তারা কি ফিরবে, ফিরতে চাইবে? by এ কে এম জাকারিয়া
গত
বছরের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে এসেছে এমন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০
লাখ ৬৮ হাজার ২৩৬ জন। এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে
বাংলাদেশ একটি চুক্তি সই করে গত ২৩ নভেম্বর। সেই চুক্তির বাস্তবায়ন ও
শরণার্থীদের পাঠানো শুরু করা নিয়ে দুই পক্ষের নানা কাজকর্মের খবর আমরা
পত্রপত্রিকায় পাই। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ব্রিফিং করে নানা অগ্রগতির
কথা জানায়, আশাবাদের কথা শোনায়। কিন্তু আমরা দেখছি রোহিঙ্গারা আসছেই।
চুক্তি সইয়ের পর গত ৮৩ দিনে বাংলাদেশে এসেছে আরও ১০ হাজার ৫৮১ জন রোহিঙ্গা।
গত বুধবারও বাংলাদেশে ঢুকেছে ২১৩ জন। তবু আমরা ‘আশাবাদী’ যে রোহিঙ্গাদের
ফেরত পাঠানো যাবে। আশার ওপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের সম্ভবত এখন কিছু করারও
নেই! চুক্তির ফসল বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা স্পষ্টতই মিয়ানমারের গোলাতেই
উঠেছে। বাংলাদেশে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে এবং যাদের আশ্রয় দিয়ে একটি
মানবিক জাতি হিসেবে বাংলাদেশে বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছে,
সেই শরণার্থীদের আমরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা জোর করে ফেরত পাঠাতে পারব
না। আন্তর্জাতিক আইনও তা অনুমোদন করে না। বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তিতেও বলা
আছে যে স্বেচ্ছায় যারা ফিরতে চাইবে, তাদেরই মিয়ানমার ফেরত নেবে। খুব সহজ
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এখন যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে, তারা কি
‘স্বেচ্ছায়’ মিয়ানমারে ফিরতে চাইবে? আমাদের সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনা
বোধ কী বলে? ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কোন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের রাখাইন
রাজ্য ছেড়েছে, তা আমাদের জানা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বর্মিদের
বর্বরতার অনেক কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। এখানে যারা এসেছে, তারা
অনেকেই তাদের আপনজনকে হারিয়েছে, চোখের সামনে আপনজনকে খুন হতে দেখেছে,
নিজেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, বাড়িঘর ধ্বংস হতে ও পুড়ে যেতে দেখেছে। সেই
দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা নয়। এরপরও সবাই নিশ্চয়
নিজের বাড়িঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি কি আদৌ তাদের
বাড়িঘরে ফেরার নিশ্চয়তা দিচ্ছে? চুক্তি অনুযায়ী ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের
অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে। কত দিন সেখানে থাকতে হবে, তার কোনো
সময়সীমা নেই। সেখানে তাদের যাচাই-বাছাই হবে। সেই পরীক্ষায় তারা উতরে যেতে
পারবে, এমন কোনো ভরসা নেই। আর এ ধরনের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো যে কার্যত বন্দী
শিবিরে পরিণত হবে না, তা কে বলতে পারে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তখন নিজের
নিয়ন্ত্রিত এসব শিবিরে রোহিঙ্গাদের ওপর যাচ্ছেতাই করবে না, সেই নিশ্চয়তা কে
দেবে? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের
বাড়িঘর, স্থাপনা, গাছপালা, এমনকি কৃষিজমিও সাফসুতরো করে ফেলা হচ্ছে। এতে
ধ্বংসযজ্ঞের কোনো চিহ্ন যেমন থাকবে না, তেমনি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের আবাস
খুঁজে পাওয়ারও কোনো পথ থাকবে না। রোহিঙ্গারা তবে স্বেচ্ছায় ফিরতে চাইবে কোন
ভরসায়? মিয়ানমারের সরকার বা সেনাবাহিনী যে তাদের রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাবে
কোনো পরিবর্তন এনেছে এমন কোনো প্রমাণ কিন্তু আমরা পাই না। প্রত্যাবাসন
চুক্তি সই হওয়ার পর এ পর্যন্ত আরও ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে
প্রবেশ প্রমাণ করে যে আরাকান রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর
অত্যাচার-নির্যাতন থামেনি। রোহিঙ্গাদের অব্যাহত বাংলাদেশে প্রবেশ এখানে
আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের ফিরতে স্বাভাবিকভাবেই নিরুৎসাহিত করবে। শরণার্থীরা
যাতে স্বেচ্ছায় ফিরতে আগ্রহী না হয়, সে জন্য ভীতি বজায় রাখতে মিয়ানমার এমন
কৌশল নিয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার
ব্যাপারে শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা কী ভাবছে, তা জানতে তাদের সঙ্গে
কথা বলতে অনুরোধ করেছিলাম প্রথম আলোর টেকনাফ প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিনকে।
তিনি বললেন, শরণার্থীরা সাধারণভাবে রাখাইনে ফিরে গিয়ে কোনো আশ্রয় শিবির বা
শেডে থাকতে চায় না। তারা রাখাইনে ফিরতে চায় ঠিকই, কিন্তু তারা ফিরতে চায়
নিজেদের গ্রামে। বাড়িঘর ও জমি ফেরতের নিশ্চয়তা চায়। রোহিঙ্গারা মনে করছে,
আশ্রয় শিবিরে যাওয়া মানে তাদের বন্দী অবস্থায় থাকতে হবে। শিবিরের বাইরে
তারা কোথাও যেতে পারবে না। সে তুলনায় বাংলাদেশে তারা অনেক ভালো আছে, এখানে
তাদের চলাচলে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মনে আছে, বাংলাদেশে যখন রোহিঙ্গাদের
ঢল নেমেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ
দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই সংকটের গভীরতা তুলে ধরেছিলেন। তিনি সেখানে
সংকটের সমাধানে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রথমত,
অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ
করা; দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি
অনুসন্ধানী দল পাঠানো; তৃতীয়ত, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের
নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের
তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় (সেফ জোন) গড়ে তোলা; চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য থেকে
জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে
প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের
সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে
চুক্তি করেছে সেখানে জাতিসংঘে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব বা এর চেতনার
বাস্তবায়ন ঘটেনি। বিশেষ করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের ভেতরে ‘সেফ
জোন’ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। এর সঙ্গে
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর জন্য
এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বা এর আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি খুবই জরুরি। চুক্তিতে
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দিকটি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। একই সঙ্গে
রোহিঙ্গারা তাদের নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারবে—এমন নিশ্চয়তাও চুক্তিটি নিশ্চিত
করতে পারছে না। ফলে এই চুক্তি শরণার্থীদের মিয়ানমার ফেরাতে পারবে বলে মনে
হয় না। এখন শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর কাজটি সফল না হলে এই চুক্তি থেকে
বাংলাদেশের প্রাপ্তি দাঁড়াবে শূন্য। আগেই বলেছি, চুক্তির পুরো ফসল
মিয়ানমারের ঘরে গেছে, কারণ এই চুক্তি তাদের অনেক কিছু দিয়েছে। রোহিঙ্গা
ইস্যুতে মিয়ানমারে ওপর আন্তর্জাতিক চাপ যে মাত্রায় বাড়ছিল, বাংলাদেশের
সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পর তা অনেকটাই কমেছে। এই চুক্তি সই করে মিয়ানমার
রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরাতে পেরেছে। আবার ভেতরে
ভেতরে তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে যাতে রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই
মিয়ানমার ফিরে যেত আগ্রহী না হয়।
এতে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার যে
নীতি মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে,
সেটাই কার্যত সফলতার মুখ দেখবে। গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত
বাংলাদেশে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে দশ লাখ ছাড়িয়েছে। এর আগে
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আরও লাখ তিনেক রোহিঙ্গার মিয়ানমারে
ফেরার বিষয়টি এখন কোনো আলোচনার মধ্যেই নেই। বর্তমান চুক্তিতে নতুন আসা
শরণার্থীদেরই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এখন এই চুক্তি কার্যকর করতে
ধারাবাহিকভাবে এ পর্যন্ত যেসব অগ্রগতির কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে
নিশ্চিত করা হচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত কিছু শরণার্থীকে ফেরানো গেলে হয়তো
চুক্তিটির ‘সম্মান’ কিছুটা বাঁচবে। কিন্তু এই চুক্তি ‘প্রতীকী’
প্রত্যাবাসনের বাইরে সাড়ে দশ লাখ শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেবে—এমন আশা করার মতো
কোনো বাস্তব পরিস্থিতি এখনো নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে নিজ উদ্যোগে চুক্তি করার
পর সেই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে কতটুকু ‘চাপ’
বাংলাদেশ আদায় করতে পারবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। রোহিঙ্গারা বর্তমান
পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে চাইবে না এবং এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশকে আরও দীর্ঘ সময় ধরে এই শরণার্থীদের চাপ বয়ে বেড়াতে হবে। বিপদের
খবর হচ্ছে রোহিঙ্গাদের খাবার জোগানে বিশ্ব সম্প্রদায় এরই মধ্যে আগ্রহ
হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে গত
সোমবার রোমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার সময় এমন তথ্যই দিয়েছেন।
শরণার্থী প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করার কারণে বা এর প্রভাবে
এমন হয়েছে কি না, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। একদিকে শরণার্থী প্রত্যাবাসন
অনিশ্চিত, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার ব্যাপারে দাতাদের আগ্রহ কমে
যাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে চুক্তিটি আমাদের কী দিচ্ছে বা দেবে, সেই হিসাব-নিকাশ
এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
akmzakaria@gmail.com
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
akmzakaria@gmail.com
No comments