ওবামা-১, রিপাবলিকান পার্টি-০ -by হাসান ফেরদৌস
বারাক ওবামাকে আমরা সবাই বড় ‘মিস-আন্ডার ইস্টিমেট’ করে ফেলেছিলাম। এই লোকটিকে নিয়ে গোড়াতে যে রকম আশান্বিত হয়েছিলাম, তার অনেকটাই অতিরঞ্জিত—এমন একটি কথা আমরা অনেকেই বলা শুরু করেছিলাম। কেউ কেউ খোলামেলাভাবেই বলছিলাম, নেতা হওয়ার জন্য যে সাহস ও একাগ্রতা লাগে, এঁর তা নেই। কেউ কেউ দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রেসিডেন্ট ওবামা নয়, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ওবামাকে চাই।’ এই লেখকও সেই সব হতাশাবাদীর একজন। কিন্তু আমাদের সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে একটি আশ্চর্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন ওবামা।
আমি মার্কিন কংগ্রেসে গত সপ্তাহে পাস হওয়া স্বাস্থ্যবিমা আইনের কথা বলছি। ঠিক এক মাস আগে হলেও কেউ বুকে হাতে দিয়ে বলতে পারত না, এই বিল পাস হবে। পুরো রিপাবলিকান দল এক সুরে ‘না’ বলেছে। দেশজুড়ে অতি-দক্ষিণপন্থীদের প্রবল রোষের আগুনে ভর করে রিপাবলিকান দল ধরেই নিয়েছিল যে এই বিলের পতনের ভেতর দিয়েই সূচিত হবে ওবামার পতন। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন, যাঁরা শুধু দ্বিধাগ্রস্তই নন, রীতিমতো বিরোধিতা করাও শুরু করেছিলেন। এসব দ্বিধাগ্রস্তের অধিকাংশই রিপাবলিকান-প্রধান রাজ্য থেকে আসা। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে মাস দুই আগে ম্যাসাচুসেটসে এডওয়ার্ড কেনেডির মৃত্যুর পর সেই শূন্য আসনে নির্বাচনে। ম্যাসাচুসেটস আমেরিকার সবচেয়ে উদারনৈতিক রাজ্য, কেনেডির পরিবার সেই উদারনৈকিতার প্রতীক। এডওয়ার্ড কেনেডি নিজে সারা জীবন যুদ্ধ করে গেছেন একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে। সেই আসনে ডেমোক্র্যাটরা হেরে বসল, মূলত কংগ্রেসে উত্থাপিত স্বাস্থ্যবিমা বিলের প্রতিবাদে ‘না’ ভোটের কারণে। শুধু রিপাবলিকানরা নয়, এই রাজ্যের ডেমোক্র্যাটরাও এই বিমা-প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল, এই রাজ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। কেনেডির আসনে পরাজয়ের কারণে সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা যে কেবল একটি আসন হারাল তাই নয়; সিনেটে এই আসন ও দুজন স্বতন্ত্র সদস্য মিলে ডেমোক্র্যাটদের মোট ভোট ছিল ৬০টি। বড় যেকোনো বিল পাস করাতে হলে কম করে হলেও ৬০টি ভোট চাই। তা না হলে বিরোধী পক্ষ একের পর এক সংশোধনী দিয়ে যেকোনো বিল পাস করা ঠেকাতে পারে। ম্যাসাচুসেটসে পরাজয়ের কারণে ডেমোক্র্যাটরা তাদের সেই ৬০ নম্বর ভোটটি হারাল। অমনি চারদিক থেকে আওয়াজ উঠল ‘গেল গেল’!
মজার কথা হলো, স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এ দেশে কোনো ভিন্নমত নেই। প্রায় সবাই মানে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় যে হারে বেড়ে চলেছে, লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সমূহ বিপদ। কিন্তু কোন পথে আগানো উচিত, মতভেদটা সেখানেই। রিপাবলিকানরা বরাবর বলে এসেছে—সংস্কার-টংস্কার যা-ই হোক, তা পুঁজিবাদী বাজারের নিয়ম মেনেই করতে হবে। সরকারিভাবে কোনো রকম নাক গলানো যাবে না। ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে। তাদের বক্তব্য, সবকিছু বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যারা সবচেয়ে কম সুবিধাভোগী, বিশেষত নিম্ন আয়ের মহিলা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিপদে পড়বে। বর্তমানে যে প্রায় পাঁচ-সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের কোনো বীমা নেই, তাদের অধিকাংশই হয় মহিলা ও শিশু, অথবা সংখ্যালঘু ও বহিরাগত। দলের সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, সবচেয়ে দুর্বল জনসংখ্যার জন্য একটি সরকার-পরিচালিত স্বাস্থ্য খাত থাকা দরকার। বারাক ওবামা নিজেও একসময় এই তথাকথিত ‘পাবলিক অপশন’-এর পক্ষে জোর আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা বলা শুরু করল, পাবলিক অপশন মানেই হলো স্বাস্থ্য খাত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া। রোগীর ভালোমন্দ দেখভাল করার কথা ডাক্তারের, তাঁর জায়গায় সেই কাজ করবেন ওয়াশিংটনের আমলারা। আমেরিকায় এ রকম ‘বলশেভিক’ কাজ-কারবার সহ্য করা হবে না! বিমা কোম্পানিগুলোও এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। ব্যাপারটা এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যে ডেমোক্র্যাটরা নিজেরাই ক্রমশ তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব কাটছাঁট করা শুরু করে। কার্যত বিনা যুদ্ধেই বাদ হয়ে যায় ‘পাবলিক অপশন’।
ব্যাপারটায় সবচেয়ে দুঃখিত হয় ডেমোক্রেটিক পার্টির উদারবাদী অংশ, ওবামার বিজয়ের পেছনে যাদের সরব ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রিপাবলিকানরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে সে তো জানা কথা। কিন্তু ওবামা কেন সেই বিরোধিতা পাত্তা দেবেন? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন, এই সংস্কারের পক্ষে তো তাঁর ম্যান্ডেট রয়েছেই। তিনি কেন লড়াই ছাড়াই রণে ভঙ্গ দেবেন? নেতা তো তাঁকেই বলব, বিপদ ও বিরোধিতার মুখে যিনি নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করেন না। সহজ সমাধান ভেবে যিনি সমঝোতার পথ বেছে নেন না। ওবামাকে নিয়ে অধিকাংশের মনভঙ্গের সেটাই আসল কারণ।
ম্যাসাচুসেটসে তাদের ৬০ নম্বর সিনেট আসন হারাবার পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম—গেল, সব গেল। সত্যি বলছি, আমি এমন কোনো লোক পাইনি যিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, এমন এক বিপর্যয়ের পরেও ডেমোক্র্যাটরা তাদের স্বাস্থ্যবিমা পাস করতে সক্ষম হবে। ওবামার নিজের দলের লোকেরাই ‘হবে না, হবে না’ বলা শুরু করেছিলেন। দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্য থেকে গত নির্বাচনে যাঁরা জিতে এসেছিলেন, তাঁরা তো একদম গেড়ে বসলেন—এই স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব নিয়ে আগানোর মানে হলো তাঁদের নিজেদের নির্বাচনী ভবিষ্যত্ জলে ভাসিয়ে দেওয়া। প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও পরামর্শদাতাদের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর চিফ অব স্টাফ রাহম ইম্যানুয়েল এসব ভীতসন্ত্রস্ত সহকর্মীদের একজন। তাঁর যুক্তি ছিল, এই এক স্বাস্থ্যবিমার জন্য ওবামার উচিত হবে না তাঁর পুরো রাজনৈতিক কর্মসূচি বিপদগ্রস্ত করা। রাহমের প্রস্তাব ছিল, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বাস্থ্যবিমার বদলে ছোটা আকারের, যেসব ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের সঙ্গে সমঝোতা করা সম্ভব হবে, এমন একাধিক প্রস্তাব নিয়ে আগানো যাক।
শেষ পর্যন্ত ওবামা এবং আমেরিকা যে এই ‘পর্যায়ক্রমিক’ পথ বেছে নেয়নি, তার কারণ দুজন মানুষ একদম নাছোড়বান্দার মতো প্রতিবাদ জানালেন। তাঁদের একজন মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলসি। অন্যজন খোদ বারাক ওবামা।
ঠিক কখন, কীভাবে এই পালাবদল ঘটল, তা এখনো পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। তবে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা স্বনামে-বেনামে যে চিত্রটি এঁকেছেন তা থেকে বোঝা যায়, ম্যাসাচুসেটসে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে এডওয়ার্ড কেনেডির আসনটি হারিয়ে ওবামা ঘুরে দাঁড়ান। স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নটি তাঁর প্রেসিডেন্সির কেন্দ্রীয় বিষয় সেন্টারপিস হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন ওবামা। কেনেডি ছিলেন এই কাজে তাঁর বন্ধু, সহযোগী ও পথপ্রদর্শক। একশ বছর ধরে এই স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে, বিশেষ করে অভাবীদের জন্য স্বাস্থ্যসুযোগ সৃষ্টি করতে অনেক প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি। এ কথা বোঝা ওবামার পক্ষে কঠিন হয়নি, যে স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচনী লড়াই তিনি করেছিলেন, সেই প্রস্তাব যদি বিনা যুদ্ধে বাতিল বলে গণ্য হয়, তাহলে তাঁর এজেন্ডার অধিকাংশ বিষয়ই রিপাবলিকানদের হাতে পরাস্ত হবে। ফলে কেবল ওবামার প্রেসিডেন্সিই ব্যর্থ বলে পরিচিত হবে না, পুরো ডেমোক্রেটিক দলই দেউলিয়া হয়ে ধরা দেবে। পোকার খেলায় বাজি ধরার মতো মরিয়া হয়ে বাজি ধরলেন ওবামা। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রস্তাবের সর্বনিম্ন বিভাজক (লোয়েস্ট ডিনমিনেটর) নয়, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিভাজককেই তিনি লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে এগোবেন। এই কাজে তাঁকে সমর্থন জানালেন পেলসি। সদ্য সত্তরে পড়া এই মহিলা উদারনৈতিক হিসেবে সুপরিচিত, রিপাবলিকানদের চোখে আমেরিকার বর্তমান অসুখের এক অন্যতম কারণ তিনি। পেলসি নিজেও জানতেন, ওবামার মতো স্বাস্থ্যবিমার টুপিতে সব ডিম তিনিও রেখেছেন। এই বিল পরাস্ত হলে ২০১২ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা সম্ভবত কংগ্রেসের উভয় কক্ষেই তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তার অর্থ পেলসির স্পিকারের দায়িত্বটি ফসকে যাওয়া।
পর্দার অন্তরালে নিজের দলের কংগ্রেস সদস্যদের সামলালেন পেলসি। আর পর্দার বাইরে স্বাস্থ্যবিমার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন ওবামা। হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকানদের ডেকে এনে চালু টিভি ক্যামেরার সামনে পাক্কা ছয় ঘণ্টা তুমুল বিতর্ক করলেন। তাতে খুব একটা কাজ হলো না, একজন রিপাবলিকানকেও পাওয়া গেল না তাঁর পক্ষে। তখন একের পর এক টিভি সাক্ষাত্কার দেওয়া শুরু করলেন ওবামা, বিভিন্ন শহরে সভাও ডাকলেন। এ যেন সেই আগের প্রার্থী ওবামা। নিজের দলের যেসব সদস্য গররাজি ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকও করলেন তিনি। তাঁদের সোজাসুজি বললেন, ‘দেখো, এই বিল ব্যর্থ হলে আমার প্রেসিডেন্সি ব্যর্থ প্রমাণিত হবে। আমি ব্যর্থ হলে তোমরাও খুব সুখে থাকবে না। এই ব্যর্থতার দাগ এক প্রজন্মেও ডেমোক্র্যাটরা মুছতে পারবে না।
শেষ পর্যন্ত ওবামাই বিজয়ী হলেন। শুধু যে পার্লামেন্টারি অর্থে এই বিজয়, তা মোটেই নয়। মাস দেড়েক আগেও ওবামার দল ডেমোক্রেটিক পার্টির অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষ—অর্থাত্ রিপাবলিকানরা যেখানে দেশজুড়ে তুমুল প্রতিবাদ-হট্টগোল করে বেড়াচ্ছিল, সেখানে ডেমোক্র্যাটরা ছিল দারুণ মনমরা। জনমত জরিপকারীরা বলছিলেন, ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় রিপাবলিকানদের মনোবলের মাত্রা দ্বিগুণ। মধ্যবর্তী নির্বাচনে শাসকদল বরাবরই বেধড়ক মার খায়। কিন্তু নিজের দলের সদস্যদের অর্থাত্ দলের ‘কোর’ সমর্থকদের মধ্যে যদি উত্সাহ না থাকে, তাঁরা যদি ভোট দিতে না যান, তাহলে কারও বাপেরও সাধ্য নেই ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি ঠেকায়। স্বাস্থ্যবিমা পাস হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ঘুঁটি উলটে গেল। এখন দেশের বৃহদাংশ মানুষ কেবল এই আইনের সমর্থকই নয়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দলের ব্যাপারে আগ্রহও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, তাদের হাতের একমাত্র তাস হারিয়ে বিব্রত, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে রিপাবলিকান পার্টি।
এই আইন গৃহীত হওয়ার ফলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার পথে আমেরিকা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। অন্ততপক্ষে সোয়া তিন কোটি মানুষ, এত দিন যাদের স্বাস্থ্যবিমা ছিল না, এখন তারা সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগ পাবে। এত দিন বিমা কোম্পানিগুলো ‘বিমাভুক্ত হওয়ার আগে থেকে সমস্যা আছে’—এই যুক্তিতে অথবা খরচের অজুহাতে যখন-তখন বিমাব্যবস্থা বাতিল করে দিতে পারত। এই নতুন আইনে সেই পথ বন্ধ হলো। বিমাহীনদের সাহায্য করার লক্ষ্যে সরকার বিশাল ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যে ভর্তুকির একাংশ উঠে আসবে অধিকতর আয় করে এমন আমেরিকানদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে। বাকিটা আসবে অপচয় বন্ধ করে।
আমি জেনে অবাক হয়েছি, অপচয় বন্ধের নতুন যে আইন হলো, এর বুদ্ধিটা এসেছে অতুল গাওয়ান্ডে এক ভারতীয় আমেরিকানের কাছ থেকে। এই দেশে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলো প্রতিটি রুগী যতবার ডাক্তারের কাছে যাবে, যত ল্যাব টেস্ট করা হবে, এর প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা করে খরচ ধরে। চিকিত্সকেরাও সেই মোতাবেক বিমা কোম্পানি থেকে ফি পেয়ে থাকেন। যতবার রুগী তাঁর কাছে আসবে, যত টেস্ট সে করাবে, এর প্রতিটির জন্য ফি। অতুল গাওয়ান্ডে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৪২ বছর বয়স্ক চিকিত্সক মাস কয়েক আগে নিউইয়র্কার পত্রিকায় হিসাব করে দেখালেন, প্রতি ভিজিট বা টেস্ট বাবদ ফি দেওয়ার ফলে আমেরিকায় কী অসম্ভব অপচয় হচ্ছে। রোগী এলেই যদি ফি মেলে, তাহলে চিকিত্সক বা ক্লিনিকের কোনো প্রয়োজন নেই, তবু চৌদ্দ রকম টেস্ট করাতে চাইবে। এর বদলে যদি যে অসুখের জন্য রোগী এসেছে, তার একটি মোদ্দা খরচ ধরা হয়, তাহলে চিকিত্সক বা হাসপাতাল কেউই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ে আগ্রহী হবে না। ঘটনাক্রমে ওবামা নিজে লেখাটি পড়েন। সেখান থেকেই প্রস্তাব ওঠে, প্রতি সার্ভিস বাবদ ফি দেওয়ার বদলে ‘মোট’ খরচের একটা অঙ্ক ধরে দেওয়া হবে। ডাক্তার বা হাসপাতাল কোনো বিমা কোম্পানির চাপে পড়ে রোগীর পরিচর্যা সংকুচিত না করে তার জন্যও পর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা রাখা হবে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই নতুন ব্যবস্থা, যার আইনি নাম হয়েছে ‘বান্ডলিং’, এর ফলে কোটি কোটি ডলারের অপচয় ঠেকানো সম্ভব হবে।
মজার কথা হলো, অপচয় রোধের এই প্রস্তাব প্রথম করেছিল রিপাবলিকানরাই। আরও নানা রকম ব্যয়-সংকোচনমূলক প্রস্তাব তারা আগে থেকেই করে আসছে। কিন্তু ‘ওবামা যা বলবেন, তাতেই না বলো’—রিপাবলিকানদের এই নীতির ফল দাঁড়াল এই যে, ভালো বুদ্ধি দিয়েও তারা এখন সেই বুদ্ধির জন্য কোনো প্রশংসা পাচ্ছে না। রিপাবলিকানরা বাজি ধরে বসেছিল, এই স্বাস্থ্যবিমা হবে ওবামার ‘ওয়াটারলু’। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটা ঘটছে উলটো। রিপাবলিকানদের মধ্যে বুদ্ধিমান কৌশলবিদ হিসেবে নাম রয়েছে ডেভিড ফ্রামের। সপ্তাহখানেক আগে তিনি লিখেছেন, আগাগোড়া ‘না’ বলার ফলে এই স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নটি ডেমোক্র্যাটদের নয়, রিপাবলিকানদের ‘ওয়াটারলু’ হয়ে উঠতে পারে। গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা আইন হলো এই স্বাস্থ্যবিমা। ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা একা সেই আইন বাস্তবায়নের সব কৃতিত্ব নিয়ে নিল। এখন নিজেদের ফোলা বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া আর কী করার আছে রিপাবলিকানদের? ফ্রাম লিখেছেন, ওবামা খুব আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন রিপাবলিকানদের সঙ্গে নিয়ে এই আইন লিখতে। তাতে সাড়া না দিয়ে নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারল রিপাবলিকান দল।
গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন হলো এই স্বাস্থ্যবিমা। এই আইন যদি টিকে যায়, তাহলে ইতিহাসে ওবামার স্থান, তাঁর ‘লিগেসি’ হবে রুজভেল্ট ও লিন্ডন জনসনের মতোই চিরস্থায়ী। এই আইন বাস্তবায়িত হলে আমেরিকার সামাজিক ব্যবস্থাপনায় যে বড় ধরনের অসাম্য চালু রয়েছে, তার অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে। অধিকতর ন্যায়সংগত সমাজের কথা বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন ওবামা। সে পথেই এক ধাপ এগিয়ে গেলেন তিনি।
নিউইয়র্ক, ৩০ মার্চ ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমি মার্কিন কংগ্রেসে গত সপ্তাহে পাস হওয়া স্বাস্থ্যবিমা আইনের কথা বলছি। ঠিক এক মাস আগে হলেও কেউ বুকে হাতে দিয়ে বলতে পারত না, এই বিল পাস হবে। পুরো রিপাবলিকান দল এক সুরে ‘না’ বলেছে। দেশজুড়ে অতি-দক্ষিণপন্থীদের প্রবল রোষের আগুনে ভর করে রিপাবলিকান দল ধরেই নিয়েছিল যে এই বিলের পতনের ভেতর দিয়েই সূচিত হবে ওবামার পতন। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন, যাঁরা শুধু দ্বিধাগ্রস্তই নন, রীতিমতো বিরোধিতা করাও শুরু করেছিলেন। এসব দ্বিধাগ্রস্তের অধিকাংশই রিপাবলিকান-প্রধান রাজ্য থেকে আসা। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে মাস দুই আগে ম্যাসাচুসেটসে এডওয়ার্ড কেনেডির মৃত্যুর পর সেই শূন্য আসনে নির্বাচনে। ম্যাসাচুসেটস আমেরিকার সবচেয়ে উদারনৈতিক রাজ্য, কেনেডির পরিবার সেই উদারনৈকিতার প্রতীক। এডওয়ার্ড কেনেডি নিজে সারা জীবন যুদ্ধ করে গেছেন একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে। সেই আসনে ডেমোক্র্যাটরা হেরে বসল, মূলত কংগ্রেসে উত্থাপিত স্বাস্থ্যবিমা বিলের প্রতিবাদে ‘না’ ভোটের কারণে। শুধু রিপাবলিকানরা নয়, এই রাজ্যের ডেমোক্র্যাটরাও এই বিমা-প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল, এই রাজ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। কেনেডির আসনে পরাজয়ের কারণে সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা যে কেবল একটি আসন হারাল তাই নয়; সিনেটে এই আসন ও দুজন স্বতন্ত্র সদস্য মিলে ডেমোক্র্যাটদের মোট ভোট ছিল ৬০টি। বড় যেকোনো বিল পাস করাতে হলে কম করে হলেও ৬০টি ভোট চাই। তা না হলে বিরোধী পক্ষ একের পর এক সংশোধনী দিয়ে যেকোনো বিল পাস করা ঠেকাতে পারে। ম্যাসাচুসেটসে পরাজয়ের কারণে ডেমোক্র্যাটরা তাদের সেই ৬০ নম্বর ভোটটি হারাল। অমনি চারদিক থেকে আওয়াজ উঠল ‘গেল গেল’!
মজার কথা হলো, স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এ দেশে কোনো ভিন্নমত নেই। প্রায় সবাই মানে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় যে হারে বেড়ে চলেছে, লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সমূহ বিপদ। কিন্তু কোন পথে আগানো উচিত, মতভেদটা সেখানেই। রিপাবলিকানরা বরাবর বলে এসেছে—সংস্কার-টংস্কার যা-ই হোক, তা পুঁজিবাদী বাজারের নিয়ম মেনেই করতে হবে। সরকারিভাবে কোনো রকম নাক গলানো যাবে না। ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে। তাদের বক্তব্য, সবকিছু বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যারা সবচেয়ে কম সুবিধাভোগী, বিশেষত নিম্ন আয়ের মহিলা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিপদে পড়বে। বর্তমানে যে প্রায় পাঁচ-সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের কোনো বীমা নেই, তাদের অধিকাংশই হয় মহিলা ও শিশু, অথবা সংখ্যালঘু ও বহিরাগত। দলের সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, সবচেয়ে দুর্বল জনসংখ্যার জন্য একটি সরকার-পরিচালিত স্বাস্থ্য খাত থাকা দরকার। বারাক ওবামা নিজেও একসময় এই তথাকথিত ‘পাবলিক অপশন’-এর পক্ষে জোর আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা বলা শুরু করল, পাবলিক অপশন মানেই হলো স্বাস্থ্য খাত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া। রোগীর ভালোমন্দ দেখভাল করার কথা ডাক্তারের, তাঁর জায়গায় সেই কাজ করবেন ওয়াশিংটনের আমলারা। আমেরিকায় এ রকম ‘বলশেভিক’ কাজ-কারবার সহ্য করা হবে না! বিমা কোম্পানিগুলোও এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। ব্যাপারটা এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যে ডেমোক্র্যাটরা নিজেরাই ক্রমশ তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব কাটছাঁট করা শুরু করে। কার্যত বিনা যুদ্ধেই বাদ হয়ে যায় ‘পাবলিক অপশন’।
ব্যাপারটায় সবচেয়ে দুঃখিত হয় ডেমোক্রেটিক পার্টির উদারবাদী অংশ, ওবামার বিজয়ের পেছনে যাদের সরব ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রিপাবলিকানরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে সে তো জানা কথা। কিন্তু ওবামা কেন সেই বিরোধিতা পাত্তা দেবেন? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন, এই সংস্কারের পক্ষে তো তাঁর ম্যান্ডেট রয়েছেই। তিনি কেন লড়াই ছাড়াই রণে ভঙ্গ দেবেন? নেতা তো তাঁকেই বলব, বিপদ ও বিরোধিতার মুখে যিনি নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করেন না। সহজ সমাধান ভেবে যিনি সমঝোতার পথ বেছে নেন না। ওবামাকে নিয়ে অধিকাংশের মনভঙ্গের সেটাই আসল কারণ।
ম্যাসাচুসেটসে তাদের ৬০ নম্বর সিনেট আসন হারাবার পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম—গেল, সব গেল। সত্যি বলছি, আমি এমন কোনো লোক পাইনি যিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, এমন এক বিপর্যয়ের পরেও ডেমোক্র্যাটরা তাদের স্বাস্থ্যবিমা পাস করতে সক্ষম হবে। ওবামার নিজের দলের লোকেরাই ‘হবে না, হবে না’ বলা শুরু করেছিলেন। দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্য থেকে গত নির্বাচনে যাঁরা জিতে এসেছিলেন, তাঁরা তো একদম গেড়ে বসলেন—এই স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব নিয়ে আগানোর মানে হলো তাঁদের নিজেদের নির্বাচনী ভবিষ্যত্ জলে ভাসিয়ে দেওয়া। প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও পরামর্শদাতাদের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর চিফ অব স্টাফ রাহম ইম্যানুয়েল এসব ভীতসন্ত্রস্ত সহকর্মীদের একজন। তাঁর যুক্তি ছিল, এই এক স্বাস্থ্যবিমার জন্য ওবামার উচিত হবে না তাঁর পুরো রাজনৈতিক কর্মসূচি বিপদগ্রস্ত করা। রাহমের প্রস্তাব ছিল, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বাস্থ্যবিমার বদলে ছোটা আকারের, যেসব ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের সঙ্গে সমঝোতা করা সম্ভব হবে, এমন একাধিক প্রস্তাব নিয়ে আগানো যাক।
শেষ পর্যন্ত ওবামা এবং আমেরিকা যে এই ‘পর্যায়ক্রমিক’ পথ বেছে নেয়নি, তার কারণ দুজন মানুষ একদম নাছোড়বান্দার মতো প্রতিবাদ জানালেন। তাঁদের একজন মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলসি। অন্যজন খোদ বারাক ওবামা।
ঠিক কখন, কীভাবে এই পালাবদল ঘটল, তা এখনো পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। তবে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা স্বনামে-বেনামে যে চিত্রটি এঁকেছেন তা থেকে বোঝা যায়, ম্যাসাচুসেটসে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে এডওয়ার্ড কেনেডির আসনটি হারিয়ে ওবামা ঘুরে দাঁড়ান। স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নটি তাঁর প্রেসিডেন্সির কেন্দ্রীয় বিষয় সেন্টারপিস হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন ওবামা। কেনেডি ছিলেন এই কাজে তাঁর বন্ধু, সহযোগী ও পথপ্রদর্শক। একশ বছর ধরে এই স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে, বিশেষ করে অভাবীদের জন্য স্বাস্থ্যসুযোগ সৃষ্টি করতে অনেক প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি। এ কথা বোঝা ওবামার পক্ষে কঠিন হয়নি, যে স্বাস্থ্যবিমা প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচনী লড়াই তিনি করেছিলেন, সেই প্রস্তাব যদি বিনা যুদ্ধে বাতিল বলে গণ্য হয়, তাহলে তাঁর এজেন্ডার অধিকাংশ বিষয়ই রিপাবলিকানদের হাতে পরাস্ত হবে। ফলে কেবল ওবামার প্রেসিডেন্সিই ব্যর্থ বলে পরিচিত হবে না, পুরো ডেমোক্রেটিক দলই দেউলিয়া হয়ে ধরা দেবে। পোকার খেলায় বাজি ধরার মতো মরিয়া হয়ে বাজি ধরলেন ওবামা। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রস্তাবের সর্বনিম্ন বিভাজক (লোয়েস্ট ডিনমিনেটর) নয়, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিভাজককেই তিনি লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে এগোবেন। এই কাজে তাঁকে সমর্থন জানালেন পেলসি। সদ্য সত্তরে পড়া এই মহিলা উদারনৈতিক হিসেবে সুপরিচিত, রিপাবলিকানদের চোখে আমেরিকার বর্তমান অসুখের এক অন্যতম কারণ তিনি। পেলসি নিজেও জানতেন, ওবামার মতো স্বাস্থ্যবিমার টুপিতে সব ডিম তিনিও রেখেছেন। এই বিল পরাস্ত হলে ২০১২ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা সম্ভবত কংগ্রেসের উভয় কক্ষেই তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তার অর্থ পেলসির স্পিকারের দায়িত্বটি ফসকে যাওয়া।
পর্দার অন্তরালে নিজের দলের কংগ্রেস সদস্যদের সামলালেন পেলসি। আর পর্দার বাইরে স্বাস্থ্যবিমার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন ওবামা। হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকানদের ডেকে এনে চালু টিভি ক্যামেরার সামনে পাক্কা ছয় ঘণ্টা তুমুল বিতর্ক করলেন। তাতে খুব একটা কাজ হলো না, একজন রিপাবলিকানকেও পাওয়া গেল না তাঁর পক্ষে। তখন একের পর এক টিভি সাক্ষাত্কার দেওয়া শুরু করলেন ওবামা, বিভিন্ন শহরে সভাও ডাকলেন। এ যেন সেই আগের প্রার্থী ওবামা। নিজের দলের যেসব সদস্য গররাজি ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকও করলেন তিনি। তাঁদের সোজাসুজি বললেন, ‘দেখো, এই বিল ব্যর্থ হলে আমার প্রেসিডেন্সি ব্যর্থ প্রমাণিত হবে। আমি ব্যর্থ হলে তোমরাও খুব সুখে থাকবে না। এই ব্যর্থতার দাগ এক প্রজন্মেও ডেমোক্র্যাটরা মুছতে পারবে না।
শেষ পর্যন্ত ওবামাই বিজয়ী হলেন। শুধু যে পার্লামেন্টারি অর্থে এই বিজয়, তা মোটেই নয়। মাস দেড়েক আগেও ওবামার দল ডেমোক্রেটিক পার্টির অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষ—অর্থাত্ রিপাবলিকানরা যেখানে দেশজুড়ে তুমুল প্রতিবাদ-হট্টগোল করে বেড়াচ্ছিল, সেখানে ডেমোক্র্যাটরা ছিল দারুণ মনমরা। জনমত জরিপকারীরা বলছিলেন, ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় রিপাবলিকানদের মনোবলের মাত্রা দ্বিগুণ। মধ্যবর্তী নির্বাচনে শাসকদল বরাবরই বেধড়ক মার খায়। কিন্তু নিজের দলের সদস্যদের অর্থাত্ দলের ‘কোর’ সমর্থকদের মধ্যে যদি উত্সাহ না থাকে, তাঁরা যদি ভোট দিতে না যান, তাহলে কারও বাপেরও সাধ্য নেই ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি ঠেকায়। স্বাস্থ্যবিমা পাস হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ঘুঁটি উলটে গেল। এখন দেশের বৃহদাংশ মানুষ কেবল এই আইনের সমর্থকই নয়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দলের ব্যাপারে আগ্রহও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, তাদের হাতের একমাত্র তাস হারিয়ে বিব্রত, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে রিপাবলিকান পার্টি।
এই আইন গৃহীত হওয়ার ফলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার পথে আমেরিকা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। অন্ততপক্ষে সোয়া তিন কোটি মানুষ, এত দিন যাদের স্বাস্থ্যবিমা ছিল না, এখন তারা সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগ পাবে। এত দিন বিমা কোম্পানিগুলো ‘বিমাভুক্ত হওয়ার আগে থেকে সমস্যা আছে’—এই যুক্তিতে অথবা খরচের অজুহাতে যখন-তখন বিমাব্যবস্থা বাতিল করে দিতে পারত। এই নতুন আইনে সেই পথ বন্ধ হলো। বিমাহীনদের সাহায্য করার লক্ষ্যে সরকার বিশাল ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যে ভর্তুকির একাংশ উঠে আসবে অধিকতর আয় করে এমন আমেরিকানদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে। বাকিটা আসবে অপচয় বন্ধ করে।
আমি জেনে অবাক হয়েছি, অপচয় বন্ধের নতুন যে আইন হলো, এর বুদ্ধিটা এসেছে অতুল গাওয়ান্ডে এক ভারতীয় আমেরিকানের কাছ থেকে। এই দেশে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলো প্রতিটি রুগী যতবার ডাক্তারের কাছে যাবে, যত ল্যাব টেস্ট করা হবে, এর প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা করে খরচ ধরে। চিকিত্সকেরাও সেই মোতাবেক বিমা কোম্পানি থেকে ফি পেয়ে থাকেন। যতবার রুগী তাঁর কাছে আসবে, যত টেস্ট সে করাবে, এর প্রতিটির জন্য ফি। অতুল গাওয়ান্ডে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৪২ বছর বয়স্ক চিকিত্সক মাস কয়েক আগে নিউইয়র্কার পত্রিকায় হিসাব করে দেখালেন, প্রতি ভিজিট বা টেস্ট বাবদ ফি দেওয়ার ফলে আমেরিকায় কী অসম্ভব অপচয় হচ্ছে। রোগী এলেই যদি ফি মেলে, তাহলে চিকিত্সক বা ক্লিনিকের কোনো প্রয়োজন নেই, তবু চৌদ্দ রকম টেস্ট করাতে চাইবে। এর বদলে যদি যে অসুখের জন্য রোগী এসেছে, তার একটি মোদ্দা খরচ ধরা হয়, তাহলে চিকিত্সক বা হাসপাতাল কেউই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ে আগ্রহী হবে না। ঘটনাক্রমে ওবামা নিজে লেখাটি পড়েন। সেখান থেকেই প্রস্তাব ওঠে, প্রতি সার্ভিস বাবদ ফি দেওয়ার বদলে ‘মোট’ খরচের একটা অঙ্ক ধরে দেওয়া হবে। ডাক্তার বা হাসপাতাল কোনো বিমা কোম্পানির চাপে পড়ে রোগীর পরিচর্যা সংকুচিত না করে তার জন্যও পর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা রাখা হবে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই নতুন ব্যবস্থা, যার আইনি নাম হয়েছে ‘বান্ডলিং’, এর ফলে কোটি কোটি ডলারের অপচয় ঠেকানো সম্ভব হবে।
মজার কথা হলো, অপচয় রোধের এই প্রস্তাব প্রথম করেছিল রিপাবলিকানরাই। আরও নানা রকম ব্যয়-সংকোচনমূলক প্রস্তাব তারা আগে থেকেই করে আসছে। কিন্তু ‘ওবামা যা বলবেন, তাতেই না বলো’—রিপাবলিকানদের এই নীতির ফল দাঁড়াল এই যে, ভালো বুদ্ধি দিয়েও তারা এখন সেই বুদ্ধির জন্য কোনো প্রশংসা পাচ্ছে না। রিপাবলিকানরা বাজি ধরে বসেছিল, এই স্বাস্থ্যবিমা হবে ওবামার ‘ওয়াটারলু’। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটা ঘটছে উলটো। রিপাবলিকানদের মধ্যে বুদ্ধিমান কৌশলবিদ হিসেবে নাম রয়েছে ডেভিড ফ্রামের। সপ্তাহখানেক আগে তিনি লিখেছেন, আগাগোড়া ‘না’ বলার ফলে এই স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নটি ডেমোক্র্যাটদের নয়, রিপাবলিকানদের ‘ওয়াটারলু’ হয়ে উঠতে পারে। গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা আইন হলো এই স্বাস্থ্যবিমা। ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা একা সেই আইন বাস্তবায়নের সব কৃতিত্ব নিয়ে নিল। এখন নিজেদের ফোলা বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া আর কী করার আছে রিপাবলিকানদের? ফ্রাম লিখেছেন, ওবামা খুব আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন রিপাবলিকানদের সঙ্গে নিয়ে এই আইন লিখতে। তাতে সাড়া না দিয়ে নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারল রিপাবলিকান দল।
গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন হলো এই স্বাস্থ্যবিমা। এই আইন যদি টিকে যায়, তাহলে ইতিহাসে ওবামার স্থান, তাঁর ‘লিগেসি’ হবে রুজভেল্ট ও লিন্ডন জনসনের মতোই চিরস্থায়ী। এই আইন বাস্তবায়িত হলে আমেরিকার সামাজিক ব্যবস্থাপনায় যে বড় ধরনের অসাম্য চালু রয়েছে, তার অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে। অধিকতর ন্যায়সংগত সমাজের কথা বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন ওবামা। সে পথেই এক ধাপ এগিয়ে গেলেন তিনি।
নিউইয়র্ক, ৩০ মার্চ ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments