দুর্নীতি দমন-মূল দায়িত্ব দুদকের নয় -সরকারের by আলী ইমাম মজুমদার
একটি সমাজের সুস্থ মূল্যবোধের সঙ্গে দুর্নীতি সাংঘর্ষিক হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে সাজা বহালকৃত ব্যক্তি যখন সমাজে নন্দিত এবং কোনো একপর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের নির্ণায়ক হয়, তখন ধরে নিতে হবে, প্রকৃতপক্ষে সে সমাজের মূল্যবোধে দুর্নীতি তেমন কোনো অপরাধ নয়। কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির মাধ্যমে লব্ধ সম্পদে তার পরিবার-পরিজন এমনকি পিতা-মাতাকে যখন গর্বিত মনে হয়, তখন উপরিউক্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। তার ওপর সেই বিত্তবান যখন তার সম্পদের ছিটেফোঁটা তার স্বজন কিংবা অনুসারীদের মধ্যে ভাগ করে নেয় তখন তো তার সামাজিক মান-মর্যাদাও বেড়ে যায়। পাশাপাশি সৎ জীবনযাপনকারী কোনো ব্যক্তি যখন তার স্বজনদের আর্থিক সহায়তায় স্বাভাবিক কারণেই আশানুরূপ সাড়া দিতে পারে না; সে তো স্বার্থপর কিংবা নিদেনপক্ষে অক্ষম বলে চিহ্নিত হয়। সমস্যাটা খুবই গভীরে এবং সমাধানও অব্যাহত কঠোর প্রয়াসেই মিলবে। দুর্নীতিকে সমাজজীবনে শুধু কথা নয়, বাস্তবেও নিন্দনীয় করার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে জনগণের মধ্যে। এর জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে জনমত গঠনের মূল দায়িত্বে থাকার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর। পাশাপাশি সিভিল সমাজকেও দুর্নীতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগে এটি সহায়ক হবে।
দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রয়োগের সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন, তা সঠিক সময়ে যথাযথভাবে প্রয়োগে রাষ্ট্রযন্ত্রকেই সচেষ্ট ও সক্রিয় থাকতে হবে। সম্ভবত আমাদের স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন (Prevention of Corruption Act) তারই একটি প্রয়াস। এটা প্রয়োগের দায়িত্বে ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। সূচনাতে ব্যুরো বেশ কিছুটা কার্যকর ছিল, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সময়ের স্রোতে এবং মূলত রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকারের অভাবে ব্যুরো হারিয়ে ফেলে তার সক্ষমতা। সিভিল সমাজের ক্রমবর্ধমান দাবি এবং প্রধানত উন্নয়ন-সহযোগীদের একরকম বেঁধে দেওয়া শর্তেই ২০০৪ সালে সংসদের আইন দ্বারা গঠন করা হয় ‘স্বাধীন’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিয়োগ পান কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দুজন কমিশনার। আইন দ্বারা তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছিল। নিয়োগও হয়েছিল সেই আইনের বিধান অনুসারে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাছাই কমিটির সুপারিশে। সে কমিটির দুজন সদস্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক। অপর দুজন সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা এবং শুধু একজন নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব)। তার পরও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পূর্ব পর্যন্ত সেই কমিশন কার্যত নিষ্ক্রিয়ই ছিল। পরস্পরের সঙ্গে কলহ আর বিলুপ্ত ব্যুরোর কর্মচারীদের দুদকে নিয়োগের জন্য বাছাই করতেই চলে গেল মূল্যবান দুটো বছর। জাতীয় জীবনে দুর্নীতির অব্যাহত বিস্তার রোধে তারা কোনো অবদানই রাখতে পারল না।
২০০৭ সালের এক-এগারো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বিতর্কের অবসান কবে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এখানে এ প্রসঙ্গটি পাশ কাটানো যাবে না। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই আইনি প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠিত হয় কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুদক আইনে কিছু অর্থবহ সংশোধনও করেছিল। দুদককে আশাতীত সক্রিয় হতে দেখা গেল। তখনকার সরকার তাদের জনবলকাঠামো, বিধিমালা ইত্যাদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করে তাদের যানবাহন ও অর্থের জোগান দেয়। ফলে কমিশন সক্রিয় হওয়ার জন্য এগুলো কিছুটা অবদান রেখেছে। তবে নেপথ্যকথাও অনেকের জানা। গুরুতর অপরাধ দমনসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি এবং এর অধীনস্থ টাস্কফোর্সগুলোই এই অতিসক্রিয়তার মূল চালিকাশক্তি ছিল। অনেকের মতে, সরকারের আর একটি সংস্থার তৎপরতাও এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নেপথ্যশক্তি বললে বরং তাদের ভূমিকাকে গৌণ করা হবে। তাদের ব্যাপক প্রভাব দুদকে ছিল এটা কারও অবিদিত নয়। সুতরাং দুদকের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা তখনো প্রশ্নবিদ্ধই ছিল। তদুপরি জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা প্রয়োগে দুদক/টাস্কফোর্স বিভিন্ন ব্যক্তির আয়কর বিবরণী ও ব্যাংক হিসাব তাদের আওতায় নিয়ে সেগুলোই মূলত মামলার মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুদক আইনে এসব বিবরণী তলব করার বিধান সন্নিবেশ করার জন্য দুদকের পুনঃপুনঃ প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ই নাকচ করা হয়েছে। আয়কর বিবরণী ও ব্যাংক হিসাবের গোপনীয়তা সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা সুরক্ষিত। এসব আইনি বিধানের যৌক্তিকতা কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা যায় না। আর জরুরি ক্ষমতা বিধিমালায় এগুলো প্রাপ্তির বিধান সন্নিবেশের যৌক্তিকতা জরুরি অবস্থা জারির যৌক্তিকতার মধ্যেই খুঁজতে হবে।
সুতরাং, জরুরি অবস্থা চলাকালে দুদকের সক্রিয়তা তার আইনি বা প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতার পুরো পরিচয় বহন করে না। এ সক্ষমতা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। এখনো দুদক আইন সম্পূর্ণ বহাল থাকলেও গত প্রায় দেড় বছরের কর্মকাণ্ডে দুদক তো তেমন কোনো ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। সক্রিয়তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি সরকারের নেওয়া দুদক আইন সংশোধনের একটি খসড়া বিতর্কের ঝড় তুলেছে। সংশোধনীগুলো সম্পর্কে মিডিয়ায় যেটুকু এসেছে তাতে প্রধানত রয়েছে দুদককে তার কার্যক্রমের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করা, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পূর্বে সরকারের অনুমোদন গ্রহণ, তদন্তকালে সমমানের কর্মকর্তা কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ, সরকার কর্তৃক দুদকের সচিব নিয়োগ এবং দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য বাদীর শাস্তির ব্যবস্থা। দেখা দরকার বিষয়গুলো গুরুত্ব নিয়ে সামনে এলো কেন।
দুদক কোনো সাংবিধানিক সংস্থা নয়, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগেরই একটি অংশ। সমাজ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন দ্বারা গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। আইন দ্বারা তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত এবং পদ-পদবি সুরক্ষিত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এসব বিষয় নিয়ে নেপথ্যে অনেক বিতর্ক হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় এগুলো হালে পানি পায়নি। নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দুদক কমিশনাররা সার্বভৌম সংসদের একটি কমিটিতে উপস্থিত না হয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাঁরাই কি বারবার সরকারের কোনো কোনো দপ্তরে হাজির হয়ে সভায় অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কাজের নিকাশ দেননি? তখনো অলিখিতভাবে তাঁরা বিভিন্ন মহলের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তবে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ হলে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্ন উঠবে কেন? সরকার তার সব কাজের জন্য তথা দুদকের কাজের জন্যও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই দুদক যাতে সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে লক্ষ্যে সর্বতোভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন দেওয়া সরকারের ন্যায্য অধিকার ও কর্তব্য। এতে অযথা হস্তক্ষেপ মনে করার কোনো কারণ নেই।
এরপর আসে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দুদক যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল তখন মামলা হয় মূলত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রের শুধু নির্বাহী বিভাগের কিছু বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তখনই সরকারি কর্মকর্তারা ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রদত্ত তাঁদের আইনি সুরক্ষার দাবি করতে থাকেন। বিশেষ কিছু মামলা যেমন চট্টগ্রামের সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে বিজয় টিভির মামলায় অর্থ ছাড় এবং মূল কাজ শেষ হওয়ার পর করপোরেশনের তদানীন্তন সচিব শুধু ভাউচারগুলো গ্রহণ করার জন্যই চার্জশিটভুক্ত ও গ্রেপ্তার হন। ভালুকার একজন চিহ্নিত ভূমিদস্যুর প্ররোচনায় সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ভুয়া ফাঁদপাতা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তাঁদের খালাস দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের ভোগান্তি কি কেউ আর ফেরত নিতে পারবে? এ ধরনের মামলা নিয়ে দুদকের সঙ্গে নিষ্ফল দেনদরবারে মনে হয়েছে, ক্ষমতা হেথা নয়, অন্য কোথাও। মনে করা হতো, দুর্নীতি শুধুই নির্বাহী বিভাগে বেসামরিক কর্মচারীদের কাজ। বাস্তবতা কি তাই? তখন যদি দুদক রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োজিত অন্য সব বিভাগ/সংস্থা/দপ্তরের চিহ্নিত দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের অভিযুক্ত করত, তাহলে এ দাবি এতটা হয়তো জোরদার হতো না। বরং দুদক সত্যিকারের স্বাধীন ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারত। হয়তো বা সীমাবদ্ধতার কথাই আসবে। তাহলে স্বাধীনতা হরণের প্রশ্নটি আসে কেন?
আমি নিশ্চিত, ওপরের অনুচ্ছেদ দুটোতে আমার মতামত পেশাগত পক্ষপাতমূলক বলে অনেকের কাছেই চিহ্নিত হতে পারে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের না-হক হয়রানি রোধে এ ধরনের বিধান অপরিহার্য। তবে অনুমোদন-প্রক্রিয়া অতিদ্রুত নিষ্পন্ন হওয়া কিংবা অনুমোদন না দেওয়ার কারণ দুদককে অবগত করার আইনি বিধান থাকা আবশ্যক। সরকারপ্রধানের কাছে শীর্ষপর্যায়ের জনসেবকদের বিষয়টিই অনুমোদনের জন্য যেতে পারে। অন্যদের জন্য একাধিক পর্যায়ে কমিটি গঠন করে প্রক্রিয়াটি সময়াবদ্ধ করা আবশ্যক। তদুপরি দণ্ডবিধির জনসেবক সংজ্ঞাটি শুধু সরকারি কর্মচারী নয়, প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও হওয়া আবশ্যক। তারা একই সুরক্ষার আওতায় আসা সমীচীন। তবে ঘুষ গ্রহণকালে হাতেনাতে ধৃত এবং জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদের অধিকারী জনসেবকদের (?) এ সুরক্ষার আওতায় আনা সংগত হবে না।
দুদক মামলা দায়ের এবং আসামি চিহ্নিত করার বিষয়ে আরও সতর্ক ও বাস্তববাদী হলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। কোনো একটি কেনাকাটার মামলায় সংস্থার বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটি এবং এর দুর্ভাগা সচিব (মন্ত্রিপরিষদের সচিব) এবং সবশেষে শুধু অনুমোদন-সূচক স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য সরকারপ্রধান পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সবাইকে সংশ্লিষ্ট করার সংস্কৃতি পরিহার করা আবশ্যক। কোনো একটি কেনাকাটা বা বিক্রিবিষয়ক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় হাজিরা তালিকা দেখে সবাইকে আসামিভুক্ত করে দলে-বলে নাজেহাল করার বিষয়টিও একইভাবে পরিহারযোগ্য। বেআইনিভাবে কে লাভবান হলো, কার দায়িত্ব অবহেলার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হলো, বা কে ঘুষ গ্রহণ করল তা চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলা করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। প্রক্রিয়াটিতে যারা নামে মাত্র যান্ত্রিকভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের অভিযুক্ত করে একটি মামলাতেও কি দুদক কোনো ফল পেয়েছে? মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটি ও সরকারপ্রধান সাধারণত প্রক্রিয়াগত বিষয়টিই বিবেচনায় রাখেন। প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন ব্যতীত সব ক্ষেত্রে এ ধরনের মামলায় তাঁদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করার ফলে জাতীয় নেতাদের চরিত্র হননই চলছে। দুর্নীতির নেপথ্য কারিগরদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমেই দুদক তার অবস্থানকে সুদৃঢ় অর্থবহ করে তুলতে পারে। ছোটখাটো কর্মচারীর তিন-চার হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের সময় ফাঁদ পাতাকে বেআইনি বা অনৈতিক বলা যাবে না। তবে দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং দুদকের বিশাল দায়িত্ব বিবেচনায় এটি কম গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের এ ধরনের অভিযান লক্ষণীয়। ফাঁদ পাতার বিষয়টিও এককভাবে দুদকের পরিচালনা করা ঠিক হবে না। তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের নৈতিকতার মান কোন স্তরের তা একটু খোঁজ করলেই জানা যায়। এর বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তা করা উচিত। আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা সেই ক্যাডারের উচ্চপদাধিকারীদের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতা আবশ্যক হলে একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তা পরিচালনা করাই শ্রেয় হবে। মিথ্যা মামলার জন্য বাদীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান দণ্ডবিধিতেও রয়েছে। তবে দুর্নীতির মামলায় এ বিধান সংযোজনে দুদক কর্মকর্তাদের মনোবলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তদন্তকালে সমমানের কর্মকর্তার আবশ্যকও বাস্তবসম্মত হবে না। সরকারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার সুবিধার্থে দুদকের সচিবকে সরকারের নিয়োগ দেওয়াই যৌক্তিক। সরকারি কর্ম কমিশন এমনকি অনেক বেশি স্পর্শকাতর নির্বাচন কমিশনেও এ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব সম্পাদনে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলে জানা যায় না।
পরিশেষে, দুর্নীতি দমনের মূল দায়িত্ব সরকারের। দুদক সরকারের এ দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। এ সংস্থাটিকে জনবল, অর্থ, আইনি লড়াইসহ সব বিষয়ে সামগ্রিক ও পক্ষপাতহীন সহায়তা দেওয়া সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। দুর্বলকে রক্ষা ও দুর্জনকে আঘাত হানা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই আবশ্যক। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে এর বিকল্প নেই। দুদকও কেন সংসদীয় কমিটির আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে গণতান্ত্রিক সরকারের সূচনাতেই একটি বৈরী পরিবেশ টেনে আনল তা বোধগম্য নয়। সংসদ ও সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া কি প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারবে? দুদক সয়ম্ভূ নয় এবং এর অসীম ও নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতাও আবশ্যক নয়। ভারতের দৃষ্টান্ত তারা দেখে নিতে পারে। আর সরকার দুদককে দুর্বল করলে প্রকারান্তরে সরকারই দুর্বল হয়ে যাবে, এটা বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে। খসড়া সংশোধনীগুলো চূড়ান্ত বিবেচনার সময় তাই যথেষ্ট যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সতর্কতা আবশ্যক। দুর্নীতি রোধে সিভিল সমাজের মতামত এবং উন্নয়ন-সহযোগীদের দাবি যথেষ্ট সংবেদনশীল বলে এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা আবশ্যক। সরকার যদি তার সব শক্তি নিয়ে দুদকের পাশে না থাকে, তবে একে আইন দ্বারা আরও শক্তিশালী করা হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক কেবিনেট সচিব।
দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রয়োগের সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন, তা সঠিক সময়ে যথাযথভাবে প্রয়োগে রাষ্ট্রযন্ত্রকেই সচেষ্ট ও সক্রিয় থাকতে হবে। সম্ভবত আমাদের স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন (Prevention of Corruption Act) তারই একটি প্রয়াস। এটা প্রয়োগের দায়িত্বে ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। সূচনাতে ব্যুরো বেশ কিছুটা কার্যকর ছিল, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সময়ের স্রোতে এবং মূলত রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকারের অভাবে ব্যুরো হারিয়ে ফেলে তার সক্ষমতা। সিভিল সমাজের ক্রমবর্ধমান দাবি এবং প্রধানত উন্নয়ন-সহযোগীদের একরকম বেঁধে দেওয়া শর্তেই ২০০৪ সালে সংসদের আইন দ্বারা গঠন করা হয় ‘স্বাধীন’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিয়োগ পান কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দুজন কমিশনার। আইন দ্বারা তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছিল। নিয়োগও হয়েছিল সেই আইনের বিধান অনুসারে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাছাই কমিটির সুপারিশে। সে কমিটির দুজন সদস্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক। অপর দুজন সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা এবং শুধু একজন নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব)। তার পরও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পূর্ব পর্যন্ত সেই কমিশন কার্যত নিষ্ক্রিয়ই ছিল। পরস্পরের সঙ্গে কলহ আর বিলুপ্ত ব্যুরোর কর্মচারীদের দুদকে নিয়োগের জন্য বাছাই করতেই চলে গেল মূল্যবান দুটো বছর। জাতীয় জীবনে দুর্নীতির অব্যাহত বিস্তার রোধে তারা কোনো অবদানই রাখতে পারল না।
২০০৭ সালের এক-এগারো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বিতর্কের অবসান কবে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এখানে এ প্রসঙ্গটি পাশ কাটানো যাবে না। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই আইনি প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠিত হয় কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুদক আইনে কিছু অর্থবহ সংশোধনও করেছিল। দুদককে আশাতীত সক্রিয় হতে দেখা গেল। তখনকার সরকার তাদের জনবলকাঠামো, বিধিমালা ইত্যাদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করে তাদের যানবাহন ও অর্থের জোগান দেয়। ফলে কমিশন সক্রিয় হওয়ার জন্য এগুলো কিছুটা অবদান রেখেছে। তবে নেপথ্যকথাও অনেকের জানা। গুরুতর অপরাধ দমনসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি এবং এর অধীনস্থ টাস্কফোর্সগুলোই এই অতিসক্রিয়তার মূল চালিকাশক্তি ছিল। অনেকের মতে, সরকারের আর একটি সংস্থার তৎপরতাও এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নেপথ্যশক্তি বললে বরং তাদের ভূমিকাকে গৌণ করা হবে। তাদের ব্যাপক প্রভাব দুদকে ছিল এটা কারও অবিদিত নয়। সুতরাং দুদকের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা তখনো প্রশ্নবিদ্ধই ছিল। তদুপরি জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা প্রয়োগে দুদক/টাস্কফোর্স বিভিন্ন ব্যক্তির আয়কর বিবরণী ও ব্যাংক হিসাব তাদের আওতায় নিয়ে সেগুলোই মূলত মামলার মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুদক আইনে এসব বিবরণী তলব করার বিধান সন্নিবেশ করার জন্য দুদকের পুনঃপুনঃ প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ই নাকচ করা হয়েছে। আয়কর বিবরণী ও ব্যাংক হিসাবের গোপনীয়তা সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা সুরক্ষিত। এসব আইনি বিধানের যৌক্তিকতা কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা যায় না। আর জরুরি ক্ষমতা বিধিমালায় এগুলো প্রাপ্তির বিধান সন্নিবেশের যৌক্তিকতা জরুরি অবস্থা জারির যৌক্তিকতার মধ্যেই খুঁজতে হবে।
সুতরাং, জরুরি অবস্থা চলাকালে দুদকের সক্রিয়তা তার আইনি বা প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতার পুরো পরিচয় বহন করে না। এ সক্ষমতা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। এখনো দুদক আইন সম্পূর্ণ বহাল থাকলেও গত প্রায় দেড় বছরের কর্মকাণ্ডে দুদক তো তেমন কোনো ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। সক্রিয়তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি সরকারের নেওয়া দুদক আইন সংশোধনের একটি খসড়া বিতর্কের ঝড় তুলেছে। সংশোধনীগুলো সম্পর্কে মিডিয়ায় যেটুকু এসেছে তাতে প্রধানত রয়েছে দুদককে তার কার্যক্রমের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করা, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পূর্বে সরকারের অনুমোদন গ্রহণ, তদন্তকালে সমমানের কর্মকর্তা কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ, সরকার কর্তৃক দুদকের সচিব নিয়োগ এবং দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য বাদীর শাস্তির ব্যবস্থা। দেখা দরকার বিষয়গুলো গুরুত্ব নিয়ে সামনে এলো কেন।
দুদক কোনো সাংবিধানিক সংস্থা নয়, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগেরই একটি অংশ। সমাজ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন দ্বারা গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। আইন দ্বারা তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত এবং পদ-পদবি সুরক্ষিত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এসব বিষয় নিয়ে নেপথ্যে অনেক বিতর্ক হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় এগুলো হালে পানি পায়নি। নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দুদক কমিশনাররা সার্বভৌম সংসদের একটি কমিটিতে উপস্থিত না হয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাঁরাই কি বারবার সরকারের কোনো কোনো দপ্তরে হাজির হয়ে সভায় অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কাজের নিকাশ দেননি? তখনো অলিখিতভাবে তাঁরা বিভিন্ন মহলের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তবে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ হলে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্ন উঠবে কেন? সরকার তার সব কাজের জন্য তথা দুদকের কাজের জন্যও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই দুদক যাতে সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে লক্ষ্যে সর্বতোভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন দেওয়া সরকারের ন্যায্য অধিকার ও কর্তব্য। এতে অযথা হস্তক্ষেপ মনে করার কোনো কারণ নেই।
এরপর আসে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দুদক যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল তখন মামলা হয় মূলত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রের শুধু নির্বাহী বিভাগের কিছু বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তখনই সরকারি কর্মকর্তারা ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রদত্ত তাঁদের আইনি সুরক্ষার দাবি করতে থাকেন। বিশেষ কিছু মামলা যেমন চট্টগ্রামের সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে বিজয় টিভির মামলায় অর্থ ছাড় এবং মূল কাজ শেষ হওয়ার পর করপোরেশনের তদানীন্তন সচিব শুধু ভাউচারগুলো গ্রহণ করার জন্যই চার্জশিটভুক্ত ও গ্রেপ্তার হন। ভালুকার একজন চিহ্নিত ভূমিদস্যুর প্ররোচনায় সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ভুয়া ফাঁদপাতা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তাঁদের খালাস দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের ভোগান্তি কি কেউ আর ফেরত নিতে পারবে? এ ধরনের মামলা নিয়ে দুদকের সঙ্গে নিষ্ফল দেনদরবারে মনে হয়েছে, ক্ষমতা হেথা নয়, অন্য কোথাও। মনে করা হতো, দুর্নীতি শুধুই নির্বাহী বিভাগে বেসামরিক কর্মচারীদের কাজ। বাস্তবতা কি তাই? তখন যদি দুদক রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োজিত অন্য সব বিভাগ/সংস্থা/দপ্তরের চিহ্নিত দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের অভিযুক্ত করত, তাহলে এ দাবি এতটা হয়তো জোরদার হতো না। বরং দুদক সত্যিকারের স্বাধীন ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারত। হয়তো বা সীমাবদ্ধতার কথাই আসবে। তাহলে স্বাধীনতা হরণের প্রশ্নটি আসে কেন?
আমি নিশ্চিত, ওপরের অনুচ্ছেদ দুটোতে আমার মতামত পেশাগত পক্ষপাতমূলক বলে অনেকের কাছেই চিহ্নিত হতে পারে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের না-হক হয়রানি রোধে এ ধরনের বিধান অপরিহার্য। তবে অনুমোদন-প্রক্রিয়া অতিদ্রুত নিষ্পন্ন হওয়া কিংবা অনুমোদন না দেওয়ার কারণ দুদককে অবগত করার আইনি বিধান থাকা আবশ্যক। সরকারপ্রধানের কাছে শীর্ষপর্যায়ের জনসেবকদের বিষয়টিই অনুমোদনের জন্য যেতে পারে। অন্যদের জন্য একাধিক পর্যায়ে কমিটি গঠন করে প্রক্রিয়াটি সময়াবদ্ধ করা আবশ্যক। তদুপরি দণ্ডবিধির জনসেবক সংজ্ঞাটি শুধু সরকারি কর্মচারী নয়, প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও হওয়া আবশ্যক। তারা একই সুরক্ষার আওতায় আসা সমীচীন। তবে ঘুষ গ্রহণকালে হাতেনাতে ধৃত এবং জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদের অধিকারী জনসেবকদের (?) এ সুরক্ষার আওতায় আনা সংগত হবে না।
দুদক মামলা দায়ের এবং আসামি চিহ্নিত করার বিষয়ে আরও সতর্ক ও বাস্তববাদী হলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। কোনো একটি কেনাকাটার মামলায় সংস্থার বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটি এবং এর দুর্ভাগা সচিব (মন্ত্রিপরিষদের সচিব) এবং সবশেষে শুধু অনুমোদন-সূচক স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য সরকারপ্রধান পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সবাইকে সংশ্লিষ্ট করার সংস্কৃতি পরিহার করা আবশ্যক। কোনো একটি কেনাকাটা বা বিক্রিবিষয়ক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় হাজিরা তালিকা দেখে সবাইকে আসামিভুক্ত করে দলে-বলে নাজেহাল করার বিষয়টিও একইভাবে পরিহারযোগ্য। বেআইনিভাবে কে লাভবান হলো, কার দায়িত্ব অবহেলার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হলো, বা কে ঘুষ গ্রহণ করল তা চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলা করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। প্রক্রিয়াটিতে যারা নামে মাত্র যান্ত্রিকভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের অভিযুক্ত করে একটি মামলাতেও কি দুদক কোনো ফল পেয়েছে? মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটি ও সরকারপ্রধান সাধারণত প্রক্রিয়াগত বিষয়টিই বিবেচনায় রাখেন। প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন ব্যতীত সব ক্ষেত্রে এ ধরনের মামলায় তাঁদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করার ফলে জাতীয় নেতাদের চরিত্র হননই চলছে। দুর্নীতির নেপথ্য কারিগরদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমেই দুদক তার অবস্থানকে সুদৃঢ় অর্থবহ করে তুলতে পারে। ছোটখাটো কর্মচারীর তিন-চার হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের সময় ফাঁদ পাতাকে বেআইনি বা অনৈতিক বলা যাবে না। তবে দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং দুদকের বিশাল দায়িত্ব বিবেচনায় এটি কম গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের এ ধরনের অভিযান লক্ষণীয়। ফাঁদ পাতার বিষয়টিও এককভাবে দুদকের পরিচালনা করা ঠিক হবে না। তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের নৈতিকতার মান কোন স্তরের তা একটু খোঁজ করলেই জানা যায়। এর বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তা করা উচিত। আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা সেই ক্যাডারের উচ্চপদাধিকারীদের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতা আবশ্যক হলে একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তা পরিচালনা করাই শ্রেয় হবে। মিথ্যা মামলার জন্য বাদীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান দণ্ডবিধিতেও রয়েছে। তবে দুর্নীতির মামলায় এ বিধান সংযোজনে দুদক কর্মকর্তাদের মনোবলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তদন্তকালে সমমানের কর্মকর্তার আবশ্যকও বাস্তবসম্মত হবে না। সরকারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার সুবিধার্থে দুদকের সচিবকে সরকারের নিয়োগ দেওয়াই যৌক্তিক। সরকারি কর্ম কমিশন এমনকি অনেক বেশি স্পর্শকাতর নির্বাচন কমিশনেও এ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব সম্পাদনে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলে জানা যায় না।
পরিশেষে, দুর্নীতি দমনের মূল দায়িত্ব সরকারের। দুদক সরকারের এ দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। এ সংস্থাটিকে জনবল, অর্থ, আইনি লড়াইসহ সব বিষয়ে সামগ্রিক ও পক্ষপাতহীন সহায়তা দেওয়া সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। দুর্বলকে রক্ষা ও দুর্জনকে আঘাত হানা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই আবশ্যক। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে এর বিকল্প নেই। দুদকও কেন সংসদীয় কমিটির আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে গণতান্ত্রিক সরকারের সূচনাতেই একটি বৈরী পরিবেশ টেনে আনল তা বোধগম্য নয়। সংসদ ও সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া কি প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারবে? দুদক সয়ম্ভূ নয় এবং এর অসীম ও নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতাও আবশ্যক নয়। ভারতের দৃষ্টান্ত তারা দেখে নিতে পারে। আর সরকার দুদককে দুর্বল করলে প্রকারান্তরে সরকারই দুর্বল হয়ে যাবে, এটা বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে। খসড়া সংশোধনীগুলো চূড়ান্ত বিবেচনার সময় তাই যথেষ্ট যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সতর্কতা আবশ্যক। দুর্নীতি রোধে সিভিল সমাজের মতামত এবং উন্নয়ন-সহযোগীদের দাবি যথেষ্ট সংবেদনশীল বলে এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা আবশ্যক। সরকার যদি তার সব শক্তি নিয়ে দুদকের পাশে না থাকে, তবে একে আইন দ্বারা আরও শক্তিশালী করা হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক কেবিনেট সচিব।
No comments