গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর

প্রীতের সকাল
প্রীত সক্কাল বেলা উঠে মাকে খুঁজতে থাকে, ভীষণ হিসি পেয়েছে। চাইলে মেঝেতে শোয়া মজনুকে ডেকে তোলা যায়, আবার নিজেই কাজটা করবার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু বিছানা থেকে বাথরুম পর্যন্ত শরীরটা টেনে নিয়ে যাবার কথা ভাবতেই, ভয় ধরে যায় ওর মনে। নিজে গিয়ে হিসি করবার সম্ভাবনা ভাবতে ভাবতে আজো সে বিছানা ভেজায়। ভেজা কাপড়ে, ভেজা বিছানায় আর একবার ঘুম দিলে গা কুটকুট করতে থাকে। ফলে প্রীত প্যান্ট খুলে বিছানার শুকনো জায়গাটাতে খানিক গড়ায়। ভারমুক্তির প্রশান্তিতে তার বিশ বছরের ঢ্যাঙা শরীরটাকে ভাঁজ করে ‘দ’ হয়ে ঘুমায়।

মজনুর সকাল

মজনুর ঘুম ভাঙতেই বিটকেলে গন্ধটা নাকে আসে। এতোগুলো চাদর, কাঁথা, প্রীতের কাপড় ধোয়ার কথা মনে করতে মেজাজটা খিঁচড়ে যায়, তার ওপরে খালাম্মার গালমন্দ তো আছেই। রোজ মজনু ভাবে আর মেজাজ খারাপ করবে না, অন্তত সকাল বেলাটাতে না। চাকরিটা জেনেশুনেই নিয়েছে সে, বেতনও ভাল। কাজও অনেক না, প্রীতের সঙ্গে থাকা, ওর খেদমত করা। প্রীতের খেদমতও তেমন করতে হয় না, ও মোটামুটি নিজের কাজ নিজেই করতে চেষ্টা করে। সমস্যা একটাই, মাঝে-মধ্যে প্রীত বিছানা ভেজায়। আর ঐ গন্ধটা নাকে যাওয়া মাত্র মজনুর মেজাজ খিঁচড়ে যায়।
 
খালাম্মা আসার আগেই মজনু প্রীতের বিছানা বদলাবার উদ্যোগ নেয়। একবার মনে হয় হেচ্কা টানে প্রীতকে ওঠায়। কিন্তু প্রীতের ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে ভীষণ মায়া হয় মজনুর। গায়ে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে থাকে প্রীতকে।

“ও প্রীত ভাইয়া ওঠ। জলদি ওঠ। ”

“হুঁ।” প্রীত ঘুমের মধ্যে সাড়া দেয়।

“হুঁ না এহনি ওঠ। খালাম্মা আসলো বুইলে।” মজনু একটু অধৈর্য হয়ে পড়ে, গলা চড়ায় সে।

“হুঁ।” প্রীতও নাছোড়বান্দা, মজনুর তারস্বরে চিৎকারের মধ্যেও সে ঘুমাতে থাকে।

“হুঁ হুঁ কইরে না। খালাম্মা আসলি কিন্তু তোমারে আমারে দুইজনরেই ভাঙ্গবেয়ানে। তখন কিন্তু কতি পারবানা মজনু আমারে বুলাসনি ক্যান?” গম্ভির হয়ে মজনু তার শেষ অস্ত্র চালায়।

মজনুর শেষ চেষ্টায় কাজ হয়। প্রীত ধড়মড় করে ওঠে। “মা, মা কৈ?” খানিক বিব্রত হয়ে প্রীত নিজের উদোম শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“আম্মা রেডী হয়ে আসতিছে। আর লজ্জা পাতি হবে না, আইজকেরাও বিছনা ভিজাইছ। এখন গোসল কইরে রেডী না হতি পারলি, ইস্কুলেও জাতি পারবানা কয়ে দেলাম।” মজনু গজগজ করতে করতে বিছানার চাদর, প্রীতের কাপড় জড়ো করে বালতিতে ভেজায়। প্রীত খানিকটা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠলে ওকেও ধরে নিয়ে সাওয়ারের তলে দাঁড় করিয়ে দেয়। গোসলটা প্রীত নিজেই সারে, মজনু পিঠ ঘসাতে হাত লাগায়।

প্রীতের স্কুল ছুটির দিনগুলো বাদে, মজনু আর প্রীতের দিন রোজ প্রায় একই ভাবে শুরু হয়। মজনু আর প্রীতের বয়স প্রায় সমান, বরং মজনু প্রীতের চাইতে বয়সে খানিক বড়ই হবে। তবুও মনিব-পুত্র বলেই প্রীতকে ভাইয়া ডাকতে হয়। যদিও মনিব কামরুল, অর্থাৎ প্রীতের পিতা সম্পর্কে মজনুর চাচা হয়। কামরুলের বাবা আর মজনুর দাদা চাচাতো ভাই। ফলে একই ভিটায় শরিক-ঘর হিসেবে মেলা দিনের বসবাস। শরিক হলেও মজনুর দাদার আমল থেকেই ওদের অবস্থা পড়তির দিকে। পুরা সরদার বাড়ির নাম ডুবিয়ে মজনুর দাদা তিন ধাক্কায় ক্লাস টু পার করেন। বিদ্যাদেবীর সঙ্গে সেযাত্রা রফা করে দাদাজি পড়ালেখার ইতি টানেন। ফলে জমি-জিরাতের পাশাপাশি পড়াশুনার কারণে যে উপরি আয় হতে পারত সে রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলতঃ ভাগের সামান্য জমি দিয়ে তাঁর দিন গুজরান্ চলে। মজনুর বাপ-চাচারা তাঁদের বাপজানের নাম রওশন করেছেন - ধরে বেধেও তাদের স্কুলমুখো করা যায়নি। বাপ মরবার পরে ভাগ-বাটোয়ারায় জমিজিরাত যা ছিল সেটুকুও ধরে রাখতে পারেননি। শরিকি ভিটা ছাড়া তাদের কিছুই ছিল না। লজ্জার মাথা খেয়ে অন্য শরিকদের জমিতে পাইট দেয়া ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা ছিল না। মজনুর বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে আয়ের সে রাস্তাটাও বন্ধ হয়।

সেবার কামরুলের স্ত্রী সাহানা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে মজনুর কথা জানতে পারে। দয়াপরবশ হয়ে মজনুুকে সাথে করে ঢাকা নিয়ে আসে সে। সাহানা মজনুকে লিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করবে বলে মজনুর মাকে কথা দিয়ে আসে। সাহানার এহেন মহানুভবতায় ধন্য ধন্য পড়ে যায় চারদিকে, কামরুলের মাথাটাও উচা হয়। শরিক ঘর পেরিয়ে মহানুভবতার সেই বার্তা গ্রামবাসীর কান অব্দি পৌঁছে যায়। ফলে বার্তার সত্যতা যাচাই, তো স্ব স্ব মত প্রকাশের জন্য কয়েক জন মজনুদের ঘরে হাজির হয়। বেশির ভাগের মতে মজনুর বাপ মরাতে বরং ভালো হয়েছে, কারণ মজনুর বাপ শত চেষ্টা করলেও ওকে কামরুলদের মতো সাচ্ছন্দ্য দিতে পারত না, ফলে মজনুর মার খুশি থাকা উচিত। মজনুর মা খুশি হোক বা না হোক রাজি সে হয়েই ছিল। মানুষের লম্বা কথায় সে কখনই অনেক ভরসা পায় নাই। ফলে পড়া-লেখা হোক বা না হোক ছেলে না খেয়ে যে মরবে না সেটা নিশ্চিত জেনে সে চুপচাপ থাকে।

সাহানা-কামরুলের সংসার
প্রীত গোসল করে নিজের কাপড় নিজেই পরতে চেষ্টা করে। মজনু জামার বোতাম ঠিকঠাক লাগিয়ে প্রীতের চুল আঁচড়ে দেয়। মজনু প্রীতকে গুছিয়ে দিতে দিতে সাহানা ঘরে ঢোকে। “হাউ ইজ মাই বেবি টুডে? আর ইউ রেডি ফর দি স্কুল?” সাহানা প্রাথমিক খোঁজ-খবর নেবার পরে ওর নাকেও বিটকেলে গন্ধটা লাগে। মজনুকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। বরং একদম ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকে। “মজনুরে আজ যে আমার জরুরি দুটো মিটিং পড়ে গেছে সকালে, তুই বাবা একটু সামলে নিতে পারবি না প্রীতের স্কুল?” “কাকী আপনার তো কাজ লাইগেই থাকে, আমিতো সামলাই আমার মতো, ভাইয়া ফিট না খালিতো কোন সমস্যাই নেই।” মজনু খানিকটা একঘেয়ে সুরে কথাগুলো বলতে থাকে আর প্রীতের ব্যাগ গোছাতে থাকে।

সাহানা গাড়ি বের করতে করতে আড়চোখে মজনু আর প্রীতকে পেছনের সিটে দেখে নেয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে, একই সঙ্গে উন্মনা দেখায় ওকে। মনের কোথাও একটা দুশ্চিন্তা পাঁক খেতে থাকে - মজনু বা সাহানার পরে প্রীতের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

কামরুল সেদিন একটু আগেই বাড়ি ফিরেছিল প্রীত, সাহানা আর মজনুকে নিয়ে বাইরে বেরুবে বলে। ওরা প্রায় তৈরি হয়েই ছিল, তবে সাহানাকে অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি ক্লান্ত আর ম্লান দেখাচ্ছিল। শেষবারের মতো সাহানা নিজেকে দেখে নিচ্ছিল আয়নায়, কামরুল বিছানায় আধসোয়া হয়ে ঘোরলাগা চোখে ওঁকে দেখছিল। সাহানা যখন ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে তৈরি কামরুল তখন ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে আলতো চুমু খায়। সাহানার এতে কোন ভাবান্তর হয় না। কামরুল খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ে সাহানার নির্লিপ্ত চেহারায়, অথচ কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। প্রীত, মজনুসহ সাহানা আর কামরুল বেরোয়।

পিজ্জাহাটে ঢোকামাত্রই একঝাঁক কৌতূহলী দর্শকের চোখ প্রীতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। দর্শককূলের দৃষ্টিতে সাহানা-কামরুল দম্পতি নতুন করে আর আজকাল বিব্রত হয় না। কিন্তু প্রীতকে নিয়ে লোকজনের অতি কৌতূহলে মজনু বিরক্ত হয়। প্রীত যে আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক তা প্রমানের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে মজনু। খাবার অর্ডার করতে করতে অধীর হয়ে ওঠে প্রীত। মজনু বুদ্ধিমানের মতো ওকে রেস্তোরাঁর বাইরে বাঁশিওয়ালার কাছে নিয়ে যায়। কামরুল সাহানাকে একলা পেয়ে আলাপ শুরু করে।

“কিহে মহারানী উদাস দেখায় যে?” হালকা স্বরে কামরুল শুরু করে খুঁনসুটি। সাহানা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ায়। কামরুল সাহানার এই দশা খুব ভালো করে চেনে। গাঢ় কোন বিষাদময় ভাবনাকালেই কেবল ওকে এমন সমাহিত দেখাতে পারে। কামরুল পরম মমতায় সাহানার হাতদুটো ধরে, চোখে চোখ রাখে।

সাহানাকে আরো বিষন্ন দেখায়। আপনমনে ও বলতে থাকে, “জানো কামরুল আমার না ইদানিং প্রীতের স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে না। কোন ইমপ্রুভমেন্ট নাই Ñএকই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না।”

কামরুল কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে বলে বসে, “সমস্যা নেই কোন, আমি প্রীতকে স্কুলে দিয়ে আসবো না হয়। ”

সাহানা খানিক চোখ কুঁচকে কামরুলকে দেখে নেয়। আরো শান্ত গলায় বলতে থাকে, “আমি রোজকার কথা বলছি না কামরুল, আমার প্রীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসলে অসহায় লাগে। ও রোজকার কাজ নিজে করতে চেষ্টা করে প্রাণপণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনো ও রাতে বিছানা ভেজায়, মজনু বা আমরা কেউ পাশে না থাকলে অজ্ঞান হয়ে নিয়মিত হাত-পা কাটে, কারো উপর রাগ করলে বেহুশ হয়ে মারতে থাকে।”

“আমি মানি তা, কিন্তু সাধ্যমতো দেশে, দেশের বাইরে আমরা ওর চিকিৎসা করিয়েছি। ষোলটা বছর, ষোলটা বছর পরীক্ষার পরে আমরা জানতে পেরেছি ওটা ওর ক্রোমজমাল ক্রুটি, যেটা সারানোই সম্ভব না। সানু প্রীতের অযতœ হতে পারে দেখে আমরা আর কোন সন্তান পর্যন্ত নেইনি। আর কী করতে পারতাম আমরা?” কামরুলকেও ক্লান্ত দেখায় এবার।

“হুঁ, আসলে আমি মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সোনা। প্রীত কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো ওর প্রতি টানের সঙ্গে ইদানীং মনে হয় আমি বা আমরা ওকে করুণাও করছি। ”

“সানু তোমার মাথা তো ঠিক আছে? করুণা করছি মানেটা কি? ওর আমাদেরকে প্রয়োজন আর আমরা তাই ওর সঙ্গে ছায়ার মতো আছি।”

“Exactly, listen to yourself darling. Preet needs us or we needed him that’s why we brought him to this world? দেখ ভাষ্যগুলো কীভাবে বদলায়। এই বদলগুলোকেই আমি করুণা বলছিলাম। ”

ওয়েটার খাবার টেবিলে দিতে দিতেই প্রীত আর মজনু হাজির। মজনু আর প্রীতের স্যুপ বেশ পছন্দ। ওরা দুজনেই হুড়মুড় করে ওটার উপর পড়ে। মজনু যতœ করে প্রীতের ন্যাপকিন গলায় গুঁজে দেয়, আর নিজের জিভ পুড়িয়ে প্রীতকে সতর্ক করে। “ভাইয়া স্যুপ কিন্তু গরম কলাম। তোমার জিভ পোড়বেয়ানে, ফুঁ দিয়ে দিয়ে খাও।” ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাহানা আর কামরুলের খানিক মুড বদল হয়, দুজনেই হাসতে থাকে।

পরদিন সকালে ছুটির দিন বলেই সাহানা ছাদে নাস্তার বন্দোবস্ত করে। কামরুল আর সাহানার ভীষণ প্রিয় বাড়ির এ অংশটা। সাহানা পৈতৃক সূত্রে গুলশানে এই জমিটুকু পায়। সাহানা আর কামরুল দীর্ঘদিন দেশের বাইরে স্থপতি হিসেবে কাজ করে দেশে ফিরতেই চেয়েছিল। প্রীতের চিকিৎসার কারণে কিছু দিন অপেক্ষা করে ওরা। কোন রকম আশার আলো দেখতে না পেয়ে সাহানা দেশে ফেরবার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকাপোক্ত দেশে আসবার আগে কামরুল আর সাহানা এই বাড়ি বানিয়েছে, ডিজাইন থেকে নির্মাণ তদারকি সকল কিছু ওরা পালাক্রমে সামলেছে - দু’জায়গায় দু’সংসারও। এই একতলা বাড়িতে সবকিছু ডিজাইন করা হয়েছে প্রীতের কথা ভেবে, এমনকি বাগান আর সুইমিংপুলটাও।

সম্বন্ধ

ছুটির দিন বলেই সাহানা ছাদে নাস্তার বন্দোবস্ত করে। কামরুল আর সাহানার ভীষণ প্রিয় বাড়ির এ অংশটা। সাহানা পৈত্রিক সূত্রে গুলশানে এই জমিটুকু পায়। সাহানা আর কামরুল দীর্ঘদিন দেশের বাইরে স্থপতি হিসেবে কাজ করে দেশে ফিরতেই চেয়েছিল। প্রীতের চিকিৎসার কারণে কিছু দিন অপেক্ষা করে ওরা। কোন রকম আশার আলো দেখতে না পেয়ে সাহানা দেশে ফিরবার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকাপোক্ত দেশে আসবার আগে কামরুল আর সাহানা এই বাড়ি বানিয়েছে , ডিজাইন থেকে নির্মাণ তদারকি সকল কিছু ওরা পালাক্রমে সামলেছে - দু’জায়গায় দু’সংসারও। এই একতলা বাড়িতে সবকিছু ডিজাইন করা হয়েছে প্রীতের কথা ভেবে, এমনকি বাগান আর সুইমিংপুলটাও।

খাবার পরে মজনু আর প্রীত বাগানে ঘুরতে থাকে। কামরুল পেপার পড়তে পড়তে সাহানাকে ওর বড় ননদের খবর জানায়। “বড় বুজি তোমাকে ফোন করতে বলেছে।”

সাহানা প্রীতের দিকে তাকিয়ে ছিল, “আচ্ছা” বলে সেদিকেই চেয়ে থাকে।

“বুজি আজকাল ঘন ঘন ফোন করছে, খুবই সন্দেহজনক। আবার কার পরোপকারে নেমেছেন?”

“প্রীতের।”

“মানে?”

“মানে বুজি প্রীতের জন্য মেয়ে দেখেছেন। ওদের অবস্থা ভয়াবহ। একে তো বাবা-মা বাচ্চাগুলোকে খেতে দিতে পারে না, তার পরে এই মেয়েকে সমানে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করছে। মেয়ের বাবা-মা সব জেনেশুনেই রাজি হয়েছেন। ”

“রাজি হয়েছে মানেটা কি? তুমি বুজির কথা শুনে চুপচাপ থাকলে?”

“আমি ভাবছি।”

“তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? ভাবছ মানেটা কী?”

“ভাবছি মেয়েটাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।” সাহানা এক দৃষ্টিতে প্রীতের দিকে চেয়ে থাকে।

মনোয়ারা
মনোয়ারা এ বাড়িতে ওর পদমর্যাদা নিয়ে খানিকটা বিচলিত। অথচ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার কথাও ভাবতে পারছে না। বাড়ি থেকে সবাই বলেছে ওর বিয়ে দেয়া হয়েছে। ওর নিজের কাপড়, গয়না দেখেও নিজের মনে হয়েছে বিয়েই হয়েছে। মজনু ওকে সবার সামনে ‘মনু আপা’ ডাকলেও, আড়ালে ভাবি বলে খেপায়। কিন্তু সানু মামানি কোন রকম শাশুড়ির মতো আচরণ করছেন না। মনোয়ারাকে প্রীতের সঙ্গেও থাকতে হচ্ছে না। মনোয়ারা এই প্রথম নিজের কামরায়, নিজের বিছানায় অসংখ্য নরম পুতুলের মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে রাজ্যের কথা ভাবতে থাকে। ভাবনায় সানু মামানি, প্রীতের বাবা, প্রীত, মজনু, বেলতলি গ্রাম, বেলতলি স্কুল, মা, আব্বা, ভাই নশু, বোন মশু, খালেদা, কুঁজোবুড়ি আসা-যাওয়া করে - নরম খাটে নাক ডেকে ঘুমায় ও।

গালে হাতের স্পর্শ পেয়ে ধড়মড় করে ওঠে মনোয়ারা। খাটের পাশে প্রীতকে দেখে চমকে ওঠে ও। প্রীতও মনোয়ারাকে জাগতে দেখে খানিক ইতস্তত বোধ করে। মনোয়ারাকে ছুঁয়ে দেখলেও জাগাতে একেবারেই চায়নি ও। মনোয়ারার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় প্রীত, “আমি প্রীত, খেলবে আমার সাথে?” মনোয়ারা হাতটা ধরতেও ভুলে যায়, ভ্যালভ্যালে চোখে তাকিয়ে থাকে।

“প্রীত বাবা কতোবার বলেছি কারো ঘরে ঢুকতে হলে নক করতে হয়। সরি মামনি প্রীত তোমাকে জাগিয়ে দিয়েছে।” সাহানা বিব্রত স্বরে কথাগুলো বলতে থাকে।

“মা আমি নক্ করেছি। ওর দরজা খোলা ছিল তাও নক করেছি।” প্রীত কাতর স্বরে ওর মাকে বোঝাতে থাকে। মনোয়ারা মা-ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।

কিছুদিনের মধ্যেই মনোয়ারা নিজের আগ্রহে এবং সাহানার উদ্যোগে বাড়ির কেতা তথা ভদ্দরলোকেদের ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলে। সাহানা ওকে নিজে ক’দিন পড়িয়ে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়ে দেয়। পড়া, তো নতুন বন্ধুরা, সাহানা-কামরুলের স্নেহ, বাড়ির বাতাবরনে ক্রমশ বুঁদ হতে থাকে মনোয়ারা ওরফে মনু। প্রীতের সঙ্গে খেলে সময় পেলে, মজনুর সাথে সাথে ওর দেখভাল করে। মজনুর সঙ্গে ওর ভীষণ ভাব - বাড়ির কথা মনে হলে ওর সঙ্গে গপ্পো করে। কিন্তু মজনুর স্বরে আজকাল কিছু ভাজ থাকে, সেটা টের পায় মনোয়ারা।

প্রেম - প্রীত, মনোয়ারা আর মজনু
সেদিনকার কথাই ধরা যাক, প্রীতকে গোসল দিতে দিতে মজনু বলছিল, “আমার চাকরির দিন তো শেষ হইয়ে আসল বুইলে, তোমার ভাতার তুমি এহন থেইকে সামলাও। আমি কিডা এসবের মধ্যি।” তো আরেকদিন ঠাট্টা করেই বলল, “ভাবি এরেই কয় কপাল। তুমি আমি দুইজনেই কপালপোড়া। দুইজনেই বেলতলির। আমাগে মিল কিন্তু ম্যালা। দুই জনরেই কিন্তুক ম্যালা আশা দিয়ে আনিছে কাকা, কাকী। কও কিসের জন্যি?” মনোয়ারা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে, “কিসের জন্য?” মজনু মনোয়ারার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়, “কিসের জন্যি আবার, প্রীত ভাইয়ার খেদমতের জন্যি।” মনোয়ারা সেটা শুনে হাসে। “তয় অমিল আমাগের আছে। দেখ ভাবিজান তুমি বিয়েটা কইরে এক ধাক্কায় মইয়ের আগায় - আমার মনিব। আর আমারে সাপে কাটতি কাটতি শেষ কইরে দেল - মুতের কাথা ধুতি ধুতি জীবন যাবে। কপাল খারাপ না হলি নাইলে মনোয়ারা বেগম তোমার মতো কাউরে বিয়ে করতাম।” কথাটা বলে মজনু দ্রুত বেরিয়ে যায়। মনোয়ারা মজনুর কথায় হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে।

প্রীতের ইদানীং স্কুলে আর ভালো লাগে না। ওর বরং মনুর সঙ্গে থাকতে বেশী ভাল লাগে। প্রীত ক্লাসে ছবি আঁকা আর কাঠের কাজ শিখেছে। তো ক্লাসে ইদানীং সে কাঠের পুতুল বানাতে চেষ্টা করে। ওর মনযোগ দেখে শেফালী মিস জিজ্ঞেস করেই বসে, “কী বানাচ্ছো প্রীত?” প্রীত কাজ করতে করতেই উত্তর দেয়, “মনুর জন্য পুতুল বানাই। ”

প্রীত পুতুল বানানো শেষ হলে বাড়ি ফিরে মনোয়ারাকে দেয় সেটা। পুতুলটা ভীষণ পছন্দ হয় মনোয়ারার। মনোয়ারার খুশি দেখে প্রীতের চোখ ছল্ছল্ করে। ও দ্বিগুণ খুশিতে মনোয়ারাকে শক্ত করে জাপটে ধরে চুমু খায়। মনোয়ারার হতচকিত লাগে। প্রীত খুশিতে মনোয়ারার সারা গালে, চোখের পাতায়, নাকে চুমু খায়। বেখেয়ালে মনোয়ারার ঠোঁটেও চুমু দেয় ও। প্রীতের এবার পাগলপারা লাগতে থাকে - চুমু প্রলম্বিত হয় - আরো শক্ত করে মনোয়ারাকে জড়িয়ে ধরে প্রীত। মনোয়ারার হাঁসফাস লাগে - দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। ও আর্তচিৎকার দেয়, “মামানি!” চিৎকার শুনে ভয়ে প্রীত মনোয়ারার কাঁধে কামড় বসায়।

মনোয়ারার চিৎকার শুনে ছুটে আসে সাহানা। মনোয়ারার ত্রস্ত চেহারা, কাঁধে নীলচে দাগ, অবিন্যস্ত বেশ দেখে সাহানা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সাহানার বুকে ওর আদরের মনু কাঁপতে থাকে, কাঁদতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রীত বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। এই প্রথমবার প্রীতের মাকে এমনকি মনুকেও অনেক দূরের মানুষ মনে হতে থাকে। ও কাঁপতে থাকে - কামনায়, প্রত্যাখ্যানে, বিস্ময়ে , বিমূঢ়তায়, হতাশায় - সবার অলক্ষে। ওর চোখের কোনায় কান্না জমতে থাকে - মা আর মনুর চেহারা অস্পষ্ট হতে থাকে। ওর পাকস্থলী উলটে আসতে চায় - প্রীত জ্ঞান হারায়, ঠোঁটের কোনা দিয়ে গাদ বেরোতে থাকে।

প্রীতকে ঐ ঘটনার পরে প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়। হুইল চেয়ারে করে বাড়ি ফেরে ও। ডাক্তারের মতে ট্রমায় প্রীতের একাংশ প্যারালাইজ হয়ে গেছে। কথাও বলে খুব কম। সাহানা প্রীতের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করে, ভিতরে পুড়তে থাকে। কামরুল সেটাও করতে পারে না, গৌতমের নির্লিপ্তি নিয়ে অবিচল থাকতে চেষ্টা করে। মজনু এক মনে প্রীতের সেবা করে যায়। মনোয়ারা পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করে। প্রীতের জন্য ভীষণ টান লাগে ওর, ভার লাগে। কেন লাগে তার কূল-কিনারা করে উঠতে পারে না। আবার ভীষণ ভয় লাগে কাছে যেতে। সারা বাড়িজুড়ে গাঢ় বিষাদ আর নিশ্চুপতা ভর করেছে। এতোগুলো মানুষ যার যার মতো নিজ নিজ ভার সমেত বাক্সবন্দি হয়ে আছে - সান্ত্বনা দেবার কেউ নাই, আসলে ভেবে দেখলে সান্ত্বনা পাবারো কিছু বাকি নাই।

প্রীতের দেখভালের জন্য সাহানা কাজ বাড়ি বসেই করে। প্রীতের খাওয়া-দাওয়া, পায়খানা-পেচ্ছাব সবই সাহানা আর মজনু সাপেক্ষে। মনোয়ারা প্রায়ই ওদের কাজে হাত লাগায়। প্রীতের সেটা ভাল লাগে না কিন্তু বলতেও পারে না কিছু। মনোয়ারা আর মজনু প্রীতের কারণেই আরো ঘনিষ্ঠ হয়। প্রীতের প্রতি ওদের টান, বন্ধুহীনতা ওদের একই সমতটে নিয়ে আসে। প্রীতকে বিকেলে দুজনে বাগানে ঘোরাতে নিয়ে যায়, কখনো বা পুলের ধারে বসে ওরা গল্প করে, তিনটিতে মিলে আকাশ দেখে। প্রীতের ওদের দুজনকে পাশে দেখতে ভাল লাগে।

সেদিন প্রীতের খানিক জ্বর এসেছিল। সারাদিন সেবা করে ক্লান্ত হয়ে সাহানা ঘুমিয়ে পড়ে। মজনু ক্লান্ত থাকায় মনোয়ারা রাতে প্রীতকে দেখভালের দায়িত্ব নেয়। ঘুমন্ত প্রীতের চুলে, কপালে, গালে এই প্রথম মনোয়ারা হাত বুলায়। ঘুমের মধ্যেই মনোয়ারার হাতটা বুকে নিয়ে পরম প্রশান্তিতে ঘুমায় প্রীত। মাঝরাতে প্রীতের ভীষণ পানির তেষ্টা পায়। মজনুকে ডাকতে যাবে এমন সময়ে খসখস আওয়াজ কানে আসে প্রীতের, আর আধো আধো কথা। মেঝেতে তাকাতেই ডিমলাইটের আলোতে কিছূ নড়তে দেখে। মেঝেতে মনু শোয়া। ওর চোখ আধবোজা, আর ভীষণ সুন্দর করে হাসছে, ওর ওপরে মজনুর নগ্ন শরীর। তেমন কিছু বুঝতে পারে না প্রীত, কিন্তু ভীষণ আজব লাগে ওর। একবার ওর মনে হয় মনু কষ্ট পাচ্ছে, ওদের ডাক দিক। কিন্তু পরক্ষণে মনুর হাসির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পাগল পাগল লাগতে থাকে - সেই পুরানো কামনা, প্রত্যাখ্যান সাপের মতো পেচিয়ে ধরে প্রীতকে। ভীষণ অভিমানে ঘুমিয়ে পড়ে ও, চোখের কোনে দু’ফোঁটা কান্না লেগে থাকে।

সায়াহ্নে প্রীতের আরেক সকাল
আজ প্রাণ ভরে সূর্যের আলো গায়ে মাখবার দিন। ভীষণ চনমনে রোদে প্রীতের নাচতে ইচ্ছা করে। ওর ভীষণ ইচ্ছে করে পুলের স্বচ্ছ নীল আর নীল আকাশকে এক করে দিয়ে, সেই অসীম নীলে ভাসতেই থাকে - মাছের মতো আবার পাখির মতো। এই প্রথম ও মাছ হতে হতে ঝাপ দেয়, তারপর পাখির মতো উড়াল দেয়। উড়তে উড়তে ও বাড়ির বাগান দেখতে পায়, মা, বাবা, মনু, মজনুকে খুব ছোট দেখায়। ও আরো দূরে যেতে চায়, আরো দূরে। উড়তেই থাকে প্রীত আজ - সাত আসমান পার করে ওর জিরোতে ইচ্ছা করে - এবার ও তারা হয় - প্রীত পরায়া।
=============================


bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ সিউতি সবুর


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.