আমরা যেন ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় না ঘটাই by সুলতানা কামাল
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দুই দিন ধরে বিডিআর সদর দপ্তরে যে মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, সেই স্মৃতি এখনো আমাদের মানবিক চেতনাকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত হেনে চলেছে। পিলখানার বিদ্রোহ নামে অভিহিত এই হত্যাকাণ্ড কোনো অবস্থাতেই সহজভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে ৫৮ জনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে নারী-শিশুসহ বেসরকারি ব্যক্তিরাও বাদ পড়েনি। আরও ন্যক্কারজনক ঘটনা হলো, হত্যাকারী হত্যা করে থেমে থাকেনি; তারা পিলখানায় নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে, গণকবরে পুঁতে ফেলেছে। চালিয়েছে লুটতরাজ। ম্যানহোলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মৃত ব্যক্তির লাশ, যা ভেসে ভেসে অজানা-অচেনা জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে। মানবতার এহেন লাঞ্ছনা যারা ঘটাতে পারে, তারা অবশ্যই সবার ঘৃণার পাত্র। আমরা চাই, এই জঘন্য অপরাধ যাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তারা যেন অবশ্যই তাদের কৃতক্রমের জন্য শাস্তি পায়। কারণ, পেছনে যত বড় কারণই থাক না কেন, এ ধরনের অন্যায় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সমাধান খোঁজাকে কখনোই সমর্থন দেওয়া যায় না। একইভাবে যারা এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারও হতে হবে ন্যায্য, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে পিলখানার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ না করে রাজনৈতিকভাবে এর মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটার যে আশঙ্কা ছিল সামরিক ও বেসামরিক পিলখানায় যারা বসবাসরত ও আশপাশের মানুষ, তা ঠেকানো গেছে। এবং সমগ্র জাতি সরকারকে এর জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার ‘অপারেশন লেবেল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, অভিযান শুরুর পর থেকেই সেনা হেফাজতে বিডিআরদের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে। বিভিন্ন কারণে এই মৃত্যু হয়েছে বলে বিডিআর সদর দপ্তর ও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও, আজকের নিজস্ব অনুসন্ধান ও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, এদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনের কারণে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, কাজে যোগদানের পর কর্তৃপক্ষের হাতে আটক অবস্থায় মারা যাওয়া বিডিআর সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে ৫৫। মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে যে তিনটি বিষয়কে দেখানো হয়েছে, সেগুলো হলো হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, অসুস্থতা ও আত্মহত্যা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এসব মৃত্যুর বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেনি। উল্লেখ্য, বিডিআরের দুই সদস্য হাবিলদার মহিউদ্দিন ও নায়েক মোবারক হোসেনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। এই দুই ব্যক্তির ময়নাতদন্তের ভিত্তিতে ঢাকার নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ ছাড়া কোন আইনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, তা নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক ছিল। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য তিনটি ভিন্ন কমিটি গঠন ও নিয়োগের মাধ্যমে সরকার জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। এর কারণ, এই তিন কমিটির মধ্যে কোনো রকম সমন্বয় দৃশ্যমান ছিল না। তা ছাড়া এদের একটি কমিটির সঙ্গে অন্য কমিটির প্রাপ্ত তথ্যেরও খুব মিল ছিল না। কারও কারও মত ছিল, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার সেনা আইনে হওয়া উচিত। আবার অনেকে মত দিয়েছে, বিচার হওয়া উচিত বিডিআর আইনে। তৃতীয় মতটি ছিল, হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত সাধারণ আইনে। আবার লক্ষ্য করলাম, এসব তর্কবিতর্কের মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বিডিআর বিদ্রোহের বিচার সেনা আইনে করা যাবে কি না, তার রেফারেন্স পাঠান। রেফারেন্সের শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে আদালতের স্থায়িত্বকারী (এমিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দেন। তাঁদের মধ্যে নয়জনই সেনা আইনে বিচার সম্ভব নয় বলে মতামত দেন। এমিকাস কিউরিদের মতামত শুনানির পর আপিল বিভাগ সেনা আইনে বিচার সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। আপিল বিভাগের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে দুই আইনে। প্রথমত, বিদ্রোহ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিচার হবে বিডিআরের নিজস্ব আইনে। হত্যা, লুটতরাজসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার করা হবে সাধারণ ফৌজদারি আইনে। বিদ্রোহ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গে বিচার করার জন্য সরকার ১৯৭২ সালের বিডিআর আইন অনুসারে ছয়টি বিশেষ আদালত স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি আদালত বিচারকাজ শুরু করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত বিডিআর সদস্যদেরও আদালতে হাজির করা হচ্ছে। অনেক বিডিআর সদস্য স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত বিডিআর সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে তিন হাজার ৯২৫ জন। বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা এবং একটি বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাই।
তবে আমাদের উদ্বেগটা অন্য জায়গায়। আজকের নিজস্ব অনুসন্ধান, আটক বিডিআর সদস্যদের আত্মীয় এবং পত্রিকার বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায়, অনেক বিডিআর সদস্যকে আটক করার পর সংবিধানের বিধান অনুসারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি বরং গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে অনেক পরে। আটক ও গ্রেপ্তার দেখানোর সময়ের মধ্যে যে ফারাক, সেই সময়ও অনেকের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে গৃহীত জবানবন্দি আইন অনুসারে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে না এবং পরবর্তী সময়ে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে যে শুধু জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কোনো অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তা ছাড়া একই ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি জবানবন্দি প্রদান করলে, সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুসারে একজনের জবানবন্দি অন্যজনের জবানবন্দি সমর্থন করে কি না, সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। আমাদের জানামতে, সেনা আইনের জবানবন্দি পরীক্ষা করার এসব আইনি বিধানও মান্য করা হয়নি। ফলে ন্যায্য বিচার বিভ্রান্তি হওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। উপরন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেনাবাহিনী। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে কখনো বিচারের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। কেননা, এর ফলে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা যেমন সব সময়ই থাকে, তেমনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করারও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আমরা বরাবরই পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতি হিসেবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কোনো অবস্থাতেই আমরা যেন ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় না ঘটাই। পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে যেমন বিচারহীন অবস্থায় থাকতে দেওয়া যায় না, তেমনি নিরীহ বিডিআর সদস্যরা যাতে কোনো অবিচারের সম্মুখীন না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা মনে করি, পিলাখানা হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটতে পেরেছে, কারণ আমরা জাতি হিসেবে ন্যায়বিচার, মানবতা বোধ ও যেকোনো রকম সহিংস আচারণের ক্ষেত্রে সহনশীলতা প্রদর্শন—এসব ব্যাপারে যত্নশীল থাকিনি। জীবনের বিভিন্ন স্তর ও ক্ষেত্রে সহিংসতাকে, বিচারহীনতাকে এবং অমানবিক আচরণকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে আমাদের ৩৮ বছর সময় লেগেছে। জেলহত্যার বিচার শুরু করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পূর্ব অঙ্গীকার সত্ত্বেও তা কবে শুরু হবে, আমরা এখনো নিশ্চিত না। আমরা চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে মারা দেখেও নির্বিকার থাকতে পারি। দিনের পর দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলেও তার সমর্থন জানাতে দ্বিধা বোধ করি না। শত শত মানুষের সামনে ফতোয়া দিয়ে দোররা মারা হয় নারীদের। সেখানে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ করি না। এমন হাজারও উদাহরণ দেওয়া যায়। পিলখানার হত্যাকাণ্ডে নিহতদের গভীর বেদনায় স্মরণ করি এবং সেই বেদনা থেকেই বলতে চাই, আর যেন কোনো নৃশংসতা ও সহিংসতা আমাদের বিচারবোধকে আছন্ন না করে।
সুলতানা কামাল: মানবাধিকার কর্মী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে পিলখানার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ না করে রাজনৈতিকভাবে এর মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটার যে আশঙ্কা ছিল সামরিক ও বেসামরিক পিলখানায় যারা বসবাসরত ও আশপাশের মানুষ, তা ঠেকানো গেছে। এবং সমগ্র জাতি সরকারকে এর জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার ‘অপারেশন লেবেল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, অভিযান শুরুর পর থেকেই সেনা হেফাজতে বিডিআরদের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে। বিভিন্ন কারণে এই মৃত্যু হয়েছে বলে বিডিআর সদর দপ্তর ও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও, আজকের নিজস্ব অনুসন্ধান ও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, এদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনের কারণে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, কাজে যোগদানের পর কর্তৃপক্ষের হাতে আটক অবস্থায় মারা যাওয়া বিডিআর সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে ৫৫। মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে যে তিনটি বিষয়কে দেখানো হয়েছে, সেগুলো হলো হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, অসুস্থতা ও আত্মহত্যা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এসব মৃত্যুর বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেনি। উল্লেখ্য, বিডিআরের দুই সদস্য হাবিলদার মহিউদ্দিন ও নায়েক মোবারক হোসেনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। এই দুই ব্যক্তির ময়নাতদন্তের ভিত্তিতে ঢাকার নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ ছাড়া কোন আইনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, তা নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক ছিল। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য তিনটি ভিন্ন কমিটি গঠন ও নিয়োগের মাধ্যমে সরকার জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। এর কারণ, এই তিন কমিটির মধ্যে কোনো রকম সমন্বয় দৃশ্যমান ছিল না। তা ছাড়া এদের একটি কমিটির সঙ্গে অন্য কমিটির প্রাপ্ত তথ্যেরও খুব মিল ছিল না। কারও কারও মত ছিল, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার সেনা আইনে হওয়া উচিত। আবার অনেকে মত দিয়েছে, বিচার হওয়া উচিত বিডিআর আইনে। তৃতীয় মতটি ছিল, হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত সাধারণ আইনে। আবার লক্ষ্য করলাম, এসব তর্কবিতর্কের মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বিডিআর বিদ্রোহের বিচার সেনা আইনে করা যাবে কি না, তার রেফারেন্স পাঠান। রেফারেন্সের শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে আদালতের স্থায়িত্বকারী (এমিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দেন। তাঁদের মধ্যে নয়জনই সেনা আইনে বিচার সম্ভব নয় বলে মতামত দেন। এমিকাস কিউরিদের মতামত শুনানির পর আপিল বিভাগ সেনা আইনে বিচার সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। আপিল বিভাগের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে দুই আইনে। প্রথমত, বিদ্রোহ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিচার হবে বিডিআরের নিজস্ব আইনে। হত্যা, লুটতরাজসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার করা হবে সাধারণ ফৌজদারি আইনে। বিদ্রোহ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গে বিচার করার জন্য সরকার ১৯৭২ সালের বিডিআর আইন অনুসারে ছয়টি বিশেষ আদালত স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি আদালত বিচারকাজ শুরু করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত বিডিআর সদস্যদেরও আদালতে হাজির করা হচ্ছে। অনেক বিডিআর সদস্য স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত বিডিআর সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে তিন হাজার ৯২৫ জন। বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা এবং একটি বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাই।
তবে আমাদের উদ্বেগটা অন্য জায়গায়। আজকের নিজস্ব অনুসন্ধান, আটক বিডিআর সদস্যদের আত্মীয় এবং পত্রিকার বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায়, অনেক বিডিআর সদস্যকে আটক করার পর সংবিধানের বিধান অনুসারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি বরং গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে অনেক পরে। আটক ও গ্রেপ্তার দেখানোর সময়ের মধ্যে যে ফারাক, সেই সময়ও অনেকের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে গৃহীত জবানবন্দি আইন অনুসারে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে না এবং পরবর্তী সময়ে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে যে শুধু জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কোনো অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তা ছাড়া একই ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি জবানবন্দি প্রদান করলে, সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুসারে একজনের জবানবন্দি অন্যজনের জবানবন্দি সমর্থন করে কি না, সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। আমাদের জানামতে, সেনা আইনের জবানবন্দি পরীক্ষা করার এসব আইনি বিধানও মান্য করা হয়নি। ফলে ন্যায্য বিচার বিভ্রান্তি হওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। উপরন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেনাবাহিনী। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে কখনো বিচারের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। কেননা, এর ফলে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা যেমন সব সময়ই থাকে, তেমনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করারও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আমরা বরাবরই পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতি হিসেবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কোনো অবস্থাতেই আমরা যেন ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় না ঘটাই। পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে যেমন বিচারহীন অবস্থায় থাকতে দেওয়া যায় না, তেমনি নিরীহ বিডিআর সদস্যরা যাতে কোনো অবিচারের সম্মুখীন না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা মনে করি, পিলাখানা হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটতে পেরেছে, কারণ আমরা জাতি হিসেবে ন্যায়বিচার, মানবতা বোধ ও যেকোনো রকম সহিংস আচারণের ক্ষেত্রে সহনশীলতা প্রদর্শন—এসব ব্যাপারে যত্নশীল থাকিনি। জীবনের বিভিন্ন স্তর ও ক্ষেত্রে সহিংসতাকে, বিচারহীনতাকে এবং অমানবিক আচরণকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে আমাদের ৩৮ বছর সময় লেগেছে। জেলহত্যার বিচার শুরু করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পূর্ব অঙ্গীকার সত্ত্বেও তা কবে শুরু হবে, আমরা এখনো নিশ্চিত না। আমরা চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে মারা দেখেও নির্বিকার থাকতে পারি। দিনের পর দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলেও তার সমর্থন জানাতে দ্বিধা বোধ করি না। শত শত মানুষের সামনে ফতোয়া দিয়ে দোররা মারা হয় নারীদের। সেখানে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ করি না। এমন হাজারও উদাহরণ দেওয়া যায়। পিলখানার হত্যাকাণ্ডে নিহতদের গভীর বেদনায় স্মরণ করি এবং সেই বেদনা থেকেই বলতে চাই, আর যেন কোনো নৃশংসতা ও সহিংসতা আমাদের বিচারবোধকে আছন্ন না করে।
সুলতানা কামাল: মানবাধিকার কর্মী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments