বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা: রিফাত ফরাজী ৭ দিনের রিমান্ডে by মো. মিজানুর রহমান
বরগুনার
আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে
বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর এবার দ্বিতীয় আসামি রিফাত ফরাজী (২৫)কে
গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাত দুইটার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে
রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল দুপুরে আদালতে হাজির করলে ৭
দিনের রিমান্ডে পাঠায় বিচারক। বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বুধবার
রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তার ও এই মামলার অন্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার নিয়ে তথ্য
জানাতে সংবাদ সম্মেলন করেন বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম। সংবাদ
সম্মেলনে ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত দুইটার দিকে গোপন
সংবাদের ভিত্তিতে রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কীভাবে তাকে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাচ্ছে না।’ রিফাত শরীফ
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
মামলাটি মাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। অপরাধকে আমরা অপরাধ হিসেবেই দেখবো।
এর সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’
এদিকে গত সোমবার রাতে বরগুনা শহরের শেখ রাসেল স্কয়ারে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেনের বাসায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় শুধু চেয়ারম্যানের বাসায়ই নয়, তার কার্যালয়েও অভিযান চালানো হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব অভিযানের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি। ধারণা করা হচ্ছে, রিফাত শরীফ খুনের মামলার অন্য দুই প্রধান আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ভাই রিশান ফরাজীকে ধরতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। এ দুই আসামি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ভায়রার ছেলে। ওই অভিযানের পরই বরগুনায় রিফাত ও রিশানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
রিফাত ফরাজীর ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর: গ্রেপ্তারকৃত রিফাত ফরাজীকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বুধবার দুপুর ২টার দিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে রিফাত ফরাজীকে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বরগুনা সদর থানার ওসি (তদন্ত) ও রিফাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, বেলা ২টার দিকে তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করি। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’
রিফাত ও রিশান ফরাজীর খতিয়ান: রিফাত ও রিশান আপন ভাই। একসঙ্গেই তারা সব অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়ক এলাকার মো. দুলাল ফরাজীর বড় ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। বুধবার সকালে ধানসিঁড়ি সড়কের রিফাত ও রিশান ফরাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির মূলফটক ও বাসার দরজা তালাবদ্ধ। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বখাটেপনায় বাবা দুলাল ফরাজীর ছিল প্রত্যক্ষ সমর্থন। কাউকে কুপিয়ে জখম, মারধর কিংবা লাঞ্ছিতের খবরে শাসন তো দূরে থাক বরং সন্তানদের এমন অপকর্মে নিজেকে গর্বিত পিতা মনে করতেন দুলাল ফরাজী। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজী সম্পর্কে এমন তথ্যই দিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে রিফাত ও রিশানের পিতা দুলাল সম্পর্কে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দুলালের পৈতৃক বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬ নং বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বরগুনা পৌরসভায় চার নং ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। সেখানেই পর্যায়ক্রমে জন্ম ও বেড়ে ওঠা রিফাত ও রিশানের। বড় ছেলে রিফাত কিশোর বয়স থেকেই বখাটে স্বভাবের ছিল। মাধ্যমিকের স্তর অতিক্রমের আগেই পড়াশোনা সাঙ্গ হয় তার। ছোট ছেলে রিশান বরগুনা সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও বড় ভাইয়ের আছর লাগে রিশানের। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ‘বড়ভাই’ হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে উভয়কে। ‘বড়ভাই’ হওয়ার মিশনে কারণে-অকারণে বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজনকে লাঞ্ছিত করতে থাকে তারা। এর মধ্যে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাতের সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালের দিকে নয়ন বন্ড তৈরি করে ০০৭ গ্রুপ। এই গ্রুপে যুক্ত হয় বেশ কিছু উঠতি বয়সী তরুণ। এলাকায় নতুন কোনো তরুণের আকস্মিক আগমন ঘটলে তাকে বাধ্য করা হতো গ্রুপের সদস্য হতে। মাদকব্যবসায়ী নয়ন বন্ডের সঙ্গে সখ্যে যোগ হয় নতুন মাত্রা।
ধানসিঁড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রিফাত শরীফ খুন হওয়ার পর থেকে রিফাত ফরাজীদের ঘরের দরজা তালাবদ্ধ ও বাড়ির গেট ভেতর থেকে আটকানো দেখতে পান তারা। ধানসিঁড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নয়ন বন্ডের ডান হাত ও বাম হাত হিসেবে কাজ করতো এই দুই ভাই। মাদকসেবন ও মাদক ব্যবসাই ছিল এদের মূল পেশা। এদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাই ও ছাত্রদের মেসে ঢুকে মুঠোফোন কেড়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ই জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন রিফাত ফরাজী।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী তরিকুল জানান, একদিন তার সঙ্গে রিফাত ফরাজীর সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস ওই সন্ত্রাসীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে নিজ বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। এতেও ক্ষোভ কমেনি রিফাত ফরাজীর। দেড় মাসের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তরিকুল তার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হয়। এসময় রিফাত দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তরিকুলের মাথায় গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
২০১৭ সালে বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।
এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ‘ডিকেপি রোডে আমাদের ভাড়া দেয়া বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।’
রিফাতের বিষয়ে বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় চারটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মারামারি এবং একটি মাদকের মামলা। ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৮ই নভেম্বর রিফাতের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছিল। এরপর রিফাতের বিরুদ্ধে মাদকের আর কোনো মামলা হয়নি। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে রিফাতকে পুলিশ মাদকসহ আটক করেছিল। ওই ঘটনার পর তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাও দেয়া হয়েছিল।
বরিশালের মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলিকেয়ারের তৎকালীন চেয়ারম্যান আরিফ খান বলেন, প্রায় বছর তিনেক আগে রিফাতের পরিবার তাকে হলিকেয়ারে ভর্তি করেছিল। কিছুদিন চিকিৎসার পর হলিকেয়ার থেকে নিয়ে আসে। পুরো চিকিৎসা না করানোর ফলে বরগুনায় এসেই রিফাত আবার মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
বরিশালের আরেকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘সেইফ দ্য লাইফের’ চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সুমন বলেন, পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে মাদকসেবীদের আটক করে পুলিশের জিম্মায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। বরগুনার রিফাত ফরাজীকে পুলিশ আটক করে তাদের জিম্মায় রেখে ‘সেইফ দ্য লাইফে’ চিকিৎসা করিয়েছিল।
মামলার বর্তমান অবস্থা: রিফাত ফরাজীকে নিয়ে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৫ জন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া এ মামলার প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজি (২৩), ৪ নম্বর আসামি চন্দন (২১), ৯ নম্বর আসামি মো. হাসান (১৯), ১১ নম্বর আসামি মো. অলিউল্লাহ অলি (২২) ও ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় (২১)। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্ততে গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. নাজমুল হাসান (১৯), তানভীর (২২), মো. সাগর (১৯), কামরুল হাসান সাইমুন (২১) ও মো. রাফিউল ইসলাম রাব্বি। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে চন্দন ও হাসান সাত দিনের এবং সাগর, সাইমুন ও নাজমুল পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছেন। আর রিফাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মামলার ১১ নম্বর আসামি অলি ও ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া অভিযুক্ত তানভীর।
এর সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’
এদিকে গত সোমবার রাতে বরগুনা শহরের শেখ রাসেল স্কয়ারে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেনের বাসায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় শুধু চেয়ারম্যানের বাসায়ই নয়, তার কার্যালয়েও অভিযান চালানো হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব অভিযানের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি। ধারণা করা হচ্ছে, রিফাত শরীফ খুনের মামলার অন্য দুই প্রধান আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ভাই রিশান ফরাজীকে ধরতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। এ দুই আসামি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ভায়রার ছেলে। ওই অভিযানের পরই বরগুনায় রিফাত ও রিশানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
রিফাত ফরাজীর ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর: গ্রেপ্তারকৃত রিফাত ফরাজীকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বুধবার দুপুর ২টার দিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে রিফাত ফরাজীকে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বরগুনা সদর থানার ওসি (তদন্ত) ও রিফাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, বেলা ২টার দিকে তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করি। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’
রিফাত ও রিশান ফরাজীর খতিয়ান: রিফাত ও রিশান আপন ভাই। একসঙ্গেই তারা সব অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়ক এলাকার মো. দুলাল ফরাজীর বড় ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। বুধবার সকালে ধানসিঁড়ি সড়কের রিফাত ও রিশান ফরাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির মূলফটক ও বাসার দরজা তালাবদ্ধ। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বখাটেপনায় বাবা দুলাল ফরাজীর ছিল প্রত্যক্ষ সমর্থন। কাউকে কুপিয়ে জখম, মারধর কিংবা লাঞ্ছিতের খবরে শাসন তো দূরে থাক বরং সন্তানদের এমন অপকর্মে নিজেকে গর্বিত পিতা মনে করতেন দুলাল ফরাজী। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজী সম্পর্কে এমন তথ্যই দিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে রিফাত ও রিশানের পিতা দুলাল সম্পর্কে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দুলালের পৈতৃক বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬ নং বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বরগুনা পৌরসভায় চার নং ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। সেখানেই পর্যায়ক্রমে জন্ম ও বেড়ে ওঠা রিফাত ও রিশানের। বড় ছেলে রিফাত কিশোর বয়স থেকেই বখাটে স্বভাবের ছিল। মাধ্যমিকের স্তর অতিক্রমের আগেই পড়াশোনা সাঙ্গ হয় তার। ছোট ছেলে রিশান বরগুনা সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও বড় ভাইয়ের আছর লাগে রিশানের। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ‘বড়ভাই’ হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে উভয়কে। ‘বড়ভাই’ হওয়ার মিশনে কারণে-অকারণে বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজনকে লাঞ্ছিত করতে থাকে তারা। এর মধ্যে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাতের সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালের দিকে নয়ন বন্ড তৈরি করে ০০৭ গ্রুপ। এই গ্রুপে যুক্ত হয় বেশ কিছু উঠতি বয়সী তরুণ। এলাকায় নতুন কোনো তরুণের আকস্মিক আগমন ঘটলে তাকে বাধ্য করা হতো গ্রুপের সদস্য হতে। মাদকব্যবসায়ী নয়ন বন্ডের সঙ্গে সখ্যে যোগ হয় নতুন মাত্রা।
ধানসিঁড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রিফাত শরীফ খুন হওয়ার পর থেকে রিফাত ফরাজীদের ঘরের দরজা তালাবদ্ধ ও বাড়ির গেট ভেতর থেকে আটকানো দেখতে পান তারা। ধানসিঁড়ি সড়কের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নয়ন বন্ডের ডান হাত ও বাম হাত হিসেবে কাজ করতো এই দুই ভাই। মাদকসেবন ও মাদক ব্যবসাই ছিল এদের মূল পেশা। এদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাই ও ছাত্রদের মেসে ঢুকে মুঠোফোন কেড়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ই জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন রিফাত ফরাজী।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী তরিকুল জানান, একদিন তার সঙ্গে রিফাত ফরাজীর সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস ওই সন্ত্রাসীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে নিজ বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। এতেও ক্ষোভ কমেনি রিফাত ফরাজীর। দেড় মাসের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তরিকুল তার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হয়। এসময় রিফাত দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তরিকুলের মাথায় গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
২০১৭ সালে বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।
এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ‘ডিকেপি রোডে আমাদের ভাড়া দেয়া বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।’
রিফাতের বিষয়ে বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় চারটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মারামারি এবং একটি মাদকের মামলা। ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৮ই নভেম্বর রিফাতের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছিল। এরপর রিফাতের বিরুদ্ধে মাদকের আর কোনো মামলা হয়নি। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে রিফাতকে পুলিশ মাদকসহ আটক করেছিল। ওই ঘটনার পর তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাও দেয়া হয়েছিল।
বরিশালের মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলিকেয়ারের তৎকালীন চেয়ারম্যান আরিফ খান বলেন, প্রায় বছর তিনেক আগে রিফাতের পরিবার তাকে হলিকেয়ারে ভর্তি করেছিল। কিছুদিন চিকিৎসার পর হলিকেয়ার থেকে নিয়ে আসে। পুরো চিকিৎসা না করানোর ফলে বরগুনায় এসেই রিফাত আবার মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
বরিশালের আরেকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘সেইফ দ্য লাইফের’ চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সুমন বলেন, পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে মাদকসেবীদের আটক করে পুলিশের জিম্মায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। বরগুনার রিফাত ফরাজীকে পুলিশ আটক করে তাদের জিম্মায় রেখে ‘সেইফ দ্য লাইফে’ চিকিৎসা করিয়েছিল।
মামলার বর্তমান অবস্থা: রিফাত ফরাজীকে নিয়ে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৫ জন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া এ মামলার প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজি (২৩), ৪ নম্বর আসামি চন্দন (২১), ৯ নম্বর আসামি মো. হাসান (১৯), ১১ নম্বর আসামি মো. অলিউল্লাহ অলি (২২) ও ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় (২১)। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্ততে গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. নাজমুল হাসান (১৯), তানভীর (২২), মো. সাগর (১৯), কামরুল হাসান সাইমুন (২১) ও মো. রাফিউল ইসলাম রাব্বি। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে চন্দন ও হাসান সাত দিনের এবং সাগর, সাইমুন ও নাজমুল পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছেন। আর রিফাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মামলার ১১ নম্বর আসামি অলি ও ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া অভিযুক্ত তানভীর।
No comments