গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা
রায়কা ঘুম ভেঙে দ্যাখে বাইরে তখনও অন্ধকার। জোর বৃষ্টি হচ্ছে। ঘড়িতে দ্যাখে সকাল সাড়ে নয়টা । পাশে মেয়ে রুদাবা আর স্বামী আলিম ঘুমাচ্ছে। রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখে কাজের মেয়ের নাস্তা বানানো প্রায় শেষ। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দৈনিক পত্রিকা টেনে নেয়। পত্রিকার প্রথম পাতায় আলিমের ছবি দেখে সংবাদটা পড়েই বিলাপ করে ওঠে, “হায় খোদা রে, ওরে আমার আল্লাহ, কী করলি তুই!” বেডরুমে আলিমের কাছে ছুটে যায়, “রুদাবার আব্বু, তুমি দ্যাখো কী সর্বনাশ হইছে!”
আলিম তখন মাত্র ঘুম ভেঙে এসির ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে-যাওয়া তিন বছরের মেয়ে রুদাবার গায়ে কাঁথা টেনে দিচ্ছিল। চিৎকার শুনে পত্রিকা হাতে নিয়ে চোখে পড়ে প্রথম পাতায় তার ছবি আর শিরোনাম : “বহুজাতিক কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ তকদির হাসান খুন”। ভেতরে লেখা আছে “অফিসে তাদের ব্যক্তিগত বিরোধের জের হিসাবে এ-হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়। অফিস-সূত্রে জানা যায়, তার সহকর্মী আলিমুদ্দৌলা তকদিরকে চৌদ্দ তলার ওপর থেকে ফেলে দিয়ে এ-হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ আলিমুদ্দৌলাকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। গতকাল রাত আটটায় এ-হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে তকদিরের স্ত্রীর সাথে আলিমের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল।”
রায়কা তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “কালকে তো তুমি সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফিরলা। তারপরই তো আমরা বড়আপার বাসায় গেলাম। এত বড় শত্র“তামি কে করল?”
আলিম তখন মাত্র ঘুম ভেঙে এসির ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে-যাওয়া তিন বছরের মেয়ে রুদাবার গায়ে কাঁথা টেনে দিচ্ছিল। চিৎকার শুনে পত্রিকা হাতে নিয়ে চোখে পড়ে প্রথম পাতায় তার ছবি আর শিরোনাম : “বহুজাতিক কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ তকদির হাসান খুন”। ভেতরে লেখা আছে “অফিসে তাদের ব্যক্তিগত বিরোধের জের হিসাবে এ-হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়। অফিস-সূত্রে জানা যায়, তার সহকর্মী আলিমুদ্দৌলা তকদিরকে চৌদ্দ তলার ওপর থেকে ফেলে দিয়ে এ-হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ আলিমুদ্দৌলাকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। গতকাল রাত আটটায় এ-হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে তকদিরের স্ত্রীর সাথে আলিমের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল।”
রায়কা তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “কালকে তো তুমি সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফিরলা। তারপরই তো আমরা বড়আপার বাসায় গেলাম। এত বড় শত্র“তামি কে করল?”
আলিম কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমি তো তোমারে আগেই বলছিলাম, নাসিম স্যার আমারে সহ্য করতে পারে না। সে জিএম হয়ে বসে আছে। পত্রিকাওয়ালা এবং পুলিশে আমার নাম উনিই দিছে। আমারে তো শেষ কইরা দিল এই নাসিম শুয়োরের বাচ্চা!” হাউমাউ কাঁদে সে। ওদের দু’জনের কান্নায় রুদাবাও ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে। রুদাবাকে জড়িয়ে ধরে আলিমের কান্নার তোড় আরও বেড়ে যায়। এরই মাঝে ফোন আসে, আলিমদের বাসা থেকে। ফোন ধরে সে আবারও কাঁদে, “আব্বা, আমারে তো শেষ কইরা ফালাইছে।” তারপরই ওপাশে মা ফোন ধরে। আলিমের কান্নার শব্দ দ্বিগুণ হয়, “আমার তো সব শেষ, আম্মা। আম্মা গো, আমার সব শেষ।” ওপাশে তার মাও কাঁদছে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি ভাই বোন সবাই চলে আসে। তার বাবা এসে বলে, “দেশ ছাইড়া আজকেই তুই ভাইগা যা, ইন্ডিয়া যা গিয়া, নাইলে পুলিশ আইসা অ্যারেস্ট কইরা নিবে।” রায়কা এবং আলিমের বাবা মা সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে। কেউ কলিংবেল টিপলেই মনে হয় পুলিশ এসেছে। আলিমের বাবা ছেলেকে কোনোভাবেই দেশে থাকতে দিতে রাজি না। বলে, “তুই আজকাই ইন্ডিয়া যা গা।” আলিমের শ্বশুর বাধা দেয়, বলে, “সে পলায়া গেলে পুলিশ তখন তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিবে।”
আত্মীয়স্বজনের টেলিফোনে রায়কা কান্নাকাটি করে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে এটা কত বড় মিথ্যা ঘটনা। আলিমের বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি কেউ মেঝেতে, কেউ বিছানায়, রুদাবা বারান্দায় তাঁর খেলনা নিয়ে খেলতে বসে। আলিমের শ্বশুর রিটায়ার্ড সরকারি আমলা। তিনি চেষ্টা করেন তাঁর পরিচিত পুলিশ অফিসারদের অনুরোধ করে আলিমের অ্যারেস্ট আটকাতে। তারপরও বিকালে পুলিশ আসে। আলিমের বাসায় মরাকান্না শুরু হয়। রায়কা বারান্দায় কাঁঠালিচাঁপা গাছের পাশে হেলান দিয়ে বসে চোখ মোছে। থানায় পিকআপ ভ্যানের পিছনে আলিমকে বসিয়ে নিচ্ছে। সে না আবার আত্মহত্যা করে! তার বাবা এবং শ্বশুর দু’জনেই তার পিছে পিছে থানায় যায়। আলিমকে লকআপে দেখে বাবা ছোট শিশুর মতো হাউমাউ কাঁদে।
আলিমের অফিস কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে মামলা করেছে। ঐ অফিসে নাসিম সাহেব প্রায় সর্বেসর্বা। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তিন দিন পর বিধ্বস্ত আলিমকে জেলে পাঠানো হয়। আত্মীয়স্বজন জেলে তার সাথে দেখা করতে গেলে আলিম শুধুই কাঁদে, কিছু বলতে পারে না। জেল সুপারের সাথে তাঁর শ্বশুরের খুব ভালো সম্পর্ক থাকায়, এবং ক্রমাগত টাকা ঢালায়, আলিমের জেল-জীবনের কষ্ট সামান্য কমানোর যায়।
রায়কা, রায়কার বাবা, আলিমের বাবা দিনরাত হাইকোর্টে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের তকদির-তদবির এবং খুব নামিদামি ব্যারিস্টার নিয়োগের কারণে আলিমকে হাইকোর্টে থেকে জামিনে ছাড়ানো যায়। জেল থেকে ফিরে আলিম অন্য মানুষ। আত্মীয়স্বজন সবার সাথেই যতটা সম্ভব কম কথা বলে, এমনকি রায়কার সাথেও।
বন্ধুবান্ধব অনেকেই ফোন করে। আফসোস করে, কেন বোকার মতো ট্র্যাপড হ’ল সে, তার বস নাসিমকে কেন সে ম্যানেজ করে চলে নাই, “জলে থেকে তো কুমিরের সাথে লড়াই করা চলে না” ইত্যাদি। বন্ধুদের সান্ত্বনা, ভালবাসা সবই বিরক্তিকর লাগে। বিষয়টা নিয়ে তার কথা বলতেই ইচ্ছা করে না।
অমায়িক মিশুক আলিম অফিসে বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রায় যে-কোনো পরিস্থিতিতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখত সে। অথচ তারই বস নাসিম সাহেব সবার সাথে খুঁচিয়ে কথা বলত, কটাক্ষ করত। অফিসে এমডি সাহেব অথবা সিনিয়ররা কাউকে বেশি স্নেহ করলে তাকে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলত অথবা নানা উছিলায় সেসব অফিসারদের বিরক্ত করত। ফলে বহু জুনিয়র কলিগ তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু লোকটা অফিসের চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রীর নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে লোকজন ভয়ে প্রতিবাদ করত না বা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাত না তার অন্যায় আচরণের। আলিম দীর্ঘদিন তার সাথে যথাসম্ভব সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করেছে।
নাসিম ছিল তার সাত আট বছরের সিনিয়র। অফিসের সবার কাছে পরিচিত ছিল খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু জটিল লোক বলে। সবাই বলে লোকটা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে পারে। তবে তার পাণ্ডিত্যে মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হ’ত আলিম। অফিসের কোনো ড্রাফট লেখা বা ডিকটেশন দেয়ায়, কি বাংলা কি ইংরেজিতে, সবাই একবাক্যে মানত যে লোকটার ভাষাদক্ষতা দুর্দান্ত। নাসিম অন্যদের তুলনায় আলিমকে বেশ স্নেহ করে তা টের পেত আলিম। প্রায়ই তাকে রুমে ডেকে নিয়ে নানা বিষয়ে গল্প করে, তবে বেশির ভাগ সময় যা করে তা হচ্ছে নির্জলা কুৎসা। অমুক অফিসারের দশটা গার্লফ্রেন্ড আছে; তমুক নারী অফিসার প্রায় খানকি টাইপের, যে কেউ ডাকলেই, বা একটা পারফিউম কিনে দিলেই, তার সাথে শুয়ে পড়বে, ইত্যাদি। আলিমকে একদিন বলে, “ফ্লোরাকে এক সেমিনারে সেদিন দেখলাম, জিন্স আর টিশার্ট পরা। মনে হ’ল টিশার্টের উপর দিয়ে ব্রেস্ট উপচে পড়ছে। বাইশ শতকের মেয়ে। একশ বছর আগে জন্মেছে। এত ইনডিসেন্ট কাপড় পরে।” আলিম দেখল, কথা বলতে বলতে নাসিম সাহেবের দু’চোখ চকচক করছে। আলিম ফ্লোরাকে ভালোভাবে চেনে। কখনোই সে অশালীন পোশাক পরে না। সেদিন হয়তো জিন্স-টিশার্ট পরেছে, তাতেই লোকটার…
এত পাণ্ডিত্য, এত পড়াশোনা নিয়ে লোকটা কোন্ রুচিতে যে দিনরাত মানুষের চরিত্র হনন করে! নাসিম স্যারের আরও একটা ব্যাপার তার খুবই বিরক্তিকর লাগে, আর তা হচ্ছে অষ্টপ্রহর আতিক স্যারের নামে দুর্নাম। “খুব বাজে অফিসার, পড়ালেখা কিছু জানে না। কিন্তু লিয়াজোঁ মেইনটেইন করে খুব। সাবস্ট্যাণ্ডার্ড একটা লোক। প্রেম করে আবার ফ্লোরার মতো দুই নম্বর এক মেয়েমানুষের সাথে।” এগুলো শুনতে আলিমের খুব ভালো লাগে না, কারণ আতিক স্যার এ-অফিসে আলিমের প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। অন্যের ব্যাপারে কখনও নাক গলায় না, দুর্নাম করে না কারো, নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জুনিয়র কলিগদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। অফিসের পিয়ন-দারোয়ান-সহ বহু মানুষ তার ভক্ত। কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছুদিন নাসিম সাহেবের অফিসে যাওয়া কমিয়ে দেয় সে। এর মাঝে আতিক স্যারের সাথে ব্যাংককে একটা ট্রেনিং-এ যায়। ওখানে আতিক স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। ঢাকায় ফেরার পরে আতিক স্যার মাঝে-মধ্যেই আড্ডা দিতে কিংবা নানা বিষয়ে পরামর্শ করতে ডাকে তাকে। একদিন দুপুরে বাইরে থেকে নাস্তা এনে আলিমকে রুমে ডেকে নেয় আতিক। নাসিম সাহেব তখনই আতিক সাহেবের রুমে ঢুকেছে। আলিমকে দেখে আতিক সাহেবকে বলেন, “কী খবর, আতিক, নতুন শিষ্য পাইছো মনে হয়।”
শুনে আতিক স্যার বেশ প্রশংসা করেন আলিমের, “ও একজন খুবই স্মার্ট অফিসার। ব্যাংককে গিয়ে টের পাইলাম ভিতরে-ভিতরে মহাপণ্ডিত সে। ওইখানে ট্রেইনাররা তো খুবই ইমপ্রেস্ড্ ওর ব্যাপারে।” প্রসঙ্গ পাল্টে নাসিম সাহেব আলিমকে বলেন, “বিকালে মিটিং-এ যে-বিষয়গুলো আলোচনা করতে বলেছি তা মাথায় রাইখো।” বলে বেরিয়ে যান।
চারপাঁচ দিন পর লাঞ্চ আওয়ারে খাওয়া শেষ করে নাসিম সাহেবের রুমে যায় আলিম। তাকে দেখেই গম্ভীর স্বরে নাসিম সাহেব বলে, “এখন খুব ব্যস্ত আছি, আলিম। পরে আইসো।” বেশ খটকা লাগে আলিমের। নাসিম স্যার কী রাগ করল কোনো কারণে? লোকটা তো খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ। না জানি কোন্ ক্ষতি করে আবার। চৌদ্দ তলায় অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, বস্তি স্টেডিয়াম… নাসিম স্যার পিছনে লাগলে খালাস করে ফেলে মানুষকে।
পরদিনই অফিসে কাজের ফাঁকে আবারও যায় নাসিম সাহেবের রুমে। নাসিম গম্ভীর মুখে বলে, “কী ব্যাপার, কোনো কাজে আসছো?”
“না স্যার, এমনি ভাবলাম একটু গল্প করে আসি আপনার সাথে।”
“কিছুক্ষণ পর একটা মিটিং আছে আমার, তার প্রেপারেশন নিতে হবে।”
“ঠিক আছে, স্যার, পরে আরেক সময় আসব,” বলে আলিম নিজের রুমে চলে আসে। তার টেবিলের ওপর ছোট টবে রাখা ক্যাকটাসের কাঁটাতে আনমনে হাত বুলায় আর ভাবে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে হয়তো।
অফিসে কাজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয় সে। প্রতিদিন রাত প্রায় আটটা-নয়টা বেজে যায় বাড়ি ফিরতে। ফেরার সময় নাসিম সাহেবের সাথে পর-পর দু’দিন দেখা হয় নিচে। এমডি স্যারের পিএস রীনাকে পাশের সিটে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আলিমকে দেখে দ্রুত গাড়ি টান দিয়ে চলে যান। তারপর থেকে আলিম হয়ে পড়ে নাসিম সাহেবের চরম শত্র“। অফিস মিটিং-এ সুযোগ পেলেই একেকদিন তুলাধুনা করে ছাড়েন। আলিমের মনে হয় নাসিম হয়তো ভাবেন এমডি’র পিএস রীনার সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা আলিম সবাইকে বলে দেবে। প্রায় প্রতিটা দিন বাসায় ফেরে তীব্র অশান্তি নিয়ে। কখনও অতি অল্পে স্ত্রী রায়কার সাথে ঝগড়াঝাঁটি, কখনও বা গলাজল হতাশায় রায়কার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ। “নতুন চাকরি আমারে কে দিবে, সোনা। যে-কোনো মুহূর্তে আমার যে কোনো ক্ষতি করবে নাসিম শুয়োরের বাচ্চা। মিটিং-এ এত মানুষের সামনে আমারে এমন অপমান করে সে!” রায়কা সান্ত্বনা দেয়, “এত ভয় পায়ো না তো! এক আল্লাহ সহায় থাকলে হাজারো শয়তানে কিছু করতে পারে না।”
বউ বাচ্চা নিয়ে বাইরে খেতে যায় সে।
এর মাঝে এমডি সাহেব আলিমকে প্রায়ই রুমে ডাকেন একটা প্রজেক্ট প্ল্যান তৈরি করতে। নাসিমের চোখে পড়ে যে আলিম প্রায়ই এমডি সাহেবের রুমে যায়। অনেক সময় থাকে। তারপরের সপ্তাহে রাতে অফিসের চৌদ্দতলার জানালা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় আলিমের বন্ধু তকদির হাসান। অফিসে অধিকাংশ মানুষই অনুমান করে তকদির আত্মহত্যা করেছে। অফিসের শুভাকাক্সক্ষীরা জানায়, তকদির আসলে চৌদ্দ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। দীর্ঘদিন সে বিষণœতার রোগী ছিল। অফিসে কারো সাথে মিশত না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না কারো সাথে। মিডিয়া এবং পুলিশে কানেকশন থাকায়, নাসিম একে হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দেয় এবং আলিমকে আসামি করে অফিস থেকে বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করে।
আলিমের শ্বশুরের প্রভাব, যোগাযোগ আর টাকার কল্যাণে অবশেষে তার জামিন হয়। বেরিয়ে এসে টেলিফোনে অফিসের কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কীভাবে সে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার কলিগ ও সিনিয়র নাসিম সাহেবের নীচতা বর্ণনা করে। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা আসে জেল খানায় কেমন ছিল সে, পুলিশ রিমান্ডে টরচার করেছে কীনা… এ-জাতীয় সব প্রশ্ন। এসবের জবাব দিতে ভালো লাগে না তার। বন্ধুদের ফোনও অসহ্য লাগে একেক সময়। তার মনে হয় সবাই স্বার্থপর। কেউ বিপদে পড়লে মজা দ্যাখে। সত্যিকার বন্ধু হয়তো বাবা মা স্ত্রী সন্তান ছাড়া আর কেউই হয় না।
দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু মিজান ফোন করে। “কী রে দোস্ত, কী খবর? আরমান ফোন করছিল আমারে। তোরে নিয়া সবাই ভীষণ টেন্সড। আমরা আসলে কেউই বিলিভ করি না মানুষ খুনের সাথে তুই জড়িত থাকতে পারস। আবার সিডনি থিকা আকবরও ফোন করছিল। সেও খুব আফসোস করছে তোর জন্য। এই দেশে পুলিশ আর পত্রিকাওয়ালারা পারেও। একটা নিরীহ মানুষরেও রাস্তায় বসাইয়া দিতে পারে। সামি আমারে প্রথম জানাইছে যে, হাইকোর্ট থিকা তোরে জামিন দিছে। জেলখানার ভিতরের পরিবেশটা কেমন, দোস্ত? চোর, ডাকাইত, অন্যসব আসামিগো লগে থাকতে দিছে তোরে? পুলিশ কি রিমান্ডে নিয়া টরচার করছে?”
“দ্যাখ মিজান, জেলখানা নিয়া একটা কথাও কমু না আমি। ভালো লাগে না। তবে একটা কথা বলতে পারি: জেলখানায় থাইকা আমার মনে হইছে যে ওইখানে যারা আছে তার একটা বড় অংশই ইনোসেন্ট।”
মিজান জিজ্ঞাসা করে, “দোস্ত, ওরা ওইখানে কী খাইতে দিছে তোরে? জেলখানার খাবার খাইতে পারছিস?”
আলিম জবাব দেয় না।
মিজান বলে, ‘ঠিকাছে, সরি দোস্ত, অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি তাইলে। আমাদের যে ক্লাসমেট ছিল হানিফ, ট্যাক্সেশন ক্যাডারের, সে যে কী বদমাইশ চিন্তা কর, তোরে নিয়া যখন পত্রিকায় লেখালেখি হইতেছে সে আমারে কয়, ‘আলিম নিশ্চয়ই খুনে ইনভলভ্ড্ ছিল। হাইকোর্ট থিকা সে জামিন পাইছে তার শ্বশুরবাড়ির তদবিরে, কারণ তার শ্বশুর সরকারি আমলা ছিল। খুব কানেকটেড লোক।’ বিশ্বাস কর দোস্ত, ওর কথা শুইনা মন চাইছে দুই গালে দুই চটকনা লাগাই। অথচ ইউনিভার্সিটিতে কত রাত্র তোর লগে সে এক বিছানায় ঘুমাইছে, এক লগে খাইছে। একেকটা ইনোসেন্ট পোলাপান গভর্মেন্ট সার্ভিসে ঢুইকা বাইর হয় একেকটা জটিলতম প্রাণী হিসাবে… দোস্ত, তোরে কি আগের চাকরিতে নরমালি অ্যাকসেপ্ট করবে? তোর ঐ হারামি কলিগটা কি এখনও ঐখানেই আছে?”
“হ্যাঁ, হাইকোর্ট যেহেতু নির্দোষ বলছে ওরা হয়তো নিবে আমারে। তা ছাড়া অফিসের প্রায় সব লোকেই বোঝে যে আমি নির্দোষ। কিন্তু তারপরও জয়েন করমু না। শুনছি ঐ হারামজাদার নাকি প্রমোশনও হইছে। হারামিরা সবসময়ই ভালো থাকে। ঠিক আছে, এখন ফোন রাখি, দোস্ত। রায়কারে নিয়া বাইরে যাইতে হইব।” বলে আলিম ফোনটা রেখে দেয়।
আসলে রায়কাকে নিয়ে বাইরে যাবার প্ল্যান আলিমের নাই। মিজানকে এড়াতেই বলা। আলিমের মনে হয় মিজান নিজেও হয়তো বিশ্বাস করে আলিম এই খুনের সাথে জড়িত ছিল। অবশ্য খুনের মামলায় জড়াবার আগ থেকেই বন্ধুবান্ধবের আড্ডা এড়িয়ে চলত সে, যেসব আড্ডায় কে কতবার বিদেশ গেল, কয়টা অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কিনল, নয়তো অন্যের সমালোচনা, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটিও দুর্নাম করছে তার বন্ধুর… এ-কারণেই অনেকদিন বন্ধুদের আড্ডা আর আকর্ষণ করত না তাকে। অবশ্য এমনকি রায়কার সাথে, তার বাবা মা ভাইবোন কারো সাথেই আর কথা বলতে মন চায় না এখন।
রায়কাও মাঝে-মধ্যে অশান্তি করত, “এই দেশে থাকলে আমার মেয়ের বিয়া দেওয়া যাবে কোনোদিন? চল, বিদেশে সেটল করি আমরা।” বিদেশে গিয়ে কী করবে মাথায় আসে না আলিমের। অফিস থেকে ট্রেনিং-এ লন্ডন ও সিডনি গিয়েছিল সে। সেখানে দেখেছে স্বামী-স্ত্রী কী কষ্ট করে অড-জব করে সংসার চালায়। ঢাকায় কাজের মেয়ে সংসারের সব কাজ করে দেয়, তবুও রায়কা হিমশিম খায়। বিদেশে গিয়ে কী করবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না আলিম। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভায়রা-শালা-শালি সবাই পরামর্শ দেয়, “বিদেশে গিয়া সেটল করো।” মানতে পারে না আলিম। এদেশের ইট-কাঠ-ধূলিকণা, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস-কর্মী, বাংলা সিনেমার নায়িকা, প্রযোজক, চোর, ডাকাত, পুলিশ সবাইকেই সে ভালোবাসে। কেন এদেশ ছেড়ে যাবে?
খুব কাছের কিছু মানুষ, তার সত্যিকার কিছু আপনজন ছিল যারা মারা গেছে। এমন আত্মার আত্মীয় তার এখন খুব কম আছে। একজন তার নানি। নানি তাকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে। সে কলেজে যখন পড়ে তখনও মুখে তুলে খাইয়েছে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। নানা জেলায় জেলায় ঘুরতে হ’ত। ফরিদপুরে নানির বাড়ি থেকে জেলা স্কুলে পড়ত সে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর-পর নানী মারা যায় ব্রেইনস্ট্রোক করে। নানির মৃত মুখটা ধরে সে আদর করেছে। একবারের জন্যও তাকে মরামানুষ মনে হয় নাই। কবর দিয়ে আসার পরও মনে হয় নাই নানি নাই। কখনও মন খারাপ হলে, নিজেকে বিপন্ন লাগলে হয়তো একা বালিশে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, “নানু গো, আমি ভীষণ বিপদে আছি। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। তুমি আমার মঙ্গল চাইলে কেউ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না…।” আরেকজন তার শিক্ষক অতীশ স্যার। ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পায় অতীশ স্যারকে। এর আগে কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর এসেছিল আলিমের জীবনে। কাউকেই তার পছন্দ হ’ত না। অতীশ স্যারই তাকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। স্যার তার প্রশংসা করত সবার কাছে, একসময় নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। স্যারের প্রেমিকা স্যারকে ছেড়ে চলে গেছে। আলিম যখন ক্লাস টেন-এ পড়ে, তাকে পড়াতে এসে আলিমের সাথে এ-গল্প করতে-করতে চোখ ছলছল করে ওঠে স্যারের। আলিম বলে, “স্যার, আপনি আরেকটা প্রেম করেন, সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। অতীশ স্যার বুয়েট থেকে পাশ করে আমেরিকায় স্কলারশিপ পায়। যাওয়ার আগেই একদিন কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনা। স্যারের লাশ দেখতে আলিম তার বাসায় গিয়েছিল। উঠানের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে-গড়িয়ে কাঁদছে মাসিমা। আলিমকে দেখে জড়িয়ে ধরে চিৎকার, “তোমারে তো অনেক আদর করত আমার ছেলে।” আলিমের কখনোই মনে হয় নাই অতীশ স্যার নেই। সে সবসময় তাকে অনুভব করে তার পাশে।
রায়কার সাথে প্রেম হয় ভার্সিটিতে পড়ার সময়। মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার তিন-চার মাস আগে রায়কার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। আলিম তার বাবা-মাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, রায়কাদের পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো এখন খুবই জরুরি। রায়কাও কোর্ট ম্যারেজে রাজি ছিল না, প্রায় সারারাত সে হলের বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, “নানুমণি, অতীশ স্যার, তোমরা প্রার্থনা করো আমি যেন রায়কাকে ফিরে পাই।” বিপদে পড়লে মৃত আপনজনদের আকুল হয়ে সে ডাকে। শেষমেশ রায়কাই তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে তার বিয়ে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। আলিমের মনে হয় তার নানু এবং অতীশ স্যারের জন্যই রায়কাকে ফিরে পেয়েছে সে। জেলখানায়ও দিনরাত তার নানি আর স্যারকে স্মরণ করেছে সে, আর কাউকে নয়, কাউকেই না। যথেষ্ট সাক্ষ্যসাবুদের অভাবে একসময় বেকসুর খালাস হয় তার ঠিকই, কিন্তু পুরো পৃথিবীটাই হঠাৎ করে জেলখানা হয়ে যায় আলিমের।
রায়কার সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়। রায়কা চাপ দেয় চাকরিবাকরির চেষ্টা করার জন্য। প্রচুর বন্ধু আছে নানা বহুজাতিক কোম্পানিতে। অথচ পরিচিত কারো কাছেই যেতে তার মন চায় না। মনে হয় সবাই উপরে-উপরে সহানুভূতি দেখায়, মনে-মনে হয়তো তারা ভাবে আলিম খুনি। বন্ধুদের ফোনও রিসিভ করে না সে আর। রায়কা যখন আত্মীয়স্বজনের বিয়ে বা জন্মদিনের দাওয়াতে নিয়ে যেতে জবরদস্তি করে, তাকে খুন করে ফেলতে মন চায়।
ইউএনডিপির একটা প্রজেক্টে চাকরি নিয়ে রাঙ্গামাটি চলে যায় আলিম। রুদাবা ঢাকায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বলে রায়কাকে ঢাকায় তার মায়ের বাসায় রেখে যায়। রাঙ্গামাটি গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। অফিসের সময় কাজে ব্যস্ত থাকে। পাহাড়ের পাশেই একটা বাড়িতে তার ঠাঁই হয়। অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে একাকী পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যা নামা দ্যাখে। নির্জনতা, নিঃসীম নির্জনতা। তবে এখানে মাঝে-মধ্যেই অপরাধ বোধে ভোগে সে। ভাবে, খুনটা না করলেই হ’ত! এত ঝামেলায় পড়তে হ’ত না। অবসরে নির্জনতায় ডুবে থাকে আলিম। আর, এই নির্জনতাকে আকণ্ঠ পান করার চাইতে ভালো কিছু পৃথিবীর কাছে পাওয়ার আছে তা আর মনে হয় না তার।
===================ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি ভাই বোন সবাই চলে আসে। তার বাবা এসে বলে, “দেশ ছাইড়া আজকেই তুই ভাইগা যা, ইন্ডিয়া যা গিয়া, নাইলে পুলিশ আইসা অ্যারেস্ট কইরা নিবে।” রায়কা এবং আলিমের বাবা মা সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে। কেউ কলিংবেল টিপলেই মনে হয় পুলিশ এসেছে। আলিমের বাবা ছেলেকে কোনোভাবেই দেশে থাকতে দিতে রাজি না। বলে, “তুই আজকাই ইন্ডিয়া যা গা।” আলিমের শ্বশুর বাধা দেয়, বলে, “সে পলায়া গেলে পুলিশ তখন তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিবে।”
আত্মীয়স্বজনের টেলিফোনে রায়কা কান্নাকাটি করে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে এটা কত বড় মিথ্যা ঘটনা। আলিমের বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি কেউ মেঝেতে, কেউ বিছানায়, রুদাবা বারান্দায় তাঁর খেলনা নিয়ে খেলতে বসে। আলিমের শ্বশুর রিটায়ার্ড সরকারি আমলা। তিনি চেষ্টা করেন তাঁর পরিচিত পুলিশ অফিসারদের অনুরোধ করে আলিমের অ্যারেস্ট আটকাতে। তারপরও বিকালে পুলিশ আসে। আলিমের বাসায় মরাকান্না শুরু হয়। রায়কা বারান্দায় কাঁঠালিচাঁপা গাছের পাশে হেলান দিয়ে বসে চোখ মোছে। থানায় পিকআপ ভ্যানের পিছনে আলিমকে বসিয়ে নিচ্ছে। সে না আবার আত্মহত্যা করে! তার বাবা এবং শ্বশুর দু’জনেই তার পিছে পিছে থানায় যায়। আলিমকে লকআপে দেখে বাবা ছোট শিশুর মতো হাউমাউ কাঁদে।
আলিমের অফিস কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে মামলা করেছে। ঐ অফিসে নাসিম সাহেব প্রায় সর্বেসর্বা। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তিন দিন পর বিধ্বস্ত আলিমকে জেলে পাঠানো হয়। আত্মীয়স্বজন জেলে তার সাথে দেখা করতে গেলে আলিম শুধুই কাঁদে, কিছু বলতে পারে না। জেল সুপারের সাথে তাঁর শ্বশুরের খুব ভালো সম্পর্ক থাকায়, এবং ক্রমাগত টাকা ঢালায়, আলিমের জেল-জীবনের কষ্ট সামান্য কমানোর যায়।
রায়কা, রায়কার বাবা, আলিমের বাবা দিনরাত হাইকোর্টে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের তকদির-তদবির এবং খুব নামিদামি ব্যারিস্টার নিয়োগের কারণে আলিমকে হাইকোর্টে থেকে জামিনে ছাড়ানো যায়। জেল থেকে ফিরে আলিম অন্য মানুষ। আত্মীয়স্বজন সবার সাথেই যতটা সম্ভব কম কথা বলে, এমনকি রায়কার সাথেও।
বন্ধুবান্ধব অনেকেই ফোন করে। আফসোস করে, কেন বোকার মতো ট্র্যাপড হ’ল সে, তার বস নাসিমকে কেন সে ম্যানেজ করে চলে নাই, “জলে থেকে তো কুমিরের সাথে লড়াই করা চলে না” ইত্যাদি। বন্ধুদের সান্ত্বনা, ভালবাসা সবই বিরক্তিকর লাগে। বিষয়টা নিয়ে তার কথা বলতেই ইচ্ছা করে না।
অমায়িক মিশুক আলিম অফিসে বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রায় যে-কোনো পরিস্থিতিতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখত সে। অথচ তারই বস নাসিম সাহেব সবার সাথে খুঁচিয়ে কথা বলত, কটাক্ষ করত। অফিসে এমডি সাহেব অথবা সিনিয়ররা কাউকে বেশি স্নেহ করলে তাকে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলত অথবা নানা উছিলায় সেসব অফিসারদের বিরক্ত করত। ফলে বহু জুনিয়র কলিগ তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু লোকটা অফিসের চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রীর নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে লোকজন ভয়ে প্রতিবাদ করত না বা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাত না তার অন্যায় আচরণের। আলিম দীর্ঘদিন তার সাথে যথাসম্ভব সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করেছে।
নাসিম ছিল তার সাত আট বছরের সিনিয়র। অফিসের সবার কাছে পরিচিত ছিল খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু জটিল লোক বলে। সবাই বলে লোকটা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে পারে। তবে তার পাণ্ডিত্যে মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হ’ত আলিম। অফিসের কোনো ড্রাফট লেখা বা ডিকটেশন দেয়ায়, কি বাংলা কি ইংরেজিতে, সবাই একবাক্যে মানত যে লোকটার ভাষাদক্ষতা দুর্দান্ত। নাসিম অন্যদের তুলনায় আলিমকে বেশ স্নেহ করে তা টের পেত আলিম। প্রায়ই তাকে রুমে ডেকে নিয়ে নানা বিষয়ে গল্প করে, তবে বেশির ভাগ সময় যা করে তা হচ্ছে নির্জলা কুৎসা। অমুক অফিসারের দশটা গার্লফ্রেন্ড আছে; তমুক নারী অফিসার প্রায় খানকি টাইপের, যে কেউ ডাকলেই, বা একটা পারফিউম কিনে দিলেই, তার সাথে শুয়ে পড়বে, ইত্যাদি। আলিমকে একদিন বলে, “ফ্লোরাকে এক সেমিনারে সেদিন দেখলাম, জিন্স আর টিশার্ট পরা। মনে হ’ল টিশার্টের উপর দিয়ে ব্রেস্ট উপচে পড়ছে। বাইশ শতকের মেয়ে। একশ বছর আগে জন্মেছে। এত ইনডিসেন্ট কাপড় পরে।” আলিম দেখল, কথা বলতে বলতে নাসিম সাহেবের দু’চোখ চকচক করছে। আলিম ফ্লোরাকে ভালোভাবে চেনে। কখনোই সে অশালীন পোশাক পরে না। সেদিন হয়তো জিন্স-টিশার্ট পরেছে, তাতেই লোকটার…
এত পাণ্ডিত্য, এত পড়াশোনা নিয়ে লোকটা কোন্ রুচিতে যে দিনরাত মানুষের চরিত্র হনন করে! নাসিম স্যারের আরও একটা ব্যাপার তার খুবই বিরক্তিকর লাগে, আর তা হচ্ছে অষ্টপ্রহর আতিক স্যারের নামে দুর্নাম। “খুব বাজে অফিসার, পড়ালেখা কিছু জানে না। কিন্তু লিয়াজোঁ মেইনটেইন করে খুব। সাবস্ট্যাণ্ডার্ড একটা লোক। প্রেম করে আবার ফ্লোরার মতো দুই নম্বর এক মেয়েমানুষের সাথে।” এগুলো শুনতে আলিমের খুব ভালো লাগে না, কারণ আতিক স্যার এ-অফিসে আলিমের প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। অন্যের ব্যাপারে কখনও নাক গলায় না, দুর্নাম করে না কারো, নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জুনিয়র কলিগদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। অফিসের পিয়ন-দারোয়ান-সহ বহু মানুষ তার ভক্ত। কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছুদিন নাসিম সাহেবের অফিসে যাওয়া কমিয়ে দেয় সে। এর মাঝে আতিক স্যারের সাথে ব্যাংককে একটা ট্রেনিং-এ যায়। ওখানে আতিক স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। ঢাকায় ফেরার পরে আতিক স্যার মাঝে-মধ্যেই আড্ডা দিতে কিংবা নানা বিষয়ে পরামর্শ করতে ডাকে তাকে। একদিন দুপুরে বাইরে থেকে নাস্তা এনে আলিমকে রুমে ডেকে নেয় আতিক। নাসিম সাহেব তখনই আতিক সাহেবের রুমে ঢুকেছে। আলিমকে দেখে আতিক সাহেবকে বলেন, “কী খবর, আতিক, নতুন শিষ্য পাইছো মনে হয়।”
শুনে আতিক স্যার বেশ প্রশংসা করেন আলিমের, “ও একজন খুবই স্মার্ট অফিসার। ব্যাংককে গিয়ে টের পাইলাম ভিতরে-ভিতরে মহাপণ্ডিত সে। ওইখানে ট্রেইনাররা তো খুবই ইমপ্রেস্ড্ ওর ব্যাপারে।” প্রসঙ্গ পাল্টে নাসিম সাহেব আলিমকে বলেন, “বিকালে মিটিং-এ যে-বিষয়গুলো আলোচনা করতে বলেছি তা মাথায় রাইখো।” বলে বেরিয়ে যান।
চারপাঁচ দিন পর লাঞ্চ আওয়ারে খাওয়া শেষ করে নাসিম সাহেবের রুমে যায় আলিম। তাকে দেখেই গম্ভীর স্বরে নাসিম সাহেব বলে, “এখন খুব ব্যস্ত আছি, আলিম। পরে আইসো।” বেশ খটকা লাগে আলিমের। নাসিম স্যার কী রাগ করল কোনো কারণে? লোকটা তো খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ। না জানি কোন্ ক্ষতি করে আবার। চৌদ্দ তলায় অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, বস্তি স্টেডিয়াম… নাসিম স্যার পিছনে লাগলে খালাস করে ফেলে মানুষকে।
পরদিনই অফিসে কাজের ফাঁকে আবারও যায় নাসিম সাহেবের রুমে। নাসিম গম্ভীর মুখে বলে, “কী ব্যাপার, কোনো কাজে আসছো?”
“না স্যার, এমনি ভাবলাম একটু গল্প করে আসি আপনার সাথে।”
“কিছুক্ষণ পর একটা মিটিং আছে আমার, তার প্রেপারেশন নিতে হবে।”
“ঠিক আছে, স্যার, পরে আরেক সময় আসব,” বলে আলিম নিজের রুমে চলে আসে। তার টেবিলের ওপর ছোট টবে রাখা ক্যাকটাসের কাঁটাতে আনমনে হাত বুলায় আর ভাবে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে হয়তো।
অফিসে কাজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয় সে। প্রতিদিন রাত প্রায় আটটা-নয়টা বেজে যায় বাড়ি ফিরতে। ফেরার সময় নাসিম সাহেবের সাথে পর-পর দু’দিন দেখা হয় নিচে। এমডি স্যারের পিএস রীনাকে পাশের সিটে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আলিমকে দেখে দ্রুত গাড়ি টান দিয়ে চলে যান। তারপর থেকে আলিম হয়ে পড়ে নাসিম সাহেবের চরম শত্র“। অফিস মিটিং-এ সুযোগ পেলেই একেকদিন তুলাধুনা করে ছাড়েন। আলিমের মনে হয় নাসিম হয়তো ভাবেন এমডি’র পিএস রীনার সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা আলিম সবাইকে বলে দেবে। প্রায় প্রতিটা দিন বাসায় ফেরে তীব্র অশান্তি নিয়ে। কখনও অতি অল্পে স্ত্রী রায়কার সাথে ঝগড়াঝাঁটি, কখনও বা গলাজল হতাশায় রায়কার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ। “নতুন চাকরি আমারে কে দিবে, সোনা। যে-কোনো মুহূর্তে আমার যে কোনো ক্ষতি করবে নাসিম শুয়োরের বাচ্চা। মিটিং-এ এত মানুষের সামনে আমারে এমন অপমান করে সে!” রায়কা সান্ত্বনা দেয়, “এত ভয় পায়ো না তো! এক আল্লাহ সহায় থাকলে হাজারো শয়তানে কিছু করতে পারে না।”
বউ বাচ্চা নিয়ে বাইরে খেতে যায় সে।
এর মাঝে এমডি সাহেব আলিমকে প্রায়ই রুমে ডাকেন একটা প্রজেক্ট প্ল্যান তৈরি করতে। নাসিমের চোখে পড়ে যে আলিম প্রায়ই এমডি সাহেবের রুমে যায়। অনেক সময় থাকে। তারপরের সপ্তাহে রাতে অফিসের চৌদ্দতলার জানালা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় আলিমের বন্ধু তকদির হাসান। অফিসে অধিকাংশ মানুষই অনুমান করে তকদির আত্মহত্যা করেছে। অফিসের শুভাকাক্সক্ষীরা জানায়, তকদির আসলে চৌদ্দ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। দীর্ঘদিন সে বিষণœতার রোগী ছিল। অফিসে কারো সাথে মিশত না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না কারো সাথে। মিডিয়া এবং পুলিশে কানেকশন থাকায়, নাসিম একে হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দেয় এবং আলিমকে আসামি করে অফিস থেকে বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করে।
আলিমের শ্বশুরের প্রভাব, যোগাযোগ আর টাকার কল্যাণে অবশেষে তার জামিন হয়। বেরিয়ে এসে টেলিফোনে অফিসের কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কীভাবে সে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার কলিগ ও সিনিয়র নাসিম সাহেবের নীচতা বর্ণনা করে। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা আসে জেল খানায় কেমন ছিল সে, পুলিশ রিমান্ডে টরচার করেছে কীনা… এ-জাতীয় সব প্রশ্ন। এসবের জবাব দিতে ভালো লাগে না তার। বন্ধুদের ফোনও অসহ্য লাগে একেক সময়। তার মনে হয় সবাই স্বার্থপর। কেউ বিপদে পড়লে মজা দ্যাখে। সত্যিকার বন্ধু হয়তো বাবা মা স্ত্রী সন্তান ছাড়া আর কেউই হয় না।
দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু মিজান ফোন করে। “কী রে দোস্ত, কী খবর? আরমান ফোন করছিল আমারে। তোরে নিয়া সবাই ভীষণ টেন্সড। আমরা আসলে কেউই বিলিভ করি না মানুষ খুনের সাথে তুই জড়িত থাকতে পারস। আবার সিডনি থিকা আকবরও ফোন করছিল। সেও খুব আফসোস করছে তোর জন্য। এই দেশে পুলিশ আর পত্রিকাওয়ালারা পারেও। একটা নিরীহ মানুষরেও রাস্তায় বসাইয়া দিতে পারে। সামি আমারে প্রথম জানাইছে যে, হাইকোর্ট থিকা তোরে জামিন দিছে। জেলখানার ভিতরের পরিবেশটা কেমন, দোস্ত? চোর, ডাকাইত, অন্যসব আসামিগো লগে থাকতে দিছে তোরে? পুলিশ কি রিমান্ডে নিয়া টরচার করছে?”
“দ্যাখ মিজান, জেলখানা নিয়া একটা কথাও কমু না আমি। ভালো লাগে না। তবে একটা কথা বলতে পারি: জেলখানায় থাইকা আমার মনে হইছে যে ওইখানে যারা আছে তার একটা বড় অংশই ইনোসেন্ট।”
মিজান জিজ্ঞাসা করে, “দোস্ত, ওরা ওইখানে কী খাইতে দিছে তোরে? জেলখানার খাবার খাইতে পারছিস?”
আলিম জবাব দেয় না।
মিজান বলে, ‘ঠিকাছে, সরি দোস্ত, অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি তাইলে। আমাদের যে ক্লাসমেট ছিল হানিফ, ট্যাক্সেশন ক্যাডারের, সে যে কী বদমাইশ চিন্তা কর, তোরে নিয়া যখন পত্রিকায় লেখালেখি হইতেছে সে আমারে কয়, ‘আলিম নিশ্চয়ই খুনে ইনভলভ্ড্ ছিল। হাইকোর্ট থিকা সে জামিন পাইছে তার শ্বশুরবাড়ির তদবিরে, কারণ তার শ্বশুর সরকারি আমলা ছিল। খুব কানেকটেড লোক।’ বিশ্বাস কর দোস্ত, ওর কথা শুইনা মন চাইছে দুই গালে দুই চটকনা লাগাই। অথচ ইউনিভার্সিটিতে কত রাত্র তোর লগে সে এক বিছানায় ঘুমাইছে, এক লগে খাইছে। একেকটা ইনোসেন্ট পোলাপান গভর্মেন্ট সার্ভিসে ঢুইকা বাইর হয় একেকটা জটিলতম প্রাণী হিসাবে… দোস্ত, তোরে কি আগের চাকরিতে নরমালি অ্যাকসেপ্ট করবে? তোর ঐ হারামি কলিগটা কি এখনও ঐখানেই আছে?”
“হ্যাঁ, হাইকোর্ট যেহেতু নির্দোষ বলছে ওরা হয়তো নিবে আমারে। তা ছাড়া অফিসের প্রায় সব লোকেই বোঝে যে আমি নির্দোষ। কিন্তু তারপরও জয়েন করমু না। শুনছি ঐ হারামজাদার নাকি প্রমোশনও হইছে। হারামিরা সবসময়ই ভালো থাকে। ঠিক আছে, এখন ফোন রাখি, দোস্ত। রায়কারে নিয়া বাইরে যাইতে হইব।” বলে আলিম ফোনটা রেখে দেয়।
আসলে রায়কাকে নিয়ে বাইরে যাবার প্ল্যান আলিমের নাই। মিজানকে এড়াতেই বলা। আলিমের মনে হয় মিজান নিজেও হয়তো বিশ্বাস করে আলিম এই খুনের সাথে জড়িত ছিল। অবশ্য খুনের মামলায় জড়াবার আগ থেকেই বন্ধুবান্ধবের আড্ডা এড়িয়ে চলত সে, যেসব আড্ডায় কে কতবার বিদেশ গেল, কয়টা অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কিনল, নয়তো অন্যের সমালোচনা, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটিও দুর্নাম করছে তার বন্ধুর… এ-কারণেই অনেকদিন বন্ধুদের আড্ডা আর আকর্ষণ করত না তাকে। অবশ্য এমনকি রায়কার সাথে, তার বাবা মা ভাইবোন কারো সাথেই আর কথা বলতে মন চায় না এখন।
রায়কাও মাঝে-মধ্যে অশান্তি করত, “এই দেশে থাকলে আমার মেয়ের বিয়া দেওয়া যাবে কোনোদিন? চল, বিদেশে সেটল করি আমরা।” বিদেশে গিয়ে কী করবে মাথায় আসে না আলিমের। অফিস থেকে ট্রেনিং-এ লন্ডন ও সিডনি গিয়েছিল সে। সেখানে দেখেছে স্বামী-স্ত্রী কী কষ্ট করে অড-জব করে সংসার চালায়। ঢাকায় কাজের মেয়ে সংসারের সব কাজ করে দেয়, তবুও রায়কা হিমশিম খায়। বিদেশে গিয়ে কী করবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না আলিম। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভায়রা-শালা-শালি সবাই পরামর্শ দেয়, “বিদেশে গিয়া সেটল করো।” মানতে পারে না আলিম। এদেশের ইট-কাঠ-ধূলিকণা, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস-কর্মী, বাংলা সিনেমার নায়িকা, প্রযোজক, চোর, ডাকাত, পুলিশ সবাইকেই সে ভালোবাসে। কেন এদেশ ছেড়ে যাবে?
খুব কাছের কিছু মানুষ, তার সত্যিকার কিছু আপনজন ছিল যারা মারা গেছে। এমন আত্মার আত্মীয় তার এখন খুব কম আছে। একজন তার নানি। নানি তাকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে। সে কলেজে যখন পড়ে তখনও মুখে তুলে খাইয়েছে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। নানা জেলায় জেলায় ঘুরতে হ’ত। ফরিদপুরে নানির বাড়ি থেকে জেলা স্কুলে পড়ত সে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর-পর নানী মারা যায় ব্রেইনস্ট্রোক করে। নানির মৃত মুখটা ধরে সে আদর করেছে। একবারের জন্যও তাকে মরামানুষ মনে হয় নাই। কবর দিয়ে আসার পরও মনে হয় নাই নানি নাই। কখনও মন খারাপ হলে, নিজেকে বিপন্ন লাগলে হয়তো একা বালিশে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, “নানু গো, আমি ভীষণ বিপদে আছি। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। তুমি আমার মঙ্গল চাইলে কেউ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না…।” আরেকজন তার শিক্ষক অতীশ স্যার। ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পায় অতীশ স্যারকে। এর আগে কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর এসেছিল আলিমের জীবনে। কাউকেই তার পছন্দ হ’ত না। অতীশ স্যারই তাকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। স্যার তার প্রশংসা করত সবার কাছে, একসময় নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। স্যারের প্রেমিকা স্যারকে ছেড়ে চলে গেছে। আলিম যখন ক্লাস টেন-এ পড়ে, তাকে পড়াতে এসে আলিমের সাথে এ-গল্প করতে-করতে চোখ ছলছল করে ওঠে স্যারের। আলিম বলে, “স্যার, আপনি আরেকটা প্রেম করেন, সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। অতীশ স্যার বুয়েট থেকে পাশ করে আমেরিকায় স্কলারশিপ পায়। যাওয়ার আগেই একদিন কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনা। স্যারের লাশ দেখতে আলিম তার বাসায় গিয়েছিল। উঠানের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে-গড়িয়ে কাঁদছে মাসিমা। আলিমকে দেখে জড়িয়ে ধরে চিৎকার, “তোমারে তো অনেক আদর করত আমার ছেলে।” আলিমের কখনোই মনে হয় নাই অতীশ স্যার নেই। সে সবসময় তাকে অনুভব করে তার পাশে।
রায়কার সাথে প্রেম হয় ভার্সিটিতে পড়ার সময়। মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার তিন-চার মাস আগে রায়কার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। আলিম তার বাবা-মাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, রায়কাদের পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো এখন খুবই জরুরি। রায়কাও কোর্ট ম্যারেজে রাজি ছিল না, প্রায় সারারাত সে হলের বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, “নানুমণি, অতীশ স্যার, তোমরা প্রার্থনা করো আমি যেন রায়কাকে ফিরে পাই।” বিপদে পড়লে মৃত আপনজনদের আকুল হয়ে সে ডাকে। শেষমেশ রায়কাই তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে তার বিয়ে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। আলিমের মনে হয় তার নানু এবং অতীশ স্যারের জন্যই রায়কাকে ফিরে পেয়েছে সে। জেলখানায়ও দিনরাত তার নানি আর স্যারকে স্মরণ করেছে সে, আর কাউকে নয়, কাউকেই না। যথেষ্ট সাক্ষ্যসাবুদের অভাবে একসময় বেকসুর খালাস হয় তার ঠিকই, কিন্তু পুরো পৃথিবীটাই হঠাৎ করে জেলখানা হয়ে যায় আলিমের।
রায়কার সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়। রায়কা চাপ দেয় চাকরিবাকরির চেষ্টা করার জন্য। প্রচুর বন্ধু আছে নানা বহুজাতিক কোম্পানিতে। অথচ পরিচিত কারো কাছেই যেতে তার মন চায় না। মনে হয় সবাই উপরে-উপরে সহানুভূতি দেখায়, মনে-মনে হয়তো তারা ভাবে আলিম খুনি। বন্ধুদের ফোনও রিসিভ করে না সে আর। রায়কা যখন আত্মীয়স্বজনের বিয়ে বা জন্মদিনের দাওয়াতে নিয়ে যেতে জবরদস্তি করে, তাকে খুন করে ফেলতে মন চায়।
ইউএনডিপির একটা প্রজেক্টে চাকরি নিয়ে রাঙ্গামাটি চলে যায় আলিম। রুদাবা ঢাকায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বলে রায়কাকে ঢাকায় তার মায়ের বাসায় রেখে যায়। রাঙ্গামাটি গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। অফিসের সময় কাজে ব্যস্ত থাকে। পাহাড়ের পাশেই একটা বাড়িতে তার ঠাঁই হয়। অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে একাকী পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যা নামা দ্যাখে। নির্জনতা, নিঃসীম নির্জনতা। তবে এখানে মাঝে-মধ্যেই অপরাধ বোধে ভোগে সে। ভাবে, খুনটা না করলেই হ’ত! এত ঝামেলায় পড়তে হ’ত না। অবসরে নির্জনতায় ডুবে থাকে আলিম। আর, এই নির্জনতাকে আকণ্ঠ পান করার চাইতে ভালো কিছু পৃথিবীর কাছে পাওয়ার আছে তা আর মনে হয় না তার।
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ রাশিদা সুলতানা
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments