প্রস্তাবিত মার্কিন-লংকা চুক্তি নিয়ে ভারতের নিরবতায় লংকান কৌশলগত সম্প্রদায়ে কৌতুহল
যুক্তরাষ্ট্রের
সাথে ব্যাপক বিতর্কিত স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (এসওএফএ) চুক্তির
দ্বারপ্রান্তে রয়েছে শ্রীলংকা। কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তি দ্বীপ
রাষ্ট্রটিকে বহু মিলিয়ন মার্কিন পেশাজীবী, প্রতিরক্ষা দফতরের কর্মী ও
প্রতিরক্ষা দফতরের ঠিকাদারদের শিকারভূমিতে পরিণত করবে।
মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশান (এমসিসি) থেকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে বিতর্কিত এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে এবং সেটা মার্কিন কংগ্রেস এবং লংকান মন্ত্রিসভায় পাস হলে এর অধীনে বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু প্রধানত, এর অধীনে রয়েছে ২০০ কিমি দীর্ঘ কলম্বো-ত্রিনকোমালি ইকোনমিক করিডোর (সিটিইসি), যেটার মাধ্যমে পশ্চিম উপকূলের সাথে পূর্ব উপকূল যুক্ত হবে।
শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. পালিথা কোহোনার মতে, এমসিসির জন্য সরকারকে ভূমি আইন পরিবর্তন করতে হবে যাতে নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের দেয়া জমি পৃথক করা যায়। বিদেশীরাও এখানে ক্রেতা হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন যে, সিট’ইসি’র মাধ্যমেও ১৯৮৭ সালের ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ড লঙ্ঘিত হবে, যেখানে ভারতের প্রতি শত্রুতাপ্রবণ কোন দেশের কাছে শ্রীলংকার কোন বন্দর বা বিমান বন্দর হস্তান্তরে বাধা আছে। ড. কোহোনা বলেন, ত্রিনকোমালিকে সরঞ্জামের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা বহুবার বলেছেন যে, তিনি এসওএফএ চুক্তির বিরোধী কারণ এতে দেশের সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। তিনি এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিলক মারাপোনাকে নির্দেশনাও দেন যাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরকে এটা জানান যে, বর্তমান কাঠামোতে এসওএফএ চুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণভাবে মার্কিন-পন্থী প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গেরও এই চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। কারণ তার সম্মতি ছাড়া তার দলের সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারাপোনা আমেরিকাকে এসওএফএ চুক্তির ত্রুটির ব্যাপারে অবগত করতে পারবে না।
একমাত্র অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা সর্বোতভাবে এসওএফএ এবং এমসিসি চুক্তির পক্ষে রয়েছেন।
এসিএসএ ২০১৭ ও এসওএফএ
সাবেক লংকান নৌবাহিনী প্রধান ও পাথফাইন্ডার ফাউন্ডেশানের নৌ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যাডমিরাল ড. জয়ানাথ কলম্বেজ বলেছেন যে, ২০০৭ সালে যে অ্যাকসেস অ্যান্ড সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটা খুবই সাদামাটা ছিল। মার্কিন সেনারা যাতে এখানে এসে লংকান সামরিক বাহিনীর সাথে যৌথ প্রশিক্ষণ মহড়ায় অংশ নিতে পারে, সেজন্য ওই চুক্তি করা হয়েছিল।
তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চলাকালে শ্রীলংকার পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন ড. পালিথা কোহোনা। তিনি বলেন যে, এসিএসএ ২০০৭ চুক্তি ছিল নির্দিষ্ট ১০ বছরের জন্য। ২০১৭ সালে যখন এটা নবায়নের প্রশ্ন আসলো, এসিএসএ’র চেহারা তখন বদলে গেছে। এটা তখন ৮৩ পাতার একটি দলিল যেখানে ৫০ এর বেশি সংযোজন রয়েছে। তাছাড়া, এটা ছিন ‘উন্মুক্ত’। এর অর্থ হলো, এখানে কোন সময়ের বিধিনিষেধ ছিল না।
এর পর যুক্তরাষ্ট্র এসিএসএ’র বদলে এসওএফএ চুক্তির প্রস্তাব দেয়। সানডে টাইমসের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে তাদের বিমান ও যানবাহনে কোন ধরনের পরিদর্শন করা যাবে না। এর অর্থ হলো শ্রীলংকান নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড বা কাস্টমসের কেউ শ্রীলংকার বিমানবন্দর বা সমুদ্র বন্দরে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের কোন সামরিক যানবাহন বা বিমান পরিদর্শন করতে পারবে না। তারা এমনকি স্থলেও তাদের যানবাহনকে পরীক্ষা করতে পারবে না, আন্তর্জাতিকভাবে যে অধিকার বিশ্বের সকল দেশের রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র একই সাথে লাইসেন্স, কাস্টমস শুল্ক, কর এবং অন্যান্য ফি থেকেও নিষ্কৃতি চায়।
শ্রীলংকার যে কোন স্থানে কাজ করার সময় মার্কিন সেনারা যাতে তাদের পোশাক পড়তে পারে, এবং অস্ত্র ও যোগাযোগ সরঞ্জাম বহন করতে পারে, সে অনুমোদন চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শ্রীলংকার সংবিধান ও সাধারণ আইন অনুসারে, শুধুমাত্র সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের এই অধিকার রয়েছে।
সেই সাথে ওয়াশিংটন চায় যাতে মার্কিন সেনা এবং ঠিকাদাররা ব্যক্তিগত ও জোটগত শুধুমাত্র মার্কিন পরিচয়পত্র ব্যবহার করে শ্রীলংকায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হতে পারে। সানডে টাইমসের মতে, এর অর্থ হলো তারা কোন পাসপোর্ট বা ভিসা বহন করবে না।
১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট লঙ্ঘিত হচ্ছে
এসওএফএ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট লঙ্ঘিত হচ্ছে, যেখানে পারস্পরিক বিনিময়ের উপর জোর দেয়া হয়েছে। যদি কোন দেশ, ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলংকায় যদি বিশেষ কূটনীতিক সুবিধা পায় এবং শ্রীলংকার জনবলকে যুক্তরাষ্ট্রে একই সুবিধা দেয়া না হয়, তাহলে শ্রীলংকা সরকার দ্বীপরাষ্ট্রে মার্কিন জনশক্তিকে ওই সুবিধা দেয়া বাতিল করতে পারবে।
তাই, ১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট অনুসারে ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সময়ে স্বাক্ষরিত এসওএফএ চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা যাবে না। যখন লংকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবশেষ যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দফতরকে এটা জানানো হয়েছে।
জোট-নিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন
ড. কোহোনার মতে, এসওএফএ চুক্তি শ্রীলংকার জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, কারণ এর মাধ্যমে শ্রীলংকার সকলের বন্ধু হওয়া এবং কারো শত্রু হওয়া থেকে বিরত থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
তিনি প্রশ্ন করেন, “যেহেতু আমরা কোন দেশ থেকে হুমকির মুখে নেই, তাহলে একটা পরাশক্তির সাথে এই ধরনের ব্যাপক-ভিত্তিক চুক্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন কেন, যদি না ওই পরাশক্তি শ্রীলংকাকে চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়?”
কোহোনা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চীনের শক্তির উত্থানের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং এসওএফএ সন্দেহাতীতভাবে শ্রীলংকাকে একটা সিনো-মার্কিন সঙ্ঘাতের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।
ভারতের নিরবতা রহস্যজনক
অ্যাডমিরাল কলম্বেজ উল্লেখ করেন যে, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারত অন্যতম প্রধান শক্তি এবং শ্রীলংকা ও যুক্তরাষ্ট্রের এসওএফএ চুক্তি নিয়ে তারা নিরব রয়েছে।
তিনি মনে করেন না যে, ভারত শ্রীলংকায় মার্কিন আধিপত্য চাইবে বা ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থে চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলে সবসময়ই একমত হবে তারা।
অ্যাডমিরাল কলম্বেজের বিশ্বাস, “বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য চীনের সাথে সুসম্পর্ক চায় ভারত। সে কারণে ভারত এখানে উদ্বিগ্ন এবং নিজেদের মতো করে নিরবে ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। ভারত তাদের কূটনীতিক অর্জন নিরবেই হাসিল করে”।
তবে, তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, অতীত হয়তো ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি স্মরণ করেন, “অতীতে ভারত নৌ শক্তির দিক থেকে অন্ধ ছিল। তাদের নৌ শক্তির সীমাবদ্ধতার কারণেই ২৬/১১ এর মুম্বাই হামলা হতে পেরেছে এবং তাদের এই সীমাবদ্ধতার কারণেই ভারত মহাসাগরে চীন তাদের শক্তির বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে”।
ড. কোহোনা বলেন যে, এমসিসির অধীনে ত্রিনকোমালিকে লজিস্টিক ঘাঁটিতে রূপান্তরের বিষয়টি এসওএফএ’র সাথে সম্পৃক্ত। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারতের এতে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
কোহোনা উল্লেখ করেন যে, ১৯৮৭ সালের ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ডে বলা হয়েছে যে, শ্রীলংকা তাদের কোন বন্দর বা পোতাশ্রয়কে এমন কোন দেশের কাছে দিতে পারবে না, যেখানে এই বন্দরগুলো সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সেটা ভারতের জন্য প্রতিকূল হবে।
অভিজ্ঞ এই কূটনীতিক বলেন, “ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ড একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যেটা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই”।
এসওএফএ’র অর্থনৈতিক যুক্তি
তবে, শ্রীলংকায় এসওএফএ চুক্তির অন্যতম কট্টর সমর্থক হলেন অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা। এই চুক্তি বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কা সম্প্রতি তিনি নাকচ করে দেন।
সামারাবিরা বলেন, “১৯৯৫ সালে, প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সময়ে একটা এসওএফএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে দেশের কোন ক্ষতি হয়নি। এখন যে আলোচনা চলছে, সেই আগের চুক্তি নবায়নের জন্যই সেটা হচ্ছে”।
তিনি বলেন, “তাছাড়া শ্রীলংকার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না, কারণ বছরে তারা শ্রীলংকা থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা ক্রয় করে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় রফতানি অংশীদার। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই শ্রীলংকার ৫ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস শিল্পের অন্যতম বৃহৎ দুই ক্রেতা”।
মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশান (এমসিসি) থেকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে বিতর্কিত এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে এবং সেটা মার্কিন কংগ্রেস এবং লংকান মন্ত্রিসভায় পাস হলে এর অধীনে বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু প্রধানত, এর অধীনে রয়েছে ২০০ কিমি দীর্ঘ কলম্বো-ত্রিনকোমালি ইকোনমিক করিডোর (সিটিইসি), যেটার মাধ্যমে পশ্চিম উপকূলের সাথে পূর্ব উপকূল যুক্ত হবে।
শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. পালিথা কোহোনার মতে, এমসিসির জন্য সরকারকে ভূমি আইন পরিবর্তন করতে হবে যাতে নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের দেয়া জমি পৃথক করা যায়। বিদেশীরাও এখানে ক্রেতা হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন যে, সিট’ইসি’র মাধ্যমেও ১৯৮৭ সালের ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ড লঙ্ঘিত হবে, যেখানে ভারতের প্রতি শত্রুতাপ্রবণ কোন দেশের কাছে শ্রীলংকার কোন বন্দর বা বিমান বন্দর হস্তান্তরে বাধা আছে। ড. কোহোনা বলেন, ত্রিনকোমালিকে সরঞ্জামের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা বহুবার বলেছেন যে, তিনি এসওএফএ চুক্তির বিরোধী কারণ এতে দেশের সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। তিনি এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিলক মারাপোনাকে নির্দেশনাও দেন যাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরকে এটা জানান যে, বর্তমান কাঠামোতে এসওএফএ চুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণভাবে মার্কিন-পন্থী প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গেরও এই চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। কারণ তার সম্মতি ছাড়া তার দলের সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারাপোনা আমেরিকাকে এসওএফএ চুক্তির ত্রুটির ব্যাপারে অবগত করতে পারবে না।
একমাত্র অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা সর্বোতভাবে এসওএফএ এবং এমসিসি চুক্তির পক্ষে রয়েছেন।
এসিএসএ ২০১৭ ও এসওএফএ
সাবেক লংকান নৌবাহিনী প্রধান ও পাথফাইন্ডার ফাউন্ডেশানের নৌ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যাডমিরাল ড. জয়ানাথ কলম্বেজ বলেছেন যে, ২০০৭ সালে যে অ্যাকসেস অ্যান্ড সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটা খুবই সাদামাটা ছিল। মার্কিন সেনারা যাতে এখানে এসে লংকান সামরিক বাহিনীর সাথে যৌথ প্রশিক্ষণ মহড়ায় অংশ নিতে পারে, সেজন্য ওই চুক্তি করা হয়েছিল।
তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চলাকালে শ্রীলংকার পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন ড. পালিথা কোহোনা। তিনি বলেন যে, এসিএসএ ২০০৭ চুক্তি ছিল নির্দিষ্ট ১০ বছরের জন্য। ২০১৭ সালে যখন এটা নবায়নের প্রশ্ন আসলো, এসিএসএ’র চেহারা তখন বদলে গেছে। এটা তখন ৮৩ পাতার একটি দলিল যেখানে ৫০ এর বেশি সংযোজন রয়েছে। তাছাড়া, এটা ছিন ‘উন্মুক্ত’। এর অর্থ হলো, এখানে কোন সময়ের বিধিনিষেধ ছিল না।
এর পর যুক্তরাষ্ট্র এসিএসএ’র বদলে এসওএফএ চুক্তির প্রস্তাব দেয়। সানডে টাইমসের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে তাদের বিমান ও যানবাহনে কোন ধরনের পরিদর্শন করা যাবে না। এর অর্থ হলো শ্রীলংকান নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড বা কাস্টমসের কেউ শ্রীলংকার বিমানবন্দর বা সমুদ্র বন্দরে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের কোন সামরিক যানবাহন বা বিমান পরিদর্শন করতে পারবে না। তারা এমনকি স্থলেও তাদের যানবাহনকে পরীক্ষা করতে পারবে না, আন্তর্জাতিকভাবে যে অধিকার বিশ্বের সকল দেশের রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র একই সাথে লাইসেন্স, কাস্টমস শুল্ক, কর এবং অন্যান্য ফি থেকেও নিষ্কৃতি চায়।
শ্রীলংকার যে কোন স্থানে কাজ করার সময় মার্কিন সেনারা যাতে তাদের পোশাক পড়তে পারে, এবং অস্ত্র ও যোগাযোগ সরঞ্জাম বহন করতে পারে, সে অনুমোদন চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শ্রীলংকার সংবিধান ও সাধারণ আইন অনুসারে, শুধুমাত্র সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের এই অধিকার রয়েছে।
সেই সাথে ওয়াশিংটন চায় যাতে মার্কিন সেনা এবং ঠিকাদাররা ব্যক্তিগত ও জোটগত শুধুমাত্র মার্কিন পরিচয়পত্র ব্যবহার করে শ্রীলংকায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হতে পারে। সানডে টাইমসের মতে, এর অর্থ হলো তারা কোন পাসপোর্ট বা ভিসা বহন করবে না।
১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট লঙ্ঘিত হচ্ছে
এসওএফএ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট লঙ্ঘিত হচ্ছে, যেখানে পারস্পরিক বিনিময়ের উপর জোর দেয়া হয়েছে। যদি কোন দেশ, ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলংকায় যদি বিশেষ কূটনীতিক সুবিধা পায় এবং শ্রীলংকার জনবলকে যুক্তরাষ্ট্রে একই সুবিধা দেয়া না হয়, তাহলে শ্রীলংকা সরকার দ্বীপরাষ্ট্রে মার্কিন জনশক্তিকে ওই সুবিধা দেয়া বাতিল করতে পারবে।
তাই, ১৯৯৬ সালের ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজ অ্যাক্ট অনুসারে ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সময়ে স্বাক্ষরিত এসওএফএ চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা যাবে না। যখন লংকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবশেষ যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দফতরকে এটা জানানো হয়েছে।
জোট-নিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন
ড. কোহোনার মতে, এসওএফএ চুক্তি শ্রীলংকার জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, কারণ এর মাধ্যমে শ্রীলংকার সকলের বন্ধু হওয়া এবং কারো শত্রু হওয়া থেকে বিরত থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
তিনি প্রশ্ন করেন, “যেহেতু আমরা কোন দেশ থেকে হুমকির মুখে নেই, তাহলে একটা পরাশক্তির সাথে এই ধরনের ব্যাপক-ভিত্তিক চুক্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন কেন, যদি না ওই পরাশক্তি শ্রীলংকাকে চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়?”
কোহোনা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চীনের শক্তির উত্থানের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং এসওএফএ সন্দেহাতীতভাবে শ্রীলংকাকে একটা সিনো-মার্কিন সঙ্ঘাতের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।
ভারতের নিরবতা রহস্যজনক
অ্যাডমিরাল কলম্বেজ উল্লেখ করেন যে, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারত অন্যতম প্রধান শক্তি এবং শ্রীলংকা ও যুক্তরাষ্ট্রের এসওএফএ চুক্তি নিয়ে তারা নিরব রয়েছে।
তিনি মনে করেন না যে, ভারত শ্রীলংকায় মার্কিন আধিপত্য চাইবে বা ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থে চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলে সবসময়ই একমত হবে তারা।
অ্যাডমিরাল কলম্বেজের বিশ্বাস, “বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য চীনের সাথে সুসম্পর্ক চায় ভারত। সে কারণে ভারত এখানে উদ্বিগ্ন এবং নিজেদের মতো করে নিরবে ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। ভারত তাদের কূটনীতিক অর্জন নিরবেই হাসিল করে”।
তবে, তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, অতীত হয়তো ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি স্মরণ করেন, “অতীতে ভারত নৌ শক্তির দিক থেকে অন্ধ ছিল। তাদের নৌ শক্তির সীমাবদ্ধতার কারণেই ২৬/১১ এর মুম্বাই হামলা হতে পেরেছে এবং তাদের এই সীমাবদ্ধতার কারণেই ভারত মহাসাগরে চীন তাদের শক্তির বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে”।
ড. কোহোনা বলেন যে, এমসিসির অধীনে ত্রিনকোমালিকে লজিস্টিক ঘাঁটিতে রূপান্তরের বিষয়টি এসওএফএ’র সাথে সম্পৃক্ত। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারতের এতে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
কোহোনা উল্লেখ করেন যে, ১৯৮৭ সালের ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ডে বলা হয়েছে যে, শ্রীলংকা তাদের কোন বন্দর বা পোতাশ্রয়কে এমন কোন দেশের কাছে দিতে পারবে না, যেখানে এই বন্দরগুলো সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সেটা ভারতের জন্য প্রতিকূল হবে।
অভিজ্ঞ এই কূটনীতিক বলেন, “ইন্দো-লংকা অ্যাকোর্ড একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যেটা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই”।
এসওএফএ’র অর্থনৈতিক যুক্তি
তবে, শ্রীলংকায় এসওএফএ চুক্তির অন্যতম কট্টর সমর্থক হলেন অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা। এই চুক্তি বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কা সম্প্রতি তিনি নাকচ করে দেন।
সামারাবিরা বলেন, “১৯৯৫ সালে, প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সময়ে একটা এসওএফএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে দেশের কোন ক্ষতি হয়নি। এখন যে আলোচনা চলছে, সেই আগের চুক্তি নবায়নের জন্যই সেটা হচ্ছে”।
তিনি বলেন, “তাছাড়া শ্রীলংকার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না, কারণ বছরে তারা শ্রীলংকা থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা ক্রয় করে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় রফতানি অংশীদার। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই শ্রীলংকার ৫ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস শিল্পের অন্যতম বৃহৎ দুই ক্রেতা”।
শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিলক মারাপোনা ও তার মার্কিন প্রতিপক্ষ মাইক পম্পেও |
No comments