গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা
দিলশাদ নিজে থেকেই বারবার আপত্তি করে। বলে, শালা নেই শালি নেই তো কোন মজাও নেই। কী হবে আমার বাপের বাড়ি গিয়ে? গিয়েও তো সেই আমাকেই দেখবে। তাছাড়া আমার এই ভরন্ত চারকোণ ছাড়া কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাই না।
সেজানও বোঝে। দেড় বছরের কিছু বেশী হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। দিলশাদের প্রেমে ভান নেই, সংসারে অমনোযোগ নেই, নিজেকে সাজাতে ক্লান্তি নেই, নিত্যনতুন রান্নায় গবেষণার শেষ নেই, সেজানের লেখা পড়তে উৎসাহের কমতি নেই, বিছানায় বিন্দুমাত্র অসহযোগিতা নেই, সেজানকে বুঝতেও তার কিছু বাকি নেই। কারণ দিলশাদ জানে লেখক সেজানকে কতখানি ছাড় দিলে তার টেবিল থেকে ভালো ফসল তোলা সম্ভব।
সেজান বলতে গেলে ঢাকারই ছেলে। ওর বাবা ঢাকায় স্থায়ী হয়েছিলেন ওর জন্মের অনেক আগে। গ্রামের সাথে সেজানের নাড়ির সম্পর্ক নেই। ঈদ বা লম্বা ছুটিতে মানুষজন গ্রামে দৌড়ায়। সেজান ঢাকার নির্জনতা উপভোগ করে। ফুলার রোডের সুনসান রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে চপ্পল পরে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে থাকে। ওর হাঁটার গন্তব্যহীন ভঙ্গী দেখে দু’একটা খালি রিকশা ‘যাইবেননি স্যার’ বলার কোন তাগিদ অনুভব করে না। খাবারহীন ডাস্টবিনে বসে কাকেরা ঠোঁটে শান দেয়। বৃটিশ কাউন্সিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় হাঁটার গতি শ্লথ করে গেটের নামফলকের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসে। কিছুদিন আগেও লেখা ছিল ‘দি বৃটিশ কাউন্সিল।’ এখন কেবল ‘বৃটিশ কাউন্সিল।’ যাক্ এতদিনে বোধোদয় হয়েছে। ঢাকার এই নাগরিক জীবন ছাড়া লেখক সেজানের ভান্ডারে গ্রাম নেই, মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত নেই, মাটির ঘরের পাশে দাঁড়ানো দাঁতে ঘোমটা কাটা লাজুক বউটি নেই, ন্যাংটো ছেলেদের মুহূর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়া নদী নেই। তবে কোকিল আছে। বসন্ত আসার আগেই ওরা সেজানের বাসার পাশের বন্ধ্যা আমগাছে এসে বসে। ডাকে। ইদানিং দিলশাদ বলে, ‘ঢাকার কোকিলরা যেন কেমন ভোঁদাই। আমি ওদের মুখ ভেঙ্গাই আর ওরা চুপ মেরে যায়। হতো আমাদের মফস্বলের কোকিল! একশোবার মুখ ভেঙ্গালে একশোবার তার জবাব দিত।’
‘ঢাকারগুলো শিক্ষিত আর তোমাদের গ্রামেরগুলো আনকালচার্ড তো তাই।’ সেজান গোঁফের নিচে কিঞ্চিত ঠোঁট প্রশস্ত করে।
‘আমিও তো গ্রামের।’
‘তুমি তো আর কোকিল নও।’
‘কিন্তু গলাটা?’
বিদ্যুৎ চলে গেলেই দিলশাদ গান গায়। অসাধারণ গলা দিলশাদের। ওর গানের সুরে অন্ধকারের শরীরে যেন ফুটে ওঠে হাজার বুটির জামদানী। অন্ধকারই নয়নাভিরাম হয়ে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ পেতে থাকে। তখন সেজানের মনে হয় এই স্নিগ্ধ মেয়েটি মফস্বল শহরের কোথায় কীভাবে কোন বাড়িতে বেড়ে উঠেছে? কোন জানালার পাশে শুয়ে শুয়ে মেয়েটি আকাশ দেখতো, কোন আলনার পেছনে ঝুলতো ওর সাদা-কালো অন্তর্বাস, ছাদের কোন কোণে বসে ও ছোটবেলায় রান্নাবাটি খেলতো, আমগাছের কোন ডালে দোলনা বেঁধে ঝুলতে গিয়ে পড়ে ওর পা ভেঙেছিল, কোন খাটে বসে হারমনিয়াম কোলে টেনে মেয়েটি গাইতো ‘আমারও পরানও যাহা চায়’ বা যে বারান্দায় বসে মেয়েটি চুল শুকাতো সেই রোদ আজও সেখানে প্রতীক্ষায় থেকে ফিরে যায় কি না - সেজানের লেখক প্রাণ তা দেখার জন্যে আঁইঢাই করে। সেজান এতো কিছু ভেঙে বলে না। কিন্তু দিলশাদদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাবার কথা বললেই দিলশাদ বলে, শালা নেই, শালি নেই…।
মা তো বেঁচে আছে। যদিও মাকে তার বড় ও একমাত্র ছেলে ঢাকা শহরেই বেশির ভাগ আটকে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু টানা দুমাস হয়ে গেলেই মাকে আর ধরে রাখা যায় না। দশ-বারো দিনের জন্যে হলেও মা বাড়ি যান। বলে যান, ‘তোমরা আমার শেকড় উপড়ে এনে মাথায় পানি ঢালো। এভাবে আমি বাঁচতে পারবো না।’ মেয়ে দিলশাদের কাছে এসেও থাকতে চান না। বলেন, ‘আমাদের বংশে জামাই বাড়ি পড়ে থাকার চল্ নেই।’
দিলশাদ বলে, ‘আরে বাবা তোমাকে তো কেউ পড়ে থাকতে বলছে না। তাছাড়া তোমার জামাই কি অন্য সবার মতো? দেখনা তোমার সাথে কেমন বন্ধুর মতো সহজ।’
‘একবার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেল না’ মা বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে অভিমান করেন। ঢাকা শহরে ভাইয়ের সরকারি বাসায় দিলশাদের বিয়ে হয়েছে। তা বলে কি নিজেদের ভিটেমাটি নেই? দিলশাদের বাবা যে অতো বড়ো বাড়ি রেখে গেছেন তার দেখাশুনাও তো করতে হয়। ভবঘুরে ভাইপোটা থাকে বটে কিন্তু সে কি আর অতোদিকে খেয়াল করে? তার তো কেবল গল্পের বই পড়ে আর কি সব ছাইপাশ লিখে দিন কাটে। রিটায়ারের পর বাবা গ্রামে ফিরে গিয়ে বাড়িটাকে মনের মতো করে গুছিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি হলেও দিলশাদের বাবার ছিল পৈতৃকসূত্রে পাওয়া পারিবারিক লাইব্রেরি। পরবর্তীতে দিলশাদরা ভাইবোন মিলে ভার্সিটি থেকে ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় পছন্দের বই কিনে নিয়ে গিয়ে ওদের লাইব্রেরিটাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এখনতো ওটা ওই ভবঘুরে লেনিনের দখলে। দিলশাদের ভাই অবশ্য বলেছিল কিছু কিছু করে ওরা ভাইবোনে মিলে ঢাকায় ওদের বাসায় বইগুলো নিয়ে আসবে। শুনতে পেয়ে মায়ের সে কি রাগ!
‘আমি মরে গেলে যা খুশী তাই ক’রো। ওগুলো তোমাদের বাবার স্মৃতি। আমি হাতছাড়া করবো না।’
দিলশাদ জানে এটা যদিও মায়ের সেন্টিমেন্টের বিষয় কিন্তু লেনিনের প্রতি মায়ের অপত্য স্নেহটাই এর পেছনে বেশি কাজ করে। বইগুলো ঢাকায় নিয়ে এলে ছেলেটা কী পড়বে? ও মন খারাপ করবে না? মা মরা ছেলেটাকে সেই ছোটবেলা থেকে নিজের সন্তানদের পাশাপাশি মানুষ করেছেন তিনি। একলা অতোবড়ো বাড়িতে রেখে আসেন। তারও তো সময় কাটতে হবে? সে তো আর দিলশাদের মতো উচ্চশিক্ষিত হতে পারেনি। ওর মাথা তো আর খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু দিলশাদের বাবার খুব একটা আগ্রহ লক্ষ করেননি মা এ ব্যাপারে। দিলশাদের সাথেই ম্যাট্রিক পাস করলে মায়ের জোরাজুরিতে তাকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করে দেয়া হয়। দিলশাদ তো ইন্টারের পর থেকেই ঢাকাতে। বড়ভাই তখন বুয়েটে ফাইনাল ইয়ারে। এতো লেখাপড়া করতে গেলে বাড়ি-বাজারঘাট-জমাজমির দেখাশুনাটা করবে কে? ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে লেনিনের আর পড়াশুনা এগোলো না। কলেজে তা বন্ধ হলেও বাড়ির লাইব্রেরি হয়ে উঠলো লেনিনের বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্বামীর জীবদ্দশায় ছেলেটিকে আস্কারা দিতে পারেননি দিলশাদের মা। মারা যাওয়ার পর যেন বাঁধভাঙা স্নেহবর্ষণ হতে থাকলো।
‘ছেলেটা আছে বলেই নিশ্চিন্তে তোমাদের কাছে এসে থাকতে পারছি। বইপত্তরগুলো কি আর এতদিন আস্ত থাকতো? সে-ই তো ঝেড়ে পুঁছে যতেœ আগলে রেখেছে,’ শ্বশুরের লাইব্রেরি সম্পর্কে সেজানের গভীর আগ্রহের জবাব দিতে গিয়ে মা আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। কেঁদে ফেলার পেছনে আরও যে কারণটা ছিল। তা হলো সেজান এবারই শাশুড়ির সাথে গ্রামের বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
দিলশাদ বলতে চেয়েছিল সাতদিন পেরিয়ে গেল এবার ওর শরীর খারাপ হচ্ছে না। সম্ভবত কনসিভ করেছে। এসময় কি নড়াচড়া ঠিক হবে? কিন্তু যেদিন ওরা রওনা দেবে তার পূর্বরাতে সেজান দিলশাদকে প্যাড চেঞ্জ করতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। যাক্ ফিরে আসি আগে গ্রাম থেকে।
যাওয়ার পথে দিলশাদের মধ্যে কোন উত্তেজনা লক্ষ্য করছিল না সেজান। বরং মাঝে মাঝেই দুই ভ্রুর মধ্যে ভাঁজের ঢেউ এসে নদীর ঢেউয়ের মতো দুদিকে মিলিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা নিজের সংসার ছাড়া এখন আর কিছু বোঝে না। যেন জোর করে ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লুকিয়ে একটু চিমটি দিয়ে ওকে উৎফুল্ল হতে বলতেই দিলশাদ একেবারে খেপে উঠলো, ‘সবসময় ফাজলামি করবে নাতো’ মাকে উদ্দেশ্য করে গলার স্বর আরও এককাঠি উপরে উঠিয়ে।
‘বুড়ো হচ্ছো আর দিনদিন বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। এ সাতদিনে ওকে একটা উপন্যাস শেষ করতেই হবে। প্রকাশকরা আগেই টাকা দিয়ে রেখেছে। একে নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি।’
সেজান গলা ছেড়ে হেসে উঠলে মায়ের মাথা থেকে ভার নেমে গেল। রাগ করুক আর যা-ই করুক মেয়েটা যে তার স্বামী নিয়ে দারুণ সুখী সেটা বুঝে নিয়ে মেয়ের ধমককে পুষ্পচন্দনের মতো গায়ে মেখে রাখলেন।
বাড়ি দেখে সেজানের সে কী উচ্ছ্বাস! ঐতো সেই ছাদ। ঐযে বারান্দার কোণে এখনও সেই প্রেমিক রোদ যাবো যাবো করেও যাচ্ছে না। এই পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিলা গুনগুনিয়ে কতো গান গেয়েছে। দিলার কাছ থেকে বাড়ির গল্প শুনে শুনে কল্পনার সাথে প্রায় সবই মিলে যাচ্ছিল সেজানের। লেনিনকে নিয়ে দিলশাদ তেমন বড় একটা গল্প না করলেও সেজানের কল্পনার লেনিনের সাথে বাস্তবের লেনিনের কোন মিলই খুঁজে পেল না। লেখকরা একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ। কারো গল্প শুনলে মনে মনে তার একটা ছবি আঁকা হয়ে যায় মনের মধ্যে। যখনই তার কথা ওঠে সেই ছবি নিখূঁত ধরা দেয় মানসপটে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে তুষারকন্যার গল্প শুনে বারবার ওর ছোটফুপুর ছবি ভেসে উঠতো মনে। ছোটফুপুর সারা শরীরে ছিল শ্বেতী রোগ। ঠোঁটদুটো লাল টকটকে। ঠিক মায়ের বর্ণনার তুষারকন্যা। একটু বড় হয়ে যখন ‘স্নো হোয়াইট’ দেখল সিনেমায় ও তখন বিরতির সময় বেরিয়ে এসেছিল হল থেকে। স্নো হোয়াইট মোটেই ওরকম না। ওর ফুপুর মতো ওরকম স্নো হোয়াইট আর কেউ হতে পারে না। তো লেনিনকেও সে মনে মনে এঁকে রেখেছিল পুরুষের স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি লম্বা, সামান্য ঝুঁকে হাঁটে, একমাথা কোকড়া চুল, একটু ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির ভাবনাটা বলাই বাহুল্য রুশ নেতা লেনিনের ছবি মনে রেখেই। কিন্তু যাকে পেল সে রোগা-পটকা, উচ্চতায় গড়মানের, মাথার চুল পাতলা, তবে চোখদুটো গভীর আর চিবুকটা দৃঢ়।
সমবয়সী কাজিনদের সাথে যে সখ্য থাকে দিলশাদ আর লেনিনের মধ্যে সে রকম কিছুই দেখলো না সেজান। এমনকি কুশল বিনিময়ও করেছে কিনা ওরা সন্দেহ। আশ্রিতদের প্রতি এ ধরনের আচরণ হয়তো স্বাভাবিক। লেনিনের জন্যে সেজানের একটু মায়াই হলো। আন্ডারপ্রিভিলাইজড্। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখার জন্যে যখনই লেনিনকে ডাকে দিলশাদ বলে, ‘ওকে দরকার কী? ম্যা হু না? চলো তোমাকে ছাদে নিয়ে যাই।’
বাড়ি এসে পর্যন্ত দিলশাদ একেবারে আঠার মতো লেগে আছে সেজানের সাথে। লাইব্রেরিটা সত্যিই সমৃদ্ধ। আর মলাট লাগিয়ে নাম্বারিং করে লেনিন খুব যতেœ রেখেছে বইগুলো। সাহিত্য সম্পর্কে লেনিনের কথাবার্তাও বেশ পরিপক্ক ও বুদ্ধিদীপ্ত। আধুনিক অনেক বই নিয়ে তার সাথে কথা বলে ভালোও লাগলো। এমনকি সেজানের শেষ উপন্যাসটার যেটুকু সমালোচনা লেনিন করলো সেজান সে যুক্তিকে খুব জোরালোভাবে খণ্ডন করতে পারলো না। ক্রমেই লেনিনের সঙ্গ সেজানের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠলেও লেনিনের সাথে একা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আলাপ করার কোন সুযোগই পেল না। কারণ তাদের মধ্যে দিলশাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি এবং বাড়িটার কোথায় কোথায় ওর ছোটবেলা জমে আছে তা সেজানকে দেখিয়ে বেড়ানোর ব্যস্ততায়। তবু ঢাকা ফিরে আসার আগের দিন শাশুড়ির অনুরোধে সেজান লেনিনের সাথে এলাকাটা ঘুরে দেখে আসতে দিলশাদের আপত্তি সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লো। দিলশাদ জোর আপত্তি করছিল, ‘এলাকার আবার দেখবেটা কী হ্যাঁ? আর যদি যেতে হয় আমিই না হয় সাথে গেলাম।’
‘কোথায় মাঠে-ঘাটে ঘুরবো, লেখার রসদ জোগাড় করবো - ভাদিমির লেনিন থাকলেই সুবিধা।’
নাহ্, দিলশাদের শেষরক্ষা হলো না। এ ক’দিন সেজানকে একমুহূর্তের জন্যও লেনিনের সাথে একা ছাড়েনি সে। আজ কি আর সেজানকে একা পেয়ে লেনিন ছেড়ে দেবে? যদিও লেনিনকে দিলশাদ ওর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়নি তবুও এরই মধ্যে একদিন দুপুরে ছাদ থেকে কাপড় নামাতে গেলে সিঁড়িঘরের পেছন থেকে লেনিন বেরিয়ে এসে পথ আটকালে দিলশাদ চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েছিল কিন্তু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে কেমন আছিস?’
‘তিনদিন পর জানতে চাইলি কেমন আছি?’
‘না, মানে ভালোই তো আছিস মনে হচ্ছে।’
‘ভালো আমি আছি, না তুই?’
‘কেন, আমি ভালো থাকলে তোর অসুবিধা আছে?’
‘অসুবিধা তো থাকতেই পারে।’
এই অসুবিধাটার জন্যেই সে সেজানকে নিয়ে এতদিন বাড়ি আসেনি। এই অসুবিধাটার জন্যেই সেজানকে একমুহূর্তের জন্যও লেনিনের সাথে একা ছেড়ে দেয়নি। অথচ শেষ পর্যন্ত লেনিন একতরফা পুরো একটা বিকেল পেয়ে গেল সেজানকে সঙ্গ দেয়ার। লেনিন কি আর কিছু বাকি রাখবে বলতে? লেনিন কি বলবে না দিলশাদের প্রথম মল্লিকা কুঁড়ি ফুটিয়েছিল ও? লেনিন তো বলতেই পারে - একদিন বাইরে ঝুম বৃষ্টি। লাইব্রেরির মধ্যে শুধু দুটো কিশোর-কিশোরী। ওরা বুদ্ধদেব গুহের ‘মাধুকরী’ পড়ছিল দুজনে মিলে। কিশোরীটি হঠাৎ কিশোরের ডান হাতটা ধরে নিজের বুকের মাঝখানে চেপে রেখে বলেছিল, ‘আমার বুকের মধ্যে এরকম লাগছে কেন? আমি কি হার্টফেইল করবো? প্লিজ আমাকে জড়িয়ে ধরো। আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি।’
সমবয়সী হওয়ার কারণে কিশোরটির সাথে তুই-তোকারি সম্পর্ক কিশোরীটির। কিন্তু ‘প্লিজ আমাকে জড়িয়ে ধরো’ কথাগুলি শোনার পর মুহূর্তেই কিশোরটি যেন একলাফে যুবক হয়ে গেল। ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপের উঠে দাঁড়ানো ও টের পাচ্ছিল। কিশোরটি পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিলে কিশোরী হঠাৎ কেঁদেই আকুল। কিশোরের বুকে তখন কেমন স্বামী স্বামী অনুভব আর শরীরের বেসামাল উন্মাদনা। কিশোরী কান্নাভেজা চোখ তুলে তাকাতেই কিশোর বুঝে হোক না বুঝে হোক কিশোরীর ঠোঁটের বিমূর্ত আহ্বান পড়ে নিয়ে নিজের ঠোঁট সমর্পণ করলে কিশোরীর উরুর স্পন্দন তীব্রতর হলো। কম্পমান দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হলেও এক ঝটকায় কিশোরকে সরিয়ে কিশোরী পালিয়ে গেল নিচে।
কিন্তু নিজেদের কাছ থেকে ওরা কেউই পালাতে পারেনি কৈশোর অতিক্রান্ত হবার পরেও। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দিলশাদ প্রথমদিকে বাড়ি আসার জন্যে দিন গুনতো। লেনিনের জন্যে নতুন নতুন বই কিনে আনতো। বই হাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও ওরা ছাদের কোণে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতো। লেনিনের জন্যে দিলশাদের কেমন যেন মায়া হতো। লেনিন যেন না ভাবে ভর্সিটিতে ভর্তি হয়ে ও কিছু একটা হয়ে গেছে, তার জন্যে ওকে আরো বেশি বেশি টানতো দিলশাদ। ওরই মধ্যে বাবা মারা গেলে বেদনায় কাতর দিলশাদ লেনিনের সান্ত্বনা ও সহানুভূতির নিবিড় সান্নিধ্যে একটু বেশিই কাছাকাছি এসে পড়েছিল। সে-ই প্রথম ও বুঝতে পেরেছিল শরীরের যাচ্ঞা কেবলই ধাপ অতিক্রম করতে চায়। অনেকটা ধর্মাচার পালনের মতো। কম তকলিব থেকে বেশিতে। ছোট আনন্দ থেকে পরমানন্দে।
বাবার চল্লিশায় যে দিলশাদকে পেল লেনিন তা ওর কাছে ছিল অভাবনীয়। সেই ‘থিরবিজুরি’ কী কারণে যেন চঞ্চলা। কী যেন এক অস্থিরতা ওর ভেতর সারাক্ষণ তোলপাড় করছিল। বাবার স্মৃতি? কই, চোখে তো জল নেই। তাহলে কি লেনিনকে নিয়ে ও কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে? কিন্তু টানা দু’ঘন্টা ছাদে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে লেনিন হতাশ হয়ে যখন নিচে ফিরছিল তখন দেখে দিলশাদ পরের দিন চলে যাওয়ার জন্যে ব্যাগ গুছাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনদের সামনেই বললো, ‘আয় বোস। কাল সকালেই যেতে হবে বলে গুছিয়ে রাখছি। তোর জন্যে একটা বই এনেছিলাম’ বলে নিতান্তই ক্যাজুয়ালি বইটা ওর কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হলো। পরদিন দীর্ঘদিনের জন্য দিলশাদ ভার্সিটিতে চলে আসার সময় বাসে উঠিয়ে দেয়ার মুহূর্তে লেনিন সেই প্রথম কেঁদেছিল। লেনিন কি ভেবেছিল দিলশাদকে হারিয়ে ফেলার সময় তার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে?
এরপর অল্প কদিনের জন্যে দিলশাদ বাড়ি এসেছিল। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে পাঁচ’ছ জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈচৈ করে কাটিয়ে গেল। আধুনিক পোশাক, চুল, কথাবার্তা, চালচলনের একঝাঁক উচ্ছল তরুণ-তরুণীর মধ্যে লেনিনের নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত ও সেকেলে মনে হতে লাগলো। এই দিলশাদকে তার অচেনা, অহংকারী, আরো সুন্দরী, আরো দুর্লভ মনে হচ্ছিল। যাওয়ার আগের দিন ওর বন্ধুরা লাইব্রেরিতে আড্ডা দিতে বসলে লেনিনের নীরব আকুল আহ্বানে দিলশাদ ওকে খানিকটা সময় ধার দিয়েছিল। ছাদে গিয়ে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়ালে কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারেনি।
‘আর বোধহয় আমাদের সেভাবে দেখা হবে না’ - আধোচেনা এই সুদূরিকাকে না ‘তুই’ না ‘তুমি’ কোন সম্মোধনেই ডাকার সাহস পাচ্ছিল না লেনিন। বুক ভেঙে যাওয়ার কোন শব্দ হয় না কিন্তু তা যে পাহাড়ের ধস নামার চেয়েও ভয়াবহ সন্ধ্যার আবছা আলোয় তার প্রতিফলন লেনিনের রক্তহীন পাণ্ডুর মুখের ওপর স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল দিলশাদ।
‘কীভাবে?’
‘না বলছিলাম ফুপুও চলে যাবেন ভাইয়ার সাথে। তখন কে আর গ্রামে আসবে?’
‘বারে, তুই তো থাকবি। মায়ের সাথে মাঝে মধ্যে আমি আসবো না? আমার লাইব্রেরি, আমার বারান্দা, আমার ছাদ, আমার অনেক সন্ধ্যা, অনেক দুপুর, অনেক কিছু তোর জিম্মায় রেখে যাচ্ছি। তুই এগুলো যত্নে রাখিস’ লেনিনের ঘাড়ে হাত রেখে একটু ঝাঁকি দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দূরতমা তার সিঁড়ির আঁধারে মিলিয়ে গেল। এ ছোঁয়ায় না ছিল উষ্ণতা, না ছিল আবেগ, না কেঁপে ওঠা। যেন এক পুরুষ বন্ধুর কাঠখোট্টা সান্ত্বনা।
সে আঘাত, সে বঞ্চনা কি লেনিন ভুলে গেছে? কিন্তু এ-ও তো সত্যি যে তাদের ভেতর কোনদিন কোন শর্ত বা অঙ্গীকারের অবতারণা হয়নি। দিলশাদ তো কোনদিনও তাকে অপেক্ষা করতে বলেনি। এমনকি মুখ ফুটে কোনদিন বলেওনি ‘ভালোবাসি’। তাহলে আজ কেন সেজানকে একলা পেয়ে ও সব বলে দেবে? ও কি নিজেও জানে না দিলশাদকে পাওয়া অবিশ্বাস্য, অসম্ভব? কিন্তু ওদের পরস্পরের কাছে আসার প্রথম দিনগুলোতে দিলশাদের আহ্বান, আকুলতা, বিহ্বলতা, ভেঙে পড়া তো একটুও মিথ্যে ছিল না। প্রথমবার ভার্সিটি থেকে এসে দিলশাদ পাগলের মতো লেনিনকে জড়িয়ে ধরেছিল। কেঁদে আকুল হয়েছিল। সেসব তো ভান ছিল না। নাকি দিলশাদের কেবলই তা ছিল শরীরের আকর্ষণ? তাহলে ভালোবাসা কি শরীরের বাইরের বায়বীয় কিছু? মেঘের মতো মুঠো মুঠো আকাশ থেকে ধরে এক প্রশ্বাসে বুকে পোরা? তারপর সময়মতো নিশ্বাসের সাথে ছেড়ে দিয়ে নির্ভার হওয়া? ভালোবাসা হৃদয়কে বিক্ষত করে না? হৃদয়ের ক্ষত হয়তো সারে কিন্তু তার দাগ মুছে ফেলা এতো সহজ? বৃষ্টির দিন, একলা দুপুর, কনে দেখা আলো, শ্যাওলা-পিছল ছাদ, ঘুঁটঘুঁটে সিঁড়ি, চারুসন্ধ্যা - এগুলো কি স্মৃতির লেজ দুলিয়ে পায়ে পায়ে নাছোড় বেড়ালটির মতো ঘুরে বেড়ায় না?
সেজান আর লেনিন ফিরলে দিলশাদের রক্তহীন শাদা মুখের দিকে তাকিয়ে সেজান ভয় পেয়ে যায়। এরই মধ্যে হলো কী মেয়েটার? ওভাবে পাথরের মতো বসে আছে কেন?
‘দিলা, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? - বলে অস্থির সেজান একপ্রকার জড়িয়ে ধরেই দিলশাদকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘এই দেখো তোমার জন্যে ছানার মুড়কি নিয়ে এসেছি। লেনিন বলছিল তোমার নাকি দারুণ পছন্দের মিষ্টি।’
সেজানের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তায় মনে তো হচ্ছে না লেনিন কিছু বলেছে। কিছু বললে সেজান কি এতো সহজ হতে পারতো ওর সাথে? ছি! লেনিনকে কী ভাবছিল ও। লেনিন আসলেই মহান। লেনিনের মতো মানুয় হওয়া চাট্টিখানি কথা না। দুঃখী, প্রবঞ্চিত, প্রতারিত, একাকী লেনিনের জন্যে ওর অন্তর হু হু করে উঠলো। ভাদিমির লেনিন! চোখে পানি দেখে সেজান বললো, ‘কাল চলে যাবে বলে মন খারাপ? না আমি দেরি করে ফিরে এলাম দেখে? চলো ছাদে গিয়ে সবাই মিলে শেষ সন্ধ্যাটা তোমার গান শুনে স্মৃতির বটুয়ায় শেষ মোহরটা ভরে নিয়ে এবারের যবনিকা টানি।’
দিলশাদের মা আরও সাতদিনের জন্য থেকে গেলেন। স্টেশনে ওদের দুজনকে তুলে দিতে এল লেনিন। সেজান গভীরভাবে লেনিনকে বুকে চেপে পিঠ চাপড়িয়ে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানালো। দেখে দিলশাদ আরও একবার নিশ্চিত হলো যে না, লেনিন কিছুই বলেনি। জানালার কাচ নামিয়ে বসে পড়লো দিলশাদ। বাইরে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে লেনিন। ট্রেন চলতে শুরু করলে বাতাস ওর পাতলা চুল উড়িয়ে খানিকটা টাক বের করে দিল। ও বাম হাত দিয়ে ডানদিকের ক’টা চুল বামে টেনে এনে টাক ঢাকার চেষ্টা করতে করতে ট্রেনের সাথে হাঁটতে লাগলো। ট্রেন হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিলে লেনিনও খানিকটা দৌড়ে এসে একজায়গায় থেমে গেল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলশাদ যখন বললো, ‘লিলু ভালো থাকিস’ তখন লিলুর থেকে ওর দূরত্ব প্রায় দেড় কিলো।
‘লিলুর কানে কি দিলুর কণ্ঠস্বর পৌছালো?’ চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে দিলশাদ দেখলো বাইরে চোখ রেখেই সেজান প্রশ্ন করলো। লেনিন ওকে ‘দিলু’ বলে ডাকে সেজান তা জানলো কেমন করে? দিলশাদের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এই নির্জন কেবিনে সেজান কি কোন প্রশ্নের মুখোমুখি করবে দিলশাদকে? কিন্তু না, ট্রেন দুলতে থাকার পরপরই সেজান চোখ বন্ধ করলো। মুখে কোন ভাবান্তর নেই।
ট্রেন চলতে শুরু করলে ট্রেনের চাকা আর রেললাইনের সম্মিলিত সংঘর্ষে যে ধ্বনি উঠলো সে সুরতাল নিয়ে শৈশবে দিলশাদরা ছন্দোময় ছড়া কাটতো। ট্রেন যেন বলতো - ‘একধামা চাল, একটি পটল…একধামা চাল, একটি পটল…’। ট্রেন আজও তা-ই বলছে। পা তুলে বসে সেজানের ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে দুলতে দুলতে দিলশাদ জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমাদের বাড়িটা কেমন?’
‘অসাধারণ’
‘ছাদ?’
‘ছেলেবেলাময়।’
‘বারান্দা?’
‘স্মৃতিভারাতুর।’
‘সিঁড়ি?’
‘বেদনাবিধুর।’
‘লাইব্রেরি?’
‘নীরব দর্শক।’
ট্রেনের লাইন পরিবর্তনের জোর ঝাঁকুনিতে, না সেজানের জবাবে দিলশাদ কেঁপে উঠলো বোঝা গেল না। কিন্তু দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে দিলশাদ সেজানকে বললো, ‘ট্রেনটা কী বলছে বুঝতে পারছো সেজান? যেন বলছে, ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…।’
সেজানও বোঝে। দেড় বছরের কিছু বেশী হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। দিলশাদের প্রেমে ভান নেই, সংসারে অমনোযোগ নেই, নিজেকে সাজাতে ক্লান্তি নেই, নিত্যনতুন রান্নায় গবেষণার শেষ নেই, সেজানের লেখা পড়তে উৎসাহের কমতি নেই, বিছানায় বিন্দুমাত্র অসহযোগিতা নেই, সেজানকে বুঝতেও তার কিছু বাকি নেই। কারণ দিলশাদ জানে লেখক সেজানকে কতখানি ছাড় দিলে তার টেবিল থেকে ভালো ফসল তোলা সম্ভব।
সেজান বলতে গেলে ঢাকারই ছেলে। ওর বাবা ঢাকায় স্থায়ী হয়েছিলেন ওর জন্মের অনেক আগে। গ্রামের সাথে সেজানের নাড়ির সম্পর্ক নেই। ঈদ বা লম্বা ছুটিতে মানুষজন গ্রামে দৌড়ায়। সেজান ঢাকার নির্জনতা উপভোগ করে। ফুলার রোডের সুনসান রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে চপ্পল পরে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে থাকে। ওর হাঁটার গন্তব্যহীন ভঙ্গী দেখে দু’একটা খালি রিকশা ‘যাইবেননি স্যার’ বলার কোন তাগিদ অনুভব করে না। খাবারহীন ডাস্টবিনে বসে কাকেরা ঠোঁটে শান দেয়। বৃটিশ কাউন্সিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় হাঁটার গতি শ্লথ করে গেটের নামফলকের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসে। কিছুদিন আগেও লেখা ছিল ‘দি বৃটিশ কাউন্সিল।’ এখন কেবল ‘বৃটিশ কাউন্সিল।’ যাক্ এতদিনে বোধোদয় হয়েছে। ঢাকার এই নাগরিক জীবন ছাড়া লেখক সেজানের ভান্ডারে গ্রাম নেই, মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত নেই, মাটির ঘরের পাশে দাঁড়ানো দাঁতে ঘোমটা কাটা লাজুক বউটি নেই, ন্যাংটো ছেলেদের মুহূর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়া নদী নেই। তবে কোকিল আছে। বসন্ত আসার আগেই ওরা সেজানের বাসার পাশের বন্ধ্যা আমগাছে এসে বসে। ডাকে। ইদানিং দিলশাদ বলে, ‘ঢাকার কোকিলরা যেন কেমন ভোঁদাই। আমি ওদের মুখ ভেঙ্গাই আর ওরা চুপ মেরে যায়। হতো আমাদের মফস্বলের কোকিল! একশোবার মুখ ভেঙ্গালে একশোবার তার জবাব দিত।’
‘ঢাকারগুলো শিক্ষিত আর তোমাদের গ্রামেরগুলো আনকালচার্ড তো তাই।’ সেজান গোঁফের নিচে কিঞ্চিত ঠোঁট প্রশস্ত করে।
‘আমিও তো গ্রামের।’
‘তুমি তো আর কোকিল নও।’
‘কিন্তু গলাটা?’
বিদ্যুৎ চলে গেলেই দিলশাদ গান গায়। অসাধারণ গলা দিলশাদের। ওর গানের সুরে অন্ধকারের শরীরে যেন ফুটে ওঠে হাজার বুটির জামদানী। অন্ধকারই নয়নাভিরাম হয়ে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ পেতে থাকে। তখন সেজানের মনে হয় এই স্নিগ্ধ মেয়েটি মফস্বল শহরের কোথায় কীভাবে কোন বাড়িতে বেড়ে উঠেছে? কোন জানালার পাশে শুয়ে শুয়ে মেয়েটি আকাশ দেখতো, কোন আলনার পেছনে ঝুলতো ওর সাদা-কালো অন্তর্বাস, ছাদের কোন কোণে বসে ও ছোটবেলায় রান্নাবাটি খেলতো, আমগাছের কোন ডালে দোলনা বেঁধে ঝুলতে গিয়ে পড়ে ওর পা ভেঙেছিল, কোন খাটে বসে হারমনিয়াম কোলে টেনে মেয়েটি গাইতো ‘আমারও পরানও যাহা চায়’ বা যে বারান্দায় বসে মেয়েটি চুল শুকাতো সেই রোদ আজও সেখানে প্রতীক্ষায় থেকে ফিরে যায় কি না - সেজানের লেখক প্রাণ তা দেখার জন্যে আঁইঢাই করে। সেজান এতো কিছু ভেঙে বলে না। কিন্তু দিলশাদদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাবার কথা বললেই দিলশাদ বলে, শালা নেই, শালি নেই…।
মা তো বেঁচে আছে। যদিও মাকে তার বড় ও একমাত্র ছেলে ঢাকা শহরেই বেশির ভাগ আটকে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু টানা দুমাস হয়ে গেলেই মাকে আর ধরে রাখা যায় না। দশ-বারো দিনের জন্যে হলেও মা বাড়ি যান। বলে যান, ‘তোমরা আমার শেকড় উপড়ে এনে মাথায় পানি ঢালো। এভাবে আমি বাঁচতে পারবো না।’ মেয়ে দিলশাদের কাছে এসেও থাকতে চান না। বলেন, ‘আমাদের বংশে জামাই বাড়ি পড়ে থাকার চল্ নেই।’
দিলশাদ বলে, ‘আরে বাবা তোমাকে তো কেউ পড়ে থাকতে বলছে না। তাছাড়া তোমার জামাই কি অন্য সবার মতো? দেখনা তোমার সাথে কেমন বন্ধুর মতো সহজ।’
‘একবার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেল না’ মা বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে অভিমান করেন। ঢাকা শহরে ভাইয়ের সরকারি বাসায় দিলশাদের বিয়ে হয়েছে। তা বলে কি নিজেদের ভিটেমাটি নেই? দিলশাদের বাবা যে অতো বড়ো বাড়ি রেখে গেছেন তার দেখাশুনাও তো করতে হয়। ভবঘুরে ভাইপোটা থাকে বটে কিন্তু সে কি আর অতোদিকে খেয়াল করে? তার তো কেবল গল্পের বই পড়ে আর কি সব ছাইপাশ লিখে দিন কাটে। রিটায়ারের পর বাবা গ্রামে ফিরে গিয়ে বাড়িটাকে মনের মতো করে গুছিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি হলেও দিলশাদের বাবার ছিল পৈতৃকসূত্রে পাওয়া পারিবারিক লাইব্রেরি। পরবর্তীতে দিলশাদরা ভাইবোন মিলে ভার্সিটি থেকে ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় পছন্দের বই কিনে নিয়ে গিয়ে ওদের লাইব্রেরিটাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এখনতো ওটা ওই ভবঘুরে লেনিনের দখলে। দিলশাদের ভাই অবশ্য বলেছিল কিছু কিছু করে ওরা ভাইবোনে মিলে ঢাকায় ওদের বাসায় বইগুলো নিয়ে আসবে। শুনতে পেয়ে মায়ের সে কি রাগ!
‘আমি মরে গেলে যা খুশী তাই ক’রো। ওগুলো তোমাদের বাবার স্মৃতি। আমি হাতছাড়া করবো না।’
দিলশাদ জানে এটা যদিও মায়ের সেন্টিমেন্টের বিষয় কিন্তু লেনিনের প্রতি মায়ের অপত্য স্নেহটাই এর পেছনে বেশি কাজ করে। বইগুলো ঢাকায় নিয়ে এলে ছেলেটা কী পড়বে? ও মন খারাপ করবে না? মা মরা ছেলেটাকে সেই ছোটবেলা থেকে নিজের সন্তানদের পাশাপাশি মানুষ করেছেন তিনি। একলা অতোবড়ো বাড়িতে রেখে আসেন। তারও তো সময় কাটতে হবে? সে তো আর দিলশাদের মতো উচ্চশিক্ষিত হতে পারেনি। ওর মাথা তো আর খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু দিলশাদের বাবার খুব একটা আগ্রহ লক্ষ করেননি মা এ ব্যাপারে। দিলশাদের সাথেই ম্যাট্রিক পাস করলে মায়ের জোরাজুরিতে তাকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করে দেয়া হয়। দিলশাদ তো ইন্টারের পর থেকেই ঢাকাতে। বড়ভাই তখন বুয়েটে ফাইনাল ইয়ারে। এতো লেখাপড়া করতে গেলে বাড়ি-বাজারঘাট-জমাজমির দেখাশুনাটা করবে কে? ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে লেনিনের আর পড়াশুনা এগোলো না। কলেজে তা বন্ধ হলেও বাড়ির লাইব্রেরি হয়ে উঠলো লেনিনের বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্বামীর জীবদ্দশায় ছেলেটিকে আস্কারা দিতে পারেননি দিলশাদের মা। মারা যাওয়ার পর যেন বাঁধভাঙা স্নেহবর্ষণ হতে থাকলো।
‘ছেলেটা আছে বলেই নিশ্চিন্তে তোমাদের কাছে এসে থাকতে পারছি। বইপত্তরগুলো কি আর এতদিন আস্ত থাকতো? সে-ই তো ঝেড়ে পুঁছে যতেœ আগলে রেখেছে,’ শ্বশুরের লাইব্রেরি সম্পর্কে সেজানের গভীর আগ্রহের জবাব দিতে গিয়ে মা আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। কেঁদে ফেলার পেছনে আরও যে কারণটা ছিল। তা হলো সেজান এবারই শাশুড়ির সাথে গ্রামের বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
দিলশাদ বলতে চেয়েছিল সাতদিন পেরিয়ে গেল এবার ওর শরীর খারাপ হচ্ছে না। সম্ভবত কনসিভ করেছে। এসময় কি নড়াচড়া ঠিক হবে? কিন্তু যেদিন ওরা রওনা দেবে তার পূর্বরাতে সেজান দিলশাদকে প্যাড চেঞ্জ করতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। যাক্ ফিরে আসি আগে গ্রাম থেকে।
যাওয়ার পথে দিলশাদের মধ্যে কোন উত্তেজনা লক্ষ্য করছিল না সেজান। বরং মাঝে মাঝেই দুই ভ্রুর মধ্যে ভাঁজের ঢেউ এসে নদীর ঢেউয়ের মতো দুদিকে মিলিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা নিজের সংসার ছাড়া এখন আর কিছু বোঝে না। যেন জোর করে ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লুকিয়ে একটু চিমটি দিয়ে ওকে উৎফুল্ল হতে বলতেই দিলশাদ একেবারে খেপে উঠলো, ‘সবসময় ফাজলামি করবে নাতো’ মাকে উদ্দেশ্য করে গলার স্বর আরও এককাঠি উপরে উঠিয়ে।
‘বুড়ো হচ্ছো আর দিনদিন বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। এ সাতদিনে ওকে একটা উপন্যাস শেষ করতেই হবে। প্রকাশকরা আগেই টাকা দিয়ে রেখেছে। একে নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি।’
সেজান গলা ছেড়ে হেসে উঠলে মায়ের মাথা থেকে ভার নেমে গেল। রাগ করুক আর যা-ই করুক মেয়েটা যে তার স্বামী নিয়ে দারুণ সুখী সেটা বুঝে নিয়ে মেয়ের ধমককে পুষ্পচন্দনের মতো গায়ে মেখে রাখলেন।
বাড়ি দেখে সেজানের সে কী উচ্ছ্বাস! ঐতো সেই ছাদ। ঐযে বারান্দার কোণে এখনও সেই প্রেমিক রোদ যাবো যাবো করেও যাচ্ছে না। এই পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিলা গুনগুনিয়ে কতো গান গেয়েছে। দিলার কাছ থেকে বাড়ির গল্প শুনে শুনে কল্পনার সাথে প্রায় সবই মিলে যাচ্ছিল সেজানের। লেনিনকে নিয়ে দিলশাদ তেমন বড় একটা গল্প না করলেও সেজানের কল্পনার লেনিনের সাথে বাস্তবের লেনিনের কোন মিলই খুঁজে পেল না। লেখকরা একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ। কারো গল্প শুনলে মনে মনে তার একটা ছবি আঁকা হয়ে যায় মনের মধ্যে। যখনই তার কথা ওঠে সেই ছবি নিখূঁত ধরা দেয় মানসপটে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে তুষারকন্যার গল্প শুনে বারবার ওর ছোটফুপুর ছবি ভেসে উঠতো মনে। ছোটফুপুর সারা শরীরে ছিল শ্বেতী রোগ। ঠোঁটদুটো লাল টকটকে। ঠিক মায়ের বর্ণনার তুষারকন্যা। একটু বড় হয়ে যখন ‘স্নো হোয়াইট’ দেখল সিনেমায় ও তখন বিরতির সময় বেরিয়ে এসেছিল হল থেকে। স্নো হোয়াইট মোটেই ওরকম না। ওর ফুপুর মতো ওরকম স্নো হোয়াইট আর কেউ হতে পারে না। তো লেনিনকেও সে মনে মনে এঁকে রেখেছিল পুরুষের স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি লম্বা, সামান্য ঝুঁকে হাঁটে, একমাথা কোকড়া চুল, একটু ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির ভাবনাটা বলাই বাহুল্য রুশ নেতা লেনিনের ছবি মনে রেখেই। কিন্তু যাকে পেল সে রোগা-পটকা, উচ্চতায় গড়মানের, মাথার চুল পাতলা, তবে চোখদুটো গভীর আর চিবুকটা দৃঢ়।
সমবয়সী কাজিনদের সাথে যে সখ্য থাকে দিলশাদ আর লেনিনের মধ্যে সে রকম কিছুই দেখলো না সেজান। এমনকি কুশল বিনিময়ও করেছে কিনা ওরা সন্দেহ। আশ্রিতদের প্রতি এ ধরনের আচরণ হয়তো স্বাভাবিক। লেনিনের জন্যে সেজানের একটু মায়াই হলো। আন্ডারপ্রিভিলাইজড্। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখার জন্যে যখনই লেনিনকে ডাকে দিলশাদ বলে, ‘ওকে দরকার কী? ম্যা হু না? চলো তোমাকে ছাদে নিয়ে যাই।’
বাড়ি এসে পর্যন্ত দিলশাদ একেবারে আঠার মতো লেগে আছে সেজানের সাথে। লাইব্রেরিটা সত্যিই সমৃদ্ধ। আর মলাট লাগিয়ে নাম্বারিং করে লেনিন খুব যতেœ রেখেছে বইগুলো। সাহিত্য সম্পর্কে লেনিনের কথাবার্তাও বেশ পরিপক্ক ও বুদ্ধিদীপ্ত। আধুনিক অনেক বই নিয়ে তার সাথে কথা বলে ভালোও লাগলো। এমনকি সেজানের শেষ উপন্যাসটার যেটুকু সমালোচনা লেনিন করলো সেজান সে যুক্তিকে খুব জোরালোভাবে খণ্ডন করতে পারলো না। ক্রমেই লেনিনের সঙ্গ সেজানের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠলেও লেনিনের সাথে একা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আলাপ করার কোন সুযোগই পেল না। কারণ তাদের মধ্যে দিলশাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি এবং বাড়িটার কোথায় কোথায় ওর ছোটবেলা জমে আছে তা সেজানকে দেখিয়ে বেড়ানোর ব্যস্ততায়। তবু ঢাকা ফিরে আসার আগের দিন শাশুড়ির অনুরোধে সেজান লেনিনের সাথে এলাকাটা ঘুরে দেখে আসতে দিলশাদের আপত্তি সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লো। দিলশাদ জোর আপত্তি করছিল, ‘এলাকার আবার দেখবেটা কী হ্যাঁ? আর যদি যেতে হয় আমিই না হয় সাথে গেলাম।’
‘কোথায় মাঠে-ঘাটে ঘুরবো, লেখার রসদ জোগাড় করবো - ভাদিমির লেনিন থাকলেই সুবিধা।’
নাহ্, দিলশাদের শেষরক্ষা হলো না। এ ক’দিন সেজানকে একমুহূর্তের জন্যও লেনিনের সাথে একা ছাড়েনি সে। আজ কি আর সেজানকে একা পেয়ে লেনিন ছেড়ে দেবে? যদিও লেনিনকে দিলশাদ ওর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়নি তবুও এরই মধ্যে একদিন দুপুরে ছাদ থেকে কাপড় নামাতে গেলে সিঁড়িঘরের পেছন থেকে লেনিন বেরিয়ে এসে পথ আটকালে দিলশাদ চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েছিল কিন্তু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে কেমন আছিস?’
‘তিনদিন পর জানতে চাইলি কেমন আছি?’
‘না, মানে ভালোই তো আছিস মনে হচ্ছে।’
‘ভালো আমি আছি, না তুই?’
‘কেন, আমি ভালো থাকলে তোর অসুবিধা আছে?’
‘অসুবিধা তো থাকতেই পারে।’
এই অসুবিধাটার জন্যেই সে সেজানকে নিয়ে এতদিন বাড়ি আসেনি। এই অসুবিধাটার জন্যেই সেজানকে একমুহূর্তের জন্যও লেনিনের সাথে একা ছেড়ে দেয়নি। অথচ শেষ পর্যন্ত লেনিন একতরফা পুরো একটা বিকেল পেয়ে গেল সেজানকে সঙ্গ দেয়ার। লেনিন কি আর কিছু বাকি রাখবে বলতে? লেনিন কি বলবে না দিলশাদের প্রথম মল্লিকা কুঁড়ি ফুটিয়েছিল ও? লেনিন তো বলতেই পারে - একদিন বাইরে ঝুম বৃষ্টি। লাইব্রেরির মধ্যে শুধু দুটো কিশোর-কিশোরী। ওরা বুদ্ধদেব গুহের ‘মাধুকরী’ পড়ছিল দুজনে মিলে। কিশোরীটি হঠাৎ কিশোরের ডান হাতটা ধরে নিজের বুকের মাঝখানে চেপে রেখে বলেছিল, ‘আমার বুকের মধ্যে এরকম লাগছে কেন? আমি কি হার্টফেইল করবো? প্লিজ আমাকে জড়িয়ে ধরো। আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি।’
সমবয়সী হওয়ার কারণে কিশোরটির সাথে তুই-তোকারি সম্পর্ক কিশোরীটির। কিন্তু ‘প্লিজ আমাকে জড়িয়ে ধরো’ কথাগুলি শোনার পর মুহূর্তেই কিশোরটি যেন একলাফে যুবক হয়ে গেল। ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপের উঠে দাঁড়ানো ও টের পাচ্ছিল। কিশোরটি পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিলে কিশোরী হঠাৎ কেঁদেই আকুল। কিশোরের বুকে তখন কেমন স্বামী স্বামী অনুভব আর শরীরের বেসামাল উন্মাদনা। কিশোরী কান্নাভেজা চোখ তুলে তাকাতেই কিশোর বুঝে হোক না বুঝে হোক কিশোরীর ঠোঁটের বিমূর্ত আহ্বান পড়ে নিয়ে নিজের ঠোঁট সমর্পণ করলে কিশোরীর উরুর স্পন্দন তীব্রতর হলো। কম্পমান দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হলেও এক ঝটকায় কিশোরকে সরিয়ে কিশোরী পালিয়ে গেল নিচে।
কিন্তু নিজেদের কাছ থেকে ওরা কেউই পালাতে পারেনি কৈশোর অতিক্রান্ত হবার পরেও। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দিলশাদ প্রথমদিকে বাড়ি আসার জন্যে দিন গুনতো। লেনিনের জন্যে নতুন নতুন বই কিনে আনতো। বই হাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও ওরা ছাদের কোণে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতো। লেনিনের জন্যে দিলশাদের কেমন যেন মায়া হতো। লেনিন যেন না ভাবে ভর্সিটিতে ভর্তি হয়ে ও কিছু একটা হয়ে গেছে, তার জন্যে ওকে আরো বেশি বেশি টানতো দিলশাদ। ওরই মধ্যে বাবা মারা গেলে বেদনায় কাতর দিলশাদ লেনিনের সান্ত্বনা ও সহানুভূতির নিবিড় সান্নিধ্যে একটু বেশিই কাছাকাছি এসে পড়েছিল। সে-ই প্রথম ও বুঝতে পেরেছিল শরীরের যাচ্ঞা কেবলই ধাপ অতিক্রম করতে চায়। অনেকটা ধর্মাচার পালনের মতো। কম তকলিব থেকে বেশিতে। ছোট আনন্দ থেকে পরমানন্দে।
বাবার চল্লিশায় যে দিলশাদকে পেল লেনিন তা ওর কাছে ছিল অভাবনীয়। সেই ‘থিরবিজুরি’ কী কারণে যেন চঞ্চলা। কী যেন এক অস্থিরতা ওর ভেতর সারাক্ষণ তোলপাড় করছিল। বাবার স্মৃতি? কই, চোখে তো জল নেই। তাহলে কি লেনিনকে নিয়ে ও কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে? কিন্তু টানা দু’ঘন্টা ছাদে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে লেনিন হতাশ হয়ে যখন নিচে ফিরছিল তখন দেখে দিলশাদ পরের দিন চলে যাওয়ার জন্যে ব্যাগ গুছাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনদের সামনেই বললো, ‘আয় বোস। কাল সকালেই যেতে হবে বলে গুছিয়ে রাখছি। তোর জন্যে একটা বই এনেছিলাম’ বলে নিতান্তই ক্যাজুয়ালি বইটা ওর কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হলো। পরদিন দীর্ঘদিনের জন্য দিলশাদ ভার্সিটিতে চলে আসার সময় বাসে উঠিয়ে দেয়ার মুহূর্তে লেনিন সেই প্রথম কেঁদেছিল। লেনিন কি ভেবেছিল দিলশাদকে হারিয়ে ফেলার সময় তার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে?
এরপর অল্প কদিনের জন্যে দিলশাদ বাড়ি এসেছিল। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে পাঁচ’ছ জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈচৈ করে কাটিয়ে গেল। আধুনিক পোশাক, চুল, কথাবার্তা, চালচলনের একঝাঁক উচ্ছল তরুণ-তরুণীর মধ্যে লেনিনের নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত ও সেকেলে মনে হতে লাগলো। এই দিলশাদকে তার অচেনা, অহংকারী, আরো সুন্দরী, আরো দুর্লভ মনে হচ্ছিল। যাওয়ার আগের দিন ওর বন্ধুরা লাইব্রেরিতে আড্ডা দিতে বসলে লেনিনের নীরব আকুল আহ্বানে দিলশাদ ওকে খানিকটা সময় ধার দিয়েছিল। ছাদে গিয়ে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়ালে কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারেনি।
‘আর বোধহয় আমাদের সেভাবে দেখা হবে না’ - আধোচেনা এই সুদূরিকাকে না ‘তুই’ না ‘তুমি’ কোন সম্মোধনেই ডাকার সাহস পাচ্ছিল না লেনিন। বুক ভেঙে যাওয়ার কোন শব্দ হয় না কিন্তু তা যে পাহাড়ের ধস নামার চেয়েও ভয়াবহ সন্ধ্যার আবছা আলোয় তার প্রতিফলন লেনিনের রক্তহীন পাণ্ডুর মুখের ওপর স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল দিলশাদ।
‘কীভাবে?’
‘না বলছিলাম ফুপুও চলে যাবেন ভাইয়ার সাথে। তখন কে আর গ্রামে আসবে?’
‘বারে, তুই তো থাকবি। মায়ের সাথে মাঝে মধ্যে আমি আসবো না? আমার লাইব্রেরি, আমার বারান্দা, আমার ছাদ, আমার অনেক সন্ধ্যা, অনেক দুপুর, অনেক কিছু তোর জিম্মায় রেখে যাচ্ছি। তুই এগুলো যত্নে রাখিস’ লেনিনের ঘাড়ে হাত রেখে একটু ঝাঁকি দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দূরতমা তার সিঁড়ির আঁধারে মিলিয়ে গেল। এ ছোঁয়ায় না ছিল উষ্ণতা, না ছিল আবেগ, না কেঁপে ওঠা। যেন এক পুরুষ বন্ধুর কাঠখোট্টা সান্ত্বনা।
সে আঘাত, সে বঞ্চনা কি লেনিন ভুলে গেছে? কিন্তু এ-ও তো সত্যি যে তাদের ভেতর কোনদিন কোন শর্ত বা অঙ্গীকারের অবতারণা হয়নি। দিলশাদ তো কোনদিনও তাকে অপেক্ষা করতে বলেনি। এমনকি মুখ ফুটে কোনদিন বলেওনি ‘ভালোবাসি’। তাহলে আজ কেন সেজানকে একলা পেয়ে ও সব বলে দেবে? ও কি নিজেও জানে না দিলশাদকে পাওয়া অবিশ্বাস্য, অসম্ভব? কিন্তু ওদের পরস্পরের কাছে আসার প্রথম দিনগুলোতে দিলশাদের আহ্বান, আকুলতা, বিহ্বলতা, ভেঙে পড়া তো একটুও মিথ্যে ছিল না। প্রথমবার ভার্সিটি থেকে এসে দিলশাদ পাগলের মতো লেনিনকে জড়িয়ে ধরেছিল। কেঁদে আকুল হয়েছিল। সেসব তো ভান ছিল না। নাকি দিলশাদের কেবলই তা ছিল শরীরের আকর্ষণ? তাহলে ভালোবাসা কি শরীরের বাইরের বায়বীয় কিছু? মেঘের মতো মুঠো মুঠো আকাশ থেকে ধরে এক প্রশ্বাসে বুকে পোরা? তারপর সময়মতো নিশ্বাসের সাথে ছেড়ে দিয়ে নির্ভার হওয়া? ভালোবাসা হৃদয়কে বিক্ষত করে না? হৃদয়ের ক্ষত হয়তো সারে কিন্তু তার দাগ মুছে ফেলা এতো সহজ? বৃষ্টির দিন, একলা দুপুর, কনে দেখা আলো, শ্যাওলা-পিছল ছাদ, ঘুঁটঘুঁটে সিঁড়ি, চারুসন্ধ্যা - এগুলো কি স্মৃতির লেজ দুলিয়ে পায়ে পায়ে নাছোড় বেড়ালটির মতো ঘুরে বেড়ায় না?
সেজান আর লেনিন ফিরলে দিলশাদের রক্তহীন শাদা মুখের দিকে তাকিয়ে সেজান ভয় পেয়ে যায়। এরই মধ্যে হলো কী মেয়েটার? ওভাবে পাথরের মতো বসে আছে কেন?
‘দিলা, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? - বলে অস্থির সেজান একপ্রকার জড়িয়ে ধরেই দিলশাদকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘এই দেখো তোমার জন্যে ছানার মুড়কি নিয়ে এসেছি। লেনিন বলছিল তোমার নাকি দারুণ পছন্দের মিষ্টি।’
সেজানের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তায় মনে তো হচ্ছে না লেনিন কিছু বলেছে। কিছু বললে সেজান কি এতো সহজ হতে পারতো ওর সাথে? ছি! লেনিনকে কী ভাবছিল ও। লেনিন আসলেই মহান। লেনিনের মতো মানুয় হওয়া চাট্টিখানি কথা না। দুঃখী, প্রবঞ্চিত, প্রতারিত, একাকী লেনিনের জন্যে ওর অন্তর হু হু করে উঠলো। ভাদিমির লেনিন! চোখে পানি দেখে সেজান বললো, ‘কাল চলে যাবে বলে মন খারাপ? না আমি দেরি করে ফিরে এলাম দেখে? চলো ছাদে গিয়ে সবাই মিলে শেষ সন্ধ্যাটা তোমার গান শুনে স্মৃতির বটুয়ায় শেষ মোহরটা ভরে নিয়ে এবারের যবনিকা টানি।’
দিলশাদের মা আরও সাতদিনের জন্য থেকে গেলেন। স্টেশনে ওদের দুজনকে তুলে দিতে এল লেনিন। সেজান গভীরভাবে লেনিনকে বুকে চেপে পিঠ চাপড়িয়ে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানালো। দেখে দিলশাদ আরও একবার নিশ্চিত হলো যে না, লেনিন কিছুই বলেনি। জানালার কাচ নামিয়ে বসে পড়লো দিলশাদ। বাইরে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে লেনিন। ট্রেন চলতে শুরু করলে বাতাস ওর পাতলা চুল উড়িয়ে খানিকটা টাক বের করে দিল। ও বাম হাত দিয়ে ডানদিকের ক’টা চুল বামে টেনে এনে টাক ঢাকার চেষ্টা করতে করতে ট্রেনের সাথে হাঁটতে লাগলো। ট্রেন হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিলে লেনিনও খানিকটা দৌড়ে এসে একজায়গায় থেমে গেল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলশাদ যখন বললো, ‘লিলু ভালো থাকিস’ তখন লিলুর থেকে ওর দূরত্ব প্রায় দেড় কিলো।
‘লিলুর কানে কি দিলুর কণ্ঠস্বর পৌছালো?’ চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে দিলশাদ দেখলো বাইরে চোখ রেখেই সেজান প্রশ্ন করলো। লেনিন ওকে ‘দিলু’ বলে ডাকে সেজান তা জানলো কেমন করে? দিলশাদের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এই নির্জন কেবিনে সেজান কি কোন প্রশ্নের মুখোমুখি করবে দিলশাদকে? কিন্তু না, ট্রেন দুলতে থাকার পরপরই সেজান চোখ বন্ধ করলো। মুখে কোন ভাবান্তর নেই।
ট্রেন চলতে শুরু করলে ট্রেনের চাকা আর রেললাইনের সম্মিলিত সংঘর্ষে যে ধ্বনি উঠলো সে সুরতাল নিয়ে শৈশবে দিলশাদরা ছন্দোময় ছড়া কাটতো। ট্রেন যেন বলতো - ‘একধামা চাল, একটি পটল…একধামা চাল, একটি পটল…’। ট্রেন আজও তা-ই বলছে। পা তুলে বসে সেজানের ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে দুলতে দুলতে দিলশাদ জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমাদের বাড়িটা কেমন?’
‘অসাধারণ’
‘ছাদ?’
‘ছেলেবেলাময়।’
‘বারান্দা?’
‘স্মৃতিভারাতুর।’
‘সিঁড়ি?’
‘বেদনাবিধুর।’
‘লাইব্রেরি?’
‘নীরব দর্শক।’
ট্রেনের লাইন পরিবর্তনের জোর ঝাঁকুনিতে, না সেজানের জবাবে দিলশাদ কেঁপে উঠলো বোঝা গেল না। কিন্তু দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে দিলশাদ সেজানকে বললো, ‘ট্রেনটা কী বলছে বুঝতে পারছো সেজান? যেন বলছে, ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…সব ভালো তার, শেষ ভালো যার…।’
===============================
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ উম্মে মুসলিমা
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments