মন্ত্রী পর্যায়ের এই সম্মেলন তেমন ফল দেবে না -ডব্লিউটিও by তৌফিক আলী
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয় মারাকাশ চুক্তির মাধ্যমে । এই চুক্তির চতুর্থ অনুচ্ছেদের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে সদস্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন প্রতি দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হবে। বিগত চারটি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও এর চলতি সম্মেলন প্রসঙ্গে কিছু দিক তুলে ধরতে চাই।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরে প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অনেক সুদূরপ্রসারী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন: এখানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে (এলডিসি) তাদের বাণিজ্য সুযোগ বাড়ানোয় সহায়তা করার জন্য বিতর্কিত ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমন্বিত রূপরেখা’ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের মে মাসে জেনেভায় দ্বিতীয় সম্মেলনটি অবশ্য ছিল মূলত আনুষ্ঠানিকতা, যেটা আবার গ্যাট/ডব্লিউটিওর ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের সঙ্গে মিলে যায়।
তবে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে সিয়াটলের সম্মেলনটি ভিন্নমাত্রা নেয়। উরুগুয়ে রাউন্ড চুক্তির কিছু বিষয় এখানে পর্যালোচনার জন্য উঠে আসে। সম্মেলনকে ঘিরে নানা রকম তত্পরতা শুরু হয়, গঠিত হয় উচ্চাশা। তবে সম্মেলনে বাইরে বিক্ষোভ-সংঘাত অনেক বেশি মনোযোগ কেড়ে নেয়। আর শেষ পর্যন্ত সম্মেলনটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২০০১ সালের নভেম্বর মাসে কাতারের দোহায় চতুর্থ সম্মেলনটি হয় আমেরিকায় ৯/১১ সংঘটিত হওয়া পর। তাই আবহটা ছিল বিষণ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কমিশন তাদের নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্য সমঝোতার একটি নতুন পর্ব শুরু করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আমেরিকার চাপে পিছু হটে মেনে নেয়। ফলে এটি অল্প সময়ে অনেক কিছু করার বিরাট উচ্চাভিলাষ নিয়ে দোহা রাউন্ড বা দোহা পর্বের সূত্রপাত ঘটে। এ সম্মেলনেই সংস্থায় চীনের সদস্য পদ অনুমোদন করা হয়।
২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে কানকুন সম্মেলনটিকে ধরা হয়েছিল দোহা পর্বের মধ্য পর্যায়। তখন পর্যন্ত কৃষি ও অকৃষি পণ্যের বাজারসুবিধা নির্ধারণের বিষয়ে একটি মতৈক্য ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসে সমঝোতা হতে পারেনি এবং আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে মতৈক্য হয়নি। এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষিস্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত হয় জি-২০ জোট। এর ফলে এত দিন ধরে চলে আসা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার প্রবণতায় পরিবর্তন আসে। শিল্পোন্নত দেশগুলো আলোচনার টেবিলে যে খসড়া উপস্থাপন করবে, তা-ই হবে আলোচনার ভিত্তি—এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যায়। এর জের ধরে কানকুন সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যা দোহা পর্বকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ষষ্ঠ সম্মেলনকে সামনে রেখে সবাই সতর্কতার সঙ্গে প্রত্যাশার মাত্রা কমিয়ে আনে। সম্মেলনকে ঘিরে একটা কথাও শুরু হয় যে এতে ‘উন্নয়ন’ ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে। অবশ্য ডব্লিউটিও প্রথাগতভাবে কোনো ‘উন্নয়ন সংস্থা’ নয়। তবে এর বিধিবিধানগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। আমরা এলডিসির উদ্বেগগুলো তুলে ধরতে এই উন্নয়ন ধারার ওপর গুরুত্ব প্রদানকে পুরোপুরি কাজে লাগাই। এর ফলে প্রথমবারের মতো শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারসুবিধার বিষয়টি আমরা বহুপক্ষীয় পর্যায়ে নিয়ে আসি। এর আগপর্যন্ত এই সুবিধার বিষয়টি পুরোপুরি সুবিধাদানকারী দেশের ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
নিয়মমাফিক ২০০৭ সালেই সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি এর অনুকূলে ছিল না। তাই সংস্থার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর অংশ জেনারেল কাউন্সিল মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে ছাড় দেয়। আর ২০০৯ সালের মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয় যে জেনেভায় এ বছরই সম্মেলন হবে। তবে ২০ অক্টোবর সপ্তম সম্মেলনের কর্মসূচির যে রূপরেখা ঘোষিত হয়, তাতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে এটা বাণিজ্য সমঝোতার চেয়ে বরং ডব্লিউটিওর সকল কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা ও নির্দেশনা প্রদানের সুযোগ তৈরি করেছে।
গতকাল ৩০ নভেম্বর শুরু হওয়া সম্মেলনে প্রতিটি সদস্য দেশের প্রতিনিধি প্রধানরা তিন মিনিট করে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। দুই দিন দুটি কার্য অধিবেশনে দোহা কার্যসূচিসহ সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সংস্থার অবদানের ওপর আলোকপাত করা হবে। পাশাপাশি চলবে প্লিনারি অধিবেশন। ২ ডিসেম্বর সম্মেলন শেষ হবে, যেখানে কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণা আসবে না। এর বদলে সভাপতি একটি সারসংক্ষেপ প্রদান করবেন, যা অবশ্য পালনীয় নয়।
স্পষ্টতই, এ আয়োজন কোনো সমঝোতা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য নয়। মাত্র তিন মিনিটের বক্তব্যে কারও পক্ষে তাঁর দেশের উদ্বেগ ও অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাহলে এই সম্মেলনের মানে কী? উত্তরটা লুকিয়ে আছে জেনেভায় বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতির মধ্যে।
মূল সম্মেলন শুরুর আগে সপ্তাহজুড়ে অনেক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। উন্মুক্ত বৈঠকে যেকোনো সদস্য দেশের প্রতিনিধি যোগ দিতে পারলেও রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শুধু আমন্ত্রিত ব্যক্তিরাই যেতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রিনরুম বৈঠক। বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্যে মাত্র দশমিক ১০ শতাংশ হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আমন্ত্রণ পাওয়াটা কঠিন। তবে এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়কারী এই বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়ে থাকে। জেনেভায় আমি যখন রাষ্ট্রদূত ছিলাম তখন সব সময়ই আমন্ত্রণ পেয়েছি। কারণ, আমি বাণিজ্য ও পরিবেশ সমঝোতা গ্রুপের সভাপতি ছিলাম। এর ফলে এসব বৈঠকে আমাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতে পেরেছি। একটি ছোট দেশের পক্ষে এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রিত বৈঠকে যোগদান করতে পারা ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিরাট অগ্রাধিকার।
অবশ্য এসব বৈঠকে যোগদান এটা নিশ্চিত করে না যে যোগদানকারীর নিজ দেশের স্বার্থকে সামনে রাখতে পারবেন। এটা নির্ভর করে প্রস্তুতির ওপর। যেমন নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে বিষয়টা উত্থাপন করা হবে, তা নিয়ে আগে প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সমর্থন নেওয়া হয়েছে কি না। এ রকম আরও অনেক কৌশল আছে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের স্বার্থের বিষয়টা সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, এবারের সম্মেলন থেকে কোনো দেশ কি কিছু পেতে পারে? দোহা পর্বকে প্রভাবিত করে ডব্লিউটিওর সপ্তম সম্মেলন থেকে এমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, সম্মেলনটা সেভাবেই সাজানো হয়েছে।
তাহলে মূল সম্মেলনের বাইরে কি কিছু হতে পারে? এটা নিয়েই তত্পরতা চলছে। যেমন ২৪ নভেম্বর সেবা খাতবিষয়ক বৈঠকে সম্মতি মিলেছে যে এলডিসিসমূহকে সেবা খাতের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে। এর মানে হলো, বিভিন্ন দেশ এলডিসিসমূহকে সেবা খাতে এমন বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে, যা এলডিসি বাদে অন্য দেশকে দিতে হবে না। (এটা অবশ্য ডব্লিউটিরও এমএফএন নীতি থেকে বিচ্যুতি)। আমরা পণ্যেও ক্ষেত্রে এই ছাড় পেয়েছিলাম কিন্তু সেবা খাতে পাইনি। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি তোলা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতসহ কিছু দেশ আমাদের দাবিকে সমর্থন দিয়েছে। এখন আশা করা যায়, আগামী বছর এ বিষয়টির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। বাকি অর্জনটুকু নির্ভর করবে জেনেভায় আমাদের প্রস্তুতির ওপর। তবে আমাদের বেশি আশা করা ঠিক হবে না। আমরা যে উচ্চ পর্যায়ের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোতেও আমন্ত্রণ পাব, এমনটা আমি মনে করি না।
ডব্লিউটিওতে এলডিসি গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে এর বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের স্বার্থের ততটা অনুকূলে নয়। দার-এস-সালামে এলডিসি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে একটি ঘোষণা ও একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। বিশেষ করে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধার ক্ষেত্রে। ২৯ নভেম্বর এলডিসি মন্ত্রীদের বৈঠক হলেও তা উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বা গ্রিনরুম বৈঠক প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এলডিসি গ্রুপ এবং বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমর্থন জোগাড় করার জন্য আরও অনেক বেশি কাজ করার প্রয়োজন ছিল।
আমরা জানি যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রপ্তানির অবদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বহুপক্ষীয় বাণিজ্য বিধিগুলো এ ক্ষেত্রে নতুন যোগদানকারীর সম্ভাবনাকে ক্রমেই বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। আমাদের তাই বহুপক্ষীয় বাণিজ্য বিধিতে এলডিসি সহায়ক অবস্থান গড়ে তোলার জন্য প্রয়াস নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা সম্পর্কে খুব ভালো বোঝাপড়া, অভ্যন্তরীণ নীতি কাঠামো এবং চমত্কার দরকষাকষির দক্ষতা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এখানে আছে। আমাদের কাজ হলো, অতীতের সাফল্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া এবং সুবিধাগুলো আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসা।
তৌফিক আলী: জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত (২০০১—২০০৭)।
toufiqali@hotmail.com
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরে প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অনেক সুদূরপ্রসারী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন: এখানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে (এলডিসি) তাদের বাণিজ্য সুযোগ বাড়ানোয় সহায়তা করার জন্য বিতর্কিত ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমন্বিত রূপরেখা’ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের মে মাসে জেনেভায় দ্বিতীয় সম্মেলনটি অবশ্য ছিল মূলত আনুষ্ঠানিকতা, যেটা আবার গ্যাট/ডব্লিউটিওর ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের সঙ্গে মিলে যায়।
তবে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে সিয়াটলের সম্মেলনটি ভিন্নমাত্রা নেয়। উরুগুয়ে রাউন্ড চুক্তির কিছু বিষয় এখানে পর্যালোচনার জন্য উঠে আসে। সম্মেলনকে ঘিরে নানা রকম তত্পরতা শুরু হয়, গঠিত হয় উচ্চাশা। তবে সম্মেলনে বাইরে বিক্ষোভ-সংঘাত অনেক বেশি মনোযোগ কেড়ে নেয়। আর শেষ পর্যন্ত সম্মেলনটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২০০১ সালের নভেম্বর মাসে কাতারের দোহায় চতুর্থ সম্মেলনটি হয় আমেরিকায় ৯/১১ সংঘটিত হওয়া পর। তাই আবহটা ছিল বিষণ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কমিশন তাদের নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্য সমঝোতার একটি নতুন পর্ব শুরু করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আমেরিকার চাপে পিছু হটে মেনে নেয়। ফলে এটি অল্প সময়ে অনেক কিছু করার বিরাট উচ্চাভিলাষ নিয়ে দোহা রাউন্ড বা দোহা পর্বের সূত্রপাত ঘটে। এ সম্মেলনেই সংস্থায় চীনের সদস্য পদ অনুমোদন করা হয়।
২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে কানকুন সম্মেলনটিকে ধরা হয়েছিল দোহা পর্বের মধ্য পর্যায়। তখন পর্যন্ত কৃষি ও অকৃষি পণ্যের বাজারসুবিধা নির্ধারণের বিষয়ে একটি মতৈক্য ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসে সমঝোতা হতে পারেনি এবং আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে মতৈক্য হয়নি। এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষিস্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত হয় জি-২০ জোট। এর ফলে এত দিন ধরে চলে আসা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার প্রবণতায় পরিবর্তন আসে। শিল্পোন্নত দেশগুলো আলোচনার টেবিলে যে খসড়া উপস্থাপন করবে, তা-ই হবে আলোচনার ভিত্তি—এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যায়। এর জের ধরে কানকুন সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যা দোহা পর্বকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ষষ্ঠ সম্মেলনকে সামনে রেখে সবাই সতর্কতার সঙ্গে প্রত্যাশার মাত্রা কমিয়ে আনে। সম্মেলনকে ঘিরে একটা কথাও শুরু হয় যে এতে ‘উন্নয়ন’ ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে। অবশ্য ডব্লিউটিও প্রথাগতভাবে কোনো ‘উন্নয়ন সংস্থা’ নয়। তবে এর বিধিবিধানগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। আমরা এলডিসির উদ্বেগগুলো তুলে ধরতে এই উন্নয়ন ধারার ওপর গুরুত্ব প্রদানকে পুরোপুরি কাজে লাগাই। এর ফলে প্রথমবারের মতো শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারসুবিধার বিষয়টি আমরা বহুপক্ষীয় পর্যায়ে নিয়ে আসি। এর আগপর্যন্ত এই সুবিধার বিষয়টি পুরোপুরি সুবিধাদানকারী দেশের ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
নিয়মমাফিক ২০০৭ সালেই সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি এর অনুকূলে ছিল না। তাই সংস্থার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর অংশ জেনারেল কাউন্সিল মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে ছাড় দেয়। আর ২০০৯ সালের মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয় যে জেনেভায় এ বছরই সম্মেলন হবে। তবে ২০ অক্টোবর সপ্তম সম্মেলনের কর্মসূচির যে রূপরেখা ঘোষিত হয়, তাতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে এটা বাণিজ্য সমঝোতার চেয়ে বরং ডব্লিউটিওর সকল কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা ও নির্দেশনা প্রদানের সুযোগ তৈরি করেছে।
গতকাল ৩০ নভেম্বর শুরু হওয়া সম্মেলনে প্রতিটি সদস্য দেশের প্রতিনিধি প্রধানরা তিন মিনিট করে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। দুই দিন দুটি কার্য অধিবেশনে দোহা কার্যসূচিসহ সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সংস্থার অবদানের ওপর আলোকপাত করা হবে। পাশাপাশি চলবে প্লিনারি অধিবেশন। ২ ডিসেম্বর সম্মেলন শেষ হবে, যেখানে কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণা আসবে না। এর বদলে সভাপতি একটি সারসংক্ষেপ প্রদান করবেন, যা অবশ্য পালনীয় নয়।
স্পষ্টতই, এ আয়োজন কোনো সমঝোতা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য নয়। মাত্র তিন মিনিটের বক্তব্যে কারও পক্ষে তাঁর দেশের উদ্বেগ ও অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাহলে এই সম্মেলনের মানে কী? উত্তরটা লুকিয়ে আছে জেনেভায় বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতির মধ্যে।
মূল সম্মেলন শুরুর আগে সপ্তাহজুড়ে অনেক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। উন্মুক্ত বৈঠকে যেকোনো সদস্য দেশের প্রতিনিধি যোগ দিতে পারলেও রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শুধু আমন্ত্রিত ব্যক্তিরাই যেতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রিনরুম বৈঠক। বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্যে মাত্র দশমিক ১০ শতাংশ হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আমন্ত্রণ পাওয়াটা কঠিন। তবে এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়কারী এই বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়ে থাকে। জেনেভায় আমি যখন রাষ্ট্রদূত ছিলাম তখন সব সময়ই আমন্ত্রণ পেয়েছি। কারণ, আমি বাণিজ্য ও পরিবেশ সমঝোতা গ্রুপের সভাপতি ছিলাম। এর ফলে এসব বৈঠকে আমাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতে পেরেছি। একটি ছোট দেশের পক্ষে এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রিত বৈঠকে যোগদান করতে পারা ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিরাট অগ্রাধিকার।
অবশ্য এসব বৈঠকে যোগদান এটা নিশ্চিত করে না যে যোগদানকারীর নিজ দেশের স্বার্থকে সামনে রাখতে পারবেন। এটা নির্ভর করে প্রস্তুতির ওপর। যেমন নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে বিষয়টা উত্থাপন করা হবে, তা নিয়ে আগে প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সমর্থন নেওয়া হয়েছে কি না। এ রকম আরও অনেক কৌশল আছে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের স্বার্থের বিষয়টা সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, এবারের সম্মেলন থেকে কোনো দেশ কি কিছু পেতে পারে? দোহা পর্বকে প্রভাবিত করে ডব্লিউটিওর সপ্তম সম্মেলন থেকে এমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, সম্মেলনটা সেভাবেই সাজানো হয়েছে।
তাহলে মূল সম্মেলনের বাইরে কি কিছু হতে পারে? এটা নিয়েই তত্পরতা চলছে। যেমন ২৪ নভেম্বর সেবা খাতবিষয়ক বৈঠকে সম্মতি মিলেছে যে এলডিসিসমূহকে সেবা খাতের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে। এর মানে হলো, বিভিন্ন দেশ এলডিসিসমূহকে সেবা খাতে এমন বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে, যা এলডিসি বাদে অন্য দেশকে দিতে হবে না। (এটা অবশ্য ডব্লিউটিরও এমএফএন নীতি থেকে বিচ্যুতি)। আমরা পণ্যেও ক্ষেত্রে এই ছাড় পেয়েছিলাম কিন্তু সেবা খাতে পাইনি। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি তোলা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতসহ কিছু দেশ আমাদের দাবিকে সমর্থন দিয়েছে। এখন আশা করা যায়, আগামী বছর এ বিষয়টির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। বাকি অর্জনটুকু নির্ভর করবে জেনেভায় আমাদের প্রস্তুতির ওপর। তবে আমাদের বেশি আশা করা ঠিক হবে না। আমরা যে উচ্চ পর্যায়ের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোতেও আমন্ত্রণ পাব, এমনটা আমি মনে করি না।
ডব্লিউটিওতে এলডিসি গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে এর বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের স্বার্থের ততটা অনুকূলে নয়। দার-এস-সালামে এলডিসি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে একটি ঘোষণা ও একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। বিশেষ করে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধার ক্ষেত্রে। ২৯ নভেম্বর এলডিসি মন্ত্রীদের বৈঠক হলেও তা উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বা গ্রিনরুম বৈঠক প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এলডিসি গ্রুপ এবং বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমর্থন জোগাড় করার জন্য আরও অনেক বেশি কাজ করার প্রয়োজন ছিল।
আমরা জানি যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রপ্তানির অবদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বহুপক্ষীয় বাণিজ্য বিধিগুলো এ ক্ষেত্রে নতুন যোগদানকারীর সম্ভাবনাকে ক্রমেই বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। আমাদের তাই বহুপক্ষীয় বাণিজ্য বিধিতে এলডিসি সহায়ক অবস্থান গড়ে তোলার জন্য প্রয়াস নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা সম্পর্কে খুব ভালো বোঝাপড়া, অভ্যন্তরীণ নীতি কাঠামো এবং চমত্কার দরকষাকষির দক্ষতা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এখানে আছে। আমাদের কাজ হলো, অতীতের সাফল্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া এবং সুবিধাগুলো আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসা।
তৌফিক আলী: জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত (২০০১—২০০৭)।
toufiqali@hotmail.com
No comments