গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ

হসা আন্নার মনে ভীতি জাগ্রত হয়। জীবনটা অসহনীয় রকমের সাধারণ, সাদামাটা, এই বোধ তাকে এতটাই কাবু করে ফেলে যে, তার মনে হয় সে যেন বছরের একটা দিনকে আর সব দিনের থেকে আলাদা করতে পারছে না। যেন পুরো বছরটা মিলে তার কাছে একটা দিন - বিশাল, দীর্ঘ একটা অন্তহীন দিনের মধ্যে আন্নার অনন্ত জাগরণ।

এইভাবে বললেও হয়তো আন্নার অনুভূতিকে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না। মেরু অঞ্চলে নাকি এরকম দিন ও রাতের খোঁজ পাওয়া যায়, যেগুলোর দৈর্ঘ্য ছয় মাস। আন্নার কাছে বছরটা ওই রকম এক থমকে থাকা দিন কিংবা রাত। প্রতিদিন সে ঘুম থেকে এক রকম ভাবে ওঠে। চোখ মেলে পাশে তাকিয়ে দেখে রাকিব প্রতিদিনকার অভ্যাস মতো বালিশটা মাথার ওপর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মাঝে কখন সে মাথার নিচ থেকে বালিশটা মাথার ওপর এনে রাখে এতদিনেও আন্না তা বুঝতে পারে না। এই রকম ছোটখাট, ছিটাফোটা রহস্য ছাড়া আন্নার জীবনে আর কিছু নাই। এইসব নিয়েও বেশি ভাবতে ইচ্ছা করে না। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে টলতে টলতে মেয়ের ঘরের দিকে যায় সে। মেয়েকে ডাক দিয়ে ড্রয়িং রুমে কি বারান্দায় বসে তার জেগে ওঠার অপেক্ষা করতে থাকে। ভোরের আবছা আলোটা যত স্পষ্ট হতে থাকে ততোই ভেতর থেকে একটা ক্লান্তি উপচে উঠতে থাকে। এইভাবে মেয়েকে ওঠাতে ওঠাতে কিংবা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কাজের মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কয়েকদিন প্রায়ই আন্নার মনে হয় : খুব কম ঘুম হলো। যেন সারারাত এইভাবে নির্ঘুম বসে আছে। মাথাটা চিনচিন করতে থাকে। ভোরবেলার বিরক্তিকর মুহূর্তটুকুই তার একমাত্র নিজের সময়। কাজের মেয়ে আসা, এসে আজ কী রান্না করবে তা জিজ্ঞেস করা, তিতলির ঘুম থেকে উঠে প্রথম ঘ্যান ঘ্যান করা পর্যন্ত এই-ই পুরো দিনে একমাত্র একা থাকার সময় তার। নিঃসঙ্গতা অথবা নিরবতার। কিন্তু এইটুকু সময়ও আন্না একা থাকতে চায় না। অসহনীয় এক তানহাই, মেলানকলি প্রতিদিন সকালে তাকে নাকাল করে ফেলে। প্রত্যেক সকালে ভাবে, কাজের মেয়ে এসে বেল বাজানোর আগে চোখ খুলবে না। কিন্তু কী এক ম্যাজিকে প্রথম আলো ফোটা আর আন্নার চোখ খুলে যাওয়ার ঘটনা দুটি এক সঙ্গে ঘটতে থাকে প্রতিদিন। একই রকম ভাবে।
দিনটা যদি একটু অন্যরকম হতো? ভাবে সে। কী রকম হতে পারতো, সে বুঝতে পারে না। তিতলির স্কুলে না যাওয়া। কাজের মেয়ের না আসা। রাকিবের ঘরে না থাকা। এইসব যদি না থাকতো তাহলে কী হতো? অনেক অপশন ভেবে যা বের হয় তা অন্য আরেকটা দিনের মতোই। এ রকম অজস্র দিনও তো আছে। ছুটির দিনের মতো। অলস দিন। অন্যরকম একটা দিনের কথা ভেবে যখন আর কোনো কিনারা পায় না তখন নিজের উপর নতুন বিরক্তি জন্মাতে থাকে। আন্না আড়মোড়া ভাঙে। শাড়ি ঠিক করে। চুলের গোছা দু হাতে ধরে একটানে খোপা বেঁধে ফেলে। একবার উঠে আবার ধপ করে বসে পড়ে। আলস্য তাকে কিছুক্ষণের জন্য আকুল করে ফেলে। হাড়ে যেন বল পাচ্ছে না।

একই সঙ্গে কলিং বেলের শব্দ আর মেয়ের ঘরের খুট খাট শুরু হয়। কাজের মেয়ে এসে পড়েছে। মেয়েও উঠেছে। ব্যস। বসে থাকার উপায় নেই। হাতে সময় দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে মেয়েকে রেডি করে, খাইয়ে স্কুল বাস পর্যন্ত দিয়ে আসতে হবে। নিজে রেডি হয়ে খেয়ে ক্যাম্পাসের বাস ধরবে। রাকিবের জন্য খাবার রেডি করে ঢেকে রাখবে। এই দুই ঘণ্টার মধ্যে তাকে পোশাক বদলাতে হবে দুইবার। সকাল বেলার অল্প সময়ের নিরবতার মতো ব্যস্ততার সময়ও সাকুল্যে ওই দুই ঘণ্টাই। কলাবাগান মোড় পার হয়ে জিনজিয়ান রেস্টুরেন্টের সমানে আটটার বাস ধরার জন্য দাঁড়ানো পর্যন্ত। রাকিব আধভাঙা ঘুম চোখে এসে দরজাটা শুধু বন্ধ করবে। প্রতিদিনকার অভ্যাস মতো আন্না মনে করিয়ে দেবে ঠিক দশটায় তিতলিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। রাকিব ঘাড় কাত করে শুধু সায় দেবে।

কলাবাগান থেকে গুলশান। এর মধ্যে ক্লাশ নোটগুলোতে চোখ বোলাতে হয়, মনে মনে কয়েকটা ক্লাশ ঝালাই করতে হয়। প্রতিদিন ক্লাশ থাকে পাঁচ কি ছয়টা। নয়টা থেকে নয়টা পঁয়তাল্লিশ। সোয়া দশটা থেকে এগারো। সাড়ে বারো থেকে পৌনে এক। দুইটা থেকে দুুইটা পঁয়তাল্লিশ। সোয়া তিনটা থেকে চারটা। মাঝে ১৫, ৩০, ৪৫, কিংবা ৭৫ মিনিটের ব্রেক। ওইগুলো নো ম্যানস ল্যান্ডের মতো। কোথাও বেরুনো যায় না। মন দিয়ে কিছু পড়া যায় না। শুধু যেন গসিপ, দৈনিক পত্রিকা পড়া, মোবাইলে কথা বলা আর ক্লাস নোটগুলোতে একটু চোখ বোলাবার মতো অবসর ভেবে চিন্তে ঠিক করা হয়েছে। ধীরগতির ভারী এক কাজ। মাঝে মাঝে অসহনীয় লাগে। মাঝে মাঝে সহনীয়। ওইটুকুই। চারটা বাজলে ভেতরের গুমোট ভাবটা আবার বাড়তে থাকে। এরপর কী?

অপশন দুইটা। হয় চারটার বাস নয়তো পাঁচটার। বাস তাকে কলাবগান মোড়ে নামিয়ে দিকে চলে যায়। কিছু কাঁচা বাজার সেরে, বড় জোর নিউ মার্কেট অথবা গাউসিয়া পর্যন্ত গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে ফিরতে পারে। এর বেশি কোনো আইডিয়া তার মাথায় আসে না। আসলেও সহসা তিতলির মুখটাই চোখে ভেসে ওঠে। তিতলিকে স্কুল থেকে বাসায় এনে রাকিব কাজে চলে যায়। ফেরার আর ঠিকঠিকানা নেই। যদি আন্না ভাবে বাসায় না গিয়ে অন্য কোথাও যাবে তাহলে মেয়েটার কী হবে? বারোটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত একা ঘরবন্দি মেয়েটা কী করবে? সারাদিন শাওনের সাথে হেসে খেলে, কার্টুন দেখে, ঘুমিয়ে কতটুকু পারা যায়? বাবা-মা তাকে কতটুকু সময় দিতে পারে? ভবিষ্যতে এগুলো তার মনে কী গভীর রেখাপাত করবে? আন্না পুরোটা এক সাথে ভেবে উঠতে পারে না। ফলে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা এতটুকুও ভাবে না। ভাবতেই পারে না। সোজা ঘরে চলে আসে। খুব ঘোরার ইচ্ছা হলে সোজা বাসায় গিয়ে শাওনকে বিদায় দিয়ে তিতলিকে গুছিয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়ে। ধানমণ্ডি লেকের ধারে, ৩২ নম্বর রাস্তায়, একটু এদিক ওদিক হেঁটে রিকশা করে আবার ফিরে আসে। তারপর সেই রাত। রাকিবের ফেরার অপেক্ষা। তিতলির ঘুম। টিভি। চিন্তাভাবনাকে মিডিওকার লেভেলে রাখতে টিভির কোনো জুড়ি নাই। মাঝারি আইডিয়া, মাঝারি চাহিদা আর কথাবার্তা আন্নাকে মাঝে মাঝে পাগল করে তোলে। বিরক্ত হয়ে সবচেয়ে অপ্রিয় অনুষ্ঠান রেসলিং ছেড়ে বসে থাকে মাঝে মাঝে। এইখানে একটু আদিমতা আছে। বানানো হলেও একটা লোক আরেকটা লোককে নির্মমভাবে মারছে। দেখতে ভাল লাগে। খুব স্যাডিস্ট আইডিয়া, তবু রেসলিং ছেড়ে বসে থাকে। তিতলি ঘুমিয়ে পড়লে টিভিটা বন্ধ করার কথা একবারও ভাবে না। পাঁচ মিনিট নিঃশব্দ ঘরের মধ্যে বসে থাকলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

মাঝে মাঝে জোর করে ভাবতে চায় জীবনটা তো স্মুথ, সাবলীলভাবেই চলে যাচ্ছে। রাকিবকে যখন বিয়ে করেছিল তখন মনে হতো কষ্ট করে সংসার চালাতে হবে। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবে। ভেবেছিল চারটা ফার্স্ট ক্লাশ নিয়ে অন্তত ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার মতো একটা বাসা পাবে। রাকিব তার ছন্নছাড়া ক্যারিয়ার নিয়ে যা আয় করবে তা দিয়ে দুজনের ছোট সংসার কোনো রকমে চলে যাবে। নিজের চাওয়াটাকে তখন একটা কবিতার লাইনে চালান করে দিতে পারতো অনায়াসে। অতটুকু চায়নি বালিকা, চেয়েছিল আরও কিছু কম। অনেক অপেক্ষার পরও যখন ডিপার্টমেন্টে জয়েন করা হলো না তখন খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল আর দেশেই থাকবে না, রাকিবকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। তখনো তিতলি হয়নি। একটা নিশ্চিত পারিবারিক জীবনে দুজনের কেউই অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অফারটা এলো তখনই। বিএনপি-আওয়ামী লীগ না করলে, টিচার্স লবির বড় চাঁইদের সঙ্গে খাতির না থাকলে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা কঠিন। প্রাইভেট উইনিভার্সিটিতে এইসবের বালাই নেই। বরং মাথায় রাজনীতি, গ্রপিং-লবিং না থাকলেই ওরা খুশি। আন্নার রেজাল্ট দেখে নিয়ে নিল। তারপর ভালই চলছে। রাকিব কাজ করছে। আর কী? হয়তো অনেক কিছু, হয়তো কিছুই না।

আন্নার জীবনে কি কোনো লক্ষ্য ছিল? নিজে ভেবে বের করতে পারে না, জীবনে আসলে সে কী চেয়েছিল। আর কী কী তার জীবনে হতে পারতো সে জানে না। বছরের কোনো একটা সময়, কোনো একটা সময়ের কয়েকটা দিন এইরকম হয়। হু হু করে ভাবনাগুলো এসে তাকে কাহিল করে দিয়ে যায়। রাকিব হয়তো বুঝতে পারে। বলে, তোমার কী হইছে। আনু, মন খারাপ কেন? শোনো। কোথাও যাবা নাকি? এক কাজ করো, তিন দিনের ছুটি নাও। চলো কক্সবাজার যাই। এক কক্সবাজার, রাঙ্গামটি, জাফলং, সুন্দরবন আর কত যাবে? রাকিবের কথার কোনো উত্তর দেয় না। এক কাজ করো, চলো গ্রামে যাই। অথবা কালকে চলো ওয়ান্ডারল্যান্ডে যাই। তুমি ক্লাস শেষ করে অপেক্ষা কোরো। আমি তিতলিকে নিয়ে এসে পড়বো। আন্না বলে, বকবক করো না। ঘুমাও। রাকিব নিঃশব্দে পাশ ফিরে শোয়। হয়তো নির্দেশ মতে ঘুমিয়েও পড়ে।

এখন আন্নার জীবনের সেইসব আকুল দিন। আর কিছু ভাল লাগতে চায় না। প্রতিদিনকার জীবনকে স্রেফ প্রতিদিনকার জীবন ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মনে হয়, ছোট্ট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে হঠাৎ একদিন স্বামী-সংসার রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে। চলে যাওয়ার আগে একটা চিরকুট লেখার কথা ভাবতেও ভাল লাগে না। রাজীবের কথা মনে পড়ে। মিথিলার কথাও। ভাবে মিথিলাকে একটা ফোন দেবে। মৃন্ময়ী মিথিলা। নব্বই দশকের সবচেয়ে আলোচিত নারী লেখক। সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহানদের পরে তাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। অদিতি ফাল্গুনী, শাহনাজ মুন্নী, রাশিদা সুলতানাদের সমসাময়িক। কতদিন মিথির সঙ্গে কথা হয় না। জানে সে, খুব সঙ্গত কারণেই হয় না। তারপরও ইচ্ছা হয় একবার ওকে ফোন করে। পরপর তিনদিন ভেবে তারপর ফোন দেয় বা ফোন দেবার মতো মুড পায়। মিথি অন্য পুরুষ লেখকদের মতোই মেলোড্রামাটিক। হিউমার উইট আর পরিহাসের বস্তা একেকটা। ফোন ধরেই বলে, আরে আমাদের আন্না কারেনিনা! তলস্তয়ের সেরা চরিত্র। কী খবর, এতদিন পর? শোন তোর কথাই ভাবছিলাম। আমি তো আজই তোকে ফোন করতাম। কিন্তু দেখ কেমন টেলিপ্যাথি। তুইই ফোন দিলি। গুড। ফোন যখন করেই ফেলেছিস তখন স্বার্থপরের মতো আগে নিজের কথাটা বলে ফেলি। বুঝলি, মাত্র আমি আলিমুল হক স্যারের বাসা থেকে বের হলাম। সাউথ এশিয়ান সোশাল স্টাডিজের ওপর একটা অ্যান্থোলজি হচ্ছে। এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সম্পাদক আলিমুল হক আর প্রফেসর খায়রুজামান। সঙ্গে আমি। আলিমুল হক ঠিক আছে, কিন্তু খায়রুজ্জামান এখানে কোত্থেকে আসে বল? হাস্যকর! সোয়াশে লিঙ্ক আছে বলেই ডোনাররা ওনার নামটা জুড়ে দিয়েছে। কাজে অবশ্য খুবই অসুবিধা হচ্ছে। দুইটা তো দুই মেরুর লোক। মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। দুইজনেই ফার্স্ট মিটিংয়ের আগে আমাকে বলেছে, দেখো মৃন্ময়ী কো-অর্ডিনেশনটা কিন্তু তোমাকেই করতে হবে। আমার নামটা আসায় অবশ্য খুব অবাক হয়েছি। বুঝলি না, আমাকে নিয়ে জেন্ডার ব্যালান্স করলো। এখন বন্ধু, তুমি আমাকে বাঁচাও। তিনটা গবেষণা আছে বলেই হয়তো কাজটা আমি পেয়েছি কিন্তু তোমার সাহায্য ছাড়া আমি একপাও আগাতে পারবো না।

আন্না বলে, না না, তুই পারবি। আর আমাকে কি সত্যিই তুই খুঁজতি নাকি? আমি ফোন দিলাম বলেই না…। মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মিথিলা বলে, দেখো বন্ধু যুক্তির খাতিরে দেখলে কাজটা কিন্তু তোরই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কী করবি বল। তুই তো টিচার পলিটিক্সের কারণে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকতেই পারলি না। লেখালেখি, গবেষণা সব বাদ দিয়ে সংসারি হয়ে গেলি। আমি হয়তো অ্যাকাডেমিক প্রোফাইলে তোর কাছাকাছিও ছিলাম না। কিন্তু সাহিত্য সমাজতত্ত্ব নিয়ে কিছু পড়াশোনা তো করেছি। লেখালেখি করেছি। ফিল্ডে কাজ করেছি। আমি বুঝি, আমার প্রতি তোর জেলাস হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিলিভ মি, তোর হেল্পটা কিন্তু সত্যিই আমার দরকার। বইটা রুটলেজ থেকে বের হবে। কাজের মান বজায় রাখতে হবে আবার প্রচুর লেখাও সম্পাদনা করতে হবে। ইংরেজিতে লেখা গবেষণাগুলো বাছাই করতে হবে। কোনো বিষয় বাদ পড়লে নতুন করে অ্যাসাইন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা গুরুত্বপূর্ণ বাংলা প্রবন্ধগুলো অনুবাদ করাতে হবে। আন্না বলে, না না মিথি। আমি মোটেও জেলাস নই। আর আমি কখন লেখালেখি করতাম বল তো? তোর কাজে আসতে পারলেই আমি খুশি। কিন্তু জানিস তো, আমি অনেক দিন গবেষণার সঙ্গে নেই। আমি কি পারবো, তোর এই বিশাল আয়োজনে কোনো কাজে আসতে? তারপরও তুই বললে থাকবো। মিথির নিজের প্রসঙ্গ শেষ হলে বলে, বল বন্ধু, তোর কথা শুনি। এতদিন পর কি মনে করে ফোন দিলি? শোন, তোকে একটা মজার কথা বলি, সেদিন রাকিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। কী একটা অ্যাড ফিল্ম তৈরি করছে। বললো, মেগা সিরিয়ালে নামবে। ভাল। উনি তো দেখি আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছেন। আচ্ছা, তোর মেয়েটা কেমন আছে? কী যেন নাম? জানিস তো, অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ের নামও তিতলি। গতবার কলকাতা বইমেলায় গিয়ে ওনার সাথে দেখা। বলে মৃন্ময়ী নামে এক লেখকের অপেক্ষাতেই যেন বাংলা সাহিত্য ছিল এতদিন। আমি বললাম টিংকুদা ফ্লার্ট করবেন না তো। আপনার মতো বিশাল ঔপন্যাসিকের মুখে এই কথা শুনে আমার তো লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত। টিংকুদা কী বলে জানিস? মৃন্ময়ী তোমার স্থানও কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছে। তো ওইখানেই উনি দাওয়াত দিয়ে বসলেন। বললেন সল্টলেকে এসো। পত্রিকায় পড়ার আগে নতুন গল্পটা তোমার মুখ থেকে শুনে নিতে চাই। ওনার মেয়েটা যে কী মিষ্টি। ষোলো, তোর মেয়ে তো অনেক ছোট না? কত হলো? ছয়? বলিস কী? এখন তো তুই তাহলে মেয়েকে রেখে মুভ করতে পারিস। তাই না? তোর কত কিছু হলো, তাই না রে? স্বামী সংসার। মেয়ে। একটা ভাল চাকরি। আর কী চাই জীবনে। কিন্তু আমাকে দেখ, লেখালেখির জন্য কী না করলাম। সংসার নেই, বিয়ে নেই। এই বয়সেও একা থাকি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবাই সন্দেহের চোখে দেখে। অনেকে আইবুড়ো দেখে নক করে। শুধু শরীরের জন্য। কী যে ঘেন্না লাগে নিজের ওপর। বাকি জীবনটাও হয়তো এইভাবেই চলে যাবে। মেলা প্রশ্ন আর রক্তচক্ষুর মাঝখানে। মাঝে মাঝে কী ভাবি জানিস? শেষ বয়সে তোদের মতো কারও সংসারে গিয়ে সওয়ার হবো। যখন একদম অচল হয়ে যাবো। রেডি থাকিস বুঝলি? আচ্ছা, শোন বন্ধু আজ রাখতে হবে। বাসে উঠবো। এখন আবার গিয়ে একটু লাইব্রেরিতে বসতে হবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে। আর একটু আড্ডা আছে। পরে কথা হবে। ভাল থাকিস। বাই।

মিথিলাকে ফোন করলে সাধারণত এরকমই ঘটে। সব কথা ওই বলে। আন্না হাসে। আহা রে মিথি। তোর এতো বলার মতো কথা? কিন্তু শোনার মতো কথা কত কম! কোথায় ভেবেছিল মনের ভেতরের শূন্যতা, অস্থিরতা নিয়ে লেখক বন্ধুর সঙ্গে একটু শেয়ার করবে। কিন্তু কী হলো? নিজের কথা তো দূরের কথা। সে প্রসঙ্গই ওঠানো গেল না। মিথিটা ভীষণ আউটস্পোকেন। নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করতে হয়, খুব ভাল জানে। মনে মনে হাসে আন্না। মজাটা কিছু সময় স্থায়ী হয়ে আবার উবে যায়। কত কথাই না বলতে চেয়েছিল। আবার রাজীবের কথা মনে হয় তার। রাজীবটা কোথায়? রাজীব লেখকদের এক গভীর নিঃসঙ্গতা ও আত্মপরতার কথা বলতো। যেখানে লেখকরা নিজের মধ্যে নিজে গুম হয়ে থাকে। নিজের কথা আর মুখে আসে না। একদম আলাদা হয়ে সঙ্গোপনে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করতে থাকে। অনন্ত যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়। তখন কেউ আর তাকে বুঝতে পারে না। এমনকি ভাষা, লেখা, গল্প, কবিতা সব দুর্বোধ্য হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় নিরব থাকলে নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার অবসরটা তৈরি হয়। আর লেখক তখনই নিজের শক্তি, অনুভূতি আর চিন্তাকে আবিষ্কার করতে পারে। সেটা নিরবতা থেকে আসে। মাঝে মাঝে পত্রিকায় রাজীবের লেখা খোঁজে। কখনোই চোখে পড়ে না। অদ্ভুত। অথচ রাজীবকে কত সম্ভাবনাময় লেখক মনে হতো। এখন বন্ধুদের মধ্যে কেবল মৃন্ময়ী মিথিলার কথা চারদিকে। আহা মিথি। নিজের কথা একটু কম করে বললে হয় না? আমরা তো সবাই তোকে ভালবাসি, তোর জন্য গর্ববোধ করি। নিজের কথা এইভাবে বলে মানুষ? একটু চুপ করে থাকতে পারিস না তুই? এইসব ওকে বলার ইচ্ছা করে। কিন্তু বলতে পারে না। হয়তো মিথির ব্যাপারে জেলাস বলেই এরকম করে ভাবে। মিথি হয়তো ঠিকই বলেছে। আন্না বুঝতে পারে, মিথির খ্যাতি আর মিডিয়ায় উপস্থিতিটা সম্পর্কের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবু মিথি আছে বলেই রক্ষা। আর কারও দেখা পাওয়াই মুশকিল। মিথিকে বললে তবু আঁলিয়সে সময় দেবে। এক কাপ কফি খাওয়া যাবে একসঙ্গে। নিজের কথা অনেক বলবে কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে অন্য সবার খবর। বাকি সবাই তো যার যার হাইড আউটে। ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে সবার মতো করে জীবন চালাচ্ছে। এক মিথিই তো নিজের মতো করে লড়াই করে জীবন কাটাচ্ছে।

রাতে আবার মিথি ফোন করে। রাকিবের হাতটা তখন তার পাজামার নটের আশপাশ দিয়ে শান্তভাবে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো। এত রাতে কে ফোন করবে? ফোনটার কাছে যেতে যেতে ভাবে আন্না। মিথি। বন্ধু ঘুমিয়েছো নাকি? তোমরা বিবাহিত লোক, এতরাতে তোমাদের বিরক্ত করা ঠিক না। তারপরও তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো। আন্না ওকে ইজি করে। বলে, বল না। ঘুমাইনি রে। আয়োজন চলছে। বল না। মিথি বলে, তোকে সবচেয়ে ভাল বন্ধু মনে করি বলেই এত রাতে ফোন করার সাহস পেলাম। আচ্ছা আন্না আমি তো ভাল চাকরি করি। একা থাকি, কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকার পড়ে না। সময় পেলে সিনেমা দেখি, গান শুনি। দু চারপাতা লিখি। সামনের ফেব্র“য়ারিতে একটা গবেষণা একটা উপন্যাস মিলিয়ে মোট দুইটা বই বের হবে। সেইভাবে দেখতে গেলে কিন্তু আমার অপূর্ণতা নাই। আচ্ছা বলতো আন্না, আমাদের জীবন কেমন করে দুই রকম হয়ে গেল?
আন্না চুপ থাকে। কত পাল্টা যুক্তি তার মনের ভেতর গড়ে ওঠে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হয় না। মিথি বলে, কিন্তু আমি ভাল আছি বলে কীভাবে এটা মানি যে তুই খারাপ আছিস বন্ধু? ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিস। প্রাইভেট হোক, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো। ভাল মানুষ একটা বর পেয়েছিস। রাকিব তো খুব ভাল ছেলে তাই না। ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে। সারাদিন ক্লাস নিয়ে ফিরে তো মেয়ের মুখটা দেখলে সব ক্লান্তি চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু জানিস আন্না, আমার আর সংসার করতে ইচ্ছা করে না। কী হয় সংসার করে? তোকে দেখে শিখছি বন্ধু। তোর হয়তো মেয়েটা আছে। কিন্তু ভাব তুই কত ভাল ছাত্রী ছিলি। তুলনা করলে তোর চেয়ে আমার প্রোফাইল তো অনেক লো। কিন্তু দেখ তোর কিছুই হলো না। অথচ আমি তো ভাবতাম আমাদের মধ্যে কেউ যদি নাম করে, কারো যদি সেই সামাজিক প্রভাব তৈরি হয় তো সেটা তুই। মিথি কথা বলতেই থাকে। আন্না অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। এই সব বলতে ফোন করেছে মেয়েটা?

হ্যাঁ যে কারণে তোকে ফোন করেছি। সিঙ্গেল একটা মেয়ের দুঃখ তো তুই বুুঝবি না। কিন্তু তারপরও বলি। তোর কি মনে হয়, আমার মধ্যে নারীত্বসুলভ কোনো সৌন্দর্য আছে নাকি একা একটা মেয়ে শহরে একা আছে, দেখি নক করে, এটা ভেবে ছেলেরা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়? বলতো আন্না।

কেন রে কে আবার কে আবার নক করলো? আন্না জিজ্ঞেস করে।

সব বলবো। তোর সঙ্গে দেখা করে সব বলবো। এখন শুধু আমাকে বল, আমার মধ্যে আকর্ষণীয় কি কিছু আছে? আমার ইন্টেলেক্ট কি মানুষকে টানে? বলতো একটা ইন্টেলেকচুয়াল মেয়ে দেখে কি ছেলেরা এগিয়ে আসে? আমি একটা মহাসমস্যায় আছি বন্ধু। তুই একদিন আমাকে সময় দে। আমি সব কথা তোকে বলবো।

এই সুযোগটাই নেয় আন্না। শোন, কাল আবার আমার ক্লাশ আছে। আপনা থেকেই একটা হাই ওঠে। আজ রাখি রে। তুই সময় করে একদিন বাসায় আয়। কথা হবে। এত কাছাকাছি থাকি অথচ দেখ, সামনা সামনি দেখাই হয় না কত দিন। আয় একদিন। কবে আসবি বল।

মিথি বলে, ঠিক আছে একদিন হুট করে তোকে ফোন দিয়ে জানাবো।

ফোনটা রেখে দেয় আন্না।

একটা বিরক্তি এসে ভর করে। বিরক্তিটা কি নিজের ওপর না মিথির ওপর বুঝতে পারে না। রাকিব একটু কৌতূহলী হয়। কিন্তু আন্নার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। আন্নার শীতল মোনালিসা টাইপ মুখের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে রাকিব খুব বিস্মিত হয়। মাঝে মাঝে ভয়ও পায়। ওর শীতলতা কিছুক্ষণের মধ্যে তাকেও শীতল করে দেয়। আন্নার মনটা এতটুকু হয়ে থাকে। এই মেয়েটা কী বলতে চায় তাকে? মাথাটা চিনচিন করতে থাকে। আজ হয়তো সারারাত সে নির্ঘুম কাটিয়ে দেবে এ পাশ ওপাশ ফিরে, কিন্তু ঠিক ভোরে আবার উঠে পড়বে। আবার শুরু হবে একই রকম আরেকটা দিন। একটু নিরবতা তারপর কাজ, ব্যস্ততা এবং ক্লান্তিকর দীর্ঘ আরেকটা দিন। সেও তো লেখক হতে পারতো। কত কিছুই না তার মনে আসে। রাজীবের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে একদিন বাসে যেতে যেতে মার্কেজের লেখা নিয়ে কথা হচ্ছিল। মার্কেজের একেকটা উপন্যাস নিয়ে নিজের ভাবনাগুলো বলছিল আন্না। রাজীবের চোখ তখন বিস্মিত, মুগ্ধ। রাজীব বলেছিল, আমি এমন এক নারীর সঙ্গে থাকতে চাই যে মার্কেজের সমান লেখক। আর তুমি সেই রকম এক লেখক হয়ে উঠবে একদিন। আই হোপ সো। সেদিন কথাটাকে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু মনের গভীরে কোথাও একটা আশা ও উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল। সে তো ভাবতোই লেখক হবে। খুব গোপনে বড় লেখক হবার বাসনা ছিল। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেল। আন্না জানে না কোথায়। রাজীবের প্রিয় উপন্যাস ছিল আনা কারেনিনা। নাকি আন্না কারেনিনা? আন্নারও। কয়েকবার সে পড়েছিল উপন্যাসটি। আন্না শেষ পর্যন্ত কি ঈশ্বরেরই প্রতিহিংসার শিকার? আন্না জানে না। রাজীব কিন্তু আন্নাকে তলস্তয়ের আনার মতো ওরকমই জটিল আর দৃঢ়চিত্ত এক নারী ভাবতো। বলতো, দেখ আন্না, তোর মুখের ঠাণ্ডা ভাবটা একদম রাশিয়ান। আচ্ছা তোর বাবা-মা কি আনা কারেনিনা থেকে তোর নামটা পেয়েছে? কী উত্তর হয় এ প্রশ্নের? না আন্নার বাবা-মা রাশিয়ান উপন্যাস থেকে তার নামটি পায়নি। আর তার মুখের ঠাণ্ডা ভাবটা কোনো রাশিয়ান আবহ থেকেও আসেনি। তারপরও রাজীবের মুগ্ধতা, ঠিক মুগ্ধতা নয় সতর্ক পর্যবেক্ষণটা তার খুব পছন্দ হতো। সে সারাক্ষণ তার মুখের রেখাগুলোর পড়ার চেষ্টা করতো। সৌন্দর্য ঠিক যেন দেখার বিষয় নয়, যেন ত্বকের ভাষা সে অনুবাদ করতে চায়।

কোথায় গেল রাজীব? হয়তো মিথি বলতে পারবে। মিথি কি বলতে পারবে? সরাসরি জিজ্ঞেস করলে মিথি হয়তো অন্য কিছু ভেবে নেবে। পুরনো প্রেমিককে কেন খোঁজে আন্না? হয়তো বলেই বসবে, তুই কি বিবাহিত জীবনে অসুখী আন্না? তারপরও তার মনে হয়, সরাসরি জিজ্ঞেস করবে একদিন। যা মনে করে করুক।

পরদিন আবার মিথিলার ফোন। একটু বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে আন্না। আচ্ছা আন্না, শায়লার কোনো খবর জানিস তুই? বল তো আন্না, শায়লা কি খুুব কষ্টে আছে? আমার সঙ্গে তো মেলা দিন যোগাযোগ নেই। কিন্তু কেন জানি হঠাৎ কাল রাতে ওকে স্বপ্নে দেখলাম। কোথায় যেন তুই আমি আর শায়লা ঘুরতে গেছি। আমরা সেই তিন পুরনো বন্ধু। হঠাৎ দেখি শায়লা আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আর তুই ওকে সান্ত¡না দিচ্ছিস। কেন এই স্বপ্নটা আমি দেখলাম বলতো? তুই কি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে পারিস? আমি ভেবেছিলাম অন্তত তোর সঙ্গে ওর একটা যোগাযোগ আছে। তোর কাছে কি শায়লার নাম্বার আছে? আমি ফোন দিলে কী ভাবে কে জানে? শোন তুই ওকে একটা ফোন দিস। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করিস তো, ও ভাল আছে কি না।

রাতে দেখা একটা স্বপ্ন, তিন বন্ধু। আন্না কিছু মেলাতে পারে না। তবু মিথিকে কথা দেয়। নিজেও ভাবে একবার শায়লার খবর নেবে।

বিকালে বাসায় ফিরে এক কাপ চা হাতে নিয়ে শায়লাকে ফোন দেয়। শায়লা সবসময়ই উচ্ছ্বসিত। লাইভ। বলে, ডার্লিং, আমার কথাও তোমার মনে পড়ে? আন্না সত্যি কথা বলে, আমার মনে পড়ে নাই। তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড তোমার কথা মনে করছে।

কী বললো?

বলে তোমাকে নিয়া নাকি কাল রাতে কী একটা স্বপ্ন দেখছে। তুমি কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে বললো।

বুঝছি, মাগী মনে হয় আবার আমার হাবির প্রেমে পড়ছে।

এইগুলা কী ভাষা শায়লা?

কেন আমি তো কমই বলছি। এর আগের বার তো ওরে তাড়ায়া একেবারে যোগাযোগ বন্ধ করে দিছিলাম। আবার ভিড়ছে তাহলে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। কিন্তু যোগাযোগটা হইলো কেমনে? দেখা হয় কই?

দ্যাখ তোকে ফোন দিয়েই মনে হয় ভুল করলাম। কোথায় মিথি তোর জন্য ভাবছে আর তুই…

শোন আন্না, এইগুলা তুই বুঝবি না। ভাল মেয়েরা এইগুলা বুঝতে পারে না। কিন্তু আমার ঘ্রাণশক্তি কুকুরের মতো। আমি ঠিকই বুঝছি কী হইছে মিথির। বেটি সাইকোলজিকাল গেমিং করে। বুঝলি তো? আমার বরের বারোটা বাজিয়ে তারপর ছাড়বে। এবার বল তোর খবর কী? কী করিস তুই?

এই তো চলছে আর কি।

চলছে আর কি, মানে কী? তোর যা ফিগার, ওই রকম আছে তো? অবশ্য ওইরকম থাকলেই বা কী? রাকিব ছাড়া তো আর কেউ দেখলো না। রাজীবকে দেখাইছিলি? নাকি ঠকাইছিস? শোন, তোর ওই শ্রীমানের সঙ্গে একদিন দেখা, গুলশানে। সুটেড বুটেড অবস্থা। আমি তো চিনে ফেলে হাসি আর আটকাইতে পারি না। কী করে জানিস? ব্যাংকের অফিসার। কার্ড দিলো।

আছে তোর কাছে নাম্বারটা?

আছে। কিন্তু ওইটা যে আমার কাছে আছে এটা তো তুমি ভাবো নাই, তাই না? তোমারে কাফফারা দিতে হইবো। বুঝলা? তিনদিন আমার পিছনে ঘুরবা, তারপর পাইবা। শোনো, তোমার মিথিলারে কইবা ওর স্বপ্ন আমি ছুটাইতেছি। তোমার ক্যাম্পাসের পাশে একটা বুটিকের দোকান আছে, চিনো নাকি? স্টাইলজ। মাঝে মাঝে ওইখানে যাই আমি। আমার ক্লায়েন্ট ওরা। সামনের ঈদে ওদের কয়টা ডিজাইন দেব। কালকে আবার যাওয়ার কথা আছে। যদি যাই তো তোমার ওখানে ঢু মারবো। ভয় পাইও না। ফোন দিয়াই আসবো। আর শোনো, হিন্দুটার নাম্বার এসএমএস কইরা পাঠাইতেছি।

না থাক, কাল এলে তখনই দিস।

বুঝছি, রাকিবকে ভয় পাচ্ছিস। ওই গোবেচারারে ভয় পাস ক্যান? ব্যাটা এখনও তোর ফোন দেখে নাকি? ওকে ফ্রেন্ড, কালকেই নিস তাইলে।

এই হলো আনপ্রেডিক্টেবল শায়লা। ক্যাম্পাসে বোরখা পরতো। সজলকে বিয়ে করার পর বছর গড়াতে না গড়াতেই বোরখা ছেড়ে লো কাটে মন দিয়েছে। কামিজ হলেও লো কাট, ব্লাউজ হলেও লো কাট। স্লিভলেস। নাভীর নিচে শাড়ি। কখন কী করে বসে ঠিক নাই। অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই পুরানা বান্ধবীর খোঁজ-খবর নিয়ে আন্নার একটু ভালই লাগে। আন্না বোঝে দুই বন্ধুর কেউই তার মতো নয়। তারপরও কেন যেন ইউনিভার্সিটিতে এদের দুজনের গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো সারাদিন। এদের সঙ্গে সারাজীবন যোগাযোগ রাখার কথা ভাবতো। জীবনে কখন যে কাকে মোস্ট এসেনশিয়াল বলে ভুল হয়ে যায়? অথচ কেউই তো কারও জন্য এসেনশিয়াল না।

দুপুরের পর নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে আন্নার ক্যাম্পাসের সামনে এসে ফোন করে শায়লা। নেমে আয়, কাছে কোথাও বসে কফি খাই। কী বলিস, সমস্যা হবে? পরের ক্লাসের পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। হুট হাট করে প্রায় দৌড়ে নেমে আসে। শায়লার সামনে দাঁড়ালে সবার আগে চোখ পড়ে ওর পোশাকের দিকে। নীল রঙের একটা টাইট জিন্সের ওপর গ্রামীণের টি শার্ট। কালো সানগ্লাস। সামনের চুলগুলো মুখের দিকে এগিয়ে এসে কপালের দুই দিক প্রায় সমান করে ঢেকে রেখেছে। ইদানিং আউটলুকে অনেক চেঞ্জ এনেছে। এর আগের বার যখন দেখা হয়েছিল তখন ছিল কদম ছাট। পরেছিল স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি। গলা থেকে ঝোলানো ছিল কাপড়ের ছোট একটা পার্স। তাতে আইপড। গাড়িতে ফুল ভলিউমে শাকিরার গান বাজছে। নাচতে নাচতে গাড়ি চালিয়ে একটা কফি শপের সামনে হার্ড ব্রেক করে দাঁড়ালো শায়লা। গাড়ি থামিয়ে কফি শপে ঢুকলো। একটা উঁচু টুলে শায়লা আর একটা নিচু টুলে আন্না।

আন্না, তোর ফিগার তো দেখি ভালই আছে। জিমে যাস না তারপরও কেমনে থাকে এই রকম? কিন্তু বন্ধু, এইভাবে খালাম্মাদের মতো শাড়ি পরিস কেন? তোর মতো ফিগার থাকলে কতভাবে পোশাক পরা যায়। চারদিকে তাকা। তোর দিকে মানুষকে তাকাতে দে। শায়লার একটা ফোন আসে। কিছুক্ষণ বেবি বেবি, হানি হানি করে ফোন রাখে। এই ফাঁকে শায়লাকে পর্যবেক্ষণ করে আন্না। ক্যাম্পাসে কখনো ভাবতেই পারেনি এইভাবে এই শায়লাকে দেখা সম্ভব। এক্সপ্রেশনে ও ছিল সবচেয়ে রক্ষণশীল। ফোন রেখে আন্নার দিকে তাকিয়ে শায়লা চোখ নাচায়। নিউ লাভার, বুঝলা? খালি শোয়ার ধান্দায় আছে। আমিও চর্কির মতো ঘুরাইতেছি। একলা পাইলে দিবেয়ানে। এক হাত মুঠি করে আরেক হাতের তালুতে বাড়ি মারে। (আন্না বলে, অসভ্য) আচ্ছা বন্ধু, তুমি প্রেম করো না?

নাহ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আন্না চুপ করে থাকে। ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায় শায়লা। তুমি তো কনসেপচুয়ালি আমার চাইতে অনেক আগানো ছিলা, আছোও মনে হয়। সমস্যা কী? ওই ব্যাটার লগে প্রতিদিন শুইতে ভাল লাগে?

চুপ কর তো। তোর সজলের সঙ্গে মিথির কী হইছে?

মাগী আবার ফোন করছে নাকি? ওরে কিন্তু আমি ছেচা দিমু কইলাম আন্না। এইবার কী করছে শোন, কালকে রাতে সজলরে রিমান্ডে নিছিলাম। কয়, মিথির সঙ্গে নাকি এক সেমিনারে দেখা। মিথি কয়, আসেন একদিন চা খাই। পুরানা ঘটনা টানবো না সজলভাই। আপনি তো আবার স্ত্রীভক্ত মানুষ। একদিন অফিসে আসেন, শায়লা কোনোভাবেই কিছু জানতে পারবে না। বোঝ, শায়লারে যদি তোর এতই অপছন্দ তাইলে ওর হাসবেন্ডের ওপর তোর এত নজর কেন?

এখন?

এখন কী হবে। আমি প্রেম করি, সে প্রেম করলে সমস্যা কী? কিন্তু মিথির সাইকোলজিকাল গেমে যদি তুই পড়তি তাইলে বুঝতি। পুুরুষদের মাথা দিয়া মাল বের করে ফেলে।

আস্তে। চারদিকে তাকিয়ে আন্না বলে।

ভাবিস না দোস্ত, তোর ছাত্র-ছাত্রী কেউ নাই মনে হয়। একেকটা মানসিক রোগী হয়ে যায়, বুঝলি। গতবার তো এইভাবেই সজল ধরা খাইল। সারাদিন মড়ক লাগা মুরগীর মতো ঝিমায়। আমি কই কী হইছে। উল্টা পাল্টা কথা কয়। বুঝলাম মিথিই নষ্টের গোড়া। ডাইকা দিলাম ছেঁচা। এইবার কইছি, প্রেম করবা করো। প্রতিদিন আইসা বলবা কী হইলো। মুরগীর মতো কোঁকাইলে কিন্তু খবর আছে। বন্ধু এক কাজ কর, তুইও একটা প্রেম কইরা ফেলা।

আন্নার পিঠে একটা চাপড় মারে শায়লা।
ক্যাম্পাস থেকে ফিরতে ফিরতে নিজের দুই বন্ধুর কথা ভাবে আন্না। হাস্যকর! আস্তে করে উচ্চারণ করে বলে। মুখ ভরা একটা হাসি প্রায় গিলে ফেলে। অদ্ভুত। রাকিবের কথা ভাবে। রাকিব কি বিয়ের পর আর কারও সঙ্গে কখনোই জড়িয়ে পড়েনি? রাকিবের পক্ষে জড়িয়ে পড়া একটু কঠিন। কোনো কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। মেয়েরা সাধারণত এ ধরনের ছেলেদের পছন্দ করে না। কিন্তু সে তো রাকিবের ওই শান্ত, অল্পতেই ঘেমে যাওয়া ভাবটাকে পছন্দই করেছিল, যতদূর মনে পড়ে। কিন্তু ঘটনাটা কি তাই ছিল? জীবনের জটিল একটা মোড় ফেরানো ঘটনাও কত দূরে সরে গেছে আন্নার জীবন থেকে। এখন মনে হচ্ছে তার জীবনে এরকম যেন ঘটেইনি। রাজীব বলতো, এখন আমাকে মোস্ট এসেনশিয়াল মনে হচ্ছে তো? আমার দিকে তাকা। আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো শোন। তোরই জীবনে এমন একদিন আসবে যেদিন আমার কথা একবারও মনে পড়বে না। আমাকে যে চিনতি কোনো দিন এইটাই মনে হবে না। একটা কথা বলবো? মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজীবের কথা শুনতো আন্না। কথার পর কথা, যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে কীভাবে কথা বলে ছেলেটা? ইচ্ছা করতো তখনই জড়িয়ে ধরে চুমো খায়। অথচ সে তো তাকে রাগিয়ে দেয়ার মতো কথা বলছে। বলছে, আমাদের কখনোই এক সাথে থাকা সম্ভব না। বলছে, ক্রশ রিলিজিয়াস বিয়ে মানে আমাদের সোসাইটিতে একটা বিপ্লব। আনু বিপ্লবটা রাষ্ট্রে করা যায়। কিন্তু জীবনে করা যায় না। প্রতিদিন যদি তোমার কিংবা আমার মনে হতে থাকে তোমার জন্য আমি বাবা-মা, পরিবারকে ছেড়েছি, তোমার জন্য আমি স্যাক্রিফাইস করেছি তাহলে তো হয় না। কেন হয় না জানো, বিয়ে একটা চুক্তির মতো। বড় বড় এক্সপেক্টেশন আগে থেকে তৈরি থাকলে বিয়েটা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন আর কম্প্রোমাইজ করতে ভাল লাগে না। তখন দাবিদাওয়ার মতো করে সমস্যাগুলো সামনে আসতে থাকে। মহামানবরা হয়তো পারে। কিন্তু আমরা সামান্য মানুষ আনু। দেখবে, পদে পদে ভুল হচ্ছে। অথচ খুব ভালোবাসাও আছে। কিন্তু পাশে কেউ যখন থাকবে না তখন তোমার ভুলগুলো আমার আর আমার ভুলগুলো তোমার চোখে অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে। মারামারি লেগে যাবে। তার চেয়ে এক কাজ করো, ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলো। একদিন দেখবে মনেও পড়বে না আমার কথা। আনু ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, সরাসরি উত্তর দাও, তুমি বিয়ে করছো কি করছো না? রাজীব এবার কঠিন স্বরে বলে, তুমি কি আমার কথা শোনো? বোঝো আমার কথা? আমি কী বলি এটা কি তোমার মাথায় ঢোকে? কী ভাবো তুমি আমার কথা শুনতে শুনতে?

কী করবে আন্না তখন? কোথায় ছেলে পাবে। কখনো কোনো ছেলের কথা তো ভাবেই নি রাজীব ছাড়া। রাজীবকে বিয়ে করবে, ছোট পাখির বাসার মতো একটা পরিবার হবে। বারান্দায় গাছ লাগাবে। ঘরে একটা বড় অ্যাক্যুরিয়াম কিনবে। রাজীব শুধু পড়বে আর লিখবে বাসায় বসে। সেও লিখবে। সারাদিন সাহিত্য-শিল্প নিয়ে আলোচনা আড্ডা হবে। দুইজনের সামান্য রোজগারে চলবে সুখের সংসার। ফাইনালি যখন বুঝলো রাজীব আর ফিরবে না, তখন ভীষণ রাগ হলো। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল রাজীব। কী করবে তখন আর? সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। কিন্তু যাবে কোথায়? ভাসতে থাকা মানুষের মতো সামনে যাকে পেল তাকেই আঁকড়ে ধরলো। রাকিব সামনে ছিল। আশপাশে কোনো অপশন ছিল কি না তা ভাবার মতো সময়ও নেয়নি। রাকিব কি তার জীবনে শুধু একটা ফিলার? শূন্যস্থান পূরণের মানুষ? আন্না ভেবে দেখেছে। রাকিবকে অত্যন্ত দ্রুততায়, দক্ষতার সঙ্গে ভাল বেসেছিল সে। পেরেছিল। আন্নার দিকে রাকিব বিস্মিত বালকের মতো তাকিয়ে থাকতো। আগে রাজীব বলতো আন্না শুনতো, আর এখন রাকিব শোনে আর আন্না বলে যায়। তারপর তো বিয়ে হলো। চলছে।

বাসায় ফিরে আন্না ভাবে রাজীবকে একটা ফোন দেবে। কত কথা, কত চুমো, কত নিরবতা। আহ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একবার ভাবে, না ফোন করবে না, ফোন নাম্বারটা ফেলে দেবে। পরে ভাবে, অন্তত কেমন আছে সে কথাটা জানলে সমস্যা কী? রাকিবের সঙ্গে আলাপ করবে বলে ভাবে। রাকিবের কী প্রতিক্রিয়া হবে জানে না। হয়তো জানতেও পারবে না। যেদিন রাকিবের সঙ্গে তার আর রাজীবের ব্যাপারটা শেয়ার করেছিল, রাকিব শুনে শুধু বলেছিল, স্যাড ভেরি স্যাড। কোনোদিন প্রসঙ্গটা রেফার করেনি। কোনোদিন আর রাজীবের কথা ওঠায়নি। নিজের অনুভূতি আর মনোভাবটাকে গোপন রাখার ব্যাপারে রাকিব সেরা লোক। এই ধরনের মানুষরা খুব সংসারি হয়। হতে পারে, আন্নাকে সে খুব বিশ্বাস করে। আন্না অবশ্য এইভাবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাপকাঠিতে ভাবে না। কারণ, তার অবিশ্বাস আসে না। রাকিব যদি কাউকে পছন্দ করে, কাউকে যদি ভাল লাগে তার, কারো সঙ্গে যদি জড়িয়ে যায় তাহলে কী হবে? কিছুই হবে না। আন্নার কোনো অনুভূতি আসে না। জেলাস ফিলিং হয় না। অথচ রাজীবের ব্যাপারে খুব পজেসিভ ছিল সে। কোনো মেয়ের সঙ্গে রাজীবের কথা হলেই তার মাথা ঘুরে উঠতো। প্রতি ঘণ্টায় রাজীবের খবর রাখতো। রাজীব হয়তো এখন প্রতিরাতে অন্য কারো সঙ্গে ঘুমায়, খায়, এক বিছানা শেয়ার করে। মনের ভুলেও কখনো হয়তো তার কথা মনে করে। হয়তো করে না। না রাজীবকে ফোন করবে না। স্যাডিস্ট একটা! বড় বড় কথা, কথার মালা, কথার ঢেউ, কথার সাগর। কোথায় সে এখন? কোথায় তার লেখা? মৃন্ময়ী মিথিলা এ সময়ের বড় লেখক। আর রাজীবের খবর নাই। অথচ আন্না ভেবেছিল, সে যখন ছেড়ে দিয়েছে তাকে তখন নিশ্চয়ই দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ভরিয়ে লিখে যাবে নিশ্চিন্তে। সংসারের চাপ নেই, প্রেমের এক্সপেক্টেশন নেই। ব্যস একলা থাকবে আর লিখবে। সেই লেখা কোথায়? হয়তো এটাই অনিবার্য ছিল। রাজীব হয়তো ভাল একজন পাঠকই। হঠাৎ করে কয়েকটা লেখা ভাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাসটেইনএবল কিছু হয়তো ওর মধ্যে ছিল না। রাজীবকে বিয়ে করার পর যদি এরকম হতো, তা হলে সেটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হতো। হয়তো ভাবতো, তাকে বিয়ে করেই রাজীব ক্রিয়েটিভিটি হারিয়েছে। নিজেকে দায়ী করতো, খুব অপরাধবোধ হতো তার। কিন্তু কী করলে কী হতো তা দিয়ে তো আর চলে না। রাজীবের জীবনে কী হলো, এটা জানার জন্য হলেও একটা ফোন করবে বলে ভাবে। ভাবে রাকিবের সঙ্গে কথা বলবে।

একদিন দুদিন করে এক সপ্তাহ চলে গেলেও আন্না কোনো ডিসিশনে আসতে পারে না। ভাবে মিথিলাকে একদিন জিজ্ঞেস করবে সাহিত্যে রাজীবের স্থান আসলে কোথায়? আদৌ কোনো স্থান আছে কি? শায়লার কাছে সজলের ব্যাপারটা ফাঁস হওয়ার পর মিথিলা আর তাকে ফোন করে না। মিথি হয়তো ভেবেছে শায়লাকে সে-ই সজলের ব্যাপারটা জানিয়েছে। কিন্তু মিথি কি জানে, সজলের সঙ্গে আগে পরে তার যা কিছু হয়েছে তার কিছুই সে জানতো না। শায়লাকে বলার তো প্রশ্নই আসে না। মিথি হয়তো মন খারাপ করেছে। মিথিকে একটা ফোন দেয়। তুই কি শুক্রবার ফ্রি আছিস? কোনো কাজ না থাকলে বাসায় আয় না। দুপুরে এক সাথে খাবো, গল্প করবো। উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দেয় মিথি। জানিস আন্না, কোনো বিবাহিত বান্ধবীর বাসায় আর যেতে ইচ্ছা করে না। কী জানি, তাদের সুখের সংসারে কখন আগুন লেগে যায়। ওরা নিজেরা নিজেদের মতো করে হাজারটা প্রেম করবে। ফিজিকাল রিলেশন তো ডাল-ভাত। কিন্তু মৃন্ময়ী কারো স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বললেই সব শেষ। কিন্তু কী যে হয় আমার? বিবাহিত লোকগুলোকেই পছন্দ হয়। এরাই বেশি নক করে তো। আচ্ছা আন্না, একটা সত্যি কথা বলতো, বিবাহিত জীবনে কি প্রেম বলে কিছু থাকে না? কীভাবে দিনের পর দিন বিবাহিত মানুষগুলো পাশাপাশি থাকে? একজন স্ত্রীর কথা না ভেবে অন্য কারো কথা ভাবছে। অন্যজন স্বামীর কথা না ভেবে অন্যজনের কথা ভাবছে। এটা কেন হয়? আন্না সত্যি করে বলতো, তুই কি সুখী? তুই তো পছন্দের ছেলেকে পাসনি। তারপরও তুই কি বিবাহিত জীবনে সুখী? আন্না কিছু বলে না। জানিস, আমার সংসার না হওয়ার একটা কারণ কিন্তু এটাও। বাসায় না রে, বাসায় যেতে চাই না। এক কাজ কর, আমি তো একা থাকি। তুই আমার এখানে আয়। দুপুর বেলা আমি তোকে রান্না করে খাওয়াই। ব্যাচেলর ছেলেদের মতো রাঁধি কিন্তু আমি। আমার রান্না পছন্দ না হলে, বাইরেও খেতে পারি। দু’বন্ধু শুক্রবার ফাঁকা শহরে ঘুরে ঘুরে গল্প করি, কী বলিস?

আন্না বুঝতে পারে না শুক্রবারটা ম্যানেজ করতে পারবে কি না। সামনে দুদিনের জন্য শাশুড়ি ঢাকায় আসবে ডাক্তার দেখাতে। তখন তার দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। বছরে একবার দুইবারই আসে। দুই তিন দিন কাটিয়ে চলে যায়। কোনো সমস্যা নেই। ওনার আসার ডেট যদি শুক্রবারে পড়ে তবে খুব মুশকিল হবে। তারপরও কিছু না ভেবেই মিথিকে কথা দেয়। দুইদিন আগে রাকিবকে জানিয়ে দেয় শুক্রবার তাকেই তিতলিকে সামলাতে হবে। দিনটা যেন ফ্রি রাখে। রান্না ফ্রিজে থাকবে। জাস্ট গরম করে নিলেই হবে। আর শাওন তো থাকছেই। গ্রামের বাড়িতে ফোন করে জেনে নেয়, শাশুড়ি কবে আসবে। রাকিব কিছু না বলে শুধু একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়? সে কি কোনো এক্সকিউজ চায়? আন্না ভাবে। এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি কি একটা ছুটির দিন নিজের মতো করে কাটাতে পারি না, নাকি? রাকিব শুধু আস্তে করে বলে, আমি কি তোমাকে কিছু জিগাইছি নাকি? তাহলে ওইভাবে তাকিয়ে আছো কেন? রাকিব প্রসঙ্গটাকে ঘোরায়, ইউ আর লুকিং ভেরি সেক্সি।

মিথির ঘরটায় ঢুকে আন্না অবাক হয়ে যায়। একগাদা বই আর কাগজপত্রের মধ্যে মেঝেতে কার্পেট পেতে তার ওপর তোষক চাপিয়ে একজনের কোনো রকম শোয়ার ব্যবস্থা। ঘরের একদিকে লেখার টেবিল। পাশে কম্পিউটার টেবিল। মাথার কাছে কিরণ দেশাইয়ের ইনহেরিট্যান্স অফ লস আর তাহমিমা আনামের এ গোল্ডেন এজ। তুই তো বই চাপা পড়ে মরবি রে মিথি। মিথি গর্বভরে হাসে। এই নিয়েই তো আছি রে বন্ধু। বই ছাড়া তো আর কিছু নেই। জানিস, একই কথা সজলভাইও বললো, বলে কী, তুমি তো ভূমিকম্প হলে বইয়ের নিচে চাপা পড়ে মরবে। তার মানে মিথি সজলের সঙ্গে ডেট করে নিজের বাসায়? মিথি তার দিকে তাকায়, বলে, না রে তেমন কিছু না। একদিন এগিয়ে দিতে এসেছিল। বাসার নিচ থেকে ঘুরে যাবে ভেবে বললাম, ওপরে আসেন। অন্তত এক কাপ চা। বলে, শুধু চা? আমি বললাম শুধুই চা। বিলিভ মি, নট মোর দ্যান টি। কিন্তু বন্ধু প্রোমিজ কর, ভুলেও তুই এটা শায়লার সঙ্গে শেয়ার করবি না। শায়লাটা খুব সন্দেহ করে বুঝলি। সজলকে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। নিজে তো পুরা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কতদিনের বন্ধু, কিন্তু ও যে এই রকম তা কি বুঝতে পেরেছিলাম কখনও? সজল কতজনের সঙ্গে কত কিছু করছে এইটা ভেবে ভেবেই নাকি সে একেকজনের সঙ্গে ডেট করে বেড়ায়। প্রতিশোধ নেয়, বুঝলি কী রকম হাস্যকর মেয়ে? আচ্ছা বল, কী খাবি? খিচুড়ি না ভাত? না চল বরং বাইরেই খাই। তুই বসে বসে বই ওল্টা, গানও ছাড়তে পারিস। আমি দু কাপ কফি করে আনি। মাত্র নাস্তা করলাম। এখনও দিনের প্রথম সিগারেট খাই নাই।

মিথি রান্না ঘরে গেলে বালিশে হেলান দেয় আন্না। একা একটা বাসায় কীভাবে থাকে মেয়েটা? বইগুলোতে একগাদা ধূলা। ছাদে মাকড়সার ঝুল, মেঝেটা কোনো রকমে পরিষ্কার করা। ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিনগুলো একদিকে ¯তূপ করে রাখা। পরিচিত একটা মলাট দেখে একটা ম্যাগাজিন টান দেয়। রাজীবের লেখা আছে ওটাতে। পুুরনো, একেবারে ছন্নছাড়া অবস্থা। একটা কবিতা লিখেছিল রাজীব। লাইনগুলো এখনও মনে করতে পারে। সারা দুুপুর। দুুটি শব্দের ভেতর মোহমুগ্ধের মতো বসে থাকি। ভুল হয়ে থাকি। রাখি হাত তোমার হাতে…। আন্নাকে নিয়ে লেখা। কী দারুণ সব দিন। মনে করে যদি পুরো একটা সন্ধ্যা কাঁদা যায় তবু ভাল। চাইলে কি মিথি ওকে ম্যাগাজিনটা দেবে?

আরে দোস্ত, এত কিছু থাকতে পুুরানা ম্যাগাজিনে কী পড়ো? কফি এগিয়ে দেয় মিথি। বেনসনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায়, তার দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে ইশারা করে। খাবা না? তোমরা গৃহিণী নারী, সিগারেট খাবা কেন? কী পড়িস দেখি? আচ্ছা, রাজীবের কবিতা? ফাইন। গল্প কেমন লিখতো জানি না। কিন্তু কবিতা কিন্তু ভালই লিখতো লোকটা। জানিস তো, একা রাজীবদা নয়, এদের পুরো জেনারেশনটাই এরকম হয়ে গেছে। কারো একটা বই, কারো একদম নেই। কেউ ব্যাংকে কাজ করে। কেউ বিদেশ চলে গেছে। কেউ নেশা ধরেছে। কেউ আর লেখেই না। কিন্তু যদি প্রস্তুতির কথা বলিস, যদি সামর্থের কথা বলিস তবে কিন্তু ওদের মতো আর কেউ ছিল না। কিন্তু কি জানিস বন্ধু, ওইরকম হলেও হয় না। প্রস্তুতি তো আমারও কম না। পড়াশোনা করা বা জীবন দেখা কোনোটাই তো বাকি নেই। কিন্তু লেখালেখি ব্যাপারটা অসীম ধৈর্যের ব্যাপার। দিনের পর দিন বোরিং একটা কাজ করে যাওয়া। ভাবতে পারিস? তার জন্য জীবনটাকে বরবাদ করে ফেলা। তুইও পারতি না। এই প্রাকটিসে আসিস নি ভালই করেছিস একদিক দিয়ে।

রাজীব একদমই লেখে না, না রে?

একদিন দেখা হয়েছিল। কোন বন্ধুর সঙ্গে নাকি দেখা করতে এসেছিল আজিজ মার্কেটে। বলে মিথিলা প্রথম আলোতে তোমার গল্পটা পড়লাম। ভাল লিখেছো। তুমি বাক্য গঠন নিয়ে এতটা সচেতন তা কিন্তু এই গল্পটা পড়ার আগে ধরতে পারিনি। সামনের মেলায় কয়টা বই আসছে? এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে চা খেলাম। গল্প করলাম। বললো, লেখালেখির কথা আর ভাবে না। জীবনে নাকি আর কোনো দাহ নাই। লেখার জন্য নাকি কষ্টগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়। বলে, এমন একটা জীবন হয়েছে আমার, সব ঠিক আছে কি না সেটা দেখার সময়ও আর নেই। কোনো কিছু লিখে ফেলা তো দূরের কথা। আর হবে না। বুঝলা, আর হবে না।

দুপুরে রেস্টুরেন্টে খেয়ে রিকশায় করে ফাঁকা শহরে ঘুরলো দুজন। মিথিলার কথা চলছে। আন্না চুপ। কখনো শুনছে কখনো শুনছে না। ভাবছে। অবাক হচ্ছে নিজের কথা ভেবে। বাচ্চা, স্বামী-সংসার নিয়ে কোনো টেনশন হচ্ছে না। শায়লা আর মিথির মতো হয়তো একদিন তার সাথেও রাস্তায় কি বাজারে রাজীবের দেখা হয়ে যাবে। এরকমই কোনো কথা হবে। বলবে, আর হবে না বুঝলা। এইভাবে হয় না।

মিথির কথা শুনতে শুনতে শায়লার কথা মনে পড়ে তার। শায়লা পা দিয়ে তার পায়ে একটা টোকা মেরে বলেছিল, বুঝলা ডিয়ার, যার হয় তার এমনেই হয়। আমারে দেখতেছো না? কিছু তো হইছে, না কি? টেক এ ব্রেক বাডি। লাইফে একটা টুইস্ট আনো।

তাতেই বা কী হয়?

মিথির কথা শুনতে শুনতে নিজে থেকেই বলে আন্না।

মিথি হঠাৎ সচকিত হয়ে যায়। কিছু বললি?

নাহ কই? তুই বল, আমি শুনছি। হ্যাঁ, তারপর কী হলো?

সেপ্টেম্বর ২০০৭
===============================

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহবুব মোর্শেদ


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.