আদিবাসী আলোচনা- 'বেদিয়া নাকি সাঁওতাল' by সালেক খোকন

পাকা রাস্তা থেকে পূর্বদিকে নেমে গেছে একটি মেঠোপথ। হেলে দুলে পথটি গিয়ে মিশেছে পিপল্লা গ্রামে। রাস্তার দুদিকে সবুজের হাতছানি।

এক পাশে গহীন শালবন আর অন্য পাশে বিস্তীর্ণ মাঠে চারা লাগানোর ধুম পড়েছে। আদিবাসী নারীরা একমনে বুনে দিচ্ছে আশীর্বাদের চারাগুলো।
দিনাজপুরের এ এলাকাটি নানা ভাষাভাষি আদিবাসীদের বাস। পিপল্লা মূলত একটি সাঁওতাল গ্রাম। সেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতেই যাচ্ছি আমরা। পিপল্লা কতদূর? প্রশ্ন করতেই এক বৃদ্ধ জানাল এক ঘণ্টার হাঁটার পথ। কোনো যান না চলায় হাঁটতে থাকি ধীরপায়ে।
আমাদের সঙ্গেই হেঁটে চলেছে কয়েক আদিবাসী। হেঁটে যেতে যেতেই পরিচয় হয় তাদের সঙ্গে। নাম জানাল মেনকা মুরমুর, লারগী টুডু, বাহামন টুডু, রবিন বাছকি। সবাই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আদিবাসী। তারাও যাচ্ছে লারকি মুরমুর বিয়ের অনুষ্ঠানে।
মেনকা মুরমুর বয়স নিদেনপক্ষে ষাট বছর। কিন্তু চোখেমুখে বয়সের ছাপ নেই এতটুকু। চলতে চলতে আলাপ হয় তার সঙ্গে। মেনকা জানাল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নামের শেষে জুড়ে দেয়া শব্দগুলো তাদের জন্মান্তর চিহ্ন। সাঁওতালী ভাষায় ‘টোটেম’। গোষ্ঠী বা উপগোষ্ঠীর টোটেমের নামকরণ হয়ে থাকে পূর্বপুরুষ, বাসস্থান, ফল-মূল, নদী-নালা, গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির নামে। মেনকা নামের পরে কেন মুরমুর যুক্ত হলো? এ রকম প্রশ্নে মেনকা মুচকি হাসে। অতঃপর বলতে থাকে মুরমুর টোটেমের সাঁওতাল কাহিনীটি।
মুরমু অর্থ নীল গাভী। তাই নীল গাভী তাদের টোটেম। সাঁওতালদের বিশ্বাসে নীল গাভী নিয়ে প্রচলিত আছে একটি গল্প।
‘এক অরণ্যভূমিতে বাস করত অনেক লোক। একবার কাজ করতে তারা অরণ্যে গেল। কাজ করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে তারা একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় দলের সর্দার ঘুমিয়ে পড়ল। সেই বনে বাস করত এক হিংস্র নীল গাভী। গাভীটি এসে পায়ের চাপা দিয়ে সর্দারকে মেরে ফেলল। ঘুম থেকে জেগেই লোকেরা তখন দলবেধে গাভীটাকে হত্যা করল। সেই থেকে মৃত ব্যক্তির গোষ্ঠীর নাম বা পদবি ‘মুরমু’। এখানেই শেষ নয়।
যারা গাভীটি ধরেছিল তারা ‘খেদোয়ার মুরমু’।
যারা গাভীটির হাড় কেটেছিল তারা ‘সামাক মুরমু’।
যারা গাভীটির লেজ টেনে ধরেছিল তারা ‘নিজ মুরমু’।
যারা গাছের ছায়ায় বসে শুধু ঘটনাটিকে দেখছিল। যারা ছিল সবচেয়ে অলস। তারা ‘উবর মুরমু’।
যারা চম্পফুল দিয়ে খুশিতে নিজেদের সাজিয়ে ছিল তারা ‘চম্পাবাহা মুরমু’।
যারা গাভীর রক্তে কপালে তিলক এঁকেছিল তারা ‘টিকা মুরমু’।
যারা পাতা কেটে এনে মাংস রান্না করেছিল তারা ‘খল্লা মুরমু’।
এভাবেই সাঁওতালদের মুরমু গোত্রে সাতটি উপগোত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
মেনকা মুরমুর কথা শুনছিলাম তন্ময় হয়ে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আরেকজন আদিবাসী ধীরগতিতেই হেঁটে চলেছে আমাদের সঙ্গে। তার নাম জানতে চাইলে কোনো উত্তর মেলে না। আমরা অবাক হই। কিন্তু হাল ছাড়ি না। হাঁটতে হাঁটতে তার সঙ্গে গল্প জমানোর চেষ্টা করি। আপনি তো সাঁওতাল? প্রশ্ন করতেই উত্তর মেলে আমরা ‘বেদিয়া’। সম্প্রদায়ের নাম শুনে আমরা খানিকটা অবাক হই। লোকটি তার নাম জানাল রাগদা মাহাতো। বাড়ি কয়েক গ্রামের ওপারে, বহবলদিঘিতে। তবে তার আদি বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জে। কথা বলতে বলতে আমরা এগিয়ে চলি রাগদা মাহাতোর সঙ্গে। তার কাছ থেকে শুনি বেদিয়া সম্প্রদায়ের নানা কথা।
বেদিয়ারা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ১২টি গোত্রের মধ্যে একটি হলেও এরা নিজেরা তা অস্বীকার করে। নিজেদেরকে এরা আলাদা আদিবাসী জাতি হিসেবে দাবি করে। এদের সঙ্গে সাঁওতালদের সকল উৎসব ও পূজা পার্বণে মিল থাকলেও একেবারে মিল নেই ভাষার সঙ্গে। এরা মু-া ও ওঁরাওদের মতো সাদরী ভাষায় কথা বলে। জনশ্রুতি আছে যে, বেদিয়া রাজা শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে ওঁরাও এবং মু-াদের সঙ্গে একত্রে বসবাস শুরু করে। সেই থেকেই বেদিয়ারা সাদরী ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
বেদিয়াদের পদবি বা উপাধি হলো ‘মাহাতো’। এদের মধ্যে গোত্র বিভক্তি রয়েছে। গোত্রগুলো জীবজন্তুর নামে নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন : পেচা, বিহা, মহকল, কছুয়া, ওইয়া, চিড়ড়া ইত্যাদি। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতোই এদের গোত্রের নামের জীব হত্যা করা নিষেধ। যেমন : পেচা গোত্রের বেদিয়ারা পেচাকে হত্যা করে না বরং পেচা তাদের কাছে পূজনীয়। একইভাবে এদের একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ।
অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো বেদিয়াদেরও একজন গ্রামপ্রধান থাকে। যাকে এরা মোড়ল বা পরধান বলে ডাকে। মোড়লকে সাহায্য করার জন্য একজন করে সহকারী থাকে। এদেরকে বলে ভগত। ভগত গ্রামের রোগ বালাই দূর করার জন্য দেবীর পূজা অর্চনাও করে থাকে। ভগতের সাহায্যকারী হিসেবে থাকে বেশ কয়েকজন শিষ্য। এদেরকে সখা বলে। ভগতের অনুপস্থিতে এরাই দায়িত্ব পালন করে।
রাগদা মাহাতোর কাছে তাদের পূজা অর্চনার কথা জানতে চাইলে মুচকি হেসে বলতে থাকে পূজার নামগুলোÑ সহরাই, পুশনা, ফগুয়া, মনসা, কারাম প্রভৃতি। স্যামা পূজার অমাবস্যার পরের দিন হয় সহরাই। পৌষ সংক্রান্তিতে হয় পুশনা। দোল পূর্ণিমার দিন ফগুয়া আর শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয় মনসাপূজা।
বেদিয়ারা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে সহরাই উৎসবটি। হিন্দুদের দিপাবলীর মতো উৎসবের আগের রাতে বেদিয়ারা বাতি জ্বালায়। প্রতিটি ঘরে এবং নিকটবর্তী ফসলের খেতে পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো সরিষার তেলে ভিজিয়ে পাট কাঠির সঙ্গে কলার ডগা আড়াআড়িভাবে গেঁথে তার ওপরে তেলে ভেজা শলতা লম্বালম্বিভাবে দিয়ে আগুন জ্বালাতে হয়। এ সময় বেদিয়া আদিবাসী ছেলেমেয়েরা একটি ছড়া বলতে থাকে; দিয়া বাতি হো হো... আর অন্যরা তখন নাচতে থাকে। অতঃপর হালকা খাবার খেয়ে শোয়ার পূর্বে এরা শরীরের বিভিন্ন অংশে তেল মাখে। এরা মনে করে এতে ভূত-প্রেত ও ডাইনিরা শরীরে রোগবালাই বিস্তার করতে পারে না। সকাল হতেই শুরু হয় সহরাইয়ের মূল অনুষ্ঠান।
সকালে প্রত্যেক বাড়িতে চালের আটা ভাঙ্গার ধুম পড়ে যায়। বাড়ির প্রবীণরা সড়া গাছের ডাল দিয়ে গরইয়া বানাতে ব্যস্ত থাকে। অন্যরা চাষাবাদের লাঙ্গল, জোয়াল, কোদাল, খোন্তা, নিরানি, পাঁচন প্রভৃতি পরিষ্কার করে। পূজার জন্য তেলের পিঠা ভাজা হয়। এই তেলের পিঠা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। পূজার পরে বাড়ির কর্তা পরিবারের সকলের সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। একইভাবে মঙ্গল কামনা করা হয় তাদের ধন সম্পদ রুপি গরু-বাছুরের জন্য।
সহরাইয়ের বিকেলের পর্বটি বেশ অন্যরকম। বাড়ির বাহির থেকে গরুর গোয়ালঘর পর্যন্ত চালের আটা গুলিয়ে আলপনা আঁকা হয়। আগের রাতের মতো জ্বালানো হয় বাতি। অতঃপর একটি একটি করে গরু-বাছুর পালাক্রমে আলপনা আঁকা রাস্তা দিয়ে গোয়ালঘরের দরজা পর্যন্ত আনা হয়। সেখানে গৃহকর্ত্রী নিজ হাতে গরু-বাছুরের পা ধুয়ে ধান, দূর্বা ও উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে। সে সময় গরু-বাছুরকে খাওয়ানো হয় তেলের পিঠা। অনুষ্ঠান শেষে গোয়াল থেকে আবার গরু বের করার সময় সরিষা বীজ নিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত টেনে ঐ সরিষা মাটির পাত্রের আগুনে দিয়ে পোড়ানো হয়। বেদিয়াদের বিশ্বাস এতে তাদের আপদ বিপদ দূর হয়ে যায়। সহরাই উৎসবকে গোয়ালপূজাও বলা হয়ে থাকে। ঐদিন সারারাত নাচগানের সঙ্গে চলে হাড়িয়া খাওয়া।
এরই মধ্যে আমরা পিপল্লা গ্রামের কাছাকাছি চলে আসি। রাগদার সঙ্গে ক্রমেই আমাদের গল্প জমে ওঠে। বেদিয়াদের ঝুমুর উৎসবের কথা শুনি তার কাছে। আদিবাসীদের ঝুমুর উৎসবের কোনো বাধা ধরা দিন বা তিথি নেই। যখন ঘরে কাজ থাকে না তখনই তারা পরিকল্পনা নেয় ঝুমুর উৎসব পালনের। এ উৎসবে আদিবাসীরা পালা করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঝুমুর গীত গায়। সঙ্গে চলে ঝুমুর নাচ আর নানা আনন্দ উল্লাস।
সাঁওতালদের মতো বেদিয়ারাও ভাদ্র মাসের শেষে পালন করে থাকে ছাতা পরব অনুষ্ঠানটি। এ অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট এক স্থানে একটি লম্বা বাঁশ পুঁতে তার অগ্রভাগে একটি ছোট ছাতা বেঁধে দেয়া হয়। অতঃপর ছাতার নিচে পূজার থান তৈরি করে সেখানে পূজা দেয়া হয়। বিভিন্ন বোঙ্গার মতো এটিও ছাতা বোঙ্গার স্মরণে করা হয়ে থাকে।
রাগদা জানাল বেদিয়াদেরও মূল ধর্ম বিশ্বাস সনাতন। পিসছু হাডম ও সিমকু বুড়ি তাদের আদি মানব। সাঁওতালদের মতো বেদিয়ারাও বিশ্বাস করে কচ্ছপের পিঠেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বেদিয়ারাই আজকাল হিন্দু সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। ফলে বেদিয়ারা ক্রমেই সরে যাচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি কালচার থেকে। বেদিয়ারা হারিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য জাতি, ধর্ম আর সংস্কৃতির স্রোতে।
মাদল আর ঢোলের শব্দ চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরে। বুঝে ফেলি আমরা পৌঁছে গেছি পিপল্লা গ্রামে। বিয়ে উপলক্ষে গোটা গ্রাম যেন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। বেদিয়া গোত্রের রাগদা মাহাতোকে বিদায় জানাই আমরা। ঢুকে পড়ি বিয়ের আনন্দ আসরে। হঠাৎ মনে হলো জানা হলো না রাগদার গন্তব্য কোথায়? কোথায়ইবা যাচ্ছে এই বেদিয়া?
================================
আলোচনা- 'পর্যটন ও জীববৈচিত্র্য:প্রেক্ষাপট-বাংলাদেশ হেমায়েত উদ্দীন তালুকদার  খবর- নাগোয়া সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ঐতিহাসিক চুক্তি  খবর- ছয় দশক পর দুই কোরিয়ার স্বজনদের পুনর্মিলন  গল্প- 'স্বপ্ন' by আলমগীর হোসেন ফারুক  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কাশ্মীর কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়'- অরুন্ধতী রায়  স্বপ্নকথা- 'আত্মবিশ্বাসী মানুষই সফল হয়' by —বেনজির ভুট্টো  আবিষ্কার খবর- আমাজনে নতুন নতুন প্রজাতির সাপ ব্যাঙ মাছ  খবর- পরমাণু চুল্লিতে জ্বালানি ভরা শুরু করেছে ইরান  কিশোর ফিচার- 'আকাশছোয়াঁ টাওয়ার ‘বুর্জ খলিফা’ by জ়ে হুসাইন  গল্প- 'ঘোস্ট হাউজ অপারেশন' by আব্দুল্লাহ আল নোমান  আলোচনা- 'মহানবীর (সা): আদর্শ জীবন' by অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান  ভ্রমণ- 'মাধবপুর লেক ভ্রমণে' by খালেদ আহমদ শিমুল  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'সুস্থতার জন্য হাসি' by আবু হেনা আবিদ জাফর  বিজ্ঞান আলোচনা- 'মহাকাশের পড়শিরা' by মো: সাইফুল ইসলাম  বিজ্ঞান আলোচনা- 'পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড কার' by সাকিব রায়হান  বিজ্ঞান আলোচনা- 'হারিয়ে যাবে দানব গ্রহ!' by সাকিব রায়হান  গল্প- 'ট্রেনের হুইসেল' by হামিদুল ইসলাম  আলোচনা- 'জীবজগতে বেঁচে থাকার কৌশল' by আরিফ হাসান  আলোচনা- 'মিনার : মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন' by শেখ মারুফ সৈকত


সাপ্তাহিক এর সৌজন্যে
লেখকঃ সালেক খোকন
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.