জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে অভিবাসন সংকট বাড়িয়ে তুলছে যেভাবে by সুসানাহ স্যাভেজ
বাংলাদেশ
যখন আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের ধকল কাটিয়ে উঠছে, তখন দেশটিতে অভ্যন্তরীণভাবে
অভিবাসন সংকট (ইন্টারন্যাল মাইগ্রেশন ক্রাইসিস) আরো ঘণীভূত হচ্ছে। জলবায়ু
পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় যেসব দেশ আছে তার অন্যতম এটি।
গত মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানে ভারতের পূর্বাঞ্চলে। গতিপথ পরিবর্তন করে তা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসার আগে কমপক্ষে ৪২ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে এতে প্রায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন। আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় এই ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কম।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ড. সলিমুল হক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পূর্বমুখী হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। এ সময় তা শক্তি হারিয়েছিল। ফলে সৌভাগ্য ও বাংলাদেশের পূর্বপ্রস্তুতিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিনি বলেন, আমি বলবো অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় উন্নত অবস্থায় রয়েছি আমরা। আমরা জীবন রক্ষায় খুবই দক্ষ। কিন্তু আমরা যেটা থামাতে পারি না, তাহলো ক্ষয়ক্ষতি। এটা এড়ানো যায় না। জীবিকা হারানো ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ায় ক্ষতিকর প্রভাব বিপুল।
সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ হাজার বাড়িঘর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অংশের চাঁদপুরে কমপক্ষে ১০০ মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের মতে, সবচেয়ে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার মধ্যে রয়েছেন কৃষক। প্রায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমি বন্যাকবলিত হয়েছে। ১৮০০ হেক্টর জমির শস্য নষ্ট হয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষতি কাটিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু বাকিগুলোর রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার স্থায়িত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলকে তছনছ করে দেয়। এতে মারা যান প্রায় ১৫০০০ মানুষ। হাজার হাজার পরিবার হয় গৃহহীন। যারা বেঁচে গিয়েছেন তাদের সামনে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
১০ বছরেরও বেশি সময় পরে, সেই বাড়িছাড়ার ধারা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বরিশাল থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের তালতলী উপজেলায় বসবাসকারী ২৫ বছর বয়সী শাহজালাল মিয়ারকে ২০১৭ সালে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন কৃষিশ্রমিক। শাহজালাল বলেন, আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। মাত্র তিন মাস কাজ করতে পারতাম। বছরের বাকি ৯ মাস আমার হাতে কোনোই কাজ থাকতো না।
শাহজালাল ও তার পরিবারের আছে ছোট্ট একখণ্ড জমি। সেখানে তারা ধান চাষ করতেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিডর শুধু বাড়িঘর আর ফসলের ক্ষতি করেনি, একই সঙ্গে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে কৃষিজমিতে। এতে তাদের কৃষিজমি লবণে সয়লাব হয়ে যায়।
এমনকি আজও, সেই জমিতে এতটাই লবণ যে, স্থানীয় কৃষকরা তাতে ধান বা অন্য শস্য চাষ করতে পারছেন না। টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে টেনে তোলা পানি এবং নদীর পানিতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার লবণাক্ততা।
শাহজালাল বলেন, পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণ। এর ফলে জমিতে কিছু উৎপাদন করা বাস্তবেই খুব অসম্ভব। যদি মিষ্টি পানি হতো তাহলে জমিতে আমার ফসল চাষ করা সম্ভব হতো। অন্যান্য কৃষিকাজ সম্ভব হতো। কিন্তু এত বেশি লবণ থাকায় কৃষকরা বছরে মাত্র একবার ফসল তুলতে পারেন ঘরে। আগে তারা বছরে দুবার বা তিনবারও ফসল ঘরে তুলতেন।
শাহজালাল সম্পদশালী পরিবারগুলোর জন্য দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু তাতে জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে শাহজালাল ও তার স্ত্রী গ্রাম ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প খুঁজে পাননি।
তাদের এই কাহিনী খুব বেশি অভিন্ন বা কমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্স ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুগুলোর কারণে লাখ লাখ বাংলাদেশি তাদের গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ড. হকের অনুমান, আগামী এক দশকের মধ্যে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি তাদের জীবিকা হারাবেন।
প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় অন্যতম। এর ফলে অভ্যন্তরীণভাবে মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। এ ছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন, বন্যা, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে তীব্র খরা ও পানির সংকট।
জাতিসংঘের ইন্টারন্যাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার থেকে প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত বিষয়ক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশ হলো বন্যার কারণে তৃতীয় বৃহৎ বাস্তুচ্যুত দেশের ঝুঁকিতে। জেনেভা ভিত্তিক আইডিএমসির পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাল বলেন, বাস্তুচ্যুত হওয়া এসব মানুষের সংখ্যায় সবাইকে আনা যায়নি। কারণ, ধীরগতিতে অনেক বিপর্যয় ঘটছে, যার ওপর নজরদারি করা খুব কঠিন। তিনি আরো বলেন, আমি যখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সফর করেছি, তখন প্রত্যক্ষ করেছি উপকূলে কি ভয়াবহ ভাঙন চলছে। তা দেখে হতাশ হয়েছি। ভোলায় আক্ষরিক অর্থেই জমিগুলো চলে যাচ্ছে পানির নিচে।
বাস্তুচ্যুতদের বেশির ভাগই গিয়ে ওঠেন রাজধানী ঢাকায়। এখানে বেশির ভাগই অবস্থান করেন বস্তি এলাকায়। ভোলা জেলা থেকে গত কয়েক দশকে এত বেশি মানুষ ঢাকায় স্থানান্তর হয়েছেন যে, ঢাকায় একটি বস্তির নামকরণই হয়ে গেছে ‘ভোলা’। তবে সবাই যে রাজধানীতে যাচ্ছেন এমন না। রাজধানীর পরিবর্তে শাহজালাল বেছে নিয়েছেন বরিশালকে। এটি তার গ্রাম থেকে কম দূরত্বের বড় শহর। তিনি বলেন, আমার গ্রামের বহু মানুষ কাজের জন্য বরিশাল এসেছেন। আমার স্ত্রী বা সন্তানদের রেখে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে যেতে চাই না। এখানে তাদেরকে নিয়ে বসবাস করছি।
শহরে জীবন সবসময় সহজ নয়। শাহজালালের স্ত্রী নাদিরা বেগম প্রথম যখন অন্তঃসত্ত্বা হন তখনকার কথা বলছিলেন তিনি। নাদিরা বলেন, বরিশালে আমরা প্রথমে যে বস্তিতে উঠেছিলাম তা ছিল নোংরা। সেখানে পরিষ্কার পানি ও টয়লেট ছিল না। আমরা দেখেছি সেখানে কীভাবে অন্য শিশুরা বেড়ে উঠছে। কি নোংরা সেই বস্তি। তাই আমরা চাইনি আমাদের সন্তান সেই পরিবেশে বড় হয়ে উঠুক।
শাহজালাল দম্পতির মেয়ে হালিফার বয়স এখন ৫ মাস। তার জন্মের আগেই এই দম্পতি চলে যান নামারচর বস্তিতে। এই বস্তিটি একটি নদীর পাড়ে। ফলে টাটকা বাতাস পাওয়া যায়। নাদিরার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা এখন টয়লেট ও পানির সুবিধা পান। তারা যে ঘরে বসবাস করেন তা থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে চকচকে পরিষ্কার টয়লেটের একটি ব্লক। এটি স্থাপন করেছে একটি দাতব্য সংস্থা ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর। এই ব্লকে রয়েছে পানি ধরে রাখার ট্যাংক ও পাম্প। ফলে অন্য বস্তিগুলোর মতো না হয়ে, এখানকার ল্যাট্রিনগুলো পরিষ্কার রাখা খুব সহজ। আটটি পরিবার সেখানে দুটি টয়লেট ও একটি বেসিন ব্যবহার করে। এর বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। নাদিরা বলেন, আমরা আগে যেখানে বসবাস করতাম তার চেয়ে এখানে জীবন অনেক উন্নত।
বাংলাদেশে বস্তিবাসীদের তুলনায় তারা খুবই সৌভাগ্যবান। বেশির ভাগ বস্তি শুধু যে অধিকসংখ্যক মানুষে গাদাগাদি শুধু তাই নয়, পুরো একটি পরিবার বসবাস করে একটি রুমে। তারা সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটির সেবা ঠিক মতো পায় না। এসব প্রতিষ্ঠান তাদেরকে পানি সরবরাহ দিতে অথবা বর্জ্য অপসারণের মতো সেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। এমন অবস্থায় বসবাসকারী বস্তিবাসীরা এমনিতেই অসুস্থতায় ভোগে। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগে বেশি ভোগেন তারা।
ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবদুস শাহিন বলেছেন, নাজুক পয়ঃনিষ্কাশন এসব পরিবার ও ব্যক্তিবিশেষের জীবনে করুণ পরিণতি বয়ে আনে। তিনি বলেন, যদি একজন রিকশাচালক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি এক বা দুই দিন কাজে যেতে না পারেন, তাহলে এতে তাদের বড় একটি ক্ষতি হয়। যদি একজন গার্মেন্ট শ্রমিক সাতদিন অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তার কর্তৃপক্ষ তার পরিবর্তে অন্যলোক নিয়ে নেবে। ওই শ্রমিক কাজ হারাবেন।
বাংলাদেশের চারটি শহরে, এশিয়ার অন্যান্য শহরে এবং আফ্রিকায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর। তাদের মতো বেসরকারি সংগঠনগুলো পয়ঃনিষ্কাশনের বিষয়ে যে গ্যাপ আছে তা পূরণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে, যদিও এ সমস্যাটি অনেক বড়। আবদুস শাহিন বলেন, অধিক থেকে অধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে। এর নেপথ্যের কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তনে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমার আশঙ্কা, এ জন্য বস্তি পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। তাই শুধু অভ্যন্তরীণ অভিবাসন সংকট শুধু তারাই মোকাবিলা করছে একা এমন নয়।
গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টের মতে, ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণ এমন নতুন উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ। এ যাবৎকালের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর মধ্যে এক কোটি ৭২ লাখ মানুষ ঝড়, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিপর্যয়ের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বাকি এক কোটি ৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন যুদ্ধ ও সহিংসতার কারণে। অভ্যন্তরীণভাবে এভাবে সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন তাদের শেষ আশ্রয় হয় শহর এলাকা। এ কথা বলেছেন আইডিএমসির পরিচালক মিসেস বিলাক। তিনি বলেন, যেকোনো শহরে যদি দলে দলে বাস্তুচ্যুত মানুষ এসে আশ্রয় নিতে থাকে তাহলে তাতে অপরিহার্যভাবে স্থানীয় সরকারের ওপর চাপ পড়ে। তাদেরকে আশ্রয় দেয়া এবং তাদেরকে সমাজে মানিয়ে নেয়াটা নির্ভর করে সম্পদের ওপর। এমন সংকট বেশি যেখানে দেশগুলো গরিব। তাদের সামনে চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি।
গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য শুধু জলবায়ু সম্পর্কিত বিপর্যয়ই একমাত্র কারণ নয়, এতে শহরের ওপরও চাপ পড়ছে। বিশ্বে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিপর্যয়ের কারণে তাই শহরগুলো ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে মানুষ বাস্তুহারা হওয়ার কারণে।
এ বছর বাস্তুচ্যুত মানুষের শহরমুখী প্রবণতা নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে জাতিসংঘ। তাতে দেখা গেছে, বন্যার কারণে প্রতি বছর সারা বিশ্বে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বসবাস করেন শহর অথবা আধা শহর এলাকায়। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে নগরায়ন। তাই এখানে এই ঝুঁকি শতকরা ৯০ ভাগ।
মিসেস বিলাক বলেন, বস্তিতে বসবাসকারী মানুষ, যারা বাস্তুচ্যুত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তারা বাস্তুচ্যুত হবে নিরাপত্তাহীন অবকাঠামো, আবাসনে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর সেটিং, সম্পদের অভাব, অসুস্থতায় বিপন্ন হওয়া ও উৎখাতের মতো ঘটনায়। মিসেস বিলাক বলেন, অবশ্যই এদের অনেকেই তাদের শহরের এসব আবাসন থেকে সরে যেতে বাধ্য হবেন। এটা হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তুচ্যুতি।
গ্রামে যারা রয়ে যাবেন, তাদের কাছে পরিস্থিতি ফুলের বিছানা নয়। শাহজালালের গ্রামে যাওয়ার রাস্তা মাঠের ভিতর দিয়ে গিয়েছে মাইলের পর মাইল। সেখানে চারদিকে সব কিছু ফাঁকা।
শাহজালাল বলেন, এই ক্ষেতগুলোতে ধান চাষ হতো। আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন দেখেছি সারা মাঠে কৃষক। এখন আপনি দেখবেন এখানে কেউ নেই।
অদ্ভুতভাবে গ্রামও নীরব। শাহজালালের পরিবারের পুরনো প্রজন্মের কেউ কেউ রয়েছেন গ্রামে। তার মধ্যে আছেন তার পিতা, মামা ও চাচা। তাদের মতে, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সেখানে বসবাসকারীদের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে। শাহজালালের চাচা বলেন, যুবকরা সবাই গ্রাম ছেড়ে গেছে কাজ খুঁজে পেতে। কেউ কেউ তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যায়। আবার কখনো তাদেরকে বাড়িতে রেখে যায়।
তবে ব্যতিক্রম শাহজালালের ভাই মোহাম্মদ সাইদুলের ক্ষেত্রে। তিনি তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার বয়স ২৭ বছর। তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন কাজের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি ও তার পরিবার চিংড়ি ও অন্য মাছের চাষ করেন। কিন্তু ধান চাষের চেয়ে মাছ চাষে অনেক কম লাভ বলে জানান তিনি। সাইদুল বলেন, আমরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করি। কিন্তু আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে চাই না। কারণ, এই বাড়ি আমার।
(লন্ডনের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
গত মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানে ভারতের পূর্বাঞ্চলে। গতিপথ পরিবর্তন করে তা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসার আগে কমপক্ষে ৪২ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে এতে প্রায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন। আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় এই ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কম।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ড. সলিমুল হক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পূর্বমুখী হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। এ সময় তা শক্তি হারিয়েছিল। ফলে সৌভাগ্য ও বাংলাদেশের পূর্বপ্রস্তুতিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিনি বলেন, আমি বলবো অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় উন্নত অবস্থায় রয়েছি আমরা। আমরা জীবন রক্ষায় খুবই দক্ষ। কিন্তু আমরা যেটা থামাতে পারি না, তাহলো ক্ষয়ক্ষতি। এটা এড়ানো যায় না। জীবিকা হারানো ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ায় ক্ষতিকর প্রভাব বিপুল।
সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ হাজার বাড়িঘর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অংশের চাঁদপুরে কমপক্ষে ১০০ মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের মতে, সবচেয়ে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার মধ্যে রয়েছেন কৃষক। প্রায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমি বন্যাকবলিত হয়েছে। ১৮০০ হেক্টর জমির শস্য নষ্ট হয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষতি কাটিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু বাকিগুলোর রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার স্থায়িত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলকে তছনছ করে দেয়। এতে মারা যান প্রায় ১৫০০০ মানুষ। হাজার হাজার পরিবার হয় গৃহহীন। যারা বেঁচে গিয়েছেন তাদের সামনে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
১০ বছরেরও বেশি সময় পরে, সেই বাড়িছাড়ার ধারা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বরিশাল থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের তালতলী উপজেলায় বসবাসকারী ২৫ বছর বয়সী শাহজালাল মিয়ারকে ২০১৭ সালে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন কৃষিশ্রমিক। শাহজালাল বলেন, আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। মাত্র তিন মাস কাজ করতে পারতাম। বছরের বাকি ৯ মাস আমার হাতে কোনোই কাজ থাকতো না।
শাহজালাল ও তার পরিবারের আছে ছোট্ট একখণ্ড জমি। সেখানে তারা ধান চাষ করতেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিডর শুধু বাড়িঘর আর ফসলের ক্ষতি করেনি, একই সঙ্গে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে কৃষিজমিতে। এতে তাদের কৃষিজমি লবণে সয়লাব হয়ে যায়।
এমনকি আজও, সেই জমিতে এতটাই লবণ যে, স্থানীয় কৃষকরা তাতে ধান বা অন্য শস্য চাষ করতে পারছেন না। টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে টেনে তোলা পানি এবং নদীর পানিতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার লবণাক্ততা।
শাহজালাল বলেন, পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণ। এর ফলে জমিতে কিছু উৎপাদন করা বাস্তবেই খুব অসম্ভব। যদি মিষ্টি পানি হতো তাহলে জমিতে আমার ফসল চাষ করা সম্ভব হতো। অন্যান্য কৃষিকাজ সম্ভব হতো। কিন্তু এত বেশি লবণ থাকায় কৃষকরা বছরে মাত্র একবার ফসল তুলতে পারেন ঘরে। আগে তারা বছরে দুবার বা তিনবারও ফসল ঘরে তুলতেন।
শাহজালাল সম্পদশালী পরিবারগুলোর জন্য দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু তাতে জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে শাহজালাল ও তার স্ত্রী গ্রাম ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প খুঁজে পাননি।
তাদের এই কাহিনী খুব বেশি অভিন্ন বা কমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্স ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুগুলোর কারণে লাখ লাখ বাংলাদেশি তাদের গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ড. হকের অনুমান, আগামী এক দশকের মধ্যে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি তাদের জীবিকা হারাবেন।
প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় অন্যতম। এর ফলে অভ্যন্তরীণভাবে মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। এ ছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন, বন্যা, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে তীব্র খরা ও পানির সংকট।
জাতিসংঘের ইন্টারন্যাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার থেকে প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত বিষয়ক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশ হলো বন্যার কারণে তৃতীয় বৃহৎ বাস্তুচ্যুত দেশের ঝুঁকিতে। জেনেভা ভিত্তিক আইডিএমসির পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাল বলেন, বাস্তুচ্যুত হওয়া এসব মানুষের সংখ্যায় সবাইকে আনা যায়নি। কারণ, ধীরগতিতে অনেক বিপর্যয় ঘটছে, যার ওপর নজরদারি করা খুব কঠিন। তিনি আরো বলেন, আমি যখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সফর করেছি, তখন প্রত্যক্ষ করেছি উপকূলে কি ভয়াবহ ভাঙন চলছে। তা দেখে হতাশ হয়েছি। ভোলায় আক্ষরিক অর্থেই জমিগুলো চলে যাচ্ছে পানির নিচে।
বাস্তুচ্যুতদের বেশির ভাগই গিয়ে ওঠেন রাজধানী ঢাকায়। এখানে বেশির ভাগই অবস্থান করেন বস্তি এলাকায়। ভোলা জেলা থেকে গত কয়েক দশকে এত বেশি মানুষ ঢাকায় স্থানান্তর হয়েছেন যে, ঢাকায় একটি বস্তির নামকরণই হয়ে গেছে ‘ভোলা’। তবে সবাই যে রাজধানীতে যাচ্ছেন এমন না। রাজধানীর পরিবর্তে শাহজালাল বেছে নিয়েছেন বরিশালকে। এটি তার গ্রাম থেকে কম দূরত্বের বড় শহর। তিনি বলেন, আমার গ্রামের বহু মানুষ কাজের জন্য বরিশাল এসেছেন। আমার স্ত্রী বা সন্তানদের রেখে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে যেতে চাই না। এখানে তাদেরকে নিয়ে বসবাস করছি।
শহরে জীবন সবসময় সহজ নয়। শাহজালালের স্ত্রী নাদিরা বেগম প্রথম যখন অন্তঃসত্ত্বা হন তখনকার কথা বলছিলেন তিনি। নাদিরা বলেন, বরিশালে আমরা প্রথমে যে বস্তিতে উঠেছিলাম তা ছিল নোংরা। সেখানে পরিষ্কার পানি ও টয়লেট ছিল না। আমরা দেখেছি সেখানে কীভাবে অন্য শিশুরা বেড়ে উঠছে। কি নোংরা সেই বস্তি। তাই আমরা চাইনি আমাদের সন্তান সেই পরিবেশে বড় হয়ে উঠুক।
শাহজালাল দম্পতির মেয়ে হালিফার বয়স এখন ৫ মাস। তার জন্মের আগেই এই দম্পতি চলে যান নামারচর বস্তিতে। এই বস্তিটি একটি নদীর পাড়ে। ফলে টাটকা বাতাস পাওয়া যায়। নাদিরার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা এখন টয়লেট ও পানির সুবিধা পান। তারা যে ঘরে বসবাস করেন তা থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে চকচকে পরিষ্কার টয়লেটের একটি ব্লক। এটি স্থাপন করেছে একটি দাতব্য সংস্থা ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর। এই ব্লকে রয়েছে পানি ধরে রাখার ট্যাংক ও পাম্প। ফলে অন্য বস্তিগুলোর মতো না হয়ে, এখানকার ল্যাট্রিনগুলো পরিষ্কার রাখা খুব সহজ। আটটি পরিবার সেখানে দুটি টয়লেট ও একটি বেসিন ব্যবহার করে। এর বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। নাদিরা বলেন, আমরা আগে যেখানে বসবাস করতাম তার চেয়ে এখানে জীবন অনেক উন্নত।
বাংলাদেশে বস্তিবাসীদের তুলনায় তারা খুবই সৌভাগ্যবান। বেশির ভাগ বস্তি শুধু যে অধিকসংখ্যক মানুষে গাদাগাদি শুধু তাই নয়, পুরো একটি পরিবার বসবাস করে একটি রুমে। তারা সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটির সেবা ঠিক মতো পায় না। এসব প্রতিষ্ঠান তাদেরকে পানি সরবরাহ দিতে অথবা বর্জ্য অপসারণের মতো সেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। এমন অবস্থায় বসবাসকারী বস্তিবাসীরা এমনিতেই অসুস্থতায় ভোগে। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগে বেশি ভোগেন তারা।
ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবদুস শাহিন বলেছেন, নাজুক পয়ঃনিষ্কাশন এসব পরিবার ও ব্যক্তিবিশেষের জীবনে করুণ পরিণতি বয়ে আনে। তিনি বলেন, যদি একজন রিকশাচালক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি এক বা দুই দিন কাজে যেতে না পারেন, তাহলে এতে তাদের বড় একটি ক্ষতি হয়। যদি একজন গার্মেন্ট শ্রমিক সাতদিন অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তার কর্তৃপক্ষ তার পরিবর্তে অন্যলোক নিয়ে নেবে। ওই শ্রমিক কাজ হারাবেন।
বাংলাদেশের চারটি শহরে, এশিয়ার অন্যান্য শহরে এবং আফ্রিকায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে ওয়াটার স্যানিটেশন ফর দ্য আরবান পুওর। তাদের মতো বেসরকারি সংগঠনগুলো পয়ঃনিষ্কাশনের বিষয়ে যে গ্যাপ আছে তা পূরণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে, যদিও এ সমস্যাটি অনেক বড়। আবদুস শাহিন বলেন, অধিক থেকে অধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে। এর নেপথ্যের কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তনে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমার আশঙ্কা, এ জন্য বস্তি পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। তাই শুধু অভ্যন্তরীণ অভিবাসন সংকট শুধু তারাই মোকাবিলা করছে একা এমন নয়।
গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টের মতে, ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণ এমন নতুন উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ। এ যাবৎকালের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর মধ্যে এক কোটি ৭২ লাখ মানুষ ঝড়, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিপর্যয়ের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বাকি এক কোটি ৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন যুদ্ধ ও সহিংসতার কারণে। অভ্যন্তরীণভাবে এভাবে সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন তাদের শেষ আশ্রয় হয় শহর এলাকা। এ কথা বলেছেন আইডিএমসির পরিচালক মিসেস বিলাক। তিনি বলেন, যেকোনো শহরে যদি দলে দলে বাস্তুচ্যুত মানুষ এসে আশ্রয় নিতে থাকে তাহলে তাতে অপরিহার্যভাবে স্থানীয় সরকারের ওপর চাপ পড়ে। তাদেরকে আশ্রয় দেয়া এবং তাদেরকে সমাজে মানিয়ে নেয়াটা নির্ভর করে সম্পদের ওপর। এমন সংকট বেশি যেখানে দেশগুলো গরিব। তাদের সামনে চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি।
গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য শুধু জলবায়ু সম্পর্কিত বিপর্যয়ই একমাত্র কারণ নয়, এতে শহরের ওপরও চাপ পড়ছে। বিশ্বে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিপর্যয়ের কারণে তাই শহরগুলো ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে মানুষ বাস্তুহারা হওয়ার কারণে।
এ বছর বাস্তুচ্যুত মানুষের শহরমুখী প্রবণতা নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে জাতিসংঘ। তাতে দেখা গেছে, বন্যার কারণে প্রতি বছর সারা বিশ্বে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বসবাস করেন শহর অথবা আধা শহর এলাকায়। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে নগরায়ন। তাই এখানে এই ঝুঁকি শতকরা ৯০ ভাগ।
মিসেস বিলাক বলেন, বস্তিতে বসবাসকারী মানুষ, যারা বাস্তুচ্যুত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তারা বাস্তুচ্যুত হবে নিরাপত্তাহীন অবকাঠামো, আবাসনে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর সেটিং, সম্পদের অভাব, অসুস্থতায় বিপন্ন হওয়া ও উৎখাতের মতো ঘটনায়। মিসেস বিলাক বলেন, অবশ্যই এদের অনেকেই তাদের শহরের এসব আবাসন থেকে সরে যেতে বাধ্য হবেন। এটা হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তুচ্যুতি।
গ্রামে যারা রয়ে যাবেন, তাদের কাছে পরিস্থিতি ফুলের বিছানা নয়। শাহজালালের গ্রামে যাওয়ার রাস্তা মাঠের ভিতর দিয়ে গিয়েছে মাইলের পর মাইল। সেখানে চারদিকে সব কিছু ফাঁকা।
শাহজালাল বলেন, এই ক্ষেতগুলোতে ধান চাষ হতো। আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন দেখেছি সারা মাঠে কৃষক। এখন আপনি দেখবেন এখানে কেউ নেই।
অদ্ভুতভাবে গ্রামও নীরব। শাহজালালের পরিবারের পুরনো প্রজন্মের কেউ কেউ রয়েছেন গ্রামে। তার মধ্যে আছেন তার পিতা, মামা ও চাচা। তাদের মতে, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সেখানে বসবাসকারীদের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে। শাহজালালের চাচা বলেন, যুবকরা সবাই গ্রাম ছেড়ে গেছে কাজ খুঁজে পেতে। কেউ কেউ তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যায়। আবার কখনো তাদেরকে বাড়িতে রেখে যায়।
তবে ব্যতিক্রম শাহজালালের ভাই মোহাম্মদ সাইদুলের ক্ষেত্রে। তিনি তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার বয়স ২৭ বছর। তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন কাজের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি ও তার পরিবার চিংড়ি ও অন্য মাছের চাষ করেন। কিন্তু ধান চাষের চেয়ে মাছ চাষে অনেক কম লাভ বলে জানান তিনি। সাইদুল বলেন, আমরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করি। কিন্তু আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে চাই না। কারণ, এই বাড়ি আমার।
(লন্ডনের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
No comments