মিটু’র ঢেউ গার্মেন্টেও by জেনিফার চৌধুরী
বয়স
মাত্র ১৬। নাম ডলি আক্তার। গার্মেন্টে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছে। যেখানে সে
কাজ করতো, সেখানকার উৎপাদিত পোশাক পশ্চিমা দেশগুলোতে বিক্রি হয়। কিন্তু যা
সে আশা করেনি সেটা হলো যৌন হয়রানি। তিনি তার কারখানার বিবাহিত লাইন
ম্যানেজারের যৌন নিগ্রহের কবলে পড়েন। তার জীবনের প্রথম কারখানার ম্যানেজার।
তার সঙ্গে বিছানায় যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ডলি বলেন, তখন আমি ভয়
পেয়েছিলাম। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। আরেকটি খুঁজে নেন। কিন্তু সেখানেও একই
সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অন্য কারখানার ব্যবস্থাপনাও একটা অভিশাপ। আমাকে
তা আঘাত করে। ওরা আমাদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়।
ডলি একদিন যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সিদ্ধান্ত নেন আর পিছু হটা নয়। তাকে লড়তে হবে। ডলি কারখানায় একটি ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। যাতে কর্মক্ষেত্রে তরুণীরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে। কিন্তু কারখানাটির ব্যবস্থাপনা যখন তার এই উদ্যোগের কথা জানতে পারে, তখন তার সুপারভাইজার তাকে একটা অফিসকক্ষে বন্দি করে রাখে। তাকে তার পদত্যাগপত্রে সই দিতে বাধ্য করে। কারখানা মালিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা প্রতিবাদী হবে, তখন তারা এটাও নিশ্চিত করে যে, তুমি যেখানেই যাও না কেন, তুমি অন্য কারখানায় কাজ পাবে না। ডলি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি আজ থেকে শুধু শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করব, ব্যবস্থাপনার পক্ষে আর কখনো কাজ করবো না।’
এক দশক পরে ডলি এমন একটি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছেন, যাদের কাজ হলো যৌন নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পে কর্মরত নারীদের কাছে এই সংগঠনটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় ২৫ লাখ শ্রমিক। এর অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশের ৪২শ’র বেশি কারখানায় তারা কাজ করে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে ১ হাজারের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারায়। আর তখনই বাংলাদেশ সরকার এবং পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো অঙ্গীকার করে যে, তারা কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেবে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা উন্নত করবে। কিন্তু ওই ঘটনা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ওপর তেমন আলো ফেলেনি। নারী শ্রমিকরা আগের মতোই বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে চলছেন। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, কর্মরত নারী গার্মেন্টস কর্মীদের ৮০ ভাগই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কমসংখ্যকই যৌন নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে কোথাও রিপোর্ট করেছে। ডলি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোতে নারীর প্রতিনিধিত্ব লঘু। নারীরা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। কিন্তু তারা সাধারণত সেটা গোপন করে। তারা সেটা প্রকাশ করতে অপারগ থাকে। ২০১৫ সালের মধ্যে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে ডলি পরিচিতি পান। এটা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন।
কুড়ি বছর বয়স্ক হাফসা বেগম তাদেরই একজন, যারা সাহায্য চেয়েছেন ডলির কাছে। হাফসা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল রাজধানী ঢাকায় গত মে মাসে। তিনি রাত্রিকালীন শিফটের কাজ শেষ করেছিলেন। বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর সামনে ছিল ঈদের ছুটি। হাফসা বেগম বলেছেন, আমি সেদিন অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করি। আর সন্ধ্যার পর থেকে কাজের গতি কমতে থাকে। কারখানা থেকে বেরুতে অন্যান্য মেয়েরা আমাকে একটু পেছনে রেখে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই লাইন ম্যানেজার সেই সুযোগটি নেয়। ‘আমি তাকে লাথি মারি। থাপ্পড় দেই। কিন্তু তারপরও সে আমাকে একটা অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আর সেটা ছিল কারখানার কাছেই। সে আমাকে জোরপূর্বক চুমু দেয় এবং তাকে স্পর্শ করে। লাইন ম্যানেজার তার উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘আমি না তোমাকে বলেছি, তুমি আমার হতে যাচ্ছ।’
সাত মাস ধরে হাফসা বেগম ওই কারখানায় কাজ করছিল। জুনিয়র মেশিন অপারেটরদের উপরে ওই লাইন ম্যানেজারের অনেক ক্ষমতা। ম্যানেজার আমাকে বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে শুতে যেতে হবে। আমি তখন বলেছি, যাব না। আর তখন সে আমার জীবনকে দোজখে পরিণত করে।’ লাইন ম্যানেজারকে যত শক্তি দিয়ে সে বাধা দিয়েছে, ততই তার প্রতি হুমকি বেড়ে গেছে। সে আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছে। ম্যানেজার তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, যদি তার সঙ্গে সে বিছানায় যেতে না চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই চাকরি হারাতে হবে। হাফসা বলেন, ‘পরদিন সকালে কাজে যাইনি। আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না আমাকে কি করতে হবে। আর তখনই আমার মনে পড়ে ডলির কথা। অনেকেই জানেন তিনি একজন ইউনিয়ন সংগঠক। যারাই কারখানায় যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তারা তার সাহায্য পেয়েছে।’
ডলি বিষয়টি স্থানীয় শিল্প পুলিশকে অবহিত করেন। তার পরিচিতদের নজরে আনেন। এবং সেই কারখানায় ব্যক্তিগতভাবে হাজির হন। আর কয়েক ঘণ্টার আলোচনা শেষে ওই লাইন ম্যানেজারকে চাকরিচ্যুত করাতে সক্ষম হন। তার প্রতি হুমকি আসতে থাকে। তাকে তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে হয়। রাজধানীর অন্য একটি প্রান্তে তাকে ঠাঁই নিতে বাধ্য করা হয়।
‘‘এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। আমি যেসব মেয়েদের যৌন নিগ্রহ থেকে রক্ষা করেছি তারা এখনো বিপদমুক্ত নয়। নিজেকে ভালো রাখার বিনিময়ে তাদের বহু কিছু উৎসর্গ করতে হয়। তাদের ভয়ের মধ্যে কাটাতে হয়। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক লজ্জা আর প্রতিশোধস্পৃহা বাংলাদেশের গার্মেন্ট কর্মীদের যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অসহায় করে রাখছে। তাদের নীরব রাখছে।’’ মন্তব্য করেছেন অরুনা কাশ্যপ। তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নারী-অধিকার বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী। কাশ্যপ বলেছেন যদি গার্মেন্টকর্মীরা তাদের যৌন হয়রানি প্রকাশ করার জন্য প্রতিশোধের মুখে না পড়তেন, তাহলে অনেকেই চিৎকার করতেন। তাদের ফুসফুসের গভীরে মিটু।’’ ২০১৭ সালের রিপোর্টে অরুনা এই মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টকর্মীরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি সংকটেরই একটি অংশ। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বলে কম আলোচিত কিন্তু এইসব ঘটনা যা ঘটছে তা অবশ্যই হলিউড, মিডিয়া বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট হাইপ্রোফাইল সব ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৮ সালের মে মাসের কথা। এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স এবং গ্লোবাল লেবার জাস্টিস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, উল্লেখযোগ্য ব্রান্ডের এশীয় সাপ্লাই চেইনে বিরাট রকম যৌন সহিংসতা চলছে। কোম্পানিগুলো বলেছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু অরুনা দাবি করেছেন, ব্র্যান্ডগুলো যদিও তদন্তের কথা বলছে। বলছে কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা রোধে তারা ব্যাপক পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু তারা আসলে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটা যদি সফল করে তুলতে হয়, তাহলে তাদেরকে ব্যবস্থাপনা কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে।
সাপ্লাই চেইনগুলোর ওপর মনিটরিং বাড়াতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির দিকে তাদের নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিষয়ে রাজনৈতিক আগ্রহ ও উদ্বেগ সামান্য। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই গাইডলাইন অনুসারে নারীরা অভিযোগ করতে পারেন, এমন প্রক্রিয়া বা এমন জায়গা এখনো কম।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গার্মেন্ট শিল্প অন্যতম বৃহত্তম অবদান রেখে যাচ্ছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের বার্ষিক রাজস্বের ৮০ ভাগের বেশি এসেছে গার্মেন্ট থেকে। অথচ কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি বন্ধে বা তা স্বীকার করতে রাজনৈতিক ইচ্ছা বা অর্থনৈতিক কোনো প্রণোদনা একদম দেখা যায় না। কারখানার মালিকরা অভিজ্ঞ ম্যানেজারকে স্বপদে বহাল রাখতে আগ্রহী। কারণ ওই সব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। কিন্তু মেশিন অপারেটর কিংবা শ্রমিকদের তারা সহজেই পরিবর্তন করতে পারে। গত ১৬ই মার্চ একটি কারখানার সামনে নারীকর্মীরা অনশন ধর্মঘটে গিয়েছিল। একজন সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তারা যৌন হয়রানির অভিযোগে সোচ্চার হয়। ওই ঘটনায় ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হন। যদিও কারখানাটি দাবি করেছে যে, ম্যানেজারকে তারা চাকরিচ্যুত করেছে। কিন্তু কারখানার শ্রমিকরা সে কথা মানতে নারাজ। সংশ্লিষ্ট প্রতিবাদী নারী বলেছেন, এটা এমন কোনো গুরুতর পদক্ষেপ নয়। কিন্তু ভিকটিমসহ আরো ১৬ জন প্রতিবাদকারীকে তারা চাকরিচ্যুত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তারা কর্মক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। তাদের এমনকি মজুরিও শোধ করা হয়নি। নারী শ্রমিকরা কোনো পুলিশ রিপোর্ট করেননি। তার কারণ প্রতিশোধের ভয়ে তারা মামলার পথে যান নি। ডলি বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি নারী শ্রমিক নির্ভর। অথচ আমরা এসব থেকে রক্ষা পাই না।
গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়াদের কয়েকজনের সঙ্গে ডলি যুক্ত থেকেছেন। ভিকটিমদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় তিনি গোপনে দেখা করেছেন। যাতে গার্মেন্ট কমিউনিটির অন্যান্য লোকেরা বিষয়টি না জানতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করা ছাড়া ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে কার্যকর কিছু সাহায্য দেয়া সত্যিই কঠিন। নারীরা মুখ খুলে তাদের সম্মান হারাতে নারাজ। আমি সর্বদাই সুপারিশ করি, তাদের উচিত পুলিশের কাছে যাওয়া। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তারা এতে সম্মতি দিয়ে থাকে। আর সে কারণে আমি বেশিরভাগ সময় যেটা করি, যাতে দুষ্কৃতকারীরা চাকরি হারায়, সেই ব্যবস্থা করি। ডলি সীমিতভাবে হলেও যাতে নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটে সে জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। ইউনিয়নে যোগ দিতে বলেন। শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা এবং ইউনিয়ন গঠনের বিষয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে তাদের শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন।
যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া নারীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রভাব ডলির পারিবারিক জীবনে পড়েছে। ‘‘আমি আমার ছেলের সঙ্গে মাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনি। কারণ বেশিরভাগ সময় সে গ্রামে আমার মায়ের সঙ্গে থেকেছে। ছুটির দিনগুলোতে সে যখন আমার কাছে আসে, তখনই আমি তাকে দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের মা-ছেলে সম্পর্কে টানাপড়েন রয়েছে। আমরা পরস্পরকে কমই জানতে পারি। কিছুদিন আগে এক মধ্যরাতে আমি একটি ফোন কল পাই। এক লোক আমাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, আমি যেন মেয়েদের ‘নোংরা বিষয়গুলো’ নিয়ে তাদেরকে উস্কানি দেয়া থেকে বিরত থাকি। আমি তার সঙ্গে সাহসের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু সত্যটা এই যে আমি জানি, নারী এবং তরুণীরা তাদের নিজ নিজ কারখানায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে তারা প্রতিবাদী হতে পারে না। কারণ প্রতিবাদী হওয়া তাদের জন্য বেশ ভয়ঙ্কর। (দি গার্ডিয়ানে ১০ই সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনের তরজমা)
ডলি একদিন যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সিদ্ধান্ত নেন আর পিছু হটা নয়। তাকে লড়তে হবে। ডলি কারখানায় একটি ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। যাতে কর্মক্ষেত্রে তরুণীরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে। কিন্তু কারখানাটির ব্যবস্থাপনা যখন তার এই উদ্যোগের কথা জানতে পারে, তখন তার সুপারভাইজার তাকে একটা অফিসকক্ষে বন্দি করে রাখে। তাকে তার পদত্যাগপত্রে সই দিতে বাধ্য করে। কারখানা মালিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা প্রতিবাদী হবে, তখন তারা এটাও নিশ্চিত করে যে, তুমি যেখানেই যাও না কেন, তুমি অন্য কারখানায় কাজ পাবে না। ডলি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি আজ থেকে শুধু শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করব, ব্যবস্থাপনার পক্ষে আর কখনো কাজ করবো না।’
এক দশক পরে ডলি এমন একটি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছেন, যাদের কাজ হলো যৌন নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পে কর্মরত নারীদের কাছে এই সংগঠনটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় ২৫ লাখ শ্রমিক। এর অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশের ৪২শ’র বেশি কারখানায় তারা কাজ করে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে ১ হাজারের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারায়। আর তখনই বাংলাদেশ সরকার এবং পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো অঙ্গীকার করে যে, তারা কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেবে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা উন্নত করবে। কিন্তু ওই ঘটনা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ওপর তেমন আলো ফেলেনি। নারী শ্রমিকরা আগের মতোই বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে চলছেন। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, কর্মরত নারী গার্মেন্টস কর্মীদের ৮০ ভাগই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কমসংখ্যকই যৌন নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে কোথাও রিপোর্ট করেছে। ডলি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোতে নারীর প্রতিনিধিত্ব লঘু। নারীরা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। কিন্তু তারা সাধারণত সেটা গোপন করে। তারা সেটা প্রকাশ করতে অপারগ থাকে। ২০১৫ সালের মধ্যে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে ডলি পরিচিতি পান। এটা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন।
কুড়ি বছর বয়স্ক হাফসা বেগম তাদেরই একজন, যারা সাহায্য চেয়েছেন ডলির কাছে। হাফসা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল রাজধানী ঢাকায় গত মে মাসে। তিনি রাত্রিকালীন শিফটের কাজ শেষ করেছিলেন। বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর সামনে ছিল ঈদের ছুটি। হাফসা বেগম বলেছেন, আমি সেদিন অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করি। আর সন্ধ্যার পর থেকে কাজের গতি কমতে থাকে। কারখানা থেকে বেরুতে অন্যান্য মেয়েরা আমাকে একটু পেছনে রেখে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই লাইন ম্যানেজার সেই সুযোগটি নেয়। ‘আমি তাকে লাথি মারি। থাপ্পড় দেই। কিন্তু তারপরও সে আমাকে একটা অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আর সেটা ছিল কারখানার কাছেই। সে আমাকে জোরপূর্বক চুমু দেয় এবং তাকে স্পর্শ করে। লাইন ম্যানেজার তার উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘আমি না তোমাকে বলেছি, তুমি আমার হতে যাচ্ছ।’
সাত মাস ধরে হাফসা বেগম ওই কারখানায় কাজ করছিল। জুনিয়র মেশিন অপারেটরদের উপরে ওই লাইন ম্যানেজারের অনেক ক্ষমতা। ম্যানেজার আমাকে বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে শুতে যেতে হবে। আমি তখন বলেছি, যাব না। আর তখন সে আমার জীবনকে দোজখে পরিণত করে।’ লাইন ম্যানেজারকে যত শক্তি দিয়ে সে বাধা দিয়েছে, ততই তার প্রতি হুমকি বেড়ে গেছে। সে আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছে। ম্যানেজার তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, যদি তার সঙ্গে সে বিছানায় যেতে না চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই চাকরি হারাতে হবে। হাফসা বলেন, ‘পরদিন সকালে কাজে যাইনি। আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না আমাকে কি করতে হবে। আর তখনই আমার মনে পড়ে ডলির কথা। অনেকেই জানেন তিনি একজন ইউনিয়ন সংগঠক। যারাই কারখানায় যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তারা তার সাহায্য পেয়েছে।’
ডলি বিষয়টি স্থানীয় শিল্প পুলিশকে অবহিত করেন। তার পরিচিতদের নজরে আনেন। এবং সেই কারখানায় ব্যক্তিগতভাবে হাজির হন। আর কয়েক ঘণ্টার আলোচনা শেষে ওই লাইন ম্যানেজারকে চাকরিচ্যুত করাতে সক্ষম হন। তার প্রতি হুমকি আসতে থাকে। তাকে তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে হয়। রাজধানীর অন্য একটি প্রান্তে তাকে ঠাঁই নিতে বাধ্য করা হয়।
‘‘এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। আমি যেসব মেয়েদের যৌন নিগ্রহ থেকে রক্ষা করেছি তারা এখনো বিপদমুক্ত নয়। নিজেকে ভালো রাখার বিনিময়ে তাদের বহু কিছু উৎসর্গ করতে হয়। তাদের ভয়ের মধ্যে কাটাতে হয়। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক লজ্জা আর প্রতিশোধস্পৃহা বাংলাদেশের গার্মেন্ট কর্মীদের যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অসহায় করে রাখছে। তাদের নীরব রাখছে।’’ মন্তব্য করেছেন অরুনা কাশ্যপ। তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নারী-অধিকার বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী। কাশ্যপ বলেছেন যদি গার্মেন্টকর্মীরা তাদের যৌন হয়রানি প্রকাশ করার জন্য প্রতিশোধের মুখে না পড়তেন, তাহলে অনেকেই চিৎকার করতেন। তাদের ফুসফুসের গভীরে মিটু।’’ ২০১৭ সালের রিপোর্টে অরুনা এই মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টকর্মীরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি সংকটেরই একটি অংশ। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বলে কম আলোচিত কিন্তু এইসব ঘটনা যা ঘটছে তা অবশ্যই হলিউড, মিডিয়া বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট হাইপ্রোফাইল সব ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৮ সালের মে মাসের কথা। এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স এবং গ্লোবাল লেবার জাস্টিস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, উল্লেখযোগ্য ব্রান্ডের এশীয় সাপ্লাই চেইনে বিরাট রকম যৌন সহিংসতা চলছে। কোম্পানিগুলো বলেছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু অরুনা দাবি করেছেন, ব্র্যান্ডগুলো যদিও তদন্তের কথা বলছে। বলছে কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা রোধে তারা ব্যাপক পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু তারা আসলে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটা যদি সফল করে তুলতে হয়, তাহলে তাদেরকে ব্যবস্থাপনা কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে।
সাপ্লাই চেইনগুলোর ওপর মনিটরিং বাড়াতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির দিকে তাদের নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিষয়ে রাজনৈতিক আগ্রহ ও উদ্বেগ সামান্য। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই গাইডলাইন অনুসারে নারীরা অভিযোগ করতে পারেন, এমন প্রক্রিয়া বা এমন জায়গা এখনো কম।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গার্মেন্ট শিল্প অন্যতম বৃহত্তম অবদান রেখে যাচ্ছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের বার্ষিক রাজস্বের ৮০ ভাগের বেশি এসেছে গার্মেন্ট থেকে। অথচ কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি বন্ধে বা তা স্বীকার করতে রাজনৈতিক ইচ্ছা বা অর্থনৈতিক কোনো প্রণোদনা একদম দেখা যায় না। কারখানার মালিকরা অভিজ্ঞ ম্যানেজারকে স্বপদে বহাল রাখতে আগ্রহী। কারণ ওই সব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। কিন্তু মেশিন অপারেটর কিংবা শ্রমিকদের তারা সহজেই পরিবর্তন করতে পারে। গত ১৬ই মার্চ একটি কারখানার সামনে নারীকর্মীরা অনশন ধর্মঘটে গিয়েছিল। একজন সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তারা যৌন হয়রানির অভিযোগে সোচ্চার হয়। ওই ঘটনায় ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হন। যদিও কারখানাটি দাবি করেছে যে, ম্যানেজারকে তারা চাকরিচ্যুত করেছে। কিন্তু কারখানার শ্রমিকরা সে কথা মানতে নারাজ। সংশ্লিষ্ট প্রতিবাদী নারী বলেছেন, এটা এমন কোনো গুরুতর পদক্ষেপ নয়। কিন্তু ভিকটিমসহ আরো ১৬ জন প্রতিবাদকারীকে তারা চাকরিচ্যুত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তারা কর্মক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। তাদের এমনকি মজুরিও শোধ করা হয়নি। নারী শ্রমিকরা কোনো পুলিশ রিপোর্ট করেননি। তার কারণ প্রতিশোধের ভয়ে তারা মামলার পথে যান নি। ডলি বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি নারী শ্রমিক নির্ভর। অথচ আমরা এসব থেকে রক্ষা পাই না।
গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়াদের কয়েকজনের সঙ্গে ডলি যুক্ত থেকেছেন। ভিকটিমদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় তিনি গোপনে দেখা করেছেন। যাতে গার্মেন্ট কমিউনিটির অন্যান্য লোকেরা বিষয়টি না জানতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করা ছাড়া ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে কার্যকর কিছু সাহায্য দেয়া সত্যিই কঠিন। নারীরা মুখ খুলে তাদের সম্মান হারাতে নারাজ। আমি সর্বদাই সুপারিশ করি, তাদের উচিত পুলিশের কাছে যাওয়া। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তারা এতে সম্মতি দিয়ে থাকে। আর সে কারণে আমি বেশিরভাগ সময় যেটা করি, যাতে দুষ্কৃতকারীরা চাকরি হারায়, সেই ব্যবস্থা করি। ডলি সীমিতভাবে হলেও যাতে নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটে সে জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। ইউনিয়নে যোগ দিতে বলেন। শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা এবং ইউনিয়ন গঠনের বিষয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে তাদের শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন।
যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া নারীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রভাব ডলির পারিবারিক জীবনে পড়েছে। ‘‘আমি আমার ছেলের সঙ্গে মাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনি। কারণ বেশিরভাগ সময় সে গ্রামে আমার মায়ের সঙ্গে থেকেছে। ছুটির দিনগুলোতে সে যখন আমার কাছে আসে, তখনই আমি তাকে দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের মা-ছেলে সম্পর্কে টানাপড়েন রয়েছে। আমরা পরস্পরকে কমই জানতে পারি। কিছুদিন আগে এক মধ্যরাতে আমি একটি ফোন কল পাই। এক লোক আমাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, আমি যেন মেয়েদের ‘নোংরা বিষয়গুলো’ নিয়ে তাদেরকে উস্কানি দেয়া থেকে বিরত থাকি। আমি তার সঙ্গে সাহসের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু সত্যটা এই যে আমি জানি, নারী এবং তরুণীরা তাদের নিজ নিজ কারখানায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে তারা প্রতিবাদী হতে পারে না। কারণ প্রতিবাদী হওয়া তাদের জন্য বেশ ভয়ঙ্কর। (দি গার্ডিয়ানে ১০ই সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনের তরজমা)
No comments