শত্রু শত্রু খেলা by সোহরাব হাসান
এই মুহূর্তে যদি কোনো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালায়, তাহলে রিপাবলিকান নেতারা কী করতেন? নিশ্চয়ই এর জন্য ডেমোক্র্যাট-দলীয় রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে দায়ী করতেন না। সবকিছু বাদ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে জেহাদেও নামতেন না। অন্যদিকে বারাক ওবামাও আক্রমণকারী দেশটির
সঙ্গে বিরোধী দলের যোগসাজশ খুঁজতেন না।
কিংবা ধরুন, কাশ্মীর বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারতকে আক্রমণ করল পাকিস্তান। বিজেপি কি সে জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে তুলোধুনো করত? বহিঃশক্তির আক্রমণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকার পতনের ডাক দিত? অন্যদিকে কংগ্রেস নেতারা পাকিস্তানের দালাল বলে বিরোধী দলের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন?
ভারতে বা আমেরিকায় সে ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটবে না। দেশীয় বা বৈদেশিক নীতি-কৌশল নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যতই বিভেদ থাকুক, এ কাজটি তারা কখনোই করবে না। করেনি।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের কথা ভাবুন। জাতীয় সংকটে, দুর্যোগে যখন ঐক্য সবচেয়ে বেশি জরুরি, তখনই তাঁরা বিভেদকে উসকে দেন। সমঝোতার পথ পরিহার করে মহোত্সাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন এক কাল্পনিক যুদ্ধে। দলীয় কর্মীদের লেলিয়ে দেন একে অপরের বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
গত বছরের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের পরিনতিতে পিলখানায় ঘটে যায় এক জঘন্য হত্যাকাণ্ড। বিডিআর জওয়ানেরা একপর্যায়ে মেতে ওঠে সেনা অফিসার হত্যায় (এ রকম সেনা অফিসার হত্যার ঘটনা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও ঘটেছিল)। বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআর সদর দপ্তরে যে নৃশংস ও হূদয়বিদারক ঘটনা ঘটল, তাতে সারা দেশ স্তম্ভিত, মানুষ শোকে মুহ্যমান। তখনো সরকারের বয়স দুই মাস পূর্ণ হয়নি।
এ অবস্থায় সবার প্রত্যাশা ছিল, সংকট মোকাবিলায় সরকার ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করবে। একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, বাস্তবে তা হলো না। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই সরকার সন্দেহের তীর ছুড়ল বিরোধী দলের দিকে। বিরোধী দল দায়ী করল সরকারকে। গত এক বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু না হলেও পারস্পরিক দোষারোপ বা ব্লেইম গেইম চলতে থাকে। এখনো চলছে।
প্রথমেই বিতর্ক ওঠে বিদ্রোহ দমনের কৌশল নিয়ে। পিলখানার অবস্থান বিবেচনা করে সেদিন সরকার শক্তি প্রয়োগের বদলে আলোচনার মাধ্যমেই বিদ্রোহীদের নিরস্ত্র ও নিবৃত্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক বিশেষজ্ঞসহ সব মহলে এ সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হলেও বিএনপির নেতারা তা মানলেন না। তারা কঠোর সমালোচনা করলেন সরকারের। তাঁদের দাবি, আলোচনায় সময়ক্ষেপণ না করে আগেভাগে সামরিক অভিযান চালালে এত এত সেনা কর্মকর্তা মারা যেতেন না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের এ দাবি সমর্থন করে না। পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরটি বেসামরিক এলাকায়। শক্তি প্রয়োগ করলে আরও বেশি প্রাণহানি ঘটত। আটকে পড়া সেনা পরিবারগুলোকে উদ্ধারও কঠিন হতো।
আবার সরকারও সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সহযোগিতা চায়নি। যদিও তাঁরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন।; অন্তত প্রকাশ্যে সে রকমই বলেছিলেন। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মহাজোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন করেনি, সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। এর পাশাপাশি সরকারের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী তদন্তের আগেই বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে বিরোধী দল জড়িত বলে অভিযোগ আনেন। তাঁদের দাবি, সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
এ নিয়ে সংসদেও দুই পক্ষের তুমুল বাগ্যুদ্ধ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সকালে সেনা সদরে যেসব কথা শুনে এসেছি, এখানেও বিরোধীদের কথায় সেসব বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনলাম। দেশবাসী ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে খেলা হচ্ছে, কেন তাদের বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে?’
বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যদি ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার মধ্যে হত্যাকাণ্ড শেষ হয়ে থাকে, তাহলে দুপুর দুইটায় কেন তাদের (বিদ্রোহী) সঙ্গে আলোচনা করা হলো? তাদের (সেনাবাহিনী) হত্যা করে দেশকে অরক্ষিত রাখলে কি স্বাধীনতা থাকবে, নাকি করদরাজ্যে পরিণত হবে?’
আমরা আগেও দেখেছি, যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, তাঁরা পরস্পরকে দোষারোপ করেন। নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে আহলাদিত হন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা বুঝতে অক্ষম যে তাঁদের এই ব্লেইম গেইমের সুযোগে দেশ ও জনবিরোধী চক্র নাক গলাতে সাহস পায়। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। মওকা বুঝে হামলে পড়ে। স্বাধীনতার পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো প্রাণঘাতি অঘটন বহুবার ঘটেছে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই ঘাতকরা শাস্তি পেয়েছে।
শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব যত দিন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তত দিন ষড়যন্ত্রকারীরা সুবিধা করতে পারেনি। তাঁরা একত্র হয়েছিলেন বলেই স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। অথচ আজ পরস্পরকে ঘায়েল করতে তারা এতোই মরিয়া যে একপক্ষ স্বৈরাচারের সঙ্গে এবং অন্যপক্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
দেশবাসী চায়, পিলখানার ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হোক। সে জন্য শত্রু শত্রু খেলা বন্ধ করতে হবে। ব্লেইম গেইম বা জজ মিয়ার মতো নকল আসামিদের নিয়ে টানাটানি শুরু করলে কেবল বিচার কাজই ব্যাহত হবে না, ভবিষ্যতে অঘটনের আশংকাও থেকে যায়।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
সঙ্গে বিরোধী দলের যোগসাজশ খুঁজতেন না।
কিংবা ধরুন, কাশ্মীর বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারতকে আক্রমণ করল পাকিস্তান। বিজেপি কি সে জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে তুলোধুনো করত? বহিঃশক্তির আক্রমণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকার পতনের ডাক দিত? অন্যদিকে কংগ্রেস নেতারা পাকিস্তানের দালাল বলে বিরোধী দলের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন?
ভারতে বা আমেরিকায় সে ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটবে না। দেশীয় বা বৈদেশিক নীতি-কৌশল নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যতই বিভেদ থাকুক, এ কাজটি তারা কখনোই করবে না। করেনি।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের কথা ভাবুন। জাতীয় সংকটে, দুর্যোগে যখন ঐক্য সবচেয়ে বেশি জরুরি, তখনই তাঁরা বিভেদকে উসকে দেন। সমঝোতার পথ পরিহার করে মহোত্সাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন এক কাল্পনিক যুদ্ধে। দলীয় কর্মীদের লেলিয়ে দেন একে অপরের বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
গত বছরের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের পরিনতিতে পিলখানায় ঘটে যায় এক জঘন্য হত্যাকাণ্ড। বিডিআর জওয়ানেরা একপর্যায়ে মেতে ওঠে সেনা অফিসার হত্যায় (এ রকম সেনা অফিসার হত্যার ঘটনা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও ঘটেছিল)। বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআর সদর দপ্তরে যে নৃশংস ও হূদয়বিদারক ঘটনা ঘটল, তাতে সারা দেশ স্তম্ভিত, মানুষ শোকে মুহ্যমান। তখনো সরকারের বয়স দুই মাস পূর্ণ হয়নি।
এ অবস্থায় সবার প্রত্যাশা ছিল, সংকট মোকাবিলায় সরকার ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করবে। একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, বাস্তবে তা হলো না। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই সরকার সন্দেহের তীর ছুড়ল বিরোধী দলের দিকে। বিরোধী দল দায়ী করল সরকারকে। গত এক বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু না হলেও পারস্পরিক দোষারোপ বা ব্লেইম গেইম চলতে থাকে। এখনো চলছে।
প্রথমেই বিতর্ক ওঠে বিদ্রোহ দমনের কৌশল নিয়ে। পিলখানার অবস্থান বিবেচনা করে সেদিন সরকার শক্তি প্রয়োগের বদলে আলোচনার মাধ্যমেই বিদ্রোহীদের নিরস্ত্র ও নিবৃত্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক বিশেষজ্ঞসহ সব মহলে এ সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হলেও বিএনপির নেতারা তা মানলেন না। তারা কঠোর সমালোচনা করলেন সরকারের। তাঁদের দাবি, আলোচনায় সময়ক্ষেপণ না করে আগেভাগে সামরিক অভিযান চালালে এত এত সেনা কর্মকর্তা মারা যেতেন না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের এ দাবি সমর্থন করে না। পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরটি বেসামরিক এলাকায়। শক্তি প্রয়োগ করলে আরও বেশি প্রাণহানি ঘটত। আটকে পড়া সেনা পরিবারগুলোকে উদ্ধারও কঠিন হতো।
আবার সরকারও সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সহযোগিতা চায়নি। যদিও তাঁরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন।; অন্তত প্রকাশ্যে সে রকমই বলেছিলেন। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মহাজোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন করেনি, সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। এর পাশাপাশি সরকারের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী তদন্তের আগেই বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে বিরোধী দল জড়িত বলে অভিযোগ আনেন। তাঁদের দাবি, সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
এ নিয়ে সংসদেও দুই পক্ষের তুমুল বাগ্যুদ্ধ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সকালে সেনা সদরে যেসব কথা শুনে এসেছি, এখানেও বিরোধীদের কথায় সেসব বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনলাম। দেশবাসী ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে খেলা হচ্ছে, কেন তাদের বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে?’
বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যদি ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার মধ্যে হত্যাকাণ্ড শেষ হয়ে থাকে, তাহলে দুপুর দুইটায় কেন তাদের (বিদ্রোহী) সঙ্গে আলোচনা করা হলো? তাদের (সেনাবাহিনী) হত্যা করে দেশকে অরক্ষিত রাখলে কি স্বাধীনতা থাকবে, নাকি করদরাজ্যে পরিণত হবে?’
আমরা আগেও দেখেছি, যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, তাঁরা পরস্পরকে দোষারোপ করেন। নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে আহলাদিত হন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা বুঝতে অক্ষম যে তাঁদের এই ব্লেইম গেইমের সুযোগে দেশ ও জনবিরোধী চক্র নাক গলাতে সাহস পায়। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। মওকা বুঝে হামলে পড়ে। স্বাধীনতার পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো প্রাণঘাতি অঘটন বহুবার ঘটেছে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই ঘাতকরা শাস্তি পেয়েছে।
শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব যত দিন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তত দিন ষড়যন্ত্রকারীরা সুবিধা করতে পারেনি। তাঁরা একত্র হয়েছিলেন বলেই স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। অথচ আজ পরস্পরকে ঘায়েল করতে তারা এতোই মরিয়া যে একপক্ষ স্বৈরাচারের সঙ্গে এবং অন্যপক্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
দেশবাসী চায়, পিলখানার ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হোক। সে জন্য শত্রু শত্রু খেলা বন্ধ করতে হবে। ব্লেইম গেইম বা জজ মিয়ার মতো নকল আসামিদের নিয়ে টানাটানি শুরু করলে কেবল বিচার কাজই ব্যাহত হবে না, ভবিষ্যতে অঘটনের আশংকাও থেকে যায়।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments