গুলি লাগে সিরাজের বুকে by সাইফুল হক মোল্লা
আজ ৮ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিরাজ বীর বিক্রমের ৩৮তম শাহাদাতবার্ষিকী। একাত্তরের এই দিনে অসম সাহসী এই যোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গকে ভেঙে জয়ের আনন্দে যখন আত্মহারা, তখন পিছু হটা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন টগবগে যুবক মো. সিরাজুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সুনামগঞ্জের সাচনাযুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ যুদ্ধেই বীরত্বের সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামের মো. মুকতুল হোসেনের ছেলে ও কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রনেতা এবং সেই সময়ের কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি পদপ্রার্থী সিরাজুল ইসলাম একাত্তরে ভারতের ‘ইকোয়ান’ ক্যাম্পে মে মাসে পঞ্চম ব্যাচে ৩২ দিন প্রশিক্ষণ নেন। পরে মেজর মোসলেহ উদ্দিনের অধীনে সেক্টর-৫-এ যোগ দেন। তাঁর কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন জগেজ্যাতি দাস। কোম্পানিতে তিনি ছিলেন সহকারী কমান্ডার। এ বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর বাট।
৮ আগস্ট ১৯৭১। জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মেজর বাট ময়মনসিংহের চৌকস ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অগ্রগামী দল (অ্যাডভান্সড পার্টি) গঠন করেন। এ দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন সিরাজুল ইসলাম। অগ্রগামী দলের ওপর আদেশ হয় ঢাকা-সিলেট নৌপথে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ‘সাচনা বাজার’ শত্রুমুক্ত করার।
রেল যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সব রসদপত্র এ পথেই সিলেটে আনা হতো। এর আগে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কপথটি পাকিস্তানি বাহিনী অভিযান পরিচালনা ও রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করত। সড়কে জলকলস ও পাগলা নামক দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে সার্বক্ষণিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা প্রহরায় থাকত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিট চেষ্টা করেও সেতুটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। তখন সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীদের ওপর এ দায়িত্ব পড়ে। সিরাজ তাঁর তিন সহযোগীকে নিয়ে রাখাল-মজুরের ছদ্মবেশে সেতুর কাছে সুযোগের অপেক্ষায় জমিতে কাজ করতে থাকেন। ২০ মে রাত ১০টার সময় সুযোগ বুঝে সিরাজ ডিনামাইটের সাহায্যে জলকলস সেতুটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেন।
এ অবস্থায় কোনো বিকল্প সড়ক না থাকায় সাচনা নদীবন্দরের মাধ্যমেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ চলত। ফলে সাচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শক্তির সমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী গড়ে তোলে এক শক্ত ঘাঁটি। এতে সাচনা ‘রাক্ষুসী সাচনা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেও মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা অর্জন করতে পারেননি। বরং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
সিরাজের নেতৃত্বাধীন অগ্রগামী দলের ওপর সাচনা মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ে। অগ্রগামী দলের সদস্যরা বিভিন্ন দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যথেষ্ট সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করেন। তাই সিদ্ধান্ত হয়, এ বাহিনীর পক্ষেই গেরিলা কায়দায় সাচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প হটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের নেতৃত্বে দলটি দুটি ছিপ নৌকায় সাচনার ২৫ মাইল উত্তর দিক থেকে অভিযান শুরু করে।
শ্রাবণের মেঘে আচ্ছাদিত হালকা বৃষ্টির মধ্যে মেজর বাট, ক্যাপ্টেন বিজয় শর্মাসহ অন্যরা অনাড়ম্বরভাবে দলটিকে বিদায় জানান। অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল হালকা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। দীর্ঘ তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে দলটি সাচনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আঁটসাঁট করে মাথায় গামছা বেঁধে কমান্ডার সিরাজের সঙ্গে অন্যরা দীপ্ত কণ্ঠে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, ‘মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পতন।’
ঠিক এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী দৈবাত্ ঘটনা আঁচ করে সচকিত হয়ে পড়ে। সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান নেয় এবং অগ্রগামী দলের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিব্রত হলেও কমান্ডার সিরাজ পাল্টা আক্রমণের আদেশ দেন। শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।
রাতের নীরবতা ভেঙে এক ভয়াল বিভীষিকা নেমে এল সাচনার বুকে। মুহুর্মুহু গর্জনে চারদিক প্রকম্পিত হতে লাগল। ভীতবিহ্বল পাখিরা আর্তকলরবে উড়তে লাগল দিশেহারা হয়ে।
পাকিস্তানি বাহিনী সংখ্যায় কয়েক গুণ বেশি এবং সুরক্ষিত বাঙ্কারে তারা। অগ্রগামী দল উন্মুক্ত জায়গায়। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে চলেছে। পাকিস্তানি হানাদার ও অগ্রগামী দলের দূরত্ব মাত্র ১০০ গজের মধ্যে। তার পরও অগ্রগামী দলের যোদ্ধারা মাটির সঙ্গে মিশে, শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন কৌশলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গেরিলা আক্রমণ করে যেতে লাগল।
সিরাজ বারবার ‘আগাও’, ‘আগাও’ বলে চিত্কার করে তাঁর বাহিনীকে বিপুল বিক্রমে শত্রুশিবিরের সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। যুদ্ধকে প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শত্রুর প্রতিরোধ ব্যূহ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তারা পালানোর প্রক্রিয়া শুরু করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধজয়ী সিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ অবস্থান ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন এবং স্বাধীনতার স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় ঘটে যায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। পলায়নরত শত্রুর ‘কাভারিং ফায়ারের’ একটি বুলেট এসে লাগল সিরাজের চোখে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আহত সিরাজকে চিকিৎসার জন্য মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ভারত নেওয়ার সময় পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর লাশ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডের নিকটবর্তী টেকেরঘাটে অবতরণ করা হয়। সেখানে সন্ধ্যায় খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিকে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার বিশাল সমাবেশে সাচনার নামকরণ করা হয় ‘সিরাজনগর’। বঙ্গবন্ধু সরকার সিরাজকে অসামান্য বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে।
মৃত্যুর মাত্র নয় দিন আগে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ সিরাজ তাঁর বাবার কাছে লিখেছিলেন সর্বশেষ চিঠি। একাত্তরের চিঠি বইতে সে চিঠিটি পড়া যাবে।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামের মো. মুকতুল হোসেনের ছেলে ও কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রনেতা এবং সেই সময়ের কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি পদপ্রার্থী সিরাজুল ইসলাম একাত্তরে ভারতের ‘ইকোয়ান’ ক্যাম্পে মে মাসে পঞ্চম ব্যাচে ৩২ দিন প্রশিক্ষণ নেন। পরে মেজর মোসলেহ উদ্দিনের অধীনে সেক্টর-৫-এ যোগ দেন। তাঁর কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন জগেজ্যাতি দাস। কোম্পানিতে তিনি ছিলেন সহকারী কমান্ডার। এ বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর বাট।
৮ আগস্ট ১৯৭১। জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মেজর বাট ময়মনসিংহের চৌকস ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অগ্রগামী দল (অ্যাডভান্সড পার্টি) গঠন করেন। এ দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন সিরাজুল ইসলাম। অগ্রগামী দলের ওপর আদেশ হয় ঢাকা-সিলেট নৌপথে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ‘সাচনা বাজার’ শত্রুমুক্ত করার।
রেল যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সব রসদপত্র এ পথেই সিলেটে আনা হতো। এর আগে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কপথটি পাকিস্তানি বাহিনী অভিযান পরিচালনা ও রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করত। সড়কে জলকলস ও পাগলা নামক দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে সার্বক্ষণিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা প্রহরায় থাকত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিট চেষ্টা করেও সেতুটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। তখন সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীদের ওপর এ দায়িত্ব পড়ে। সিরাজ তাঁর তিন সহযোগীকে নিয়ে রাখাল-মজুরের ছদ্মবেশে সেতুর কাছে সুযোগের অপেক্ষায় জমিতে কাজ করতে থাকেন। ২০ মে রাত ১০টার সময় সুযোগ বুঝে সিরাজ ডিনামাইটের সাহায্যে জলকলস সেতুটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেন।
এ অবস্থায় কোনো বিকল্প সড়ক না থাকায় সাচনা নদীবন্দরের মাধ্যমেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ চলত। ফলে সাচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শক্তির সমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী গড়ে তোলে এক শক্ত ঘাঁটি। এতে সাচনা ‘রাক্ষুসী সাচনা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেও মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা অর্জন করতে পারেননি। বরং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
সিরাজের নেতৃত্বাধীন অগ্রগামী দলের ওপর সাচনা মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ে। অগ্রগামী দলের সদস্যরা বিভিন্ন দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যথেষ্ট সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করেন। তাই সিদ্ধান্ত হয়, এ বাহিনীর পক্ষেই গেরিলা কায়দায় সাচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প হটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের নেতৃত্বে দলটি দুটি ছিপ নৌকায় সাচনার ২৫ মাইল উত্তর দিক থেকে অভিযান শুরু করে।
শ্রাবণের মেঘে আচ্ছাদিত হালকা বৃষ্টির মধ্যে মেজর বাট, ক্যাপ্টেন বিজয় শর্মাসহ অন্যরা অনাড়ম্বরভাবে দলটিকে বিদায় জানান। অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল হালকা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। দীর্ঘ তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে দলটি সাচনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আঁটসাঁট করে মাথায় গামছা বেঁধে কমান্ডার সিরাজের সঙ্গে অন্যরা দীপ্ত কণ্ঠে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, ‘মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পতন।’
ঠিক এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী দৈবাত্ ঘটনা আঁচ করে সচকিত হয়ে পড়ে। সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান নেয় এবং অগ্রগামী দলের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিব্রত হলেও কমান্ডার সিরাজ পাল্টা আক্রমণের আদেশ দেন। শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।
রাতের নীরবতা ভেঙে এক ভয়াল বিভীষিকা নেমে এল সাচনার বুকে। মুহুর্মুহু গর্জনে চারদিক প্রকম্পিত হতে লাগল। ভীতবিহ্বল পাখিরা আর্তকলরবে উড়তে লাগল দিশেহারা হয়ে।
পাকিস্তানি বাহিনী সংখ্যায় কয়েক গুণ বেশি এবং সুরক্ষিত বাঙ্কারে তারা। অগ্রগামী দল উন্মুক্ত জায়গায়। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে চলেছে। পাকিস্তানি হানাদার ও অগ্রগামী দলের দূরত্ব মাত্র ১০০ গজের মধ্যে। তার পরও অগ্রগামী দলের যোদ্ধারা মাটির সঙ্গে মিশে, শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন কৌশলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গেরিলা আক্রমণ করে যেতে লাগল।
সিরাজ বারবার ‘আগাও’, ‘আগাও’ বলে চিত্কার করে তাঁর বাহিনীকে বিপুল বিক্রমে শত্রুশিবিরের সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। যুদ্ধকে প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শত্রুর প্রতিরোধ ব্যূহ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তারা পালানোর প্রক্রিয়া শুরু করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধজয়ী সিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ অবস্থান ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন এবং স্বাধীনতার স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় ঘটে যায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। পলায়নরত শত্রুর ‘কাভারিং ফায়ারের’ একটি বুলেট এসে লাগল সিরাজের চোখে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আহত সিরাজকে চিকিৎসার জন্য মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ভারত নেওয়ার সময় পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর লাশ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডের নিকটবর্তী টেকেরঘাটে অবতরণ করা হয়। সেখানে সন্ধ্যায় খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিকে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার বিশাল সমাবেশে সাচনার নামকরণ করা হয় ‘সিরাজনগর’। বঙ্গবন্ধু সরকার সিরাজকে অসামান্য বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে।
মৃত্যুর মাত্র নয় দিন আগে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ সিরাজ তাঁর বাবার কাছে লিখেছিলেন সর্বশেষ চিঠি। একাত্তরের চিঠি বইতে সে চিঠিটি পড়া যাবে।
No comments