একজন অসাধারণ চিকিৎসকের কথা by সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী
মহীরুহপ্রতীম পথিকৃৎ চিকিৎসাবিজ্ঞানী আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী তিন বছর হলো এইদিনে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। আমি তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করছি।
বাংলাদেশের বরেণ্য চিকিৎসকদের শিক্ষক অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি মুসলিম সমাজে জন্মগ্রহণ করেও এক উদার উন্নত শিক্ষায় আলোকিত পরিবারের সংস্পর্শে এসে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তাঁর কর্মজীবনে অসংখ্য যোগ্য নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসাবিজ্ঞানী গড়ে গিয়েছেন। বিশ শতকের শুরুতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কুসংস্কারের ধোঁয়াশাক্রান্ত পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সূচনা করে নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এ দেশের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি তাঁর এ কল্যাণকর ব্রত গ্রহণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েছেন নানাভাবে। তাঁর আদর্শ অনুসরণে আজ দেশের চিকিৎসা অঙ্গনে অসংখ্য নারী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান রাখছেন।
অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী এ ক্ষেত্রে নিজ পরিশ্রম, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যে শীর্ষস্থানে অলংকৃত হয়েছেন, তা এক অভূতপূর্ব সাফল্যগাথা। বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ ধাত্রীবিদ্যায় বর্তমানে যে অগ্রগতি, আজ থেকে ৮০ বছর আগে তা ছিল কল্পনাতীত। বিশেষত, এ ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিম নারীদের পদচারণ ছিল নিতান্ত নগণ্য, অকিঞ্চিৎকর। তথাকথিত ধর্মীয় বিধিনিষেধের গোঁড়ামিপূর্ণ অসামঞ্জস্য এক সময় তাঁর চিকিৎসাক্ষেত্রে পদচারণ ছিল রেনেসাঁর সূচনা, যার পরিপ্রেক্ষিতে সে যুগেও মুসলিম মহিলারা সানন্দে এগিয়ে এসেছেন বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি সেবাদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে দৃঢ়চিত্তে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁদের। নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর সেবার মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই নারী প্রতিভূ সর্বাবস্থায় আমাদের জন্য আদর্শ মানবাধিকারস্বরূপ।
সৌভাগ্য আমার যে, ষাটের দশকের শুরুতে এমবিবিএস পড়তে গিয়ে এই মহীয়সী নারীকে পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে। অবশ্য তারও আগে থেকে ডা. জোহরা বেগম কাজী ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করে শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন। উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে তিনি এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিই শুধু নন, বরং বলা চলে, তিনি নিজেই এক ইতিহাস। তবে তার চেয়েও বড় কথা, তিনি চিকিৎসাব্যবস্থার মান উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসক তৈরির ক্ষেত্রে একজন সার্থক অধ্যাপক।
আমি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে মাত্র কয়টি বছর তাঁকে চিনেছি ও শিক্ষা পেয়েছি, তাতে আমার কর্মজীবনে এত দূর পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সময় ও নিয়মানুবর্তিতা বলতে যা বোঝায়, তার সংজ্ঞা ডা. জোহরা বেগমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। তিনি সময়মতো ক্লাসে আসতেন। ক্লাস শুরু হওয়ার দু-এক মিনিট পরে গেলে ক্লাসে ঢোকার সুযোগ ছিল না। কোনো ছাত্রছাত্রী ক্লাসে আমাদের পাঠদানকালে বিষয়ভিত্তিক ছাড়া অন্য কোনো বিষয় গল্প করতেন না। আমাদের বোঝানো ছিল তাঁর সাধনা। তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষক। তাঁর নীতি ও আদর্শ এতই কঠোর ছিল যে, আমরা তা মানতে বাধ্য হতাম। শিক্ষাজীবনে তাঁর আদর্শ আমাদের আলোর দিশারি হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ পরীক্ষক। পক্ষপাতদুষ্টতা-বর্জিত এমন শিক্ষক সবার কাছেই ছিল প্রিয়। হাঁটাচলায় ভাবগম্ভীর, প্রশাসনিক দক্ষতায় ও তাঁর মেধাশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে তিনি আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর ক্লাস করতে পারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি তাদের হাতে-কলমে শেখানোয় বিশ্বাসী ছিলেন, শুধু বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না।
অধ্যাপকের নির্দিষ্ট রুমে তিনি সময় কাটাতেন না। তখন তাঁকে লেডি ডাক্তার হিসেবে সবাই চিনতেন ও জানতেন। বই পড়ে সময় কাটাতেন, ফলে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পেতেন না। সময় পেলে জুনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলাপ করতেন। ডাক্তারি পেশা মহান পেশা, এ মূল্যবান বাণী দিয়ে উৎসাহিত করতেন শিক্ষকদেরও। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি নারীসমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেছেন। চিকিৎসার অভাবে মাতৃগর্ভ ঝুঁকিপূর্ণ সন্তান প্রসবের সময় হতভাগ্য মায়েরা যখন চিকিৎসা থেকে হয়েছিল বঞ্চিত, ঠিক সেই যুগে জোহরা বেগম কাজী ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের প্রধানের হাল ধরে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার চিকিৎসার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীও সম-অধিকারে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। তিনি এ দেশের নারীসমাজের অগ্রগতির অনুপ্রেরণা। সেবাদানের অন্যতম মাধ্যম সুচিকিৎসক হওয়ার আদর্শিক পথদ্রষ্টা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ছিলেন প্রশাসনিক ও অভিজ্ঞ ডাক্তার, তেমনি তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক তৎপর। রাতদিন যেকোনো সময় তিনি রোগীদের খোঁজখবর নিতেন। নার্স ও ডাক্তার তাঁদের যথার্থ কাজ করতেন কি না, তা তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করতেন। কোনো প্রকার ভুলভ্রান্তি হলে কাউকে তিনি ক্ষমা করতেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষাদান এবং রোগীদের সেবাদানের পাশাপাশি তিনি আরও কয়েকটি হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মহীয়সী বিজ্ঞানীকে তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রোকেয়া পদক, একুশে পদক, বিএমএ স্বর্ণপদক এবং পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদকে সম্মানিত করা হয়।
অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের অনারারি কর্নেল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসাদানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও দেশসেবার কাজে উৎসাহিত রাজনীতিবিদের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি উপলব্ধি করতেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কীভাবে বাঙালির ওপর অত্যাচার করত।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল ও তাঁর সরকার দিশেহারা হয়ে যখন বাঙালির বুকে গুলি চালায়, সেই গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সংবাদ প্রথমে আমরা পেয়েছিলাম অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর কাছ থেকে। সার্জন ফজলুল হক গুরুতরভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় ক্যান্টনমেন্টে আটক ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যাওয়া-আসার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যেতেন। এভাবে চাকরি অব্যাহত রেখে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালেও ডা. জোহরা বেগম কাজী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। আমি এই মহীয়সী চিকিৎসাবিজ্ঞানীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
বাংলাদেশের বরেণ্য চিকিৎসকদের শিক্ষক অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি মুসলিম সমাজে জন্মগ্রহণ করেও এক উদার উন্নত শিক্ষায় আলোকিত পরিবারের সংস্পর্শে এসে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তাঁর কর্মজীবনে অসংখ্য যোগ্য নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসাবিজ্ঞানী গড়ে গিয়েছেন। বিশ শতকের শুরুতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কুসংস্কারের ধোঁয়াশাক্রান্ত পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সূচনা করে নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এ দেশের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি তাঁর এ কল্যাণকর ব্রত গ্রহণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েছেন নানাভাবে। তাঁর আদর্শ অনুসরণে আজ দেশের চিকিৎসা অঙ্গনে অসংখ্য নারী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান রাখছেন।
অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী এ ক্ষেত্রে নিজ পরিশ্রম, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যে শীর্ষস্থানে অলংকৃত হয়েছেন, তা এক অভূতপূর্ব সাফল্যগাথা। বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ ধাত্রীবিদ্যায় বর্তমানে যে অগ্রগতি, আজ থেকে ৮০ বছর আগে তা ছিল কল্পনাতীত। বিশেষত, এ ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিম নারীদের পদচারণ ছিল নিতান্ত নগণ্য, অকিঞ্চিৎকর। তথাকথিত ধর্মীয় বিধিনিষেধের গোঁড়ামিপূর্ণ অসামঞ্জস্য এক সময় তাঁর চিকিৎসাক্ষেত্রে পদচারণ ছিল রেনেসাঁর সূচনা, যার পরিপ্রেক্ষিতে সে যুগেও মুসলিম মহিলারা সানন্দে এগিয়ে এসেছেন বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি সেবাদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে দৃঢ়চিত্তে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁদের। নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর সেবার মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই নারী প্রতিভূ সর্বাবস্থায় আমাদের জন্য আদর্শ মানবাধিকারস্বরূপ।
সৌভাগ্য আমার যে, ষাটের দশকের শুরুতে এমবিবিএস পড়তে গিয়ে এই মহীয়সী নারীকে পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে। অবশ্য তারও আগে থেকে ডা. জোহরা বেগম কাজী ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করে শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন। উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে তিনি এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিই শুধু নন, বরং বলা চলে, তিনি নিজেই এক ইতিহাস। তবে তার চেয়েও বড় কথা, তিনি চিকিৎসাব্যবস্থার মান উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসক তৈরির ক্ষেত্রে একজন সার্থক অধ্যাপক।
আমি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে মাত্র কয়টি বছর তাঁকে চিনেছি ও শিক্ষা পেয়েছি, তাতে আমার কর্মজীবনে এত দূর পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সময় ও নিয়মানুবর্তিতা বলতে যা বোঝায়, তার সংজ্ঞা ডা. জোহরা বেগমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। তিনি সময়মতো ক্লাসে আসতেন। ক্লাস শুরু হওয়ার দু-এক মিনিট পরে গেলে ক্লাসে ঢোকার সুযোগ ছিল না। কোনো ছাত্রছাত্রী ক্লাসে আমাদের পাঠদানকালে বিষয়ভিত্তিক ছাড়া অন্য কোনো বিষয় গল্প করতেন না। আমাদের বোঝানো ছিল তাঁর সাধনা। তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষক। তাঁর নীতি ও আদর্শ এতই কঠোর ছিল যে, আমরা তা মানতে বাধ্য হতাম। শিক্ষাজীবনে তাঁর আদর্শ আমাদের আলোর দিশারি হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ পরীক্ষক। পক্ষপাতদুষ্টতা-বর্জিত এমন শিক্ষক সবার কাছেই ছিল প্রিয়। হাঁটাচলায় ভাবগম্ভীর, প্রশাসনিক দক্ষতায় ও তাঁর মেধাশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে তিনি আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর ক্লাস করতে পারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি তাদের হাতে-কলমে শেখানোয় বিশ্বাসী ছিলেন, শুধু বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না।
অধ্যাপকের নির্দিষ্ট রুমে তিনি সময় কাটাতেন না। তখন তাঁকে লেডি ডাক্তার হিসেবে সবাই চিনতেন ও জানতেন। বই পড়ে সময় কাটাতেন, ফলে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পেতেন না। সময় পেলে জুনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলাপ করতেন। ডাক্তারি পেশা মহান পেশা, এ মূল্যবান বাণী দিয়ে উৎসাহিত করতেন শিক্ষকদেরও। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি নারীসমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেছেন। চিকিৎসার অভাবে মাতৃগর্ভ ঝুঁকিপূর্ণ সন্তান প্রসবের সময় হতভাগ্য মায়েরা যখন চিকিৎসা থেকে হয়েছিল বঞ্চিত, ঠিক সেই যুগে জোহরা বেগম কাজী ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের প্রধানের হাল ধরে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার চিকিৎসার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীও সম-অধিকারে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। তিনি এ দেশের নারীসমাজের অগ্রগতির অনুপ্রেরণা। সেবাদানের অন্যতম মাধ্যম সুচিকিৎসক হওয়ার আদর্শিক পথদ্রষ্টা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ছিলেন প্রশাসনিক ও অভিজ্ঞ ডাক্তার, তেমনি তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক তৎপর। রাতদিন যেকোনো সময় তিনি রোগীদের খোঁজখবর নিতেন। নার্স ও ডাক্তার তাঁদের যথার্থ কাজ করতেন কি না, তা তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করতেন। কোনো প্রকার ভুলভ্রান্তি হলে কাউকে তিনি ক্ষমা করতেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষাদান এবং রোগীদের সেবাদানের পাশাপাশি তিনি আরও কয়েকটি হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মহীয়সী বিজ্ঞানীকে তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রোকেয়া পদক, একুশে পদক, বিএমএ স্বর্ণপদক এবং পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদকে সম্মানিত করা হয়।
অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের অনারারি কর্নেল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসাদানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও দেশসেবার কাজে উৎসাহিত রাজনীতিবিদের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি উপলব্ধি করতেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কীভাবে বাঙালির ওপর অত্যাচার করত।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল ও তাঁর সরকার দিশেহারা হয়ে যখন বাঙালির বুকে গুলি চালায়, সেই গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সংবাদ প্রথমে আমরা পেয়েছিলাম অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর কাছ থেকে। সার্জন ফজলুল হক গুরুতরভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় ক্যান্টনমেন্টে আটক ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যাওয়া-আসার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যেতেন। এভাবে চাকরি অব্যাহত রেখে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালেও ডা. জোহরা বেগম কাজী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। আমি এই মহীয়সী চিকিৎসাবিজ্ঞানীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
No comments