চাপে কাবু মধ্যবিত্ত by এম এম মাসুদ
বাজেটের
প্রভাবে খরচের খাতায় যোগ হয়েছে বাড়তি অর্থ। হাতের মোবাইল ফোনটি থেকে কথা
বলতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। বাজেটের পর ইতিমধ্যে বেড়েছে কিছু নিত্যপণ্যের
দাম। সর্বশেষ যুক্ত হলো গ্যাসের বর্ধিত মূল্য। চতুর্মুখী ব্যয় বাড়ার চাপে
সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত শ্রেণির
মানুষ। বাজেট বিশ্লেষকরা জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আয় বাড়ানোর জন্য
যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ চাপে পড়বে। এছাড়া মধ্যবিত্ত
শ্রেণি উপেক্ষিত হয়েছে। ৫টি মৌলিক চাহিদার ৩টির বিপরীতেই কর বাড়ানো হয়েছে।
বরাদ্দের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাজেটের কর কাঠামো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর সমাজের মধ্যবিত্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর আঘাত করবে। বাজেটে মোবাইল ফোনসহ ডিজিটাল সেবায় যেসব করারোপ করা হয়েছে তাতে শুধু মধ্যবিত্তেরই নয়, নিম্নবিত্তের ওপরও চাপ বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে পরোক্ষ করের ওপর। অর্থাৎ মোট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে (এনবিআর) আদায় হওয়া ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার করের মধ্যে ভ্যাট থেকে আসবে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর তা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এ বছরও আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের টার্গেট করা হয়েছে। যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যেই, তারাই মধ্যবিত্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি। বড় ধনী শ্রেণির পক্ষে গেছে। তার মতে, সাধারণ মানষের আয়ের একমাত্র উৎস সঞ্চয়পত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে, শেয়ারবাজারের বড় ব্যবসায়ীদের কর হার কমিয়ে সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা চরম বৈষম্য বলে তিনি মনে করেন।
একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন আমিনুল ইসলাম। মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মিরপুরের একটি ভাড়া বাসায়। তিনি বলেন, মাসে ১৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। দুই সন্তানের স্কুলের খরচ লাগে অন্তত ৮ হাজার টাকা। এছাড়া নিজের ও সন্তানদের যাতায়াতের খরচ হয় আরো অন্তত ৪ হাজার টাকা। বাকি ১০ হাজার টাকায় পুরো মাসের খরচ চালাতে হয়। তিনি বলেন, জরুরি কোনো প্রয়োজন হলে ধার কর্জ করতে হয়। এ অবস্থায় বছর শেষেই বাড়ি ভাড়া অন্তত ৫০০ টাকা বাড়ে। সন্তানদের স্কুলে প্রতিবছর তাদের বেতন বাড়ায়। বাজেটের পর যোগ হয়েছে নতুন খরচ। গ্যাসের দাম বেড়েছে পৌনে দুইশ টাকা। এ অবস্থায় ঠিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক আমিনা ইসলাম। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে বেতন বাড়ে না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত ৩০ ভাগ খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় চলতে কষ্ট হচ্ছে। সর্বশেষ বাজেটের পর নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাসের নতুন দাম বিপাকে ফেলেছে। তিনি বলেন, নিজে শিক্ষকতা করি। কিন্তু আমার দুই সন্তানকে চাহিদা মতো শিক্ষার খরচই দিতে পারি না।
আবদুল হালিম। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন সর্বসাকুল্যে ৪০ হাজার টাকা। থাকেন ঢাকার বাসাবো এলাকায়।
দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে অষ্টম আর মেয়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ভালো ফলের জন্য দু্থজনেরই প্রয়োজন প্রাইভেট টিউটরের। প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছে তাদের জন্য। প্রতি মাসে ছেলেমেয়েদের স্কুল ও প্রাইভেট টিউটরের বেতন মিলিয়ে খরচ ১০ হাজার টাকা। বাসাভাড়া দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। অসুস্থ মায়ের ও নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে যায় ৩ হাজার টাকা। পানি, গ্যাস বিদ্যুৎ, নাইটগার্ড, ডিশ অ্যান্টেনা, ময়লা পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের বিলসহ অন্যান্য মিলিয়ে ইউটিলিটি চার্জ দেন আড়াই হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত ও দুপুরের খাবার হিসেবে নিজের হাত খরচ রাখেন মাসে ৩ হাজার টাকা। অবশিষ্ট থাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তা দিয়ে পরিবারের সবার খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাসের বাজার ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় আবদুল হালিমকে। নিজের সংসারের হিসাব তুলে ধরে উল্টো জানতে চান- ‘কী খাই, তা আপনিই বলেন? এ অবস্থায় সামনে খরচ বাড়লে জীবন চলবে কি করে?
এদিকে বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্টভাবে এবারের বাজেটের যেসব উদ্যোগ মধ্যবিত্তকে চাপে ফেলবে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানো, টেলিফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, পোশাকে ভ্যাট বাড়ানো, বাড়ি ভাড়া, সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় উৎসে কর বাড়ানো এবং খাদ্যপণ্যে ট্যারিফ মূল্য বিলুপ্ত। এছাড়া পুরো বাজেটে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করে বেশি জোর দেয়া হয়েছে, যা ভোক্তা শ্রেণির ব্যয় বাড়াবে। তবে তুলনামূলকভাবে উচ্চ ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের গুরুত্ব কম বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
গত কয়েক বছর বাস্তবায়ন করতে না পারা ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আইন এবারই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ ভ্যাট আইনে বেশকিছু নিত্যপণ্যে ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। তারপরও এ আইন বাস্তবায়নে অনেক পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ হবে কিংবা আরোপকৃত ভ্যাটের পরিমাণ বাড়বে। বাজেটে বেশকিছু ক্ষেত্রে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন-যাপনে খরচের বাড়তি চাপ দিয়েই শুরু হলো নতুন অর্থবছর।
নতুন অর্থবছরে ইটিআইএন ছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও লাগবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর)। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ইটিআইএন উল্লেখ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভুয়া নম্বর দিলে দলিল বাতিল হবে। বাজেটে শুল্ক বাড়ানোর কারণে বাজারে বিদেশি গুঁড়া দুধের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। বেড়েছে আরো কিছু নিত্যপণ্যের দাম। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও গত তিন বছরের মতো একই থাকছে করমুক্ত আয়সীমা। এতে মাসে ২০,৮৩৪ টাকা নিট আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে সরকারি কোষাগারে করের অর্থ জমা দিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে বাইরে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি উৎস কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা কমানো হয়নি। করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল বেসরকারি খাতের।
কমানো হয়নি করপোরেট কর হার। মোবাইল কলরেট ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপে এ ক্ষেত্রেও মানুষকে গুনতে হবে পকেটের টাকা। অগ্রিম কর প্রত্যাহার না হওয়ায় এবং জোগানদারের ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাবে। নতুন অর্থবছর থেকে ভ্যাটের সব হারে রেয়াত নেয়ার সুযোগও থাকছে না।
এছাড়া বাজেটে শিল্পের সব কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম কর পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে এবং জোগানদারের ক্ষেত্রে ভ্যাট ৫ শতাংশর পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা ও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের সীমা এক কোটি টাকার পরিবর্তে তিন কোটি টাকা করার দাবি আমলে আনা হয়নি। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর হারে ছাড় দেয়া, সব রপ্তানি আয়ের উৎসে ন্যূনতম করহার কমানোর প্রস্তাব করা হলেও চূড়ান্ত বাজেটে আনা হয়নি।
এবারের বাজেটে ব্যক্তিগত সব গাড়ি নিবন্ধন, রুট পারমিট, ফিটনেস, মালিকানা সনদ নেয়া ও নবায়নের মাশুলের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে। মোটরসাইকেলের বিদেশি টায়ারে কর বাড়ানো হয়েছে। চিনি আমদানিতে বাজেটে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভোজ্যতেলে আরোপ করা হয়েছে ভ্যাট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যা ছিল, চূড়ান্তভাবেও মোটামুটি তাই রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েই গেল। তিনি বলেন, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল এটি কমতে পারে, তা কমেনি। তিনি বলেন, ভ্যাটের কারণে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়বে। কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্কের প্রভাবে আমদানি ব্যয় বাড়বে। এতে ব্যবসা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিভিন্ন করের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এতে মানুষের জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, জ্বালানি ও ভ্যাটের সঙ্গে সবকিছু জড়িত। বিশেষ করে পণ্যের দাম, পরিবহন ব্যয় এবং বাসাভাড়া। ফলে এর প্রভাব জীবনযাত্রার সবগুলো খাতেই পড়বে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে বড় একটি শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরা হয়তো সঞ্চয় ভেঙে খাবে, অথবা তাদের জীবনযাত্রার মান কমবে।
বরাদ্দের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাজেটের কর কাঠামো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর সমাজের মধ্যবিত্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর আঘাত করবে। বাজেটে মোবাইল ফোনসহ ডিজিটাল সেবায় যেসব করারোপ করা হয়েছে তাতে শুধু মধ্যবিত্তেরই নয়, নিম্নবিত্তের ওপরও চাপ বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে পরোক্ষ করের ওপর। অর্থাৎ মোট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে (এনবিআর) আদায় হওয়া ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার করের মধ্যে ভ্যাট থেকে আসবে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর তা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এ বছরও আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের টার্গেট করা হয়েছে। যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যেই, তারাই মধ্যবিত্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি। বড় ধনী শ্রেণির পক্ষে গেছে। তার মতে, সাধারণ মানষের আয়ের একমাত্র উৎস সঞ্চয়পত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে, শেয়ারবাজারের বড় ব্যবসায়ীদের কর হার কমিয়ে সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা চরম বৈষম্য বলে তিনি মনে করেন।
একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন আমিনুল ইসলাম। মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মিরপুরের একটি ভাড়া বাসায়। তিনি বলেন, মাসে ১৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। দুই সন্তানের স্কুলের খরচ লাগে অন্তত ৮ হাজার টাকা। এছাড়া নিজের ও সন্তানদের যাতায়াতের খরচ হয় আরো অন্তত ৪ হাজার টাকা। বাকি ১০ হাজার টাকায় পুরো মাসের খরচ চালাতে হয়। তিনি বলেন, জরুরি কোনো প্রয়োজন হলে ধার কর্জ করতে হয়। এ অবস্থায় বছর শেষেই বাড়ি ভাড়া অন্তত ৫০০ টাকা বাড়ে। সন্তানদের স্কুলে প্রতিবছর তাদের বেতন বাড়ায়। বাজেটের পর যোগ হয়েছে নতুন খরচ। গ্যাসের দাম বেড়েছে পৌনে দুইশ টাকা। এ অবস্থায় ঠিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক আমিনা ইসলাম। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে বেতন বাড়ে না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত ৩০ ভাগ খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় চলতে কষ্ট হচ্ছে। সর্বশেষ বাজেটের পর নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাসের নতুন দাম বিপাকে ফেলেছে। তিনি বলেন, নিজে শিক্ষকতা করি। কিন্তু আমার দুই সন্তানকে চাহিদা মতো শিক্ষার খরচই দিতে পারি না।
আবদুল হালিম। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন সর্বসাকুল্যে ৪০ হাজার টাকা। থাকেন ঢাকার বাসাবো এলাকায়।
দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে অষ্টম আর মেয়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ভালো ফলের জন্য দু্থজনেরই প্রয়োজন প্রাইভেট টিউটরের। প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছে তাদের জন্য। প্রতি মাসে ছেলেমেয়েদের স্কুল ও প্রাইভেট টিউটরের বেতন মিলিয়ে খরচ ১০ হাজার টাকা। বাসাভাড়া দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। অসুস্থ মায়ের ও নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে যায় ৩ হাজার টাকা। পানি, গ্যাস বিদ্যুৎ, নাইটগার্ড, ডিশ অ্যান্টেনা, ময়লা পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের বিলসহ অন্যান্য মিলিয়ে ইউটিলিটি চার্জ দেন আড়াই হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত ও দুপুরের খাবার হিসেবে নিজের হাত খরচ রাখেন মাসে ৩ হাজার টাকা। অবশিষ্ট থাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তা দিয়ে পরিবারের সবার খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাসের বাজার ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় আবদুল হালিমকে। নিজের সংসারের হিসাব তুলে ধরে উল্টো জানতে চান- ‘কী খাই, তা আপনিই বলেন? এ অবস্থায় সামনে খরচ বাড়লে জীবন চলবে কি করে?
এদিকে বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্টভাবে এবারের বাজেটের যেসব উদ্যোগ মধ্যবিত্তকে চাপে ফেলবে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানো, টেলিফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, পোশাকে ভ্যাট বাড়ানো, বাড়ি ভাড়া, সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় উৎসে কর বাড়ানো এবং খাদ্যপণ্যে ট্যারিফ মূল্য বিলুপ্ত। এছাড়া পুরো বাজেটে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করে বেশি জোর দেয়া হয়েছে, যা ভোক্তা শ্রেণির ব্যয় বাড়াবে। তবে তুলনামূলকভাবে উচ্চ ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের গুরুত্ব কম বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
গত কয়েক বছর বাস্তবায়ন করতে না পারা ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আইন এবারই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ ভ্যাট আইনে বেশকিছু নিত্যপণ্যে ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। তারপরও এ আইন বাস্তবায়নে অনেক পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ হবে কিংবা আরোপকৃত ভ্যাটের পরিমাণ বাড়বে। বাজেটে বেশকিছু ক্ষেত্রে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন-যাপনে খরচের বাড়তি চাপ দিয়েই শুরু হলো নতুন অর্থবছর।
নতুন অর্থবছরে ইটিআইএন ছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও লাগবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর)। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ইটিআইএন উল্লেখ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভুয়া নম্বর দিলে দলিল বাতিল হবে। বাজেটে শুল্ক বাড়ানোর কারণে বাজারে বিদেশি গুঁড়া দুধের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। বেড়েছে আরো কিছু নিত্যপণ্যের দাম। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও গত তিন বছরের মতো একই থাকছে করমুক্ত আয়সীমা। এতে মাসে ২০,৮৩৪ টাকা নিট আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে সরকারি কোষাগারে করের অর্থ জমা দিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে বাইরে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি উৎস কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা কমানো হয়নি। করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল বেসরকারি খাতের।
কমানো হয়নি করপোরেট কর হার। মোবাইল কলরেট ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপে এ ক্ষেত্রেও মানুষকে গুনতে হবে পকেটের টাকা। অগ্রিম কর প্রত্যাহার না হওয়ায় এবং জোগানদারের ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাবে। নতুন অর্থবছর থেকে ভ্যাটের সব হারে রেয়াত নেয়ার সুযোগও থাকছে না।
এছাড়া বাজেটে শিল্পের সব কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম কর পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে এবং জোগানদারের ক্ষেত্রে ভ্যাট ৫ শতাংশর পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা ও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের সীমা এক কোটি টাকার পরিবর্তে তিন কোটি টাকা করার দাবি আমলে আনা হয়নি। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর হারে ছাড় দেয়া, সব রপ্তানি আয়ের উৎসে ন্যূনতম করহার কমানোর প্রস্তাব করা হলেও চূড়ান্ত বাজেটে আনা হয়নি।
এবারের বাজেটে ব্যক্তিগত সব গাড়ি নিবন্ধন, রুট পারমিট, ফিটনেস, মালিকানা সনদ নেয়া ও নবায়নের মাশুলের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে। মোটরসাইকেলের বিদেশি টায়ারে কর বাড়ানো হয়েছে। চিনি আমদানিতে বাজেটে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভোজ্যতেলে আরোপ করা হয়েছে ভ্যাট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যা ছিল, চূড়ান্তভাবেও মোটামুটি তাই রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েই গেল। তিনি বলেন, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল এটি কমতে পারে, তা কমেনি। তিনি বলেন, ভ্যাটের কারণে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়বে। কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্কের প্রভাবে আমদানি ব্যয় বাড়বে। এতে ব্যবসা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিভিন্ন করের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এতে মানুষের জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, জ্বালানি ও ভ্যাটের সঙ্গে সবকিছু জড়িত। বিশেষ করে পণ্যের দাম, পরিবহন ব্যয় এবং বাসাভাড়া। ফলে এর প্রভাব জীবনযাত্রার সবগুলো খাতেই পড়বে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে বড় একটি শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরা হয়তো সঞ্চয় ভেঙে খাবে, অথবা তাদের জীবনযাত্রার মান কমবে।
No comments