দয়া করে ওদের রেহাই দিন by মুনির হাসান
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন আমার ছোট ভাগনির জন্ম। আমার মনে আছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বারান্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মামাদের নানা দিকে দৌড়াদৌড়ি। আমার সেই ভাগনি চলতি বছর এইচএইসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত হয়েছে। ওর বয়সী হাজারো ছেলেমেয়ের মতো ওরও ইচ্ছা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। এ বছর বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনে ভর্তির জন্য আবেদন করা সম্ভব হয়েছে। কাজেই সম্ভাব্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
৪ নভেম্বর তার পরীক্ষা ছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েটে)। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই চুয়েটে পরীক্ষা দিয়ে মা-মেয়ে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে। ৫ তারিখ সকালে ঢাকায় নেমে মেয়ে গিয়েছে আইডিয়াল কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে। বিকেলে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, বললাম মামার বাড়ি থেকে যেতে। বলল, সম্ভব নয়। কারণ ৬ তারিখে তাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য থাকতে হবে সিলেটে। সেদিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা! রাত ১২টার বাসে (এবার কোনো ট্রেনের টিকিট জোগাড় করা যায়নি) মা-মেয়েকে তুলে দিয়ে এসেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের এই কষ্ট আমরা অনেক দিন ধরে দেখছি। আগে এর সঙ্গে আরও দুই কষ্ট ছিল। ছিল উদ্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি ফরম সংগ্রহ আর সেটি জমা দেওয়ার সংগ্রাম। ফরম জোগাড় করার জন্য বরগুনার একটি মেয়েকে রাজশাহী বা চট্টগ্রামে যেতে হয়েছে। গত বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় মোবাইল ফোনে ভর্তির আবেদন গ্রহণের পদ্ধতি চালু করে সফলভাবে। আমরা ভেবেছিলাম, সব বিশ্ববিদ্যালয় এবার এ পদ্ধতি চালু করে শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করবে। দু-একটি প্রস্তরযুগের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা এই কাজটি করেছে। শিক্ষার্থীদের মামাদের পক্ষ থেকে আমি তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। এ কারণে ফরমের জন্য অন্তত শিক্ষার্থীদের দৌড়াতে হয়নি। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার হয়রানি থেকে আমরা তাদের মুক্তি দিতে পারলাম না এবারও।
দেশে বর্তমানে ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। গড়ে চারটি করে অনুষদ ধরলেও ১২৪টি পরীক্ষা নিতে হবে। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি ইউনিট। সেখানে পরীক্ষা দিতে হলে রাজশাহী শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়!
সাধারণত এ পরীক্ষাগুলো হয় শুক্র অথবা শনিবারে। ১২৪টি পরীক্ষা যদি কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিতে হয়, তাহলে দুই বছর লাগবে। এটি এড়ানো হয় একই দিনে নানা জায়গায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। প্রতিবছর এই সময়টায় ভর্তি-প্রত্যাশী আর তাদের অভিভাবকদের বিপুল অঙ্কের টাকা, শ্রম ও সময় নষ্ট হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াতে। অথচ একটু উদ্যোগ নিলেই এই কষ্ট থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব ছিল। কেমন করে?
কয়েক বছর ধরে আমরা যা বলছি, তা কোনো নতুন বিষয় নয়। দেশের সব মেডিকেল কলেজে একটিমাত্র ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যেকোনো শিক্ষার্থী ঢাকা বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারেন। এমনকি চুয়েট, রুয়েট ও কুয়েট যখন ইনস্টিটিউট ছিল, তখনো একজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিআইটিতে ভর্তি হতে পারতেন। কিন্তু যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলো, তখন তাদের আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল হলো যে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য তারা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে শুরু করল।
দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল, কলা, বাণিজ্য, আইন এবং বিশেষায়িত দু-একটি অনুষদ রয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইচ্ছা করলে’ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে। পরীক্ষার্থীর ফলাফল আর তাঁর পছন্দ অনুসারে তাঁকে ভর্তি করানো যাবে নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে করে আসছে আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজগুলো। আমি ‘ইচ্ছা করলে’ শব্দ দুটি কোটেশন মার্কের ভেতর রেখেছি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেই এ কাজ করতে পারে। সব কটি প্রকৌশল বিশ্ববিদালয়ে একটি, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির জন্য একটি এবং এভাবে মাত্র সাত-আটটি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যন্ত্রণার অবসান ঘটানো যায়। আমার দুঃখ হলো, ঠিক এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েও সেটি এবার বাস্তবায়ন করা যায়নি।
শুধু তা-ই নয়, সামনের দিনগুলোয় যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়বে, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া আরও সহজ ও সাবলীল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে এ সমস্যার সহজ সমাধান করে ফেলেছে। যদি বিশ্বখ্যাত এমআইটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হতো, তাহলে আমাদের নাজিয়া চৌধুরীর মতো সারা বিশ্বের সেরা মেধাবীরা সেখানে জড়ো হতে পারতেন না। তথ্যপ্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের এই যুগে আমাদের শিক্ষার্থীদের শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির হতে হয় ভর্তি হওয়ার জন্য; এটি ভাবলেই আমার গা কেমন যেন শিউরে ওঠে।
আমাদেরও এমন কোনো পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া হবে সহজ ও সাবলীল এবং সেখানে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে কেউ বিশেষ সুবিধা পাবেন না।
আর কাজটা শুরু করতে হবে এখনই।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
৪ নভেম্বর তার পরীক্ষা ছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েটে)। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই চুয়েটে পরীক্ষা দিয়ে মা-মেয়ে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে। ৫ তারিখ সকালে ঢাকায় নেমে মেয়ে গিয়েছে আইডিয়াল কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে। বিকেলে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, বললাম মামার বাড়ি থেকে যেতে। বলল, সম্ভব নয়। কারণ ৬ তারিখে তাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য থাকতে হবে সিলেটে। সেদিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা! রাত ১২টার বাসে (এবার কোনো ট্রেনের টিকিট জোগাড় করা যায়নি) মা-মেয়েকে তুলে দিয়ে এসেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের এই কষ্ট আমরা অনেক দিন ধরে দেখছি। আগে এর সঙ্গে আরও দুই কষ্ট ছিল। ছিল উদ্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি ফরম সংগ্রহ আর সেটি জমা দেওয়ার সংগ্রাম। ফরম জোগাড় করার জন্য বরগুনার একটি মেয়েকে রাজশাহী বা চট্টগ্রামে যেতে হয়েছে। গত বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় মোবাইল ফোনে ভর্তির আবেদন গ্রহণের পদ্ধতি চালু করে সফলভাবে। আমরা ভেবেছিলাম, সব বিশ্ববিদ্যালয় এবার এ পদ্ধতি চালু করে শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করবে। দু-একটি প্রস্তরযুগের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা এই কাজটি করেছে। শিক্ষার্থীদের মামাদের পক্ষ থেকে আমি তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। এ কারণে ফরমের জন্য অন্তত শিক্ষার্থীদের দৌড়াতে হয়নি। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার হয়রানি থেকে আমরা তাদের মুক্তি দিতে পারলাম না এবারও।
দেশে বর্তমানে ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। গড়ে চারটি করে অনুষদ ধরলেও ১২৪টি পরীক্ষা নিতে হবে। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি ইউনিট। সেখানে পরীক্ষা দিতে হলে রাজশাহী শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়!
সাধারণত এ পরীক্ষাগুলো হয় শুক্র অথবা শনিবারে। ১২৪টি পরীক্ষা যদি কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিতে হয়, তাহলে দুই বছর লাগবে। এটি এড়ানো হয় একই দিনে নানা জায়গায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। প্রতিবছর এই সময়টায় ভর্তি-প্রত্যাশী আর তাদের অভিভাবকদের বিপুল অঙ্কের টাকা, শ্রম ও সময় নষ্ট হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াতে। অথচ একটু উদ্যোগ নিলেই এই কষ্ট থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব ছিল। কেমন করে?
কয়েক বছর ধরে আমরা যা বলছি, তা কোনো নতুন বিষয় নয়। দেশের সব মেডিকেল কলেজে একটিমাত্র ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যেকোনো শিক্ষার্থী ঢাকা বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারেন। এমনকি চুয়েট, রুয়েট ও কুয়েট যখন ইনস্টিটিউট ছিল, তখনো একজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিআইটিতে ভর্তি হতে পারতেন। কিন্তু যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলো, তখন তাদের আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল হলো যে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য তারা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে শুরু করল।
দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল, কলা, বাণিজ্য, আইন এবং বিশেষায়িত দু-একটি অনুষদ রয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইচ্ছা করলে’ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে। পরীক্ষার্থীর ফলাফল আর তাঁর পছন্দ অনুসারে তাঁকে ভর্তি করানো যাবে নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে করে আসছে আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজগুলো। আমি ‘ইচ্ছা করলে’ শব্দ দুটি কোটেশন মার্কের ভেতর রেখেছি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেই এ কাজ করতে পারে। সব কটি প্রকৌশল বিশ্ববিদালয়ে একটি, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির জন্য একটি এবং এভাবে মাত্র সাত-আটটি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যন্ত্রণার অবসান ঘটানো যায়। আমার দুঃখ হলো, ঠিক এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েও সেটি এবার বাস্তবায়ন করা যায়নি।
শুধু তা-ই নয়, সামনের দিনগুলোয় যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়বে, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া আরও সহজ ও সাবলীল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে এ সমস্যার সহজ সমাধান করে ফেলেছে। যদি বিশ্বখ্যাত এমআইটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হতো, তাহলে আমাদের নাজিয়া চৌধুরীর মতো সারা বিশ্বের সেরা মেধাবীরা সেখানে জড়ো হতে পারতেন না। তথ্যপ্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের এই যুগে আমাদের শিক্ষার্থীদের শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির হতে হয় ভর্তি হওয়ার জন্য; এটি ভাবলেই আমার গা কেমন যেন শিউরে ওঠে।
আমাদেরও এমন কোনো পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া হবে সহজ ও সাবলীল এবং সেখানে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে কেউ বিশেষ সুবিধা পাবেন না।
আর কাজটা শুরু করতে হবে এখনই।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
No comments