বিবর্ণ ভবিষ্যতের মুখোমুখি রোহিঙ্গা শিশুদের শেষ প্রজন্ম by রুবায়েত জেসমিন
চিকিৎসক
হওয়ার স্বপ্নের কথা বলার সময় বালকটির চোখ দুটি জ্বলে ওঠল। সাত বছর বয়সের
মোহাম্মদ (তার আসল নাম নয়) মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম। কক্সবাজারের
একটি উদ্বাস্তু শিবিরে একটি শিক্ষা কেন্দ্রে তার সাথে আমার সাক্ষাত হয়
চলতি মাসের প্রথম দিকে।
আকাঙ্ক্ষার কথা বলার পরই মোহাম্মদ দ্রুত বাস্তবতায় ফিরে আসে। ম্লান হাসিতে জানায়, আমি জানি, আমার স্বপ্ন কখনো সত্য হবে না।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ২০১৭ সালের মধ্যভাগে খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ জাতিগত নিধন অভিযানের ফলে যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, মোহাম্মদ তাদেরই একজন। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমার থেকে এর আগেই নির্যাতনের মুখে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছিল।
অবহেলায় ৫ লাখ শিশু
নতুন আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ নারী ও শিশু। এ তথ্য জাতিসংঘের।
বাংলাদেশ সরকার মহান মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব নির্যাতিত লোককে আশ্রয় দিয়েছে। বিভিন্ন বাংলাদেশী সামাজিক সংগঠন, জাতিসংঘ সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা আশ্রয়, খাবার, পোশাক ও মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা পাচ্ছে।
এই অপরিহার্য পরিচর্যার জন্য ২০১৯ সালে ব্যয় হয় প্রায় ৯২০.৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখনো তাদের প্রয়োজন মেটানো বেশ কঠিন ব্যাপার।
বেশির ভাগ উদ্বাস্তু বাস করছে অস্বাস্থ্যকর জনাকীর্ণ শিবিরগুলোতে। ন্যূনতম পুষ্টি ও অন্যান্য প্রয়োজনের ওপর তারা টিকে আছে। মওসুমি বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, ভূমিধস তাদের নিত্য সঙ্গী।
সবার জন্যই এটি ভয়াবহ পরিবেশ। তবে ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশুদের জীবনই সবচেয়ে কষ্টকর।
হারানো প্রজন্ম নিয়ে উদ্বেগ
গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বাস্তু শিশুরা যত বেশি স্কুলের বাইরে থাকবে, তাদের ভবিষ্যত তত খারাপ হবে।
তুরস্ক, লেবানন, উগান্ডাসহ অন্য যেসব দেশে বড় সংখ্যায় উদ্বাস্তু গেছে, সেখানে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ইউনিসেফ শিবিরে বা আশপাশের পাবলিক স্কুলগুলোতে শিশুদের মানসম্পন্ন ও পূর্ণকালীন শিশু নিশ্চিত করেছে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু শিশুদের মাত্র ২৩ ভাগের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাত্র ১ ভাগ।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের সরকারি উদ্বাস্তুর মর্যাদা না দিয়ে তাদেরকে ‘বলপূর্ব উচ্ছেদ হওয়া মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এখানে তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় কোনো ধরনের প্রবেশাধিকার নেই।
ইউনিসেফ ও এর সহযোগীরা ৪ থেকে ১৪ বছর বয়স্ক রোহিঙ্গা শিশুদের প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বর্মি, ইংরেজি, গণিত ও লাইফ স্কিল শিক্ষা দিয়ে থাকে। এসব শেখানোর জন্য ক্যাম্পগুলোতে ১,৬০০ শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এসব ক্লাসে প্রায় ১৪৫,০০০ রোহিঙ্গা শিশু বা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিশুদের প্রায় ৩০ ভাগ শিক্ষা পাচ্ছে। এরাও কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা চাকরির বাজারে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাবে না।
ক্যাম্পগুলোতে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স্ক রোহিঙ্গা কিশোরদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
কোনো কোনো কিশোর, বেশির ভাগই ছেলে, মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হয়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে।
আর যেসব রোহিঙ্গা শিশু ইউনিসেফের ক্লাব বা মাদরাসা কোথাও যাচ্ছে না, তারা নিজেদের মতো করে চলছে। আমি ক্যাম্পে ছেলেদেরকে দোকানে কাজ করতে দেখেছি, কার্ড খেলতে দেখেছি, কিংবা অলসভাবে দিনের পর দিন পার করতে দেখেছি।
স্কুল না থাকলে কী করে, এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম মোহাম্মদকে। সে জানাল, সে পরিবারের দেখাশুনা করে।
সে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল, আমি অন্য শিশুদের সাথে খেলাও করি।
আমি শুনেছি, রোহিঙ্গাদের রক্ষণশীল সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে মেয়েদেরকে তাদের মা-বাবারা ঘরের ভেতরেই রাখেন।
ক্যাম্পগুলো মেয়েদের জন্য বিপজ্জনকও। আদম পাচারকারীরা রোহিঙ্গা তরুণদের সামনে ক্যাম্পের বাইরে চাকরির টোপ দেয়। এসব ক্যাম্পেও তারা সহিংসতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
অস্থিতিশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠতে থাকায় মোহাম্মদের মতো রোহিঙ্গা শিশুরা হারানো প্রজন্মে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তবে তাদের অবহেলা হয়তো চিরস্থায়ী হবে না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার ২০১৮ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। অবশ্য মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ নেই, এমন আশঙ্কায় উদ্বাস্তুর ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- উভয় স্থানেই বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে।
তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকার মধ্যেই রোহিঙ্গা শিশুদের সন্ত্রস্ত্র একটি প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যত শুরুর জন্য অপেক্ষা করছে।
আকাঙ্ক্ষার কথা বলার পরই মোহাম্মদ দ্রুত বাস্তবতায় ফিরে আসে। ম্লান হাসিতে জানায়, আমি জানি, আমার স্বপ্ন কখনো সত্য হবে না।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ২০১৭ সালের মধ্যভাগে খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ জাতিগত নিধন অভিযানের ফলে যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, মোহাম্মদ তাদেরই একজন। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমার থেকে এর আগেই নির্যাতনের মুখে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছিল।
অবহেলায় ৫ লাখ শিশু
নতুন আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ নারী ও শিশু। এ তথ্য জাতিসংঘের।
বাংলাদেশ সরকার মহান মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব নির্যাতিত লোককে আশ্রয় দিয়েছে। বিভিন্ন বাংলাদেশী সামাজিক সংগঠন, জাতিসংঘ সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা আশ্রয়, খাবার, পোশাক ও মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা পাচ্ছে।
এই অপরিহার্য পরিচর্যার জন্য ২০১৯ সালে ব্যয় হয় প্রায় ৯২০.৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখনো তাদের প্রয়োজন মেটানো বেশ কঠিন ব্যাপার।
বেশির ভাগ উদ্বাস্তু বাস করছে অস্বাস্থ্যকর জনাকীর্ণ শিবিরগুলোতে। ন্যূনতম পুষ্টি ও অন্যান্য প্রয়োজনের ওপর তারা টিকে আছে। মওসুমি বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, ভূমিধস তাদের নিত্য সঙ্গী।
সবার জন্যই এটি ভয়াবহ পরিবেশ। তবে ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশুদের জীবনই সবচেয়ে কষ্টকর।
হারানো প্রজন্ম নিয়ে উদ্বেগ
গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বাস্তু শিশুরা যত বেশি স্কুলের বাইরে থাকবে, তাদের ভবিষ্যত তত খারাপ হবে।
তুরস্ক, লেবানন, উগান্ডাসহ অন্য যেসব দেশে বড় সংখ্যায় উদ্বাস্তু গেছে, সেখানে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ইউনিসেফ শিবিরে বা আশপাশের পাবলিক স্কুলগুলোতে শিশুদের মানসম্পন্ন ও পূর্ণকালীন শিশু নিশ্চিত করেছে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু শিশুদের মাত্র ২৩ ভাগের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাত্র ১ ভাগ।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের সরকারি উদ্বাস্তুর মর্যাদা না দিয়ে তাদেরকে ‘বলপূর্ব উচ্ছেদ হওয়া মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এখানে তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় কোনো ধরনের প্রবেশাধিকার নেই।
ইউনিসেফ ও এর সহযোগীরা ৪ থেকে ১৪ বছর বয়স্ক রোহিঙ্গা শিশুদের প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বর্মি, ইংরেজি, গণিত ও লাইফ স্কিল শিক্ষা দিয়ে থাকে। এসব শেখানোর জন্য ক্যাম্পগুলোতে ১,৬০০ শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এসব ক্লাসে প্রায় ১৪৫,০০০ রোহিঙ্গা শিশু বা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিশুদের প্রায় ৩০ ভাগ শিক্ষা পাচ্ছে। এরাও কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা চাকরির বাজারে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাবে না।
ক্যাম্পগুলোতে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স্ক রোহিঙ্গা কিশোরদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
কোনো কোনো কিশোর, বেশির ভাগই ছেলে, মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হয়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে।
আর যেসব রোহিঙ্গা শিশু ইউনিসেফের ক্লাব বা মাদরাসা কোথাও যাচ্ছে না, তারা নিজেদের মতো করে চলছে। আমি ক্যাম্পে ছেলেদেরকে দোকানে কাজ করতে দেখেছি, কার্ড খেলতে দেখেছি, কিংবা অলসভাবে দিনের পর দিন পার করতে দেখেছি।
স্কুল না থাকলে কী করে, এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম মোহাম্মদকে। সে জানাল, সে পরিবারের দেখাশুনা করে।
সে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল, আমি অন্য শিশুদের সাথে খেলাও করি।
আমি শুনেছি, রোহিঙ্গাদের রক্ষণশীল সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে মেয়েদেরকে তাদের মা-বাবারা ঘরের ভেতরেই রাখেন।
ক্যাম্পগুলো মেয়েদের জন্য বিপজ্জনকও। আদম পাচারকারীরা রোহিঙ্গা তরুণদের সামনে ক্যাম্পের বাইরে চাকরির টোপ দেয়। এসব ক্যাম্পেও তারা সহিংসতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
অস্থিতিশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠতে থাকায় মোহাম্মদের মতো রোহিঙ্গা শিশুরা হারানো প্রজন্মে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তবে তাদের অবহেলা হয়তো চিরস্থায়ী হবে না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার ২০১৮ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। অবশ্য মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ নেই, এমন আশঙ্কায় উদ্বাস্তুর ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- উভয় স্থানেই বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে।
তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকার মধ্যেই রোহিঙ্গা শিশুদের সন্ত্রস্ত্র একটি প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যত শুরুর জন্য অপেক্ষা করছে।
No comments