দেশহীন মানুষের কথা: ধরিত্রী আমার নয়, আমিই ধরিত্রীর by সঞ্জীব দ্রং
পাহাড়ের
কথা লিখতে গিয়ে সব সময় মহাশ্বেতা দেবীর কথা মনে পড়ে। এক যুগ আগে চিম্বুক
পাহাড়ের কোলে, বাগানপাড়ায় মেননিয়াম ম্রোর বাড়ি গিয়েছিলাম। তারপর এম্পুপাড়ার
পথে যেতে যেতে বাস্তার পাশে একটু দাঁড়িয়েছিলাম। বৃষ্টিশেষে রোদ উঠেছিল
তখন। সামনে, পেছনে, দূরে, কাছে সব পাহাড়, অপরূপ সুন্দর এক বাংলাদেশ। নিচে
মেঘমালা আর আর ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। বাড়িগুলো বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি। মাচাং
ধরনের। এখানে ধরিত্রী, প্রকৃতি ও মানুষ পরিপূরক ও একাকার। মানুষ ধরিত্রীর,
ধরিত্রী মানুষের নয়। বাঙালিরা বলেন, পৃথিবী আমার, ভূমি আমার। আমরা
আদিবাসীরা বলি, পৃথিবী আমার নয়, আমিই পৃথিবীর। এই ভূমি আমার নয়, আমিই
ভূমির। এই ধরিত্রী ও ভূমি কেনাবেচা করার, একে নষ্ট করার, ধ্বংস করার অধিকার
মানুষের নেই। মানুষ ধরিত্রী ও ভূমির মালিক নয়, যত্নকারী ও রক্ষাকারী মাত্র
এবং এ ধরিত্রীকে অনাগত শিশুদের জন্য সুন্দর করে রেখে যাওয়া তার দায়িত্ব।
কিছুদিন আগে আবার ম্রোদের পাড়ায় গেলাম। বান্দরবানে এসব পাহাড় ও ভূমি ছিল তাদের, আর খেয়াং, বম, লুসাই, ত্রিপুরা, পাংখুদের। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর বিখ্যাত টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা উপন্যাসের শেষের দিকে লিখেছেন, ‘আদিবাসীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কোনো সংবাহন বিন্দু তৈরি করিনি আমরা। অনাবিষ্কৃত রেখেই ধীরে, সভ্যতার নামে ধ্বংস করেছি এক মহাদেশ। নো কমিউনিকেশন। একেবারে নেই? সেটা গড়ে তোলা কি অসম্ভব? গড়তে হলে যে অসম্ভব ভালোবাসতে হয় বহুকাল ধরে। কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা ওদের তো ভালোবাসিনি, সম্মান করিনি। এখন সময় কোথায়, শতাব্দীর শেষ সময়ে? সমান্তরাল পথ, ওদের পৃথিবী আমাদের পৃথিবী আলাদা, ওদের সঙ্গেও কোনো প্রকৃত আদান-প্রদান হয়নি, যা আমাদের সমৃদ্ধ করত।’ পরে লেখক আবার বলেছেন, ‘ভালোবাসা, প্রচণ্ড, নিদারুণ, বিস্ফোরক ভালোবাসা পারে এ কাজে এখনো আমাদের ব্রতী করতে শতাব্দীর সূর্য যখন পশ্চিম গগনে, নইলে ভীষণ দাম দিতে হবে এই আগ্রাসী সভ্যতাকে। প্রতিবার আগ্রাসী সভ্যতা নিজেকে ধ্বংসই করে অগ্রসরণের নামে, ইতিহাস দেখ। ভালোবাসা, নিদারুণ ভালোবাসা, তাই হোক প্রথম পদক্ষেপ।’
চিম্বুকের এম্পুপাড়ার ওই পথে দাঁড়িয়ে মেল গিবসনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অ্যাপোক্যালিপ্ট-এর শেষ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখনো এইচবিও ও স্টার মুভিতে ছবিটি মাঝেমধ্যে দেখানো হয়। মায়া আদিবাসীদের নিয়ে ছবি। ছবিতে আদিবাসী নায়ককে অস্ত্রশস্ত্রসহ তাড়া করছে শয়তানের দল। প্রাণপণে ছুটছে নায়ক বনের ভেতর দিয়ে। একসময় গভীর এক জলপ্রপাতের ভেতর নায়ক ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূরে জলপ্রপাতের ওপারে শয়তানের দল দাঁড়িয়ে থাকে। নায়ক আদিবাসী যুবক ওদের দিকে চিত্কার করে বলে, ‘এই বন আমার। এখানে শিকার করেছিল আমার বাবা। এই বনে শিকার করব আমি, আমার সন্তান এবং ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের সন্তান।’ এ ছবির শেষ দৃশ্যটি আরও অর্থবহ। শয়তানদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয় নায়ক। কোলে তার নবজাত সন্তান চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে। একটু দূরে সমুদ্রের তীরে কয়েকটি জাহাজ ভেড়ে। ওখানে অচেনা মানুষের দল। নায়ককে স্ত্রী প্রশ্ন করে ওরা কারা, আমরা কি তাদের সঙ্গে যাব? নায়ক তার নবজাত সন্তানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওরা এই বনে বহিরাগত মানুষ নিয়ে আসে। আমরা ওদের সঙ্গে যাব না, বনে ফিরে যাব, আমাদের সন্তানের জন্য নতুন স্বপ্ন রচনা করব।’ যে কেউ সিডির দোকান থেকে এ ছবির কপি কিনে দেখতে পারেন। বান্দরবানে ম্রোদের পাড়ায় দাঁড়িয়ে আমার অ্যাপোক্যালিপ্ট-এর দৃশ্য চোখে ভাসে।
ম্রোদের পাড়া থেকে যখন ফিরি তখন পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ওরা বলল, ওদের জুম বাগানভূমি, বিচরণক্ষেত্র, পূর্বপুরুষের অবারিত রেখে যাওয়া বিস্তীর্ণ বন ও পাহাড় বেদখলে চলে যাচ্ছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওদের অনুমতি তো দূরে থাক, ওদের কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন, অর্থহীন এমনকি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এক আদিবাসী সমাজ, যারা ধরিত্রী ও প্রকৃতিকে, বনকে, পাহাড়ের বুকে বয়ে চলা নদী ও জলধারাকে, বৃক্ষ ও পরিবেশকে এতকাল রক্ষা করে এসেছে সবার জন্য, তারা এখন উপেক্ষিত বিলুপ্তপ্রায় অসহায় জাতি। এ ধারায় চললে একদিন ওরা হারিয়ে যাবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসার যে শিক্ষা ওদের আছে, তা এই শহরে কোথায় পাব আমরা? ওরা হারিয়ে গেলে শুধু ওদের না, আমাদের দেশের ও পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়াবহ চিত্র পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছে, মেনে নিতে হবে যে আদিবাসী জীবন কাছ থেকে আধুনিক সভ্যতা ও রাষ্ট্র কিছুই শেখেনি। এ বিষয়ে মহাশ্বেতা দেবী ওই উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিচেতনা, সভ্যতা, সব মিলিয়ে যেন নানা সম্পদে শোভিত এক মহাদেশ। আমরা, মূলস্রোতের মানুষেরা, সে মহাদেশকে জানার চেষ্টা না করেই ধ্বংস করে ফেলেছি, তা অস্বীকার করার পথ নেই।...মূলস্রোতের ধাক্কায় এদের বারবার দেশান্তরী হতে হয়েছে। ফলে অনেক কিছু গেছে হারিয়ে। মূলস্রোত এ বিষয়ে যে অপরাধে অপরাধী তার ক্ষমা নেই।’
আমাদের রাষ্ট্রকে এই আদিবাসীদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিপন্নতার জন্য দায়ী করলেই তো হবে না, ওদের রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সবার আগে দরকার ওদের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও জীবনের স্বীকৃতি। ধরিত্রী ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে বন্ধন ও মমতা তৈরি করে গেছে ওরা, তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
>>>সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com
কিছুদিন আগে আবার ম্রোদের পাড়ায় গেলাম। বান্দরবানে এসব পাহাড় ও ভূমি ছিল তাদের, আর খেয়াং, বম, লুসাই, ত্রিপুরা, পাংখুদের। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর বিখ্যাত টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা উপন্যাসের শেষের দিকে লিখেছেন, ‘আদিবাসীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কোনো সংবাহন বিন্দু তৈরি করিনি আমরা। অনাবিষ্কৃত রেখেই ধীরে, সভ্যতার নামে ধ্বংস করেছি এক মহাদেশ। নো কমিউনিকেশন। একেবারে নেই? সেটা গড়ে তোলা কি অসম্ভব? গড়তে হলে যে অসম্ভব ভালোবাসতে হয় বহুকাল ধরে। কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা ওদের তো ভালোবাসিনি, সম্মান করিনি। এখন সময় কোথায়, শতাব্দীর শেষ সময়ে? সমান্তরাল পথ, ওদের পৃথিবী আমাদের পৃথিবী আলাদা, ওদের সঙ্গেও কোনো প্রকৃত আদান-প্রদান হয়নি, যা আমাদের সমৃদ্ধ করত।’ পরে লেখক আবার বলেছেন, ‘ভালোবাসা, প্রচণ্ড, নিদারুণ, বিস্ফোরক ভালোবাসা পারে এ কাজে এখনো আমাদের ব্রতী করতে শতাব্দীর সূর্য যখন পশ্চিম গগনে, নইলে ভীষণ দাম দিতে হবে এই আগ্রাসী সভ্যতাকে। প্রতিবার আগ্রাসী সভ্যতা নিজেকে ধ্বংসই করে অগ্রসরণের নামে, ইতিহাস দেখ। ভালোবাসা, নিদারুণ ভালোবাসা, তাই হোক প্রথম পদক্ষেপ।’
চিম্বুকের এম্পুপাড়ার ওই পথে দাঁড়িয়ে মেল গিবসনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অ্যাপোক্যালিপ্ট-এর শেষ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখনো এইচবিও ও স্টার মুভিতে ছবিটি মাঝেমধ্যে দেখানো হয়। মায়া আদিবাসীদের নিয়ে ছবি। ছবিতে আদিবাসী নায়ককে অস্ত্রশস্ত্রসহ তাড়া করছে শয়তানের দল। প্রাণপণে ছুটছে নায়ক বনের ভেতর দিয়ে। একসময় গভীর এক জলপ্রপাতের ভেতর নায়ক ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূরে জলপ্রপাতের ওপারে শয়তানের দল দাঁড়িয়ে থাকে। নায়ক আদিবাসী যুবক ওদের দিকে চিত্কার করে বলে, ‘এই বন আমার। এখানে শিকার করেছিল আমার বাবা। এই বনে শিকার করব আমি, আমার সন্তান এবং ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের সন্তান।’ এ ছবির শেষ দৃশ্যটি আরও অর্থবহ। শয়তানদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয় নায়ক। কোলে তার নবজাত সন্তান চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে। একটু দূরে সমুদ্রের তীরে কয়েকটি জাহাজ ভেড়ে। ওখানে অচেনা মানুষের দল। নায়ককে স্ত্রী প্রশ্ন করে ওরা কারা, আমরা কি তাদের সঙ্গে যাব? নায়ক তার নবজাত সন্তানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওরা এই বনে বহিরাগত মানুষ নিয়ে আসে। আমরা ওদের সঙ্গে যাব না, বনে ফিরে যাব, আমাদের সন্তানের জন্য নতুন স্বপ্ন রচনা করব।’ যে কেউ সিডির দোকান থেকে এ ছবির কপি কিনে দেখতে পারেন। বান্দরবানে ম্রোদের পাড়ায় দাঁড়িয়ে আমার অ্যাপোক্যালিপ্ট-এর দৃশ্য চোখে ভাসে।
ম্রোদের পাড়া থেকে যখন ফিরি তখন পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ওরা বলল, ওদের জুম বাগানভূমি, বিচরণক্ষেত্র, পূর্বপুরুষের অবারিত রেখে যাওয়া বিস্তীর্ণ বন ও পাহাড় বেদখলে চলে যাচ্ছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওদের অনুমতি তো দূরে থাক, ওদের কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন, অর্থহীন এমনকি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এক আদিবাসী সমাজ, যারা ধরিত্রী ও প্রকৃতিকে, বনকে, পাহাড়ের বুকে বয়ে চলা নদী ও জলধারাকে, বৃক্ষ ও পরিবেশকে এতকাল রক্ষা করে এসেছে সবার জন্য, তারা এখন উপেক্ষিত বিলুপ্তপ্রায় অসহায় জাতি। এ ধারায় চললে একদিন ওরা হারিয়ে যাবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসার যে শিক্ষা ওদের আছে, তা এই শহরে কোথায় পাব আমরা? ওরা হারিয়ে গেলে শুধু ওদের না, আমাদের দেশের ও পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়াবহ চিত্র পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছে, মেনে নিতে হবে যে আদিবাসী জীবন কাছ থেকে আধুনিক সভ্যতা ও রাষ্ট্র কিছুই শেখেনি। এ বিষয়ে মহাশ্বেতা দেবী ওই উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিচেতনা, সভ্যতা, সব মিলিয়ে যেন নানা সম্পদে শোভিত এক মহাদেশ। আমরা, মূলস্রোতের মানুষেরা, সে মহাদেশকে জানার চেষ্টা না করেই ধ্বংস করে ফেলেছি, তা অস্বীকার করার পথ নেই।...মূলস্রোতের ধাক্কায় এদের বারবার দেশান্তরী হতে হয়েছে। ফলে অনেক কিছু গেছে হারিয়ে। মূলস্রোত এ বিষয়ে যে অপরাধে অপরাধী তার ক্ষমা নেই।’
আমাদের রাষ্ট্রকে এই আদিবাসীদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিপন্নতার জন্য দায়ী করলেই তো হবে না, ওদের রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সবার আগে দরকার ওদের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও জীবনের স্বীকৃতি। ধরিত্রী ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে বন্ধন ও মমতা তৈরি করে গেছে ওরা, তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
>>>সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com
No comments