কলকাতার টুকরো ডায়েরি by ফারুক চৌধুরী
গত ২১ থেকে ৩১ জুলাই ২০০৯—এই ১০ দিন কলকাতায় কাটিয়ে এলাম। কলকাতা, শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ৩০০ বছর আগে। তত দিনে ঢাকার শতায়ু প্রাপ্তি হয়ে গেছে। গত ৩০০ বছরে এই শহর দুটি বিভিন্ন মর্যাদায় অবস্থান করেছে। ভারতের রাজধানী থেকে কলকাতা এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, আর নানা উত্থান-পতনের চাকায় পড়ে সুবা বাংলার রাজধানী থেকে ডিভিশন শহর, আর প্রাদেশিক রাজধানী থেকে এখন ঢাকা রাজধানী একটি স্বাধীন দেশের। বিগত শতাব্দীগুলোয় আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে দুই শহরের মাঝে সম্পর্কে এসেছে প্রভূত পরিবর্তন—কখনো নৈকট্যে, কখনো বা দূরত্বে। তবে গত ছয় দশকের ব্রিটিশ-উত্তর সময়ের মোদ্দাকথাটি হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর দুটির বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ভিন্ন থেকে ভিন্নতরই হচ্ছে। স্বভাবতই স্বাধীন দুটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আর ভারতের যাত্রাপথে ভিন্নতা রয়েছে। কেবল ভাষার বাঁধনের সীমাবদ্ধতা বহুরূপেই এখন দৃশ্যমান।
তবে এবার কলকাতা যাত্রায় উপলব্ধি করলাম, ঘড়ির কাঁটা ধরে সময়ের মাপে এখন দুই শহরের মাঝে যে ব্যবধান, এমনতর আমার জানামতে আগে কখনো ঘটেনি। এখন ঢাকায় যখন ভোর ছয়টা, কলকাতায় তখনো কাক ডাকেনি। বিমানযোগে ঢাকা থেকে মিনিট চল্লিশের ওড়ানের পরও হাতে সময় বাঁচে আধা ঘণ্টারও বেশি। এই অভিজ্ঞতায় নতুনত্ব ছিল বৈকি।
ঢাকার যেকোনো নাগরিকেরই আজকাল ঢাকা ত্যাগকালে যানজট থেকে, সাময়িক হলেও, পরিত্রাণের সুখকর একটি ভাবনা থাকে। কিন্তু বিধি বাম! আমার বেলায় এ যাত্রায় তা হলো না, বরং যা ঘটল তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বিমানবন্দর থেকে চৌরঙ্গিতে আমার হোটেলে যেতে লেগে গেল তিনটি ঘণ্টা। ঢাকা থেকে কলকাতা গিয়ে আমি যেন পড়লাম, ‘ফ্রাইং প্যান’ থেকে ‘ফায়ারে’! কলকাতায় নামার আগে জানা ছিল না ২১ জুলাই বিকেলে তৃণমূল কংগ্রেস বিরাট জনসভা ডেকেছে। সভা অনুষ্ঠিত হবে ‘অ্যাসপ্লেনেডে’ আমার চৌরঙ্গি হোটেলের অনতি দূরে। সভার প্রধান বক্তা ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
তবে এইটুকু বলব যে যানজটের মাঝেও পুলিশের নির্দেশ মোতাবেকই গাড়ি চালান চালকেরা। এই বোধশক্তি চালকদের রয়েছে যে ট্রাফিক পুলিশের হুকুম শিরোধার্য করাই হচ্ছে যানজটের মাঝে গন্তব্যে পৌঁছার প্রকৃষ্ট পন্থা। ঢাকার মতো ‘ফ্রি ফর অল’ নয়।
কী বিরাট জনসভা মমতা ব্যানার্জির! প্রায় ছয় লাখ মানুষের সমাগম ছিল সেখানে। মমতা ব্যানার্জি, কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী, কিন্তু চোখ তাঁর ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ ক্ষমতা দখলের ওপর। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা তো মমতা ব্যানার্জির জনসভাকে বিগত কয়েক দশকের মাঝে চতুর্থ বৃহত্তম জনসভা বলে আখ্যায়িত করল। ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরার ১০ লাখ মানুষের সমাবেশ ছিল, তার মাঝে বৃহত্তম। বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরার সেই জনসভার একটি ছবিও ছাপাল পত্রিকাটি। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে, জয় প্রকাশ নারায়ণের একটি জনসভায় নাকি নয় লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ১৯৭৭ সালে জ্যোতিবাবুর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় রাজভবনের চারধারে জনতার ঢল। তারপরই হলো মমতা ব্যানার্জির ২১ জুলাইয়ের জনসমাগম আর যানজট। এমন দিনে কলকাতায় যাওয়া, একেই বলে ‘ফ্রাইং প্যান থেকে ফায়ারে’। তবে লক্ষ করলাম রাজপথে তৃণমূল সমর্থক জনতা আর বামপন্থী রাজ্য সরকারের পুলিশ বা প্রশাসন যন্ত্রের মাঝে কোনো অহেতুক তিক্ততা নেই। বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনির মাঝে মমতা ব্যানার্জি বললেন, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কংগ্রেসের প্রতি লক্ষ রেখে বললেন, “আমাদের সরকারে, ‘আমরা’-‘ওরা’ থাকবে না, ‘আমাদের’ থাকবে।” কথায় বড়, কিন্তু কাজে কি তত বড় হতে পারবেন মমতা? তিনি বললেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট টিকিয়ে রাখবেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে ইতিমধ্যেই টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ এবং স্বার্থ, তৃণমূলের আগ্রহ আর স্বার্থের চেয়ে ভিন্নতর। অথচ মমতা ব্যানার্জি এখন তো কেন্দ্রেরই মন্ত্রী। জোটের ভবিষ্যৎ যে কণ্টকাকীর্ণ হবে, এর অনেক আলামত এখনই পাওয়া যাচ্ছে—তা লোকসভায় ভূমি অধিগ্রহণ আইন পাস করা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে। তা ছাড়া আগামীর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতায় আসতে অনেক কাঠখড়ই পোড়াতে হবে কংগ্রেস আর তৃণমূলের। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বামপন্থীদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। যদি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে রাজ্যে গভর্নরের, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আগামীর বিবর্তন আগ্রহ-উদ্দীপকই বইবে। ওই জনসভায় মমতা ব্যানার্জি বললেন, ‘বিনয়’ আর ‘উন্নয়ন’—এই দুই ‘অস্ত্রের’ মাধ্যমেই তিনি রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ আনবেন। তবে গ্রামাঞ্চল থেকে বামপন্থী আর তৃণমূলের সংঘর্ষে হতাহতের খবরে মনে হয় যে ‘বিনয়’ আর ‘উন্নয়নের’ চেয়েও ধারালো ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করছেন দুই দলের অনুসারীরা!
কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের রেলযোগাযোগে উন্নতিসাধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে তাঁর ‘চমক’ হবে কিছুদিনের মধ্যে চালু হওয়া কলকাতা-দিল্লি দ্রুত আরামদায়ক ট্রেন সার্ভিস, যা কলকাতা থেকে সোজা দিল্লিতে থামবে। কলকাতার এক বন্ধুর মন্তব্য, ট্রেনটি আসলে থামবে দিল্লিতে নয়—ফিরে এসে থামবে কলকাতার ‘মহাকরণ’ অর্থাৎ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সচিবালয়ে!
কিছুদিন আগে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম ঢাকায় এসেছিলেন। কলকাতায় গিয়ে দেখি তাঁকে নিয়ে মহা হইচই। তাঁর বাংলাদেশ সফর নিয়ে নয়, সেই সফরে কলকাতার সংবাদমাধ্যম কোনো নজর দিয়েছে বলে মনে হলো না। হইচই হলো; গত ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস’-এর নিরাপত্তাকর্মীরা আবদুল কালামের দেহ তল্লাশি করেছেন। এই দেহ তল্লাশি ভারতের রাষ্ট্রাচার নিয়মের পরিপন্থী বলে বিরোধী দল হইচই শুরু করল, প্রথমে লোকসভায় এবং পরে রাজ্যসভায়। বিষয়টি বেশি দূর গড়ানোর আগেই সরকারের চাপের মুখে কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস ক্ষমা চাইল আবদুল কালামের কাছে (আবদুল কালাম বর্তমান বিরোধী দল গোষ্ঠীরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন)। তবে মজার কথাটি হলো, তাঁর মুখপাত্রের ভাষ্যে, আবদুল কালাম কিন্তু জুতা খোলা থেকে দেহ তল্লাশি প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায়ই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কোনো ওজর-আপত্তি তিনি তোলেননি। তবুও ব্যবসায় সাবধানতার মার নেই—কথাটি কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস ভালো করেই জানে!
আমার কলকাতা অবস্থানকালে ভারতের লোকসভায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে বিরোধী দল আর সরকারের মাঝে বিপুল উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। কারণ হচ্ছে, মিসরের ‘শারম আল শেখ’-এ মনমোহন সিং আর ইউসুফ রাজা জিলানির সাক্ষাতের পর যে যুগ্ম বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী জিলানি জানিয়েছেন, বেলুচিস্তান এবং ‘অন্যান্য এলাকার’ ওপর সম্ভাব্য হামলার কিছু তথ্য পাকিস্তানের কাছে রয়েছে। এটা পড়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে বিজেপি। তাদের কথা হলো, বেলুচিস্তান হলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অতএব, বেলুচিস্তানের উল্লেখ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যুগ্ম বিবৃতিতে কেন থাকবে। তাদের কথা হলো, একবার পাকিস্তান যখন বেলুচিস্তানের কথা একটি যুগ্ম বিবৃতিতে উল্লেখ করে ফেলেছে, পাকিস্তান ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বারবার বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ টেনে আনবে। একা কাশ্মীরের রক্ষে নেই, এখন বেলুচিস্তান দোসর!
বেলুচিস্তানে কে কী হামলা করছে, তা আমার জানা নেই। তবে গত মে মাসে পাকিস্তান সফর শেষে আমি প্রথম আলোর পাতায়ই লিখেছিলাম, ‘পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিশালাকার বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী বেলুচিস্তান। বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি এখন বেলুচিস্তানের সর্বত্র। যুগ যুগ ধরে বেলুচিস্তানের ওপর নিষ্পেষণ এবং সেই প্রদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ জবরদখলের খেসারত এখন পাকিস্তানকে দিতে হচ্ছে। অবস্থা এতই গুরুতর যে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন অথবা জাতীয় সংগীত পরিবেশন বেলুচি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিষিদ্ধ...।’
শারম আল শেখের যুগ্ম বিবৃতিতে বেলুচিস্তানের উল্লেখ, বিজেপির মতে, পাকিস্তানের কাছে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয়ের শামিল। কারণ, বেলুচিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তার সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। এই লাইন ধরেই লোকসভায় লালকৃষ্ণ আদভানি, যশোবন্ত সিংহ, সুষমা স্বরাজ প্রমুখ বিজেপি নেতা সরকারের তুলোধোনা করে ছাড়লেন। এসব অভিযোগের জবাব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নম্রতায় ভালোই দিলেন। তিনি বললেন, তাঁর পূর্বসূরি অটল বিহারি বাজপেয়ি লাহোর যাওয়ার রাজনৈতিক সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে এল কারগিল এবং হাইজেকিং। তা সত্ত্বেও তিনি পারভেজ মোশাররফকে আগ্রায় আমন্ত্রণ জানালেন। তারপর দিল্লির পার্লামেন্টের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হলো। তবুও দমলেন না বাজপেয়ি। মনমোহন সিং বললেন তিনিও বাজপেয়ির ‘ভিশনে’ বিশ্বাসী। তাঁর বিশ্বাস, শান্তি স্থাপন ভারতের মতো পাকিস্তানও কামনা করে। পাকিস্তানের নেতারা এখন অনুধাবন করেন যে পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসকে পরাজিত না করে, তাহলে সন্ত্রাসই পাকিস্তানকে পরাস্ত করবে। মনমোহন সিং বললেন, পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব সন্ত্রাস দমনে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বলেই তাঁর বিশ্বাস। বললেন, যশোবন্ত সিংহ প্রশ্ন উঠিয়েছেন, ‘আমরা কি পাকিস্তানকে বিশ্বাস করি?’ ‘প্রেসিডেন্ট রেগানের উদ্ধৃতি দিয়ে মনমোহন সিং বললেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর উচিৎ একে অপরের ওপর বিশ্বাস রাখা, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে নজরদারিও রাখা (Trust and Verify)। মনমোহন সিংয়ের মৃদুভাষণ ভালোই ছিল। কিন্তু তবুও তাঁর সমর্থনে জোরালো ভাষায় বক্তব্য দিলেন সাবেক বিদেশ মন্ত্রী এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। তিনি বললেন, বেলুচিস্তান সম্পর্কে পাকিস্তানের বক্তব্যটি একতরফা। আসলে এ বিষয়ে ভারতের কিছুই লুকানোর নেই। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, নবনিযুক্ত বিদেশ মন্ত্রী এস এম কৃষ্ণকে কিছু বলতেই হয়। প্রণব বাবুর কথার রেশ ধরে তিনি বললেন, বেলুচিস্তান নিয়ে ভারতের লুকানোর কিছু নেই। কিন্তু তার পরের উক্তিটি ছিল অপ্রয়োজনীয়। তিনি বললেন, ভারতের কিছু লুকানোর নেই বলেই যুক্ত বিবৃতিতে বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ উল্লেখ করার প্রস্তাবটিতে ভারত ‘তাত্ক্ষণিকভাবে’ (readily) রাজি হয়ে যায়। তার এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করল বিজেপি। তাদের অভিযোগ, বিদেশ মন্ত্রী হিসেবে এস এম কৃষ্ণ অদক্ষতা ও অনজ্ঞিতাই দেখিয়েছেন এবং তিনি বর্তমান সরকারের জন্য বিরাট বোঝা। এই বলে লোকসভা থেকে ওয়াকআউট করল বিরোধী দল।
কিছু বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, বেলুচিস্তানের উল্লেখটি না থাকলেই ভারতের জন্য ভালো হতো এবং এতে রাজি হয়ে বিদেশ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়নি। তবে মহাভারত তাতে অশুদ্ধ হয়ে যায়নি, বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, মনমোহন সিংয়ের উক্তির প্রশংসা করেছেন এবং কিছুটা অনর্থক এই কাজিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে মতৈক্য আরও প্রগাঢ় হয়েছে। এখানে মনে রাখা ভালো যে, পাকিস্তানে যেহেতু এখন একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে, যার সঙ্গে ভাবনার লেনদেন ভারতের নেতাদের জন্য আগের চেয়ে সহজতর। তা ছাড়া সন্ত্রাস দমনের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তির বাড়তি চাপ তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে ক্রিকেটই ছিল আমার কলকাতা থাকাকালীন সেখানকার সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখের প্রধান বিষয়। মাশরাফি, সাকিব, আশরাফুল—তাদের নাম কলকাতার ক্রিকেট প্রেমিকদের কাছে এখন পরিচিত। তবে অবাক লাগল যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি, এমনকি টিপাইমুখের মতো দ্বিপক্ষীয় সমস্যার প্রতি, কলকাতার সংবাদমাধ্যমের চরম ঔদাসীন্য দেখে। কলকাতায় কোনো বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল দেখা যায় না। মুঠোফোন না থাকলে কলকাতায় বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো খবরই পেতাম না। বাংলাদেশের খবর কখনো বা জেনেছি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী আপনজনের করুণায়। এ অবস্থাটি ভয়ানক অস্বস্তিকর। আর মুখের মিঠে বুলি সত্ত্বেও নৈকট্যের ভাবটি হারিয়ে যায়। মনে হয় দূরের কোনো এক দেশে যেন এসেছি।
পাশ্চাত্য দেশগুলোর, ঘরের অথবা এলাকার মানুষকে কূটনীতিক প্রতিনিধি করে পাঠানোর প্রবণতা যেন বাড়ছে (বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের আনোয়ার চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গীতা পাসি)। যুক্তরাজ্য এবার কলকাতায় কূটনীতিক প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছে কলকাতায়ই জন্ম নেওয়া একজন কূটনীতিককে। কলকাতার যুক্তরাষ্ট্রের নবাগত এই হাইকমিশনারের নাম সঞ্চয় ওয়াদভানি। জন্ম কলকাতায় ১৯৬৬ সালে (আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনের সময়ে) আর পরিবারের সঙ্গে দেশান্তরি হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে। অবশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনীতিক চুনোপুঁটিরা বাংলাদেশের মতো নাক গলানোর সুযোগ পান না। সেই অর্থে এই নিয়োগবিধির কোনো বিশেষ তাত্পর্য নেই।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব; কলাম লেখক।
তবে এবার কলকাতা যাত্রায় উপলব্ধি করলাম, ঘড়ির কাঁটা ধরে সময়ের মাপে এখন দুই শহরের মাঝে যে ব্যবধান, এমনতর আমার জানামতে আগে কখনো ঘটেনি। এখন ঢাকায় যখন ভোর ছয়টা, কলকাতায় তখনো কাক ডাকেনি। বিমানযোগে ঢাকা থেকে মিনিট চল্লিশের ওড়ানের পরও হাতে সময় বাঁচে আধা ঘণ্টারও বেশি। এই অভিজ্ঞতায় নতুনত্ব ছিল বৈকি।
ঢাকার যেকোনো নাগরিকেরই আজকাল ঢাকা ত্যাগকালে যানজট থেকে, সাময়িক হলেও, পরিত্রাণের সুখকর একটি ভাবনা থাকে। কিন্তু বিধি বাম! আমার বেলায় এ যাত্রায় তা হলো না, বরং যা ঘটল তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বিমানবন্দর থেকে চৌরঙ্গিতে আমার হোটেলে যেতে লেগে গেল তিনটি ঘণ্টা। ঢাকা থেকে কলকাতা গিয়ে আমি যেন পড়লাম, ‘ফ্রাইং প্যান’ থেকে ‘ফায়ারে’! কলকাতায় নামার আগে জানা ছিল না ২১ জুলাই বিকেলে তৃণমূল কংগ্রেস বিরাট জনসভা ডেকেছে। সভা অনুষ্ঠিত হবে ‘অ্যাসপ্লেনেডে’ আমার চৌরঙ্গি হোটেলের অনতি দূরে। সভার প্রধান বক্তা ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
তবে এইটুকু বলব যে যানজটের মাঝেও পুলিশের নির্দেশ মোতাবেকই গাড়ি চালান চালকেরা। এই বোধশক্তি চালকদের রয়েছে যে ট্রাফিক পুলিশের হুকুম শিরোধার্য করাই হচ্ছে যানজটের মাঝে গন্তব্যে পৌঁছার প্রকৃষ্ট পন্থা। ঢাকার মতো ‘ফ্রি ফর অল’ নয়।
কী বিরাট জনসভা মমতা ব্যানার্জির! প্রায় ছয় লাখ মানুষের সমাগম ছিল সেখানে। মমতা ব্যানার্জি, কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী, কিন্তু চোখ তাঁর ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ ক্ষমতা দখলের ওপর। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা তো মমতা ব্যানার্জির জনসভাকে বিগত কয়েক দশকের মাঝে চতুর্থ বৃহত্তম জনসভা বলে আখ্যায়িত করল। ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরার ১০ লাখ মানুষের সমাবেশ ছিল, তার মাঝে বৃহত্তম। বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরার সেই জনসভার একটি ছবিও ছাপাল পত্রিকাটি। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে, জয় প্রকাশ নারায়ণের একটি জনসভায় নাকি নয় লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ১৯৭৭ সালে জ্যোতিবাবুর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় রাজভবনের চারধারে জনতার ঢল। তারপরই হলো মমতা ব্যানার্জির ২১ জুলাইয়ের জনসমাগম আর যানজট। এমন দিনে কলকাতায় যাওয়া, একেই বলে ‘ফ্রাইং প্যান থেকে ফায়ারে’। তবে লক্ষ করলাম রাজপথে তৃণমূল সমর্থক জনতা আর বামপন্থী রাজ্য সরকারের পুলিশ বা প্রশাসন যন্ত্রের মাঝে কোনো অহেতুক তিক্ততা নেই। বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনির মাঝে মমতা ব্যানার্জি বললেন, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কংগ্রেসের প্রতি লক্ষ রেখে বললেন, “আমাদের সরকারে, ‘আমরা’-‘ওরা’ থাকবে না, ‘আমাদের’ থাকবে।” কথায় বড়, কিন্তু কাজে কি তত বড় হতে পারবেন মমতা? তিনি বললেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট টিকিয়ে রাখবেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে ইতিমধ্যেই টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ এবং স্বার্থ, তৃণমূলের আগ্রহ আর স্বার্থের চেয়ে ভিন্নতর। অথচ মমতা ব্যানার্জি এখন তো কেন্দ্রেরই মন্ত্রী। জোটের ভবিষ্যৎ যে কণ্টকাকীর্ণ হবে, এর অনেক আলামত এখনই পাওয়া যাচ্ছে—তা লোকসভায় ভূমি অধিগ্রহণ আইন পাস করা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে। তা ছাড়া আগামীর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতায় আসতে অনেক কাঠখড়ই পোড়াতে হবে কংগ্রেস আর তৃণমূলের। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বামপন্থীদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। যদি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে রাজ্যে গভর্নরের, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আগামীর বিবর্তন আগ্রহ-উদ্দীপকই বইবে। ওই জনসভায় মমতা ব্যানার্জি বললেন, ‘বিনয়’ আর ‘উন্নয়ন’—এই দুই ‘অস্ত্রের’ মাধ্যমেই তিনি রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ আনবেন। তবে গ্রামাঞ্চল থেকে বামপন্থী আর তৃণমূলের সংঘর্ষে হতাহতের খবরে মনে হয় যে ‘বিনয়’ আর ‘উন্নয়নের’ চেয়েও ধারালো ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করছেন দুই দলের অনুসারীরা!
কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের রেলযোগাযোগে উন্নতিসাধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে তাঁর ‘চমক’ হবে কিছুদিনের মধ্যে চালু হওয়া কলকাতা-দিল্লি দ্রুত আরামদায়ক ট্রেন সার্ভিস, যা কলকাতা থেকে সোজা দিল্লিতে থামবে। কলকাতার এক বন্ধুর মন্তব্য, ট্রেনটি আসলে থামবে দিল্লিতে নয়—ফিরে এসে থামবে কলকাতার ‘মহাকরণ’ অর্থাৎ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সচিবালয়ে!
কিছুদিন আগে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম ঢাকায় এসেছিলেন। কলকাতায় গিয়ে দেখি তাঁকে নিয়ে মহা হইচই। তাঁর বাংলাদেশ সফর নিয়ে নয়, সেই সফরে কলকাতার সংবাদমাধ্যম কোনো নজর দিয়েছে বলে মনে হলো না। হইচই হলো; গত ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস’-এর নিরাপত্তাকর্মীরা আবদুল কালামের দেহ তল্লাশি করেছেন। এই দেহ তল্লাশি ভারতের রাষ্ট্রাচার নিয়মের পরিপন্থী বলে বিরোধী দল হইচই শুরু করল, প্রথমে লোকসভায় এবং পরে রাজ্যসভায়। বিষয়টি বেশি দূর গড়ানোর আগেই সরকারের চাপের মুখে কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস ক্ষমা চাইল আবদুল কালামের কাছে (আবদুল কালাম বর্তমান বিরোধী দল গোষ্ঠীরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন)। তবে মজার কথাটি হলো, তাঁর মুখপাত্রের ভাষ্যে, আবদুল কালাম কিন্তু জুতা খোলা থেকে দেহ তল্লাশি প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায়ই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কোনো ওজর-আপত্তি তিনি তোলেননি। তবুও ব্যবসায় সাবধানতার মার নেই—কথাটি কন্টিনেন্টেল এয়ারলাইনস ভালো করেই জানে!
আমার কলকাতা অবস্থানকালে ভারতের লোকসভায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে বিরোধী দল আর সরকারের মাঝে বিপুল উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। কারণ হচ্ছে, মিসরের ‘শারম আল শেখ’-এ মনমোহন সিং আর ইউসুফ রাজা জিলানির সাক্ষাতের পর যে যুগ্ম বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী জিলানি জানিয়েছেন, বেলুচিস্তান এবং ‘অন্যান্য এলাকার’ ওপর সম্ভাব্য হামলার কিছু তথ্য পাকিস্তানের কাছে রয়েছে। এটা পড়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে বিজেপি। তাদের কথা হলো, বেলুচিস্তান হলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অতএব, বেলুচিস্তানের উল্লেখ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যুগ্ম বিবৃতিতে কেন থাকবে। তাদের কথা হলো, একবার পাকিস্তান যখন বেলুচিস্তানের কথা একটি যুগ্ম বিবৃতিতে উল্লেখ করে ফেলেছে, পাকিস্তান ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বারবার বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ টেনে আনবে। একা কাশ্মীরের রক্ষে নেই, এখন বেলুচিস্তান দোসর!
বেলুচিস্তানে কে কী হামলা করছে, তা আমার জানা নেই। তবে গত মে মাসে পাকিস্তান সফর শেষে আমি প্রথম আলোর পাতায়ই লিখেছিলাম, ‘পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিশালাকার বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী বেলুচিস্তান। বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি এখন বেলুচিস্তানের সর্বত্র। যুগ যুগ ধরে বেলুচিস্তানের ওপর নিষ্পেষণ এবং সেই প্রদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ জবরদখলের খেসারত এখন পাকিস্তানকে দিতে হচ্ছে। অবস্থা এতই গুরুতর যে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন অথবা জাতীয় সংগীত পরিবেশন বেলুচি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিষিদ্ধ...।’
শারম আল শেখের যুগ্ম বিবৃতিতে বেলুচিস্তানের উল্লেখ, বিজেপির মতে, পাকিস্তানের কাছে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয়ের শামিল। কারণ, বেলুচিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তার সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। এই লাইন ধরেই লোকসভায় লালকৃষ্ণ আদভানি, যশোবন্ত সিংহ, সুষমা স্বরাজ প্রমুখ বিজেপি নেতা সরকারের তুলোধোনা করে ছাড়লেন। এসব অভিযোগের জবাব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নম্রতায় ভালোই দিলেন। তিনি বললেন, তাঁর পূর্বসূরি অটল বিহারি বাজপেয়ি লাহোর যাওয়ার রাজনৈতিক সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে এল কারগিল এবং হাইজেকিং। তা সত্ত্বেও তিনি পারভেজ মোশাররফকে আগ্রায় আমন্ত্রণ জানালেন। তারপর দিল্লির পার্লামেন্টের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হলো। তবুও দমলেন না বাজপেয়ি। মনমোহন সিং বললেন তিনিও বাজপেয়ির ‘ভিশনে’ বিশ্বাসী। তাঁর বিশ্বাস, শান্তি স্থাপন ভারতের মতো পাকিস্তানও কামনা করে। পাকিস্তানের নেতারা এখন অনুধাবন করেন যে পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসকে পরাজিত না করে, তাহলে সন্ত্রাসই পাকিস্তানকে পরাস্ত করবে। মনমোহন সিং বললেন, পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব সন্ত্রাস দমনে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বলেই তাঁর বিশ্বাস। বললেন, যশোবন্ত সিংহ প্রশ্ন উঠিয়েছেন, ‘আমরা কি পাকিস্তানকে বিশ্বাস করি?’ ‘প্রেসিডেন্ট রেগানের উদ্ধৃতি দিয়ে মনমোহন সিং বললেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর উচিৎ একে অপরের ওপর বিশ্বাস রাখা, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে নজরদারিও রাখা (Trust and Verify)। মনমোহন সিংয়ের মৃদুভাষণ ভালোই ছিল। কিন্তু তবুও তাঁর সমর্থনে জোরালো ভাষায় বক্তব্য দিলেন সাবেক বিদেশ মন্ত্রী এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। তিনি বললেন, বেলুচিস্তান সম্পর্কে পাকিস্তানের বক্তব্যটি একতরফা। আসলে এ বিষয়ে ভারতের কিছুই লুকানোর নেই। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, নবনিযুক্ত বিদেশ মন্ত্রী এস এম কৃষ্ণকে কিছু বলতেই হয়। প্রণব বাবুর কথার রেশ ধরে তিনি বললেন, বেলুচিস্তান নিয়ে ভারতের লুকানোর কিছু নেই। কিন্তু তার পরের উক্তিটি ছিল অপ্রয়োজনীয়। তিনি বললেন, ভারতের কিছু লুকানোর নেই বলেই যুক্ত বিবৃতিতে বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ উল্লেখ করার প্রস্তাবটিতে ভারত ‘তাত্ক্ষণিকভাবে’ (readily) রাজি হয়ে যায়। তার এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করল বিজেপি। তাদের অভিযোগ, বিদেশ মন্ত্রী হিসেবে এস এম কৃষ্ণ অদক্ষতা ও অনজ্ঞিতাই দেখিয়েছেন এবং তিনি বর্তমান সরকারের জন্য বিরাট বোঝা। এই বলে লোকসভা থেকে ওয়াকআউট করল বিরোধী দল।
কিছু বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, বেলুচিস্তানের উল্লেখটি না থাকলেই ভারতের জন্য ভালো হতো এবং এতে রাজি হয়ে বিদেশ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়নি। তবে মহাভারত তাতে অশুদ্ধ হয়ে যায়নি, বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, মনমোহন সিংয়ের উক্তির প্রশংসা করেছেন এবং কিছুটা অনর্থক এই কাজিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে মতৈক্য আরও প্রগাঢ় হয়েছে। এখানে মনে রাখা ভালো যে, পাকিস্তানে যেহেতু এখন একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে, যার সঙ্গে ভাবনার লেনদেন ভারতের নেতাদের জন্য আগের চেয়ে সহজতর। তা ছাড়া সন্ত্রাস দমনের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তির বাড়তি চাপ তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে ক্রিকেটই ছিল আমার কলকাতা থাকাকালীন সেখানকার সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখের প্রধান বিষয়। মাশরাফি, সাকিব, আশরাফুল—তাদের নাম কলকাতার ক্রিকেট প্রেমিকদের কাছে এখন পরিচিত। তবে অবাক লাগল যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি, এমনকি টিপাইমুখের মতো দ্বিপক্ষীয় সমস্যার প্রতি, কলকাতার সংবাদমাধ্যমের চরম ঔদাসীন্য দেখে। কলকাতায় কোনো বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল দেখা যায় না। মুঠোফোন না থাকলে কলকাতায় বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো খবরই পেতাম না। বাংলাদেশের খবর কখনো বা জেনেছি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী আপনজনের করুণায়। এ অবস্থাটি ভয়ানক অস্বস্তিকর। আর মুখের মিঠে বুলি সত্ত্বেও নৈকট্যের ভাবটি হারিয়ে যায়। মনে হয় দূরের কোনো এক দেশে যেন এসেছি।
পাশ্চাত্য দেশগুলোর, ঘরের অথবা এলাকার মানুষকে কূটনীতিক প্রতিনিধি করে পাঠানোর প্রবণতা যেন বাড়ছে (বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের আনোয়ার চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গীতা পাসি)। যুক্তরাজ্য এবার কলকাতায় কূটনীতিক প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছে কলকাতায়ই জন্ম নেওয়া একজন কূটনীতিককে। কলকাতার যুক্তরাষ্ট্রের নবাগত এই হাইকমিশনারের নাম সঞ্চয় ওয়াদভানি। জন্ম কলকাতায় ১৯৬৬ সালে (আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনের সময়ে) আর পরিবারের সঙ্গে দেশান্তরি হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে। অবশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনীতিক চুনোপুঁটিরা বাংলাদেশের মতো নাক গলানোর সুযোগ পান না। সেই অর্থে এই নিয়োগবিধির কোনো বিশেষ তাত্পর্য নেই।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব; কলাম লেখক।
No comments