শেখ হাসিনা: তাঁর দল ও তাঁর সরকার -চলমান রাজনীতি by সৈয়দ বদরুল আহসান
সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার ছয় মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হবার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে শেখ হাসিনা তাঁর দলের ভেতর যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পর যেভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির ওপর নেতৃত্ব-বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সবার কাছে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে দল বলতে যা বোঝায় সেই সত্যটি তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। এবং সেটি হয়েছে তাঁর দৃঢ়তার ফলে, যে দৃঢ়তা তিনি পেয়েছেন দলের এই যুগের, অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের সমর্থনের মাধ্যমে। মোট কথায়, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রচণ্ডভাবে হাসিনা-নির্ভরশীল একটি প্রতিষ্ঠান বা দল এবং বর্তমান সময়ে দলের ভেতরে এমন কেউ নেই, যিনি নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে হাসিনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন। অবশ্য এটা স্মরণ রাখা দরকার যে ১৯৮১ সাল থেকে আজ অব্দি দলের নেতৃত্বের বিষয়ে শেখ হাসিনা কখনো কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হননি। যাদের তিনি চ্যালেঞ্জ মনে করছেন, যেমন ড. কামাল হোসেন, তাঁদের দলে থাকার খুব একটা সুযোগ দেওয়া হয়নি। কথা এখানে একটাই, শেখ হাসিনার ক্ষমতা দলের ভেতর বরাবরই নিরঙ্কুশভাবে বিরাজমান ছিল এবং সেই ক্ষমতা এই গেল দলীয় কাউন্সিল অধিবেশনের মধ্য দিয়ে আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে।
এক কথায় বলা যায়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে এক ধরনের ক্যু ঘটিয়ে দিয়েছেন। তিনি দলের শক্তিধর বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। এটি ভাবার বিষয় যে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আব্দুর রাজ্জাকের মতো নেতা আজ এমন এক অবস্থায় আছেন, যেখানে দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়া তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা দলের প্রেসিডিয়ামে নেই। তাঁরা মন্ত্রিসভায়ও নেই। বলা হয়ে থাকে, তাঁদের এ অবস্থার জন্য দায়ী তাঁদের সংস্কারবিষয়ক চিন্তাধারা। শেখ হসিনা ও তাঁর সমর্থকদের একটি বদ্ধ ধারণা হয়েছে যে এসব নেতা তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস-টু নীতিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেছিলেন। এবং সমর্থন করেছিলেন বলেই দলের বিপুলসংখ্যক সদস্য তাঁদের দলের বা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে নারাজ। এবং সে কারণেই নাকি শেখ হাসিনা এঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে বারংবার এই নেতাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বললেও দলের সভানেত্রী শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমা প্রদর্শনের কোনো মনোভাব দেখাননি। যখন ধরে নেওয়া হয়েছিল যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে দলীয় ঐক্য ফিরে আসছে এবং দল আবার সবাইকে নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করছে, ঠিক তখনই শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরে তাঁর প্রতিপত্তির কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের দল থেকে বহিষ্কার না করলেও তিনি তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলেছেন।
এ তো হলো একটা দিক, ক্ষমা প্রদর্শনের এবং সেই প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসার। কিন্তু যেটা আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তা এই যে, ভিন্নমত পোষণ করাকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা। যদি আওয়ামী লীগে কেউ সংস্কারবাদী হয়ে থাকেন, এর অর্থ কখনো এই নয় যে, তিনি দলের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। হ্যাঁ এটা অবশ্য স্বীকার করে নিতেই হয় যে যাঁরা শেখ হাসিনার কঠিন সময়ে তাঁকে তাঁর দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছেন, তাঁরা খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দেননি। দলীয় নেতা বা নেত্রী কারাগারে থাকবেন আর সে সুযোগে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি একটি নৈতিকতাবিরোধী কাজ। তাই বলে এটা অস্বীকার করা চলবে না যে দলের অভ্যন্তরে ভিন্নমত প্রকাশ করার অধিকার দলের সব সদস্যের রয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশ করা এবং দলের অন্যদের সেটি মনেপ্রাণে স্বছন্দে গ্রহণ করলেই দলে আধুনিকতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রচলন সম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগে সেই সত্যটি বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে প্রতিফলিত হয়নি। এবং হয়নি বলেই শেখ হাসিনা আগের চেয়ে আরও অধিক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় দলের সভানেত্রীর আসন বজায় রাখেননি। তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নতুন দলীয় সাধারণ সম্পাদকও দল মেনে নিয়েছে। এই যে বিনা নির্বাচনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দুই ব্যক্তিকে পাওয়া গেল এবং অন্যান্য পদ পূরণ করার বিষয়ে দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদককে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলো, তাতে আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র কতটা বিস্তার লাভ করেছে, সে প্রশ্নটি থেকে যায়। আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের ভেতর নির্বাচন হবে না এবং দলীয় সভানেত্রী বা নেতা যেমনটি চাইবেন তেমনটি হবে, সেটা বোধ করি দেশের জন্য সুখকর হবে না। দলের ভেতর এক ব্যক্তির প্রতিপত্তি কায়েম হয়ে গেলে সে সত্যটি ক্রমশ অন্য ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে যদি সেই দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। যে অর্থে আমরা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রতীক হিসেবে দেখছি, সেই একই অর্থে আমরা তাঁকে সরকারপ্রধান হিসেবে দেখতে পারি। প্রধানমন্ত্রিত্বে তিনি কী পরিমাণ ক্ষমতার অধিকারী, সে বিষয়ে কমবেশি আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে ইদানীংকালে তিনি যেভাবে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করেছেন এবং মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করেছেন, তাও লক্ষ করা যায়। তিনি কত ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এক কথায় বলতে গেলে, দেশে বর্তমানে কেবিনেট-শাসিত সরকারের পরিবর্তে চলছে প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার। এটা অবশ্য খালেদা জিয়ার সময়ও প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। এবং এই প্রথার একটি বিশেষ দিক হলো যে মন্ত্রীবর্গ বরাবরই তাঁদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে থাকেন অথবা জাতিকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন যে তাঁদের আনুগত্য যতটা জাতীয় সংসদের প্রতি হওয়া দরকার, এর চেয়ে অধিক আনুগত্য রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। যাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাঁদের জন্য ব্যাপারটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক এ কারণে যে, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তখন সংসদ হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে, বিশেষ করে ১৯৯১-এর পর থেকে এই ধারাটিই চলে এসেছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাব সমগ্র দেশে যে কত ব্যাপক, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রাজনীতি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগ ও সরকার বলতে শেখ হাসিনাকেই বোঝায়। তিনি যেভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী নেতাদের দলীয় প্রেসিডিয়াম থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, এতে সে কথাই প্রমাণিত হয়। একইভাবে তিনি মন্ত্রিসভার ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এতেও তাঁর ক্ষমতার ব্যাপকতা প্রকাশ পায়। শেখ হাসিনার এই শক্তিশালী অবস্থানের আরেকটি দিক রয়েছে, এবং সেটি হলো তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে। যে সাতজন উপদেষ্টাকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে যথার্থই জনমনে প্রশ্ন রয়েছে এবং এসব প্রশ্নের মূলে আছে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কাজের ধরন ও নিয়ম। সাধারণত রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের একটা ভূমিকা থাকে বা থাকতে পারে। থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে যখন ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি তাঁর কাজের সহায়তা ও সমন্বয়ের জন্য উপদেষ্টা নিয়োগ করেন, তখন তিনি কখনো উপদেষ্টাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তদারক করতে বলেন না। এ নিয়মটা মেনে চলা হয় যে, একটি মন্ত্রণালয়ে কেবল মন্ত্রীই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। সেখানে কোনো উপদেষ্টার কোনো ভূমিকা নেই এবং থাকেও না। সে নিয়ম বা প্রথাটি আদৌ মনে হয় না মেনে চলা হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারে। মন্ত্রীদের পাশাপাশি উপদেষ্টা রয়েছেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কাজ দেখার জন্য। পররাষ্ট্র, অর্থ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপদেষ্টা দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কার কর্তৃত্ব এসব মন্ত্রণালয়ে থাকবে? মন্ত্রী সংসদে জবাবদিহি করবেন তাঁর কাজ সম্পর্কে। অন্যদিকে উপদেষ্টা কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। তাঁরা নির্বাচিত নন এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে তাঁদের জন্য কোনো স্থান বরাদ্দ নেই। তবু তাঁরা আছেন এবং শোনা যাচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের ধরনের কারণে মন্ত্রীরা অস্বস্তি বোধ করছেন।
এই অস্বস্তিবোধ আমাদের কারও কাম্য নয়। কিন্তু এই উপদেষ্টাবিষয়ক আলোচনার মধ্য দিয়ে আবার ফুটে ওঠে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশালাকৃতির ক্ষমতা। এত ক্ষমতা কি দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে? প্রশ্নটা এ জন্য যে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এমন নেতা বেরিয়ে আসুন, যাঁরা ভবিষ্যতে জাতিকে পথ দেখাতে পারেন, যাঁদের মধ্য থেকে আমরা ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পেয়ে যাই। সে রকম রাজনীতি আমাদের কাম্য। সে ক্ষেত্রে যখন দেশের রাজনীতি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, তখন আমাদের দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। এই যে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আব্দুর রাজ্জাক, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের ভেতর দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো, তাতে তো ক্ষতি সমগ্র জাতির হলো। আবুল হাসান চৌধুরীকে কয়েক বছর আগে বাধ্য করা হয় দল ত্যাগ করতে। অথচ তাঁর মতো মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদের খুবই প্রয়োজন আমাদের এই দেশে।
শেখ হাসিনাই এ কাজটি করতে পারেন। কোন কাজ? তিনিই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন এবং সেটা তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে দলে ও মন্ত্রিসভায় এমন ব্যক্তিদের স্থান করে দিতে পারেন, যাঁরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা রাখেন। এবং দ্বিমতের মধ্য দিয়েই কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, দেশ এগিয়ে যায়।
সৈয়দ বদরুল আহসান: সাংবাদিক।
এক কথায় বলা যায়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে এক ধরনের ক্যু ঘটিয়ে দিয়েছেন। তিনি দলের শক্তিধর বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। এটি ভাবার বিষয় যে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আব্দুর রাজ্জাকের মতো নেতা আজ এমন এক অবস্থায় আছেন, যেখানে দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়া তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা দলের প্রেসিডিয়ামে নেই। তাঁরা মন্ত্রিসভায়ও নেই। বলা হয়ে থাকে, তাঁদের এ অবস্থার জন্য দায়ী তাঁদের সংস্কারবিষয়ক চিন্তাধারা। শেখ হসিনা ও তাঁর সমর্থকদের একটি বদ্ধ ধারণা হয়েছে যে এসব নেতা তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস-টু নীতিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেছিলেন। এবং সমর্থন করেছিলেন বলেই দলের বিপুলসংখ্যক সদস্য তাঁদের দলের বা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে নারাজ। এবং সে কারণেই নাকি শেখ হাসিনা এঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে বারংবার এই নেতাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বললেও দলের সভানেত্রী শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমা প্রদর্শনের কোনো মনোভাব দেখাননি। যখন ধরে নেওয়া হয়েছিল যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে দলীয় ঐক্য ফিরে আসছে এবং দল আবার সবাইকে নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করছে, ঠিক তখনই শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরে তাঁর প্রতিপত্তির কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের দল থেকে বহিষ্কার না করলেও তিনি তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলেছেন।
এ তো হলো একটা দিক, ক্ষমা প্রদর্শনের এবং সেই প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসার। কিন্তু যেটা আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তা এই যে, ভিন্নমত পোষণ করাকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা। যদি আওয়ামী লীগে কেউ সংস্কারবাদী হয়ে থাকেন, এর অর্থ কখনো এই নয় যে, তিনি দলের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। হ্যাঁ এটা অবশ্য স্বীকার করে নিতেই হয় যে যাঁরা শেখ হাসিনার কঠিন সময়ে তাঁকে তাঁর দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছেন, তাঁরা খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দেননি। দলীয় নেতা বা নেত্রী কারাগারে থাকবেন আর সে সুযোগে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি একটি নৈতিকতাবিরোধী কাজ। তাই বলে এটা অস্বীকার করা চলবে না যে দলের অভ্যন্তরে ভিন্নমত প্রকাশ করার অধিকার দলের সব সদস্যের রয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশ করা এবং দলের অন্যদের সেটি মনেপ্রাণে স্বছন্দে গ্রহণ করলেই দলে আধুনিকতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রচলন সম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগে সেই সত্যটি বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে প্রতিফলিত হয়নি। এবং হয়নি বলেই শেখ হাসিনা আগের চেয়ে আরও অধিক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় দলের সভানেত্রীর আসন বজায় রাখেননি। তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নতুন দলীয় সাধারণ সম্পাদকও দল মেনে নিয়েছে। এই যে বিনা নির্বাচনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দুই ব্যক্তিকে পাওয়া গেল এবং অন্যান্য পদ পূরণ করার বিষয়ে দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদককে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলো, তাতে আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র কতটা বিস্তার লাভ করেছে, সে প্রশ্নটি থেকে যায়। আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের ভেতর নির্বাচন হবে না এবং দলীয় সভানেত্রী বা নেতা যেমনটি চাইবেন তেমনটি হবে, সেটা বোধ করি দেশের জন্য সুখকর হবে না। দলের ভেতর এক ব্যক্তির প্রতিপত্তি কায়েম হয়ে গেলে সে সত্যটি ক্রমশ অন্য ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে যদি সেই দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। যে অর্থে আমরা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রতীক হিসেবে দেখছি, সেই একই অর্থে আমরা তাঁকে সরকারপ্রধান হিসেবে দেখতে পারি। প্রধানমন্ত্রিত্বে তিনি কী পরিমাণ ক্ষমতার অধিকারী, সে বিষয়ে কমবেশি আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে ইদানীংকালে তিনি যেভাবে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করেছেন এবং মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করেছেন, তাও লক্ষ করা যায়। তিনি কত ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এক কথায় বলতে গেলে, দেশে বর্তমানে কেবিনেট-শাসিত সরকারের পরিবর্তে চলছে প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার। এটা অবশ্য খালেদা জিয়ার সময়ও প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। এবং এই প্রথার একটি বিশেষ দিক হলো যে মন্ত্রীবর্গ বরাবরই তাঁদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে থাকেন অথবা জাতিকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন যে তাঁদের আনুগত্য যতটা জাতীয় সংসদের প্রতি হওয়া দরকার, এর চেয়ে অধিক আনুগত্য রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। যাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাঁদের জন্য ব্যাপারটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক এ কারণে যে, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তখন সংসদ হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে, বিশেষ করে ১৯৯১-এর পর থেকে এই ধারাটিই চলে এসেছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাব সমগ্র দেশে যে কত ব্যাপক, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রাজনীতি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগ ও সরকার বলতে শেখ হাসিনাকেই বোঝায়। তিনি যেভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী নেতাদের দলীয় প্রেসিডিয়াম থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, এতে সে কথাই প্রমাণিত হয়। একইভাবে তিনি মন্ত্রিসভার ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এতেও তাঁর ক্ষমতার ব্যাপকতা প্রকাশ পায়। শেখ হাসিনার এই শক্তিশালী অবস্থানের আরেকটি দিক রয়েছে, এবং সেটি হলো তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে। যে সাতজন উপদেষ্টাকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে যথার্থই জনমনে প্রশ্ন রয়েছে এবং এসব প্রশ্নের মূলে আছে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কাজের ধরন ও নিয়ম। সাধারণত রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের একটা ভূমিকা থাকে বা থাকতে পারে। থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে যখন ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি তাঁর কাজের সহায়তা ও সমন্বয়ের জন্য উপদেষ্টা নিয়োগ করেন, তখন তিনি কখনো উপদেষ্টাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তদারক করতে বলেন না। এ নিয়মটা মেনে চলা হয় যে, একটি মন্ত্রণালয়ে কেবল মন্ত্রীই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। সেখানে কোনো উপদেষ্টার কোনো ভূমিকা নেই এবং থাকেও না। সে নিয়ম বা প্রথাটি আদৌ মনে হয় না মেনে চলা হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারে। মন্ত্রীদের পাশাপাশি উপদেষ্টা রয়েছেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কাজ দেখার জন্য। পররাষ্ট্র, অর্থ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপদেষ্টা দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কার কর্তৃত্ব এসব মন্ত্রণালয়ে থাকবে? মন্ত্রী সংসদে জবাবদিহি করবেন তাঁর কাজ সম্পর্কে। অন্যদিকে উপদেষ্টা কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। তাঁরা নির্বাচিত নন এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে তাঁদের জন্য কোনো স্থান বরাদ্দ নেই। তবু তাঁরা আছেন এবং শোনা যাচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের ধরনের কারণে মন্ত্রীরা অস্বস্তি বোধ করছেন।
এই অস্বস্তিবোধ আমাদের কারও কাম্য নয়। কিন্তু এই উপদেষ্টাবিষয়ক আলোচনার মধ্য দিয়ে আবার ফুটে ওঠে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশালাকৃতির ক্ষমতা। এত ক্ষমতা কি দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে? প্রশ্নটা এ জন্য যে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এমন নেতা বেরিয়ে আসুন, যাঁরা ভবিষ্যতে জাতিকে পথ দেখাতে পারেন, যাঁদের মধ্য থেকে আমরা ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পেয়ে যাই। সে রকম রাজনীতি আমাদের কাম্য। সে ক্ষেত্রে যখন দেশের রাজনীতি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, তখন আমাদের দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। এই যে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আব্দুর রাজ্জাক, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের ভেতর দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো, তাতে তো ক্ষতি সমগ্র জাতির হলো। আবুল হাসান চৌধুরীকে কয়েক বছর আগে বাধ্য করা হয় দল ত্যাগ করতে। অথচ তাঁর মতো মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদের খুবই প্রয়োজন আমাদের এই দেশে।
শেখ হাসিনাই এ কাজটি করতে পারেন। কোন কাজ? তিনিই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন এবং সেটা তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে দলে ও মন্ত্রিসভায় এমন ব্যক্তিদের স্থান করে দিতে পারেন, যাঁরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা রাখেন। এবং দ্বিমতের মধ্য দিয়েই কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, দেশ এগিয়ে যায়।
সৈয়দ বদরুল আহসান: সাংবাদিক।
No comments