আফ-পাক যুদ্ধ -ভারত-পাকিস্তানের পারস্পরিক অবিশ্বাসের বিপদ by কুলদীপ নায়ার
কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন আফগাননীতি প্রণয়নের সময় পাকিস্তান ও তার স্বার্থের বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি জানান। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ করার ওপরও তিনি জোর আরোপ করেন। আফগানিস্তানে ৩০ হাজার সেনা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসলামাবাদকে উপেক্ষা করেছেন, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। পাকিস্তানের কাছ থেকেও কোনো প্রতিবাদ আসেনি যে, দেশটির স্বার্থের কথা এতে বিবেচিত হয়নি।
২০ হাজার বাড়তি মার্কিন সেনা এরই মধ্যে আফগানিস্তানে পৌঁছে গেছে। সেনাসংখ্যা বাড়ানোর যথার্থতা যা-ই হোক, এই অঞ্চলের জন্য এটি কোনো সুখকর অগ্রগতি নয়। জেনারেল স্টানলি ম্যাকক্রিস্টালকে বলতে শোনা গেছে, প্রচণ্ড ইতিবাচক অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে ম্যাকক্রিস্টাল সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এমন বক্তব্যের সময় এখনো হয়নি। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ভিয়েতনাম, ইরাক বা অন্য কোনো জায়গায় যেখানেই মার্কিন বাহিনী গেছে, সেখানেই পেছনে ফেলে গেছে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের তেজোদীপ্ততার প্রমাণ তারা রাখতে পারেনি।
আফগানিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ব্রিটিশ বা সোভিয়েত—কোনো শক্তিই আফগানিস্তানের স্পর্ধিত উপজাতিদের বাগে আনতে পারেনি, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা। বিদেশি সেনারা তাদের প্রচারণায় ইসলামের প্রভাবের কথা বলেছে। অশিক্ষিত জনগণ, যাদের লাভজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, তারা দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে না হেঁটে মৌলবাদের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। সমাজের অধিপতিরা অর্থের বিনিময়ে চুপ থাকার পথ বেছে নেয়; তারা কাউকে ভবিষ্যতের ওপর আস্থাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে না। তাই উপজাতীয় জনগণ সীমাহীন
দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে যায়।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যার এ কাজে প্রয়োজনীয় সামর্থ্য আছে। কিন্তু দেশটির জন্য সমস্যা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে কারজাইয়ের শাসনাধীন আফগানিস্তানের চেয়ে তালেবানের শাসনাধীন আফগানিস্তান অনেক বেশি বন্ধুসুলভ ও নির্ভরযোগ্য। তালেবানের শাসনের অধীনে স্বেচ্ছাচারী উপজাতিদের অনেকটা বাগে আনা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানের অন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ওপর ভারতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেড়েছে। ইসলামাবাদ এখনো স্বপ্ন দেখে, একসময় পাকিস্তানের কৌশলগত গভীরতা অর্জনে আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হবে। উপজাতীয় হুমকি চিরতরে অবসানে পাকিস্তান কতটুকু কাজ করবে, সেটিও তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পাকিস্তানি সেনারা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তের সোয়াত উপত্যকা থেকে তালেবানদের হটিয়েছে এবং দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তাদের পরাস্ত করেছে—এসব সত্যি। সোয়াত পাকিস্তানের অংশ, যে শরণার্থীরা সেখানে এখন ফিরে গেছে, তারা সব পাকিস্তানি। তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু ওয়াজিরিস্তানের বিজয় ধরে রাখা মুশকিল হবে, যদি স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানকে তাদের মুক্তিদাতা মনে না করে, পাকিস্তানের পেছনে তাদের সমর্থন না জানায়। এ সংশয় হয়তো ইসলামাবাদকে কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান খোঁজার পথে না গিয়ে বরং তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার পথে যাওয়া অধিকতর গ্রহণযোগ্য—এমন উপলব্ধি তৈরি করেছে। এ ছাড়া, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোয় তালেবানরা যে রকম ধ্বংসাত্মক বোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে, লাহোর যেমন আবারও হামলার লক্ষ্যস্থল হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায়, ইসলামাবাদ বা পশ্চিমের থেকে তালেবানের সহযোগী-সংখ্যা বেশি। অতি সুরক্ষিত জায়গায় যেভাবে তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে, তাতে ভেতরের অনেকে যে জড়িত, এমন কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর একই সময়ে ওবামা যখন বলেন, নতুন সেনাদের জন্য ১৮ মাসের সময়সীমা বাঁধা, এরপর তাদের অল্প অল্প করে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে—এ কথার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি পাকিস্তানকেও এ সময়সীমার সঙ্গে দেশটির ভূমিকাকেও জড়িত করার কথাই বলেন। এর মানে হলো, মার্কিন সেনাদের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান যেন এই এলাকার নিরাপত্তা বিধান করার সামর্থ্য অর্জন করে। সে সময় পর্যন্ত তালেবানকে নীরবে ঘাপটি মেরে থাকার পথ খুঁজে পেলেই হবে। এ কারণেই হয়তো এখন মার্কিন আক্রমণ তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়ছে না। শত শত বছর ধরে যে উপজাতীয় জনগণ কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা করেনি, তাদের ১৮ মাসে হারানো যাবে না—এ কথা পাকিস্তান বা যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই জানা। একই কথা পাকিস্তানে তালেবানবিরোধী যুদ্ধের ব্যাপারেও খাটে—এ যুদ্ধে জনসমর্থন বেশ কম।
সম্প্রতি পাকিস্তানে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশটিতে গণতান্ত্রিক ও শরিয়া শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন সমান, উভয়ই ৩০ শতাংশ করে। জনগণ মৌলবাদীদের যতটুকু বিরোধী, ততটুকুই বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের জন্য এটি সন্তোষজনক না হলেও দিনের পর দিন এ বিরোধিতা স্পষ্ট হচ্ছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনগণের অংশীদারি আছে, যুদ্ধবিগ্রহে নয়। বছরের পর বছর তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন তারা দেখছে না। আসলে তারা ধর্মকে প্রবলভাবে আঁকড়ে থাকাকে ‘পশ্চিমা খেলায়’ অর্থ নষ্টের চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক মনে করে।
তালেবানবিরোধী নীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান আগামী পাঁচ বছরে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পেতে যাচ্ছে, এ বিষয়টি পরিষ্কার। কিন্তু এই অর্থ পেতে অবমাননাকর শর্ত মেনে নেওয়ার কারণ ঘোলাটে। অতীতে যেমন ঘটেছে, এবারও তেমনি যদি কিছু কর্তাব্যক্তির পকেট ভারী বা অস্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করতে এই অর্থ ঢালা হয়, তাহলে জনগণের অংশটা কি থাকে? শাসকেরা যে দলেরই হোক, আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানকে এক ধরনের কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে চালিত করবে, এমন কল্পনা বেশ দুরূহ। শুরুতে হটাতে হবে সামন্ততন্ত্র। এ লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
তবুও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতেই হবে, কারণ তা এই অঞ্চলের জনগণের জীবন অনিরাপদ করে তুলেছে। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় সন্ত্রাসবাদের শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে জনগণ কীভাবে জীবন যাপন করবে। এ জন্য আঞ্চলিক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তান মিলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি সাধারণ কৌশল নির্ধারণ এবং যৌথ ফ্রন্ট গঠন করা উচিত ছিল।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার সম্পর্ক না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। ইসলামাবাদের কাছে নয়াদিল্লির অবস্থান অনমনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু নয়াদিল্লি যদি মনে করে, পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির বিস্তার ঘটাতে সন্ত্রাসবাদ ব্যবহার করে, তাহলে নয়াদিল্লির দৃঢ়প্রত্যয় উত্পাদনের জন্য ইসলামাবাদের কেবল বিবৃতি দিলেই চলবে না, আরও বেশি কিছু করতে হবে। এখানে একটি শূন্যতা রয়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র এখন পূরণ করছে। নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ—উভয়ই ওয়াশিংটনকে এ ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে পারস্পরিক অবিশ্বাস শুধুই গভীরতর হয়েছে। সমস্যার মূলে আছে অবিশ্বাস, কাশ্মীর নয়। অবিশ্বাস দূর না হলে, পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচবে না। বর্তমান কাশ্মীর-সমস্যার হয়তো সমাধান হবে, কিন্তু তখন গজিয়ে উঠবে আরেক কাশ্মীর-সমস্যা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
২০ হাজার বাড়তি মার্কিন সেনা এরই মধ্যে আফগানিস্তানে পৌঁছে গেছে। সেনাসংখ্যা বাড়ানোর যথার্থতা যা-ই হোক, এই অঞ্চলের জন্য এটি কোনো সুখকর অগ্রগতি নয়। জেনারেল স্টানলি ম্যাকক্রিস্টালকে বলতে শোনা গেছে, প্রচণ্ড ইতিবাচক অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে ম্যাকক্রিস্টাল সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এমন বক্তব্যের সময় এখনো হয়নি। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ভিয়েতনাম, ইরাক বা অন্য কোনো জায়গায় যেখানেই মার্কিন বাহিনী গেছে, সেখানেই পেছনে ফেলে গেছে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের তেজোদীপ্ততার প্রমাণ তারা রাখতে পারেনি।
আফগানিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ব্রিটিশ বা সোভিয়েত—কোনো শক্তিই আফগানিস্তানের স্পর্ধিত উপজাতিদের বাগে আনতে পারেনি, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা। বিদেশি সেনারা তাদের প্রচারণায় ইসলামের প্রভাবের কথা বলেছে। অশিক্ষিত জনগণ, যাদের লাভজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, তারা দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে না হেঁটে মৌলবাদের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। সমাজের অধিপতিরা অর্থের বিনিময়ে চুপ থাকার পথ বেছে নেয়; তারা কাউকে ভবিষ্যতের ওপর আস্থাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে না। তাই উপজাতীয় জনগণ সীমাহীন
দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে যায়।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যার এ কাজে প্রয়োজনীয় সামর্থ্য আছে। কিন্তু দেশটির জন্য সমস্যা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে কারজাইয়ের শাসনাধীন আফগানিস্তানের চেয়ে তালেবানের শাসনাধীন আফগানিস্তান অনেক বেশি বন্ধুসুলভ ও নির্ভরযোগ্য। তালেবানের শাসনের অধীনে স্বেচ্ছাচারী উপজাতিদের অনেকটা বাগে আনা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানের অন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ওপর ভারতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেড়েছে। ইসলামাবাদ এখনো স্বপ্ন দেখে, একসময় পাকিস্তানের কৌশলগত গভীরতা অর্জনে আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হবে। উপজাতীয় হুমকি চিরতরে অবসানে পাকিস্তান কতটুকু কাজ করবে, সেটিও তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পাকিস্তানি সেনারা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তের সোয়াত উপত্যকা থেকে তালেবানদের হটিয়েছে এবং দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তাদের পরাস্ত করেছে—এসব সত্যি। সোয়াত পাকিস্তানের অংশ, যে শরণার্থীরা সেখানে এখন ফিরে গেছে, তারা সব পাকিস্তানি। তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু ওয়াজিরিস্তানের বিজয় ধরে রাখা মুশকিল হবে, যদি স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানকে তাদের মুক্তিদাতা মনে না করে, পাকিস্তানের পেছনে তাদের সমর্থন না জানায়। এ সংশয় হয়তো ইসলামাবাদকে কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান খোঁজার পথে না গিয়ে বরং তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার পথে যাওয়া অধিকতর গ্রহণযোগ্য—এমন উপলব্ধি তৈরি করেছে। এ ছাড়া, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোয় তালেবানরা যে রকম ধ্বংসাত্মক বোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে, লাহোর যেমন আবারও হামলার লক্ষ্যস্থল হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায়, ইসলামাবাদ বা পশ্চিমের থেকে তালেবানের সহযোগী-সংখ্যা বেশি। অতি সুরক্ষিত জায়গায় যেভাবে তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে, তাতে ভেতরের অনেকে যে জড়িত, এমন কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর একই সময়ে ওবামা যখন বলেন, নতুন সেনাদের জন্য ১৮ মাসের সময়সীমা বাঁধা, এরপর তাদের অল্প অল্প করে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে—এ কথার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি পাকিস্তানকেও এ সময়সীমার সঙ্গে দেশটির ভূমিকাকেও জড়িত করার কথাই বলেন। এর মানে হলো, মার্কিন সেনাদের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান যেন এই এলাকার নিরাপত্তা বিধান করার সামর্থ্য অর্জন করে। সে সময় পর্যন্ত তালেবানকে নীরবে ঘাপটি মেরে থাকার পথ খুঁজে পেলেই হবে। এ কারণেই হয়তো এখন মার্কিন আক্রমণ তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়ছে না। শত শত বছর ধরে যে উপজাতীয় জনগণ কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা করেনি, তাদের ১৮ মাসে হারানো যাবে না—এ কথা পাকিস্তান বা যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই জানা। একই কথা পাকিস্তানে তালেবানবিরোধী যুদ্ধের ব্যাপারেও খাটে—এ যুদ্ধে জনসমর্থন বেশ কম।
সম্প্রতি পাকিস্তানে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশটিতে গণতান্ত্রিক ও শরিয়া শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন সমান, উভয়ই ৩০ শতাংশ করে। জনগণ মৌলবাদীদের যতটুকু বিরোধী, ততটুকুই বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের জন্য এটি সন্তোষজনক না হলেও দিনের পর দিন এ বিরোধিতা স্পষ্ট হচ্ছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনগণের অংশীদারি আছে, যুদ্ধবিগ্রহে নয়। বছরের পর বছর তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন তারা দেখছে না। আসলে তারা ধর্মকে প্রবলভাবে আঁকড়ে থাকাকে ‘পশ্চিমা খেলায়’ অর্থ নষ্টের চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক মনে করে।
তালেবানবিরোধী নীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান আগামী পাঁচ বছরে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পেতে যাচ্ছে, এ বিষয়টি পরিষ্কার। কিন্তু এই অর্থ পেতে অবমাননাকর শর্ত মেনে নেওয়ার কারণ ঘোলাটে। অতীতে যেমন ঘটেছে, এবারও তেমনি যদি কিছু কর্তাব্যক্তির পকেট ভারী বা অস্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করতে এই অর্থ ঢালা হয়, তাহলে জনগণের অংশটা কি থাকে? শাসকেরা যে দলেরই হোক, আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানকে এক ধরনের কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে চালিত করবে, এমন কল্পনা বেশ দুরূহ। শুরুতে হটাতে হবে সামন্ততন্ত্র। এ লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
তবুও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতেই হবে, কারণ তা এই অঞ্চলের জনগণের জীবন অনিরাপদ করে তুলেছে। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় সন্ত্রাসবাদের শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে জনগণ কীভাবে জীবন যাপন করবে। এ জন্য আঞ্চলিক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তান মিলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি সাধারণ কৌশল নির্ধারণ এবং যৌথ ফ্রন্ট গঠন করা উচিত ছিল।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার সম্পর্ক না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। ইসলামাবাদের কাছে নয়াদিল্লির অবস্থান অনমনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু নয়াদিল্লি যদি মনে করে, পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির বিস্তার ঘটাতে সন্ত্রাসবাদ ব্যবহার করে, তাহলে নয়াদিল্লির দৃঢ়প্রত্যয় উত্পাদনের জন্য ইসলামাবাদের কেবল বিবৃতি দিলেই চলবে না, আরও বেশি কিছু করতে হবে। এখানে একটি শূন্যতা রয়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র এখন পূরণ করছে। নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ—উভয়ই ওয়াশিংটনকে এ ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে পারস্পরিক অবিশ্বাস শুধুই গভীরতর হয়েছে। সমস্যার মূলে আছে অবিশ্বাস, কাশ্মীর নয়। অবিশ্বাস দূর না হলে, পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচবে না। বর্তমান কাশ্মীর-সমস্যার হয়তো সমাধান হবে, কিন্তু তখন গজিয়ে উঠবে আরেক কাশ্মীর-সমস্যা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments