ফুটবল ও প্রযুক্তি
বিশ্বকাপ প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে। এ লেখা ছাপাখানায় গেছে প্রথম সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কিছু আগে। তাই সরাসরি খেলার বিষয়ে না বলে অন্য একটা বিষয় তুলি, কয়েক দিন ধরে যা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ইংল্যান্ড এবার দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নিলেও একটা বিষয়কে বোধ হয় অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। ফুটবলেও খেলা পরিচালনায় প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারটা বোধ হয় আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। জার্মানির বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ল্যাম্পার্ডের গোলটা টাচলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে নিশ্চিত গোল বলে প্রমাণিত হতো। ইংলিশ মিডিয়া তাদের প্রতি অবিচারের কথা সারা বিশ্বে তোলপাড় তুলে বলতে পেরেছে। ফলে ইংল্যান্ডের পক্ষে একটি জোরালো মতামত তৈরি হয়েছে। ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাত’-খ্যাত গোলটি যদি ফুটবলপাগল ইংল্যান্ড না হয়ে অন্য কোনো দেশের বিপক্ষে হতো, তাহলে তা এত কুখ্যাতি পেত কি? ঠিক সে রকম তাঁর ছয়জনকে কাটানো ঐন্দ্রজালিক দ্বিতীয় গোলটি যদি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে না হতো, তাহলে সেটিও এত বিখ্যাত হতো কি না, জানি না।
সে যা-ই হোক, এবারের বিশ্বকাপের কিছু খেলার বিতর্কিত পরিচালনা নিয়ে ফিফা এখন চাপে আছে। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার ফুটবলের রেফারিংয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে এত দিন অনমনীয় থাকলেও এখন নরম হয়েছেন। তিনি এখন বলছেন, ২০১৪ সাল থেকে বল গোললাইন অতিক্রম করল কি না, সেটা নির্ধারণ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার করার প্রস্তাব থাকবে।
কিন্তু ব্যাপারটা কী করে সম্ভব, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ফুটবল হচ্ছে একটানা চলা একটি সার্বক্ষণিক উত্তেজনার খেলা। এখন যদি প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য নির্ধারিত বিরতির বাইরে বারবার খেলা বন্ধ করতে হয়, তাহলে আবার আগের রেশ ধরে খেলা চালু করা যাবে কি? কতবার যে একটি খেলায় প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই! সেটা কোনো খেলায় একবারও প্রয়োজন না হতে পারে, আবার কোনো সময় হয়তো বারবার প্রয়োজন হবে। তা হলে খেলা শেষ হওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সময়ও হয়তো দেওয়া যাবে না। শেষে ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে না তো?
তার চেয়ে সহজ হলো পরিচালনার মান উন্নত করা। এ ব্যাপারে ফিফা অনেক পরিকল্পনা নিতে পারে।
ফুটবলের জনপ্রিয়তার কথা যখন এল, তখন আলোচনাটি একটু পেছনে টেনে নিই। বাংলা সাহিত্যে এযাবৎকাল লেখা ক্রিকেটের ওপর শ্রেষ্ঠ বই শংকরীপ্রসাদ বসুর রমণীয় ক্রিকেট। সে বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে ক্রিকেট ও ফুটবলের জনপ্রিয়তার ওপর তুলনামূলক একটি আলোচনা আছে। ষাটের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ বইটিতে স্বীকার করা হয়েছে, ফুটবল ক্রিকেটের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়, তবে একটা বিরাট কিন্তু আছে—পাঁচ দিনের টেস্ট ক্রিকেট গ্রিক নাট্যের মতো জীবনের উত্থান-পতনকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ, ফুটবল বেশি জনপ্রিয় হয়তো বা, কিন্তু ক্রিকেট অধিকতর জীবনঘনিষ্ঠ।
শংকরীপ্রসাদ বসুর কথা ধরে বলা যায়, ফুটবল নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কেননা এটা খেলতে সহজ, আর উপকরণ লাগে খুব কম। বিশ্বের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ গরিব, কিন্তু ফুটবলটা তারা সহজে খেলতে পারে। পেলে, ম্যারাডোনাসহ লাতিন আমেরিকার নামকরা অনেক খেলোয়াড়ই প্রায় বস্তি থেকে উঠে এসেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটের ঘরানা তৈরি করেছে জমিদার শ্রেণী, আর ফুটবলার তৈরি হয়েছে শহরের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল কিংবা গ্রামাঞ্চল থেকে। আমাদের অঞ্চলের এককালের নামকরা ফুটবলার ‘জাদুকর’ সামাদ (বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্ম, কিন্তু পরে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নিবাস গড়েন) ক্লাস এইটে স্কুল ছেড়ে দেন, সম্ভবত দারিদ্র্যের কারণেই।
কিন্তু ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট বেশি জীবনঘনিষ্ঠ—শংকরীপ্রসাদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হওয়া যাচ্ছে না। কেননা, শুধু সহজলভ্যতাই ফুটবলের জনপ্রিয়তার কারণ নয়। ফুটবল খেলাটার দর্শন যদি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করি, দেখব যে মানবজীবনের অপার রহস্যের সঙ্গে এরও ঘনিষ্ঠ মিল আছে। জীবনের এ রহস্যের উত্তর রবীন্দ্রনাথ জীবনের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ হয়ে প্রশ্ন করে পাননি, পাননি ‘দিবসের শেষ সূর্য‘ হয়ে প্রশ্ন করেও। ফুটবলের প্রাণ হচ্ছে এর অপার ঐন্দ্রজালিকতা।
এ ঐন্দ্রজালিকতা আছে খেলাটার প্রকৃতিতে। মানুষ তার হাত দিয়ে নয়, পা দিয়ে একটি চামড়ার গোলককে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেখানেই ঘটছে জাদুর ব্যাপারটা। কবি যেমন শূন্য থেকে শব্দের চেহারায় ফুল পেড়ে আনেন, তেমনি ফুটবলাররা যেন শূন্য থেকে ছোঁ মেরেই নিয়ে আসেন একেকটি গোল।
ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জার্মানির দেওয়া আটটি গোলই ছিল এমন শূন্য থেকে সৃষ্টি করার কবিত্বে মাখা। এ জন্যই পেলে বা ম্যারাডোনার খেলাকে ‘পোয়েট্রি ইন মোশন’ বা চলমান কবিতা বলা হয়।
ইংল্যান্ড এবার দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নিলেও একটা বিষয়কে বোধ হয় অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। ফুটবলেও খেলা পরিচালনায় প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারটা বোধ হয় আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। জার্মানির বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ল্যাম্পার্ডের গোলটা টাচলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে নিশ্চিত গোল বলে প্রমাণিত হতো। ইংলিশ মিডিয়া তাদের প্রতি অবিচারের কথা সারা বিশ্বে তোলপাড় তুলে বলতে পেরেছে। ফলে ইংল্যান্ডের পক্ষে একটি জোরালো মতামত তৈরি হয়েছে। ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাত’-খ্যাত গোলটি যদি ফুটবলপাগল ইংল্যান্ড না হয়ে অন্য কোনো দেশের বিপক্ষে হতো, তাহলে তা এত কুখ্যাতি পেত কি? ঠিক সে রকম তাঁর ছয়জনকে কাটানো ঐন্দ্রজালিক দ্বিতীয় গোলটি যদি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে না হতো, তাহলে সেটিও এত বিখ্যাত হতো কি না, জানি না।
সে যা-ই হোক, এবারের বিশ্বকাপের কিছু খেলার বিতর্কিত পরিচালনা নিয়ে ফিফা এখন চাপে আছে। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার ফুটবলের রেফারিংয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে এত দিন অনমনীয় থাকলেও এখন নরম হয়েছেন। তিনি এখন বলছেন, ২০১৪ সাল থেকে বল গোললাইন অতিক্রম করল কি না, সেটা নির্ধারণ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার করার প্রস্তাব থাকবে।
কিন্তু ব্যাপারটা কী করে সম্ভব, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ফুটবল হচ্ছে একটানা চলা একটি সার্বক্ষণিক উত্তেজনার খেলা। এখন যদি প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য নির্ধারিত বিরতির বাইরে বারবার খেলা বন্ধ করতে হয়, তাহলে আবার আগের রেশ ধরে খেলা চালু করা যাবে কি? কতবার যে একটি খেলায় প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই! সেটা কোনো খেলায় একবারও প্রয়োজন না হতে পারে, আবার কোনো সময় হয়তো বারবার প্রয়োজন হবে। তা হলে খেলা শেষ হওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সময়ও হয়তো দেওয়া যাবে না। শেষে ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে না তো?
তার চেয়ে সহজ হলো পরিচালনার মান উন্নত করা। এ ব্যাপারে ফিফা অনেক পরিকল্পনা নিতে পারে।
ফুটবলের জনপ্রিয়তার কথা যখন এল, তখন আলোচনাটি একটু পেছনে টেনে নিই। বাংলা সাহিত্যে এযাবৎকাল লেখা ক্রিকেটের ওপর শ্রেষ্ঠ বই শংকরীপ্রসাদ বসুর রমণীয় ক্রিকেট। সে বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে ক্রিকেট ও ফুটবলের জনপ্রিয়তার ওপর তুলনামূলক একটি আলোচনা আছে। ষাটের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ বইটিতে স্বীকার করা হয়েছে, ফুটবল ক্রিকেটের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়, তবে একটা বিরাট কিন্তু আছে—পাঁচ দিনের টেস্ট ক্রিকেট গ্রিক নাট্যের মতো জীবনের উত্থান-পতনকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ, ফুটবল বেশি জনপ্রিয় হয়তো বা, কিন্তু ক্রিকেট অধিকতর জীবনঘনিষ্ঠ।
শংকরীপ্রসাদ বসুর কথা ধরে বলা যায়, ফুটবল নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কেননা এটা খেলতে সহজ, আর উপকরণ লাগে খুব কম। বিশ্বের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ গরিব, কিন্তু ফুটবলটা তারা সহজে খেলতে পারে। পেলে, ম্যারাডোনাসহ লাতিন আমেরিকার নামকরা অনেক খেলোয়াড়ই প্রায় বস্তি থেকে উঠে এসেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটের ঘরানা তৈরি করেছে জমিদার শ্রেণী, আর ফুটবলার তৈরি হয়েছে শহরের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল কিংবা গ্রামাঞ্চল থেকে। আমাদের অঞ্চলের এককালের নামকরা ফুটবলার ‘জাদুকর’ সামাদ (বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্ম, কিন্তু পরে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নিবাস গড়েন) ক্লাস এইটে স্কুল ছেড়ে দেন, সম্ভবত দারিদ্র্যের কারণেই।
কিন্তু ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট বেশি জীবনঘনিষ্ঠ—শংকরীপ্রসাদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হওয়া যাচ্ছে না। কেননা, শুধু সহজলভ্যতাই ফুটবলের জনপ্রিয়তার কারণ নয়। ফুটবল খেলাটার দর্শন যদি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করি, দেখব যে মানবজীবনের অপার রহস্যের সঙ্গে এরও ঘনিষ্ঠ মিল আছে। জীবনের এ রহস্যের উত্তর রবীন্দ্রনাথ জীবনের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ হয়ে প্রশ্ন করে পাননি, পাননি ‘দিবসের শেষ সূর্য‘ হয়ে প্রশ্ন করেও। ফুটবলের প্রাণ হচ্ছে এর অপার ঐন্দ্রজালিকতা।
এ ঐন্দ্রজালিকতা আছে খেলাটার প্রকৃতিতে। মানুষ তার হাত দিয়ে নয়, পা দিয়ে একটি চামড়ার গোলককে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেখানেই ঘটছে জাদুর ব্যাপারটা। কবি যেমন শূন্য থেকে শব্দের চেহারায় ফুল পেড়ে আনেন, তেমনি ফুটবলাররা যেন শূন্য থেকে ছোঁ মেরেই নিয়ে আসেন একেকটি গোল।
ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জার্মানির দেওয়া আটটি গোলই ছিল এমন শূন্য থেকে সৃষ্টি করার কবিত্বে মাখা। এ জন্যই পেলে বা ম্যারাডোনার খেলাকে ‘পোয়েট্রি ইন মোশন’ বা চলমান কবিতা বলা হয়।
No comments