পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক পথেই -আদিবাসী অধিকার by ফিরোজ জামান চৌধুরী
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এক বহুল আলোচিত বিষয়। সরকারের মেয়াদ সবে সাত মাস পেরিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ: ‘শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর আরও ৩৫টি ক্যাম্প ও তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নসহ একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন ধাপে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ২০০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার নতুন এই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০০৯)।
সেনা প্রত্যাহার নিয়ে সর্বস্তরের জনগণ ও নাগরিক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। সবার কাছে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় অবস্থানরত পাঁচ ব্রিগেড থেকে প্রাথমিকভাবে মাত্র এক ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরও সেখানে যে বিপুল পরিমাণ সেনাসদস্য অবস্থান করবেন, তা দেশের যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে কয়েক গুণ। বিএনপি-জামায়াত আর কিছু বামপন্থী নামধারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এ ইস্যুতে অকারণ বিরোধিতার ধোঁয়া তুলে পরিস্থিতি বাঁকা পথে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে— এটি কোনোভাবেই পার্বত্যবাসীর জন্য মঙ্গলকর হতে পারে না। তবে যারা বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়, তাদের কথা ভিন্ন। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে বা সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এই সিদ্ধান্ত পাহাড়িদের প্রতি সরকারের আস্থার প্রতিফলন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে সরকারের প্রতিও পার্বত্য জনগণের আস্থা সৃষ্টি হবে যদি সরকার পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেখানকার লোকালয়গুলো থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
এখানে একটি কথা বলা খুবই জরুরি যে সেনা প্রত্যাহার বা সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমানোই বড় কথা নয়, পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর ‘অসীম ক্ষমতা’ সীমিত করাও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনী রয়েছে—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য যা থাকা জরুরি। পার্বত্য অঞ্চলেও সেনাবাহিনী থাকতে হবে। তবে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনী যেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করতে পারে তা নিশ্চিত করা দরকার। অপারেশন দাবানল, অপারেশন উত্তরণসহ বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। মোটকথা, তিন পার্বত্য জেলায় সিভিল প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর নিয়ন্ত্রকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমাদের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, পার্বত্য চুক্তির পর গত ১১ বছরে পার্বত্য অঞ্চলে কোনো ধরনের যুদ্ধাবস্থা নেই। দু-একটি বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র ঘটনার যে চিত্র আমরা দেখতে পাই, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম। সুতরাং পাহাড়ে সশস্ত্র অবস্থা বিরাজমান—এই অজুহাতে এখানে কোনোভাবেই অতিমাত্রায় সেনা মোতায়েত করা যুক্তিসংগত নয়। অধিক সেনা মোতায়েনের ফলে এখানে যে বিপুল টাকার অপচয় হয়, সেনা প্রত্যাহার করে সেই টাকা পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে এবং এলাকাবাসীর জীবনমানের বিকাশে ব্যয় করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে যেমন স্থিতিশীলতা আনবে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সহায়তা করবে।
২.
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮.১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে।’
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে চলেছেন। ২৯ এপ্রিল সফররত ফ্রান্সের নৌ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপে মনে হচ্ছে, সরকার সে পথেই এগোচ্ছে।
দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র আন্দোলন, রক্তক্ষয়ের পর অনেক প্রচেষ্টার ফসল পার্বত্য চুক্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর আওয়ামী লীগ সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে তারা সত্যিকারভাবে গতিশীল পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এরপর ২০০১ সালে চুক্তির বিরোধিতাকারী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে চুক্তি বাতিল না করলেও চুক্তির বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির করে রেখেছিল। দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পার্বত্য অঞ্চলে মোবাইল ফোন চালুর বিষয়টি পাহাড়িদের জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। যাঁরা আশঙ্কা করতেন, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক চালু হলে পাহাড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়বে, তাঁদের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। এবারের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও পাহাড়ে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতার পুনরাবৃত্তি করবে না বলেই আশা করা যায়। সামরিক পথে পার্বত্য সমস্যার সমাধান মিলবে না—এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে রাজনৈতিক পথেই। শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয়বারের মতো সে লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য জনপদের মানুষ তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে পুনর্বার তাদের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে এই সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে।
পার্বত্য চুক্তির পরপরই প্রতিষ্ঠিত ওই অঞ্চলের প্রধানতম রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ শুরু থেকেই পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। তারাও এখন কিছুটা নমনীয় হয়েছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ইউপিডিএফও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চাইছে। তাই সরকারের উচিৎ হবে, পার্বত্য চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।
চুক্তির অন্যতম প্রধান ও মৌলিক কাজ ভূমিবিরোধ নিরসন। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়ভিত্তিক সূচি প্রণয়ন করে তা অনুসরণ করা উচিৎ। এতে চুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত হতে পারে। এটা আশা করা খুব অমূলক হবে না যে সরকারের সদিচ্ছা লোকদেখানো না হলে এ সরকারের সময়ই পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হবে।
৩.
খুবই বিস্ময়কর ও দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের কোনো স্বীকৃতি নেই। তারা যেন ‘নিজভূমে পরবাসী’। পার্বত্য অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) কর্তৃক গণপরিষদে উত্থাপিত (১৯৭২) আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাকচ হয়ে গিয়েছিল। ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ সংবিধান প্রণেতারা এ দায় এড়াতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাও’—তাঁর এ বক্তব্যে পাহাড়িদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিপীড়নমূলক পথে অগ্রসর হননি ঠিকই, তবে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে তাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল—এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে নিয়মতান্ত্রিক সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে এম এন লারমা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ গ্রহণ করেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সরকার পাহাড়িদের দমন-পীড়নের পাশাপাশি বাঙালি পুনর্বাসনের মাধ্যমে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করার কৌশল গ্রহণ করে। প্রায় দুই দশক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি।
বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান সমস্যা ভূমিবিরোধ ও ভূমিদখল। পার্বত্য চুক্তির ১২ বছর হতে চলল, কিন্তু এখনো এ সমস্যার কোনো পরিপূর্ণ সমাধান হলো না। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ভূমিদখল এবং বহিরাগত বাঙালিদের বসতি স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়িদের ভূমিদখল বন্ধ করতে হলে এর পৃষ্ঠপোষকদেরও থামাতে হবে—এ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘উপজাতি’ শব্দটির পরিবর্তন করে তাদের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বলে অভিহিত করা হবে। ১৯৯৭ সালে সরকার পার্বত্য চুক্তির দলিলে ‘উপজাতি’ শব্দটি পরিহার করার সাহস দেখায়নি; ১২ বছরের ব্যবধানে সেই সরকারই যখন ‘উপজাতি’র পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ বা ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ শব্দ ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়, তখন তা সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষজন নিজেদের কী নামে পরিচয় দিতে আগ্রহী, সে বিষয়ে তাঁদের চিন্তাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পাহাড়ি আদিবাসী ও সমতলের আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দীর্ঘ তিন যুগ পর আবার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এই সংসদে আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে পাঁচজন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দুজন প্রতিমন্ত্রী এবং দুজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় সরকারি দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই সংগত কারণেই আমাদের প্রত্যাশা, তাঁরা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে সংসদে উত্থাপন করবেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৪তম বার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীও সংবিধানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবির প্রতি সহমত পোষণ করেছেন।
সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, পার্বত্য অঞ্চল ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য রয়েছে পৃথক বিধিবিধান। যেমন: ১৯০০ সালের শাসনবিধি ও ১৯৯৭-এর পার্বত্য চুক্তির কার্যকারিতা যেমন সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তেমনি সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য অনেক আইন-কানুনও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপযোগী নয়। তাই সংবিধানে পাহাড়ি আদিবাসী ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক বিধান রাখা অপরিহার্য।
বাঙালির পাশাপাশি দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছপা হবে না বলেই আমরা আশা করতে চাই। বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ—এই সত্যের স্বীকৃতি দিতে হবে সংবিধানসহ জীবনের সবক্ষেত্রে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
সেনা প্রত্যাহার নিয়ে সর্বস্তরের জনগণ ও নাগরিক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। সবার কাছে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় অবস্থানরত পাঁচ ব্রিগেড থেকে প্রাথমিকভাবে মাত্র এক ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরও সেখানে যে বিপুল পরিমাণ সেনাসদস্য অবস্থান করবেন, তা দেশের যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে কয়েক গুণ। বিএনপি-জামায়াত আর কিছু বামপন্থী নামধারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এ ইস্যুতে অকারণ বিরোধিতার ধোঁয়া তুলে পরিস্থিতি বাঁকা পথে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে— এটি কোনোভাবেই পার্বত্যবাসীর জন্য মঙ্গলকর হতে পারে না। তবে যারা বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়, তাদের কথা ভিন্ন। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে বা সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এই সিদ্ধান্ত পাহাড়িদের প্রতি সরকারের আস্থার প্রতিফলন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে সরকারের প্রতিও পার্বত্য জনগণের আস্থা সৃষ্টি হবে যদি সরকার পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেখানকার লোকালয়গুলো থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
এখানে একটি কথা বলা খুবই জরুরি যে সেনা প্রত্যাহার বা সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমানোই বড় কথা নয়, পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর ‘অসীম ক্ষমতা’ সীমিত করাও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনী রয়েছে—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য যা থাকা জরুরি। পার্বত্য অঞ্চলেও সেনাবাহিনী থাকতে হবে। তবে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনী যেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করতে পারে তা নিশ্চিত করা দরকার। অপারেশন দাবানল, অপারেশন উত্তরণসহ বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। মোটকথা, তিন পার্বত্য জেলায় সিভিল প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর নিয়ন্ত্রকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমাদের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, পার্বত্য চুক্তির পর গত ১১ বছরে পার্বত্য অঞ্চলে কোনো ধরনের যুদ্ধাবস্থা নেই। দু-একটি বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র ঘটনার যে চিত্র আমরা দেখতে পাই, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম। সুতরাং পাহাড়ে সশস্ত্র অবস্থা বিরাজমান—এই অজুহাতে এখানে কোনোভাবেই অতিমাত্রায় সেনা মোতায়েত করা যুক্তিসংগত নয়। অধিক সেনা মোতায়েনের ফলে এখানে যে বিপুল টাকার অপচয় হয়, সেনা প্রত্যাহার করে সেই টাকা পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে এবং এলাকাবাসীর জীবনমানের বিকাশে ব্যয় করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে যেমন স্থিতিশীলতা আনবে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সহায়তা করবে।
২.
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮.১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে।’
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে চলেছেন। ২৯ এপ্রিল সফররত ফ্রান্সের নৌ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপে মনে হচ্ছে, সরকার সে পথেই এগোচ্ছে।
দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র আন্দোলন, রক্তক্ষয়ের পর অনেক প্রচেষ্টার ফসল পার্বত্য চুক্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর আওয়ামী লীগ সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে তারা সত্যিকারভাবে গতিশীল পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এরপর ২০০১ সালে চুক্তির বিরোধিতাকারী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে চুক্তি বাতিল না করলেও চুক্তির বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির করে রেখেছিল। দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পার্বত্য অঞ্চলে মোবাইল ফোন চালুর বিষয়টি পাহাড়িদের জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। যাঁরা আশঙ্কা করতেন, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক চালু হলে পাহাড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়বে, তাঁদের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। এবারের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও পাহাড়ে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতার পুনরাবৃত্তি করবে না বলেই আশা করা যায়। সামরিক পথে পার্বত্য সমস্যার সমাধান মিলবে না—এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে রাজনৈতিক পথেই। শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয়বারের মতো সে লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য জনপদের মানুষ তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে পুনর্বার তাদের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে এই সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে।
পার্বত্য চুক্তির পরপরই প্রতিষ্ঠিত ওই অঞ্চলের প্রধানতম রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ শুরু থেকেই পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। তারাও এখন কিছুটা নমনীয় হয়েছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ইউপিডিএফও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চাইছে। তাই সরকারের উচিৎ হবে, পার্বত্য চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।
চুক্তির অন্যতম প্রধান ও মৌলিক কাজ ভূমিবিরোধ নিরসন। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়ভিত্তিক সূচি প্রণয়ন করে তা অনুসরণ করা উচিৎ। এতে চুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত হতে পারে। এটা আশা করা খুব অমূলক হবে না যে সরকারের সদিচ্ছা লোকদেখানো না হলে এ সরকারের সময়ই পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হবে।
৩.
খুবই বিস্ময়কর ও দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের কোনো স্বীকৃতি নেই। তারা যেন ‘নিজভূমে পরবাসী’। পার্বত্য অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) কর্তৃক গণপরিষদে উত্থাপিত (১৯৭২) আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাকচ হয়ে গিয়েছিল। ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ সংবিধান প্রণেতারা এ দায় এড়াতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাও’—তাঁর এ বক্তব্যে পাহাড়িদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিপীড়নমূলক পথে অগ্রসর হননি ঠিকই, তবে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে তাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল—এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে নিয়মতান্ত্রিক সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে এম এন লারমা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ গ্রহণ করেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সরকার পাহাড়িদের দমন-পীড়নের পাশাপাশি বাঙালি পুনর্বাসনের মাধ্যমে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করার কৌশল গ্রহণ করে। প্রায় দুই দশক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি।
বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান সমস্যা ভূমিবিরোধ ও ভূমিদখল। পার্বত্য চুক্তির ১২ বছর হতে চলল, কিন্তু এখনো এ সমস্যার কোনো পরিপূর্ণ সমাধান হলো না। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ভূমিদখল এবং বহিরাগত বাঙালিদের বসতি স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়িদের ভূমিদখল বন্ধ করতে হলে এর পৃষ্ঠপোষকদেরও থামাতে হবে—এ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘উপজাতি’ শব্দটির পরিবর্তন করে তাদের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বলে অভিহিত করা হবে। ১৯৯৭ সালে সরকার পার্বত্য চুক্তির দলিলে ‘উপজাতি’ শব্দটি পরিহার করার সাহস দেখায়নি; ১২ বছরের ব্যবধানে সেই সরকারই যখন ‘উপজাতি’র পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ বা ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ শব্দ ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়, তখন তা সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষজন নিজেদের কী নামে পরিচয় দিতে আগ্রহী, সে বিষয়ে তাঁদের চিন্তাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পাহাড়ি আদিবাসী ও সমতলের আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দীর্ঘ তিন যুগ পর আবার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এই সংসদে আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে পাঁচজন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দুজন প্রতিমন্ত্রী এবং দুজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় সরকারি দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই সংগত কারণেই আমাদের প্রত্যাশা, তাঁরা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে সংসদে উত্থাপন করবেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৪তম বার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীও সংবিধানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবির প্রতি সহমত পোষণ করেছেন।
সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, পার্বত্য অঞ্চল ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য রয়েছে পৃথক বিধিবিধান। যেমন: ১৯০০ সালের শাসনবিধি ও ১৯৯৭-এর পার্বত্য চুক্তির কার্যকারিতা যেমন সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তেমনি সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য অনেক আইন-কানুনও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপযোগী নয়। তাই সংবিধানে পাহাড়ি আদিবাসী ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক বিধান রাখা অপরিহার্য।
বাঙালির পাশাপাশি দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছপা হবে না বলেই আমরা আশা করতে চাই। বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ—এই সত্যের স্বীকৃতি দিতে হবে সংবিধানসহ জীবনের সবক্ষেত্রে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
No comments