গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী

এখন কয়েকটা দিন কলেজ বন্ধ। ক্রিসমাসের ছুটি। শীতের সোনারদ্দুর আয় আয় করে একসময় খুব ডাকত আমাদের। এখন আর তেমন ডাকে না।

আসলে ইচ্ছেটাই চলে গেছে। ছেলেটা বাইরে পড়ছে। এমন একটা বিষয় নিয়ে পড়তে পাঠানো হলো, যার কোনো বাজার নেই, চাহিদা নেই। ফুড প্রসেসিং। ছেলেটা খুব বিমর্ষ গলায় ফোন করে বেঙ্গালুরু থেকে।
বলে যারা কম্পিউটার বা আইটি নিয়ে পড়ছে, তারা ইতিমধ্যেই ভালোভালো অফার পেয়ে গেছে, আমাদেরই কিছু হবে না। কেন যে এটা নিয়ে পড়তে গেলাম...। আমি বলি, মনে জোর রাখো, বর্ষা বলে ভগবানের কাছে বলো...।
বর্ষা এখন একটু বেশি ঈশ্বরভক্ত হয়ে গেছে। সকাল-সন্ধ্যায় ঠাকুরের আসনের সামনে অনেকক্ষণ বসে থাকে। আগে এতটা ছিল না। আমি একেবারেই নাস্তিক। তাই বলে বর্ষার সঙ্গে এসব নিয়ে ঝগড়া-ঝামেলা করিনি খুব একটা। ও ওর মতো, আমি আমার মতো। মাঝেমধ্যে দক্ষিণেশ্বরে পূজা দিতে যায়, একাই। আমার মাথায় টুক করে একটু ফুল গুঁজে দেয়_আমি প্রতিবাদ করি না আবার হাতজোড়ও করি না। প্রসাদ দিলে খেতাম না, তাই প্রসাদ দেয়টেয় না।
আমি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়াই। নিজেকে মার্কসবাদী বলি। সুযোগ পেলেই নাস্তিকতা প্রচার করি ক্লাসে।
একদিন বর্ষা বলল, 'একটা অনুরোধ করব, না করবে না বলো?'
আমি বলি, 'না করার মতো হলে করব!'
_তাহলে বলব না! আমি একাই যাব।
_কোথায়?
_তারকেশ্বর
_কেন?
_পূজা দিতে।
_তো আমি কী করব?
_তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে বলতাম...।
_তোমার সঙ্গে যেতে হবে কেন? ট্রেনে উঠবে, চলে যাবে...।
তা তো জানি। তুমি গেলে ভালো হতো। একা ভয় লাগে। যাইনি তো কখনো...।
তা ছাড়া শুনেছি, ওখানে পাণ্ডারা ঝামেলা করে। তুমি গেলে ভালো লাগত, একটু আউটিংও তো হতো, শীতকাল, মন্দ লাগত না। কত দিন আমরা একসঙ্গে বেড়াতে যাইনি। তোমার তো কলেজও ছুটি।
এই কথাটা মনে ধরল। তারকেশ্বরের ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দিয়ে একটু তাঁটপুর থেকেও ঘুরে আসা যায়। ওখানে টেরাকোটার কাজ করা মন্দির আছে। যাওয়া হয়নি। বাইরে বেরোলে দু-চারটে অন্য রকম কথাও তো হয়, যেমন দেখো ওই পাখিটা, কী পাখি বলো তো?
চাতক?
চাতক? হুঁ : মাছরাঙা চেনো না? মাছরাঙা খুব রঙিন হয়।
কিংবা ওই দেখ সরষের ক্ষেত। হলুদ হয়ে আছে...
এ রকম আর কী।
একটু ট্রেনের খাবারদাবার পাওয়া যায়, লালসালুতে ঢাকা চপ, কিংবা খাস্তাগজা, মন্দ লাগে না।
সঙ্গে সঙ্গেই বউয়ের ইচ্ছায় সায় দিয়ে দেওয়া কেমন যেন ইয়ে লাগে। বলি, হঠাৎ তারকেশ্বরই বা যাবে কেন? আটটিংয়ে তো অন্য জায়গায়ও যাওয়া যায়।
_বললাম তো, পূজা দিতে।
_কেন, কেন পূজাটা, কেন আবার?
_মানত করেছিলাম।
_কেন মানত? ও যাতে ভালো চাকরি পায়?
_কী যে বল, ওর সেই অসুখের সময়।
_সে তো দু-তিন বছর আগেকার কথা। যখন ডিপথেরিয়া হয়েছিল তখন তো?
_হ্যাঁ। আইডি হাসপাতালের আউটডোরে একটা তারকেশ্বরের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল, আমি হাতজোড় করে বলে ফেলেছিলাম, হে তারকনাথ...
_হুঁ। সে তো চুকেবুকে গেছে। এত দিন পর হঠাৎ?
_হঠাৎ কেন? মাঝেমধ্যেই মনে হয় প্রমিজ রাখিনি।
_তো বাবা তারকেনাথ স্বপ্ন দেখাল নাকি_এই আমার পাওনা দিসনি।
_বাবা তারকেনাথ নয়, সুনীল গাঙ্গুলী। পরশু রেডিওতে শুনলাম সুনীল গাঙ্গুলীর কেউ কথা রাখেনি।
_আমি বলি, সুনীল গাঙ্গুলী শুনলে রাগ করবেন। ওর কবিতা শুনে কেউ তারকেশ্বর যাচ্ছে। তিনি ঘোর নাস্তিক। যেতে হবে না। অন্য কোথাও চলো।
_না গো, খারাপ হবে।
_খারাপ হবে মানে? তারকেনাথ অভিশাপ দেবে না কি?
_না, তা নয়; অ্যাথিকালি খারাপ হবে। এটা দুর্বল মুহূর্তে বলেছিলাম, আমার বাবাইকে ভালো করে দাও...
_ভালো তো হয়েছে পেনিসিলিনের জন্য।
_হতে পারে। কিন্তু আমি তো বলেছিলাম বাবাইকে ভালো করে দাও, ওঁর স্মরণ নিয়েছিলাম, আশ্রয় করেছিলাম। ওঁর মন্দিরে যাব বলেছিলাম। কিন্তু যেটা বলেছিলাম, যেটা প্রমিজ করেছিলাম, সেটা না করলে আমার ভালো লাগবে না।
আমি বলি, এত দুর্বল তুমি...।
বর্ষা কপাল কুঁচকায়। বলে, তুমি দুর্বল, না? তোমরা!
যা ভাব তা বলো? যা বলো তা করো? কী হাল করেছ তোমাদের পার্টিটাকে! তোমাদের দুর্বলতাই আমাদের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়।
আমাদের পার্টি ইলেকশনে হারছে বলে সবাই খোঁচা দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে বর্ষাও দিল। কী আর করা যাবে?
সকালে তারকেশ্বর লোকালে উঠলাম। জালমুড়িটালমুড়ি হলো ট্রেনে। মন্দিরে ঢুকব না ভেবেছিলাম, কিন্তু গেলাম। শিবলিঙ্গ, গ্রানাইট, আদিপাথর_সবাই কী ভক্তিতে জল ঢালছে। হুট করে রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে গেল_কথা কও কথা কও অনাদি অতীত। চেপে গেলাম। বর্ষা হাতজোড় করে বিড়বিড় করল। পাণ্ডাকে পয়সা দিল। কেন যে এর মধ্যে আবার রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে। কোনো মানে হয় না_হে ভৈরব শক্তি দাও ভক্ত পানে চাহ।
পূজা দিয়েছে বর্ষা। পূজার ডালা ওর ব্যাগে। স্টেশনে এসেছি। হরিপাল নেমে আটপুর যাব কি না ভাবছি। কচুরি খেলাম। বেশ লাগল।
স্টেশনে জামালের সঙ্গে দেখা। সৈয়দ আমজাদ জামাল। আমার ছাত্র। মনে মনে বলি, এই রে...! জামাল দেখবে ওর নাস্তিক স্যার তারকেশ্বরে পূজা দিচ্ছে!
জামাল তো আমাকে দেখেই উত্তেজিত। কী আশ্চর্য! আপনি এখানে? আজ সকালেই আপনার কথা মনে হয়েছিল।
আমি তাড়াতাড়ি করে বলে ফেলি, এখানে আমাদের এক রিলেটিভ থাকে। অনেক দিন অসুস্থ, দেখতে এসেছিলাম। বর্ষার দিকে তাকালাম, একটু চোখের কারুকাজ করলাম। চোখ টেপাটা খুব ভালো দেখাবে না। বর্ষা বোধ হয় আমার চোখের ভাষা বুঝল। ও কপাল কুঁচকাল, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল।
জামাল বলল, 'বৌদিসমেত আপনাকে পেয়ে গেছি যখন, সহজে ছাড়ছি না।
'আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাব। কলেজ তো ছুটি। আজ থাকতেই হবে।'
বর্ষা বলে, 'না-না, বাড়ি ফিরে যেতে হবে।'
'কেন? কী করবেন বাড়ি গিয়ে?
'ছেলেও তো নেই। আজ চলুন।
'নলেন গুড়ের পায়েস খাওয়াব। কত গিয়েছি আপনাদের বাড়িতে, কত খেয়েছি। সে দিনগুলো ভুলব কখনো? চলুন না, গাঁয়ের বাড়ি, একদম অন্য রকমের পরিবেশ। আজ খুব জোছনা হবে। বাইরে জোছনা মাখানো হিম পড়বে। সঙ্গে মায়ের রান্না। দারুণ জমবে। কতবার বলেছি, আমাদের বাড়ি যেতে। বলেছিলেন আসবেন। আজ যখন এতটা কাছাকাছি এসেই গিয়েছেন, আজই চলুন।'
জামালের চোখে নির্ভেজাল আকুতি।
আমি বর্ষাকে বললাম, 'চলোই তবে...।'
জামাল এখন হরিপাল কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ায়। আমার কাছেই পিএইচডি করেছে। জামালের গবেষণার বিষয় ছিল গরু নিয়ে রাজনীতি।
জামালের বিষয়টা বেশ অভিনব। আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম। ও আমার খুব প্রিয় ছাত্র। আমাদের দেশের গো-মাতার রক্ষাকর্তা এবং গো-ঘাতকরা যে রাজনীতি করেন, সেই সাম্প্রদায়িক রজনীতিতে কিভাবে বারবার নিরীহ প্রাণী গরুকে ব্যবহার করা হয়েছে_সেটাই তুলে ধরেছে জামাল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি যুদ্ধের সময় রোহিলা খণ্ডের মুসলিমরা ঘোষণা করেছিল, হিন্দুরা যদি স্বাধীনতার এই যুদ্ধে যোগ দেয় তবে ভারতবর্ষে গো-হত্যা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
১৮৭১ সালে লর্ড মোয়ার নির্দেশে হান্টার সাহেবের 'দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্' প্রকাশিত হয়। ওই বইটিতে হিন্দু ও মুসলমানকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলস রাজনীতির শুরু। গরুকে তারা ব্যবহার করতে থাকল। নানা কৌশলে গো-হত্যা নিবারণের জন্য বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংস্থাকে উসকে দেওয়া হলো, আবার মুসলমানদের উত্তেজিত করা হতে লাগল এই বলে যে দেখো, হিন্দুরা তোমাদের খাদ্যের স্বাধীনতার ওপর কিভাবে হস্তক্ষেপ করছে। ১৮৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১০ বছরে গো-হত্যা আর গো-রক্ষা নিয়ে ছয় শ-র ওপর দাঙ্গা বাধে।
স্বাধীন ভারতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গো সদন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্তরে। যেখানে কর্মক্ষমতাহীন গরুগুলোকে আমৃত্যু লালন-পালন করা হবে। কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই খাতে খুব কম টাকা বরাদ্দ হওয়ায় ব্যাপারটা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫৫ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার গো নিবন্ধন কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, গো-জাতের সমস্যা জাতীয় প্রতিরক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গো-জাতির সমস্যা ভারতের অন্যতম সমস্যা।
এসব আলোচনা হতো। সংবিধানের ৪৮ ধারা, গরু সম্পর্কে নেহেরুর বক্তৃতা, জিন্নাহর বক্তৃতা, শ্যামাপ্রসাদের বক্তৃতা, ফজলুল হকের মন্তব্য_এসব কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হতো আমাদের বাড়িতে। তখন একদিন বর্ষা বলল, 'তোমরা বিবেকানন্দ পড়েছো? বিবেকানন্দ।' আমি বললাম, 'এ নিয়ে বিবেকানন্দ কিছু লিখেছেন না কি? বিবেকানন্দের কথা উঠছে কেন?' বর্ষা তখন বিবেকানন্দ রচনাবলির একটা পৃষ্ঠা খুলে সামনে ধরেছিল।
পড়ো। এখানটা পড়ো।
স্বামীজী_আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কী?
প্রচারক_আমরা দেশের গো-মাতাগণকে কসাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করে থাকি।
স্বামীজী_আপনাদের আয়ের পন্থা কী?
প্রচারক_মাড়োয়ারি বণিক সম্প্রদায় এ কাজের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক।
স্বামীজী_মধ্যভারতে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আপনাদের সভা দুর্ভিক্ষকালে কোনো সাহায্যদানের আয়োজন করেছে কি?
প্রচারক_আমরা দুর্ভিক্ষে সাহায্য করি না। কেবল গো-মাতৃগণের রক্ষাকল্পেই এই সভা স্থাপিত।
স্বামীজী_যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাতভাই মানুষ লাখ লাখ মৃত্যুমুখে পতিত হলেও তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেননি?
প্রচারক_না, লোকের কর্মফলে, পাপে এই দুর্ভিক্ষ। যথা কর্ম তথা ফল।
স্বামীজী_আপনাদের গো-মাতা ও আপন আপন কর্মফলেই কসাইয়ের হাতে যাচ্ছেন। আমাদের ওতে কিছু করার প্রয়োজন নেই।
প্রচারক একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন_'হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন তা সত্য। কিন্তু শাস্ত্র বলে, গরু আমাদের মাতা।'
তখন স্বামী বিবেকানন্দ মৃদু হাসিয়া বলিলেন_'হ্যাঁ, গরু আমাদের মাতা তা বিলক্ষণ বুঝেছি, তা না হলে এমন সব কৃতীসন্তান আর কে এসব করবেন?'
ওই অংশটুকু ওর থিসিসে ঢুকিয়ে দিয়েছিল জামাল। পিএইচডি হওয়ার পর মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল। গো-দুগ্ধের ছানায় তৈরি সন্দেশ। জামালের মায়ের নিজের হাতে বানানো। একটু অন্য রকমের স্বাদ। খুব প্রশংসা করেছিল বর্ষা। দুপুরে আমাদের বাড়িতেই খেয়েছিল জামাল। অনেকবার করে বলেছিল ওদের দেশের বাড়িতে যেতে। ঘরে গরু আছে, অনেক দুধ হয়, পুকুরে মাছ, মুরগির ডিম, টাটকা সবজি...। দুটো দিন থাকলেও দেখবেন বেশ ফ্রেশ লাগছে। যাব বলেছিলাম, কিন্তু যাওয়া হয়নি।
আজ মানুষ এবং দেবতা সবার কাছেই কথা রাখা হয়ে গেল। তারকেশ্বর থেকে দশঘড়ায় বাসে যাওয়া যায়। তারকেশ্বর থেকে হাজিপুর ১১ কিলোমিটার। একটা অটো রিজার্ভ করে নিলাম। তারকেশ্বরের ঘিঞ্জি এলাকাটা ছাড়ালেই বেশ খোলা আকাশ। মাঠের কতরকম রঙ। কোথাও সবুজ ধানক্ষেত। শীতেও ধান। মাঠের বিশ্রাম নেই। কোথাও হলুদ। সরষেক্ষেত। ধনে ফুলে ভরা বেগুনি মাঠ, সাদা ফুলকপির ক্ষেত। তারই মধ্যে মাঝেমধ্যে দু-একটা চিমনি। মানে ইটভাটা। মাটি পুড়িয়ে ইট হচ্ছে। ইট দরকার_ইট-সিমেন্ট-লোহা মানে উন্নয়ন। মাঝখানে কালো রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বাবলা গাছ ঝুঁকে আছে। যেন তোরণ। মাঠের মাঝখান দিয়ে আঙুল দেখায় জামাল; ওখানে চিড়েতনের পাপড়ির মতো তিনটে খেলনার গ্রাম। জামাল বলল, 'মাঝখানের গ্রামটা হাজিপুর।'
ডানদিকে রাস্তা। একটু সরু। রাস্তায় ঢুকবার মুখেই একটা বোর্ড। 'এই রাস্তা পাকা করিয়াছে হাজিপুরের বর্তমান গ্রাম পঞ্চায়েত। ভোট দেবার সময় মনে রাখিবেন।' আর একটু দূরে একটা বাড়ির গায়ে বড় বড় লেখা_'হাজিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে মুসলিম স্বার্থে, ইসলামের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য মুসলিম কনফারেন্স প্রার্থী মহম্মদ ইকবালকে ভোট দিন। বর্তমান পঞ্চায়েত বোর্ডকে পরাস্ত করুন।'
আমি বলি_পঞ্চায়েত ভোট তো হয়ে গেছে।
জামাল বলে_ভোট হয়ে গেছে, চিহ্ন রয়ে গেছে। একটু পরই বলল_ইকবাল আমার ভাই।
জিতেছে?
ঘাড় নাড়ল জামাল। যেন জিতে ঠিক করেনি।
পিচ রাস্তা থেকে এবার বাঁদিকে কাঁচা রাস্তা। অটো বলল আর যাব না। এখানে নেমে যান।
নেমে গেলাম। হাঁটছি। বর্ষার মুখে খুশির আভা। গরুর গাড়ি যায় বলে রাস্তার দুধারে দুটো রেখা। মাঝ বরাবর যেন কুঁজ উঠেছে। একটা রোগা মসজিদ, মিনারে দুটো তাগড়া মাইক ফিট করা! কিছু খড়ের চালের বাড়ি ঝুঁকে পড়েছে কুঁজো বুড়োদের মতো! দেয়াল থেকে খসে পড়েছে মাটির চাপড়া। বিদ্যুতের পোস্টও রয়েছে। পোস্টে চাঁদ তাঁরা। একটা কোঠা দালান! বাইরেটায় সিমেন্ট-বালির পলেস্তারা পড়েনি এখনো। ইটের ওপরই কিছুটা অংশে চুনকাম করে আলকাতরা দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে_মুসলিম কনফারেন্স প্রার্থী মহম্মদ ইকবালের নির্বাচনী কার্যালয়। আরেকটু সামনে গেলেই কোঠা-দালান, তারপর উঠোন। উঠোনের শেষে একটা দোতলা মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। নিচে একটা ঘরে গিয়ে বসাল জামাল। বলল, 'এটা আমার ঘর।' ঘরে বইয়ের আলমারি, টিভি, ফ্রিজ, চৌকি_ঠাসা ঘর। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি। আর একটা দেয়াল-ঘড়ি। ঘড়িতে ৭টা বেজে আছে, কিন্তু এখন বেলা ১টা।
আগে একটু ডাব খান...।
জামাল হুকুম করতেই একটা লোক ডাব কেটে দিয়ে গেল।
আবার হুকুম করতেই লোকজন পুকুর থেকে বালতি বালতি জল এনে নতুন কোঠার বাথরুমের চৌবাচ্চাটা ভর্তি করতে লাগল।
কোঠা দালানটার লম্বালম্বি বারান্দা। পরপর কয়েকটা ঘর। একটা ঘরের লোহার শেকল খুলে জামাল বলল, 'এটা আমাদের গেস্টরুম। এই ঘরে থাকবেন।'
ঘরে বড় তক্তাপোশ। একটা ময়ূর খোদাই করা কাঠের আলমারি, তাতে আয়না বসানো। পরিষ্কার চাদর। বালিশে এমব্রয়ডারি করা ফুল, লতাপাতার মাঝখানে লেখা_খোদার মেহেরবাণী।
বর্ষা চুল খুলে বারান্দায় দাঁড়াল। শস্যের গন্ধ। উঠানের একপাশে স্তূপাকার ধান। অন্য পাশে একটা চালাঘর। দেয়াল নেই, সেখানে সারি সারি ধান সেদ্ধ করার উনুন।
একটি পূর্ণগর্ভা নারী উঁকি দিল, তারপর ঘোমটা টেনে ঢুকে গেল।
জামাল বলল, 'আমার ছোট ভাইয়ের বউ।'
মানে ইকবালের?
হ্যাঁ।
ইকবাল কোথায়?
ওর কত কাজ...।
মা কোথায়?
ওই বাড়িতে থাকেন।
ওই মাটির বাড়িতে।
হ্যাঁ। ওই বাড়িতে কত ঘর। মা ওই বাড়ি ছেড়ে আসতে চান না। ওই বাড়িটা দেখুন, হেলে পড়েছে, মা তবু ওই বাড়ি ছাড়বেন না। চলুন যাই, দেখা করে আসি।
একটু অন্ধকার অন্ধকার ঘর। সাদা শাড়ির ওপর একটা ধূসর বালপোশ জড়িয়ে বসে আছেন জানালার ধারে। কপালে দীর্ঘদিন ধরে নামাজের সিজদা করার দাগ।
জামাল বলল, 'স্যারকে ধরে এনেছি মা। সঙ্গে বউদি। পেয়ে গেলাম। ওরা তারকেশ্বরে ওদের এক আত্মীয়ের বাড়ি এসেছেন।'
জামালের মা বললেন, 'আপনাদের কথা কত শুনেছি। আপনারা যে মেহেরবাণী করে এলেন, তাতে বড় খুশি হলাম। আপনাদের জন্যই আমার ছেলে সরস্বতী পেয়েছে।' সরস্বতী পেয়েছে কথাটা শুনে আমি বর্ষার চোখের দিকে তাকালাম।
বসুন। একটু শরবত বানিয়ে দিই।
মাটির দেয়ালে একটা কুলঙ্গি। কুলঙ্গিতে একটা রুহ আফজার বোতল। কয়েকটা কাচের গ্লাসও আছে। জগে জল নেই। মাটির দেয়াল কেটে বানানো জানালায় মুখ রেখে প্রৌঢ়া হাঁকলেন_ও নেহার...পানি নে আয় লো...।
বললেন, জামাল শাদি করছে না। ওকে ধরে-বেঁধে একটা শাদি দিয়ে দাও দেখি। বাড়িতে একটা মোটে বউ। একটা বউতে হয়? এত বড় বাড়ি...। তুমিতে চলে এলেন জামালের মা।
রুহ মানে আত্মা। কাচের গ্লাসে রুহ আফজা ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলেন, 'তোমাদের কথা ও ঠিক মানবে। এটা নক্খী মে আনতে বলো।'
কাজের মেয়ে নেহারবানু পানি নিয়ে এলে ইউসুফের মা শরবত করতে থাকেন। বিছানায় একটা বই পড়ে আছে। ইসলামী আধুনিকতা ও মাছলা মাছায়েল, মহম্মদ ইকবাল প্রণীত। এ রকম অদ্ভুত নাম দেখে বইটা টেনে নিলাম। পৃষ্ঠা উল্টে দেখি_উৎসর্গ : আম্মাজানকে।
সূচিপত্রটা দেখতে থাকি।
নারীর বৈশিষ্ট্য
পর্দা কী ও কেন
নারীর সুন্নত
কোরআনের আলোকে আধুনিকতা
ওজুর ফজিলত...
দাও, বইটা দাও। দেখতে হবে না...। বইটা টেনেই নিলেন জামালের মা।
বললাম, 'ইকবালের লেখা তো, তাই একটু দেখছিলাম...।'
_কী আর দেখবে, ওটা দাও। বললেন, ছেলেকে জিনে পেয়েছে। জামাল বলল, অনেক বেলা হয়ে গেল। স্নান সেরে নিন।
_স্নানটান সেরেই তো বেরিয়েছি।
_তবে হাত-পা ধুয়ে নিন। খেতে দেওয়া হচ্ছে।
বারান্দায় একটা ফোল্ডিং টেবিল পেতে দেওয়া হয়েছে। তিনজন বসেছে। জামালের মা নেমে এসেছেন। রান্নাঘর থেকে খাবার বয়ে আনছে নেহারবানু-কুলসুমরা, জামালের মা প্লেটে সাজিয়ে রাখছেন, জিজ্ঞেস করলাম ইকবাল খাবে না? উনি বললেন, ওর কথা বোলো না। কখন খায় কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। শাক ভাজা, মাছ ভাজা, ডাল, মাছের ঝোল, মাছের টক। বড় পুকুর থেকে মাছ ধরে পাশের ছোট পুকুরে রাখা হয় যেন দরকার মতো তোলা যায়। সেই তাজা মাছ। খুব স্বাদ। তবে একটু রসুন্যে আধিক্য মনে হলো। পালংশাকে পেঁয়াজ দিয়েছে কেন?
বিছানাও রেডি। জামাল বলল, 'একটু গড়িয়ে নিন।' বর্ষা বলল, 'ঘুমোব না। বরং গ্রাম দেখব।'
দেখবেন? বড় দারিদ্র্য...।
এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হাড়জিরজিরে বলদ। পেটফোলা শিশু। মাদ্রাসা। সাদা আলখেল্লা আর মাথায় টুপি পরা, থুতনিতে দাড়ি রাখা কয়েকজন। পাজামা পায়ের গোড়ালি থেকে এক ইঞ্চি ওপরে উঠে আছে। লুঙ্গি পরা দু-একজন মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটা মাটির প্রাচীরে 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' ঝাপসা হয়ে গেছে, বরং গদ্য লেখা 'ইসলামী ঐক্য জিন্দাবাদ' জ্বলজ্বল করছে।
জামাল বলল, 'পাশাপাশি তিনটে গ্রামের সবাই মুসলমান। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতে কোনো মৌলবাদী দল জেতেনি এত দিন। এবারে ওরা খুব অ্যাকটিভ। বলছে, এত দিনের শাসনে মুসলিমদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবার পরিবর্তন চাই। আমার ভাই ইকবাল ওদের একজন পাণ্ডা।'
ও কেন এ রকম হয়ে গেল? আমি জিজ্ঞেস করি।
_সেটাই আশ্চর্য। আমাদের বাড়ির পরিবেশ কিন্তু একদম অন্য রকম। আমাদের বাড়িতে কখনো গরুর মাংস ঢোকেনি।
মা বলেন, 'প্রতিবেশীর মনে দাগ দেওয়া গোশত হজম হয় না। যদিও কোনো হিন্দু প্রতিবেশী নেই, আমার বাবাও ধার্মিক ছিলেন, নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন; কিন্তু বাংলা সন-তারিখের জন্য দেউলপুরের বাজার থেকে মনসার ছবিওয়ালা কিংবা রাধাকৃঞ্চের ছবিওয়ালা বাংলা ক্যালেন্ডার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এই পরিবেশে থেকেও ইকবাল কেন এমন হয়ে গেল জানি না।'
আমরা একটা চৌমাথায় পড়লাম। সাইকেল ভ্যানে কিছু লোক। জামাল বলল, আজ বেউলপুরের হাট। একটা ফাঁকা বিড়ির প্যাকেট ফেলল কেউ। প্যাকেটে লেখা জয়রাম বিড়ি। জামাল বলল, 'বাবরি মসজিদ ভাঙার পরপর দেউলপুরে রাম মন্দির হলো। জয়রাম বিড়ির তখনই উৎপত্তি। দেউলপুরের বাজারে ইকবাল বোকার মতো কিছু বলতে গিয়েছিল। ইকবালের বয়স তখন অনেক কম। ওখানে তর্কাতর্কি হয়েছিল। মারও খেয়েছিল। সেই থেকেই ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন। এখন আর সেই সময়ের মতো অবস্থা নেই। কিন্তু মুসলমানদের উন্নতির নামে কিছু লোক কেমন যেন হয়ে গেল। যেন ইসলাম ইসলাম করলেই মুসলমানদের উন্নতি হবে। দু-একটা পলিটিক্যাল পার্টি ইন্ধনও দিচ্ছে।'
আমি বলি, 'বুঝলাম।'
সূর্য ঢলছে। পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে বাসায় ফিরছে। সন্ধ্যার আজানের আওয়াজ এল একটু পরই। এবার আমরাও ফিরছি।
ওদের বাড়ির বারান্দায় একটা মিটিং চলছে। জামাল বলল ইকবালের দলবল। বলল, 'ভালো লাগে না স্যার। বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না।'
আমি বলি_'চলে যাও তাহলে। বিয়ে করো। হরিপাল কলেজের কাছাকাছি পাশে থাকো। পারো তো মাকেও নিয়ে যাও...।' জামাল হাসল। বলল, 'হরিপালে সহজে ঘর ভাড়া পাব? কেউ ভাড়া দেবে? কোনো বাড়িওয়ালা দেবে না। মুসলমান না?'
মিটিংয়ে ইকবাল বলছে, 'যারা বলে ইসলাম পুরান হয়ে গেছে, তারা মিথ্যা বলে। ভুল বলে। কোরআন আজও আধুনিক। কোরআনেই আছে রেডিও অ্যাকটিভিটির ব্যাখ্যা। ফিজিঙ্, কেমিস্ট্রি_সব কোরআনে আছে। কিন্তু আমাদের তা জানতে হবে। বুঝতে হবে। আর ইসলামী গানের কথা বলি, যা আছে তা আছে। ঠিক আছে, তবে নতুন নতুন গান আমাদের নবীন প্রজন্মের জন্য রচনা করতে হবে। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি, যেটা আমি রচনা করেছি।'
'তোমারি রহমে ইলেকট্রন প্রোটন
পবিত্র নূর ফোটন রাশি
আরএনএ ডিএনএ তুমি গড়িয়াছ
তোমার ইচ্ছায় কাঁদি আর হাসি।
আমাদের মনে কালিমা যা ছিল
কলেমায় তাহা মুুছিয়া যায়
বি্লচিং যেমন জীবাণুনাশক
আল্লার নাম তাহারই প্রায়।'
শীতের সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এল। ওদের মিটিংয়ে চা এল। আমাদেরও চা দরকার ছিল। ওদের কাছ থেকে কয়েক কাপ চা চেয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল জামাল।
বারান্দায় চলছে ইসলামী আলোচনা। আর এই ঘরে জামাল আর আমার মধ্যে শুরু হলো অন্য তত্ত্বকথা। ফলে মার্কস নিজে কতটা মার্কসবাদী ছিলেন, এঙ্গেলস মেয়েদের যোগ্য সম্মান দিতেন কি না, কার্লমার্কসের সময়ের শ্রমিক আর আজকের শ্রমিক, শ্রমিকরা কি সত্যিই কোনো শ্রেণী, না শ্রমিকদের মধ্যেই শ্রেণীভেদ আছে। কন্ট্রাক্টরের আন্ডারে কাজ করা মজদুর আর লারসেন টুবরো কিংবা ব্রিটানিয়া কম্পানির শ্রমিকরা কি একরকম চিন্তা করতে পারে? মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা অমর্ত্যসেন কতটা বামপন্থী এসব...।
ধীরে ধীরে ওই দোতলা মাটির ঘরটির দিকে হেঁটে যাই। শীত গাঢ় হচ্ছে। জোনাকিরা খেলছে। রান্নাঘর থেকে মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। মাটির ঘরে গেলেই মাটির নিজস্ব গন্ধ। কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে ঘরে। জামালের মা খাটে বসে রেডিওতে কৃষিকথার আসর শুনছেন। বর্ষাকে দেখতে পেয়ে উঠে বসলেন। বললেন, 'এসো গো মেয়ে।'
বর্ষা যেন কী রকম রোমাঞ্চিত হলো এই আহ্বানে।
'বোসো।'
কাঁচা চাদরে রদ্দুরের গল্প। দেয়ালে দুলদুল ঘোড়ার বাঁধানো ছবিটা আগে লক্ষ করিনি। তিনি বললেন, 'এই বাড়িতে অনেকেই আসে। আমার এই মাটির ঘরে কেউ আসে গো। সব কোঠাদালান, থেকেই চলে যায়, তোমরাই এলে।'
কী অবলীলায় আমাদের 'তুমি' বলছেন এই গ্রাম্য মহিলা। শহুরে সুন্দরী বিদূষীকে তুমি বলার, আপন করার এই স্মার্টনেস কোথা থেকে পেলেন এই অশিক্ষিত মহিলা?
গ্রাম দেখলে?
হুঁ।
কী বুঝলে?
কিছু বলে না বর্ষা।
ইকবালের মিটিং চলছে দেখলে?
হুঁ। দেখলাম।
ছেলেটা আমার বখে গেছে।
কুলুঙ্গিতে সেই বইটা। বইটা খোলে বর্ষা। এবার আমাকে দেয়। বলে, 'পড়ো এখানটা...।'
'নারীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে আগুনের সঙ্গে দাহ্য পদার্থের যে সম্পর্ক, টকের সঙ্গে জিহ্বার যে সম্পর্ক, একজন যুবতীর সঙ্গে পুরুষেরও সেই সম্পর্ক। টক দেখলে যেমন জিহ্বায় পানি আসবে, তেমনি একজন বেপর্দা যুবতীকে দেখলেই একজন পুরুষ যৌনসাগরে ঢেউ খেলতে শুরু করবে। এক ধরনের মাছির কথা ধরা যাক, যারা পাকা ফলের রস খেতে ভালোবাসে। তারা ফলের দোকানে গিয়ে ভোঁ ভোঁ করে, কিন্তু ফলের আবরণ থাকায় ফলের রস খেতে পারে না। যদি একবার ফলের খোসা খুলল তো মাছিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল। পর্দা হলো ফলের আবরণের মতো। সুতরাং মা-বোনেরা, এবার নিশ্চয় বেপর্দার কুফল বুঝতে পেরেছেন...।'
এরপর অনেক গল্প হলো। বিরিয়ানি বানানোর গল্প, কাবাব কিভাবে নরম করতে হয়, কেয়ামতের গল্প, ইস্রাফিলের গল্প, নবীর কথা...।
জামালের বাবা ছিলেন একজন কবি। সৈয়দ বংশের লোক হয়েও খোদা তালায়ার সঙ্গে কৃষ্ণ মিশিয়ে গান বাঁধতেন। মাটির ঘরের সোঁদা গন্ধ।
পাশে একটা ঘর আছে। ওই ঘরে কয়েক বস্তা ধান। ধানের কী আশ্চর্য গন্ধ। একটা তক্তাপোশও পাতা। পাশেই জানালা। বর্ষার খুব ইচ্ছে করছিল রাতে ওই মাটির ঘরেই শোয়। মাকে বলল, ওই ঘরেই শোব।
মা বললেন ও ঘরে শোবে কেন গো, কোঠাদালান থাকতে... বর্ষা বলল_ভীষণ ইচ্ছে করছে যে...
খাওয়াদাওয়ার পর আবার ওই মাটির ঘরটায় চলে এলাম আমরা। আবার গল্প হলো কিছুক্ষণ। বর্ষা একটু হাত বুলিয়ে দিল ওই বৃদ্ধার মাথায়। গল্প করতে করতে জানা গেল, তিনিও গান বাঁধেন।
একটা গান শোনালেন কাঁপা গলায়_
'মানুষ যদি না হইত
কে গাহিত খোদার নাম
কবি যদি না লিখিত
কে জানিত বৃন্দাবন ধাম।'
ওমা! এ যে দেখি সেই রবীন্দ্রনাথের আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।
রাতে বিছানা পেতে দিলেন জামালের মা। পাশের ঘরের তক্তাপোশ। মাথায় বালিশে ফুল-লতা। ভারি সুন্দর দিনটা কাটল। বালিশটা একটু নিচু। নিচু বালিশে একটু অসুবিধে হয় আমার। বর্ষার ব্যাগটা ফোমের লাইনিং দেওয়া আছে। ব্যাগের ভেতরে একটা ছোট চুবড়িতে তারকেশ্বরের প্রসাদ। কেউ জানে না। তারকেশ্বর এ বাড়িতে গোপন। চুবড়িটা ব্যাগ থেকে বের করে ধানের বস্তার ফাঁকে রেখে দিল বর্ষা। ব্যাগটা দিয়ে বালিশ উঁচু করলাম। তারপর ধানের গন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। ভোর দেখতে বিছানা ছেড়ে চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে গেল বর্ষা। আমি একটু পরেই উঠলাম। চা-টা খাওয়া হলো। এবার যাব।
তারকেশ্বরে পেঁৗছেই বর্ষা বলল, তারকেশ্বরের প্রসাদটা ফেলে এসেছি।
আমি আঁৎকে উঠলাম। সে কী? জামাল কী ভাববে? হিপোক্র্যাট ভাববে। তুমি ফেলে এলে? কিচ্ছু মনে থাকে না?
তোমার বালিশ উঁচু করতেই তো...
তাই বলে ফেলে আসবে? ইস্। জামাল কী ভাববে আমায়? ভাববে আমার কথায় আর ভাবনায় কোনো মিল নেই। ওদের কাছে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ!
দুদিন পর জামাল এসে হাজির। হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ।
জামাল বলল, 'মা এটা পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, আজই যা। এই ব্যাগে কী আছে আমি জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী এমন দরকারি জিনিস আছে এতে?
'মা বললেন, তোর জানার দরকার নেই।' ছোট্ট চটের ব্যাগটার মুখ সেলাই করে দেওয়া হয়েছে।
জামাল চলে গেল। বর্ষা ব্যাগের সেলাইটা খুলল। ব্যাগের ভেতরে একটা পলিথিনের ব্যাগ। পলিথিনের ওই ব্যাগের ভেতরে কিছু সন্দেশ। সেই সন্দেশ। ঘরের ছানার তৈরি। এর তলায় সেই চুবড়িটা, তাতে সেই বেলপাতা মাখানো নকুলদানা।
এরপর নিস্তব্ধতা। বর্ষা বলল, 'সেই মাটির গন্ধটা পাচ্ছি যেন ব্যাগের ভেতর থেকে। তুমি পাচ্ছ?'
আশ্চর্য, আমিও পাচ্ছি।
=====================================
সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার  কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী  শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর  আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন সন্ত্রাস'  সাহিত্যালোচনা- 'মারিও ভার্গাস ইয়োসা'র সাহিত্যে নোবেলের রাজনৈতিক মোড়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা by নূরুল কবীর  রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া 


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ স্বপ্নময় চক্রবর্তী


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.