নারী গৃহকর্মীদের নিয়তি -বাঘা তেঁতুল by সৈয়দ আবুল মকসুদ
একবার দিল্লি বিমানবন্দরে প্লেনের অপেক্ষায় বসেছিলাম। পাশের আরেকজন অপেক্ষমাণ যাত্রী মন দিয়ে একটি নভেলজাতীয় বই পড়ছিলেন। বইটির নাম চকোলেট। লেখকের, বোধহয় লেখিকাই হবে, নাম মনে নেই; একজন ভারতীয়। ও রকম পরিবেশে যা স্বাভাবিক—সময় কাটানোর জন্য খবরের কাগজ পড়া বা বইপত্র নাড়াচাড়া করতে হয়। পাশের যাত্রীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে বইটির পাতা ওল্টাতে থাকি। বইটির বিষয়বস্তু হলো, বালিকা ও কিশোরীরা ভারতীয় সমাজে কীভাবে পরিবারের নিকটাত্মীয়দের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তার বিবরণ। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেক্সুয়াল মোলেসটেশন বা যৌন-উত্ত্যক্ত বা নিগ্রহের কথা তারা কাউকে না বলে আজীবন গোপন করে রাখে। তবে কারও কারও শৈশবের সেই অভিজ্ঞতার বিশ্রী স্মৃতি সারা জীবন তাদের তাড়া করে ফেরে। তাদের মনে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পরিণত বয়সে যা তাদের নানা রকম মানসিক সমস্যার কারণ হয়।
বাড়ির কোনো পুরুষ হয়তো চকোলেট-লেবেঞ্চুস নিয়ে প্রথমে ভাব জমায় বালিকা-কিশোরীদের সঙ্গে। তারপর সদ্য-পরিবর্তন আসা কিশোরীর শরীরে হাত দেয় তারই কোনো লম্পট নানা-দাদা, চাচা-মামা, খালু-ফুফা সম্পর্কের গুরুজন পর্যন্ত। কাজিন সম্পর্কের অর্থাত্ চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই হলে তো কথাই নেই। বয়স্ক মুরুব্বি-স্থানীয়দের দ্বারা চুম্বনের অভিজ্ঞতা তো আছেই, ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। সবচেয়ে করুণ ব্যাপার হলো, ‘গুরুজনদের’ দ্বারা অপকর্মের শিকার হলে তা বাড়ির কাউকে বলা যায় না, বললেও অনেকে বিশ্বাস করে না। চকোলেট-এ বিষয়টিকে খুব প্রামাণ্যভাবে উপস্থিত করা হয়েছে।
বাড়ির নিকটাত্মীয়ের কাছেই যখন একজন বালিকা বা কিশোরী নিরাপদ নয়, সেখানে নিঃস্ব, দরিদ্র ও অসহায় বালিকা গৃহকর্মীদের যে কী অবস্থা তা অনুমান করা সহজ। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা মনে আছে। ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের উল্টো দিকে লেকের পাড়ে দেখি তিন-চারজন পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ১৫-১৬ বছরের একটি মেয়ে কাঁদছে। আমি সেখানে গিয়ে জানলাম যে মেয়েটি কোনো এক বাড়িতে কাজ করত। পালিয়ে এসেছে। ময়মনসিংহের দিকে কোথাও ওর বাড়ি। কোথা থেকে বাস ধরবে তা সে জানতে চাইছে।
কেন সে ওই বাড়িতে কাজ করবে না সে কথা মেয়েটি পুলিশকে বলছিল। ওর কাজ ছিল বিরাট ব্যবসায়ী গৃতকর্তার বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনা করা। গৃহকর্ত্রী সকালে গাড়ি নিয়ে বেরোন, আসেন সন্ধ্যার পরে। গরম পানি করে বুড়োকে গোসল করিয়ে খাওয়াতে হয়। গোসলের সময় মেয়েটিকে বুড়ো তার শরীরে সাবান ঘষে দিতে বলে। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এমন আচরন করে বসেন যা সঙ্গত নয়। লজ্জায় মেয়েটি সরে যেতে চাইলে বুড়ো দু-একটা দাঁত যা আছে তা বের করে বলে, ‘যাইস না, তুই তো আমার নাতনির মতোই।’ পুরুষীয় লাম্পট্যের কোনো বয়সসীমা নেই।
সম্প্রতি আমি দু-তিনটি কিশোরী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা দূর থেকে আমার ইন্দ্রিয় চোখ ও কানের দ্বারা প্রত্যক্ষ করেছি। অমন নির্মমতা দেখে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেটুকু অনুভব করেছি, তা অবর্ণনীয়। মেয়ে দুটির আর্তনাদ অনেকেই শুনেছে, কিন্তু নিরুপায়। প্রতিকার তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করে কার সাধ্য?
শ্রমিকসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বিল্স-এর হিসেবে, তাদের কাছে তথ্য আছে, গত সাত বছরে দেশে ৬৪০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৩০৫ জন, পঙ্গু হয়েছে ২৩৫ জন, ধর্ষিত হয়েছে ৭৭ জন এবং অন্যান্যভাবে নিগৃহীত হয়েছে ২৩ জন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দেশে বাসাবাড়িতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ এক হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে নারীশিশু ৮০ হাজার ৯৯৩ জন। বেসরকারি হিসাবে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখ।
কতভাবে শিশু গৃহপরিচারিকাদের যে নির্যাতন করা হয় তার তালিকা করা কঠিন। প্রায় সারা দিনই ওদের কাজ। ভালো খাবার খেতে দেওয়া হয় না। ঘরের কোনায় শুতে দেওয়া হয়। ঘরে তালা দিয়ে বন্দী করে রাখা খুব স্বাভাবিক রীতি। ভাত একটু নরম হলে, তরকারি পুড়ে গেলে, গ্লাস বা প্লেট ভেঙে ফেললে বা অতি সামান্য অপরাধে নেমে আসে নিপীড়ন। চড়-থাপড়, চুলের মুঠি ধরে মারধর, শরীরে গরম তেল ঢালা, গরম খুন্তি দিয়ে ছেঁকা দেওয়া, স্যান্ডেল-জুতা, পুতা বা ডাল-ঘুঁটানি দিয়ে পেটানো ও ঝাড়ুর বাড়ি ওদের অনেকেরই সইতে হয়। যৌন হয়রানি তো আছেই। ধর্ষণ, হত্যা খুবই ঘটছে। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়েও মৃত্যু হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, সরকার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আচরণবিধি’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে। তাতে গৃহকর্মীদের নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা থাকবে। ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থাও থাকবে। গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় ও কল্যাণে যদি এই কাজটি সরকার করে তা হলে সরকারকে সাধুবাদ জানাব। কাজটি যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বাড়ির কোনো পুরুষ হয়তো চকোলেট-লেবেঞ্চুস নিয়ে প্রথমে ভাব জমায় বালিকা-কিশোরীদের সঙ্গে। তারপর সদ্য-পরিবর্তন আসা কিশোরীর শরীরে হাত দেয় তারই কোনো লম্পট নানা-দাদা, চাচা-মামা, খালু-ফুফা সম্পর্কের গুরুজন পর্যন্ত। কাজিন সম্পর্কের অর্থাত্ চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই হলে তো কথাই নেই। বয়স্ক মুরুব্বি-স্থানীয়দের দ্বারা চুম্বনের অভিজ্ঞতা তো আছেই, ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। সবচেয়ে করুণ ব্যাপার হলো, ‘গুরুজনদের’ দ্বারা অপকর্মের শিকার হলে তা বাড়ির কাউকে বলা যায় না, বললেও অনেকে বিশ্বাস করে না। চকোলেট-এ বিষয়টিকে খুব প্রামাণ্যভাবে উপস্থিত করা হয়েছে।
বাড়ির নিকটাত্মীয়ের কাছেই যখন একজন বালিকা বা কিশোরী নিরাপদ নয়, সেখানে নিঃস্ব, দরিদ্র ও অসহায় বালিকা গৃহকর্মীদের যে কী অবস্থা তা অনুমান করা সহজ। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা মনে আছে। ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের উল্টো দিকে লেকের পাড়ে দেখি তিন-চারজন পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ১৫-১৬ বছরের একটি মেয়ে কাঁদছে। আমি সেখানে গিয়ে জানলাম যে মেয়েটি কোনো এক বাড়িতে কাজ করত। পালিয়ে এসেছে। ময়মনসিংহের দিকে কোথাও ওর বাড়ি। কোথা থেকে বাস ধরবে তা সে জানতে চাইছে।
কেন সে ওই বাড়িতে কাজ করবে না সে কথা মেয়েটি পুলিশকে বলছিল। ওর কাজ ছিল বিরাট ব্যবসায়ী গৃতকর্তার বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনা করা। গৃহকর্ত্রী সকালে গাড়ি নিয়ে বেরোন, আসেন সন্ধ্যার পরে। গরম পানি করে বুড়োকে গোসল করিয়ে খাওয়াতে হয়। গোসলের সময় মেয়েটিকে বুড়ো তার শরীরে সাবান ঘষে দিতে বলে। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এমন আচরন করে বসেন যা সঙ্গত নয়। লজ্জায় মেয়েটি সরে যেতে চাইলে বুড়ো দু-একটা দাঁত যা আছে তা বের করে বলে, ‘যাইস না, তুই তো আমার নাতনির মতোই।’ পুরুষীয় লাম্পট্যের কোনো বয়সসীমা নেই।
সম্প্রতি আমি দু-তিনটি কিশোরী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা দূর থেকে আমার ইন্দ্রিয় চোখ ও কানের দ্বারা প্রত্যক্ষ করেছি। অমন নির্মমতা দেখে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেটুকু অনুভব করেছি, তা অবর্ণনীয়। মেয়ে দুটির আর্তনাদ অনেকেই শুনেছে, কিন্তু নিরুপায়। প্রতিকার তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করে কার সাধ্য?
শ্রমিকসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বিল্স-এর হিসেবে, তাদের কাছে তথ্য আছে, গত সাত বছরে দেশে ৬৪০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৩০৫ জন, পঙ্গু হয়েছে ২৩৫ জন, ধর্ষিত হয়েছে ৭৭ জন এবং অন্যান্যভাবে নিগৃহীত হয়েছে ২৩ জন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দেশে বাসাবাড়িতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ এক হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে নারীশিশু ৮০ হাজার ৯৯৩ জন। বেসরকারি হিসাবে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখ।
কতভাবে শিশু গৃহপরিচারিকাদের যে নির্যাতন করা হয় তার তালিকা করা কঠিন। প্রায় সারা দিনই ওদের কাজ। ভালো খাবার খেতে দেওয়া হয় না। ঘরের কোনায় শুতে দেওয়া হয়। ঘরে তালা দিয়ে বন্দী করে রাখা খুব স্বাভাবিক রীতি। ভাত একটু নরম হলে, তরকারি পুড়ে গেলে, গ্লাস বা প্লেট ভেঙে ফেললে বা অতি সামান্য অপরাধে নেমে আসে নিপীড়ন। চড়-থাপড়, চুলের মুঠি ধরে মারধর, শরীরে গরম তেল ঢালা, গরম খুন্তি দিয়ে ছেঁকা দেওয়া, স্যান্ডেল-জুতা, পুতা বা ডাল-ঘুঁটানি দিয়ে পেটানো ও ঝাড়ুর বাড়ি ওদের অনেকেরই সইতে হয়। যৌন হয়রানি তো আছেই। ধর্ষণ, হত্যা খুবই ঘটছে। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়েও মৃত্যু হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, সরকার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আচরণবিধি’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে। তাতে গৃহকর্মীদের নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা থাকবে। ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থাও থাকবে। গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় ও কল্যাণে যদি এই কাজটি সরকার করে তা হলে সরকারকে সাধুবাদ জানাব। কাজটি যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments