যুত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। আমেরিকানস ফর পিস নাও, টিককুন কমিউনিটি, ইসরাইল পলিসি ফোরাম এবং নিউ ইসরাইল ফান্ডের মতো গ্রুপ টিকে আছে এবং তা প্রসারিত হলেও ‘ব্রেইরা’ টিকে থাকতে পারেনি। অন্যান্য প্রগতিশীল ইহুদি গ্রুপ, যেমন নিউ জুইশ এজেন্ডা ‘ব্রেইরা’র মতো বিরোধিতার সম্মুখীন হয় এবং মাত্র এক দশকের সামান্য বেশি সময় টিকে থাকে। একইভাবে, আমেরিকানস ফর পিস নাউ বিবাদপূর্ণ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৯৩ সালে কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসে অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রগ্রেসিভ মেরেত্জ ইউএসএ এবং রিকনস্ট্রাকসনিস্ট রাবিবনিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ওই কনফারেন্সের অভ্যন্তরের মধ্যপন্থী গ্রুপের সমর্থন পাওয়ার পরও ২০০২ সালে এর সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করা হয়। একইভাবে সানফ্রানসিসকো এলাকায় ইহুদি সম্প্রদায়ের একটা প্রধান অনুষ্ঠানে জুইশ ভয়েস ফর পিসকে স্থান দিতে অস্বীকার করা হয়। এ গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা পর্যাপ্তভাবে ইসরাইল সমর্থক নয়। টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে হিল্লেল চ্যাপ্টারও জুইশ স্টুডেন্টস ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটসকে একটা স্টাডি গ্রুপ পরিচালনার জন্য স্থান দিতে অস্বীকার করে। ভিন্নমত পোষণকারী ইহুদি কণ্ঠকে কোণঠাসা করার প্রয়াস এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্ট নীরবতা ভঙ্গ করে ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরব হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলে অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাজের সমালোচনাকারী সাবেক ইসরাইল সৈনিকদের সংগঠন, জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করে এবং দাবি করে যে, তাদেরকে ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন থেকে বহিষ্কার করা হোক। ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন হলো ইসরাইল সমর্থকগোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক, যার মধ্যে আছে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ও অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ। জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার ক্লেইনের মতে, ‘ইসরাইলের সমালোচনাকারী গ্রুপগুলোকে স্পন্সর করা ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের মিশন নয়।’ ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্টের পরিচালক জোর দিয়ে বলেন যে, এ গ্রুপের ‘ইসরাইলের প্রতি ভালোবাসা’ আছে। অন্যান্য গ্রুপও তাদের সমর্থন করে। তবু ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের স্টিয়ারিং কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার দাবি বাতিল করে দেয়। হতাশ না হয়ে ক্লেইন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদেরকে দোষারোপ করে বলেন, ‘তাদের মিশনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে যুদ্ধের উদ্দীপনা। তবু আমরা বিস্মিত যে, ইসরাইলি কর্তৃক ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই উদ্দীপনাকে তারা উপেক্ষা করছে।’ জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা একটা প্রেস রিলিজ ইস্যু করে – এতে ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশনের সদস্য সংগঠনগুলোকে তাদের ভোট পরিবর্তনের আহবান জানানো হয়। ওই প্রেস রিলিজে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা রিপোর্টের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, যাতে বলা হয়, ‘এসব সংগঠনকে সহায়তা, এমনকি স্পন্সর করার জন্য ইহুদি সম্প্রদায়ের আগ্রহ দুঃখজনক… ইসরাইলের ভাবমূর্তির ওপর তাদের নেতিবাচক ফলাফলকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ ইসরাইল অন ক্যাম্পাস কোয়ালিশন স্টিয়ারিং কমিটির অন্তত একটা অর্থোডক্স গ্রুপ এরপর ঘোষণা করে যে, এটা এখন ইউনিয়ন অব প্রগ্রেসিভ জাইয়নিস্টসকে অপসারণের পক্ষে। লবি ডানদিকে ঝুঁকে পড়েছে অধিকাংশ আমেরিকান ইহুদি অনেকদিন থেকেই উদার দৃষ্টিভঙ্গী ও গণতান্ত্রিক দলকে সমর্থন করেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সংকট নিরসনে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’কে সমর্থন করে। তবু লবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপগুলো সময়ের ব্যবধানে ক্রমাগতভাবে রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আছে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ও কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস। এসব গ্রুপ এখন পরিচালিত হচ্ছে কট্টরপন্থীদের দ্বারা – তারা ইসরাইলে বৈদেশিক নীতিতে বল প্রয়োগে বিশ্বাসী তাদের প্রতিপক্ষদের অবস্থানকে সমর্থন করে। জে. জে. গোল্ডবার্গ তার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘জুইশ পাওয়ার, দি সিক্স ডে ওয়ার অ্যান্ড ইটস আফটারম্যাথ’-এ বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় ‘নতুন ইহুদি’দের একটা গ্রুপকে লক্ষ্যণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। ওইসব ‘নতুন ইহুদি’ অসামঞ্জস্যভাবে এসেছে কট্টরপন্থী জাইয়নিস্ট, অর্থোডক্স ও নয়া-রক্ষণশীল গোষ্ঠী থেকে। ‘তাদের বিরোধিতা এমন জোরালো ও তাদের ক্রোধ এমন গভীর যে’ তিনি লেখেন, ‘ইহুদি সম্প্রদায়ের অবশিষ্টরা সম্ভ্রমের সঙ্গে পেছনে থাকে এবং নতুন ইহুদিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে দেয়। সংখ্যালঘিষ্টদের সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা ইহুদি রাজনীতির প্রভাবশালী কণ্ঠ হয়ে ওঠে।’ এ ধারা আরো শক্তিশালী হয় ১৯৭৪ সালের জ্যাকসন-বণিক সংশোধনের পক্ষে প্রচারের মাধ্যমে – ওই সংশোধনের ফলে সোভিয়েট ইউনিয়নের জন্য অত্যন্ত অনুকূল রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মর্যাদার সঙ্গে ব্যাপকহারে ইহুদি দেশান্তর অনুমোদনে মস্কোর আগ্রহ সংশ্লিষ্ট হয়। ওই ধারা জোরদার হওয়ার সঙ্গে আরো যুক্ত হয় তথাকথিত নতুন রক্ষণশীল আন্দোলনের শুরু ও অগ্রগতি এবং ইসরাইলের লেবার পার্টির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সময়কালে ইসরাইল সমর্থক সংগঠনগুলোর কট্টরপন্থীদের সমর্থন আদায় ও জোরদার করতে লিকুড পার্টির সফল প্রয়াস। গোল্ডবার্গের মতে, ‘শামিরের কৌশল দক্ষতা ছিল ইহুদি প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সুবিধাজনকভাবে কাজে লাগানো, যেন কোনো পক্ষ অবলম্বন ছাড়াই তারা সরকারের অর্ধেক অংশীদার লিকুড পার্টির কণ্ঠ হয়ে ওঠে।’ লিকুড পার্টির কর্মকর্তারা (প্রধানমন্ত্রী শামিরের চিফ অব স্টাফ ইয়োসি বেন-আহরণসহ) এটা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যে, কনফারেন্স অব প্রেসিডন্টসের চেয়ারম্যান হবেন রক্ষণশীল কর্মকর্তারা। তারা ১৯৮৬ সালে কনফারেন্সের নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে ম্যালকম হোসেন লিনকে মনোনীত করার কাজে সহায়তা করে। ইসরাইলী নেতারা অনেক কট্টরপন্থী গ্রুপকে অধিক মাত্রায় গ্রহণ ও তাদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। এর ফলে এ ধারণা জোরদার হয়, তারাই হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বমূলক কণ্ঠ। লেবার পার্টি নেতার উপদেষ্টা হিসেবে শিমন পেরেজ পরে স্বীকার করেন, ‘আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের উপেক্ষা করে আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম… শামিরের লোকেরা যা করতে চেয়েছিল আমরা তাদের তা করতে দিয়েছিলাম।’ লবির কিছু কিছু প্রধান সংস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা থেকে ডানপন্থী ধারার প্রতিফলন ঘটে। এছাড়া কিছুসংখ্যক সম্পদশালী রক্ষণশীল লোকদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকেও তা দৃশ্যমান হয়, যারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো সংগঠনে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসে পঞ্চাশটার বেশি সংগঠনের প্রতিনিধি আছে এবং ছোট-বড় নির্বিশেষে প্রত্যেক সংগঠনের একটা করে ভোট আছে। মাইকেল ম্যাসিং উল্লেখ করেন, ‘কনফারেন্সে ছোট ছোট রক্ষণশীল গ্রুপ নিশ্চিতভাবে বড় উদার গ্রুপের চেয়ে সংখ্যায় বেশি এবং এ কারণে তারা তাদের (উদার গ্রুপ) প্রভাবকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। এর ফলে ম্যালকম হোয়েনলিনের (নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান) হাতে ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। হোয়েনলিন দীর্ঘকাল ধরে ইসরাইলের সেটলার আন্দোলনের সমর্থক এবং তিনি অসলো শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। একইভাবে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের সদস্য পদের ভিত্তি হলো প্রত্যেক ডাইরেক্টরের আর্থিক অনুদান, ম্যাসিং বলেন যে, ‘আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য হিসেবে কতোটা ভালোভাবে কাজ করেন তার ওপর ভিত্তিশীল নয়।’ যেসব ব্যক্তি আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে (এবং সহানুভূতিশীল রাজনীতিকদের) বেশি অংকের অর্থ অনুদান দিতে আগ্রহী হয় তাদের ইসরাইলের উৎসাহী রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য করার ধারা বিদ্যমান আছে। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব (সাধারণত এ সংগঠনের সাবেক প্রেসিডেন্ট) অধিকাংশ ইহুদি আমেরিকানদের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে অধিকতর বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি যদিও ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অসলো শান্তি প্রক্রিয়াকে অনুমোদন করে তবু একে কার্যকর করতে কাজ করে খুব কম এবং ১৯৯৯ সালে এহুদ বারাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ধারনাকে অনুমোদন না করেই এর বিরোধিতাকে বাদ দেয়। বস্তত, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং অন্যান্য কট্টরপন্থী গ্রুপ ইসরাইল সরকার সমর্থন না করলেও অধিক চরম অবস্থাকে মাঝে মাঝে সমর্থন করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৪ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে অধিক বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা ফরেন এইড বিল সংশোধনে সফলভাবে লবিং করে – সংশোধিত আইনে প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর অতিরিক্ত বাধানিষেধ আরোপ করা হয়। ক্লিনটন প্রশাসন এবং ইসরাইলে রবিন সরকার অবশ্য ওই ব্যবস্থার বিরোধিতা করে। কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস কখনো অসলো শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি, আর আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ১৯৯৫ সালের জেরুজালেম এমব্যাসি অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগে সহায়তা করে – এর স্পষ্ট প্রয়াস ছিল তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। বস্তুত, আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির অভ্যন্তরীণ সার্কেলের প্রধান দাতারা নির্বাহী পরিচালক টুম ডাইনকে বহিষ্কার করে। কারণ, তার দৃষ্টিভঙ্গীতে পররাষ্ট্র বিষয়ে বলপ্রয়োগের বিষয়টা যথেষ্ট ছিল না এবং তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় স্বাধীন। লবির মধ্যকার প্রধান সংগঠনগুলো পরিচালনা ও প্রভাবিত করার চরম দৃষ্টিভঙ্গির লোকদের এ ধরনের প্রবণতা ছাড়াও আর একটা উপাদান এই যে, ইসরাইল সমর্থক অনেক গোষ্ঠী ডান চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর লক্ষ্য হলো, চাঁদার প্রবাহ অব্যাহত রাখা। ওয়াক্সম্যান বলেন, ‘অনেক আমেরিকান জুইশ সংগঠনের পক্ষে এখন তাদের নিজের অস্তিত্বের বৈধতার জন্য ইসরাইলকে প্রয়োজন। ইসরাইলের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ওইসব সংগঠন গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখন তাদের অব্যাহতভাবে টিকে থাকার জন্য ইসরাইল হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যক।’ ইসরাইলকে অবরুদ্ধ ও সমালোচনার যোগ্য গণ্য করে অব্যাহত বা ক্রমাগতভাবে সেমিটিক বিরোধী বলে বেশি করে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তারা সম্ভাব্য সমর্থকদের গভীরভাবে উদ্বিগ্নের মধ্যে রাখে এবং এভাবে ওইসব সংগঠন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিশ্চিত করে। উত্তর আমেরিকার জুইশ এডুকেশন সার্ভিসের জোনাথন উচার ১৯৯২ সালে লেখেন : ‘আমরা আমেরিকায় একেবারে নতুন এক শিল্পের উত্থান লক্ষ্য করেছি, আর তা হলো বিভিন্ন সংগঠন, যার কাজ হলো মনিটরিং এবং সারাবিশ্বে সেমিটিক বিরোধী যুদ্ধের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা… এ ব্যাপারে সাইমন ওয়াইসেনদাল সেন্টারের সাফল্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ইহুদি নিরাপত্তার জন্য তা হুমকিস্বরূপ সেমিটিক বিরোধীর খোঁজে তা অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের চেয়ে বেশি সরাসরি ফান্ড সংগ্রহের প্রধান সংগঠন হয়ে ওঠে। সেমিটিক বিরোধী যুদ্ধে কে বেশি ‘কঠোর’ তা সংগঠনগুলোর মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর সেমিটিক বিরোধী ওই যুদ্ধ চালানো হয় ইহুদি সংবাদপত্রে এবং সরাসরি মেইল করে আবেদনের মাধ্যমে।’ এর তিন বছর পর নিউইয়র্ক টাইমসের টমাস এল ফ্রেডম্যান মন্তব্য করেন, ‘মি. রবিন ও মি. আরাফাত করমর্দন করার দিন থেকে আমেরিকান জুইশ গ্রুপের প্রধান ধারার গ্রুপগুলো তাদের সাদামাটাভাবে গ্রহণ করে। এরমধ্যে আছে কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টস। অন্যসব গোঁড়া ও শাখা ইহুদি গ্রুপগুলো সরাসরি এর বিরোধিতা করে। মনে হয় এসব সংগঠন তখনই কেবল সক্রিয় হয়ে ওঠে যখন তারা কোনো শত্রু বা লড়াই করার জন্য কাউকে পায়।’ এসব ঘটনা থেকে বার বার স্পষ্ট হয় যে, আমেরিকান জুইশ কমিউনিটির বেশ কয়েকটা গ্রুপ ইসরাইলের কিছু কিছু নীতি, বিশেষ করে অধিকৃত এলাকায় এর অব্যাহত অবস্থানের সমালোচনা করে। এর মধ্যে কিছু কিছু সংগঠন, যেমন ইসরাইল পলিসি ফোরাম শান্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। সাম্প্রতিককালে তারা আইন পরিষদে কিছু ছোট-খাটো বিষয়ে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। তবু এসব গ্রুপের আর্থিক সম্পদ নেই এবং আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ, জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা বা কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের মতো প্রভাব নেই। ওইসব গ্রুপের ডান-ঘেঁষা মধ্যপন্থী মতামতকে দুঃখজনকভাবে রাজনীতিক ও নীতি-নির্ধারকরা এবং আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের প্রতিনিধিত্বমূলক কণ্ঠ বলে মিডিয়া গ্রহণ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে লবির প্রধান সংগঠনগুলো অনেক লোকের সঙ্গে অসম নীতিগত অবস্থানকে সমর্থন করে, তারা দাবি করে, ওইসব লোকের জন্যই তারা কথা বলে। নিউ কন বা রক্ষণশীলদের ভূমিকা লবির ডানপন্থার দিকে যাওয়ার প্রবণতা আরো শক্তিশালী হয় নিও কনজারভেটিভ বা নয়া রক্ষণশীলদের উত্থানের পর। সত্তর দশক থেকে আমেরিকার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক জীবনে নয়া রক্ষণশীল আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ওই বিষয়টার দিকে বিশেষ দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বুশ প্রশাসনের এককভাবে পররাষ্ট্র নীতি এবং বিশেষভাবে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নয়া রক্ষণশীলবাদ একটা রাজনৈতিক আদর্শ- এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে স্পষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখানে শুধু পররাষ্ট্রনীতিই প্রাসঙ্গিক। অধিকাংশ নয়া রক্ষণশীল আমেরিকার কর্তৃত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করে। কখনো কখনো তারা আমেরিকান সাম্রাজ্যের ধারণারও প্রশংসা করে। তারা বিশ্বাস করে যে, গণতন্ত্রের বিস্তারে এবং এমনকি আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতার চেষ্টাকারী সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে অনুৎসাহিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে ব্যবহার করা উচিত। তাদের মতে, গণতন্ত্রের বিস্তার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার পথই হলো দীর্ঘস্থায়ী শান্তির উত্তম পথ। নয়া রক্ষণশীলরা আরো বিশ্বাস করে, আমেরিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এটা নিশ্চিত করে যে অধিকাংশ দেশ ওই পদ্ধতিকে সদয় প্রাধান্য বলে দেখবে এবং মার্কিন নেতৃত্বকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে; তবে শর্ত হলো, তা যদি দৃঢ়সংকল্পের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিষয়ে তারা সন্দেহপ্রবণ বিশেষভাবে জাতিসংঘের ব্যাপারে। এ সংস্থাকে তারা ইসরাইলবিরোধী এবং আমেরিকার স্বাধীনভাবে কাজ করার পক্ষে বাধাস্বরূপ বলে মনে করে। তারা অনেক মিত্রের ব্যাপারেও সতর্ক (বিশেষ করে ইউরোপীয়দের ব্যাপারে- তাদেরকে তারা গণ্য করে আদর্শবাদী-শান্তিবাদী যারা মার্কিনিদের যুদ্ধ বন্ধের কথা বলে স্বাধীনভাবে চলতে চায়)। নয়া রক্ষণশীলদের ‘প্রজেক্ট ফর নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির’ ওয়েবসাইটের উদ্ধৃতি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ‘আমেরিকা ও বিশ্ব উভয়ের জন্য ভালো’। নয়া রক্ষণশীলরা সাধারণভাবে মার্কিন শক্তিকে এককভাবে কার্যকর করার পক্ষপাতী। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নয়া রক্ষণশীলরা বিশ্বাস করে যে বিশ্বকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করার জন্য সামরিক শক্তি একটা অতি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার এবং এতে আমেরিকা লাভবান হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সামরিক শৌর্য প্রদর্শন করে এবং দেখায় যে, সে তার অধীন ক্ষমতা ব্যবহার করতে ইচ্ছুক, তাহলে মিত্ররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব অনুসরণ করবে এবং সম্ভাব্য বিরোধীরা অনুধাবন করবে যে প্রতিরোধ করা অর্থহীন। তখন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সংক্ষেপে, নয়া রক্ষণশীলবাদ হলো বিশেষভাবে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বল প্রয়োগে বিশ্বাসী রাজনৈতিক আদর্শ। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে নয়া রক্ষণশীলরা প্রভাবশালী পদে আসীন হয়। খ্যাতনামা নয়া রক্ষণশীলদের মধ্যে আছে সাবেক ও বর্তমান নীতিনির্ধারক, যেমন ইলিয়ট আব্রামস, কেনেথ এডেলম্যান, উইলিয়াম বেনেট, জন বোল্টন, ডগলাস ফেইথ, পরলোকগত জিনে কির্কপ্যাট্রিক, আই.লিউস ‘স্কুটার’ লিবিব, রিচার্ড বার্লি, পল উলফোইৎজ, জেমস উলসে এবং ডেভিড উর্মসার। সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন পরলোকগত রবার্ট বার্টলে, ডেভিড ব্রুকস, চার্লস ক্রাউথ্যামার, উইলিয়াম ক্রিস্টল, ব্রেট স্টিফেন্স এবং নর্মান পুধোরেৎজ। শিক্ষাবিদদের মধ্যে আছেন ফওয়াদ আজামি, ইলিয়ট কোহেন, আরন ফ্রেইডবার্গ, বার্নার্ড লুইস এবং রুথ ওয়েজউড, থিংক-ট্যাংক পন্ডিতদের মধ্যে আছেন ম্যাক্স বুট, ডেভিড ফ্রাম, রিউয়েল মার্ক জেরেস্ট, রবার্ট কাগান, মাইকেল লেডিন, জশুয়া মুরাভচিক, ডেনিয়েল পাইপস, ডেনিয়েলে প্লেথকা, মাইকেল রুবিন এবং মেয়ারভ উর্মসার। নয়া রক্ষণশীলদের প্রধান সাময়িকী ও সংবাদপত্রের মধ্যে আছে কমেন্টারি, নিউইয়র্ক সান, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ড। এই নয়া রক্ষণশীলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে অনেক থিংক ট্যাঙ্ক ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপ জড়িত আছে। এরা হলো আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইনস্টিটিউট, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, মিডল ইস্ট ফোরাম, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেনচুরি এবং ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি। আসলে নতুন সব রক্ষণশীলই ইসরাইলের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ – এ বিষয়টা তারা খোলাখুলি এবং অপরাধবোধ না করেই প্রকাশ করে এবং গুরুত্ব দেয়। একজন প্রভাবশালী নয়া রক্ষণশীল পন্ডিত ম্যাক্স বুটের মতে, ইসরাইলকে সমর্থন করা হলো ‘নয়া রক্ষণশীলবাদের একটা প্রধান নীতি’। এ অবস্থাকে তিনি মূল্যায়ন করেন ‘অংশীদারিত্বের উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ হিসেবে। বেঞ্জামিন জিনসবার্গ নামে একজন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আমেরিকান রাজনীতি ও সেমিটিক-বিরোধী বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন। তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, নয়া রক্ষণশীলদের ডানপন্থী হওয়ার একটা প্রধান কারণ হলো ‘ইসরাইলের প্রতি তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং ষাটের দশকে একটা গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে থাকার সময় তাদের ক্রমবর্ধমান হতাশা- ওই দল আমেরিকার সামরিক প্রস্তুতির বিরোধিতা এবং তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থের প্রতি ক্রমাগতভাবে অনুরক্ত হয়ে ওঠে।’ জিনসবার্গ নির্দিষ্টভাবে লেখেন যে, তারা রোনাল্ড রিগানের ‘কঠোর কমিউনিজম বিরোধী’ নীতিকে সমর্থন করে। কারণ তারা ওই নীতিকে দেখতে পায় একটা ‘রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে যা ইসরাইলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে।’ নয়া রক্ষণশীলরা ছিল বৈদেশিক নীতিতে বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী এবং এ কারণে এটা বিস্ময়ের কিছু নয় যে, তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরের ডানপন্থীদের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা গড়ে তুলবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আটজন নয়া রক্ষণশীলের একটা গ্রুপ (এর নেতৃত্বে ছিলেন রিচার্ড পার্লে, এ গ্রুপে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন ডগলাস ফেইথ এবং ডেভিড উর্মসার) লিকুড দলের নতুন প্রধানমন্ত্রী রেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য ১৯৯৬ সালে ‘ক্লিন ব্রেক’ অর্থাৎ ‘স্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন’ সম্পর্কিত গবেষণার খসড়া তৈরি করে। ওই গবেষণায় সুপারিশ করা হয় যে, ইসরাইল অসলো শান্তি প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করুক এবং অবন্ধুসুলভ মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক শক্তিসহ সাহসী ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এবং অতঃপর আরব ইসরাইল যুদ্ধে ‘উচ্চতর’ অবস্থান গ্রহণ করুক। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রসারমান অনেক থিংক ট্যাংক, কমিটি ও প্রকাশনার সঙ্গে অনেক নয়া রক্ষণশীল জড়িত। তাদের এজেন্ডার মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের উন্নয়ন করা। রিচার্ড পার্লের কথাই ধরুন। প্রসিদ্ধ নয়া রক্ষণশীলদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো। ডানপন্থী সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইনস্টিটিউট, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, মিডল ইস্ট ফোরাম এবং ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির উপদেষ্টা বোর্ডেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার সহকর্মী নয়া রক্ষণশীলরাও একইভাবে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত : উইলিয়াম ক্রিস্টল হলেন সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ডের সম্পাদক, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির সহপ্রতিষ্ঠাতা। পূর্বে তিনি জড়িত ছিলেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, মিডল ইস্ট ফোরাম এবং আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট চার্লস ক্রাউথামার আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের আরভিং ক্রিস্টল পুরস্কার পান (নয়া রক্ষণশীলবাদের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন উইলিয়ামের পিতার নামে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়)। এছাড়া তিনি ছিলেন প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির পক্ষে অনেক খোলা চিঠির স্বাক্ষরকারী, সাপ্তাহিক স্টান্ডার্ডের কন্ট্রিবিউটিং সম্পাদক। তিনি ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এর সঙ্গে অতীতে যারা জড়িত ছিলেন এবং বর্তমানে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের নামের তালিকা থেকে এর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এরা হলেন- এলিয়ট আব্রামস (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, হডসন ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); উইলিয়াম বেনেট (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); জন বোল্টন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); ডগলাস ফেইথ (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স); ডেভিড ফ্রাম (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, উইকলি স্ট্যান্ডার্ড); রিউইয়েল মার্ক গেরেস্ট (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, উইকলি স্টান্ডার্ড); মাইকেল লেডিন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স); জিন কার্ক প্যাটরিক (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস, জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); জসুয়া মুরাভচিক (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); ডেনিয়েল পাইপস (প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, মিডলইস্ট ফোরাম, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি); নরম্যান পোধোরেজ (হডসন ইন্সটিটিউট, কমেন্টারি, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি); মাইকেল রুবিন (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, মিডলইস্ট ফোরাম); পল উলফোইৎজ, (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ারইস্ট পলিসি); ডেভিড উর্মসার (আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট, মিডলইস্ট ফোরাম, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস) এবং জেমস উলসে (সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, জুইশ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স, প্রজেক্ট ফর এ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি, ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস)। নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনের মধ্যকার এই পারস্পরিক সংশ্লিষ্টতার সারসংক্ষেপ কোনোভাবেই শেষ হওয়ার নয়। তবে অনেকের কাছে এটা কিছুটা ছায়ামূলক ষড়যন্ত্র বলে মনে হয় (বা অনেকের কাছে মনে হয় এমনকি এটা একটি ডানপন্থী গুপ্ত সমিতি)। এর বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের থিঙ্কট্যাংক, কমিটি, ফাউন্ডেশন ও প্রকাশনা নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখে, যেমনভাবে তা টিকিয়ে রাখে নীতির নেটওয়ার্ক। প্রচারণা থেকে বিরত না থেকে অথবা গুপ্ত কার্যক্রমে জড়িত না থেকে এসব গ্রুপ সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায় জনমত এবং এলিট অংশের মত গঠন করার জন্য। এভাবেই তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি গঠনে অগ্রসর হয়। নয়া রক্ষণশীল নেটওয়ার্ক নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কর সংস্কার, পরিবেশ বা দেশান্তর নীতির মতো এর নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। এটা ঠিক যে, নয়া রক্ষণশীলরা আমেরিকার নিরাপত্তার মতো ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতিও যত্নশীল। তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের নীতির ব্যবস্থাপত্র উভয় দেশকেই লাভবান করবে। যাহোক, আশির দশকে বেশকিছু প্রথাগত রক্ষণশীল দাবি করে যে, নয়া রক্ষণশীলরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরাইলের বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। দৃষ্টান্ত হিসেবে খ্যাতনামা রক্ষণশীল রাজনৈতিক তাত্ত্বিক রাসেল কির্কের কথা বলা যায়। তিনি বলেন, নয়া রক্ষণশীলদেরকে যা উদ্দীপ্ত করে তা হলো ইসরাইলকে রক্ষা করা। সবকিছুর পেছনে এটা বর্তমান থাকে। নয়া রক্ষণশীলরা এ অভিযোগ জোরের সঙ্গে অস্বীকার করে এবং এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল গ্রুপগুলোর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। ওই দ্বন্দ্ব এখন আর নেই, তবে রক্ষণশীল আন্দোলনের মধ্যকার দুই শাখার মধ্যে এখনো উত্তেজনা বিদ্যমান রয়েছে। অনেক ভাষ্যকার নয়া রক্ষণশীলদের ইহুদি উৎসের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যদিও এ আন্দোলনের প্রধান নীতিগুলোর অনেকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায় এখনো উদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত। ‘দি নিওকনজারভেটিভ রেভ্যুলিউশন : জুইশ ইনটেলেকচুয়ালস অ্যান্ড দি শেপিং অব পাবলিক পলিসি’ বইয়ে মুরে ফ্রাইডম্যান নয়া রক্ষণশীলবাদকে ‘আমেরিকান জুইস রক্ষণশীলবাদ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু নয়া রক্ষণশীলদের সবাই ইহুদি নয়। এ থেকে আমাদের মনে হয় যে, ধর্ম বা জাতিগতভাবে লবির ব্যাখ্যা করা হয়নি বরং এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে রাজনৈতিক এজেন্ডা দিয়ে। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব আছেন যারা নয়া রক্ষণশীলবাদের মূল সব নীতি গ্রহণ না করলেও এর অনেকটাই গ্রহণ করেছেন ইসরাইলের জন্য ব্যাপক সমর্থন অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তাদের মধ্যে এর কঠোর নীতি গ্রহণের প্রতি প্রবণতা দেখা যায়। এদের মধ্যে আছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদক রবার্ট বার্টলে, সাবেক শিক্ষাসচিব উইলিয়াম বেনেট, জাতিসংঘে নিয়োজিত সাবেক রাষ্ট্রদূত জন বোল্টন এবং জিনে কার্কপ্যাট্রিক এবং সিআইএ-এর সাবেক পরিচালক জেমস উলসে। নয়া রক্ষণশীল এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার জন্য এসব অ-ইহুদি ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর কেন্দ্রবিন্দুতে যেসব ইহুদি আছে তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এই অর্থে নয়া রক্ষণশীলবাদ হলো ব্যাপক ইসরাইল সমর্থক আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। আমেরিকান ইহুদিরা হলো নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনের মূল, যেমন তারা অধিকাংশ লবির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই অ-ইহুদিরা সক্রিয়। নয়া সংরক্ষণশীলরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব প্রতীকস্বরূপ। কারণ তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অধিকাংশ মার্কিন ইহুদির প্রথাগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইহুদি সমর্থক খ্রিস্টান এ লবির মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অইহুদি গ্রুপ আছে – এরা ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টস অর্থাৎ ইহুদীবাদী খৃষ্টান। এটা হলো ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক চিন্তাধারার খ্রিস্টান ডানপন্থী উপদল। এ গ্রুপের নামকরা সদস্যদের মধ্যে আছেন ধর্মীয় সব ব্যক্তিত্বরা। যেমন পরলোকগত জেরি ফালওয়েল, গেরি বাউয়ের, প্যাট রবার্টসন এবং জন হ্যাগি। এর সদস্যদের মধ্যে আছেন রাজনীতিবিদ, যেমন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা টম ডি’লে ও রিচার্ড আর্মে এবং সিনেটর জেমস ইনহোপে। ইসরাইলের প্রতি সমর্থন তাদের একমাত্র উদ্বেগের বিষয় না হলেও অনেক খ্রিস্টান ধর্মযাজককে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যপটে দেখা যায় এবং তারা ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে সোচ্চার। সম্প্রতি তারা অনেক সংগঠন গড়ে তুলেছেন তাদের অঙ্গীকারকে রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এক অর্থে বলা যায়, আমেরিকান ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভিন্ন ইসরাইল সমর্থক গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ক্রিশ্চিয়ান জাইয়নবাদের উৎস হলো বিধির বিধান ধর্মতত্ত্বে, যার বাইবেলীয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয় উনিশ শতকে, ইংল্যান্ডে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ধর্মযাজক মন্ত্রী লুইস ওয়ে এবং জন লেনসন ডার্বি। বিধির বিধান মতবাদ হলো পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের পুনরাগমন সম্পর্কিত, যেখানে বলা হয়েছে, যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে না আসা পর্যন্ত বিশ্ব দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষ করবে। অনেক খ্রিস্টানের মতো বিধির বিধানে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করত যে, যিশুখ্রিস্টের পুনরায় এ বিশ্বে আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টে। ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে ফিরে যাবে – এটা একটা প্রধান ঘটনা যা একটা পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া, যা যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমনের আগে সংঘটিত হবে। ডার্বি, ওয়ে এবং তাদের অনুসারীদের ধর্মীয় মতবাদ বহু ইংরেজ রাজনীতিককে প্রভাবিত করে। এটাও হতে পারে যে, এভাবেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসস্থল সৃষ্টির ধারণায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ‘বিধির বিধান’ ধর্মতত্ত্ব উনিশ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এজন্য বেশ কয়েকজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সক্রিয় ছিলেন। এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন ধর্মযাজক ডুইট মুডি (শিকাগোর মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা), সিআই স্কোফিল্ড এবং উইলিয়াম ই-ব্লাকস্টোন। সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় বক্তব্য প্রচরিত হয়েছে সত্য ও অসত্যের কাল্পনিক যুগের বিবরণ সংবলিত হাল লিন্ডসের ‘লেট গ্রেট প্ল্যানেট আর্থ’ এবং টিমোথি লা’হায়েসের ‘লেফট বিহাইন্ড’ সিরিজে। এ দুই সিরিজের বিক্রীত সংখ্যা ৫০ মিলিয়নের বেশি বলে জানা যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিধির বিধান আন্দোলন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধকে নেতারা মূল্যায়ন করেন ‘খোদার অলৌকিক ঘটনা’ হিসেবে। আর ওই যুদ্ধের পর বিধির বিধান আন্দোলন রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ইসরাইল কর্তৃক জেরুসালেম ও পশ্চিম তীর দখলকে (লিকুড পার্টির মতো তারা পশ্চিম তীরকে জুডিয়া ও সামারিয়া বলে গণ্য করে) বিধির বিধানের সমর্থনকারীরা ব্যাখ্যা করেন ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন হিসেবে। এসব ‘নিদর্শন’ তাদের এবং অন্যান্য ধর্মযাজককে নতুন করে কাজ শুরু করতে উৎসাহিত করে যে, বাইবেলে বর্ণিত পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সঠিক পথে’ আছে। মেমফিস থিয়োলজিক্যাল সেমিনারির সাবেক প্রেসিডেন্ট টিমোথি ওয়েবারের মতে, ‘ছয় দিনের যুদ্ধের আগে বিধির বিধানের সমর্থনকারীরা ইতিহাসের সাধারণ দর্শকদের আসনে বসে মাটিতে ‘শেষ সময়ের খেলার ব্যাখ্যা করে তৃপ্ত হতো… কিন্তু পশ্চিমতীর ও গাজায় ইসরাইলের অগ্রাভিযানের পর তারা মাঠে নেমে পড়তে শুরু করে এবং নিশ্চিত হয় যে, সব দল লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় কাজে জড়িত হয়ে পড়ে; এর আগে তারা ওইসব কাজে জড়িত ছিল না।’ তাদের ওই প্রয়াস ছিল তথাকথিত খ্রিস্টান অধিকারের ব্যাপক উত্থান (তাদের অনেকে ইসরাইলের জোর সমর্থক ছিল না) এবং তাদের একাজে স্পষ্টভাবে সহায়ক হয় ধর্মযাজকদের আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রাধান্য। এসব বিশ্বাস থাকার পর ডেনিয়েল পাইপসের বিশ্বাস বিস্ময়কর কিছু ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ‘ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ছাড়া আমেরিকার খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা ইহুদি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কৌশলগত সম্পদ হতে পারে।’ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাবেক যোগাযোগ পরিচালক মাইকেল ফ্রেয়ান্ড ২০০৬ সালে লেখেন, ‘খ্রিস্টান জাইওনিস্টদের খোদাকে ধন্যবাদ। এটা পছন্দ করুন বা না করুন, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আমেরিকার খ্রিস্টানদের চেয়ে ইহুদিদের ওপর অনেক কম নির্ভরশীল হবে।’ খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা অনেক সংগঠন গঠন করে, যার ঘোষিত নীতি হলো ইসরাইলের প্রতি সমর্থনকে উৎসাহিত করা। এসব সংগঠনের মধ্যে আছে ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইল (এর প্রতিষ্ঠাতা জন হ্যাপি এটাকে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির খ্রিস্টান রূপ বলে মন্তব্য করেন), ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কনফারেন্স ফর ইসরাইল, ইউনিটি কোয়ালিশন ফর ইসরাইল, ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেন্ডস অব ইসরাইল কমিউনিটিজ, খ্রিস্টানস ইসরাইল পাবলিক অ্যাকশন কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান অ্যাম্বাসি জেরুসালেম এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ। খ্রিস্টান জাইওনিস্টরা আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ অব ক্রিশ্চিয়ানস আন্তর্জাতিক অ্যান্ড জুইসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকাগো ভিত্তিক এ সংগঠনটা পরিচালনা করেন রাবিব ইয়েমিয়েল ইকসটেইল। তার লক্ষ্য হলো ‘ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ইসরাইলের জন্য ব্যাপক সমর্থন গড়ে তোলা।’ ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অব ক্রিশ্চিয়ানস অ্যান্ড জুইস সাবেক ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশনের পরিচালক এবং জিওপি কৌশলবিদ রালফ রিডের সঙ্গে মিলে একটা নতুন গ্রুপ গঠন করে। ওই গ্রুপের নাম ‘স্ট্যান্ড ফর ইসরাইল, এর লক্ষ্য হলো আত্মিক ও রাজনৈতিকভাবে জনগণকে ইসরাইলের পক্ষে উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করা।’ তারা ইসরাইলের পক্ষে বছরে একবার ‘প্রার্থনা ও সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস’ পালন করে। সক্রিয় আন্দোলনের ওই আধুনিক যুগে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের স্বাভাবিক বিশ্বাস এই যে, তাদের আমেরিকা ও ইসরাইলের ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করতে হবে যারা বসতি আন্দোলনকে সমর্থন এবং দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতির বিরোধিতা করে। ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা হ্যাপির মতে, ‘আমরা ইসরাইলকে সমর্থন করি কারণ সব রাষ্ট্রই মানুষের বিধান দ্বারা সৃষ্ট, কিন্তু ইসরাইল সৃষ্টি হয়েছে খোদার বিধান দ্বারা।’ হ্যাপি তার অনুসারীদের আরো বলেন, ‘খোদা এ ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেন।’ তিনি দাবি করেন যে, অধিকৃত এলাকায় বসতিদের এবং ইসরাইলে নতুন দেশান্তরীদের সহায়তার জন্য তিনি ১২ মিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছেন। হ্যাপির দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিশ্চিয়ান জাইওনবাদের প্রতিনিধিত্বমূলক। এভানজেনিক্যাল রিলিজিয়াস রাউন্ডটেবলের প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘ক্রিশ্চিয়ান রাইট’-এর মধ্যে একজন প্রধান সাংগঠনিক শক্তি পরলোকগত অ্যাডওয়ার্ড ম্যাকাটির একবার ঘোষণা করেন যে, ‘মৃত সাগর, জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার প্রতিটি বালুকণা ইহুদিদের। এর মধ্যে আছে পশ্চিমতীর ও গাজা।’ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান অ্যাম্বাসি জেরুজালেমের পরিচালক ম্যালকম হেডিংয়ের মতে, ‘চার হাজার বছর আগে আব্রাহামের চুক্তির অধীন যে ভূমি খোদা দিয়েছিলেন তা ইসরাইলের এবং আমরা ইসরাইলের অধিকারকে সমর্থন করি … ফিলিস্তিনি বলতে কিছু নেই।’ একইভাবে ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেন্ডস অব ইসরাইলি কমিউনিটিজের প্রতিষ্ঠাতা ট্রেড বেকেট এই সংগঠকের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন যে, এর লক্ষ্য হলো ‘জুডিয়া, সামারিয়া গাজায় বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ, সান্ত্বনা দেওয়া ও সহায়তা করা।’ এ সংগঠনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গির্জার সঙ্গে ইসরাইলে বসতি স্থাপনকারীদের ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গির্জা তাদের সহযোগিতা করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কলোরাডোর আর্ভডায় ফেইথ বাইবেল চ্যাপেল অ্যারিয়েলে পশ্চিমতীর বসতি এলাকা ‘গ্রহণ’ করে এবং সেখানে লাইব্রেরি, হেলথ ক্লিনিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে তারা সাহায্য করে বলে জানা যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টরা সমস্যার দুই-রাষ্ট্র সমাধান নীতির অথবা ফিলিস্তিনিদের কোনোভাবে কোনো এলাকায় সুবিধা দেওয়ার বিরোধিতা করে। ১৯৭৭ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাতের জেরুসালেমে ঐতিহাসিক সফরের প্রাক্কালে ইভানজেলিকাল গ্রুপগুলো প্রধান প্রধান মার্কিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ওইসব বিজ্ঞাপনে তারা ‘ইহুদি আবাসভূমিতে অন্য রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠার যে কোনো প্রচেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।’ ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তিনি (খোদা) তার জনগণকে যে ভূমি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তা বিভক্ত করা যাবে না … ইরেতজ ইসরাইলের যে কোনো অংশে একটা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া সব রাষ্ট্রের জন্য আরো একটা ভুল বলে গণ্য হবে। এ ধরনের গভীর বিশ্বাসের জন্য ক্রিশ্চিয়ান রাইট নেতা প্যাট রবার্টসন বলেন, ২০০৬ সালে জানুয়ারি মাসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন হূদরোগে আক্রান্ত হন স্বর্গীয় প্রতিশোধের জন্য। কারণ তিনি গাজা ভূখন্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রবার্টসনের ভাষায়, তিনি খোদার ভূমি ভাগ করছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য ইসরাইলের যেসব প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের পথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি আমি ধিক্কার জানাই।… খোদা বলেন, ‘এ ভূমি আমার। তুমি বরং তা ত্যাগ কর এককভাবে।’ রবার্টসন পরে অবশ্য তার ওই ‘অনুপযুক্ত ও অনুভূতিহীন’ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এ ঘটনা থেকে অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় যে, কিছু কিছু ক্রিশ্চিয়ান ইভানজেলিক কিভাবে বিশাল ইসরাইলের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করে। একই ধরনের বিশ্বাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিকের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। হাউসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হুইপ (এবং পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা) টম ডেলে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির বার্ষিক নীতি নির্ধারণী সম্মেলনে বলেন, তিনি ফিলিস্তিনিদের ভূমি দেওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জুডিয়া সামারিয়া সফর করেছি এবং গোলান মালভূমির চূড়ায় উঠেছি। আমি অধিকৃত কোনো অঞ্চল দেখিনি, আমি দেখেছিলাম ইসরাইল।’ ডেলের পূর্বসূরি সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা রিচার্ড আর্মে ২০০২ সালের মে মাসে ‘হার্ডবলে’র ক্রিস ম্যাথিউসকে বলেন, ‘পশ্চিমতীরের পুরো এলাকা ইসরাইল দখলে আনায়’ তিনি খুশি এবং ‘ফিলিস্তিনিদের চলে যাওয়া উচিত’ বলে তিনি বিশ্বাস করেন। একইভাবে জেমস ইনহোপ তার সঙ্গীদের এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে সমগ্র প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের অধিকার সম্পর্কে যুক্তি দেখান। তিনি বলেন, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি – কারণ খোদা এমনই বলেছিলেন … এই স্থানে (হেবরন) খোদা আব্রাহামের কাছে আবির্ভূত হন এবং বলেন ‘আমি তোমাকে এই ভূমি দিচ্ছি’ অর্থাৎ পশ্চিমতীর। সম্প্রসারণশীল ইসরাইলের প্রতি ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের সমর্থনের প্রেক্ষাপটে এটা বিস্ময়ের কিছু নয় যে, ‘ইসরাইলের কট্টরপন্থীরা সাধারণ স্বার্থে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী। এটা আরো বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রধান ধারার খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে ইসরাইল কর্তৃক বিভিন্ন এলাকা অধিকার করার ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে। কলিন শিনডলার বলেন, ১৯৭৭ সালের পর বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক অস্তিত্বে আসে যা ইসরাইলি ডানপন্থী ও ক্রিশ্চিয়ান ডানপন্থী আদর্শের উভয়ের পক্ষে অনুকূল হয়।’ মেনাহেম বেগিনের লিকুড সরকারের সময় ইভানজেলিকদের সক্রিয়ভাবে ডেকে আনা হয়, ১৯৭৯ সালে ফলওয়েলকে একটা ব্যক্তিগত জেট দেওয়া হয় এবং ১৯৮০ সালে তাকে ‘অসামান্য অবদানের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ জ্যাবটিনস্কি মেডেল প্রদান করা হয়। তিনিই একমাত্র অইহুদি যিনি এ মেডেল লাভ করেন। এ মেডেল প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যান্য ব্যক্তিত্ব হলেন লেখক লিয়ন উরিস এবং এলি ওয়াইজেল। ১৯৮১ সালে ইসরাইল ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা নিক্ষেপের পর বেগিন প্রেসিডেন্ট রিগানের সঙ্গে দেখা করার আগে ফলওয়েলের সঙ্গে দেখা করেন বলে জানা যায়। তিনি তাকে ‘আমার জন্যে কাজ করার’ অনুরোধ করেন এবং ইসরাইলের কাজকে আমেরিকার জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৬ সালে এক দল ইভানজেলিক নেতাকে ইসরাইলে নিয়ে আসেন ইসরাইল ক্রিস্টিয়ান অ্যাডভোকেসি কাউন্সিলের উদ্যোগে। প্যাট রবার্টসন এবং এহুদ ওলমার্ট (ওই সময় জেরুসালেমের মেয়র) যৌথভাবে ২০০২ সালে জেরুসালেম প্রচার অভিযান প্রার্থনার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ইসরাইল সরকার খ্রিস্টান সফরকারী দলকে ইসরাইল সফর করার জন্যে উৎসাহিত করে। এর ফলে একদিকে পর্যটন খাতে আয় হয়, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মযাজকদের সমর্থন আরো জোরদার হয়। এভাবে ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিস্টিয়ান এমব্যাসি জেরুসালেমের বার্ষিক ভোজসভায় (ইসরাইলে আয়োজিত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশ বলে কথিত) বলেন যে, ‘আমাদের প্রয়োজন আপনাদের এবং আপনাদের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন… আমি আপনাদের একটা কথা বলছি যা আপনারা মনে করে দেশে নিয়ে যাবেন : আপনাদের মতো আরো লোককে ইসরাইল সফরে পাঠান। শ্যারনের উত্তরসূরি এহুদ ওলমার্ট যখন জেরুসালেমের মেয়র ছিলেন তখন তিনি এক সমাবেশে একই ধরনের বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাদের সৈন্যবাহিনী, আমাদের শক্তি ও আমাদের প্রতিরক্ষার অংশ।’ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ইস্যুতেও ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের সময় ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরাইল ওয়াশিংটনে ইসরাইল সমর্থকদের এক সভার আয়োজন করে। ওই সময়টাকে সতর্ক করে দেওয়ার উপযুক্ত মনে করেন জেরি ফলওয়েল। তিনি বলেন, ‘আমরা সীমান্ত ছাড়াই একটা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আছি’ যা ‘ভবিষ্যতের সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার যুদ্ধ এবং যীশুখ্রিস্টের মহান প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাবনা বা অগ্রদূত হিসেবে গণ্য হবে।’ বিখ্যাত লেখক জন হ্যাসি ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে লেখেন যে, ‘ইসরাইলের জন্যে একমাত্র যৌক্তিক বিকল্প হলো’ ইরানের ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারমাণবিক আঘাত হানা। জন হ্যাসি ২০০৬ সালে তার ‘জেরুসালেম কাউন্টডাউন’ বইয়ে সতর্ক করে দেন যে, ‘ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সংঘাত একটা নিশ্চিত বিষয়। ইজেকিয়েল ৩৮-৩৯ যুদ্ধ বই প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে যেতে পারে।’ হ্যাগি পক্ষপাতমূলক ইরাক গবেষণা গ্রুপের রিপোর্টকে (২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত) সমালোচনা করেন। ওই রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি বলেন যে, জেমস বেকার ‘আরো একবার ইসরাইলের পিঠে ছুরি মারছে’। তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘আমার পিতার প্রজন্ম … এ সময়ের মধ্যে ইরানের ওপর বোমা নিক্ষেপ করত।’ অনেক ইহুদি আমেরিকান সংগঠন ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের সঙ্গে ঐক্যকে স্বাগত জানায় একটা দীর্ঘায়িত উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও যে, এসব গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চিয়ান এজেন্ডা কার্যকর করতে এবং ইহুদিদের খ্রিস্টান বানাতে চায়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি ইভানজিলিক্যাল আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করার জন্যে নিজস্ব একটা লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠিত করেছে। জাইওনিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার মতো লিকুদ সমর্থক সংগঠনগুলো ফলওয়েলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং ক্রিশ্চিয়ান ইভানজিলিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। তারা ‘কমেনটারির’ পাতায় আরভিং ক্রিস্টলের সমর্থন লাভ করে। ক্রিস্টল হলো নতুন রক্ষণশীলবাদের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের মধ্যে একজন। অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগের সাবেক পরিচালক নাথান পালমোটারের মতে, ‘ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের অভ্যন্তরীণ সব অগ্রাধিকারের সঙ্গে ইহুদিরা বসবাস করতে পারে। এ বিষয়ে উদার ইহুদিরা মৌলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করে, কারণ এসব বিষয় তাদের কাছে ইসরাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ পালমোটারের উত্তরসূরি আব্রাহাম ফক্সম্যান নিয়মিতভাবে ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডার সমালোচনা করেন। তিনিও ওই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন ২০০৭ সালে। তিনি বলেন যে, অ্যান্টি-ডিফামেশন লীগ ইভানজিলিকদের সমর্থনকে স্বাগত জানান ‘এমন এক সময় যখন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি মারাত্মক হুমকি ছিল।’ আমেরিকান জুইশ কমিটির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড হ্যারিসের মতে, ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের সঙ্গে সমঝোতা করার ইচ্ছা অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক : ‘সময়ের শেষ আগামীকালও হতে পারে, কিন্তু ইসরাইল এখন ভারসাম্যের দোলায় দুলছে।’ লবির মধ্যে দুটো প্রধান শাখার গভীর বন্ধন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির নীতি বিষয়ক সম্মেলনে। উদ্বোধনী নৈশভোজে জন হ্যাসি যে ভাষণ দেন তা উপস্থিত সবাই সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। হ্যাসির প্রতি প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়কর। কারণ সম্প্রতি তিনি লেখেন যে ইহুদিদের ‘আত্মিক জীবন ছাড়া সবকিছুই আছে’ এবং ইহুদিদের (খোদার বিরুদ্ধে) বিদ্রোহের ফল হলো সেমিটিকবাদ-বিরোধিতা এবং খোদা ‘সেমিটিকবিরোধী জাতিগুলোকে ইসরাইল জাতির মধ্যে নিয়ে আসবেন তাদের ধ্বংস করার জন্যে যেন ইসরাইলের ইহুদিরা সামগ্রিকভাবে স্বীকার করে যে, একমাত্র তিনিই প্রভু।’ হ্যাসির বিরক্তিকর বক্তব্য সত্ত্বেও অ্যান্টি ডিফামেশন লীগের ফক্সম্যান ঘোষণা করেন যে, তার জন্যে একটা ভূমিকা আছে … কারণ, ইসরাইলের জন্য তার সমর্থন। ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের এজেন্ডা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর মধ্যপন্থী ইসরাইলি ও ইহুদি মার্কিনিরা তাদের ঐক্যের বিষয়ে গভীরভাবে সতর্ক, ঐতিহাসিক নায়োমি কোহেন বলেন যে, ‘ইসরাইলের প্রয়োজন ছাড়া অধিকাংশ মার্কিন ইহুদি নিউ ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের সঙ্গে যেকোনো লেনদেন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতো। তাদের আশংকা যে, অনেক ইভানজিলিক গ্রুপের এখনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ইহুদিদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা। তাদের চিন্তার বিষয় এই যে, ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের একগুঁয়ে দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সত্যি কষ্টকর। আমেরিকানস ফর পিচ নাউয়ের জো-অ্যান মোর্ট মার্কিন ইহুদি ও ক্রিশ্চিয়ান রাইটদের মধ্যকার সহযোগিতাকে ‘অসৎ ঐক্য’ বলে মন্তব্য করেন। ইসরাইলের মধ্যপন্থী ইয়োসি আলফার সতর্ক করে দেন যে, অব্যাহতভাবে বসতি স্থাপনের জন্যে খ্রিস্টানদের সমর্থন ‘আমাদেরকে এক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা পুরোপুরি সর্বনাশা।’ সিবিএস নিউজকে তিনি বলেন, ‘এসব লোক থেকে খোদা আমাদের রক্ষা করুন।’ একইভাবে ইসরাইলি-আমেরিকান পন্ডিত ব্যক্তি জারশম গোরেনবার্গ মন্তব্য করেন যে, বিধির বিধান ধর্মীয় মত অনুযায়ী ইহুদিদের জন্যে সুখী নিয়তি দেখা যায় না : শেষ সময়ে ‘ইহুদিরা মরে যায় বা ধর্মান্তরিত হয়।’ বিশেষভাবে তিনি সতর্ক করেন ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টদের, ‘আসল ইহুদি লোকদের ভালোবেস না। তারা আমাদের ভালোবাসে তাদের নাটক ও কাহিনীর চরিত্র হিসেবে … (এবং) এটা পাঁচ অঙ্কের নাটক- চতুর্থ অঙ্কেই ইহুদিরা অদৃশ্য হয়ে যায়।’ ইসরাইল লবির ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্ট শাখা ইসরাইলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ইসরাইলে বসতি স্থাপন আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এবং আঞ্চলিক এলাকা ছাড় দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান জাইওনিস্টরা ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করেছে। একইসঙ্গে তারা ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টির বিষয়টি মার্কিন নেতৃবৃন্দের জন্যে কষ্টকর করে তুলেছে। তাদের সমর্থন ছাড়া ইসরাইলে বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা অনেক কম হতো। অধিকৃত অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সরকারও কম বাধার সম্মুখীন হতো। এছাড়া খ্রিস্টানদের সফর বা ভ্রমণ (এর বেশিরভাগই হয় ধর্মযাজকদের উদ্যোগে) হয়ে উঠেছে ইসরাইলের জন্যে এক আকর্ষণীয় আয়ের পথ। এ খাত থেকে ইসরাইল ও তার আশপাশের এলাকা প্রতি বছরে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে বলে জানা যায়। ইসরাইলের পক্ষে এই অ-ইহুদি জোরালো সমর্থন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদানে এমন উৎসাহিত করে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদানে বসবাসকারী ইহুদিদের সুপারিশের চেয়ে বেশি। সম্ভবত ওই সমর্থনের প্রভাব ইহুদি নির্বাচনী এলাকা নয় এমন রাজনীতিকদের এলাকার হিসাব-নিকাশের ওপরও পড়ে। আরভিন অ্যান্ডারসন মনে করেন যে, ‘বিধির বিধান’ অনুসারীদের চিন্তা পুনরায় শক্তিশালী হয় ‘ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থনে মার্কিন সাংস্কৃতিক পূর্ব ধারণা, যার ভিত্তি আংশিকভাবে খ্রিস্টান বাইবেলের প্রভাব।’ ‘বাইবেলের কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হওয়া… অথবা তা পড়ে… ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে জড়ো হওয়া ‘দ্বিতীয় আগমনের সূচনার অংশবিশেষ, এটা বিস্ময়কর নয়, অনেক (যদিও সবাই নয়) আমেরিকান সাধারণভাবে ধারণা করে যে, ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে প্রত্যাবর্তন এবং সেখানে তাদের নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সঠিক ও যথার্থ। তবু খ্রিস্টান জাইয়নিস্টদের প্রভাব বাড়িয়ে বলা ঠিক হবে না। ‘বৃহৎ ইসরাইলে’র জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার এবং এর উপজাত ফলস্বরূপ সমস্যার দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতির বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিডে ক্লিনটন প্রশাসন শেষোক্ত বিষয় (অর্থাৎ দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি) থেকে বিরত ছিল না। এছাড়া ক্লিনটন প্রশাসন পশ্চিম তীরের কিছু কিছু এলাকায় ইসরাইলি সৈন্য পুনরায় মোতায়েন না করার বিধানসহ ১৯৯৮ সালের উইয়ি চুক্তি অকার্যকর করেনি। সম্ভবত আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ক্রিস্টিয়ান রাইটদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ২০০১ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি তার নিজের সমর্থনের ঘোষণা থেকে বিরত করেনি। ইসরাইল লবির অন্যান্য অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে যতোটা প্রভাব বিস্তার করে, ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টরা ততোটা না পারার একাধিক কারণ আছে। প্রেসিডেন্ট বুশের রাজনৈতিক ভিত্তির একটা প্রধান অংশ ক্রিস্টিয়ান রাইট হলেও ওই ঐক্য ইসরাইল সম্পর্কিত বিষয়ের বাইরেও বিস্তৃত। এর মধ্যে যুক্ত আছে অনেক সামাজিক বিষয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে ইসরাইলকে সমর্থন করা একটা এবং এই একটা বিষয়ের সঙ্গেই রবার্টসন, বাউয়ের ও ফলওয়েলের মতো ইভানজিলিকরা সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তাদের সম্পৃক্ততা থাকে। ক্রিস্টিয়ান রাইটের নেতারা প্রায়ই ৪ কোটি অথবা আরো বেশি স্বীকৃত ইভানজিলিক খ্রিস্টানদের পক্ষে কথা বলেন বলে দাবি করেন। কিন্তু এদের মধ্যে ইসরাইল সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেন এমন অনুসারীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে খুবই কম। এছাড়া আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো গ্রুপের বিপরীতে ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টদের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় পর্যালোচনা করার অথবা পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার সাংগঠনিক সামর্থ্য নেই। আশির দশকে রুখ মৌলি এবং ১৯৯৯ সালে আরভিন অ্যান্ডারসন কংগ্রেসীয় জরিপে যে সহায়তা দেন তাতে দেখা যায়, ‘ইসরাইল বিষয়ে ফলওয়েল এবং রিলিজিয়াস রাইটের অন্যান্য বিখ্যাত সদস্যদের কংগ্রেসে ব্যাপক ও সরাসরি লবিং ছিল খুবই কম।’ একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অব ক্রিস্টিয়ানস অ্যান্ড জু উসের প্রতিষ্ঠাতা রাবিব ইয়েসিয়েল ইকসটেইন ইসরাইলি লেখক জেড সাফেটসকে বলেন, ইভানজিলিকদের এক প্রতিনিধি দলকে তিনি ২০০৩ সালে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কন্ডোলিৎসা রাইসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নিয়ে যান। এটাই ছিল ‘একমাত্র ক্রিস্টিয়ান গ্রুপ যা প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের পক্ষে লবিং করে।’ ইকসটেইন কিছুটা বাড়িয়ে বললেও এটা স্পষ্ট যে, ইভানজিলিকদের অনেক উদ্বেগের তালিকার মধ্যে ইসরাইল মাত্র একটা বিষয়। এর বিপরীতে আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, অ্যান্টি ডিফামেশন লীগ, জাইয়নিস্ট অর্গনাইজেশন অব আমেরিকা এবং কনফারেন্স অব প্রেসিডেন্টসের মতো জায়ালিস্ট গ্রুপগুলো ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে তাদের কর্মতালিকার শীর্ষে রেখেছে। পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য তাদের প্রয়াসকে জোরদার করে জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স ও ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির মতো থিংক ট্যাংকগুলো। এছাড়াও খ্রিস্টধর্মে বেশ কিছু জটিল নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা আছে এবং এর গুরুত্বপূর্ণ কার্যধারাগুলোর মধ্যে আছে ইসরাইলকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন বা সমর্থনের জন্য উৎসাহিত না করা। ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টরা বিশ্বাস করতে পারে, সমগ্র প্যালেস্টাইনের ওপর ইহুদি নিয়ন্ত্রণ বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু অন্য খ্রিস্টান নীতি যেমন যিশু খ্রিস্টের নির্দেশ হলো ‘নিজের মতো তোমার প্রতিবেশীকেও ভালোবাসো’, প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি ইসরাইলের আচরণ একেবারে বিপরীতমুখী। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনীর সঙ্গে পরিচিতি এবং অন্যান্য ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও প্রধান ধারার খ্রিস্টান গীর্জাগুলোকে সমস্যা সমাধানের জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি সমর্থন এবং খ্রিস্টান নীতির ওপর ভিত্তিশীল শান্তি ও ন্যায় বিচারের অঙ্গীকার সত্ত্বেও ইসরাইলের বিভিন্ন নীতিকে সমালোচনা করা থেকে তাদের বিরত রাখা যায়নি। ইসরাইল যা করছে তার সব কিছু সব আমেরিকান ইহুদি যেমন সমর্থন করে না - তেমনি অনেক খ্রিস্টান ও ইভানজিলিকও তা সমর্থন করে না। ইসরাইল সমর্থক জুইশ গ্রুপদের মতো ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টদের আর্থিক ক্ষমতা নেই। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তাদের সমর্থনের জন্য মিডিয়ার ভূমিকাও কম। নৈতিক বা ধর্মীয় বিষয়ে কথা বললে রবার্টসন বা বাউয়ের মতো নেতাদের প্রতি মিডিয়া বেশ দৃষ্টি দেয়। কিন্তু ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বা ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি যখন ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে তখন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকেই বেশি দৃষ্টি দেয়। এসব কারণে ক্রিস্টিয়ান জাইয়নিস্টকে লবির ইহুদি অংশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে করা হয় না। লবির ক্ষমতার উৎস : ইসরাইল লবি এতোটা ফলপ্রসূ কেন? এর একটা কারণ হলো আমেরিকার রাজনৈতিক পদ্ধতির ব্যাপক মুক্ত বৈশিষ্ট্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে বিভাজিত সরকার পদ্ধতি, স্বাধীন মত প্রকাশের সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য, এমন এক পদ্ধতি যেখানে নির্বাচন পরিচালনা খুবই ব্যয়বহুল এবং নির্বাচন প্রচারণার জন্য দেয় চাঁদা নিয়ন্ত্রিত হয় খুবই দুর্বলভাবে। এমন পরিবেশে কোনো নীতিকে প্রভাবিত করার অথবা নিজের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের পথ আছে। স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো তাদের প্রিয় প্রার্থীর প্রচারণার জন্য চাঁদা প্রদান এবং সন্দেহজনক মতাদর্শের প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য চেষ্টা করতে পারে। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি ও নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের কাছে লবিং করতে পারে এবং শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পদে তাদের সমর্থক লোকদের নিয়োগ করাতে পারে। এছাড়াও, জনমত গঠনে স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর সামনে অনেক পথ খোলা থাকে। এরমধ্যে আছে সহানুভূতিশীল সাংবাদিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা; বই, প্রবন্ধ লেখা এবং ভিন্ন মতাবলম্বী কাউকে অসম্মান বা ছোট করার জন্য কাজ করা। যেসব গ্রুপ অত্যন্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং যাদের যথেষ্ট অর্থ আছে তাদের জন্য সরকারি নীতি প্রভাবিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উপায়ের কোনো কমতি নেই। লবির ফলপ্রসূতার মধ্যে প্রতিফলিত হয় বহুদলীয় সমাজে স্বার্থবাদী গ্রুপ রাজনীতির মূল কর্মপদ্ধতি। গণতন্ত্রে আনুপাতিক হারে ক্ষুদ্র গ্রুপও বিশেষ কোনো ইস্যুতে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ওই ইস্যুতে অন্যসব লোক ব্যাপকভাবে উদাসীন থাকলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। এমনকি ওইসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা একেবারে কম হলেও নীতিনির্ধারকরা এবং বিশেষভাবে কংগ্রেস সদস্যরা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়। কারণ তারা নিশ্চিতভাবে জানে, এজন্য অবশিষ্ট জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যাবে না। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটরকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি এবং তার সহকর্মীরা লবির সমর্থিত বিতর্কিত আইন স্বাক্ষর করেছিলেন কেন। তার জবাব ছিল এ রকম : ‘এটা স্বাক্ষর না করলে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা হতো না। আপনি স্বাক্ষর করলে কারো মনে কষ্ট দিতেন না। কিন্তু স্বাক্ষর না করলে আপনি আপনার রাজ্যে কিছু ইহুদিকে হয়তো কষ্ট দিতেন।’ যখন বিরোধী গ্রুপের অস্তিত্ব থাকে না বা থাকলেও দুর্বল থাকে তখন ক্ষুদ্র অথচ দৃশ্যমান স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর অসামঞ্জস্য প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায়। কারণ রাজনীতিকদের একটা গ্রুপের স্বার্থকে মানতে হয় এবং জনগণ শুধু কাহিনীর একটা দিকই হয়তো শুনতে পায়। ইস্যুটা কৃষিতে ভর্তুকি বা পররাষ্ট্রনীতি হোক না কেন, বিশেষ স্বার্থবাদী গ্রুপগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই এমনভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে যা জনসংখ্যার চেয়ে তাদের মোট সংখ্যা অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নীতি নির্ধারণে প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতায় ইসরাইল লবি অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করে। আমেরিকার ইহুদিরা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ ও সুশিক্ষিত এবং তাদের আছে এক প্রশংসনীয় লোকহিতকর ঐতিহ্য। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে উদারভাবে সহায়তা করে এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণের হারও খুব বেশি। আমেরিকার ইহুদিদের সংখ্যালঘিষ্ট একটা দল ইসরাইলের বিষয়ে জোরালোভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়। তবে তাদের মধ্যে স্পষ্টভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দল যে কোনোভাবে ইসরাইলের ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট এবং সংখ্যালঘিষ্ট একটা দল ওই ইস্যুতে জোরালোভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, লবির মধ্যে প্রধান ইহুদি সংগঠনগুলোর আকর্ষণীয় সম্পদ ও বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞানের স্তর। রাজনৈতিক বিজ্ঞানী রবার্ট ট্রাইসের মতে, ‘অধিকাংশ প্রধান ইহুদি গ্রুপগুলোর বৈশিষ্ট হলো তাদের অধিক সংখ্যক সদস্য, সুশিক্ষিত পেশাগত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সামাজিক, কল্যাণ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ এবং অভ্যন্তরীণভাবে সুবিস্তৃত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।’ এছাড়া, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহুসংখ্যক সংগঠনের উপস্থিতি থেকে অনুধাবন করা যায়, ‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির বিষয় উত্থাপিত হলে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুত ও সমন্বিতভাবে ইসরাইল সমর্থক আন্দোলন সংগঠনের সামর্থ্য তাদের আছে।’ এসব প্রয়াস আরো সহজতর হয় সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের অনুকূল ভাবমূর্তি থাকার জন্য। সাবেক সিনেটর ওয়ারেন রুডম্যান একবার মন্তব্য করেন, ‘বিক্রি করার মতো তাদের খুবই ভালো পণ্য আছে।’ আমরা দেখতে পাই, লবির নিজস্ব প্রচেষ্টায় ওই ভাবমূর্তির একটা বড় অংশ গড়ে উঠেছে এবং তারা নিশ্চিতভাবে চেষ্টা করে ইসরাইল সম্পর্কে অনুকূল ভাবমূর্তি গড়ে তোলার। ব্যাপক অর্থে অনুকূল ভাবমূর্তির জন্য আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল একই ইহুদি-খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ এবং তারা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত। সবশেষে, এ লবি উপকৃত হয় কার্যকর বিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতির জন্য। একজন সিনেটর বলেন, ‘কোনো ভারসাম্যমূলক অনুভূতি নেই… আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মারাত্মক চাপের বিপরীতে আপনি যদি ভোট দেন, তাহলে কেউ আপনাকে বলবে না যে এটা ভালো কাজ।’ আরব-আমেরিকানরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘিষ্ট জনগোষ্ঠী হলেও তারা ইহুদি আমেরিকানদের মতো তেমন সমৃদ্ধ, সুসংগঠিত, বহুসংখ্যক বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নয়। গ্রুপ হিসেবে আরব-আমেরিকানরা শিক্ষা, ব্যবসা ও মিডিয়ায় উল্লেখযোগ্য পদে পৌঁছাতে সফল হয়নি। রাজনীতিতে তাদের প্রায় দেখাই যায় না। এর আংশিক কারণ হলো এই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরবদের অভিবাসিত হওয়া আনুপাতিকহারে সাম্প্রতিক এবং প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা সম্পদের দিক দিয়ে কম সমৃদ্ধ, গুরুত্বপূর্ণ পেশায় কম প্রতিনিধিত্ব্মূলক এবং মার্কিন রীতি-নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কম পরিচিত। তারা রাজনীতিতে কম সক্রিয় এবং সে কারণে কম প্রভাবশালী। তবে পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। আরব-সমর্থক সংগঠনগুলো ইসরাইল লবির প্রধান প্রধান গ্রুপগুলোর অনুরূপ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরব সমর্থক ও প্যালেস্টাইন সমর্থক কিছু গ্রুপ আছে, তবে তারা আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং অন্য ইসরাইল সমর্থক গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও দুর্বল। আর্থিকভাবে তারা সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এবং কোথাও তারা কার্যকর নয়। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির ‘নিয়ার ইস্ট রিপোর্টে’র সাবেক সম্পাদক মিটসেল বোর্ডের মতে, ‘শুরু থেকে আরব লবি শুধু নির্বাচনী রাজনীতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি, তারা সাংগঠনিক দিক থেকেও অসুবিধার সম্মুখীন হয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক গ্রুপ আছে, কিন্তু তাদের অনেকগুলোই পরিচালিত হয় একক ব্যক্তির মাধ্যমে। তাদের যেমন আর্থিক সামর্থ নেই, তেমনি জনসমর্থনও নেই।’ মার্কিন রাজনীতিকরা কখনো ‘আরব-আমেরিকান লবি’ থেকে কোনো চাপ প্রয়োগের অভিযোগ করেনি এবং তারা এমন কোনো আচরণ করেনি যা গ্রহণের জন্য সামান্য কারণ থাকে। এ বিষয়ে হ্যারি ট্রুম্যান একটা বিখ্যাত উক্তি করেন তা হলো ‘আমার পুরো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আমি কখনো স্মরণ করতে পারি না যে, সমান সমান নির্বাচনে আরব ভোটে কেউ বিজয়ী হয়েছে।’ তদুপরি, আরব-আমেরিকানরা বিভিন্ন দেশ এবং পরিবেশ থেকে আসে এবং এদের মধ্যে মুসলমান ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তারা একক চিন্তা-চেতনায় কাজ করবে এটা প্রায় অসম্ভব। বস্ত্তত, তারা মাঝে মাঝে একেবারে বিপরীত মত পোষণ করে। অনেক আমেরিকান মনে করে, ইসরাইল ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক নৈকট্য আছে এবং বিশ্বাস করে, ইসরাইলিরা ‘আমাদের মতো’। আরবদের প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা হয় বিদেশি (অথবা এমনকি শত্রু) সভ্যতার অংশ হিসেবে। আমেরিকান ইহুদি বা তাদের খ্রিস্টান মিত্রদের জন্য আমেরিকায় কারো মন জয় করা যতটা সহজ, আরবদের জন্য তা ততটাই কঠিন এবং কষ্টকর যুদ্ধের মতো। রবার্ট ট্রাইস ১৯৮১ সালে আরব-আমেরিকান গ্রুপগুলো সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেন তা এখনো প্রণিধানযোগ্য। তার মূল্যায়ন ছিল : ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব উপেক্ষণীয়।’ তেলের (পরিমিত) প্রভাব : আরব সরকারগুলো অথবা দাম্ভিক ‘তেল লবি’ ইসরাইল লবির মতো এতটা গুরুত্ব বহন করে না। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, তেল কোম্পানিগুলো এবং/অথবা তেলসমৃদ্ধ শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর ব্যাপক ও শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে। এই বিশ্বাসের ব্যাপক প্রতিফলন ঘটে বারবার এ দাবির ক্ষেত্রে যে, ২০০৩ সালে ইরাকে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা ছিল ‘তেলের জন্য যুদ্ধ’ এবং সংশ্লিষ্ট কর্পোরেট স্বার্থ, যেমন হ্যালিবার্টনের জন্য। বিস্ময়ের বিষয়, এই দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত করেন ইসরাইলের কঠোর সমালোচকরা, যেমন নোয়াম চমসকি ও স্টিফেন জোনস এবং অতি সমর্থক, যেমন মার্টিন পেরেৎজ। এই দৃষ্টিভঙ্গির আরো ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য এমন যে, বুশ পরিবার ও সউদের পরিবারের মধ্যকার ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতির বাস্তব রূপ লাভ করে। এ ধরনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ইসরাইল লবি মাত্র একটা নিয়ামক শক্তি এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লবি নয়। এটা কোনো প্রশ্ন নয় যে, পারস্য উপসাগর এলাকার জ্বালানি সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের কৌশলগত স্বার্থ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে তার জ্বালানির অধিকাংশই আমদানি করে কানাডা, মেক্সিকো ও ভেনিজুয়েলা থেকে। তেল ও গ্যাস অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত বিশ্ববাজারে কেনা ও বিক্রি করা হয়। কোনোভাবে এর সার্বিক সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায় এবং মার্কিন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা পারস্য উপসাগরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের স্থান বলে বিবেচনা করে এবং সেখানে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ওই এলাকা থেকে তেলের সরবরাহ কোনো শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিঘ্নিত হওয়াও তারা প্রতিরোধ করে। মূল তথ্য থেকে এ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় যে, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক বিভিন্ন নীতির সঙ্গে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও উপসাগরীয় একাধিক দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের গুরুত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাহকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করে। এর কারণ ছিল একই। ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের পর একই ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে রিগান প্রশাসন ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় (১৯৮০-৮৮) সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের প্রতি সমর্থন দেয়। আবার ১৯৯০ সালে শেখ শাসিত রাজ্য দখল করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েত থেকে ইরাককে উৎখাত করে। ওই এলাকায় কোনো একক শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করার এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এসব নীতিকে উৎসাহিত করার জন্য কোনো শক্তিশালী লবির প্রয়োজন ছিল না। কারণ বন্ধু নয় এমন কারো কর্তৃত্বের বাইরে পারস্য উপসাগরের তেল থাকুক, এ বিষয়ে খুব কম লোকই প্রশ্ন তোলে। যা হোক, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের অধিকার রক্ষার স্পষ্ট স্বার্থের বাইরে খুব সামান্য সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, ব্যাপকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর সমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলোর বা শক্তিশালী ‘তেল লবি’র যথেষ্ট প্রভাব আছে। আরব পেট্রো ডলার বা জ্বালানি কোম্পানিগুলো যদি মার্কিন নীতিকে পরিচালিত করত তাহলে যে কেউই দেখতে পেত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য সে রাতদিন কাজ করছে। সৌদি আরবের মতো দেশ বারবার ওয়াশিংটনের ওপর চাপ দিয়েছে যে, ইসরাইল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে ওয়াশিংটন যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের যুদ্ধে ‘তেল অস্ত্র’কে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা সত্ত্বেও ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন অথবা ওই এলাকায় সামগ্রিকভাবে মার্কিন নীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। একইভাবে তেল কোম্পানিগুলো যদি ইসরাইলের ব্যাপারে মার্কিন নীতিকে পরিচালিত করত তাহলে কেউ হয়তো দেখতে পেত যে, ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর, যেমন সাদ্দাম হোসেনের ইরাক (সাদ্দাম হোসেন যখন জীবিত ও ক্ষমতায় ছিলেন তখন একথা বলা হয়) মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিবিয়া অথবা ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের অনুগ্রহ পাওয়ার চেষ্টা করছে, যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো অর্থ আয় করে নিজেদের জ্বালানি সম্পদের উন্নতি করতে পারে এবং তা বাজারে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই তিন দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটা ছিল জ্বালানি কোম্পানিগুলো যা চেয়েছিল তার ঠিক বিপরীত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ। এমনকি এটাও দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো লাভবান হবে এমন ব্যবসায়িক চুক্তি ব্যর্থ করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এক্ষেত্রে অনেক সমালোচকেরই বিশ্বাস তেল লবি ততটা শক্তিশালী হলে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো না। সমৃদ্ধ তেল উৎপাদনকারী দেশ, যেমন সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং নির্দিষ্ট অস্ত্র চুক্তির লবিং করার জন্য জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এবং পেশাগত লবিস্টদের নিয়োগ করে। তাদের প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে সফল হয়। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৮২ সালে সৌদি আরবে এডব্লিউএসিএস (অ্যাওয়াক) বিমান বিক্রি করতে কংগ্রেসকে রাজি করানো। এ ঘটনায় মাঝে মাঝে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইসরাইল লবির প্রভাব সীমিত এবং আরব লবির ক্ষমতা বেশি। তবে এ ঘটনায় আরব লবির সাফল্যের কারণ ছিল বেশ কিছু অসাধারণ অনুকূল অবস্থা। সৌদি তেলের কৌশলগত গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। ওই সময় পারস্য উপসাগরে সোভিয়েট ইউনিয়ন সামরিক হুমকি হিসেবে আবিভূূর্ত হয়। রোনাল্ড রিগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য তার প্রশাসন সব ধরনের বাধা তুলে নেয়। তবু ওই যুদ্ধবিমান বিক্রি সিনেটে সামান্য ভোটের ব্যবধানে (৫২-৪৮) অনুমোদিত হয় এবং রিগানকে লবি ও কংগ্রেসের পুনরায় বিরোধিতার মুখে পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব ও জর্দানের সঙ্গে সম্পাদিত একাধিক অস্ত্র বিক্রি প্যাকেজ বাতিল করতে বাধ্য হতে হয়। তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলোর সীমিত প্রভাবের একটা কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে তাদের সমর্থনের ভিত্তি নেই। কারণ তারা পেশাগত লবিস্টস্ এবং জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। তাদের প্রতিনিধিদের বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে কলঙ্কিত করা সমালোচকদের জন্য খুবই সহজ। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির টম ডাইন একবার সৌদি লবিং প্রয়াসকে বাতিল করে দিয়ে বলেন, তারা তদের পক্ষে দরপত্র দেওয়ার জন্য ফ্রেড ডাটলের মতো বিদেশি এজেন্ট নিয়োগ করে। অথচ তাদের সমর্থন আমেরিকার মাটিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়।’ এর বিপরীতে ইসরাইল লবি হলো আমেরিকান নাগরিকদের একটা অংশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ এবং এ কারণে এর রাজনৈতিক কাজকে ব্যাপক ও যথার্থভাবে বৈধ বলে গণ্য করা হয়।
==================================
ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি' গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী'
সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে
অনুবাদঃ ওসমান করীম
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি' গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী'
সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে
অনুবাদঃ ওসমান করীম
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments