ডেঙ্গু: তিন দিন নয়, জ্বর হলেই যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে by জাকিয়া আহমেদ
তীব্র
জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে র্যাশ ও বমি বমি ভাবকেই আগে ডেঙ্গুর লক্ষণ হিসেবে
ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু রোগের ধরন বদলেছে। এখন
ডেঙ্গু হলে আগের কোনও লক্ষণ আর দেখা যায় না। এবার ডেঙ্গু হলেই রোগীর
হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে
আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। একইসঙ্গে রোগী দ্রুত শকে চলে
যাওয়ারও আশঙ্কা বেড়েছে। এ কারণে এবার বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীরই মৃত্যু হয়েছে
‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’। শিশুদের বেলায় এটি আরও ভয়ঙ্কর বলেও চিকিৎসকরা
জানান। তারা বলছেন, আগে জ্বর হলে তিনদিন অপেক্ষা করতে বলা হতো। এরপরও না
কমলে পরীক্ষা করাতে বলা হতো। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। জ্বর হলে প্রথম
দিনেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এবার ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশেই। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
৩৭ বছরের মাহফুজার রহমানের বাড়ি জয়পুরহাটে। ঢাকায় চাকরি করেন। গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই জ্বর। জ্বরের ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল খান রাতের খাবারের পর। বুধ, বৃহস্পতিবার; এই দুই দিনই তিনবেলা খাবারের পর প্যারাসিটামল খান। কিন্তু বৃহস্পতিবার অফিস সেরে বাসায় ফেরার পর রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন। শুক্রবার এভাবেই যায়, কিন্তু জ্বর আর কমে না। শনিবার যান সরকারি কর্মচারী কল্যাণ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। বাসায় ফেরার পর আর কিছু মনে নেই তার। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শুয়ে আছেন, তার হাতে স্যালাইন লাগানো। এখন এই হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছে তার।
দুই বছর আগে বাংলাদেশ বিমানের এক কর্মকর্তা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এবার আবারও জ্বর হচ্ছিল, সঙ্গে কাঁপুনি। এরপর তাকে গত ১৩ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জ্বর তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
পুরান ঢাকার দনিয়া এলাকার ৩২ বছরের লাকি আক্তারের গত পাঁচ জুলাই ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপরই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ১৪ জুলাই কথা হয় তার সঙ্গে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তিনি বলেন, ‘জ্বর কমেছে কিছুটা। কিন্তু মাথাব্যথা, চোখব্যথা, পুরো শরীর ব্যথা, আর প্রচণ্ড বমি। একটু ডাবের পানি খেয়েও রাখতে পারতাম না। সব বমি হয়ে যেতো।’
মুখে হাত বোলাতে বোলাতে লাকি বলেন, ‘মুখ থেকে চামড়া উঠতো, ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে প্রচণ্ড। আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে এই অসহ্য যন্ত্রণার চেয়ে মরে গেলেও ভালো হতো, এত কষ্ট হয়েছে।’
হাসপাতালে কবে ভর্তি হলেন, জানতে চাইলে লাকি আক্তার বলেন, ‘গত ৫ জুলাই পুরনো ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়ায় চলে আসি এই বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু গত শুক্রবার যখন এই হাসপাতালে আসি, তখন অবস্থা খারাপ দেখে আমাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। এরপর অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেবল আমিই নই, আমার ছেলে ও মেয়ে দুজনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তাইয়েবা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, আর দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাফি একই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি।’
লাকি আক্তারের স্বামী প্রকৌশলী এস এম মনির হোসেন বলেন, ‘পরিবারের তিনজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেটা নেওয়া হচ্ছে না। এ কারণেই ভোগান্তি আরও বাড়ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০১ জন রোগী। সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা এক হাজার ২০৭ জন।
সরকারি হিসাব বলছে, ডেঙ্গুতে গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, মৃত্যু হয়েছে মোট ১২ জনের।
কন্ট্রোল রুম জানায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৪৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আর ছাড়পত্র নিয়েছেন চার হাজার ৩৩৪ রোগী।
ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আগে শরীর ব্যথা হতো, শরীরে র্যাশ হতো কিন্তু এবারের ডেঙ্গুতে এসবের বালাই নেই। আগে যেসব উপসর্গ দেখা যেতো, সেসব এখন হয় না বলে মানুষ বুঝতে পারছেন না। তাই চিকিৎসকের কাছে যেতেও দেরি করছে। কিন্তু এই দেরিতেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।’
অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ‘এবারে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।’ তিনি বলেন, ‘জ্বর হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনও ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে যেকোনও পানীয় জাতীয় খাবার খেতে হবে।’
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘২০০০ সালে যখন প্রথম ডেঙ্গু শুরু হয়, তখন কেবল ছিল ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যাল এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুতে তীব্র জ্বর, তীব্র শরীর ব্যথা ছিল। রোগী মনে করতো তার শরীরের হাড় ভেঙে যাচ্ছে। এজন্য ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যালকে বলা হতো হাড্ডিভাঙা জ্বর বা ইংরেজিতে বোনব্রেকিং ফিভার। তখন শরীরে র্যাশ উঠতো। এসব উপসর্গের সঙ্গে আরেকটি ছিল, প্লাটিলেট এবং পিসিভি দ্রুত কমে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতো। একে ইংরেজিতে বলা হয় হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গু।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এবারে ডেঙ্গুতে লক্ষণ বদলে গেছে। আগে যেমন ১০৪ থেকে ১০৫ ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকতো, এবারে সে উচ্চমাত্রার তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে না। ১০১ থেকে ১০২-তেই থাকছে তাপমাত্রা, ব্যথাও থাকছে মধ্যম মানে। যে কারণে মানুষ তাকে নিয়ে ভাবছে না। আর এতেই রোগী ভুলটা করছে।’
লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘রক্তক্ষরা ডেঙ্গু এবারে একেবারেই কম। তবে, রোগীরা ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। শরীরে একদমই র্যাশ নেই, হয়তো কিছুটা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হচ্ছে। হঠাৎ করেই শকে চলে যাচ্ছে।’
শক কী জানতে চাইলে লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘যখন রোগীর নাড়ির গতি অনেক বেড়ে যায়, হৃদপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে যায়, ব্লাডপ্রেসার কমে যায়, পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন তাকে শক বলা হয়। এই শক সিন্ড্রোমের রোগী এবার বেশি পাচ্ছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এবার র্যাশ পাওয়া যাচ্ছে না, জ্বরের তাপমাত্রা তেমন উঠছে না। কিন্তু তীব্র জ্বরে, তীব্র শরীর ব্যথা, গায়ে র্যাশ উঠলে মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতো। কিন্তু এবারে সেসব উপসর্গ না থাকায় মানুষ সচেতন হচ্ছে না। এবারে তাই জ্বর ছেড়ে যাওয়ার এক থেকে দুই দিন পরই রোগী শকে চলে যাচ্ছে। সেজন্যই ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম বেশি ঝামেলাপূর্ণ।’
একইসঙ্গে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে থাকলে রোগীর পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে উল্লেখ করে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এবার সব মিলিয়ে যে সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, রোগীর মৃত্যুও কিন্তু সে অনুযায়ী বেশি।’ এর আগের বছরগুলোয় অনেক বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক হলেও মৃত্যুর হার তত বেশি ছিল না বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এবার ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশেই। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
৩৭ বছরের মাহফুজার রহমানের বাড়ি জয়পুরহাটে। ঢাকায় চাকরি করেন। গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই জ্বর। জ্বরের ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল খান রাতের খাবারের পর। বুধ, বৃহস্পতিবার; এই দুই দিনই তিনবেলা খাবারের পর প্যারাসিটামল খান। কিন্তু বৃহস্পতিবার অফিস সেরে বাসায় ফেরার পর রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন। শুক্রবার এভাবেই যায়, কিন্তু জ্বর আর কমে না। শনিবার যান সরকারি কর্মচারী কল্যাণ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। বাসায় ফেরার পর আর কিছু মনে নেই তার। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শুয়ে আছেন, তার হাতে স্যালাইন লাগানো। এখন এই হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছে তার।
দুই বছর আগে বাংলাদেশ বিমানের এক কর্মকর্তা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এবার আবারও জ্বর হচ্ছিল, সঙ্গে কাঁপুনি। এরপর তাকে গত ১৩ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জ্বর তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
পুরান ঢাকার দনিয়া এলাকার ৩২ বছরের লাকি আক্তারের গত পাঁচ জুলাই ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপরই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ১৪ জুলাই কথা হয় তার সঙ্গে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তিনি বলেন, ‘জ্বর কমেছে কিছুটা। কিন্তু মাথাব্যথা, চোখব্যথা, পুরো শরীর ব্যথা, আর প্রচণ্ড বমি। একটু ডাবের পানি খেয়েও রাখতে পারতাম না। সব বমি হয়ে যেতো।’
মুখে হাত বোলাতে বোলাতে লাকি বলেন, ‘মুখ থেকে চামড়া উঠতো, ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে প্রচণ্ড। আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে এই অসহ্য যন্ত্রণার চেয়ে মরে গেলেও ভালো হতো, এত কষ্ট হয়েছে।’
হাসপাতালে কবে ভর্তি হলেন, জানতে চাইলে লাকি আক্তার বলেন, ‘গত ৫ জুলাই পুরনো ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়ায় চলে আসি এই বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু গত শুক্রবার যখন এই হাসপাতালে আসি, তখন অবস্থা খারাপ দেখে আমাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। এরপর অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেবল আমিই নই, আমার ছেলে ও মেয়ে দুজনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তাইয়েবা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, আর দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাফি একই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি।’
লাকি আক্তারের স্বামী প্রকৌশলী এস এম মনির হোসেন বলেন, ‘পরিবারের তিনজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেটা নেওয়া হচ্ছে না। এ কারণেই ভোগান্তি আরও বাড়ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০১ জন রোগী। সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা এক হাজার ২০৭ জন।
সরকারি হিসাব বলছে, ডেঙ্গুতে গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, মৃত্যু হয়েছে মোট ১২ জনের।
কন্ট্রোল রুম জানায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৪৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আর ছাড়পত্র নিয়েছেন চার হাজার ৩৩৪ রোগী।
ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আগে শরীর ব্যথা হতো, শরীরে র্যাশ হতো কিন্তু এবারের ডেঙ্গুতে এসবের বালাই নেই। আগে যেসব উপসর্গ দেখা যেতো, সেসব এখন হয় না বলে মানুষ বুঝতে পারছেন না। তাই চিকিৎসকের কাছে যেতেও দেরি করছে। কিন্তু এই দেরিতেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।’
অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ‘এবারে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।’ তিনি বলেন, ‘জ্বর হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনও ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে যেকোনও পানীয় জাতীয় খাবার খেতে হবে।’
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘২০০০ সালে যখন প্রথম ডেঙ্গু শুরু হয়, তখন কেবল ছিল ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যাল এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুতে তীব্র জ্বর, তীব্র শরীর ব্যথা ছিল। রোগী মনে করতো তার শরীরের হাড় ভেঙে যাচ্ছে। এজন্য ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যালকে বলা হতো হাড্ডিভাঙা জ্বর বা ইংরেজিতে বোনব্রেকিং ফিভার। তখন শরীরে র্যাশ উঠতো। এসব উপসর্গের সঙ্গে আরেকটি ছিল, প্লাটিলেট এবং পিসিভি দ্রুত কমে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতো। একে ইংরেজিতে বলা হয় হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গু।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এবারে ডেঙ্গুতে লক্ষণ বদলে গেছে। আগে যেমন ১০৪ থেকে ১০৫ ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকতো, এবারে সে উচ্চমাত্রার তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে না। ১০১ থেকে ১০২-তেই থাকছে তাপমাত্রা, ব্যথাও থাকছে মধ্যম মানে। যে কারণে মানুষ তাকে নিয়ে ভাবছে না। আর এতেই রোগী ভুলটা করছে।’
লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘রক্তক্ষরা ডেঙ্গু এবারে একেবারেই কম। তবে, রোগীরা ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। শরীরে একদমই র্যাশ নেই, হয়তো কিছুটা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হচ্ছে। হঠাৎ করেই শকে চলে যাচ্ছে।’
শক কী জানতে চাইলে লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘যখন রোগীর নাড়ির গতি অনেক বেড়ে যায়, হৃদপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে যায়, ব্লাডপ্রেসার কমে যায়, পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন তাকে শক বলা হয়। এই শক সিন্ড্রোমের রোগী এবার বেশি পাচ্ছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এবার র্যাশ পাওয়া যাচ্ছে না, জ্বরের তাপমাত্রা তেমন উঠছে না। কিন্তু তীব্র জ্বরে, তীব্র শরীর ব্যথা, গায়ে র্যাশ উঠলে মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতো। কিন্তু এবারে সেসব উপসর্গ না থাকায় মানুষ সচেতন হচ্ছে না। এবারে তাই জ্বর ছেড়ে যাওয়ার এক থেকে দুই দিন পরই রোগী শকে চলে যাচ্ছে। সেজন্যই ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম বেশি ঝামেলাপূর্ণ।’
একইসঙ্গে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে থাকলে রোগীর পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে উল্লেখ করে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এবার সব মিলিয়ে যে সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, রোগীর মৃত্যুও কিন্তু সে অনুযায়ী বেশি।’ এর আগের বছরগুলোয় অনেক বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক হলেও মৃত্যুর হার তত বেশি ছিল না বলেও জানান তিনি।
No comments