বাঘার পদ্মাগর্ভে ডুবো-স্থাপত্যকীর্তি by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
রাজশাহীর বাঘায় পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত পুরাকীর্তি—একটি বিশালকায় স্থাপনার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রতিদিনই নদীপাড়ে উত্সুক দর্শনার্থীদের ঢল নামছে। সংবাদপত্রে ও টিভি চ্যানেলগুলোতে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ায় জনমনে আগ্রহ যেন বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের পুরাবস্তু রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিরা সরেজমিনে জায়গাটি দেখে গেছেন। লাল নিশান টাঙিয়ে সংরক্ষিত সরকারি এলাকা বলে ঘোষণাও দিয়েছেন তাঁরা। আকস্মিকভাবেই স্থাপনাটির প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। স্থানীয় লোকজনই এর সন্ধান লাভ করে। অতিদ্রুতই সুযোগসন্ধানী লোকজন এখান থেকে ইট, কাঠ কিছু নিয়েও গেছে নিজেদের বাড়িতে।
স্থাপনাটি কোন সময়ের? বিষয়টি এখনো সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছে না। ‘আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফ’ পেলে অবশ্য অনেকটা সহজ হবে এর সময়কাল নিয়ে কথা বলা। তবে স্থাপনাটির সঙ্গে যে ইতিহাসের গভীর যোগসূত্র রয়েছে, তা খানিকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এই বাঘার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মুসলিম শাসকদের গৌড়-বঙ্গ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে না হলেও কিছুকাল পরে বাঘা মুসলিম শাসনের একটি প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত হয় কসবে বাঘা নামে। স্থাপিত হয় মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। গৌড়ের স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহর (১৫২৩-২৪) আমলে অপূর্ব কারুকার্যখচিত মসজিদ এখানে নির্মিত হয়। বাঘা মাদ্রাসায় তর্কবিদ্যা, গণিত, চিকিত্সাবিজ্ঞান, আলকেমি (রসায়নবিদ্যা), হিনদাসা (জ্যামিতি), ফিকহ, তারিখ (ইতিহাস), জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতি প্রাগ্রসর বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব তথ্য সংগ্রহের জন্যই ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম এডাম বাঘায় আসেন এবং তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান। তবে উইলিয়াম এডাম মূল মাদ্রাসা কোথায় ছিল, সে তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। এখনো আমরা জানি না, বাঘার সেই মাদ্রাসাটি কোথায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। একটি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারবাকাবাদের অন্তর্গত একটি পরগনা ছিল লস্করপুর পরগনা নামে। লস্কর খাঁ নামের এক পাঠান জায়গিরদার এই পরগনার প্রতিষ্ঠাতা। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে এই লস্করপুরের উল্লেখ আছে। এই লস্করপুর পরগনার প্রধান কেন্দ্র ছিল আলাইপুর, এখানে সেনাছাউনিও ছিল। মোগল সুবাদার ইসলাম খানের শাসনামলে বাংলার সামন্ত জমিদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শঙ্কিত সুবাদার এদের প্রতিপত্তি স্তব্ধ করার উদ্যোগ নেন। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও তাঁর পুত্রকে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় এনে নজরবন্দী করা হয় বাকলার রামচন্দ্রকে। লস্করপুর পরগনার জমিদার আলাবশখ বরখুরদার লস্করির অধস্তন পুরুষ বরখুরদারের বিরুদ্ধেও মোগল প্রশাসন সোচ্চার হয়। বরখুরদার বাধা দিলে মোগল সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে বরখুরদার পরাস্ত হন। ইসলাম খান লস্করপুর পরগনার জমিদারি মোগলদের আশীর্বাদপুষ্ট জমিদার পুঠিয়ার পিতাম্বরকে দিয়ে দেন। শক্তি সঞ্চয় করে বরখুরদারের পুত্র পরবর্তী সময়ে পিতৃ-জমিদারি উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও সম্রাট জাহাঙ্গীরের অমাত্য মির্জা নাথানের হাতে পরাস্ত হন। আলাইপুরেই তিনি জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বাঘার আরেক খ্যাতি, ষোলো শতকের শুরুতে এখানে পদ্মা নদীপথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এসেছিলেন হজরত শাহদ্দৌলা—প্রকৃত নাম শাহ মুয়াজ্জিম দানিশমন্দ। তিনি ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের বংশধর। এই সাধক আলা বখশ বরখুরদারের কন্যা জেবুন্নেসার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর জে এস কার্সটেইনস এই শাহ মুয়াজ্জিম দানিশমন্দ সম্পর্কে একটি আখ্যান তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন: গৌড়ের একজন সুলতান ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন, এখানে এক দিনের জন্য যাত্রাবিরতি করেন। রাতে আগুনের প্রয়োজন হলে লোকজন আগুনের সন্ধান করতে বেরোয়। লোকজন দেখতে পায়, জঙ্গলের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, পাশে ধ্যানমগ্ন এক ফকির, তাঁকে চারদিকে পাহারা দিচ্ছে বাঘের দল। লোকজন সুলতানকে বিষয়টি অবহিত করলে, সুলতান স্বয়ং গিয়ে ঘটনাটি দেখেন। বিস্মিত সুলতান ফকিরের কাছে জানতে চান, এখন তাঁর ঢাকা অভিযানে যাওয়া সমীচীন হবে কি না। ফকির তাঁকে এক দিন অপেক্ষা করতে বলেন। পরদিন ঢাকা থেকে দূত এসে সুলতানকে যুদ্ধ বিজয়ের সংবাদ জানায়। সুলতান ফকিরের কামালিয়াতে অভিভূত হন এবং কিছু নিষ্কর জমি গ্রহণের অনুরোধ জানান। পার্থিব সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত ফকির পুত্র হামিদ দানিশমান্দকে তা প্রদানের ইঙ্গিত করেন। সুলতান প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪২ মৌজার লাখেরাজ ভূমি দান করেন। অনুমান করা হয়, ইনিই সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরাত শাহ, যাঁর শাসনকালে বাঘায় অপূর্ব শিল্পসুষমামণ্ডিত মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মহান সাধক হজরত শাহদ্দৌলার নামানুসারে লস্করপুর পরগনা এ সময় মখদুমপুর নামে পরিচিত হয়।
পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত স্থাপনাটি লস্করপুর পরগনার জমিদারির কোনো স্থাপনা নয় তো? নদীপথে আলাইপুরের সেই বর্ধিষ্ণু আর অভিজাত স্থাপনা কোথায় ছিল? দিল্লির আর গৌড়ের শাসকেরা পদ্মা নদীপথে যেতে যেখানে যাত্রাবিরতি করতেন। মিরজা নাথানের বাহারীস্তান-ই গয়বীর বিবরণমতে, সম্রাট শাহজাহান ঢাকা থেকে রাজমহল যেতে কালবৈশাখীর কবলে পড়ে এই আলাইপুরে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে পরে রাজমহল হয়ে পাটনা ফিরে গিয়েছিলেন। সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল থেকে পদ্মার নদীপথে ঘোড়াঘাট যাত্রা করেন। এই আলাইপুরেই সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন বলে সহযাত্রী আবদুল লতিফ, ফারসি ভাষায় লেখা তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন। দিল্লি-গৌড়ের সেই রাজকীয় অতিথিদের সাময়িক অবস্থানের নিবাসই বা কোথায় ছিল?
আদতেই ইতিহাসের অনেক গৌরবের সাক্ষ্য বাঘা, মখদুমপুর, লস্করপুর ও আলাইপুর। নিমজ্জিত স্থাপনা তারই অংশ সন্দেহ নেই। ভূমিধসে অথবা ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে তখনকার পদ্মাতীরের সেই স্থাপনাই কি এখন এ অবস্থায়?
আমাদের ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত উদ্ধার ও সংরক্ষণের স্বার্থে পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত স্থাপত্যকীর্তি রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া জরুরি। এবং সে কাজ করতে হবে খুব দ্রুত; বর্তমানের ক্ষীণতোয়া পদ্মা প্রমত্তা হয়ে ওঠার আগেই। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে খুব একটা দেরি নেই। বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ইউনেসকোর এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। ২০০৩ সালে ইউনেসকো জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকদের সহায়তায় দক্ষিণ ফ্রান্সের রেন নদীর গর্ভ থেকে আরলস নগরের অনেক প্রাচীন কীর্তি উদ্ধার করে দিয়েছে। গভীর সমুদ্র ও অরণ্যের সংস্কৃতিচর্চায় বিশ্বব্যাপী কাজ করছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেল—ইউনেসকোর মাধ্যমে তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা আমাদের সরকারের।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
স্থাপনাটি কোন সময়ের? বিষয়টি এখনো সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছে না। ‘আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফ’ পেলে অবশ্য অনেকটা সহজ হবে এর সময়কাল নিয়ে কথা বলা। তবে স্থাপনাটির সঙ্গে যে ইতিহাসের গভীর যোগসূত্র রয়েছে, তা খানিকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এই বাঘার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মুসলিম শাসকদের গৌড়-বঙ্গ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে না হলেও কিছুকাল পরে বাঘা মুসলিম শাসনের একটি প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত হয় কসবে বাঘা নামে। স্থাপিত হয় মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। গৌড়ের স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহর (১৫২৩-২৪) আমলে অপূর্ব কারুকার্যখচিত মসজিদ এখানে নির্মিত হয়। বাঘা মাদ্রাসায় তর্কবিদ্যা, গণিত, চিকিত্সাবিজ্ঞান, আলকেমি (রসায়নবিদ্যা), হিনদাসা (জ্যামিতি), ফিকহ, তারিখ (ইতিহাস), জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতি প্রাগ্রসর বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব তথ্য সংগ্রহের জন্যই ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম এডাম বাঘায় আসেন এবং তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান। তবে উইলিয়াম এডাম মূল মাদ্রাসা কোথায় ছিল, সে তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। এখনো আমরা জানি না, বাঘার সেই মাদ্রাসাটি কোথায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। একটি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারবাকাবাদের অন্তর্গত একটি পরগনা ছিল লস্করপুর পরগনা নামে। লস্কর খাঁ নামের এক পাঠান জায়গিরদার এই পরগনার প্রতিষ্ঠাতা। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে এই লস্করপুরের উল্লেখ আছে। এই লস্করপুর পরগনার প্রধান কেন্দ্র ছিল আলাইপুর, এখানে সেনাছাউনিও ছিল। মোগল সুবাদার ইসলাম খানের শাসনামলে বাংলার সামন্ত জমিদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শঙ্কিত সুবাদার এদের প্রতিপত্তি স্তব্ধ করার উদ্যোগ নেন। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও তাঁর পুত্রকে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় এনে নজরবন্দী করা হয় বাকলার রামচন্দ্রকে। লস্করপুর পরগনার জমিদার আলাবশখ বরখুরদার লস্করির অধস্তন পুরুষ বরখুরদারের বিরুদ্ধেও মোগল প্রশাসন সোচ্চার হয়। বরখুরদার বাধা দিলে মোগল সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে বরখুরদার পরাস্ত হন। ইসলাম খান লস্করপুর পরগনার জমিদারি মোগলদের আশীর্বাদপুষ্ট জমিদার পুঠিয়ার পিতাম্বরকে দিয়ে দেন। শক্তি সঞ্চয় করে বরখুরদারের পুত্র পরবর্তী সময়ে পিতৃ-জমিদারি উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও সম্রাট জাহাঙ্গীরের অমাত্য মির্জা নাথানের হাতে পরাস্ত হন। আলাইপুরেই তিনি জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বাঘার আরেক খ্যাতি, ষোলো শতকের শুরুতে এখানে পদ্মা নদীপথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এসেছিলেন হজরত শাহদ্দৌলা—প্রকৃত নাম শাহ মুয়াজ্জিম দানিশমন্দ। তিনি ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের বংশধর। এই সাধক আলা বখশ বরখুরদারের কন্যা জেবুন্নেসার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর জে এস কার্সটেইনস এই শাহ মুয়াজ্জিম দানিশমন্দ সম্পর্কে একটি আখ্যান তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন: গৌড়ের একজন সুলতান ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন, এখানে এক দিনের জন্য যাত্রাবিরতি করেন। রাতে আগুনের প্রয়োজন হলে লোকজন আগুনের সন্ধান করতে বেরোয়। লোকজন দেখতে পায়, জঙ্গলের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, পাশে ধ্যানমগ্ন এক ফকির, তাঁকে চারদিকে পাহারা দিচ্ছে বাঘের দল। লোকজন সুলতানকে বিষয়টি অবহিত করলে, সুলতান স্বয়ং গিয়ে ঘটনাটি দেখেন। বিস্মিত সুলতান ফকিরের কাছে জানতে চান, এখন তাঁর ঢাকা অভিযানে যাওয়া সমীচীন হবে কি না। ফকির তাঁকে এক দিন অপেক্ষা করতে বলেন। পরদিন ঢাকা থেকে দূত এসে সুলতানকে যুদ্ধ বিজয়ের সংবাদ জানায়। সুলতান ফকিরের কামালিয়াতে অভিভূত হন এবং কিছু নিষ্কর জমি গ্রহণের অনুরোধ জানান। পার্থিব সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত ফকির পুত্র হামিদ দানিশমান্দকে তা প্রদানের ইঙ্গিত করেন। সুলতান প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪২ মৌজার লাখেরাজ ভূমি দান করেন। অনুমান করা হয়, ইনিই সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরাত শাহ, যাঁর শাসনকালে বাঘায় অপূর্ব শিল্পসুষমামণ্ডিত মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মহান সাধক হজরত শাহদ্দৌলার নামানুসারে লস্করপুর পরগনা এ সময় মখদুমপুর নামে পরিচিত হয়।
পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত স্থাপনাটি লস্করপুর পরগনার জমিদারির কোনো স্থাপনা নয় তো? নদীপথে আলাইপুরের সেই বর্ধিষ্ণু আর অভিজাত স্থাপনা কোথায় ছিল? দিল্লির আর গৌড়ের শাসকেরা পদ্মা নদীপথে যেতে যেখানে যাত্রাবিরতি করতেন। মিরজা নাথানের বাহারীস্তান-ই গয়বীর বিবরণমতে, সম্রাট শাহজাহান ঢাকা থেকে রাজমহল যেতে কালবৈশাখীর কবলে পড়ে এই আলাইপুরে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে পরে রাজমহল হয়ে পাটনা ফিরে গিয়েছিলেন। সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল থেকে পদ্মার নদীপথে ঘোড়াঘাট যাত্রা করেন। এই আলাইপুরেই সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন বলে সহযাত্রী আবদুল লতিফ, ফারসি ভাষায় লেখা তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন। দিল্লি-গৌড়ের সেই রাজকীয় অতিথিদের সাময়িক অবস্থানের নিবাসই বা কোথায় ছিল?
আদতেই ইতিহাসের অনেক গৌরবের সাক্ষ্য বাঘা, মখদুমপুর, লস্করপুর ও আলাইপুর। নিমজ্জিত স্থাপনা তারই অংশ সন্দেহ নেই। ভূমিধসে অথবা ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে তখনকার পদ্মাতীরের সেই স্থাপনাই কি এখন এ অবস্থায়?
আমাদের ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত উদ্ধার ও সংরক্ষণের স্বার্থে পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত স্থাপত্যকীর্তি রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া জরুরি। এবং সে কাজ করতে হবে খুব দ্রুত; বর্তমানের ক্ষীণতোয়া পদ্মা প্রমত্তা হয়ে ওঠার আগেই। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে খুব একটা দেরি নেই। বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ইউনেসকোর এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। ২০০৩ সালে ইউনেসকো জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকদের সহায়তায় দক্ষিণ ফ্রান্সের রেন নদীর গর্ভ থেকে আরলস নগরের অনেক প্রাচীন কীর্তি উদ্ধার করে দিয়েছে। গভীর সমুদ্র ও অরণ্যের সংস্কৃতিচর্চায় বিশ্বব্যাপী কাজ করছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেল—ইউনেসকোর মাধ্যমে তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা আমাদের সরকারের।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments