জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বুঝছি by মুহাম্মদ ইব্রাহীম
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি জানা গেছে প্রায় শত বছর আগে। অন্তত চার দশক ধরে সচেতন বিশ্ব এটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সম্মেলন করছে, সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিকারের চেষ্টাও করছে। তা সত্ত্বেও এতে অবিশ্বাসীদের পক্ষও প্রবল ছিল, এই সেদিন পর্যন্ত। আর এই অবিশ্বাসীদের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে রিও ডি জেনিরোর গ্লোরিয়া সমুদ্রসৈকতে প্রতিবাদী এনজিওদের তাঁবু থেকে বের হওয়া বিক্ষোভে আমিও ছিলাম—অবিশ্বাসী নির্বিকার জর্জ বুশের (সিনিয়র) মুণ্ডুপাত করতে। ওই তাঁবুতেই অনানুষ্ঠানিক আলাপে বক্তব্য শুনি কেনিয়ার পরিবেশবাদী তরুণী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের। আমাদের হিরো হয়ে এসেছিলেন তরুণ সিনেটর আল গোর, মার্কিন প্রশাসনকে ধিক্কার জানাতে। তাঁরা দুজনই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৫ ও ২০০৭ সালে। ২০০৭ সালে এসেই মনে হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে অবিশ্বাসীরা হঠাত্ হালে পানি হারিয়ে ফেলেছে। এটি ঘটতে পেরেছে প্রধানত বৈজ্ঞানিক গবেষণার সর্বশেষ ফলাফলগুলোর অনিবার্যতা ও স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের কারণে। এই লেখায় তার সামান্য পরিচিতি দিতে চাই।
গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার মূল কথা হলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড (ও অন্যান্য আরও দু-একটি গ্যাস) বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর কারণে ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ বাড়ছে। গড় উত্তাপ বহুদিন ধরে মাপা গেলেও বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সরাসরি সূক্ষ্মভাবে মাপা যাচ্ছে মাত্র ১৯৫০ সাল থেকে। উত্তাপের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক দেখাতে হলে আরও প্রাচীন উপাত্ত দরকার। সেটি সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে লাইব্রেরিতে, তবে বইয়ের লাইব্রেরিতে নয়, বরফের লাইব্রেরিতে। চির বরফের অঞ্চলে নলকূপ খোঁড়ার মতো প্রক্রিয়ায় বহু মিটার লম্বা নিরেট নলাকৃতি বরফ আস্ত তুলে আনা হয়—যাকে বলা হয় আইসকোর। প্রতিবছরের তুষারপাতে নতুন এক স্তর বরফ জমে জমে এই আইসকোরে রয়েছে হাজার বছরের বরফ। গত বছরেরটি সবার ওপরে, আর প্রাচীনতমটি সবার নিচে। স্তরের অবস্থান থেকে বলা যায়, কোন বরফ কোন বছরের। আর তাতে আটকা পড়া বুদবুদের মধ্যে জমা বাতাস বিশ্লেষণ করে জানা যায় সে বছর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কত ছিল। তা ছাড়া সাধারণ পানির সঙ্গে সব সময় খুব সামান্য পরিমাণে ভারী আইসোটোপ গঠিত ভারী পানি থাকে। ওই স্তরের বরফে ভারী পানির অনুপাতটি তখনকার গড় উত্তাপটিও নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে।
এতে দেখা যাচ্ছে, এক হাজার বছর আগে থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় সমান থেকেছে ২৮০ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন)। এই সময় গড় উত্তাপও প্রায় সমান থেকেছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর পর থেকে হঠাত্ আশ্চর্যজনকভাবে দুটিই সমানে বেড়েছে, ক্রমবর্ধমান হারে। স্পষ্টত শিল্পবিপ্লবই এর কারণ। অতি সাম্প্রতিককালে এসে বাড়ার হার অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে—২০০৭ সালে হয়েছে ৩৫০ পিপিএম আর ১৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি। এই শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি উত্তাপ বৃদ্ধি সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু এর তাত্পর্য অনেক।
উত্তাপ বৃদ্ধির প্রথম নাটকীয় ফল হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর চারদিকে অনেকখানি জায়গায় বহু যুগ ধরে সঞ্চিত বরফ গলতে থাকা। সম্প্রতি উপগ্রহ থেকে পর পর বছরগুলোতে ছবি নিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এই বরফ এলাকা দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বরফ গলা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে—যার বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। অকুস্থলে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) স্থাপন করে ক্রমে দ্রুততর বরফ গলার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বড় আশঙ্কার কথা হলো, এর মধ্যে চক্রবৃদ্ধি হারের একটি পাগলা ঘোড়া কাজ করছে। উত্তাপ বাড়ছে বলে বরফ গলছে। বরফ গলছে বলে চকচকে বরফ থেকে আগে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করে উত্তাপ যেটুকু কমত, এখন আর তা হচ্ছে না। ফলে উত্তাপ আরও দ্রুত বাড়ছে। তাই বরফ আরও দ্রুত গলে প্রতিফলন আরও দ্রুত কমছে। এভাবে একটি আর একটিকে ক্রমাগত উসকে দিয়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি। এ রকম চক্রবৃদ্ধি আরও কয়েকটি রয়েছে। সমুদ্রের পানি আগে যত কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত করে আটকে রাখতে পারত, উত্তপ্ত হলে তা পারে না, বাতাসে ছেড়ে দেয়। তাতে উত্তাপ আরও বাড়ে, ফলে বাতাসে ছেড়ে দেওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডও বাড়ে। আরও একটি চক্রবৃদ্ধি হলো, উত্তরের বিস্তীর্ণ জায়গায় একটু তলার মাটি রয়েছে বরফ-শীতল হয়ে পার্মাফ্রস্ট রূপে। উত্তাপ বাড়াতে এর সঙ্গে জমে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন (উভয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস) বাতাসে যাচ্ছে। ফলে উত্তাপ আরও বাড়ছে, পার্মাফ্রস্ট আরও দ্রুত গ্যাস ছাড়ছে।
প্রশ্ন হলো, সামনে এরা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? এর উত্তর পাচ্ছি সম্প্রতি অতি উন্নত কম্পিউটার মডেলিং থেকে। জোয়ার মাপার টাইডগেজ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা অনেক দিন ধরে মাপা হচ্ছে, এখন উপগ্রহের সাহায্যেও মাপা হচ্ছে। ১৯৯২ সালের কাছাকাছি বছরগুলোতে এটি বছরে ২ দশমিক ৮ মিমি হারে বেড়েছে। বর্তমানে এই বার্ষিক বৃদ্ধি ৪ মিমিতে দাঁড়িয়েছে। আমাদের খুলনার কাছে স্থানীয় পরিমাপে বৃদ্ধি ৫ দশমিক ১৮ মিমিও পাওয়া গেছে। সমুদ্রে এই পানি বৃদ্ধির পুরোটা বরফ গলার ফল নয়, এর বেশির ভাগ অধিক তাপে পানি আয়তনে সম্প্রসারিত হওয়ার ফল। সমুদ্রে উষ্ণতর পানির আরেকটি ফল হলো অধিক বাষ্পীভবন, যা আবার জমে পানি হওয়ার সময় প্রচুর সুপ্ততাপ বের হয়ে আসে। এটিই ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি জোগায়। ১৯৭০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত জরিপে দেখা গেছে, এ সময় তীব্রতর ঘূর্ণিঝড়গুলোর সংখ্যা (ক্যাটাগরি ৪ ও ক্যাটাগরি ৫) ১৬ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছে। আমাদের সিডর বা আইলাজাতীয় ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ক্রমে যে বাড়বে, এ তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
এসব উপাত্ত নিয়ে আমাদের মডেল ভবিষ্যত্ সম্পর্কে কী বলছে, তা আগামী দশকগুলোতে, পঞ্চাশ বছর কিংবা এক শ বছর পর কী হবে, তার প্রায় নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী দিতে পারছে। অবশ্য ভবিষ্যতে আমাদের আচরণের বিভিন্ন দৃশ্যকল্পের জন্য এই ভবিষ্যদ্বাণী বিভিন্ন হচ্ছে। সবচেয়ে নৈরাশ্যজনক দৃশ্যকল্পে আমরা যেভাবে চলছি, সেভাবে বা তার চেয়েও খারাপভাবে চলব। উন্নত, উন্নয়নশীল—সবাই যেকোনো মূল্যে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ও উচ্চতর ভোগের দিকে ছুটব। সমানে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ব, উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা ক্রমে বাড়বে, বাড়বে জৈব বর্জ্য ও তার থেকে মিথেন নিঃসরণ। এসবের প্রতিকারে কথা হবে মেলা, কাজ হবে নগণ্য। যারা সুবিধায় আছে তারা আসলে ছাড় দেবে খুবই সামান্য। সে ক্ষেত্রে মডেল দেখাচ্ছে এ পর্যন্ত শূন্য ৬ ডিগ্রি উত্তাপ বৃদ্ধি এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বেড়ে ১০ গুণ হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে অন্তত এক মিটার। বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ সমুদ্রে চলে যাবে। আরও ভয়ানক আশঙ্কা হলো উত্তাপ বৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি অতিক্রম করলে সেই পাগলা ঘোড়া এমন লাফ দেবে যে মেরু অঞ্চলের সব বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠ কয়েক মিটার বাড়বে। এ রকম পরিস্থিতি কল্পনা করতেই শিউরে উঠতে হয়। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, কৃষি ও খাদ্য ধ্বংস ইত্যাদি যোগ করলে তো কথাই নেই। এরপর পৃথিবীটি আর কত দিন মানুষের বা অন্যান্য প্রাণীর বাসযোগ্য থাকবে, সেটিই হবে চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে সবচেয়ে কাম্য দৃশ্যকল্পটিতে সর্বত্র মানুষের সব কর্মকাণ্ড নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সহযোগিতা এমন পর্যায়ে যাবে যে ভোগ বাড়ানো নয়, পৃথিবীকে সবার জন্য স্বচ্ছন্দ করাটাই হবে লক্ষ্য। দারিদ্র্য দূর হয়ে শেষোক্তদের পক্ষেও এতে অবদানের ক্ষমতা বাড়বে, জনসংখ্যা কমবে, সব জৈব বর্জ্য রিসাইকেল হবে, জ্ঞান ও সেবানির্ভর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশে দেশে সমতা ও সুবিচার বাড়াবে। মডেল বলছে, এই দৃশ্যকল্প পূর্ণ বাস্তবায়িত হলেও অতীত পাপের কারণে কিছু ক্ষতি হবেই, তবে তা সহনশক্তির মধ্যে থাকবে। শতাব্দীর শেষে গিয়ে গড় উত্তাপ বৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ ডিগ্রির নিচে থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১০ সেন্টিমিটারের বেশি বাড়বে না। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা নিজকে রক্ষার ও উন্নত জীবন গড়ার সুযোগ পাব।
এখন কোপেনহেগেনে বিশ্বসমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কোন দৃশ্যকল্প বেছে নেব।
মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার মূল কথা হলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড (ও অন্যান্য আরও দু-একটি গ্যাস) বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর কারণে ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ বাড়ছে। গড় উত্তাপ বহুদিন ধরে মাপা গেলেও বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সরাসরি সূক্ষ্মভাবে মাপা যাচ্ছে মাত্র ১৯৫০ সাল থেকে। উত্তাপের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক দেখাতে হলে আরও প্রাচীন উপাত্ত দরকার। সেটি সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে লাইব্রেরিতে, তবে বইয়ের লাইব্রেরিতে নয়, বরফের লাইব্রেরিতে। চির বরফের অঞ্চলে নলকূপ খোঁড়ার মতো প্রক্রিয়ায় বহু মিটার লম্বা নিরেট নলাকৃতি বরফ আস্ত তুলে আনা হয়—যাকে বলা হয় আইসকোর। প্রতিবছরের তুষারপাতে নতুন এক স্তর বরফ জমে জমে এই আইসকোরে রয়েছে হাজার বছরের বরফ। গত বছরেরটি সবার ওপরে, আর প্রাচীনতমটি সবার নিচে। স্তরের অবস্থান থেকে বলা যায়, কোন বরফ কোন বছরের। আর তাতে আটকা পড়া বুদবুদের মধ্যে জমা বাতাস বিশ্লেষণ করে জানা যায় সে বছর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কত ছিল। তা ছাড়া সাধারণ পানির সঙ্গে সব সময় খুব সামান্য পরিমাণে ভারী আইসোটোপ গঠিত ভারী পানি থাকে। ওই স্তরের বরফে ভারী পানির অনুপাতটি তখনকার গড় উত্তাপটিও নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে।
এতে দেখা যাচ্ছে, এক হাজার বছর আগে থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় সমান থেকেছে ২৮০ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন)। এই সময় গড় উত্তাপও প্রায় সমান থেকেছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর পর থেকে হঠাত্ আশ্চর্যজনকভাবে দুটিই সমানে বেড়েছে, ক্রমবর্ধমান হারে। স্পষ্টত শিল্পবিপ্লবই এর কারণ। অতি সাম্প্রতিককালে এসে বাড়ার হার অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে—২০০৭ সালে হয়েছে ৩৫০ পিপিএম আর ১৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি। এই শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি উত্তাপ বৃদ্ধি সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু এর তাত্পর্য অনেক।
উত্তাপ বৃদ্ধির প্রথম নাটকীয় ফল হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর চারদিকে অনেকখানি জায়গায় বহু যুগ ধরে সঞ্চিত বরফ গলতে থাকা। সম্প্রতি উপগ্রহ থেকে পর পর বছরগুলোতে ছবি নিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এই বরফ এলাকা দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বরফ গলা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে—যার বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। অকুস্থলে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) স্থাপন করে ক্রমে দ্রুততর বরফ গলার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বড় আশঙ্কার কথা হলো, এর মধ্যে চক্রবৃদ্ধি হারের একটি পাগলা ঘোড়া কাজ করছে। উত্তাপ বাড়ছে বলে বরফ গলছে। বরফ গলছে বলে চকচকে বরফ থেকে আগে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করে উত্তাপ যেটুকু কমত, এখন আর তা হচ্ছে না। ফলে উত্তাপ আরও দ্রুত বাড়ছে। তাই বরফ আরও দ্রুত গলে প্রতিফলন আরও দ্রুত কমছে। এভাবে একটি আর একটিকে ক্রমাগত উসকে দিয়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি। এ রকম চক্রবৃদ্ধি আরও কয়েকটি রয়েছে। সমুদ্রের পানি আগে যত কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত করে আটকে রাখতে পারত, উত্তপ্ত হলে তা পারে না, বাতাসে ছেড়ে দেয়। তাতে উত্তাপ আরও বাড়ে, ফলে বাতাসে ছেড়ে দেওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডও বাড়ে। আরও একটি চক্রবৃদ্ধি হলো, উত্তরের বিস্তীর্ণ জায়গায় একটু তলার মাটি রয়েছে বরফ-শীতল হয়ে পার্মাফ্রস্ট রূপে। উত্তাপ বাড়াতে এর সঙ্গে জমে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন (উভয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস) বাতাসে যাচ্ছে। ফলে উত্তাপ আরও বাড়ছে, পার্মাফ্রস্ট আরও দ্রুত গ্যাস ছাড়ছে।
প্রশ্ন হলো, সামনে এরা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? এর উত্তর পাচ্ছি সম্প্রতি অতি উন্নত কম্পিউটার মডেলিং থেকে। জোয়ার মাপার টাইডগেজ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা অনেক দিন ধরে মাপা হচ্ছে, এখন উপগ্রহের সাহায্যেও মাপা হচ্ছে। ১৯৯২ সালের কাছাকাছি বছরগুলোতে এটি বছরে ২ দশমিক ৮ মিমি হারে বেড়েছে। বর্তমানে এই বার্ষিক বৃদ্ধি ৪ মিমিতে দাঁড়িয়েছে। আমাদের খুলনার কাছে স্থানীয় পরিমাপে বৃদ্ধি ৫ দশমিক ১৮ মিমিও পাওয়া গেছে। সমুদ্রে এই পানি বৃদ্ধির পুরোটা বরফ গলার ফল নয়, এর বেশির ভাগ অধিক তাপে পানি আয়তনে সম্প্রসারিত হওয়ার ফল। সমুদ্রে উষ্ণতর পানির আরেকটি ফল হলো অধিক বাষ্পীভবন, যা আবার জমে পানি হওয়ার সময় প্রচুর সুপ্ততাপ বের হয়ে আসে। এটিই ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি জোগায়। ১৯৭০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত জরিপে দেখা গেছে, এ সময় তীব্রতর ঘূর্ণিঝড়গুলোর সংখ্যা (ক্যাটাগরি ৪ ও ক্যাটাগরি ৫) ১৬ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছে। আমাদের সিডর বা আইলাজাতীয় ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ক্রমে যে বাড়বে, এ তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
এসব উপাত্ত নিয়ে আমাদের মডেল ভবিষ্যত্ সম্পর্কে কী বলছে, তা আগামী দশকগুলোতে, পঞ্চাশ বছর কিংবা এক শ বছর পর কী হবে, তার প্রায় নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী দিতে পারছে। অবশ্য ভবিষ্যতে আমাদের আচরণের বিভিন্ন দৃশ্যকল্পের জন্য এই ভবিষ্যদ্বাণী বিভিন্ন হচ্ছে। সবচেয়ে নৈরাশ্যজনক দৃশ্যকল্পে আমরা যেভাবে চলছি, সেভাবে বা তার চেয়েও খারাপভাবে চলব। উন্নত, উন্নয়নশীল—সবাই যেকোনো মূল্যে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ও উচ্চতর ভোগের দিকে ছুটব। সমানে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ব, উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা ক্রমে বাড়বে, বাড়বে জৈব বর্জ্য ও তার থেকে মিথেন নিঃসরণ। এসবের প্রতিকারে কথা হবে মেলা, কাজ হবে নগণ্য। যারা সুবিধায় আছে তারা আসলে ছাড় দেবে খুবই সামান্য। সে ক্ষেত্রে মডেল দেখাচ্ছে এ পর্যন্ত শূন্য ৬ ডিগ্রি উত্তাপ বৃদ্ধি এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বেড়ে ১০ গুণ হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে অন্তত এক মিটার। বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ সমুদ্রে চলে যাবে। আরও ভয়ানক আশঙ্কা হলো উত্তাপ বৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি অতিক্রম করলে সেই পাগলা ঘোড়া এমন লাফ দেবে যে মেরু অঞ্চলের সব বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠ কয়েক মিটার বাড়বে। এ রকম পরিস্থিতি কল্পনা করতেই শিউরে উঠতে হয়। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, কৃষি ও খাদ্য ধ্বংস ইত্যাদি যোগ করলে তো কথাই নেই। এরপর পৃথিবীটি আর কত দিন মানুষের বা অন্যান্য প্রাণীর বাসযোগ্য থাকবে, সেটিই হবে চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে সবচেয়ে কাম্য দৃশ্যকল্পটিতে সর্বত্র মানুষের সব কর্মকাণ্ড নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সহযোগিতা এমন পর্যায়ে যাবে যে ভোগ বাড়ানো নয়, পৃথিবীকে সবার জন্য স্বচ্ছন্দ করাটাই হবে লক্ষ্য। দারিদ্র্য দূর হয়ে শেষোক্তদের পক্ষেও এতে অবদানের ক্ষমতা বাড়বে, জনসংখ্যা কমবে, সব জৈব বর্জ্য রিসাইকেল হবে, জ্ঞান ও সেবানির্ভর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশে দেশে সমতা ও সুবিচার বাড়াবে। মডেল বলছে, এই দৃশ্যকল্প পূর্ণ বাস্তবায়িত হলেও অতীত পাপের কারণে কিছু ক্ষতি হবেই, তবে তা সহনশক্তির মধ্যে থাকবে। শতাব্দীর শেষে গিয়ে গড় উত্তাপ বৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ ডিগ্রির নিচে থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১০ সেন্টিমিটারের বেশি বাড়বে না। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা নিজকে রক্ষার ও উন্নত জীবন গড়ার সুযোগ পাব।
এখন কোপেনহেগেনে বিশ্বসমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কোন দৃশ্যকল্প বেছে নেব।
মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments